Sunday, November 17, 2013

শিক্ষা ও নৈতিকতা

আজ হতে দশ বৎসরাধিক কাল আগে, কোন এক ক্লান্ত দুপুরে, চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক মিলনায়তনটি সরগরম হয়ে উঠেছিল দুই দল শিক্ষকের মাঝে দার্শনিক বিতর্কে। এক দলের বক্তব্য ছিল শিশুদের নিজের মত করে বেড়ে ওঠার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা চাই, ‘আমাদের দায়িত্ব হোল একটি শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খাবার, পোশাক, শিক্ষা, নিরাপত্তা, চিকিৎসা ইত্যাদি সুবিধাদি নিশ্চিত করা যেন সে বেঁচেবর্তে চলতে পারে। নৈতিকতা সে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে যেটা ভাল সেটা গ্রহণ করে এবং যেটা মন্দ সেটা বর্জন করে নিজের মাঝে তৈরী করে নেবে’। আরেক দলের কথা ছিল, ‘খাবারদাবাড়, পোশাক আশাক, নিরাপত্তা, চিকিৎসা এ’সবই জরুরী তবে এগুলোতে কমবেশি হলেও একটা শিশু বেঁচেবর্তে যেতে পারে। কিন্তু নৈতিকতা শিক্ষার প্রধানতম উদ্দেশ্য এবং অপরিহার্য অঙ্গ। অবশ্যই একটা শিশু বড় হয়ে বেছে নেবে সে নৈতিকতার কোন স্তরে অবস্থান করবে, কিন্তু কোনটা ভাল বা কোনটা খারাপ তার একটা মানদন্ড তো তাকে দিয়ে দিতে হবে! যেমন সাহিত্য পড়তে গেলে আগে এমন কিছু বই পড়া অপরিহার্য যেগুলোকে আমরা ধরে নিই ক্লাসিক হিসেবে। এমন নয় যে এর সবটাই আমার ভাল লাগবে কিংবা সবগুলো আমার অসাধারন মনে হবে। কিন্তু বইগুলো পড়ে স্বীকৃতভাবে উত্তম সাহিত্যমান সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাবে যা আমাকে পরবর্তীতে উত্তম, মধ্যমে এবং অধম সাহিত্যের মাঝে পার্থক্য করতে সাহায্য করবে। একজন মানুষের রুচিবোধ যে পদ্ধতিতে গড়ে তোলা হয়, নৈতিকতাবোধ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটিও তার চেয়ে খুব একটা আলাদা নয় এবং দু’টোই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বরং একজন স্বল্প রুচিসম্পন্ন মানুষের সাথে চলা যায়, কিন্তু একজন নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষকে আমরা কোন হিংস্র পশুর চেয়ে কম ভয়ংকর মনে করিনা। শিশুদের প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা যেন সে ছোটবেলা থেকেই বুঝতে শেখে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ। ভাল কাজের উপকারীতা সম্পর্কে যেমন তার জানা প্রয়োজন তেমনি খারাপ কাজের মাধ্যমে নিজের, আশেপাশের লোকজনের এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের যে ক্ষতি হয় সে সম্পর্কেও তার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এর ফলে সে আলোকিত মানুষের পর্যায়ে পৌঁছতে পারুক বা না পারুক, অন্তত অপর কোন ব্যাক্তির জন্য অপকারের কারণ হবেনা। কিন্তু যে শিশুটিকে ছোটবেলা থেকেই কেউ জানায়নি ভাল কি বা মন্দ কি সে কিসের ভিত্তিতে ভালকে গ্রহণ বা মন্দকে বর্জন করবে আর কিসের ভিত্তিতেই বা নিজের চরিত্রে নৈতিকতার গোড়াপত্তন করবে?'
[img]http://www.bdtomorrow.com/blog/bloggeruploadedimage/rehnuma/1384676419.png[/img]
সেদিন বুঝিনি, কিন্তু আজ মনে হয় কালক্রমে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ প্রথম দলের অংশ হয়ে গিয়েছে এবং সেটা কেবল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সেই ক্ষুদ্র গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়। আসলে প্রক্রিয়াটা চলে আসছিল অনেকদিন ধরেই, আমাদেরই চোখে পড়েনি। পাড়ার ছেলেরা গাছের ফল চুরি করবে, মুরগী চুরি করে চড়ুইভাতি করবে এটাকে আমাদের উদারপ্রান জনগণ অনাদিকাল থেকে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই নিয়ে এসেছেন। কারো মাথায় আসেনি এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চুরিগুলোকে যখন নৈতিক মনে করা হয় বা ন্যূনপক্ষে অনৈতিক মনে করা হয়না তখন একসময় এই একই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে ক্ষুদ্র ব্যাক্তিটি ভাবতে শেখে – আমার পরীক্ষায় পাশ করা প্রয়োজন, সুতরাং নকল করা আমার নৈতিক অধিকার; আমি তো কাজ করেই দিচ্ছি, সুতরাং ঘুষ নেয়া আমার নৈতিক অধিকার; আমি তো এই মেয়েটিকে সারাজীবন দেখাশোনা করব, সুতরাং যৌতুক নেয়া আমার নৈতিক অধিকার; আমার ছেলেমেয়ের মেধা না থাকতে পারে, কিন্তু টাকার জোরে তাদের জন্য সীট কেনা বাবা হিসেবে আমার নৈতিক দায়িত্ব - এভাবেই জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে নৈতিকতার দৈন্য। অথচ ছোটবেলায় যদি কোন মুরুব্বী তার মনে নৈতিকতার বীজ বুনে দিতেন, ‘বাবা, আমার বাগানের সব ফল তোমার, কিন্তু না বলে যে নিতে হয়না! ক’টা দিন সবুর কর, পাকলে এসে যত খুশি নিয়ে যেও, শুধু বলে নিয়ো’ - তাহলে ছোটবেলা থেকেই সে বুঝতে পারত কিছু পাবার জন্য অনুমতি, অপেক্ষা এবং অধিকারের প্রয়োজন হয় – সেই বয়স থেকেই সততা তার জীবনসঙ্গী হয়ে যেত।
ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের এক প্রতিবেশিনী দিনরাত নামাজ পড়তেন, তাসবীহ পড়তেন; কিন্তু তাঁর ছেলেদের রুমের দেয়ালে নগ্ন মেয়েদের ছবি টাঙ্গানো, দিনরাত গান বাজত, এটা নিয়ে তাঁর তেমন কোন আপত্তি ছিলোনা। প্রতি বেলায় তিনি সন্তানদের হরেক রকম তরকারী, মিষ্টি মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, কিন্তু নামাজ পড়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতেন না। তিনি ফজরের নামাজের জন্য উঠতে হবে বলে তাড়াতাড়ি শুতে চলে যেতেন, তাঁর সন্তানরা অর্ধরাত্রি পর্যন্ত বসে সিনেমা দেখে ফজরের আগে আগে ঘুমাতে যেত সে ব্যাপারে তাঁর কোন বক্তব্য ছিলোনা। এসব ব্যাপারে কেউ কিছু বললে তিনি বলতেন, ‘কম বয়সী ছেলেপুলেরা এসব একটু আধটু করে, ঠিক হয়ে যাবে’। ঠিক হয়নি, তাঁর ছেলেরা বখে গেছিল। যাবারই কথা। যেকোন পরিশুদ্ধির জন্য কিছু পরিকল্পনা, প্রক্রিয়া, প্রস্তুতি এবং প্রয়াসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু তিনি বসে ছিলেন এই ভেবে যে কোন একদিন তাদের মন পরিবর্তন হয়ে যাবে, একদিন তারা ‘ঠিক’ হয়ে যাবে। কিন্তু এই ‘ঠিক’ করার উদ্দেশ্যে তিনি তো কোনদিন তাদের সাথে নিয়ে বসে নৈতিকতার শিক্ষা দেননি, তাদের আচরনে রাগ কিংবা অভিমান করে তাদের নৈতিকতার বন্ধনে জড়াননি, তাদের শাসন করে কারো কাছে জবাবদিহিতার উপলব্ধি সৃষ্টি করেননি – কিভাবে আর কেনই বা ‘ঠিক হয়ে যাবে’ তারা?
আমাদের শিক্ষাব্যাবস্থার মূখ্য উদ্দেশ্য একটি কর্মক্ষম জাতি সৃষ্টি করা যারা লিখতে পড়তে পারবে এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো কিঞ্চিৎ দক্ষতার সাথে সমাধা করতে পারবে। এই শিক্ষানীতির কোথাও তো ‘মানুষ’ তৈরী করাটাকে মূল উদ্দেশ্য এমনকি একটি আংশিক উদ্দেশ্য হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়নি! বরং কালক্রমে আমাদের সিলেবাস থেকে হারিয়ে গিয়েছে ‘সুখী মানুষ’ কিংবা ‘পন্ডিতমশাই’য়ের মত গল্পগুলো যেগুলো আমাদের স্বল্পে সুখী হতে শেখাত, অন্যের কষ্ট উপলব্ধি করতে শেখাত। আমাদের বাবামায়েদের মাথায় ঢুকানো হয়েছে ‘টাকাই সকল সুখের মূল’ এবং ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ীঘোড়া চড়ে সে’। সুতরাং, বাবারা ছুটেছেন টাকার পেছনে আর মায়েরা ছুটেছেন সে টাকা খরচ করার পেছনে; সন্তানদের তুলে দিয়েছেন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কোচিং সেন্টার, নাচ, গান, ছবি আঁকার ঘূর্ণিপাকের চক্রে। পরম বিশ্বাসী এই পিতামাতারা কেউ সময় করে খোঁজ নেননি তাদের সন্তানদের আসলে কি শেখানো হচ্ছে, ওরা আসলে কি পড়ছে, ওদের শিক্ষকরা আসলে কি করছে, ওদের মানসিকতা কিভাবে গড়ে উঠছে। তারা সন্তানদের খাইয়ে পরিয়ে শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে সিরিয়াল দেখে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন এবং তাদের শিক্ষকরা তাদের নীতিনৈতকতা বিবর্জিত নেশাখোর নাস্তিক বানিয়ে বাবামায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সারা জীবন সত্যিকারের অশ্রুপাতের সুযোগ করে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি? উপায় একটাই- সচেতনতা। শিক্ষার উৎস যেগুলো, নৈতিকতার উৎসও সেগুলোই। একই উৎসের উভয় উদ্দেশ্যের মাঝে সমন্বয় সাধন করার মাধ্যমেই আমরা সন্তানদের শিক্ষা এবং নৈতিকতা উভয় গুনে দীক্ষিত করতে পারি। 
শিক্ষার প্রথম উৎস পরিবার। আমাদের সন্তানরা যেভাবে আমাদের দেখে বসতে শেখে, হাঁটতে শেখে, খেতে শেখে, কথা বলতে শেখে; ঠিক একইভাবে আমরা তাদের যতই নীতিবাক্য শোনাই না কেন, ওরা সেটাই অনুসরন করে যা আমরা করি, সেটা নয় যা আমরা বলি। সুতরাং, আমাদের কথাবার্তা এবং আচরনে দ্বিমুখিতা থাকলে আমাদের সন্তানরা আমাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে, নতুবা আমাদের অনুসরন করে নিজেরাও পতিত হবে দ্বিমুখিতার গহন আবর্তে। যে মা নিজে বোরকা পরে মেয়েকে নাচের স্কুলে নিয়ে যান, যে পিতা পঞ্চাশজন শিক্ষক দিয়ে ছেলেকে গান শেখান কিন্তু কোনদিন নামাজ শেখাননি, যে মা পর্দার লংঘন হবে বলে মেয়েকে পড়াশোনা করতে দিতে চাননা অথচ মহিলা ডাক্তার ছাড়া চিকিৎসা করাতে নারাজ- তাঁদের সন্তানরা নৈতিকতার সংজ্ঞা নিয়ে বিড়ম্বিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক! সন্তানের আগমনের আগেই বাবামাকে প্রস্তুতি নিতে হবে জানার, লব্ধ জ্ঞানকে উপলব্ধি করার এবং নিজেদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যেন তারা সন্তানদের জন্য আদর্শ হতে পারেন, যেন তাদের সন্তানরা তাদের দেখে নৈতিকতা নিয়ে দ্বৈততায় না ভোগে। যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ছাড়া অবতীর্ণ হওয়া আর অস্ত্রচালনার দক্ষতা ছাড়া অবতীর্ণ হওয়া একই কথা। তাই সন্তানদের আগমনের আগেই তাদের গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রস্তুত থাকতে হবে যেন আমরা তাদের নিয়ে পরীক্ষানীরিক্ষা না চালিয়ে তাদের জীবনের প্রথম মূহূর্ত হতেই তাদের উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলায় সহযোগিতা করতে পারি।
নৈতিকতার দ্বিতীয় উৎস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একসময় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা শিক্ষক হতেন। দুর্ভাগ্যবশত কালের পরিক্রমায় আমরা আজ এমন এক সংকটময় স্থানে এসে পৌঁছেছি যখন দুই মহান পেশা, শিক্ষকতা এবং ডাক্তারী, রোগে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। ইদানিং প্রথমটিতে অধিকাংশ তারাই যান যাদের যাবার আর কোন জায়গা নেই, অপরটিতে তারা যাদের জীবনের মূল লক্ষ্য অর্থ উপার্জন। যে ব্যাক্তি প্রকৃতপক্ষে শিক্ষানুরাগী নন, যিনি জীবিকা উপার্জনের জন্য শিক্ষা দান করেন, তার প্রদত্ত শিক্ষার মান এবং আন্তরিকতা সম্পর্কে আশঙ্কা অমূলক নয়। ইদানিংকালে আমাদের কিছু কিছু শিক্ষকের যে কীর্তিকলাপ উন্মোচিত হচ্ছে তা দিনের আলোকে অন্ধকারে রূপান্তরিত করার জন্য যথেষ্ট। তবু কি আমরা তাদের হাতে আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকব? বাবামা হিসেবে আমাদের কি দায়িত্বের মধ্যে পড়েনা যে আমরা লক্ষ্য রাখব আমাদের সন্তান কি শিখছে, ভুল শিখলে তাকে সঠিক তথ্য প্রদান করব এবং শিক্ষকের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখব যেন তিনি আমার সন্তানকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার স্বাধীনতা না পান? বাবামাকে বুঝতে হবে, আমার সন্তানের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য একজন দক্ষ কর্মী হওয়া নয়, অর্থ উপার্জন নয়, বিখ্যাত হওয়া নয়, বরং একজন ভাল মানুষ হওয়াই তার জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
নৈতিকতার তৃতীয় ধাপ জীবনে পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া। স্বার্থের দ্বন্দ্ব না এলে মানুষ চেনা যায়না- সে হোক নিজেকে বা অপরকে। স্বার্থের ব্যাপার এলেই কেবল আমরা নিজেকে যাচাই করতে পারি যে আমি আমার অধিকার সম্পর্কে যতটুকু সচেতন অপরের অধিকার সম্পর্কে ততটা সচেতন কিনা; আমি আমার অধিকার সম্পর্কে যতটুকু সচেতন আমার দায়িত্ব সম্পর্কে ততটুকু সচেতন কিনা। এই সময়গুলোতে নিজেকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা বস্তুত কঠিন বা ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব ব্যাপার। বাবামায়ের উচিত সন্তানকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার বেষ্টনে আবৃত করে না রেখে মাঝে মাঝে জীবনের প্রখর বাস্তবতার স্বাদ গ্রহন করতে দিয়ে বা ন্যূনপক্ষে নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলো আলোচনা করে তাকে বাস্তবতার সম্মুখীন হবার মত মানসিক শক্তি, সংযম এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার যোগ্যতা দিয়ে গড়ে তোলা।
তবে সবচেয়ে বড় কথা নৈতিকতার একটি ধ্রুব মানদন্ড আমাদের নির্ধারন করে দেয়া জরুরী যা সর্বাবস্থায় আমার সন্তানকে পথ দেখাবে এবং যা সে সর্বদা হাতের কাছে পাবে। আমরা মারা যেতে পারি, আমাদের ভুল হতে পারে, আমরা স্বার্থান্ধ হয়ে পড়তে পারি; কিন্তু আমাদের অনুপস্থিতি কিংবা ভুল যেন আমাদের সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার কারণ না হয় সেটা নিশ্চিত করা আমাদের সন্তানদের নৈতিক অধিকার। সেক্ষেত্রে যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার চেয়ে ভাল মানদন্ড আর কে দিতে পারেন? তাঁর কথায়ঃ ‘আমি পৃথিবীস্থ সবকিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা করেছি, যাতে মানুষকে পরীক্ষা করতে পারি তাদের মধ্যে কে ভাল কাজ করে’ (সূরা কাহফঃ আয়াত ৭)। যখন এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে পৃথিবীস্থ সবকিছু মূলত প্রলোভন এবং পরীক্ষার আধার, তখন এর অসারতা এবং জীবনের মূল লক্ষ্য আমাদের কাছে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। তখন নৈতিকতার পথটি অনেক সোজা সরল প্রতীয়মান হয় এবং সঠিক কাজটি করা, সত্য কথাটি বলা কিংবা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সঠিক সিদ্ধান্তটি নেয়া আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। তবে কেন আমরা আমাদের সন্তানদের অন্ধকারে হাতড়ে মরার জন্য ছেড়ে দেব? যেখানে তাদের গায়ে একটি আঁচড় লাগলেও আমরা সহ্য করতে পারিনা, সেখানে তাদের ভুলের সাগরে ডুবে অভিজ্ঞতার মুক্তো সংগ্রহ করে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাবার পর মূল্যবান মূহূর্তগুলি নষ্ট করা নিয়ে হাহাকার করতে দেখে কি আসলে আমরা আনন্দ পাব? এমনও তো হতে পারে যে সে পথ খুঁজেই পেলোনা কিংবা কষ্ট করে পথ খুঁজেই দেখলনা! আমাদের সন্তানদের এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ করার আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কি?

বিদেশে বাংলাদেশী ঈদ



ঈদের আগে তিনদিনের লং উইকএন্ড পড়লেও ঈদের দিনটা পড়ল ঠিক লং উইকএন্ডের পরদিন। অফিসে যখন ঈদের ছুটি নিতে গেলাম, বান্ধবী কাম টিম লিড জেইন বলল, 'তিনদিন ছুটির পর আবার ছুটি নিতে চাও? তুমি একদিন কাজ না করলে একদিনের বেতন পাবেনা তা জানো তো?' আমি বললাম, 'তাতে কি? ঈদের নামাজ পড়া, বাচ্চাদের সময় দেয়া, বন্ধুদের অপ্যায়ন করা একদিনের বেতনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ'।  নিয়ে নিলাম ছুটি। কিন্তু বন্ধুদের অনেকেই ছুটি পেলেন না।
দুর্ভাগ্য, অসুস্থতাবশত লং উইকএন্ড শুরু হবার আগের দিন বিকেল থেকে পুরো চার দিনই ছিলাম শয্যাশায়ী। ঈদের আগের দিন অল্প সময়ের জন্য উঠে দাঁড়ালাম, টলতে টলতে গেলাম গ্যারেজে, অল্প কিছু রান্না করে রাখলাম পরের দিনের জন্য আর হাফিজ সাহেবের চমচম বানানো পর্যবেক্ষণ করলাম। এখানে রান্নাঘরের চুলাগুলো মূলত ইলেকট্রিক হিটার। বেশি পরিমাণে রান্না সহজে এবং স্বল্প সময়ে করার জন্য গ্যারেজে দু'টি গ্যাসের চুলা এবং কিছু বৃহদাকার হাঁড়ি রয়েছে।  ঈদের দিন বাসায় দু'টো গরু কাটা হবে, চৌদ্দ পরিবারের ভাগ। এতগুলো মানুষ কাজ করবে, তাঁদের খাওয়ানোর তাগিদেই শয্যাত্যাগ করা। এখানে সাধারনত সবাই দেশেই কোরবানী দেন। আমরা কিছু লোকজন বেশ ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হলেও এখানে অন্তত একটি ভাগ কোরবানী দেই যেন আমাদের সন্তানরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং এই কাজগুলো করতে অভ্যস্ত হয়।

ঈদের দিন নামাজে যাবার প্রচন্ড ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দেখলাম দর্বলতাহেতু চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা। অবস্থা দেখে হাফিজ সাহেব বললেন, 'তুমি তো কখনো ঈদের নামাজ মিস করনা, কিন্তু এবার মনে হয় তোমার বাসায় থাকা উচিত'। ওঁরা ঈদের জামাত থেকে সরাসরি ফার্মে চলে যাবেন, এই অবস্থায় আমার পক্ষে এতক্ষণ বসে থাকা সম্ভব নয়, তাই ওনার কাছে হার মানলাম। উনিও সদাপ্রতিবাদী স্ত্রী কিভাবে এত বাধ্য, অনুগত হয়ে গেল ভেবে আনন্দসহকারে ঈদের নামাজে যাত্রা করলেন। বাচ্চারা স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে যায়নি। কিন্তু ওদের সবকিছু কেন যেন আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। আমি যেতে না পারায় ওরাও গেলনা। আমরা তিনজন নিরানন্দ দূর করতে আরো এক চোট ঘুম দিলাম।
এগারোটায় উঠে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। ফার্মে গরু জবাই করে, বড় বড় টুকরো করে নিয়ে এসে, গ্যারেজে রান্নার উপযুক্ত সাইজ করে কেটে, অতঃপর ভাগ করা হবে। এই উপলক্ষ্যে ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় দু'জন ভাই এসে একটি কাঠের টেবিল বানিয়েছেন যেন সবাই মিলে একসাথে মাংস কাটতে পারেন। প্রথম গরু এলো দুপুর একটায়। প্রথম দল প্রথম গরু নিয়ে কাটতে বসে গেলেন। পৌনে এক ঘন্টা পর দ্বিতীয় দল এসে উপস্থিত। এবার শুরু হোল পুরোদমে গরু কাটা, বাচ্চাদের ছুটোছুটি, 'এটা দাও, ওটা দাও' শোরগোল। কিছুক্ষণ পর হাফিজ সাহেব এক বালতি মাংস এনে বললেন ভাইরা ফ্রেশ মাংস খেতে চেয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে আমরা ক'টি পরিবার মিলে ফার্ম থেকে একটি গরু জবাই করে এনে আমাদের বাসায় কেটে ভাগ করে নেই। তখন এক ঘন্টার ভেতর তাঁদের ফ্রেশ মাংস রান্না করে খাইয়েছিলাম, সবাই খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন এবং বাসায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ভাল গৃহিনী নই, কিন্তু হাফিজ সাহেব একজন উত্তম সহকারী, তাই সম্ভব হয়েছিল। এবার শরীর অসুস্থ বলে আগে রান্না করে রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হোলনা। গ্যারেজে মাংস কাটা হচ্ছে, তাই গ্যাসের চুলা বাসায় এনে হাফিজ সাহেব আর আমি মিলে দেড় ঘন্টায় দশ কেজি মাংস, বিরাট এক হাঁড়ি সাদাভাত আর বড় পাতিলে ডাল রান্না করলাম। রাদিয়া সালাদ বানালো। এই দিয়ে বিশ পঁচিশজন ক্ষুধার্ত মানুষ খেয়ে ওঠার পর দেখা গেল সামান্য ডাল ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবু কম পড়েনি এতেই রক্ষা। ভাইদের মধ্যে যারা কাজের কারণে আসতে পারেননি তাঁদের কারো কারো স্ত্রী এলেন। সন্ধ্যা সাতটায় তাঁরা মাংস ভাগ করে, সমস্ত দা ছুরি ধুয়েমুছে, টেবিল সাবান দিয়ে ধুয়ে, গ্যারেজ ধুয়ে, ময়লা গার্বেজে ফেলে অদ্ভুত সুন্দরভাবে পরিষ্কার করে রেখে গেলেন।
বাচ্চারা বিকালে চলে গিয়েছিল ফারজানা আপার বাসায়- ওনার মেয়ে সারিকা রাদিয়ার বান্ধবী, আর ছেলে সামীর রিহামের বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা সবাইকে বিদায় দিয়ে, মাংস গুছিয়ে, পরিচ্ছন্ন হয়ে ফারজানা আপার বাসায় গেলাম। গত কয়েকমাস আপার বাবামা ক্যাল্গেরীতে ছিলেন, আমাদের সব প্রোগ্রামে এসেছেন, তাঁদের নিয়ে আমরা এডমন্টন গেছি, পিকনিক করেছি, বাসায় দাওয়াত করেছি, সারারাত জেগে বসে গল্প করেছি, তারাবীর নামাজ পড়েছি- ওরা চলে যাবেন তিনদিন পর। সব বন্ধুদেরই খুব মন খারাপ, সবাই দেখা করতে গিয়েছেন- ব্যাস্ততার কারণে আমরা গেলাম সবার শেষে। খালাম্মা খালুর সাথে গল্প করলাম, ফারজানা আপার নানান রান্না খেলাম। বাচ্চারা কিছুতেই বাসায় যাবেনা, ফারজানা আপাও বললেন, 'ওরা থাকুক আরো কিছুক্ষন, বাচ্চারাও মজা পাচ্ছে, ঈদের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে'। তখন ওদের রেখেই আমরা ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় মাংস দিতে গেলাম, বেচারা বিশিষ্ট কর্মঠ ব্যাক্তি, কিন্তু সেদিন ছুটি না পাওয়ায় কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। তারপর একছুটে দু'তিনটা বাসা ঘুরে এলাম যেগুলো না গেলেই নয়। এর মধ্যে নাহিদ আপার বাসায় আমার এক ছাত্রীর সাথে দেখা, গত ঈদে ওদের বাসায় যাব যাব করে যাওয়া হয়নি। ওর মা বৃহস্পতিবার দাওয়াত দিলেন। প্রচন্ড ক্লান্ত বোধ করছিলাম। পরদিন আবার কাজে যেতে হবে। তাই বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে এলাম।
দিনের শুরুটা তাড়াতাড়ি করতে পছন্দ করি। ইদানিং শীত এগিয়ে আসায় সূর্য ওঠে আমি অফিসে যাবার দু'ঘন্টা পর। ক'দিন পর ফজর নামাজ পড়া শুরু করতে হবে অফিসে। তবু সকালটা আমার খুব প্রিয় সময়- কাজের দিন কাজ করার জন্য আর ছুটির দিন ঘুমোনোর জন্য। বাকি সপ্তাহটা গেল এই ধরাবাঁধা রুটিনে। তবে সব সপ্তাহ যদি এমন তিনটি কর্মদিবস সম্বলিত হত তাহলে কি মজাই না হত!
বৃহস্পতিবার কাজ থেকে ফিরে গেলাম আমার প্রিয় ছাত্রী ফারিয়ার বাসায়। ওখানে আমাদের সমবয়স্কা এক ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ প্রসঙ্গে আরেকজন বয়োঃজ্যেষ্ঠা মেহমান নামাজের গুরুত্বের কথা স্মরন করিয়ে দিলেন। তো ভদ্রমহিলা দেখি রেগে আগুন, যাবার সময় ভুল ইংরেজীতে তাঁকে কিছু শুনিয়ে দিয়ে গেলেন। রাগ করার হেতু বুঝতে পারলাম, অনেকেই ভাল কথা শুনতে পছন্দ করেন না এবং নিজের দুর্বলতা স্বীকার করার পরিবর্তে নিজের ইচ্ছাপ্রসূত কাজটিকেই সঠিক প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর থাকেন, কিন্তু রাগ হলে মাতৃভাষা পরিত্যাগ করতে হবে কেন সেটা বোধগম্য হোলনা। পরে বয়োঃজ্যেষ্ঠা বোনটির সাথে আলাপ প্রসঙ্গে জানতে পারলাম তিনি এবং তাঁর স্বামী মূলত ধর্ম সম্পর্কে তেমন জানতেন না বা এখনো শিখছেন, শিখছেন তাঁদের ছেলেমেয়েদের কাছে। ক্যানাডায় ব্যাক্তিস্বাধীনতার এই বিশেষ উপকারী দিকটি আমার খুব ভাল লাগছে। ইদানিং প্রচুর ছেলেমেয়ে দেখছি যাদের বাবামায়েরা ইসলাম সম্পর্কে নিজেরাই জানেন না, সন্তানদের শেখাবেন কি? কিন্তু ছেলেমেয়েরা নিজেরা লেখাপড়া করে পুরোদমে ইসলাম পালন করছে, বাবামা সাথে থাকলে ভাল, না থাকলেও তাঁদের সন্তানদের বাঁধা দেয়ার অধিকার নেই। অনেক বাবামাই অবশ্য বোঝেন না তাঁরা এমন সন্তান পেয়ে কতটা ভাগ্যবান।
গত বছর পর্যন্ত আমরা ঈদে বান্ধবীরা সবাই মিলে ঘুরতে বেরোতাম। দেখা যেত কোন বাসায় আরাম করে বসা বা খাওয়া যেতনা, কোন কোন বাসায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যেতনা, অধিকাংশ সময় কাটত পথে পথে। দিন শেষে প্রচন্ড ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফেরা। তাই এ'বছর থেকে ঠিক হোল আমরা সবাই এক বাসায় মিলিত হব, রান্না সবাই এক আইটেম করে করবে। কারো চাপ পড়বেনা, সবাই আরাম করে খাওয়া এবং কথা বলা যাবে। ঈদুল ফিতরের অনুষ্ঠান আমার বাসায় হয়। বান্ধবী তানজিন বলল, 'তোমার ওপর অতিরিক্ত চাপ হয়ে যাচ্ছে, এবারের অনুষ্ঠান তাহলে আমার বাসায় করা হোক'। কিন্তু হিসেব করে দেখা গেল মেহমানের সংখ্যা আনুমানিক দেড়শ, তানজিনের বাসা বড় হলেও নীচতলা ভাড়া দেয়া, স্থান সংকুলান করা মুস্কিল হয়ে যাবে, তাই অনুষ্ঠান আবার ঘুরেফিরে আমাদের বাসায় চলে এলো। ক'দিন আগে এডমন্টনে নাজমা আপাদের সাথে সুন্দর সময় কাটিয়ে এসেছি। তাঁদেরসহ এডমন্টনের তিনটি পরিবারকেও দাওয়াত করা হোল। ঈদ যেহেতু মঙ্গলবার, অনেকের অফিস, অনেকের পরদিন কাজ, তাই ঈদ পুনর্মিলনীর ব্যাবস্থা হোল শনিবার। এতে এডন্টনবাসীদেরও আসতে সুবিধা হবে। কিন্তু শনিবার নাজমা আপার ছেলে জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এডন্টনবাসীদের আসা ক্যান্সেল হয়ে গেল। হতাশ হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে হোল।
পুরো সপ্তাহ কাজ শেষে সপ্তাহান্তে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শুক্রবার পর্যন্ত কাজ করে শনিবারের ভেতর বাসার সব কাজ সামাল দেয়া মুস্কিল। তদুপরি আমি অসুস্থতা থেকে সেরে উঠতে না উঠতেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ায় দুর্বলতার কারণে অল্প কাজ করি আর তারপর অনেকক্ষণ বসে হাঁপাই। তাই সবাই হাত লাগালেন। রাদিয়া পুরো ঘরের কার্পেট ভ্যাকুয়াম করল তিনদিন ধরে। আমি সব রুম গুছালাম, বাথরুম পরিষ্কার করলাম।  হাফিজ সাহেব রান্নাঘরের জিনিসপত্র ধোয়াপালা করে দিলেন যেন আমি রান্নাঘর গুছিয়ে ফেলতে পারি। কিন্তু প্রথম থেকেই নিউ ইয়র্ক যাত্রা, তারপর অসুস্থতা সব মিলে বেশ কিছু কাজ বাকি পড়ে গিয়েছিল যেগুলো গুছিয়ে উঠতে পারার কোন সম্ভাবনা দেখ যাচ্ছিল না। সকাল এগারোটার দিকে মোহাম্মদ ফোন করে বলল, 'আপু, তোমার তো বাসায় বিরাট আয়োজন। কোন হেল্প লাগবে?' আমি বললাম, 'লাগবে মানে?! চলে আয়, আমার সামনের আর পেছনের উঠোন পাতা পড়ে ভর্তি হয়ে রয়েছে, এগুলো তুলে দিলে ভীষণ উপকার হবে'। আমাদের বাসাটার সামনে পেছনে প্রচুর গাছ দিয়ে ঘেরা। পুরো গরমকাল আমরা এগুলোর ছায়া, বিভিন্ন রঙের ফুল পাতার মায়া, পাতার ফাঁকে বয়ে যাওয়া ঝিরঝির বাতাস, গাছে গাছে পাখীদের কলকাকলী আর কাঠবেড়ালীদের খেলা উপভোগ করেছি। কিন্তু এখন শীতের আগমনী বার্তায় তাদের পাতা ঝরা দেখে কেবল এই আয়াতটিই মনে পড়ে যায়ঃ 'তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর সে পানি যমীনের ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেছেন, এরপর তদ্দ্বারা বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন, অতঃপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তোমরা তা পীতবর্ণ দেখতে পাও। এরপর আল্লাহ তাকে খড়-কুটায় পরিণত করে দেন। নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশ রয়েছে' (সুরা যুমারঃ আয়াত ২১)।
মোহাম্মদ আসার সময় ওর শ্বশুর আর বৌকেও নিয়ে এলো। ওরা শ্বশুরজামাই মিলে পাতা পরিষ্কার করল। রাদিয়া আর ওর মামী মিলে শেলফে বই গুছিয়ে রাখল, নামাজের জায়গা পরিষ্কার করল, সব বিছানায় চাদর পরিবর্তন করল। ওদের দুপুরের খাওয়া শেষ হতে না হতেই মোনালিসা আপা এলেন। উনি রাদিয়া আর ওর মামীকে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে 'ঈদ মুবারাক' পোস্টার বানাবে, বেলুন দিয়ে ঘর সাজাবে, তারপর এসে আমাকে কাপড় ভাঁজ করতে সাহায্য করলেন। বেশ কিছু দিন অসুস্থ থাকায় মেশিনে কাপড় ধোয়া হলেও ভাঁজ করা হয়ে ওঠেনি, তাই স্তুপ জমে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর সবাই বাসায় চলে গেল জামাকাপড় বদলে সেজেগুজে আসতে। ততক্ষণে আবার আসমা আপা আর তানজিন এসে হাজির। আসমা আপা বললেন, 'আপনার রান্নাঘরের দায়িত্ব সম্পূর্ন আমার, আপনি রেডি হতে যান'। কিন্তু সবার ঘর গুছিয়ে বাকি ছিল কেবল আমার রুম। একজন অসুস্থ বোন আসার কথা, তাঁর জন্য ঘরটা গুছিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল যেন তিনি খারাপ লাগলে শুতে পারেন। তানজিন যেমন কথাবার্তায় ধীরস্থির তেমনি কাজ করে বিদ্যুতগতিতে। দুই মিনিটের ভেতর আমার ঘর গুছানো শেষ।
আমার ব্যাপারে তানজিনের বহুদিনের নালিশ আমি নাকি যত বড় অনুষ্ঠান হয় তত সাধারন জামাকাপড় পরি, আমার মেয়েও আন্টির সাথে সুর মেলায়। গত ঈদে তানজিন ওর জমকালো এক শাড়ি নিয়ে এসেছিল আমাকে পরাবে বলে। বিয়ের দিন শাড়ি পরিনি আর আমি পরব শাড়ি! কিন্তু বারোজন বান্ধবী মিলে চেপে ধরে সেই শাড়ি পরিয়েই ছাড়ল আমাকে। তারপর আবার ছবি তুলে রাখল যেন ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেখাতে পারে আন্টি জীবনে একদিন শাড়ি পরেছিল। এবার তাই নিউ ইয়র্কে খালা শাশুড়ির দেয়া সালোয়ার কামিজ আগেই বের করে রেখেছিলাম। রাদিয়া আবার আন্টিকে দেখিয়ে নিশ্চিত করল যে এটা পরলে আন্টির কোন আপত্তি নেই।
কিছুক্ষণ পর মেহমান আসতে শুরু করল। এর ফাঁকে জেসমিন আপা আর স্বপ্না আপাকে পাঠানো হোল ফারজানা আপাকে নিয়ে আসতে- ওনার বাবামা সেদিনই বাংলাদেশ রওয়ানা করেছেন, বাসায় একা থাকলে মন খারাপ হবে, আমাদের সাথে থাকলে অন্তত কিছু সময় তিনি কষ্ট ভুলে থাকতে পারবেন। মোনালিসা আপা বাচ্চাদের অনুষ্ঠান শুরু করলেন। বাচ্চারা আবৃত্তি করল, গান গাইল। এর মধ্যে আসমা আপা কয়েকজন বোনকে নিয়ে খাবার বাড়তে শুরু করলেন। ভাইরা নীচের তলায় নামাজ পড়ছিলেন, তারপর খেতে বসবেন, তাই ওদের টেবিল আগে বাড়া হোল। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই মোনালিসা আপা বললেন, 'আপনি ঈদুল আজহার ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলেন'। বান্ধবীদের কল্পনায় সম্ভবত আমি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ছোটবোন। তাৎক্ষনিক কি যে বলেছি জানিনা। পরে মোনাজাত করলেন আসমা আপা। এরপর এক টেবিলে মায়েরা বাচ্চাদের খাওয়াতে শুরু করলেন, বাবারা আলাদা টেবিল থেকে খাবার নিতে লাগলেন- ফলে দেড়শ মানুষ হলেও কোনদিকে কোনপ্রকার ঝামেলা অনুভূত হোলনা।
 
সবার খাওয়াদাওয়া শেষ, মেহমানরা অধিকাংশ চলে গিয়েছেন, যাবার সময় অধিকাংশ মেহমানকে বক্সে করে খাবার দেয়া হয়েছে যার দায়িত্ব ছিল তানিয়া আপা, জেসমিন আপা আর তানজিনের। তারপর শুরু হোল আসল মজা। ভাইদের ওপরতলায় আসা নিষেধ, আছি কেবল বান্ধবীরা, সুতরাং শুরু হোল বাঁধভাঙ্গা দুষ্টুমী। তানজিনের সংকল্প হোল, 'আমি রেহনুমার জন্য কিছু বাকি রাখতে চাইনা'। সে বেচারী এসে পোলাও আর সাদাভাত রান্না করেছে, এবার লেগে গেল ধোয়াপালায়। ওর দেখাদেখি যোগ দিলেন নাহিদ আপা। অন্যরা সবাই হাততালি দিচ্ছেন, 'দেখি কে বেশি উপযুক্ত বুয়া!' জেসমিন আপা বিশিষ্ট ফাঁকিবাজ, ওর গলাটাই শোনা যাচ্ছে বেশি। এই নিয়ে আবার আমরা হাসাহাসি করছি। দুই এক্সপার্ট মিলে অল্প সময়ে সব কাজ শেষ। এবার গল্পের আসর বসল ডাইনিং রুমে। ওখানে আরেক চোট হাসাহাসি, দুষ্টুমী, ফাঁকে ফাঁকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়েও আলাপ হোল। আসর ভাঙ্গল রাত সাড়ে বারোটায়।
খেলতে, আনন্দ করতে ক্লান্ত বাচ্চারা যেন বিছানায় আছড়ে পড়ল। ওদের আর কোন সাড়াশব্দ নেই। হাফিজ সাহেবও বেহুঁশ। এই সুযোগে ধীরে সুস্থে ঘর পরিষ্কার করে রাত তিনটায় এসে নামাজ পড়লাম, সাড়ে ছ'টায় ফজরের নামাজের অ্যালার্ম দিলাম এবং এত অসুস্থতা সত্ত্বেও এমন সুন্দর একটি ঈদ উপহার দেয়ার জন্য আমার প্রভুর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঈর্ষা

সা'দ চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখতে পেল মায়া ড্রয়িংরুমের জানালার সামনে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে- রাতের অন্ধকারের পটভূমিতে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পরীর মত লাগছে ওকে। সোফায় বসে পা দু'টো একটা মোড়ার ওপর তুলে দেয়া, দু'বাহু পরস্পরকে জড়িয়ে মুকুটের মত ধারণ করে আছে ওর প্রিয় মুখটা, পাশে টেবিলের ওপর একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। বৌটাকে এভাবে একা বসে থাকতে দেখে দুনিয়াদারী কাজকর্ম সব ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে সা'দের। একটা মাত্র বৌ, তাও নতুন- কত, সবেমাত্র পনেরো বছর হোল, ওর তো ইচ্ছে মায়ার সাথে অনন্তকাল কাটানোর- কিন্তু একসাথে থাকা হচ্ছে কই? কাজ থেকে অবসরই যে মিলেনা!
সা'দের শব্দ পেয়ে হাসিমুখে উঠে আসে মায়া, 'আসসালামু আলাইকুম!'
এ কি? ওর মুখে হাসি কিন্তু চোখের কোণে চিক চিক করছে দু'ফোঁটা অশ্রু। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে সা'দের। সে অস্থির হয়ে ওঠে, 'মায়া, আমি কি তোমাকে কোনভাবে কষ্ট দিয়েছি?'
'সে কি? হঠাৎ এ'কথা কেন?', অবাক হয় মায়া। 
'তোমাকে কেউ কিছু বলেছে?'
'কে আবার আমাকে কি বলবে?'
'কোথাও কোন দুঃসংবাদ পেয়েছ?'
'তুমি হঠাৎ এমন জেরা করা শুরু করলে কেন? কোন সমস্যা?', কিছুই বুঝতে পারেনা মায়া।
'তোমার চোখে জল কেন?'
'কি!', আশ্চর্য হয় মায়া, আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণ পরখ করে লজ্জা পেয়ে যায়, 'ও কিছু না, তুমি খেতে এসো'।
সা'দের মনের ভেতর খচখচ করে। খেতে বসে বার বার মায়াকে বলে, 'অ্যাই কি হয়েছে বলনা! তুমি কাঁদছিলে কেন?'
মায়াও ভীষণ লজ্জা পেয়ে বার বার বলে, 'আমি কাঁদছিলাম না'।
সা'দ জানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে মায়ার ভীষণ আপত্তি। সে সবসময় পরিবারের সবাইকে ছায়া দিয়ে, মায়া দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়, কিন্তু নিজের সমস্যাগুলো কারো সামনে তুলে ধরতে চায়না, ওর সামনেও না। তাই তো এতবার করে জিজ্ঞেস করা।
খাওয়ার পর দু'জনে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসে গল্প করার জন্য। এই সময়টুকু একান্তই ওদের নিজেদের। কোনদিন বাসায় মেহমান থাকলে কিংবা দাওয়াতে গেলে এই সময়টা মার যায়- খুব আফসোস হয় সা'দের। কিছুক্ষণ গল্প করল ওরা- সারাদিন কে কি করেছে, বাবামা কেমন আছেন, বাচ্চারা কি কি দুষ্টুমী করল, সা'দের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওরা কিভাবে ঘুমিয়ে পড়ল ইত্যাদি। এত কথার ভিড়েও প্রশ্নটা আবার সা'দের মাথায় চেপে বসল, মায়ার চোখে জল কেন? ওকে সা'দ কখনো সাধারন মেয়েদের মত কাঁদতে দেখেনি, বরং সা'দ ভেঙ্গে পড়লে মায়াই সাহস আর সংকল্প দিয়ে ওকে টেনে তুলেছে বার বার। সে যে কাঁদতে পারে তাই তো সা'দ জানতোনা!
'মায়া!'
'হুঁ!'
'তোমার চোখে পানি দেখলাম, ভাল লাগছেনা। বলবেনা  কি হয়েছে?
'আমি তো প্রায়ই চোখের পানি ফেলি, তুমিই দেখতে পাওনা। আজ একদিন দেখে ফেলেই অস্থির হয়ে গেলে?' দুষ্টুমী করে মায়া।
সা'দের চোখে আতঙ্ক দেখে দুষ্টুমী উড়ে পালায় মায়ার। নাহ, এ'লোক দুষ্টুমীও বোঝেনা!
'আচ্ছা, বলছি। হাসবেনা কিন্তু'।
সামনের দিকে ঝুঁকে আগ্রহ প্রকাশ করে সা'দ।
'মুস'আব (রা)র জীবনী পড়ছিলাম। কেন যেন চোখে পানি চলে এলো'।
হাসি পায়না সা'দের, একটা সুক্ষ্ণ ঈর্ষাবোধ খোঁচা দেয় মনের ভেতর, 'ও! সেই হ্যান্ডসাম সাহাবী?'
মায়া আবেগের সাথে কথা বলতে থাকে যেন শুনতে পায়নি, 'তিনি সেই সাহাবী যিনি ইসলামের জন্য সকলপ্রকার প্রাচুর্য আরাম আয়েশ ত্যাগ করেন, মদীনায় রাসূল (সা)এর আগমনের পটভূমি রচনা করার দায়িত্ব পান, যিনি রাসূল (সা) কে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছান, যার জীবনের শেষমূহূর্তে বলা কথাগুলো আল্লাহ কুর'আনের অন্তর্ভুক্ত করে দেন, যার মৃত্যু রাসূল (সা)কে কাঁদায়।'
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া, 'আমার ভীষণ ঈর্ষা হচ্ছে ওনার জীবনী পড়ার পর থেকে'।
এবার সা'দের অবাক হবার পালা, 'কেন? শ্রদ্ধা বোধ হতে পারে, মায়া লাগতে পারে, কিন্তু ঈর্ষা কেন বুঝলাম না'।
'আচ্ছা শোন। এটা একটা কথা হোল, আল্লাহ একটা মানুষকে একই সাথে জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা, ব্যাবহার, সৌন্দর্য, প্রাচুর্য সবকিছু দিয়ে দিলেন; আর উনিও সুন্দর সবকিছু তাঁর রাব্বের জন্য উৎসর্গ করে দিলেন! এই কম্পিটিশনে আমাদের টেকার কোন সম্ভাবনা আছে?'
সা'দ ভেবে দেখল, 'হুমম। প্রথমত এই জিনিসগুলোর মধ্যে সবগুলো আমাদের নেই বা ঐ পরিমাণে নেই। দ্বিতীয়ত, যতটুকু আছে তার সবটুকুই আমরা খরচ করছি পৃথিবীর আরাম আয়েশের জন্য। এভাবে ভেবে দেখা হয়নি'।
'তারপর দেখ, তিনি একটি নতুন জায়গায় অপরিচিত লোকজনের মাঝে ইসলাম প্রচার করার কাজ নিয়ে চলে যান এবং অল্প সময়ে পরিস্থিতি অনুকুলে নিয়ে আসেন। আমরা কি এমনকি আমাদের সন্তানদের ইসলামে প্রবেশ করার পেছনে এত সাধনা করি?'
'তাই তো? সন্তানদের খাওয়াপরা, পড়াশোনা, ভবিষ্যত চিন্তা নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই কিন্তু তাদের আখিরাত নিয়ে তো আমাদের ভাবার সময় হয়না!'
'তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে পলায়নপর যোদ্ধাদের বার বার আহ্বান করছিলেন, 'আর মুহাম্মদ একজন রাসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়েছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদাপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদাপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করবেন'। ভাব তো, বিশৃংখল পরিবেশ, কেউ কেউ ধারণা করছে রাসূল (সা) হয়ত আর নেই তাহলে যুদ্ধ করে কি হবে, সব এলোমেলো, এর ভেতর একজন দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে আমরা আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করি, রাসূল (সা) থাকুন বা না থাকুন ইসলামকে টিকিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব! আর তারপর তিনি রাসূল (সা)কে রক্ষা করতে করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর কথাগুলো তাঁর মহান বানীর অংশ হিসেবে গ্রহন করে নিলেন। এর সাথে তুলনা করলে আমরা কোথায় স্থান পাই বল তো?'
'আসলেই তো! আমরা তো নিজেদের কোনকিছুতে এক চুলও ছাড় দিতে রাজী না আল্লাহর দ্বীনের জন্য। আগে আমাদের প্রয়োজন, আরাম আয়েশ ঠিক থাকা চাই, তারপর সুযোগ থাকলে দ্বীনের কাজ। মনে হয় যেন আমাদের জন্য দুনিয়াটা ফরজ আর আল্লাহর সন্তুষ্টি হোল একটা শৌখিন ব্যাপার, সময় থাকলে করা যাবে।'
'হুমম, তাই ঈর্ষায় চোখে পানি চলে এসেছিল। তুমি তো জানো আমি ভীষণ কম্পিটিটিভ, হারতে পছন্দ করিনা মোটেই, তোমার কাছে ছাড়া। কিন্তু কিয়ামতের মাঠে এঁদের ডিঙ্গিয়ে যাবার উপায় তো নেইই, বরং এঁরা যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করেছেন তারপর বিচারে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এসব ভাবলেই কেন যেন চোখে পানি চলে আসে', দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মায়া।
সা'দকে ভাবনায় ডুবিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের গায়ে কাঁথা ঠিক আছে কিনা চেক করতে চলে যায় মায়া।
মায়া অন্যান্য মেয়েদের মত নয়। সা'দের চোখ দিয়ে না দেখলে সে সুন্দরী নয়। সবসময় গুছিয়ে থাকলেও স্বামীর জন্য সাজগোজ করা ছাড়া সে হালফ্যাশনের কোন তোয়াক্কা করেনা। ওর রান্না কোনক্রমে খাওয়া যায় যদিও সা'দের মুখে ওটা অমৃত মনে হয়, কোন শৌখিন রান্নাবান্না করার চেয়ে সে পড়তেই ভালবাসে বেশি। তবু কেন যে বৌটাকে এত ভাল লাগে সা'দের! এজন্যই কি যে সে প্রতিদিন ভোরে সা'দকে কপালে টিপ দিয়ে প্রভুর সান্নিধ্যে যাবার জন্য আহ্বান করে? নাকি এজন্য যে সে প্রতিদিন সৃষ্টিকর্তার বানী থেকে কিছু অংশ নিজে পড়ে, তারপর বাসার সবাইকে শোনায়? এজন্য যে সে সা'দের বাবামায়ের প্রতিটি প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখে, তার সন্তানদের গড়ে তোলার ব্যাপারে যত্নশীল বলেই সা'দ নিশ্চিন্তে এত রাত পর্যন্ত বাইরে কাজ করতে পারে? নাকি এজন্য যে মায়া প্রতিদিন ওর আখিরাতের মাপকাঠিটাকে একটু উঁচু করে দেয় যেটা অর্জন করার জন্য ওকে আরেকটু বেশি মনোযোগী হতে হয়, আরেকটু বেশি সচেষ্ট হতে হয়, গতকাল সে যেখানে অবস্থান করছিল তার চেয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে হয়? এই তো সেই সাথী যার সাথে একটি জীবন কাটালে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়না, যার সাথে থাকার জন্য প্রয়োজন অনন্তকাল!

ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক


হাফিজ সাহেবের এক অত্যন্ত প্রিয় খালার বিয়ে হয় অ্যামেরিকা প্রবাসী পাত্রের সাথে। খালার বাড়ী, গাড়ী, ব্যাবসা সবই আছে কিন্তু কাগজপত্র সংক্রান্ত জটিলতার জন্য আর দেশে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই বিশ বছর খালার সাথে দেখা হয়নি ওনার। ক্যানাডা আসার পর থেকে খালার সাথে প্রায়ই কথা হয়। এবার সুযোগ করে খালার সাথে দেখা করতে গেলাম।
 

১৩ই সেপ্টেম্বর

বেলি আপা, যার কাছ থেকে আমাদের গাড়ী কেনা, আমাদের এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গাড়ী নিয়ে চলে গিয়েছেন। এয়ারপোর্টে ঢোকার পর থেকে মেজাজটা ক্রমাগত খারাপ হতে রয়েছে। প্রথমেই নামে মুহাম্মাদ দেখে হাফিজ সাহেবকে আলাদা রুমে নিয়ে আটকে রাখা হোল আধাঘন্টা যেন সন্ত্রাসীরা প্লেন উড়িয়ে দেয়ার জন্য সন্তানসন্ততি নিয়ে প্লেনে ওঠে কিংবা নাম থেকে মুহাম্মাদ বাদ দেয়ার মত বুদ্ধি তাদের নেই।  ওখান থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সামনে এগিয়ে যেতে ওরা আমাদের পানির বোতল, জুস সব ফেলে দিল যেন এগুলো মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। আমাদের পরনের সেফটি পিন, ব্রুচগুলোও ওদের ভীতির সঞ্চার করে।  এরা টাকা ছাড়া একটা লাগেজও নিতে দেয়না আর ওদের দৃষ্টিতে পাসপোর্ট বহনকারী কোমরের বেল্টটিও একটি স্বতন্ত্র ব্যাগ হিসেবে পরিগণিত হয়। জীবনে শতাধিকবার প্লেনে চড়েছি কিন্তু এমন সংকীর্ণ, বে-আরাম, বালিশ কম্বলবিহীন, অকেজো এসিওয়ালা প্লেন আর দেখিনি। প্লেনে কোন খাবার দেয়া হয়না, তবে কেউ চাইলে কিনে খেতে পারে, পানীয়ও বিক্রয়যোগ্য তবে সাদা পানি এবং কোকজাতীয় পানীয় চাইলে পাওয়া যায়।

 

পথে ট্রানজিট ছিল হিউস্টনে, এক ঘন্টারও কম, এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতেই শেষ। নইলে হিউস্টনে বসবাসরত আমার এক বান্ধবীকে আসতে বলতাম যার সাথে বিশ বছর দেখা হয়নি। এই অ্যামেরিকান মুসলিমা বাংলাদেশী বিয়ে করায় এক সময় চট্টগ্রামে থাকতেন, বিধবা হয়ে ফিরে এসে আবার বাংলাদেশী বিয়ে করেন। তিনি এত সুন্দর করে ইসলামকে বুঝেন এবং বোঝান যাতে জন্মগত মুসলিমরা নিজেদের মূর্খতায় লজ্জা পাবে।

 

প্লেন নিউ ইয়র্ক এসে নামতেই ঝাঁ করে একটা দুর্গন্ধ নাকে এসে ঢুকল। বুঝলাম ঘটনা খারাপ। আমি এমনিতেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাপ্রিয়, তার ওপর টানা পাঁচ বছর পৃথিবীর পরিচ্ছন্নতম নগরীতে বসবাস আমাকে শুচিবায়ুগ্রস্ততার দ্বারপ্রান্তে এনে দিয়েছে নিজের অজান্তেই। সমস্ত পুরোনো শহরগুলোর মতই এই শহরটিও ঘিঞ্জি, সংকীর্ণ রাস্তাঘাটযুক্ত, লোকে লোকারণ্য, আবর্জনা, শব্দদূষণ এবং অপরাধপ্রবনতার শিকার। দেশে থাকতে আমরা প্রায়ই কলকাতা বেড়াতে যেতাম। হাফিজ সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই কলকাতাকে মিস করছিলেন। ওনাকে বললাম, 'ওয়েলকাম টু কলকাতা'। নিউ ইয়র্ক আর কলকাতা কাছাকাছি সময়ে একই ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে গড়া। আদতেই এই দুই শহরের মাঝে অনেক মিল। উভয় স্থানে একই স্থাপত্যকলার দেখা মেলে, একই লাল ইটের ব্যাবহার, একই সাইজের বাড়ীঘর, একই ধরনের দোকানপাট আর রাস্তায় একইরকম ট্রাফিক।

 

খালু যখন আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিতে এলেন তখন রাত বারোটা। হাফিজ সাহেবের সাথে খালুর এই প্রথম সাক্ষাত। কিন্তু প্রথমে দেখাতেই ওনার খালুকে ভাল লেগে গেল। খালা একটু পর পর ফোন করছেন আমরা কত দূর, কতক্ষণে পৌঁছাব। খালার বাসা নিউ ইয়র্কের বাইরে, লং আইল্যান্ডে। ওখান থেকে যেকোন জায়গাই ন্যূনতম এক ঘণ্টার দুরত্ব। আমরা যতক্ষনে গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে খালা অস্থির হয়ে ঘরের বাইরে চলে এসেছেন। খালা, খালু আর দুই বোন রুশা ও হৃদিতার সাথে এই আমাদের প্রথম দেখা হলেও কোন জড়তা ছিলোনা। আর ছিলেন খালার বৃদ্ধা শাশুড়ি যিনি ছিলেন 'আরজালিল উমুর' শব্দের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, 'তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌছানো হয়, যাতে সে জানার পর জ্ঞাত বিষয় সম্পর্কে সজ্ঞান থাকে না' (সূরাহ হাজ্জ্বঃ আয়াত ৫) তিনি এককালে দুর্দন্ড প্রতাপশালী মহিলা ছিলেন, যেভাবে স্বামীর সহায়সম্পত্তি সামলেছেন, একইভাবে বৌদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন অথচ এখন সামান্য ব্যাপারেও শিশুদের মত আচরন করেনখুব আশ্চর্য লাগে যখন দেখি কেউ ক্ষমতা পেলে ভবিষ্যতের কথা ভাবেনা। অনেক শাশুড়ি বোঝেন না বৌয়ের প্রতি তাঁর আদর করার দায়িত্ব না থাকলে শাসন করার অধিকার জন্মায় কি করে? তিনি একটি মেয়েকে স্নেহ দিয়ে বৃদ্ধ বয়সে তার সেবাযত্নের অধিকার অর্জন করতে পারেন অথবা সাময়িক ক্ষমতার লোভে মত্ত হয়ে বৃদ্ধবয়সে তার দয়ার পাত্রী হতে পারেন। খালা তাঁর মাস্টার বেডরুম শাশুড়িকে ছেড়ে দিয়ে নীচতলায় থাকেন, শাশুড়ির তদারকে সদা যত্নবান, অনেক সময় শিশুদের মত আচরন করলে খাইয়েও দেন। রুশা আমাদের ওর রুম ছেড়ে দিয়ে দাদুর রুমে চলে গেল। রাদিয়া আর হৃদিতা সমবয়সী, ওরা দু'জন একসাথে থাকার সংকল্প করল।

 

খাবার ইচ্ছা না থাকলেও খালার অনুরোধে খেতে বসলাম। খাবার টেবিল দেখে আমি নিশ্চিত হলাম খালা পাগল হয়ে গিয়েছেন। বিশাল টেবিলের কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা খালি নেই। আমরা খেয়ে দেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। বহুদিন পর দেখা হলে যা হয়, অনেকের কথা মনে পড়ে, অনেকের খোঁজখবর করা হয়। দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেল।

 

১৪ই সেপ্টেম্বর

রাতে অন্ধকারে ভালভাবে দেখা হয়নি। সকালে উঠে দেখলাম খালার বিশাল বাগান। এই এলাকায় সরকারের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি লটের ২০% জায়গা বাড়ীর, ৮০% জায়গা বাগানের। সামনের বাগানে পথের দু'পাশে গাছগুলো খালু সুন্দর  শেপ করে কেটে রেখেছেন, খালা ফুলের বাগান করেছেন, ঝর্ণা, ইট দিয়ে ছোট্ট ঘের বানিয়ে জলজ উদ্ভিদ লাগিয়েছেন, ডানপাশে বিরাট বিরাট গাছ, একটা গাছের কান্ডের পুরোটাই লতায় ঢাকা পেছনের বাগানে লাউ, কুমড়া, সীম, বরবটি, করলা, টমেটো, বেগুন, ক্যাপ্সিকাম, কাঁচামরিচ, ফলফলাদি। নিউ ইয়র্কের আবহাওয়া ক্যাল্গেরীর মত শীতল নয়, তাই ফলনে প্রাচুর্য দেখা যায়। তার ওপর খালাখালুর যত্নে বাগানটি এত সুন্দরভাবে বেড়ে উঠেছে যে পথচারীরা বাড়ী বয়ে প্রশংসা করে যায়।

 

হাফিজ সাহেব শখ করেছিলেন খালার হাতে মোগলাই পরোটা খাবেন। খালা দেখি সাত সকাল উঠে মোগলাই বানাচ্ছেন। দেশে থাকতে রান্নার সময় শাশুড়ি আম্মার সাথে বসে বসে গল্প করতাম। বহুদিন পর আবার রান্নাঘরে খালার সাথে বসে গল্প করলাম। খালা কথা বলেন খুব আদর করে। অন্যরা ঘুম থেক উঠার আগেই অনেক গল্প হোল খালার সাথে।

 

আমাদের কন্যারা ঘুম থেকে উঠেই জানাল ওরা কার্লোস বেকারী দেখতে যাবে। এখানে একটি জনপ্রিয় টিভি প্রোগ্রাম কেক বস। নিউ জার্সীর কার্লোস বেকারীর মালিক বাডি ভ্যালাস্ট্রো আর তাঁর পরিবার মিলে ছোট ছোট ফুলওয়ালা কেক থেকে ট্রেন, জাহাজ, চিড়িয়াখানার প্রতিকৃতি, এমনকি প্রমানসাইজের মটরসাইকেল, গাড়ী পর্যন্ত বানায় কেক দিয়ে যা দেখতে একেবারেই আসলের মত। এই বেকারীর প্রতিষ্ঠাতা কার্লোস ছিলেন বাডির বাবা। কার্লোসের ঐতিহ্য যাতে পরিবারের বাইরে না যায় সেজন্য এই দোকানের সমস্ত কর্মচারীই হোল পরিবারের সদস্য। লং আইল্যান্ড থেকে নিউ জার্সী যেতেই লাগে দুই ঘণ্টা। তাই আমরা ভাল করে খেয়েদেয়ে রওয়ানা হলাম। লম্বা সময় পর দোকানের সামনে পৌঁছে দেখি মানুষের লাইন দোকানের সামনে ফুটপাথ পেরিয়ে রাস্তার অপর পাড়ে ফুটপাথ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দোকানে ঢোকা গেল প্রায় এক ঘন্টা পর। ছোট্ট দোকানটি মূলত সিটি হলের সামনে অবস্থিত হওয়ায় এবং টিভিতে প্রচার পাওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বাচ্চারা কিনল যা কিনতে চায়, অবশ্যই ভালভাবে উপকরণাদি চেক করে নেয়ার পর।

 

তবে সেদিনের প্রধান চমক, যার জন্য আমরা নিউ ইয়র্ক যাবার আগে থেকেই উদগ্রীব হয়ে বসে ছিলাম সবাই, তা ছিল নিউ ইয়র্কের বাইতুল মা'মুর মসজিদে একটি অনুষ্ঠান যেখানে প্রধান বক্তা ছিলেন শাইখ ইউসুফ এস্তেস। রাদিয়া বার বার বলছিল, 'আমি আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপসকে সামনাসামনি দেখেছি, এবার ইউসুফ এস্তেসকে দেখব, এর পর ডঃ জাকির নায়েককে দেখতে পারলে আমার জীবনের একটা বড় শখ পূরন হবে'। অনেক ট্রাফিক পেরিয়ে, অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে মাগরিবের সময় বাইতুল মা'মুর মসজিদে পৌঁছলাম। কিন্তু তারপর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কিছু কিছু মহিলার আচরন দেখে এই আয়াতটি মনে পড়ে যাচ্ছিল, 'আর কাফেররা বলে, তোমরা এ কোরআন শ্রবণ করো না এবং এর আবৃত্তিতে হট্টগোল সৃষ্টি কর, যাতে তোমরা জয়ী হও' (সূরাহ ফুসসিলাতঃ আয়াত ২৬) এঁরা উচ্চকন্ঠে কথা বলছিলেন, হাসাহাসি করছিলেন ফলে না মসজিদের আদব রক্ষা হচ্ছিল, না তারা নিজেরা শুনছিলেন না কাউকে শোনার সুযোগ দিচ্ছিলেন। বাঙ্গালী স্বর্গে গেলেও মানুষ হবেনা! একটি প্রশ্নের জবাবে শাইখ এস্তেস বললেন, কিয়ামতের অনেকগুলো নিদর্শনের মাঝে বর্তমানে সবচেয়ে প্রকট দু'টি উদাহরণ হোল, পিতামাতা সন্তানদের দাসদাসীতে পরিণত হবে এবং যারা এক সময় রাখাল ছিল তারা অট্টালিকা নির্মানে পরস্পরের প্রতিযোগিতা করবে। কথার সত্যতায় শিউড়ে উঠলাম। শাইখ এস্তেসকে দেখলাম অনেক নরম হয়ে পড়েছেন তবু কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পুরোদমে যেন মৃত্যুর পর তিনি এর ফায়দা লাভ করতে পারেন। বয়স আমাদের সবাইকে গ্রাস করছে কিন্তু আমরা কয়জন আখিরাতের ব্যাপারে এতটা সচেতন?

 

মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখা হোল ব্লগার আবুসামীহা সিরাজুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে। আর ছিলেন হাফিজ সাহেবের বাল্যবন্ধু আলী হাসান ভাই। ঠিক হোল আমরা পরদিন আলী হাসান ভাইয়ের সাথে নিউ ইয়র্কের শহর এলাকা দেখতে বের হব।

 

১৫ই সেপ্টেম্বর

পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন। ট্রেনে করে ম্যানহাটনের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন স্টেশনে এসে নামলাম। কলকাতায় পাতাল রেলে চড়ার অভিজ্ঞতা থাকায় মাটির নীচে পথঘাট খুঁজে পেতে অসুবিধা হোলনা। নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে সিস্টেম প্রতিষ্ঠার দিক থেকে লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ের পরে হলেও আকারের দিক থেকে পৃথিবীর বৃহত্তম, দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে জটিল। কোন কোন জায়গায় তিনতলায় ট্রেন চলে। এই ব্যাবস্থা নিউ ইয়র্কের পাঁচটি বৃহৎ কাউন্টি ব্রঙ্কস, নিউ ইয়র্ক (ম্যানহাটন), কুইনস, কিংস (ব্রুকলিন) এবং রিচমন্ড (স্টেটেন আইল্যান্ড) এর মধ্যে প্রথম চারটিকে সংযুক্ত করেছে।

 

আমরা বের হবার অল্পক্ষণের মধ্যে আলী হাসান ভাই আমাদের সাথে একত্রিত হলেন।  দুই বন্ধু চট্টগ্রামের ভাষায় গল্প করতে করতে এগোচ্ছেন। নাগরিক সভ্যতা আমাকে আকর্ষন করেনা, তাছাড়া আমি কিছুতেই নিউ ইয়র্কের আবর্জনাময় পরিবেশ আর দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতে পারছিলামনা, তাই রাদিয়া রিহাম আর আমি চলছি ধীরেসুস্থে। কিছুক্ষণ পর একটি দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় খেয়াল করলাম এক ভদ্র্লোক উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সামনের দুই ভদ্রলোকের দিকে। একটু পর তিনি হাঁক ছাড়লেন, 'অবা, আঁইও চাঁটগাঁইয়া' (ভাই, আমিও চট্টগ্রামের)। কথা বলতে বলতে দেখা গেল এঁদের তিনজনই একই পরিমন্ডলে একই লোকজনের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন যদিও তাঁদের নিজেদের মাঝে দেখা হয়নি কখনো। তাঁর কাছে কিছু পরিচিত লোকজনের ফোন নাম্বারও পাওয়া গেল। ভদ্রলোক বিদেশ ছিলেন বহুবছর, বিয়েও করেছেন এক মিশরীয় ভদ্রমহিলাকে, ফলে নিজের ভাষায় কথা বলার লোক পেয়ে আপ্লুত বোধ করছিলেন। আমরা চা খাবনা, তিনি খাওয়াবেনই, পরে হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের একটি চায়ের মগ উপহার দিলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীটা খুব ছোট, একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝি মিলে যাবে কোন শেকড় যা আমাদের মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ করবে। কতই না সহজ মানুষে মানুষে আন্তরিকতা! তবু মানুষ অমানুষে রূপান্তরিত হতে রয়েছে।

 

কিশোরী বয়সে একটা মুভি দেখেছিলাম 'ওয়াল স্ট্রিট', এটা অ্যামেরিকার ব্যাবসায়িক প্রাণকেন্দ্র, মুভির উপসংহারটা খুব ভাল লেগেছিল। টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত ফ্রিডম টাওয়ার হয়ে গেলাম ওয়াল স্ট্রিট দেখতে। পুরোনো শহরগুলোর রাস্তা তৈরী হত ঘোড়ার গাড়ী চলার জন্য, রাস্তার দুধারে স্থাপত্য নির্মান হয়ে গেলে আর শহরের চেহারা পরিবর্তন করা যায়না, ওয়াল স্ট্রিটে গাড়ী ঢোকানো মুশকিল। তবে অধিকাংশ শহরের কেন্দ্রস্থল হয় খুব ছোট, ফলে হেঁটেই দেখা যায় বা হেঁটে না দেখলে এর স্বাদ পাওয়া যায়না। ওয়াল স্ট্রিটের ফেডারেল হলটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকলার উদাহরণ। এটি সামান্য আগ্রহ উদ্রেক করল।

 

এখান থেকে চলে গেলাম স্টেটেন আইল্যান্ডগামী ফেরীতে। চট্টগ্রামে জন্ম আমার, তারপর পৃথিবীর যেখানেই গেছি সমুদ্রের কাছাকাছি ছিলাম, কিন্তু ক্যাল্গেরী এসে রকি মাউন্টেনের কোলে ভূমিপরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছি। বহুদিন পর হাডসন বে'র মুক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলাম। ফেরীর প্রোপেলারের ধাক্কায় পানির ফেনাগুলো মনে হচ্ছিল যেন ‘ঠাকুরমা'র ঝুলি’র গল্পের দুধসাগর। ফেরীর পেছনে ঘেরা দেয়া অংশের বাইরে একটা গাংচিল এসে বসল, খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের পর্যবেক্ষন করতে লাগল, মনে হচ্ছিল যেন ‘দ্য এনশিয়েন্ট ম্যারিনার’এর অ্যালবাট্রস। ফেরী একটু দূরে চলে এলে বামদিকে দেখা গেল হাডসন বে'র প্রবেশ পথের দু'পাশে কামান লাগানো দূর্গ আর দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। সামনে একইসাথে নিউ জার্সী, নিউ ইয়র্ক আর কুইন্সের ইট কাঠ লোহা পাথরের আকাশচুম্বী স্তুপ, কিন্তু দূর থেকে দেখে আর এত অসহ্য লাগছেনা। ডানদিকে দোতলা ব্রুকলিন ব্রিজ। এই সফরটুকু খারাপ লাগলনা। স্টেটেন আইল্যান্ডে নামাজ পড়েই আমরা ফিরে এলাম ম্যানহাটন। এবার গন্তব্য স্ট্যাচু অফ লিবার্টি।

 

হাঁটতে হাঁটতে সবার ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল। এখানে মোড়ে মোড়ে খাবার দোকানের পাশাপাশি কলকাতার মতই ঠেলাগাড়িতে খাবার বিক্রি হয় যার অন্তত অর্ধেক হালাল। এগুলোতে সব ধরনের লোকজনের ভিড় লেগে থাকে। ক্যাল্গেরীতে শীতল আবহাওয়ার জন্য এমনটা করা সম্ভব হয়না। তবে ইদানিং উষ্ণ দিনগুলোতে কিছু কিছু ভ্যানগাড়ীর পেছনে ভ্রাম্যমান কিচেন করে খাবার বিক্রি করতে দেখা যায়। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ফেরীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম স্বাধীনতার এই মূর্তি বৃটেনের কাছ থেকে অ্যামেরিকার মুক্তি উপলক্ষ্যে ফ্রান্সের উপহার হলেও এর পেছনে রয়েছে মূলত চিরশত্রু বৃটেনের প্রতি ফ্রান্সের সুক্ষ্ণ রাজনৈতিক ঠেস। এই বিশাল মূর্তি ওরা ভগ্নাংশ আকারে জাহাজে করে এনে জোড়া দিয়ে গেলেও এর ভিত্তিটা অ্যামেরিকাকে নিজ খরচে তৈরী করে নিতে বলে। এত খরচ কে করে? অ্যামেরিকানরা একটা দূর্গের মাটিরঙ্গা ইটের ভিত্তির ওপর তুলে দেয় স্বাধীনতার দেবীকে যেন তালপাতার টুকরীতে ডায়মন্ডের আংটি! আবার এই উপহার লোকজনকে দেখিয়ে আরো পয়সা উপার্জনের উপায় হয় তাদের- এক্কেবারে ডাবল লাভ! তবে ওদের এত সাধের মূর্তিটি আর দেখা হয়নি কাছে থেকে, ফেরীর সময় শেষ হয়ে গেছিল আমরা যেতে যেতে।

 

এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল রকফেলার সেন্টার আর টাইমস স্কোয়ার। এগুলো রাতের বেলাই দেখতে বেশি ভাল লাগে। তাই সময় ক্ষেপনের জন্য আমরা একটি আদিবাসী মিউজিয়ামে ঢুকলাম। আবার উপলব্ধি করলাম মিডিয়া আসলে কত বড় অস্ত্র। আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে অ্যামেরিকা আবিষ্কার করেন কলম্বাস আর আমরাও তা বিশ্বাস করেছি। অথচ এই মহাদেশ এর শত শত বছর আগে থেকে আবিষ্কৃত এবং অধ্যূষিত ছিল- ওরা কি তাহলে মানুষ ছিলোনা? আরব ব্যাবসায়ীরা কলম্বাসের আগমনের প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর আগে মানচিত্রে এই মহাদেশ সুচারুরূপে এঁকে রাখে- ওরাও কি মানুষ ছিলোনা? মিউজিয়ামে হাতেগোণা যে কয়টি বস্তুসামগ্রী দেখলাম তাও এত উচ্চমানের যে এই আদিবাসীদের আদিম বা অসভ্য বলার কোন উপায় নেই। তাহলে বাকি থাকে একটিই অস্ত্র যা শ্বেতাঙ্গরা সর্বত্রই প্রয়োগ করে থাকে। আদিবাসীদের অস্তিত্বের লড়াই চিহ্নিত হয় সন্ত্রাসবাদ হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীরা প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিল। ফলে তাদের সেই কূটবুদ্ধি, নৃশংসতা এবং মানববিধ্বংসী অস্ত্র ছিলোনা যা দিয়ে তারা শ্বেতাঙ্গদের মোকাবিলা করতে পারে। এখন যে আদিবাসীরা অবশিষ্ট আছে তাদের সম্মান দেখানোর নামে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো হয় কিন্তু তাদের দেশ পরিচালনার ব্যাপারে কোন অধিকার নেই, কার্যত এঁদের অধিকাংশই সহজলভ্য আয়ের দ্বারা অকর্মন্য এবং আত্মবিধ্বংসী জীবনযাপন করে নিজেদের তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।

 

এবার রকফেলার সেন্টার- ২২ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত রকফেলার পরিবারের ১৯ টি বাণিজ্যিক ভবন মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে নানাপ্রকার বিনোদনের ব্যাবস্থা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বাচ্চাদের চার্জ শেষের দিকে। আমিও টের পাচ্ছিলাম, আল্লাহ আমাকে নিউ ইয়র্কের দুর্গন্ধ থেকে মাফ করতে চলেছেন, পাঁচ বছর পর আমার সর্দি হতে চলেছে আমার সর্দি যে কি ভয়াবহ বস্তু তা যে দেখেনি সে কল্পনাও করতে পারবেনা। আমাদের অবস্থা দেখে হাফিজ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন টাইমস স্কোয়ার আরেকদিন হবেতখন আমরা চারপাশে সামান্য ঘুরাঘুরি করে রকফেলার স্কোয়ারের জি ই বিল্ডিংয়ের ছাদে গেলাম যেখান থেকে নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইন দেখা যায়। আবার সেই ইট কাঠ লোহা পাথরের স্তুপ দেখলাম, এবার ওপর থেকে যেহেতু এই বিল্ডিং নিজেই নিউ ইয়র্কের দশম উচ্চতম ভবন। ছাদে থাকা অবস্থাতেই সূর্যাস্তের সময় হয়ে গেল। নেমে এলাম নামাজ পড়ার জন্য। এবার একটি বিশেষ দাওয়াতে যাব।

 

ক্যাল্গেরী থেকে আসার আগে দৃঢ়সংকল্প ছিলাম ঘুরাঘুরি করব, দাওয়াত নেবনা। কিন্তু আবুসামীহা ভাইয়ের সাথে পারিবারিকভাবে পরিচিত হবার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমরা তাঁর বাসার কাছাকাছি ট্রেন স্টেশনে পৌঁছতেই তিনি গাড়ী নিয়ে হাজির হলেন আমাদের নিয়ে যেতে। বাসায় ভাবী এবং বাচ্চাদের পাশাপাশি অপেক্ষমান ছিল তাঁর প্রতিবেশিনী, আমার প্রিয় ছাত্রী বর্ষা। মূহূর্তেই গল্প জমে উঠল আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের, যেন কতদিনের পরিচয়! ভাবী অনেক আগে থেকেই আমার ফেসবুকে বন্ধু হয়ে আছেন অথচ একবারও জানাননি যে তিনিই আমাদের গুণবতী ভাবীবার বার মানা করা সত্ত্বেও তিনি টেবিল ভরে ফেললেন। সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে ক্ষুধার্ত থাকায় খেলামও খুব মজা করে। অন্যদিকে বর্ষার সাথে দেখা পাঁচবছর পর। আমার একটি ইশারায় সে দশ দিনের ভেতর স্বামীর সাথে অ্যামেরিকা চলে আসে যদিও এর আগে কেউ ওকে রাজী করতে পারেনি। এই বিশ্বাস আর ভালোবাসা কি কিছু দিয়ে পরিমাপ করা যায়? সে ওর ফুটফুটে সন্তান দু'টিকে দেখাল, ওর বর্তমান জীবনের কথা বর্ণনা করল এবং জানালো আমার সেদিনের সেই উপদেশ ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমার আট বছরের সহকর্মী সালমা আপা, যিনি ছিলেন আমার রুমমেট এবং আমার সকল কথা ও কাজের সাক্ষী, প্রায়ই আমাকে বলতেন, 'রেহনুমা, তুমি দুঃসাহসী। কৃতঘ্নতার এই যুগে মানুষ কাছের মানুষদেরও পরামর্শ দিতে ভয় পায়, আর তুমি কিনা ফ্রি ফ্রি উপদেশ বিলি কর!' ইচ্ছে হচ্ছিল সালমা আপাকে জানাই, পাঁচ বছর পর একজন আমাকে জানালো একটি পরামর্শ ওর জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে, সে সুখি হয়েছে, এই আনন্দটুকুর জন্যই তো মানুষ বেঁচে থাকে! কিছুক্ষণের মধ্যে অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ ভাইও এসে উপস্থিত। তিনি খবর পেয়েছেন আমরা এই বাসায় দাওয়াত নিয়েছি সুতরাং আর ছাড়াছাড়ি নেই, তাঁর বাসায় যেতেই হবে। পরদিন আবুসামীহা ভাইয়ের কাজ, তবু তিনি আমাদের খালার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর। এদিকে বাচ্চারা কিছুতেই এই বাসা থেকে যেতে রাজী না। পাশাপাশি ঠিক বেরোবার সময় ভাবী কোথা থেকে 'এক গুচ্ছ গোলাপ' বইটি এনে বললেন, 'কিছু লিখে দিন'। ভীষণ লজ্জা পেলামআমি কি একটা মানুষ হলাম! তবু তাড়াহুড়া করে কিছু লিখলাম, জানিনা ভাবীর মন ভরাতে পারলাম কিনা। ভাবীকে 'বিয়ে' বইটির একটি কপি উপহার দিলাম। ভাবী পালটা এক বিশাল প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন, কিছুতেই না শুনবেন না! এঁরা ভারী ডেঞ্জারাস মানুষ, খাইয়ে দাইয়ে, উপহার দিয়ে আবার বাড়ী পৌঁছে দেন! আমাদের দিয়ে এসে বাড়ী ফিরতে আবুসামীহা ভাইয়ের প্রায় রাত বারোটা বেজে গেছিল। তবে একটি কথা না বললেই নয়। সৃষ্টিশীল উপহার দেয়া শিখতে চাইলে আবুসামীহা ভাই এবং ভাবীর কাছে ট্রেনিং নিতে হবে- তাঁদের প্রতিটি উপহার নির্বাচনে ছিল রুচি, চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া; প্রতিটি উপহারই ছিল যার জন্য দেয়া তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তবে সবচেয়ে হৃদয়ছোঁয়া ছিল তাঁদের আন্তরিকতা যার জন্য অবশ্যই আমরা সোনার বাংলাদেশ ব্লগের কাছে কৃতজ্ঞ

 

১৬ই সেপ্টেম্বর

ব্যাক্তিগত অভ্যাস এবং ডাউনটাউনে কাজ করার সুবাদে আমি প্রচুর হাঁটতে পারি কিন্তু বাকি তিনজনের অবস্থা ছিল বিধ্বস্ত। সকালে উঠে আলী হাসান ভাইয়ের সাথে দু'টো মিউজিয়াম দেখতে যাবার কথা থাকলেও কার্যত রাদিয়া উঠল এগারোটায়, হাফিজ সাহেবকে বেলা বারোটায় খালার বকা খাইয়ে ঘুম থেকে তুললাম, রিহাম উঠল একটায়। খালু হাফিজ সাহেবকে ভারী সুন্দর একটা টি-শার্ট উপহার দিয়ে বকা খেয়ে ঘুম ভাঙ্গার দুঃখ ভুলিয়ে দিলেন। নাস্তা খাবার পর খালা বললেন, 'আজকের দিনটা তো কোন কাজে লাগলনা। তুমি বললে অনেকদিন সমুদ্র দেখনা। চল, তোমাকে সমুদ্র দেখিয়ে আনি'।

 

সৈকত খালার বাসার অদূরেই। সাগর দেখতে গিয়ে বুঝলাম এ তো সাগর নয়, একেবারে মহাসাগর, অ্যাটলান্টিক মহাসাগর! ইচ্ছে ছিল বালির ওপর হাঁটব, পানিতে নামব, কিন্তু এমন দিনেই কিনা শরীর সায় দিচ্ছিলোনা। সুতরাং চললাম বাতিঘরের দিকে। এই স্থাপনাটির প্রতি আমার এক দুর্বার আকর্ষন কাজ করে। কন্যাকুমারী বেড়াতে গিয়ে সারারাত জেগে বসে কয়শ বার যে সেই একই আলোর আবর্তন দেখেছিলাম! আমার জীবনের লক্ষ্য বাতিঘর হওয়া যেন কোন একদিন কোন এক পথহারা নাবিককে পথ দেখাতে পারি। যোগ্যতা সীমিত হলেই কি আর আশা সীমিত হয়? তবু মাঝে মাঝে সীমাবদ্ধতা মেনে নিতেই হয়। বাতিঘর দেখলাম কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় সেই আড়াইশ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সাহস করতে পারলাম না। খালু একটা ঘেরা দেয়া জায়গা দেখালেন যেখানে পায়ে হেঁটে যেতে হয় শুধু তারাই গাড়ী নিয়ে যেতে পারে যাদের ওখানে বাড়ী আছে। সাগরের একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। আবুধাবিতে আমার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত। সেই উচ্ছ্বল তরঙ্গ কখনো নীল কখনো সবুজ রঙ ধারণ করত, নেচেগেয়ে হাতছানি দিত। সারাদিন তাকে দেখার পর আবার সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা করতে যেতাম, ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত কিন্তু তার গর্জন শুনে মন ভরতনা, তার স্রোতের আসা যাওয়া দেখে প্রান ভরতনা। কোন কোনদিন ভোরে উঠে বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম, রূপালী ঝলকে উছলে উঠত সমুদ্রের প্রান। বাজারে এত মাছ তবু নিজ হাতে মাছ ধরার সে কি আনন্দ! এঁরা কতইনা ভাগ্যবান যারা প্রতিদিন সাগরের এই হাতছানিতে সাড়া দিতে পারে!

 

বাসায় ফিরে খালুর সাথে তাঁদের দোকান দেখতে চললাম। খালাদের দোকান অ্যাস্টোরিয়ায়, বাসা থেকে এক দেড়ঘন্টার দুরত্বে। দোকানের নাম খালার নামে, দীপা মিনি মার্কেটদোকানটি বেশ বড়, জিনিসপত্র প্রচুর, সারাক্ষনই লোকজনের আসা যাওয়া। এর মধ্যেই খালু আমাদের জন্য চা বানালেন, রিহামকে শেখালেন কিভাবে টাকা নিতে হয়, কোথায় রাখতে হয়, কিভাবে ভাংতি পয়সা গুছিয়ে রাখতে হয়, আবার কয়েকবার প্র্যাকটিস করিয়ে ওকে চকলেট আর আইসক্রীম পারিশ্রমিক দিলেন! আমরাও নিলাম যার যা প্রয়োজন। এই প্রথম কোন দোকান থেকে কিছু নিয়ে পয়সা দিতে হোলনা! দোকানের সাজ সরঞ্জামাদি সব খালুর হাতে করা। এক সময় খালারা পাশের বিল্ডিংয়েই থাকতেন, স্বামী স্ত্রী মিলে যখন যে ফ্রি থাকত তখন সে দোকানে বসত। বাসাটা দেখতে গেলাম। তারপর আমরা রওয়ানা হলাম টাইমস স্কোয়ারে।

 

টাইমস স্কোয়ারের নামকরন নিউ ইয়র্ক টাইমসের হেড কোয়ার্টারের নামে হলেও এটি মূলত একটি ব্যাবসাকেন্দ্র। এখানে অবস্থিত নানান ব্যাবসার মাঝে প্রধান একটি হোল বিনোদন ব্যাবসা। ব্রডওয়ে থিয়েটার, ম্যাডাম তুসোঁর মিউজিয়াম, রিপ্লির বিলিভ ইট অর নট মিউজিয়ামসহ প্রচুর অফিস, হোটেল ইত্যাদি থাকার কারণে এই পথ দিয়ে প্রতি তিন দিনে এক মিলিয়ন মানুষ হেঁটে যায় যার একটি বিশাল অংশ পর্যটক। এখানে খুব ধুমধাম করে নববর্ষ উদযাপিত হয়। রাতের বেলা সবচেয়ে দর্শনীয় হোল এখানকার বিলবোর্ডগুলো যেগুলো নিয়ন বাতি কিংবা আস্ত বিল্ডিং সাইজের টিভিস্ক্রীণের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করেদুর্ভাগ্যজনকভাবে এত আলোর ঝলকানি দেখেও গাইতে পারলাম না, নিউ ইয়র্ক 'শহর আইসা আমার আশা পুরাইল, লাল নীল বাত্তি দেইখা নয়ন জুড়াইল'আমি বড় বেরসিক টাইপের মানুষ। কৃত্রিম বস্তুনিচয় আমাকে আকর্ষন করেনা, আলোর ঝলকানি আমার বিরক্তির উদ্রেক করে।

 

কিছুক্ষণ পর অ্যাডভোকেট আব্দুল আজিজ ভাই এলেন। হাফিজ সাহেবের দুলাভাইয়ের বিশেষ বন্ধু থেকে তিনি একসময় আমাদের পারিবারিক বন্ধুতে রূপান্তরিত হন। রাদিয়ার নামের আরেকটি অংশ তানজিলা রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আজিজ ভাইয়ের মেয়ের নাম তানজিলা হওয়ায় হাফিজ সাহেব রাজী হননি, 'এত কাছের সম্পর্কে দু'জনের একই নাম হলে গুলিয়ে যাবে'আজিজ ভাইয়ের সাথে ট্রেনে করে তাঁর বাসায় চললাম। তিনি ব্রুকলিনের ইহুদী অধ্যূষিত একটি এলাকায় থাকেন। তিনি দেখালেন ওরা কিভাবে পাশাপাশি সমস্ত বাড়ীগুলো কিনে নিয়ে একটি পাড়ার মত করে নিয়েছে। ইহুদীরা ধর্মীয় ব্যাপারে অসম্ভব গোঁড়া, আর এঁরা ছিল ধার্মিক ইহুদী। পুরুষদের সবার দেখলাম লম্বা ঢোলাঢালা পোষাক আর মুখভর্তি লম্বা দাঁড়ি। ওদের বিবাহিতা মহিলারা পর্দার একটা বিকল্প সমাধান বের করেছে- মাথা ন্যাড়া করে পরচুলা পরা! তবে আমার সবচেয়ে যেটা জানার আগ্রহ তা হোল পুরুষরা, মাথাভর্তি চুল থাক কি টাকমাথা, মাথার তালুর ঠিক মধ্যখানে মিনি সাইজের একটা টুপি পরে, এটা কিভাবে আটকে থাকেওদের এই টুপি পরে সারাদিন ঘুরতে, এমনকি দৌড়াতে দেখেছি কিন্তু টুপি নড়েনা, টাকমাথা হলেও না!

 

বাসায় পৌঁছনোর আগেই দেখি ভাবী ছোট মেয়েটিকে নিয়ে বাতাসের ভেতর রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য! রাস্তার মধ্যেই গল্প শুরু! বাসায় পৌঁছে তানজিলাকে পেয়ে রাদিয়ার গল্প শুরু। তবে আমাদের পুত্রদ্বয়ের বয়সের অনুপাতে গড়মিল, ওরা বসে রইল যার যার মতভাবীর সেদিন কাজ ছিল তবু রান্না করে ভর্তি করে ফেলেছেন। আমি বললাম, 'এতকিছু না করে শুধু শুটকি ভর্তা করলেই তো হত!' ভাবীর উত্তরে অবাক হলাম, উনি ভেবেছিলেন হাফিজ সাহেব চট্টগ্রামের আর আমি চট্টগ্রামের বাইরের! ভেবে দেখলাম কথা সত্য। হাফিজ সাহেব চমৎকার চাঁটগাঁইয়া বলেন, আমার নাকি অ্যাক্সেন্ট ঠিক হয়না! হতদ্যোম হয়ে মুখ হাত ধুতে গেলাম। এসে দেখি ভাবী এর মধ্যেই চমৎকার শুটকী ভর্তা তৈরী করে ফেলেছেন! লজ্জা পাচ্ছিলাম যে কথাটা বলে ভাবীকে কষ্টে ফেলে দিলাম। কিন্তু উনি বললেন, 'ভাবী, বাপের বাড়ীর মানুষ দেখলেও শান্তি লাগে!' আমার যা চেহারা তাতে যেকোন ছুতাতেই চেহারা দেখে কেউ শান্তি পান শুনে যারপরনাই আনন্দিত হলাম। গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেল কিন্তু মনে হোল কোন কথাই হয়নি। এর মধ্যে হাফিজ সাহেবের এক বন্ধু কামরুল সাহেব এসে ঘুরে গেলেন। অবশেষে আজিজ ভাই বললেন, 'চলেন, আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আসি'। ভাবীও রওয়ানা হলেন আমাদের সাথে, পথে যেতে যেতে বাকি গল্পটুকু করা যাবেখালার বাসায় আসার পথে রাতের নিউ ইয়র্ক দেখলাম, বিশাল চাঁদের নীচে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি টিমটিমে আলো জ্বেলে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চারা পথেই ঘুমিয়ে পড়ল। খালার বাসায় নেমে, ভাই ভাবীর কাছে বিদায় নিয়ে, ঘরে ঢুকে বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়ে এসে দেখি খালু ভাত খাচ্ছেন আর 'বাবাগো, মাগো' করে কাতরাচ্ছেন। বেচারার সায়াটিকার ব্যাথার সমস্যা আছে। কিন্তু খালু কাউকে দিয়ে কাজ করানো পছন্দ করেন না, আবার কাজ না করেও বসে থাকতে পারেন না। খালার বকার ভয়ে স্বীকার না করলেও সম্ভবত উনি দোকানে কোন ভারী মালপত্র তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যাথায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। ভয়ানক অবস্থা। কোনক্রমে কিছু খেয়ে, ব্যাথার ওষুধ খেয়ে, গরম পানির ব্যাগ নিয়ে শুতে যাবেন খালু। এর মধ্যেও তিনি তরকারী ঢেকে তুলে রাখতে, প্লেট ধুতে অস্থির হয়ে পড়লেন। শেষে খালা থ্রেট দিলেন এমন অনিয়ম করলে অপারেশন করাবেন। তখন খালু বাধ্য ছেলের মত চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লেন!

 

১৭ই সেপ্টেম্বর

সকালে উঠে খালা বললেন, 'তোমাদের যেহেতু নিউ ইয়র্ক ভালো লাগছেনা, তোমরা রুশার গাড়ী নিয়ে ওয়াশিংটন, ভার্জিনিয়া আর পেনসিলভেনিয়া ঘুরে এসো'।

আসলেই শুধু মানুষগুলো ছাড়া নিউ ইয়র্কের আর কিছু ভাল লাগছিলোনা। এই ইট কাঠ লোহা পাথরের মাঝে ওরা কিভাবে নিজেদের সুকোমল রেখেছেন, ঢাকাবাসীদের মত কঠোর হৃদয় হয়ে যাননি তাই ভাবি। এর জন্য এঁদের সম্বর্ধনা দেয়া উচিত! কিন্তু রুশা এক বছর চাকরী করে টাকা জমিয়ে এই গাড়ীটা কিনেছে। মানুষের শখের জিনিসে হাত দেয়া উচিত না। তাই দ্বিধা বোধ করছিলাম।

খালু কঁকাতে কঁকাতে বললেন, 'ওরা ছোটমানুষ, একা একা যেতে পারবেনা, আমি ওদের নিয়ে যাব'।

হাসব না কাঁদব? ব্যাথায় খালুর অবস্থা শেষ আর উনি আমাদের চিন্তায় অস্থির! খালারও মন চাইছে যেতে, কিন্তু বৃদ্ধা শাশুড়িকে দেখবে কে? রুশার ইউনিভার্সিটি আর হৃদিতার ক্লাস চলছে পুরোদমে। তাছাড়া আমাদের জন্য ওঁদের ব্যাবসার ক্ষতি হবে এটাও আমাদের ভাল লাগবেনা। খালার সাথে বসে রুট ঠিক করে প্রোগ্রাম ঠিক করা হোল। গাড়ী চেষ্টা করব রুশারটা না নিয়ে ভাড়া করতে। ব্লগার নূসরাত রহমানকে ফোন করলাম। আমাদের নিউ ইয়র্ক যাবার কথা শুনেই বেচারী যোগাযোগ করতে শুরু করেছিল এসে আমাদের নিয়ে যাবে। জানালাম আমরা বাল্টিমোর হয়ে ওয়াশিংটন যাব। বহুদিন পর দেখা হবে এই খুশিতে আমরা ডগমগ।

 

দুপুরের দিকে আমরা বের হলাম ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে। সেন্ট্রাল পার্কের দু'পাশে দু'টো মিউজিয়াম, এই দু'টোই দেখার সংকল্প করে এসেছিলাম ক্যাল্গেরী থেকেসেদিন উদ্দেশ্য ছিল অ্যামেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরি দেখবরাদিয়ার পছন্দের জায়গায় যাওয়া হয়েছে প্রথম দিনই, এটা রিহামের পছন্দের স্থান এখানে চারতলায় বিষয় অনুযায়ী জীবনের ইতিহাস বিন্যস্ত হয়েছে। একতলায় রয়েছে পৃথিবীর নানান প্রান্তে প্রাপ্ত বিভিন্ন পশুপাখির ট্যাক্সিডার্মি। যারা ট্যাক্সিডার্মির বিষয়ে আগ্রহ বোধ করেননা তাদের জানার জন্য বলছি জিনিসটা আমারও পছন্দ না, কিন্তু এর মাধ্যমে বাচ্চারা অনেককিছু দেখার বা জানার সুযোগ পায়। এই পদ্ধতিতে বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া, পালক, আঁশ ইত্যাদি নিয়ে প্রাণীটিকে জীবিত অবস্থার মত করেই মমি বানানো হয়। দেয়ালে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবি এঁকে, প্রাকৃতিক পরিবেশের কিছু উপাদান ফ্লোরে ছড়িয়ে দিয়ে এর ওপর প্রাণীটিকে দাঁড় করিয়ে কাঁচ দিয়ে ঘিরে দেয়া হয় যেন এটি ক্ষয়ে না যায়। তো ধরুন দেয়ালে একটি বনের দৃশ্য এঁকে, ফ্লোরে কিছু ঘাসের প্রতিকৃতি দিয়ে, সামনে একটি বহতা স্রোতের প্রতিকৃতি বানিয়ে ঘাসের ওপর একটি হরিন শিশুসহ কয়েকটি পুরুষ ও মা হরিণ দাঁড় করিয়ে দেয়া হোল। কাঁচের সামনে বর্ননা লিখে দেয়া থাকে এই প্রাণীর নাম কি, কোথায় পাওয়া যায়, কি ধরণের পরিবেশে থাকে, কি খায়, কত বছর বাঁচে ইত্যাদি। এ'রকম কয়েক হাজার ট্যাক্সিডার্মি স্থান পেয়েছে এই মিউজিয়ামে। ধারণা করুন তো একটি শিশু কয়েক মূহূর্তের ভেতর কতগুলি জিনিস শিখতে পারবে এরকম একটি উদাহরণ সামনাসামনি দেখতে পেলে! আমাদের সময় ছিল কম, পাঁচটায় মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে। রিহাম আমাকে হাত ধরে টানতে টানতে বলল, 'আম্মু চল, আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে নাহলে আমরা সব দেখতে পারবনা'। আমিও সমান উৎসাহী।

 

পরের ফ্লোরে ছিল নানান মহাদেশের আদি সভ্যতার কিছু কিছু নিদর্শন। দেখলাম দুরত্বের কারণে এখানে অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় দক্ষিণ অ্যামেরিকার নিদর্শনাদি স্থান পেয়েছে বেশি। হয়ত এগুলো সংগ্রহ করা এবং আনা সহজতর ছিল। সকল আদি সভ্যতার মাঝে কয়েকটি জিনিসে মিল খুঁজে পেলাম। এরা পোশাক পরতনা বা যৎসামান্য পরত, এরা নানান দেবদেবীর পুজা করত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভীত বিহ্বল জীবন কাটাত, এরা গানবাজনা নাচগান নিয়ে সময় কাটাত- ব্যাপারগুলো বর্তমান সভ্যতার চেয়ে খুব একটা আলাদা মনে হোলনা যদিও বর্তমানে দেবদেবীর স্থান দখল করেছে নেতাশ্রেণী, ধনীকশ্রেণী, অভিনেতা, গায়ক, ফ্যাশন, টাকাপয়সা, খ্যাতি ইত্যাদি। একমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানুষকে এসব দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে, মানুষকে আত্মসম্মানসহকারে বাঁচার সাহস দিতে পারেদুঃখ হোল কত বিপুল সংখ্যক মানুষ এই সহজ পথটি বেছে না নিয়ে কঠিন পথ ধরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে এবং আরো কত মানুষ সেই একই পথের যাত্রী।

 

পরের ফ্লোরে একপাশে ছিল মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনপ্রনালীর বৃহৎ ছবি বা প্রতিকৃতি ও বৃত্তান্ত। সময় কম থাকায় এই অংশটি দ্রুত পেরোলাম যেহেতু এগুলো আমি বাচ্চাদের বাসায়ও বই দেখিয়ে শেখাতে পারব। শুধু একটি দেহকোষের গঠনপ্রকৃতি নিয়ে রিহামের সাথে আলোচনা করলাম। তার পাশের অংশটি ছিল খনিজ পদার্থ নিয়ে। রাদিয়াকে বছর কয় আগে ক্যাল্গেরীর খনিজ মিউজিয়ামে নিয়ে গেছিলাম, পুরো মিউজিয়ামই খনিজ নিয়ে রিহাম তখন দু'বছরের শিশুতাই মূলত ওকেই এই জায়গাটা ভালভাবে ঘুরিয়ে দেখালাম। হাফিজ সাহেব আর রাদিয়া ততক্ষণ বিশ্রাম নিল, নামাজ পড়ল। এখানে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল একটি বিশাল উল্কাপিন্ড এবং খনিতে খনিজ কি অবস্থায় থাকে এর কয়েকটি প্রতিকৃতি। অন্যপাশে ছিল রিহাম আর আমার প্রিয় ডাইনোসর। তবে ড্রামহেলারে যে বিরাট ডাইনোসর মিউজিয়াম আছে সেখানে প্রতি বছর যাওয়া আসার পর আমাদের কারুরই এই অংশটা তেমন আকর্ষনীয় মনে হোলনা। এখানে কেবল তিনটি কঙ্কাল ছিল যেগুলো ড্রামহেলারে নেই- হরিণ, গরু আর ঘোড়ার আদি পুরুষদের কঙ্কাল। আহারে! ঐ গরু এখন একটি জবাই করলে পুরো গ্রাম সাতদিন খেতে পারত!

 

একেবারে নীচের ফ্লোরে যখন পৌঁছেছি তখন ঘোষনা দিচ্ছে মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবেহাফিজ সাহেব বললেন, 'বলার সাথে সাথে তো আর বন্ধ করে দেবেনা, দশ পনেরো মিনিট সময় আছে। তুমি আর রিহাম যতটুকু পারো ঘুরে দেখে এসো। একপাশে ছিল ফসিল। এগুলো ড্রামহেলারে প্রচুর দেখা হয়েছে। তাই রিহাম আর আমি দ্রুত ঐ জায়গা ঘুরে অন্যপাশে চলে গেলাম। এখানে ছিল বর্তমানের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রানীর প্রতিকৃতি। সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল নীল তিমির একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতি আর নিজের পরিবেশে সুন্দরবনের বাঘের প্রতিকৃতি। সময়ে শেষ হয়ে গেল। শান্তি পেলাম যে মিউজিয়ামের কিছু বাদ যায়নি। মা ছেলের শখ এবং সংকল্প দু'টোই পূরণ হয়েছে।

 

মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আলী হাসান ভাইয়ের বাসায় রওয়ানা হলাম। ভাবী দু'দিন আগেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন, পরে সিরিয়াল মিলে না মিলে। ট্রেনে করে তাঁদের বাসার কাছাকাছি পৌঁছলে তাঁরা এসে আমাদের বাসায় নিয়ে গেলেন। হাফিজ সাহেব আর আলী হাসান ভাই দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে সহপাঠী ছিলেন, প্রগতিশীল পরিবার থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়ায় উভয়েই একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে বড় হয়েছেন। তাই তাঁদের দু'জন একে অপরকে যেভাবে বোঝেন সেভাবে আমার পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয়। আলী হাসান ভাইদের চৌদ্দ ভাইবোন। এই প্রসঙ্গে আমার কিশোরীবেলার একটা ঘটনা মনে পড়লে আমি এখনো ভীষণ লজ্জা পাই। আমার এক সহপাঠিনী বলল ওরা তেরো ভাইবোন, বড়জনের বয়স তখন চল্লিশ, ছোটটি কয়েক মাস। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা, তোমরা সব ভাইবোন কি সবাইকে চেন?' আসলে এর আগে এতবড় পরিবার দেখিনি, কিন্তু পরে মনে হয়েছে আমার মত গাধা পৃথিবীতে আর নেই। সে শুধু আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে তাকাল, কিন্তু কিছু বললনা। পরে আরেকজনের কাছে ওর একটি মন্তব্যে বুঝতে পারি আমার প্রতি ওর কোন অনুযোগ নেই, সে বুঝতে পেরেছে এই বোকামী আমার অনভিজ্ঞতার ফল, কি যে আরাম পেয়েছিলাম সেদিন, মনে হোল মনের ওপর থেকে এক বিরাট বোঝা হাল্কা হয়ে গেল! অবশ্য আমরা সহপাঠী থাকা অবস্থাতেই ওদের পরিবারে চৌদ্দতম ভাইটির পদার্পন ঘটে। যাই হোক, আলী হাসান ভাইদের অনেকজন ভাইবোন একই সময় অ্যামেরিকায় ইমিগ্রেশন পাওয়ায় তাঁরা বেশ কয়েকজন এখন তাঁর বড় ভাইয়ের বাড়ীতে অবস্থান করছেন, আর বড় ভাই এই সুযোগে বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন! তাঁর বড় ভাইবোনরা বয়সে তাঁর অনেক বড়। মজার ব্যাপার হোল তাঁর এক বোন আমার এক দাদীর ভাইয়ের বৌ, বাবার বন্ধুর বৌ হিসেবে তাঁকে সারাজীবন মামী ডেকে এসেছি। তাঁর আরেক বোন আমার আপন ভাইয়ের চাচীশাশুড়ি, আমার বাবামা এবং আমরা উভয়েই তাঁকে আপা ডাকি! তাঁর ছেলেমেয়েরাও ছিল তখন। বাসা ভর্তি ভাইবোনদের ছেলেমেয়ে- ছেলেরা আলাদা রুমে, মেয়েরা আলাদা রুমে- এদের কেউ কেউ আবার প্রেসিডেন্সি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে আমাদের ছাত্রছাত্রী ছিলভাবী খুব ভাল রান্না করেন। ভাই তাঁকে বলে রেখেছিলেন, 'আমার বন্ধু আসবে, সব চাঁটগাঁইয়া আইটেম হওয়া চাই'।  ভাবী জানালেন ভাই বন্ধুর জন্য শখ করে নিজে গরুর মাংস রান্না করেন। নানাবিধ তরকারী দিয়ে খাওয়ার পর ভাবী পরিবেশন করেন ফালুদা যা চট্টগ্রামের লিবার্টির ফালুদার চেয়ে কোন অংশে কম মজাদার ছিলোনা। খাওয়ার পর ভাবী, তাঁর ননদরা সবাই মিলে গল্প হোল। আলী হাসান ভাইয়ের বাবার লেখা 'কাবা শরীফের ইতিহাস' আমার পড়া সবচেয়ে তথ্যসম্বৃদ্ধ বইগুলোর একটি। ইচ্ছা আছে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করব আমাদের যাওয়া উপলক্ষ্যে ভাবী আলী হাসান ভাই এবং হাফিজ সাহেবের আরো কিছু বন্ধুবান্ধবকে খবর দেন। তার মধ্যে খালেদ ভাই নিউ জার্সী থেকে এসে পৌঁছান। তারপর আবার বেচারা একঘন্টার জ্যাম ঠেলে আমাদের বাসায় দিয়ে আসেন।

 

বাসায় পৌঁছে দেখি খালুর এই প্রাণান্তকর অবস্থার মধ্যে তাঁরা গিয়ে আমার আর রাদিয়ার জন্য জামা কিনে এনেছেন। মনে মনে একপ্রকার কষ্টই পেলাম যে আমরা আসার কারণে তাঁদের এই কষ্ট। কিন্তু খালাখালুর ভালবাসা উপেক্ষা করতে পারলাম না, বিশেষ করে যেখানে জামাগুলো এত সুন্দর। পরদিন বাল্টিমোর রওয়ানা হব তাই জামাকাপড় গুছিয়ে শুতে গেলাম।

 

১৮ই সেপ্টেম্বর

আমরা যারা অনার্সে একসাথে পড়েছি তার মধ্যে বেশ কিছু বান্ধবীর বিয়ে হয় বিদেশে অবস্থানরত পাত্রের সাথে, আবার কিছু কিছু বান্ধবী বিয়ের পর সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমায়। আমাদের সবচেয়ে বন্ধুবৎসল সহপাঠী ছিল বর্ণালীওর কাছে মোটামুটি সবার খবরাখবর পাওয়া যায়সে স্বামীর সাথে নিউ ইয়র্ক চলে আসে আমরা ক্যাল্গেরী আসার কিছুদিন পরই, লং আইল্যান্ডেই থাকে। নিউ ইয়র্ক যাবার প্ল্যান হবার সাথে সাথে সবার আগে ওর সাথেই যোগাযোগ করি, অথচ আসার পর থেকে ফোনে পর্যন্ত কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠছিলোনা। মেয়েদের জীবনের বাস্তবতাই এমন যে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন, স্বামীর বন্ধুবান্ধব নিজের আত্মীয়বন্ধুদের চেয়ে প্রায়োরিটি পায়। যে বান্ধবীরা ছুটিতে দেশে যান তাঁরা ফিরে এসে অতৃপ্তি প্রকাশ করেন যে বাপের বাড়ী আর শ্বশুরবাড়ীর মাঝে ছুটাছুটি করতে করতেই ছুটিটা কেটে গেলএখানে ব্যাস্ত জীবন, পরিকল্পনা থাকে দেশে গেলে হয়ত বিশ্রামের সুযোগ হবে। অথচ কার্যত দেখা যায় উভয়পক্ষের লোকজনকে খুশি করতে করতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে আসা হয়, তারপর আবার সেই কাজের সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়াযাই হোক, বর্ণালীর সাথে প্ল্যান হয়েছিল সকালে ওর বাসায় নাস্তা খেয়ে ওদিক থেকেই আমরা সরাসরি বাল্টিমোর চলে যাব। সকালে উঠে দেখা গেল রুশার গাড়ির চাকা বদলানো প্রয়োজন। রুশা তখন ইউনিভার্সিটিতে, গাড়ীর কাগজপত্র কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। কাগজপত্র ছাড়া আমরা গাড়ী নেবনা। খালা খালু গাড়ী ভাড়া করে যেতে দেবেন না। সব মিলে এক জগাখিচুড়ি অবস্থা। ওদিকে বর্ণালীর অফিসের সময় হয়ে গেল। হাফিজ সাহেব বললেন, 'চল, আমরা আগে গিয়ে বর্ণালীর সাথে দেখা করে আসি, নইলে হয়ত আর দেখাই হবেনা'।

 

আমরা যতক্ষণে বর্ণালীর বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে ওর অফিসে যাবার সময় পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ও অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে দেরীতে যাবে। আমার এই বন্ধুপাগল বান্ধবীটির বিশেষত্বই এই যে ওর কাছে বন্ধুরা সবার আগে। যাবার সাথে সাথে সে আফসোস করতে লাগল ওর স্বামী অফিসে আর মেয়ে স্কুলে চলে গিয়েছে, যেন আমাদের জন্য সবাই কাজ বাদ দিয়ে বসে থাকবে! ওর শ্বশুরবাড়ী চট্টগ্রাম। ক্যাল্গেরী চলে আসার আগে যখন শেষবার ওর সাথে দেখা করতে গেছিলাম তখন ওর এক জায়ের মেয়েকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে বলেছিল। দেখি উনি এখানে চলে এসেছেন মেয়েসহ! ওর শাশুড়িও এসেছেন বেড়াতে। ওর ঘর, বাগান ঘুরে দেখলাম। ওর বানানো মজার মজার নাস্তা খেলাম। অনেকের খোঁজখবর পাওয়া গেল। ও ভাল আছে এটা নিজ চোখে দেখে আনন্দিত হলামকথাপ্রসঙ্গে ও জানাল এক বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখে গৃহকর্ত্রীর মা আমাদের চেনেন, তবে কিভাবে চেনেন বর্ণালী জানেনা। ঐ বাসায় ফোন করে জানতে পারলাম তিনি আই আই ইউ সি'র সাবেক প্রো ভিসি লোকমান স্যারের স্ত্রী, নিউ ইয়র্কে মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। ওনাকে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখা গেল উনি তখন এডমন্টন চলে এসেছেন ছেলের বাসায়। যাক, এডমন্টন ক্যাল্গেরী থেকে আড়াই ঘন্টার পথ, ফিরে এসে যাওয়া যাবে। তবে আমরা ফিরে আসার পাঁচদিন পর তিনি নিজেই ক্যাল্গেরী আসেন, আমাদের বাসায় বেড়াতে এলে বহুদিন পর আবার তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়।

 

আমরা চলে আসার একটু আগে বর্ণালী বলল, 'ভুলেই গেছিলাম, মমি বলেছিল তুই এলে ফোন দিতে'।

অনার্স জীবনে আমরা চার বান্ধবী সবসময় একসাথে থাকতাম- শিমু, মমি, সিমিন আর আমি। এর মধ্যে শিমু ছিল ফিলোসফার, মমি ছিল সিনসিয়ার, সিমিন ছিল কমেডিয়ান আর আমি ছিলাম সিরিয়াস। এছাড়া আমাদের আরেকটা বিশেষত্ব ছিল- আমাদের একজন ভি করে গায়ে ওড়না দিত, একজন আধামাথা ঢেকে ওড়না পরত, একজন পুরামাথা ঢাকত, আরেকজন মুখসহ ঢাকত- কিন্তু তখন মানুষ অনেক বেশি উদারপন্থী ছিল, এগুলো কখনোই আমাদের বন্ধুত্বে অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়নি। আমরা প্রতিবছর ৮ই মে যেকোন এক জায়গায় মিলিত হতাম, একেকজন একেকরকম খাবার তৈরী করে নিয়ে আসত আর তার স্বাদ যেমনই হোক সেটাই অমৃত মনে করে খেতাম। ৮ই মে কেন সেটা অবশ্য আমরা কেউই জানিনা! একবার ৮ই মে উদযাপিত হয় আমার বাসায়। আমাদের ডাইনিং রুমের ফ্যানটা উৎকট রকম ঘটঘট শব্দ করত। এর মধ্যে আমরা বসে বসে মমির হাতের মজাদার মটর পোলাও খাচ্ছি। শিমু বলল, 'মনে করি, আমরা প্যারিসের রেস্টুরেন্টে মিউজিক শুনে শুনে খাচ্ছি, তাহলে ফ্যানের শব্দটা মিষ্টিমধুর মনে হবে!'

আমাদের যেকোন কাজ করতে হলে মমিকে বলার সাথে সাথে ও করে দিত, তাই পুরো ক্লাস ওকে 'সিনসিয়ার' ডাকত। আর সিমিনের এক একটা কথা শুনলে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যেত। একবার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, ক্যান্টিনের সিঙ্গারা অখাদ্য, রাস্তার ওপাড়েই আয়মানস যেখানে মজার মজার সব খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু মাঝখানে বিরাট লোহার গেটটা শেকল দিয়ে তালা মারা। আমি মনে মনে ভাবছি, 'কারার ঐ লৌহকপাট, ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট ...'মমি বলল, 'আমরা একটু ঘুরে অন্য গেট দিয়ে যেতে পারি'। শিমু বলল, 'শুধু খাওয়ার জন্য এত কষ্ট করব?' সিমিনের চটপট উত্তর, 'রাসূল (সা) বলেছেন জ্ঞানার্জনের জন্য চীনদেশে যেতে, আর আমরা খাওয়ার জন্য আয়মানসে যেতে পারবনা?!'

 

মমি থাকে নিউ জার্সীিউ ইয়র্ক যাবার আগে ওর সাথে ফোনে কথা হয়েছে, কিন্তু যাবার পর কিছুতেই ও আমাকে পায়না আর আমি ফোন করারই সময় পাইনা। ওর সাথে কথা বলতে বলতে জানালাম ভার্জিনিয়া যাচ্ছি, ফেরার পথে ওর বাসা হয়ে আসবমমি বলল, 'ওখানে আমাদের এক বান্ধবী আছে, আন্দাজ কর তো কে?' আমি একজনের কথা বললাম। ও বলল, 'নাহ, সে না। এ যে অ্যামেরিকা এসেছে তা আমি নিজেই দু'দিন আগেও জানতাম না'। বুঝতে পারলাম না কে হতে পারে। খানিক পরে মমি নিজেই পরিষ্কার করে দিল, 'সিমিন ভার্জিনিয়া এসেছে আড়াই বছর হয়ে গেল অথচ দুষ্টটা আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করেনি!' আমি তো শুনেই চিৎকার! হাফিজ সাহেব বলে, 'কি হোল? কোন দুঃসংবাদ?' এমন বেরসিক লোকের সাথে কি করে যে থাকি আমি! খুশির চিৎকারও বোঝেন না। সিমিনের নাম্বার নিলাম। তারপর বর্ণালীর বাসা থেকে বেরোলাম। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলে হয়ত আগে ভার্জিনিয়া যাওয়া যেতে পারে।

 

খালার বাসায় যেতে যেতে ছাত্রীজীবনের নানান মজাদার ঘটনা স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে লাগল। তবে পৌঁছে কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম। চাকা ঠিক করতে করতে বেজে গেল তিনটা। অচেনা জায়গায় দিনের আলো থাকা অবস্থায় ভ্রমন করতে পারলে চিনতে সুবিধা হয়। কিন্তু সমস্ত কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে করতে ছয়টা বেজে গেল। তবু এক ঘন্টার মত দিনের আলো পাওয়া যাবে ভেবে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। ভার্জিনিয়া যাওয়া অসম্ভব, বাল্টিমোরই যেতে হবে। তবে বিধি বাম। বর্ণালীর বাসা পর্যন্ত পৌঁছতে সকালে লেগেছিল আধঘন্টা, এখন ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঐটুকু পথ যেতে চলে গেল এক ঘন্টা। কুইন্স পেরোবার আগেই অন্ধকার নামল, জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজে যখন উঠছি তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। তবে রাতের বেলা বলেই হয়ত দোতলা ব্রিজটার মাহাত্ম বেশি চোখে পড়লব্রিজ পেরিয়ে নিউ জার্সী ঢুকতেই পড়ল সব ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। সি এন এন চ্যানেলে যেসব পরিবেশ দূষণের রিপোর্ট দেখতাম সেগুলো এবার সচক্ষে দেখা হোল, আসলেই বীভৎস ব্যাপারএই এলাকাটা পেরিয়ে একটা ফিলিং স্টেশনে দাঁড়িয়ে আমরা গাড়ীতে তেল ভরলাম, গাড়ী পরিষ্কার করলাম, পাশের রিফ্রেশমেন্ট সেন্টারে অজু করে নামাজ পড়লাম, হাফিজ সাহেব কফি কিনলেন- এই বিচ্ছিরি জিনিসটা খেতে বিস্বাদ হলেও ঘুম নিরোধক হিসেবে চমৎকার, তবে আমি খাই চুইং গামআবার পথে নামলাম আমরা।

 

হাফিজ সাহেব চালক হিসেবে ভাল আর আমি খোলা রাস্তায় ন্যাভিগেটর হিসেবে ভাল যদিও আমাকে গলিপথে ছেড়ে দিলে আমি ধাঁধায় পড়ে যাই। জীবনের পথটা যেমন একা চলা যায়না তেমনি হাইওয়েতেও অ্যাসিস্ট্যান্ট ছাড়া গাড়ী চালানো যায়না, ক্লান্তি এসে যায়, পথ ভুল হতে চায়খালার বাসা থেকে বালিশ নিয়ে এসেছিলাম দু'টো। পেছনে বাচ্চারা দু'জন দুটোতে হেলান দিয়ে ঘুম, অবশ্যই সীট বেল্ট বেঁধে শুয়েআমরা দু'জন কথা বলছি, উনি চালাচ্ছেন, আমি পথ দেখাচ্ছি। এভাবেই চার ঘন্টা, অনেক দূর পথ, অনেক নদী, অনেক ব্রিজ, অনেক টোল বুথ আর অনেক সুন্দর সময় কেটে গেল। পৌঁছে গেলাম নূসরাতের বাসায়। এর মধ্যে খালা আর নূসরাত যে কতবার ফোন করেছে! খালা ভাবছেন, 'ওরা যদি হারিয়ে টারিয়ে যায় তাহলে আমি আপাকে কি জবাব দেব?' আর নূসরাত ভাবছে সকাল থেকে রাত হয়ে গেল, চারঘন্টার পথ ফুরোচ্ছে না কেন?! বেচারী তো আর জানেনা আমাদের নিউ ইয়র্ক থেকে বেরোতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে!

 

পৌঁছনোর সাথে সাথে নূসরাতের বর শামস নেমে এলো, হাফিজ সাহেব আর শামস মিলেই জিনিসপত্র সব টেনে তুলল দোতলায়। নূসরাতের এক বেডরুম বাসাটা সুন্দর গোছানো ছিমছাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। বুঝলাম, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে কথাটা সত্য বটে। আমার এই পি এইচ ডিধারী বোনটা যেমন পড়ে, তেমন লেখে, তেমনই গুছিয়ে সংসার করে, তেমনই রাঁধে আবার তেমনই ছড়ি ঘুরায়। শামস বলল, 'আপু, আপনারা আসবেন দেখে আমি আজকে অনেক কাজ করেছি'। জিজ্ঞেস করলাম, 'কি কি করলে?' ও বলল, 'কোন চাদরটা বিছালে নূসরাতের বকা খেতে হবেনা সেটাই ভেবেছি তিনঘন্টা ধরে!' খুব মজা পেলাম ওর কথায়। আর নূসরাত দেখি এত রান্না করেছে যে টেবিলে রাখার জায়গা নেই, প্লেট গ্লাস পানি দেয়ার জন্য আলাদা টেবিল প্রয়োজন হচ্ছে! খেতে খেতেই অনেক গল্প হোল- পি এইচ ডি'র পড়া কোন পর্যায়ে, এর পর পরিকল্পনা কি, আমাদের দিনকাল কেমন কাটছে, নিউ ইয়র্ক কেমন লাগল ইত্যাদি। নূসরাত এর আগে একদিন আমাদের সাথে কথা বলার জন্য খালার বাসায় ফোন করেছিল। সেদিন আমরা ম্যানহাটন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, ওর কথা হয় খালুর সাথে। ও পরিচয় দিলো, 'আমি রেহনুমার ছোট বোন'। খালু বললেন, 'ওর তো বোন নেই, তুমি কেমন বোন?' নূসরাতও মজা করে বলল, 'আমি ওনার পাতানো বোন'। খালুর খুব পছন্দ হোল বুদ্ধিমতি মেয়েটিকে, তেমনি নূসরাতেরও পছন্দ হোল মজার মজার কথা বলা খালুকে

 

খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে সোফা বেড পেতে রাদিয়া রিহামের ঘুমের বন্দোবস্ত হোল, আমাদের দেয়া হোল বেডরুমে আর আমরা যাতে আরাম করে থাকতে পারি সেজন্য বেচারারা নিজেরা স্বেচ্ছানির্বাসিত হোল পাশের বাসায়। এমন স্বার্থপর বড়বোন কেউ কোনদিন দেখেছে? কোথায় ফ্লোরিং করে সারারাত গল্প করব! কিন্তু আসলে সবাই ছিল ক্লান্ত। আমরা জার্নি করে ক্লান্ত, আর ওরা সারাদিন ঘর গুছিয়ে রান্না করে ক্লান্ত। তাই গল্প আপাতত শিকেয় তোলা রইল।

 

ঠিক হোল, সকালে নূসরাত ল্যাবে গিয়ে কাজ সেট করে আমাদের সাথে ওয়াশিংটন যাবে। তারপর ভার্জিনিয়া যাবার চেষ্টা করব। কারণ তার পরদিনের প্রোগ্রাম অলরেডি সেট করা- সুতরাং হাতে সময় এই একদিনই।  তারপর আমরা ঘুমের রাজ্যে অবগাহন করতে যার যার রুমে আশ্রয় গ্রহণ করলাম।

 

১৯এ সেপ্টেম্বর

ভোর থেকেই রান্নাঘরে নানারকম আওয়াজ পাচ্ছি আর মজাদার সব গন্ধ, কিন্তু কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিনা যে উঠে গিয়ে একটু হাত লাগাব, ক্লান্তি আর সর্দি মিলে ভালই কাবু করে ফেলেছে। যতক্ষণে উঠলাম তখন আমি ছাড়া সবাই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। নূসরাত আবার অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাল। নাস্তা দিয়েও যে টেবিল ভর্তি করে ফেলা যায় তা প্রমাণ করার জন্যই যেন এত আয়োজন!

 

আজকের দিনটাই সম্বল। তাই আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এর ভেতরেই গুনবতী নানারকম খাবার, পানীয় আর আমার প্রবাহমান নাকের সেবায় টিস্যুর আস্ত রোল নিয়ে নিয়েছে। আমরা প্রথমে গেলাম ওদের ক্যাম্পাসে। ভারী সুন্দর শান্ত একটা ক্যাম্পাস, দেখলেই পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করেনূসরাত সেদিনের কাজটা ল্যাবে সেট করে সুপারভাইজারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে পনেরো মিনিটের ভেতর এসে হাজির! আমরা রওয়ানা হলাম ওয়াশিংটন ডিসি

 

ওয়াশিংটন ডিসির ডিসি শব্দটা ডিস্ট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়ার সংক্ষেপিত রূপযেহেতু যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো রাষ্ট্রের সমষ্টি, যখন একটি রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন আসে তখন সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এটি কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেনাসেই মোতাবেক ১৭৯১ সালে ভার্জিনিয়া এবং মেরিল্যান্ডের কিছু কিছু জমি নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে ক্যাপিটল বা পার্লামেন্ট অবস্থিত হবে যেন এখানে প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব সমান মর্যাদা পায় (যদিও প্রায় ৫৫ বছর পর ভার্জিনিয়ার জমি ফিরিয়ে দেয়া হয়)। রাজধানীর নামকরণ হয় অ্যামেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্টের নামানুসারে। পৃথিবীর অধিকাংশ রাজধানীর মত ওয়াশিংটনও একটি নদীর তীরে অবস্থিত যার নাম পটম্যাকরাজধানী মুলত পার্লামেন্টকে ধারণ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন এখানে রয়েছে প্রেসিডেন্টের বাসভবন ওয়াইট হাউজ, সুপ্রীম কোর্ট, বিভিন্ন দেশের এম্বাসী, প্রচুর মিউজিয়াম এবং স্থাপত্য যার অধিকাংশই মূলত ন্যাশনাল মল এলাকার আশাপাশে অবস্থিত। এই ব্যাস্ত শহরটিতে অধিকাংশ লোকজন আশেপাশের রাষ্ট্রগুলো থেকে যাতায়াত করে কাজ করে থাকে। যাতায়াতের জন্য সড়কপথের পাশাপাশি রয়েছে দ্রুতগামী ট্রেনের ব্যাবস্থাশহরে অপরাধপ্রবণতার হার অনেক বেশি। এক সময় এই শহরের এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। পরবর্তীতে সরকারের বিবিধ পদক্ষেপের কারণে একটি বিচিত্রবর্ণ সমাজ সৃষ্টি হয়েছে।

নূসরাতদের ক্যাম্পাস থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত প্রায় পুরো পথটা বেশ গাছপালায় ঘেরা ছায়াঢাকা, পথে বাচ্চাসহ হরিণও দেখলামওয়াশিংটন পৌঁছে আমরা ন্যাশনাল মলের কাছাকাছি লোগান সার্কেলে গাড়ী পার্ক করলাম। এখানে কিছু হেরিটেজ হাউজ আছে ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে এগুলো রয়ে গিয়েছেরাদিয়া বলল, 'আম্মু, তোমাদের চট্টগ্রামের বাসাটাও তো এরকম। এটা দেখার জন্য ওয়াশিংটন আসতে হয় নাকি?' আসলে ব্রিটিশ আমলে বানানো বাড়ীগুলো একটা দেখলে মোটামুটি সব দেখা হয়ে যায়- পানখাওয়া দাঁতের মত লাল ইটের মুখগুলো প্রায়ই হয় ষড়ভুজ আকারের কিংবা চতুষ্কোণ, ছোট্ট ছোট্ট কামরা আর অনেক অনেক দরজা জানালা - এই হোল এই স্থাপত্যের সারসংক্ষেপ

 

ওখান থেকে হেঁটে ন্যাশনাল স্কোয়ারে পৌঁছে দেখি বিশাল বিশাল বাগানের মাঝে আবার সেই ইট কাঠ লোহা পাথরের স্তুপ। একটা স্তুপে ঢুকলাম- লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস- পৃথিবীর বৃহত্তম দু'টি লাইব্রেরীর একটি। এখানকার বইয়ের কালেকশন কিংবদন্তীতুল্য। কিন্তু পুরোটা ঘুরে মনে হোল একে বিদ্যামন্দির বলাই যথার্থ। প্রচুর মূর্তি, বিশাল বিশাল সব ছবি, চার্চের মত রঙ্গিন কাঁচ দেয়া জানালা, কিন্তু বই ধরাছোঁয়ার বাইরে।  বই যদি হাত দিয়ে ছোঁয়া না যায়, এর গন্ধ শোঁকা না যায়, স্পর্শ দিয়ে এর অনুভূতি পাওয়া না যায়, চোখ দিয়ে এর সৌন্দর্য অনুভব করা না যায়, মন দিয়ে এর বানী উপলব্ধি করা না যায় তাহলে কি মন ভরে? মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বের হয়ে ক্যাপিটল বিল্ডিং দেখলাম। প্রচন্ড গরমের মধ্যে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিলনা। তাছাড়া এইসব স্তুপ আর সহ্য হচ্ছিলোনা। হাফিজ সাহেবকে বললাম, 'চলেন, ভার্জিনিয়া যাই'। ওনার ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছিলোনা। কিন্তু নূসরাত যখন বলল, 'তাহলে আমি ড্রাইভ করি', উনি সাথে সাথে বললেন, 'আচ্ছা, যাওয়া যাক'। ওর ড্রাইভিংয়ের ওপর ওর ভাইয়ের আস্থার পরিমান দেখে নূসরাতও হাসতে লাগল।

 

ভার্জিনিয়া যাবার পথে ওয়াশিংটনের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো দেখতে দেখতে যেতে লাগলাম।  স্মিথসনিয়ান ইন্সটিটিউশনে যাবার খুব ইচ্ছে ছিল, এমন বিচিত্র কাহিনী সচরাচর শোনা যায়না- এক বৃটিশ বিজ্ঞানীর সমস্ত সম্পদ উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন তাঁর ভাগ্নে যিনি নিজেও নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান, মারা যাবার সময় তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ দান করে যান এমন একটি দেশে জ্ঞানের বিচ্ছুরণের জন্য যেটি তিনি নিজেই দেখেননি! কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছিলনা, মনও এই স্তুপসমূহের মাঝে হাঁপিয়ে উঠেছিল।

 

সিমিনকে ফোন করলাম, 'ভার্জিনিয়া আসছি'কিন্তু বেচারীর কাজ বিকাল পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা মনে হচ্ছিলোনা আমরা কোনভাবেই গিয়ে ওকে পাব,  তবু ফোনে কথা বললাম কয়েকবার। পথটুকু ভীষণ ভাল লাগছিল। উঁচুনীচু পাহাড়শ্রেণীর মাঝে সোজা পথ। অ্যামেরিকার রাস্তাগুলো ক্যানাডার মত এতটা প্রশস্ত নয়, লেনগুলোও অপ্রশস্ত, এর মধ্য দিয়ে ওরা গাড়ী চালায় স্পিড লিমিটের অনেক অনেক ওপরে, অধিকাংশই সীট বেল্টের তোয়াক্কা করেনা, ক্যানাডিয়ানরা আইনের প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল। নিউ ইয়র্ক থেকেই আমরা রাস্তার নিয়ম অনুযায়ী স্পিড লিমিট বজায় রেখে গাড়ী চালিয়ে আসছি আর দেখি আশেপাশে সব গাড়ী সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে! তবে এই রাস্তায় ভিড় ছিল তুলনামূলকভাবে কম।

 

দু'এক ঘন্টা পর ভূমির বিন্যাস মনে হতে লাগল যেন সমুদ্রের ঢেউ। বিশ বছর আগে রিডার্স ডাইজেস্টের একটি বই পড়েছিলাম যেখানে পৃথিবীর সব আশ্চর্য জায়গাগুলোর বর্ণনা এবং ছবি ছিল। তার মধ্যে একটি অধ্যায় ছিল শেনানদোয়াহ। এটি ছিল ইরোকি রেড ইন্ডিয়ানদের পবিত্র ভূমি, মাইলের পর মাইল জুড়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উঁচুনীচু সমভূমি, গাছপালা আর ঘাসে ছাওয়া যাকে ওরা ভালবেসে ডাকত শেনানদোয়াহ যার সম্ভাব্য অর্থগুলির একটি ছিল 'বিউটিফুল ডটার অফ দ্য স্টারস' (সুন্দরী তারকাকন্যা)। খালাত বোনকে বইটি দেখিয়ে বলেছিলাম, 'আল্লাহ যদি কোনদিন আমাকে এই জায়গাগুলো দেখতে যাবার তাওফিক দিতেন!' হাফিজ সাহেবকে বললাম, 'জায়গাটা দেখে আমার শেনানদোয়াহর বর্ণনা মনে পড়ে গেল!' একটু পর রাস্তায় সাইনবোর্ড চেক করতে গিয়ে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল, জায়গার নাম শেনানদোয়াহ! ঐ মূহূর্তের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত মন বার বার উচ্চারন করছে, 'সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি, সুবহান্নাহিল আজীম। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ!' আজ যদি আমি ঐ ইট কাঠ লোহা পাথর দেখে দিনটা কাটিয়ে দিতাম তাহলে এই অসাধারন সৃষ্টি আমার কল্পনাতেই রয়ে যেত, বাস্তবে দেখা হতনা; আজ যদি নূসরাত সামান্য কসরত না করত তাহলেও এখানে আসা হতনা; আজ যদি আল্লাহ হাফিজ সাহেবের মন পরিবর্তন করে না দিতেন তাহলেও এই অপূর্ব সৃষ্টি দেখা হতনা। বিশ বছর আগের স্বপ্ন আল্লাহ আমার অজান্তেই পূরণ করে দিলেন! অতঃপর আমি আমার রাব্বের আর কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করব?!

 

দু'চোখ মেলে দেখতে রইলাম এই মাটির সমুদ্র, যতটুকু পারি স্মৃতিতে গেঁথে নেবার আশায়। মনের অবস্থা বোঝাতে পারবনা। খালাখালুকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছি লুরে ক্যাভার্নে যাবার কথা বলার জন্য। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন গুহার কথা পড়ে আসছি। সেই গুহামানবের বাসগৃহ থেকে আজকের গুহাবাস পর্যন্ত যত গুহার কথা পড়েছি, ছবি দেখেছি তার মাঝে আমাকে সবচেয়ে আকর্ষন করত সেই সব গুহা যেগুলোতে হাজার হাজার বছর ধরে পানি চুঁইয়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে নানাধরনের অদ্ভুত প্রাকৃতিক স্থাপত্যলুরে ক্যাভার্ন তেমনই একটি গুহা। ১৮৭৮ সালে যখন জানা গেল চুনাপাথরের একটি উচ্চভূমির ফাটল থেকে শীতল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে, পাঁচজন স্থানীয় লোক কৌতুহলী হয়ে খুড়তে গিয়ে এই গুহাটি পেয়ে যায়। গুহার খবর ছড়িয়ে পড়ে এবং অ্যামেরিকায় সবকিছু যেভাবে ব্যাবসার উপায়ে পরিণত হয় তেমনি এটিও পয়সার বিনিময়ে দর্শনীয় স্থানে রূপান্তরিত করা হয়।

 

আমরা যখন গিয়ে পৌঁছাই তখন পৌনে পাঁচটা, শেষ ট্রিপের টিকেট বিক্রি হচ্ছে। নূসরাত গাড়ী থেকে নেমেই দিল দৌড়। ওর অসদুদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আমাকেও দৌড় দিতে হোল। দৌড়ে ভাল ছিলাম, বয়সের সাথে সাথে ওজন না বাড়ার কারণে অন্যদের তুলনায় উত্তরোত্তর ভালই হয়েছি।  ক্যাভার্নের টিকেটের দাম ভালই, নূসরাতের সাথে ধস্তাধস্তি করে টিকেট কিনলাম। তবু সে দমে যাবার পাত্রী নয়, ওর কাছে ডিসকাউন্ট কার্ড ছিল, ওটা দিয়ে টিকেটের দাম কিছু কমাল।  ট্রিপ শুরু হতে পনেরো মিনিট সময় ছিল। ততক্ষণে সবাই আসর নামাজ পড়ে নিলাম।

 

গুহায় ঢুকলাম পাঁচটায়। একঘণ্টার ট্যুরে সাথে গাইড আছে নানান বিষয় বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। এই গুহাটি  একসময় পানিতে পরিপূর্ণ ছিল, অম্লধর্মী সেই পানি গুহাভ্যন্তরের নরম চুনাপাথরকে গলিয়ে খালি জায়গার সৃষ্টি করে। পরে পানি সরে যেতে থাকে এবং চুঁইয়ে পড়া পানি অবশিষ্ট চুনাপাথরকে নানান বিন্যাসে সাজিয়ে একটি অনবদ্য প্রাকৃতিক স্থাপত্য সৃষ্টি করে। গুহাভ্যন্তরের এই স্থাপত্য মূলত চুনাপাথরের তৈরী হওয়ায় সৃষ্টিগতভাবে শ্বেতবর্ণ। তবে এর মধ্যে লৌহের উপস্থিতির কারণে লাল কিংবা হলুদ; তামার উপস্থিতির কারণে নীল বা সবুজ; এবং ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইডের কারণে কাল বর্ণ ধারণ করতে পারে। এটি এখনও জীবিত অর্থাৎ এখানে এখনো পানি চুঁইয়ে পড়ে নতুন নতুন স্ট্যালেগমাইট এবং স্ট্যালেকটাইট তৈরী হচ্ছে।  পানির সাথে যে খনিজ থাকে তা যখন মাটির ওপর জমা হতে হতে ওপর দিকে উঁচু হতে থাকে তখন তাকে স্ট্যালেগমাইট বলে। আর যদি তা ওপর থেকে ঝুলতে ঝুলতে নীচের দিকে নামতে থাকে তখন তাকে স্ট্যালেকটাইট বলে। এর প্রতি কিউবিক ইঞ্চি তৈরী হতে পানির ধারার ওপর নির্ভর করে ১২০ থেকে ৩০০ বছর সময় লাগে। অর্থাৎ আমরা ঐ মূহূর্তে যা দেখছি তা পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে!

 

এখানে তাপমাত্রা ছিল ১২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। অ্যামেরিকায় আসার পর থেকে গরমে কষ্ট পাচ্ছিলাম যেহেতু এখানে ক্যানাডার চেয়ে তাপমাত্রা বেশি। এবার শান্তিতে হাঁটা এবং দেখা যাচ্ছিল। গুহায় যে কতরকম বিন্যাস ছিল সব আলোচনা করে শেষ করা সম্ভব নয়- একেবারে প্রাচীন ও মজবুত স্ট্যালেগমাইট আর স্ট্যালেকটাইট মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে এমন থেকে এখনো গাঠনিক পর্যায়ে আছে এমন পাথরও ছিল। তবে আমাকে যে জিনিসগুলো সবচেয়ে আকর্ষন করেছে তার মধ্যে কয়েকটি জিনিস তুলে ধরা যেতে পারে। গুহায় বিভিন্ন স্থানে মানুষের হাড়গোর পাওয়া গিয়েছে তবে একটি লাশ সম্পূর্ন পাওয়া যায়। মেয়েটিকে সম্ভবত তার আত্মীয় স্বজন কবর দিয়ে চলে যায়, পরে মাটি ধ্বসে পড়লে সে সরাসরি গুহায় পড়ে যায়। রেড ইন্ডিয়ান মেয়েটির সম্মানে ওরা স্থানটির নাম দিয়েছে দ্য প্রিন্সেস চেম্বার। খুব মজা পেলাম। মেয়েটি জীবিত থাকলে এই সম্মান পেত কিনা সেটা আলোচনার অবকাশ রয়েছে। মানুষ মৃত ব্যাক্তিকে যে সম্মান দেয় সেটা জীবিত ব্যাক্তিকে দেয় না কেন সেটা আমার কাছে একটা বিস্ময়। মৃত ব্যাক্তি কি সম্মান অসম্মান বোঝার মত অবস্থায় থাকে? জীবিত ব্যাক্তিই কি সম্মানের বেশি হকদার নয়?

 

একটি জায়গা অসাধারন লাগল। ওপরে প্রচুর স্ট্যালেকটাইট, দেয়ালের মত একটি পাথরের আড়ালে থাকায় এদের দেখা যায়না। নীচে ওদের চুঁইয়ে পড়া পানি জমা হয়ে একটি সরোবরের মত সৃষ্টি করেছে। ওখানে স্ট্যালেকটাইটের ছায়া এত স্পষ্ট দেখা যায় যে মনে হয়ে সব পানির নীচে স্ট্যালেগমাইট! অসাধারন সুন্দর এই প্রতিচ্ছায়া কাঁচের ওপর প্রতিফলনের চেয়েও যেন বাস্তব!

 

এক জায়গায় দেখলাম একটি বিশাল স্ট্যালেকটাইট, অন্তত তিনতলার চেয়ে কম উচ্চতার হবেনা, ভূমিকম্পে উপড়ে পড়ে ওভাবেই শুয়ে আছে। ঐ মূহূর্তে ভূমিকম্প হলে আমাদের কি হতে পারে ভেবে শিউরে উঠলাম যদিও জানি এগুলো সহজে খসে পড়েনা।

 

এক জায়গায় কর্মচারীরা ভুলে দু'টি মিনি সাইজের স্ট্যালেগমাইট ভেঙ্গে ফেলেছিল।  তবে এর ফলে দেখার সুযোগ হয় এই পাথরগুলোর ভেতরটা দেখতে কেমন হয়। অবিশ্বাস্য হলেও এগুলো দেখতে হুবহু ডিম ভাজির মত, মধ্যখানে একটা খনিজ কুসুম আর বাইরে ডিমের শ্বেতাংশের মত জমা হওয়া পাথর!

 

তবে যে স্থাপত্যটি দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলামনা তা ছিল এমন কিছু পাথর যা ঝরঝর করে পানি পড়লে সৃষ্টি হয় পানির স্রোতের কারণে এখানে এক ইঞ্চি পাথর তৈরী হতে লাগে তিনশ বছর। কিন্তু এগুলো দেখতে যেন দামী পর্দার মত, চওড়া পর্দায় ভাঁজ ভাঁজ, এক ইঞ্চির আটভাগের এক ভাগ পুরু এই পর্দার ভেতর দিয়ে আলো দেখা যায় অথচ আদতে এগুলো পাথর! এর সৌন্দর্য যতই দেখি তবু যেন মন ভরেনা!

 

এখানেও মানুষের আধিপত্য বিস্তারের কিছু চিহ্ন চোখে পড়ল- গুহায় ঢুকতেই প্রথম স্ট্যালেগমাইটটির নাম ওয়াশিংটন; একজোড়া পিলারসদৃশ স্টালেগমাইট যার সাথে স্ট্যালেকটাইট মিলে গিয়ে একাকার হয়ে গিয়েছে, এখানে প্রচুর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই আশায় যে এই সম্পর্কে এই পিলারের মত হবে; একটি  সরোবর যেখানে কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন মানত করে পয়সা ছুঁড়ে গুহামালিকের সম্পদ বৃদ্ধি করে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহতদের তালিকা; সম্পূর্ন গুহাটিকে একটি বাজনায় রূপান্তরিত করা। তবু আল্লাহর এই অনবদ্য সৃষ্টি দেখে চোখ আর মন উভয়ই তৃপ্ত হোল।

 

বের হয়ে দেখি সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নূসরাত যে খাবার এনেছিল তাই খাওয়া হোল। তারপর মাগরিব পড়ে আবার বাল্টিমোর রওয়ানা হতে হোল। তখনও পৌঁছতে এগারোটার পর হবে। সিমিনের কাজ শেষ হবে এগারোটায়। সুতরাং কোনভাবেই ওর সাথে দেখা করা সম্ভব নাএই একটি অপূর্ণতা নিয়ে ফিরে চললাম।

 

আমরা তখন পথে, নূসরাত শামসকে ফোন বলল ভাত বসিয়ে দিতে, আলু সেদ্ধ করতে। গুনবতী পৌঁছে মাত্র এমন মজার এক আলু ভর্তা বানাল যে অন্য সব তরকারী বাদ দিয়ে আমরা ভর্তা দিয়ে রাতের খাবারটা তৃপ্তি সহকারে খেলামশুতে যাবার আগেই নূসরাতের ভাইয়ের একটি সুখবর পেলাম। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি দিন শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে ঘুমাতে গেলাম।

 

২০এ  সেপ্টেম্বর

সকালে উঠেই হুলস্থুল করে গোছগাছ শুরুনিউ জার্সি হয়ে নিউ ইয়র্ক যেতে হবে। সময় ঠিকমত মিলাতে না পারলে সিমিনের মত আরো কিছু হয়ত মিস হয়ে যাবেওদিকে নূসরাত নানান পদের নাস্তা বানাচ্ছে যেন এক সপ্তাহ থাকলে যা খাওয়াত তার একটা নমুনা দিয়ে রাখ চায় যাতে ভবিষ্যতে দীর্ঘতর অবস্থানের পরিকল্পনা নিয়ে আসি। খেয়েদেয়ে বেরোবার সময় নূসরাত আবার পথের জন্য কিছু খাবার দিয়ে দিল, এমনকি আমার নাকের বন্যায় বাঁধ দেয়ার জন্য টিস্যূর রোল পর্যন্ত দিতে ভুললনা। ওর সাথে ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ে বসে গল্প করা হোলনা, ছোট বোনটাকে কিছু কিনে দেয়া হোলনা, মায়ার বাঁধনটা কাটিয়ে ঠিকভাবে বিদায় নেয়ার পর্যন্ত সময় হোলনা। আবার আমরা পথে নামলাম।

 

যাবার সময় রাতের অন্ধকারে পথের পাশে কিছুই দেখতে পাইনি। ফেরার সময় দেখলাম পুরো পথটাই গাছপালায় ঘেরা। পটম্যাক নদী দেখে মনে পড়ল সম্ভবত 'দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস' উপন্যাসে পড়েছিলাম কিভাবে নব আবিষ্কৃত এই মহাদেশে ভূমি দখলের প্রতিযোগিতায় ফরাসী আর ইংরেজদের যুদ্ধে পটম্যাকের পানি বহুবার লোহিতবর্ণ ধারন করেছে। ব্রিটিশ এবং অ্যামেরিকান সাহিত্যের কাঠামোগত দিক থেকে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ব্রিটিশ সাহিত্যে গল্প শুরুর আগে স্থান কাল পাত্র এমনভাবে বর্ণনা করে নেয়া হয় যেন পাঠক মানসপটে ঐ স্থানে পৌঁছে ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। অ্যামেরিকান সাহিত্যে আপনি পুরো উপন্যাস শেষ করার পরেও বুঝতে পারবেন না ঘটনাটা কোথায়, কোন যুগে ঘটেছে, কিংবা যার সাথে নায়কের ঝগড়া সে তাঁর ডানপাশের বাড়ীতে থাকে না বাঁপাশের প্রতিবেশী।  এক্ষেত্রে 'দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকানস' ব্যাতিক্রম। এখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে নব্য উপনিবেশ স্থাপনকারীরা কখনো বন্ধু সেজে, কখনো শত্রুর বেশে স্থানীয় অধিবাসীদের বিলোপ সাধন করেছে। লেখায় স্থান কাল পাত্র স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে এবং রেড ইন্ডিয়ানদের হেয় করার পরিবর্তে তাদেরও যে একটি কৃষ্টি ছিল, সংস্কৃতি ছিল তা তুলে ধরা হয়েছে। তাই এই বইটি আমার খুব প্রিয়। এসব ভাবতে ভাবতে ন্যাভিগেশনে অমোনযোগী হয়ে পড়েছিলাম। হাফিজ সাহেব ফিরিয়ে আনলেন বর্তমানে, 'এবার তো পথ দেখাও!'

 

পথে হাফিজ সাহেবের তিনজন বন্ধু ফোন করলেন যারা নিউ জার্সিতে থাকেন। কথা ছিল আমরা নিউ জার্সিতে যে গন্তব্যে যাব তাঁরা সেখানে এসে দেখা করে যাবেন। কিছুক্ষণ কথা বলার পর স্পষ্ট হোল তাঁরা নিউ জার্সিতে থাকলেও উভয় স্থানের মাঝে দুরত্ব এত বেশি যে শুধু আসতেই দু'ঘন্টা লাগবে। কর্মদিবসের মাঝে চারঘন্টা কেবল যাতায়াতে ব্যায় করে বন্ধুর সাথে দেখা করা কোনভাবেই পোষায় না। তাই পথেই নির্ধারন হয়ে গেল তাদের সাথে দেখা হচ্ছেনা। এটাই অ্যামেরিকায় জীবনের বাস্তবতা।

 

আড়াই ঘন্টায় পৌঁছলাম মমির বাসায়। আমরা পথে থাকাকালীন মমি বার বার ফোন করছিলআমরা যখন ওর বাসার কাছাকাছি তখন মমি ফোন করে জানাল, ‘আমি বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি, কিন্তু বাসায় আব্বু আম্মু আছে, তোমরা এসে খেতে বসে যেও’যখন ওর বাসায় পৌঁছলাম তখনও মমি ফেরেনি। আমার সৌভাগ্য, আমার সব বন্ধুদের বাবামায়েরা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আংকেল আন্টির সাথে দেখা হোল অনেক বছর পর, কিন্তু তাঁদের সাথে কথাবার্তা বলতে গিয়ে মনে হোল বুঝি গতকালই দেখা হয়েছে! দু’জনে অনেক স্মৃতিচারণ করলেন, জানালেন এমনকি মমির চাচীও আমার সাথে দেখা হবে শুনে আনন্দিত যদিও তিনি থাকেন অন্য স্টেটে। একটু পর মমি এসে পড়ল ওর তিন বাচ্চা নিয়ে। আমাদের শেষবার যখন দেখা হয় তখন দু’জনেরই নতুন বিয়ে হয়েছে। ওর স্বামীকে আমরা দেখিনি। সে দেশ ছেড়ে চলে আসবে, তাই একজনের কাছ থেকে বাইক জোগাড় করে হাফিজ সাহেব আর আমি অনেক দূর পথ পেরিয়ে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এবার আবার দেখা হোল পনেরো বছর পর যখন সে তিন সন্তানের মা আর আমার দুই সন্তানমজা পেলাম দেখে যে মমিরও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, মনে হচ্ছে যেন সেই আগের মমি। বাচ্চাদের সময় দেয়ার জন্য সে বাসায় বসেই ট্র্যাভেল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, ড্রয়িং রুমের একপাশে ওর সাজানো অফিস। তবে একটা কথা না বললেই নয়। নিউ ইয়র্কের ঘিঞ্জির পর ওর বাসাটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। রাদিয়া বলল, ‘আম্মু, আন্টির বাসাটা দেখে মনে হচ্ছে আমরা ক্যাল্গেরী ফিরে এসেছি!’

 

খেতে বসে চোখ কপালে উঠল, কত কিছু যে রান্না করেছে মমি! তবে ও সবকিছু বাদ দিয়ে নানাবিধ আচার সম্বলিত বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো, ‘আমার মনে আছে তুমি ভাতের সাথে আচার খেতে পছন্দ কর’। আসলেই আমি এমনিতে আচার খাইনা, তবে ভাতের সাথে খেতে পছন্দ করি। এই ছোট ছোট জিনিসগুলো শুধু তারাই মনে রাখে যারা আপনাকে আন্তরিকভাবে ভালবাসে। আমার বিয়ের পর একবার আমার দাদার ছোটবোন- যাকে আমি ছোটবেলায় নাম দিয়েছিলাম ভালদাদু যেহেতু এই দাদুর কাছেই থাকা হত বেশি, আহ্লাদও পাওয়া যেত বেশি- আমাদের রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছে। সকালে এমনিতেই দেখতে গেলাম দাদু কি করছে। গিয়ে দেখি দাদু ডাইনিং রুমে বসে চাউল বাছছে। দাদুর বাসায় দশ বারোজন কাজের লোক। তাই আশ্চর্য হয়ে বললাম, ‘কি ব্যাপার দাদু? তুমি চাল বাছছ কেন?’ দাদু বলল, ‘এগুলো বাছা চাল’। তখন আরো আশ্চর্য হলাম, ‘বাছা চাল আবার বাছছ কেন?’ দাদু বলল, ‘তোমার জন্য’। এবার একেবারেই বোকা বনে গেলাম, ‘আমার জন্য!’ দাদু মুচকি হেসে বলল, ‘দেখে নিচ্ছি মরা চাল আছে কিনা। নইলে তুমি খাবার টেবিলে বসে বাছতে শুরু করবে তাই’। ভালবাসা প্রকাশ করার জন্য আসলে মোমবাতি কিংবা ফায়ারওয়ার্কস প্রয়োজন হয়না, হৃদয় থেকে উৎসারিত অনুভূতিগুলো এমন ছোট ছোট বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে আপনিই হৃদয়কে স্পর্শ করে

 

খাওয়া দাওয়া শেষে মমি বলল, ‘দাঁড়াও, আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলার ব্যাবস্থা করে আসি’। ও হাফিজ সাহেবকে ঘুমানোর ব্যাবস্থা করে দিয়ে, বাচ্চাদের খেলার ঘরে আন্টিকে তদারক করতে দিয়ে চলে এলো। কিন্তু ওর ছেলের ফুটবল প্র্যাক্টিসে যাবার কথা, ভাইয়ার আসতে দেরী হবে। মমিকে বললাম, ‘চল, আমিও তোমার সাথে যাই। দিয়ে আসতে আসতে কথা হবে’। যাওয়া আসার পথে আমরা দু’জন মোটামুটি গত পনেরো বছরের স্মৃতিচারণ করে ফেললামকবিতা আমার প্রিয় সাহিত্যরূপ নয় কারণ আমার মোটা মাথায় কবিতা ঢোকেনা। কিন্তু রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতা ভাল লাগত আর মেটাফিজিকালদের যেহেতু এগুলো সহজবোধ্য কিংবা চিন্তার খোরাকসম্বৃদ্ধ। ব্রাউনিংয়ের ‘দ্য লাস্ট রাইড টুগেদার’ কবিতাটি আমার ভীষণ পছন্দের যেহেতু এখানে সীমিত সময়কে আশার ফোয়ারা দিয়ে অসীমে রূপান্তরিত করা হয়েছে। আমাদের এই সময়টুকুও যেন সেভাবেই কাটলফিরে এসে ভাইয়ার সাথে দেখা হোল, এই প্রথম। ভাল লাগল তাঁকে, ভাল লাগল তিনি আমার বান্ধবীটিকে ভাল রেখেছেন, ভাল লাগল মমির তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। মাগরিবের পর আমরা আবার আঙ্কেল, আন্টি, ভাইয়া, মমি আর ওর মেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, হাতে মমির দেয়া উপহার। আবার কবে দেখা হয় কে জানে! কিন্তু কিছু কিছু বন্ধন এমন হয় যেগুলো সময়ের ব্যাবধানেও থেকে যায় চির অটুট।

 

দীর্ঘ পথ পেরিয়ে প্রায় আড়াই তিন ঘন্টা পর গিয়ে পৌঁছলাম নিউ ইয়র্কের জ্যামেইকা এলাকায় এদিকটা আগে আসা হয়নি। এখানে হাফিজ সাহেবের বন্ধু তাউস সাহেবের বাসায় তাঁর ইউনিভার্সিটি জীবনের তিন বন্ধু একত্রিত হয়েছিলেন তাঁদের স্ত্রীপুত্রসহ- এই তিনজনের মাঝে একজন আজিজ ভাইয়ের বাসায় দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন যেদিন আমাদের ওনার বাসায় দাওয়াত ছিল। বহুদিন পর দেখা ওঁদের, তাই তাঁদের মনমত গল্প করতে দিয়ে আমরা ভেতরের ঘরে গিয়ে বসলামাঁদের স্ত্রীদের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। প্রথমত, আমার বিয়ের সময় এঁদের কারো বিয়ে হয়নি; দ্বিতীয়ত, তাঁদের বিয়ের সময় তাঁদের স্বামীরা অ্যামেরিকায় চলে এসেছেন ফলে তাঁদের স্ত্রীদের মাঝে যারা দেশে ছিলেন তাঁদের সাথেও আমাদের সাক্ষাত হয়নি। যাই হোক, আমার সামাজিক দক্ষতা শূন্য বললেই চলে। পরিচিত অঙ্গনে যেখানে সবাই কথা বলছেন তার মাঝে দু’একটা কথার ভাঁজ দিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারি, কিন্তু অপরিচিত স্থানে নিজের যোগ্যতার ওপর ভর দিয়ে অগ্রসর হবার মত দক্ষতার প্রচন্ড অভাব। এটাকে আবার সনাতন ভাষায় বিশ্লেষণ করা হয় ‘অহংকার’ শব্দটি দিয়েএসব জায়গায় আমি জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসের মিস্টার ডার্সিকে খুব অনুভব করি যাকে বন্ধুরা ভালবাসত, কিন্তু অচেনা লোকজন তাঁর লাজুকতাকে অহংকার হিসেবে ধরে নিতজেন অস্টেনের মত কেউ যদি এসে আমার পক্ষে সাফাই গাইতেন কতইনা ভাল হত! এই বিষয়ে আমার একটি অভিজ্ঞতা খুব মনে পড়ে। আমার এক বাহরাইনী পত্রমিতা ছিল। মেয়েটি আমার প্রথম চিঠি পেয়েই লিখে পাঠাল, ‘আমার ধারণা তুমি প্রচন্ড অহংকারী’! আমি তো বিধ্বস্ত! কি ব্যাপার, কেন তার এমন মনে হোল? তখন সে বলল, ‘তুমি টাইপ করে চিঠি লিখলে কেন?’ আমি প্যাঁচানো অক্ষরে ইংরেজী লিখি এবং হাতের লেখাও ঠিক মুক্তার মত নয়, সেজন্য টাইপ করে দিয়েছিলাম যেন তা ওর জন্য সহজপাঠ্য হয় আর ফল হোল এই! কিন্তু তখন আমি উপলব্ধি করলাম মানুষ কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস দিয়ে অন্যকে বিচার করে। দু’বছর পর অবশ্য সে লিখে পাঠিয়েছিল, ‘তুমি মোটেই অহংকারী নও। তোমার ব্যাপারে আমার প্রথম ধারণা সম্পূর্ন ভুল ছিল’। তাউস সাহেবের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার সময় মোটামুটি সব ভাইদের পরিবারের সাথে একটি আন্তরিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে আসতে পেরেছি আশা করি যেহেতু তাঁরা গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন

 

খালার বাসায় যতক্ষণে গিয়ে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত। বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়ে খালার সাথে কিছুক্ষণ গল্পসল্প করলাম। পরদিন হাফিজ সাহেবের আল্টিমেটাম পূর্ণ হবার দিন। যাবার আগে উনি খালুকে বলে গেছিলেন, ‘আব্বাজান, নিউ ইয়র্কে আমাদের শেষ দিন আমরা আপনাদের সাথে বেড়াব। সেদিন আপনি কোমরে কোন ব্যাথা রাখবেন না। কোন এক্সকিউজ শোনা হবেনা’। তাই দেরী না করে সবাই শুয়ে পড়লাম।

 

২১এ  সেপ্টেম্বর

সকালে উঠে খালা তড়িঘড়ি নাস্তা বানাচ্ছেন, হাফিজ সাহেব খালাকে সাহায্য করছেন, রাদিয়া রিহামকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দুই ভাইবোন তৈরী হচ্ছে, আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি দ্রুত হাতে- পরদিন ভোরে আমাদের ফিরতি ফ্লাইট, বাইরে থেকে ফিরতে রাত হতে পারে, তাই শুধু আজকের দিনে যা লাগবে তা ছাড়া সব বাক্সে ভরে রেখে যাচ্ছি। সবাই তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ডাউনটাউন পৌঁছতেই এক ঘন্টার বেশি লেগে যাবে।

 

পথে রুশাকে ইউনিভার্সিটি থেকে তোলা হোল। তারপর সোজা ডাউনটাউন। নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম অফ আর্ট দেখা বাকি রয়ে গিয়েছিল। মিউজিয়ামে যাবার পথে রুশা হৃদিতা শখ করল বিখ্যাত ‘হালাল গাইজ’এর শাওয়ার্মা খাবে। শাওয়ার্মা আমারও খুব প্রিয় কিন্তু বিশাল লম্বা লাইন দেখে বুঝলাম আপাতত এই শখ শিকেয় তুলে রাখতে হবে, নইলে মিউজিয়াম দেখা হবেনা। বিশ্বের সমস্ত ডাউনটাউনগুলোতে গাড়ি পার্কিংয়ের সমস্যামিউজিয়ামের সামনে গিয়ে দেখা গেল কোথাও গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া যাচ্ছেনা। খালু আমাদের নামিয়ে দিয়ে পার্কিং খুঁজতে গেলেন। আমরা টিকেট করার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম।

 

হৃদিতা একটা গাইডেড ট্যুর পেলএতে মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে একজন গাইড মিউজিয়াম ঘুরে দেখাবে। ভাগ্য ভাল ট্যুর শুরু হবার একটু আগে খালা খালু মিউজিয়ামে এসে ঢুকলেন। আমরা একে একে মিশরীয়, গ্রীক, চাইনিজ, ইউরোপীয় এবং আমেরিকান সভ্যতার নিদর্শনগুলো দেখে অতঃপর গাইডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইসলামী সভ্যতার নিদর্শনসমূহ দেখতে গেলাম। পাঠক আমাকে একপেশে ভাবতে পারেন তবে চাইনিজ সভ্যতা ছাড়া বাকী সবগুলো সভ্যতার নিদর্শন আমার সভ্যতার চেয়ে অসভ্যতাই বেশি মনে হচ্ছিল- প্রাচীন সভ্যতায় কোন মূর্তির গায়ে পোশাক নেই, থাকলেও যৎসামান্য। ইউরোপীয় চিত্রকলায় ধর্মীয় চিত্রেও লোকজন নগ্ন। তবে তাদের তৈজসপত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসে যে নান্দনিক শৈল্পিকতার ছোঁয়া তা কোনভাবেই চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। যেমন অনেক বাটির হাতলগুলোও মূর্তির আকারে তৈরী, ফুলদানীর গায়ে আঁকা ছবিতে বা মূর্তিতে গল্পকথার সমাহার, কিংবা একটি সাধারন মানের হাড়ির বাইরেটাতেও সমান্তরাল রেখা টেনে শিল্পী নিজের সৌন্দর্যবোধের স্বাক্ষর রেখেছে। আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ছিল একটি পিরামিডের ভেতরটার প্রতিকৃতি এবং পিরামিডের ভেতর যা যা পাওয়া যায় সেগুলোর কিছু কিছু নমুনা। শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করে এসেছেন পিরামিড তৈরী হয়েছে নীল নদের ওপাড় থেকে পাথর এনে। তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না এই পাথর নদী পার করে আনা হোল কিভাবে, টনে টনে পাথর এত কষ্ট করে টেনে না এনে ওপাড়েই কেন পিরামিড তৈরী করা হোলনা, পাথরগুলিকে এমন নিখুঁত মসৃন আয়তাকার করার মত এত উন্নতমানের যন্ত্রপাতিই বা তারা পেল কোথায় কিংবা আজ অবধি পিরামিড তৈরীর জন্য পাথরকে আকৃতি দিতে ব্যাবহৃত কোন যন্ত্রপাতির হদিস মেলেনি কেনআজ অ্যামেরিকান এবং ফরাসী বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করেছেন যে পিরামিড আদতেই পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়নি বরং এগুলো মাটি দিয়ে তৈরী বিশালাকার ইট। এবার এই আয়াতটি পড়ে দেখুন তোঃ 'ফেরাউন বলল, ‘হে পারিষদবর্গ, আমি জানিনা যে আমি ব্যাতীত তোমাদের কোন উপাস্য আছে। হে হামান, তুমি ইট পোড়াও, অতঃপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মান কর যাতে আমি মূসার উপাস্যকে উঁকি মেরে দেখতে পারি’ (সূরা ক্কাসাসঃ আয়াত ৩৮)আরবীতে ‘সারহান’ শব্দটির বাংলা করা হয় প্রাসাদ, ইংরেজীতে শব্দটিকে অনুবাদ করা হয় ‘টাওয়ার’ হিসেবে কিন্তু আমরা জানি আদতে এটি প্রাসাদও নয়, টাওয়ারও নয়। পিরামিডের গোড়া প্রাসাদের মত প্রশস্ত এবং আগা টাওয়ারের মত সুঁচালো। এমন একটি স্থাপত্যের কথাই এখানে বলা হয়েছে যার ওপর আরোহন করে ফিরাউন আল্লাহকে দেখতে চেয়েছিল। আরবী এত সম্বৃদ্ধ একটি ভাষা যাকে অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে এর প্রকৃত ভাবার্থ অনুবাদ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে এ’ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে গত সাড়ে চার হাজার বছর যাবত পিরামিডই ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্তম্ভ এবং মাত্র গত এক শতক যাবত এর চেয়ে উচ্চ সৌধ বা ভবন নির্মিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বহুদিন যাবত ভাবছিলেন শুধু মৃতের সমাধি হিসেবে এত বড় বড় সৌধ নির্মানের কি কারণ থাকতে পারে। বরং এর একটি কারণ থাকাই যুক্তিযুক্ত। আমি ভাবি, এই বিজ্ঞানীরা শত শত বছর বেকার সময় নষ্ট না করে এই একখানা আয়াত পড়লেই তো সঠিক তথ্য পেয়ে যেতেন! তবে এটাই সত্য, চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী। আমরা যারা উত্তরাধিকারসূত্রে এই অসাধারন জ্ঞানের উৎস প্রাপ্ত হয়েছি তারা যতখানি সময় অন্যান্য সূত্র থেকে জ্ঞান আহরনের প্রচেষ্টায় ব্যায় করি তার তুলনায় কতখানি সময় এই মহান উৎসের ফল্গুধারা থেকে সুধা পানের জন্য ব্যায় হয়?

 

গাইড মহিলাটি প্রতিটি স্থানে একটি নির্দিষ্ট নিদর্শন নিয়ে দীর্ঘ সময় ভ্যাজর ভ্যাজর করছিল কিন্তু ওর কথা শেষ হলেই আর ঐ স্থানে বাকী কোন নমুনা দেখার সুযোগ দিচ্ছিলনা। তাই আমরা গ্রুপের সাথে থাকলেও এক জায়গায় না বসে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। তবে তাঁর কাছ থেকে একটি নতুন তথ্য জানতে পারলাম। তা হোল, গ্রীক সভ্যতার ওপর মিশরীয় সভ্যতার প্রভাব। আমাদের ইতিহাস পড়ানো হয় পরস্পর সম্পর্কহীন একেকটি অধ্যায় হিসেবে। কিন্তু আসলে তো ইতিহাস প্রতিটি জাতির সাথে অন্যান্য জাতির আদনাপ্রদানের কাহিনী। আমার মুখস্তবিদ্যা একেবারেই শূন্য। কিছুতেই সন তারিখ মনে থাকেনা। নইলে ইতিহাস পড়তে আমার এত ভাল লাগত যে হয়ত একটা চেষ্টা চালাতাম।

 

অন্যান্য সভ্যতায় শিল্পে মানব এবং পশুর প্রতিকৃতি উঠে এলেও চাইনিজ শিল্প মূলত প্রকৃতিনির্ভর এবং শৈল্পিক গুনাবলীতেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। মিউজিয়ামের এই অংশটি বেশ ভাল লাগল। তাদের শিল্প যেমন মার্জিত তেমনি কিঞ্চিত অ্যাবস্ট্র্যাক্ট হবার কারণে কৌতূহলোদ্দীপকও বটে।

 

এবার আমরা গেলাম ইসলামী সংস্কৃতির জন্য নির্ধারিত অংশে। এখানে স্থাপত্যকলার নিদর্শন দেয়ার জন্য সম্পূর্ন একটি বৈঠকখানার প্রতিকৃতি তৈরী হয়েছে যার মধ্যখানে নীচু অংশে ফোয়ারা, চারপাশে উঁচু স্থানে গদি আর কার্পেট দিয়ে বসার ব্যাবস্থা, জানালাগুলোতে মিহি কাঠের কাজ, দেয়ালে দামী পর্দা আর কল্পনার দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি সিংহ দরজায় দাঁড়ানো আফ্রিকান প্রহরীদের। অ্যামেরিকান পর্যটকরা এই স্থাপত্য দেখে আহা উহু করতে করতে অস্থির, কিন্তু আমি যেন এর মাঝে দেখতে পাচ্ছিলাম ইসলামের অগ্রযাত্রার ধ্বংস। এত আরাম করে বসার ব্যাবস্থা করার পর কোন জাতি কি আর উঠে দাঁড়াতে পারে? ফলে আমাদের ধ্বংস শুরু হয়েছিল তখনই যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে আরাম আয়েশে ডুবে গিয়েছিলেন।

 

কিছু হস্তলিখিত কুর’আন এবং আরবী ফার্সী গ্রন্থ বা বইয়ের পৃষ্ঠা পেলাম যার মাঝে ছিল মানতেক আত ত্বাইর এবং শাহনামা। ইচ্ছে হচ্ছিল কাঁচের আবরন খুলে বইগুলো নিয়ে ছুঁয়ে দেখি, গন্ধ শুঁকি, পড়ি কিছুক্ষণ। কিন্তু এগুলো যদি আমার মত লোকজনের হাতে পড়ত তাহলে আর এই প্রজন্মের দেখার জন্য টিকতনা। যাই হোক, বুঝলাম এই মিউজিয়ামটি পুরোটা ঘুরার জন্য আমাদের অন্তত তিনটি দিন হাতে রাখা প্রয়োজন ছিল। সবাই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও এখানেই মিউজিয়াম দেখার ইতি টানতে হোল।

 

সকালে খালা এত খাইয়েছিলেন যে ক্ষিদে পায়নিতবু খালা খালু চিন্তায় অস্থির ক্ষিদে পেল কিনা। পরে আমরা সবাই একটি আফগান রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবার খেলাম। তারপর চললাম ম্যাডাম তুসোঁর যাদুঘরে।

 

ম্যাডাম মারি তুসোঁর জন্ম তাঁর বাবার মৃত্যুর দু’মাস পর। বিধবা মা জীবিকা নির্বাহের জন্য এক ডাক্তারের বাসায় ঝিয়ের কাজ নেন। এই ডাক্তারসাহেব মোম দিয়ে রোগীদের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিকৃতি বানিয়ে ছাত্রদের দেখাতেন। ছোট্ট মারি এই কাজে বেশ দক্ষটার পরিচয় দেয়। তখন ডাক্তারসাহেব তাকে মোম দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি বানানো শেখাতে থাকেন এবং তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের এবং মারির করা প্রতিকৃতিগুলো তাকে দিয়ে যান। ফরাসী বিপ্লবের সময় বিপ্লবের পক্ষের এবং বিপক্ষের প্রচুর মানুষের মুখমন্ডলের প্রতিকৃতি তাঁর দ্বারা করানো হয় যার মধ্যে রয়েছে ষোড়ষ লুই এবং তাঁর স্ত্রী মারি আঁতোয়ানেত। বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ফ্রান্সের আরো বহু প্রতিভাবান শিল্পীদের মত মারিও তাঁর শিল্পকে উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ইংল্যান্ডে যান। বহুবছরের চেষ্টা এবং সাধনার মাধ্যমে তিনি লন্ডনে একটি মিউজিয়াম করতে সক্ষম হন এবং কালক্রমে এই দেশই তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের আবাসস্থল হয়ে ওঠে। আজ পৃথিবীর নানান স্থানে তাঁর নামে মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে তাঁর প্রদর্শিত পন্থায় বিভিন্ন জ্ঞানীগুনী লোকজনের আসল মাপে তাদের প্রতিকৃতি নির্মান করে প্রদর্শনীতে দেয়া হয় যেগুলো দেখে মনে হয় যেন এখনই কথা বলে উঠবে। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে এমন একটি মিউজিয়াম রয়েছে।

 

মিউজিয়ামে পৌঁছে আবার সেই পার্কিংয়ের সমস্যা। খালু গেলেন গাড়ী পার্ক করতে, হাফিজ সাহেব গেলেন টিকেট করতে, সেখানে খালা আর হাফিজ সাহেবের ধস্তাধস্তি, খালা টাকা দেবেন আর হাফিজ সাহেব দিতে দেবেন না। সুস্বাস্থ্যের একটি উপকারীতা খুঁজে পেলাম, হাফিজ সাহেবের সাথে ধস্তাধস্তিতে পারতে হলে সুমো রেস্টলার হতে হবে। খালু তখনও পার্কিং পাননি। খালা নীচতলায় টিকেট নিয়ে অপেক্ষায় রইলেন, আমরা হৃদিতাকে নিয়ে ওপরতলায় চলে গেলাম। লিফটে সর্বোচ্চ তলায় উঠে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকতে হয়। প্রথম তলায় সব নায়ক নায়িকা। খুব মজা পেলাম, ম্যাডাম তুসোঁর প্রথম মূর্তি ছিল ভলটেয়ার। এককালে জ্ঞানীগুনী লোকজনের কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। ইতিহাসে আর কোন সময় মনে হয় দেহ এত গুরুত্ব পায়নি, আর যারা দেহকে পুঁজি করে উপার্জন করে তারা এখন মান মর্যাদায় সবার ওপরে! পরের ফ্লোরে ছিল হাউজ অফ হরর যেখানে ভয় পাবার মত সব মূর্তিআমার ভয়ডর কম কিন্তু রাদিয়া আর হৃদিতার চিৎকারে মনে হোল লোকজনের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। ওখান থেকে বেরিয়ে এক জায়গায় কেবল দু’টো মূর্তি- শাহরুখ খান আর অমিতাভ বচ্চন এরা আসলেই ব্যাবসা বোঝে। দু’খানা মাত্র মূর্তি, কিন্তু লোকজন, বিশেষ করে মহিলারা পারলে মনে হয় আবেগে বেহুঁশ হয়ে যায়। ওখান থেকে বের হয়ে কিছু ঐতিহাসিক লোকজনের মূর্তি- জর্জ ওয়াশিংটন, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ। রুমের একপাশে দেয়ালে ওয়াইট হাউজের ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে ওবামা আর তাঁর স্ত্রীর মূর্তি, এখানেই দেখি ছবি তোলার জন্য লাইন বেশি। আমাদের গ্রুপ ওঁদের সাথে ছবি তুলল, আমি তুলে দিলাম কিন্তু আমার এদের সাথে ছবি তুলতে ইচ্ছে হোলনা। প্রথমত, আমি ছবি তুলতে পছন্দ করিনা যেহেতু ছবিতে আমাকে আমার মতই দেখায়; দ্বিতীয়ত, ওবামাকে আমার পছন্দ নয়। তবে আমি একটি মূর্তির সাথে ছবি তুললাম সাগ্রহে যেটাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছিলনা। মহিলার উচ্চতা মাত্র পাঁচফুট, বয়স আশি, চামড়ায় প্রতিটি ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি চুল পাকা, লম্বা কালো ম্যাক্সি পরা, মাথায় টুপি- বলুন তো তিনি কে? এটি ছিল মারি তুসোঁর মূর্তি, তাঁর নিজের হাতে তৈরী নিজের প্রতিকৃতি, তাঁর জীবনের শেষ কাজ। পরের ফ্লোরে গায়ক গায়িকা। দ্রুত পার হলাম। তার পরের ফ্লোরে আমার খুব পছন্দের একজনকে পেয়ে গেলামছোটবেলায় তাঁর প্রতি আমার প্রচন্ড মায়া ছিল কারণ বেচারা সবসময় একা একা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতবেচারা সহজেই রেগে যেত কিন্তু রেগে গেলেই তাঁর গায়ের রঙ সবুজ হয়ে যেত। আমি ছিলাম তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল কারণ আমারও প্রচন্ড রাগ ছিল, শুধু আমার গায়ের রঙ কালো থেকে লাল হয়ে যেত এই যা। চিনতে পেরেছেন তাকে? হুমম, ইনক্রেডিবল হাল্ক! ওর সাথে একটা ছবি তুললাম! পরের ফ্লোরে একটা জিনিস আমার খুব মজা লাগল, পথের পাশে দাঁড়ানো এক লোক, নড়ছেইনা, কাউকে জায়গা দিচ্ছেনা যাবার, অনেকক্ষণ খেয়াল করার পর বোঝা যায় আসলে ওটা মূর্তি! তারপর ওরা আমাদের একটা মুভি দেখাল, থ্রি ডি, সব সুপারহিরোদের নিয়ে একটা কার্টুন। বাচ্চারা মজা পেল কারণ সব ‘ম্যান’দের এখানে একত্রিত করা হয়েছে। তবে আমরাও মজা কম পেলাম না কারণ সুপারহিরোদের মারামারিতে আমাদের সীটের নীচে ফ্লোর কাঁপছিলো, কার্টুনে পানির ট্যাঙ্ক ফাটলে আমাদের গায়ে পানি ছিটাচ্ছিল, ওরা একজন আরেকজনকে আঘাত করতে গেলে সীটের ভেতর থেকে একটা লাঠি আমাদের পিঠে গুঁতো দিচ্ছিল, ওখানে রে মারা হলে ছাদে আলো চমকাচ্ছিল, আর ওরা বাবল ছুঁড়ে মারলে আমাদের চারপাশে সত্যিকার বুদবুদে ছেয়ে যাচ্ছিল। মুভি দেখার সচরাচর সময় পাইনা, কিন্তু এই মুভিটা মাত্র পনেরো মিনিট হলেও খুব মজা পেলাম।

 

ওখান থেকে বের হয়ে হাফিজ সাহেব বললেন জ্যাকসন হাইটস দেখা বাকী রয়ে গেল। ওখানে গেলে নাকি মনে হয় বাংলাদেশে এসেছেন। অবশ্য নিউ ইয়র্কের আরো বহু জায়গায় দেখেছি বাংলাদেশীরা রাস্তার ওপর জটলা পাকিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় গল্প জমিয়েছে। কিন্তু এখানে সর্বপ্রকার বাংলাদেশী মাছ এবং সব্জী পাওয়া যায়। আমরা নিতে পারব না কিছুই, কাস্টমসে সব ফেলে দেবে, কিন্তু খাদ্যরসিক খাবার দেখেও শান্তি পায়। তাই জ্যাকসন হাইটসে গেলাম, ওটুকু আর বাকী থাকবে কেন? খালু আর হাফিজ সাহেব গেলেন কেনাকাটা করতে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই আমরা আর নামলাম না। এই সুযোগে খালা আর দুই ননদিনীর সাথে গপ্প জমালাম, আমরা অধিকাংশই ঘুরাঘুরিতে থাকায় প্রথম দিন ছাড়া আর এই সুযোগ হয়ে ওঠেনি। রাস্তায় দেখলাম এক মহিলা সাদা সালোয়ার কামিজ পরে দোকানে ঢুকছেন, মনে হোল বাংলাদেশী, তাঁকে মাথাও নাড়ালাম। কিছুক্ষণ পর হাফিজ সাহেব এসে হতবাক হয়ে বললেন ঐ ভদ্রমহিলা বরিশালে ওনাদের প্রতিবেশী ছিলেন, তাঁর বাবা আবার খালার বড়বোনের বিয়ের ঘটক ছিলেন এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার হোল ঐ খালুকে আমরা আসার আগে বরিশাল দেখে এলেও এখন উনি এখানেই আরেক মেয়ের বাসায় থাকেন! পৃথিবীটা আবারও মনে হোল খুব ছোট কিন্তু সময় ততোধিক সংক্ষিপ্ত। তখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা, খালুর আম্মা বাসায় একা, আমাদের পরদিন ভোর ছ’টায় বেরোতে হবে, সুতরাং তাঁর মেয়ের সাথে দেখা হলেও তাঁর সাথে দেখা করার কোন উপায় নেই।

 

বাসায় পৌঁছে প্রথমেই বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। হাফিজ সাহেব খেতে না পারলেও মাছ আর সব্জী হাত দিয়ে ধরেই মজা পাচ্ছিলেন। তাঁকে তাঁর মত মজা পেতে দিয়ে আমি বাকী জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম, বাইরে রইল শুধু যে যা পরে যাবে সেই পোশাক। হৃদিতার কাছ থেকে একটা গল্পের বই নিয়েছিলাম যেটা গত কয়দিন ভ্রমনের সময় আমার সাথী হয়ে ছিল। বইটির শেষ কয়টি পৃষ্ঠা পড়ে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন রাত তিনটা। সবার তখন দু’ঘন্টা ঘুম হয়ে গিয়েছে। তবু সকালে সবাইকে ঘুম থেকে উঠিয়ে রেডি করার জন্য আমাকেই উঠতে হবে পাঁচটায়। তবে বিশেষ শান্তির কথা হোল বইটা সমাপ্ত হয়েছে!

 

২২ এ সেপ্টেম্বর

ভোরবেলা খালা খালু আমাদের এয়ারপোর্টে দিয়ে গেলেন। খালা এর মধ্যেই বাচ্চাদের জন্য নাস্তা বানিয়ে সাথে দিয়ে দিয়েছেন বেরোবার মূহূর্তে আমাকে এক সেট বেডকভার উপহার দিলেন, ওটা তখন আর বাক্সে ভরার সময় নেই তাই আলাদা লাগেজ হিসেবেই নিতে হোল।

 

নিউ ইয়র্কে এক অদ্ভুত জিনিস দেখলাম যা এর আগে কোনদিন কোথাও দেখিনি। এয়ারপোর্টে ট্রলি নেয়ার জন্য পয়সা লাগে! পয়সা দিয়েই ট্রলি নিলাম বটে কিন্তু বেশি দূর নিতে দিলোনা। বাকী পথ সব লাগেজ আমরা চারজন মিলে হাতেই বহন করতে হয়েছে। যার মাথায় বাক্সে চাকা লাগানোর বুদ্ধি এসেছিল আল্লাহ তাকে উপযুক্ত পুরস্কারে ভূষিত করুন। নইলে সেদিন আমাদের অবস্থা হত করুণ।

 

প্রথম ফ্লাইট নিউ ইয়র্ক থেকে টেক্সাস। টেক্সাস এয়ারপোর্টে নামাজ পড়ে উঠলাম টেক্সাস থেকে ক্যাল্গেরীর প্লেনে। নিজের বাসস্থানের প্রতি মায়াটাই মনে হয় এমন যে সারা রাতে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমালেও বেশ ভালই লাগছিল। ক্যাল্গেরীর আকাশ সীমায় প্রবেশ করতেই রাদিয়া বলল, ‘আম্মু, একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করেছ?’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি?’ ও বলল, ‘আমি আর সর্দি টের পাচ্ছিনা’। আমি খেয়াল করলাম আমারও সর্দি উধাও! অথচ গত কয়টা দিন কি কষ্টটাই না পেয়েছি!

 

ক্যাল্গেরী এয়ারপোর্টে প্লেন নামতেই মনটা ভাল হয়ে গেল। বেলী আপা দিয়ে গেছিলেন, ওনার স্বামী এলেন নিয়ে যেতে। কিন্তু ভাই আমাদের বাসায় না এসে আমাদের ওনার বাসায় নিয়ে গেলেন। বেলী আপা কাজে গেছিলেন, কিন্তু আমাদের জন্য খাবারের ব্যাবস্থা করে গেছিলেন যেন বাসায় গিয়ে রান্না করতে না হয়। ওনার মেয়ে এবং ভাগনীরা খুব যত্ন করে খাওয়াল আমাদের। তারপর আমরা বাসায় যাবার পথে মোনালিসা আপার বাসায় গেলামযাবার সময় আমার টুকটাক গহনা, যা কোনদিনই পরা হয়না তবু রাখতে হচ্ছে ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য, মোনালিসা আপার কাছে দিয়ে গেছিলাম। ওগুলো নিতে গিয়ে দেখি উনি তিনটা বাটি দিচ্ছেন। আমি বললাম, ‘এতগুলো বাটি কিসের? আমি তো আপনাকে কেবল একটি ছোট্ট কৌটো দিয়ে গেছিলাম!’ উনি বললেন, ‘আপনি আবার এসে রান্না করবেন? তাই আমি অল্প একটু তরকারী রান্না করে রেখেছিলাম যে আপনি গহনা নিতে এলে দিয়ে দেব’। বাসায় এসে জামাকাপড় ছেড়ে বসেছি মাত্র। দরজায় বেল শুনে দেখি ইফতেখার ভাই প্রচুর বাটি নিয়ে উপস্থিত। বললেন, ‘আপনারা অনেক ক্লান্ত। আমি বসবনা। বাটিগুলো নেন। অল্প খাবার আছে, রাতে আর রান্না করার দরকার নেই’। তাঁদের দেয়া খাবারে অবশ্য শুধু রাতটুকু নয়, আমার আর তিনদিন রান্না করার দরকার হয়নি। ক্যাল্গেরীতে এত মায়া বলেই বুঝি নিউ ইয়র্কের এত আলোর ঝলকেও ভাল লাগেনি?