Wednesday, October 20, 2010

আমি কিপটা বলছি

আমি ভীষণ কিপটা। যেমন আমি কখনো ভিক্ষুকদের ভিক্ষা দেই না। একবার এক ভিক্ষুককে দারোয়ান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলাম। সে বোবা সেজে মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষে চাইত। বেচারার একটাও দাঁত ছিলোনা। দাঁত কি জন্মগতভাবে ওঠেনি নাকি ভিক্ষে করার জন্য সে উপড়ে ফেলেছিল আমি কখনো তাকে জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু এ’ছাড়া তার আর কোন সমস্যা ছিলোনা। তার একমাত্র কাজ ছিল কেউ এলে দরজা খুলে দেয়া। সদর দরজা ছিল বাসার দরজা থেকে খানিকটা দূরে। আমি তখন ছাত্রী। বাবামা থাকে ইন্ডিয়াতে। বারবার উঠে দরজা খুলতে গেলে পড়াশোনা ঘরের কাজ হয়না, তাই দারোয়ান রাখা। দাঁত নেই, ঝাল খেতে পারেনা তাই প্রতিদিন আমি নিজ হাতে তার জন্য রান্না করতাম। তখন বাসার কাজের লোকের বেতন হত সাধারণত দু থেকে তিনশ টাকার মধ্যে। আমি তার বেতন নির্ধারণ করেছিলাম পাঁচশ। কয়েকমাস কাজ করার পর সে একদিন আমার কাছে ছুটি নিয়ে গেল মায়ের সাথে দেখা করতে। সাতদিন পরও তার দেখা নেই। আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম সে অসুস্থ হয়ে পড়ল বা কোন বিপদ হোল কি’না। এ’সময় একদিন ভাইয়া এসে বল্ল ওকে আমাদের দোকানের সামনে ভিক্ষা করতে দেখেছে। আমি তো হতবাক! ওকে আমি এত বেতন দিলাম, এত যত্ন করে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ালাম, আর সে কি’না …! ভাইয়াকে বললাম তাকে ধরে আনতে। সে এসে বোবার অভিনয় করতে শুরু করল। আমি বললাম, “তুমি মাসের পর মাস আমার সাথে কথা বলেছ, এখন বোবার অভিনয় করছ কেন? তুমি কাজ করবেনা ভালো কথা কিন্তু বলে তো যাবে!” সে তখন বল্ল, “আপা, আপনি এত আদর করেছেন যে আমি আপনাকে সামনাসামনি বলতে পারিনি, আপনি আমাকে অনেক টাকা বেতন দিতেন কিন্তু সে পরিমাণ টাকা আমি ভিক্ষা করে সপ্তাহে কামাতে পারি। তাই …” আমি কি বলব? তাকে যেতে দেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় রইলোনা।

আরেকবার ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে এক মহিলা ধরে বসল ভিক্ষা দিতেই হবে! স্বাস্থ্যবতী যুবতী কেন এভাবে ছেঁড়াফাটা কাপড় পরে রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমেছে আমি বুঝে পেলাম না। তাকে বললাম, “আমার সাথে চল, আমি তোমাকে এক বাসায় কাজ দেব। ওরা খুব ভালো মানুষ। কাজও কম। তুমি ভালো থাকবে”। সে আরো কিছুক্ষণ ভিখারীরা সচরাচর যে ঘ্যানঘ্যানে টোনে কথা বলে সেভাবে টাকা চাইল। শেষে ট্রাফিক জ্যাম ছুটে গেলে যখন ট্যাক্সি চলতে শুরু করল হঠাৎ সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলো, “হুহ! ভিক্ষা দেয়না আবার কাজ করতে বলে!” আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম আর আমার পাশে বসা আমার ননদ শেষপর্যন্ত হাসি সামলাতে না পেরে বলেই ফেল্ল, “ভাবী, তুমি খুব বোকা। তুমি কি মনে কর সে অভাবের কারণে ভিক্ষা করে? তুমি খুব সহজেই মানুষকে বিশ্বাস কর!”

আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন এক বান্ধবী এসে জানালো কলেজে ব্যান্ড পার্টি আসবে। লীড সিঙ্গার আমাদের এক ছাত্রীর বয়ফ্রেন্ড। সে টাকাপয়সা নেবেনা। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ চান মেয়েরা অন্তত ৫ টাকা করে চাঁদা দিয়ে ব্যান্ডদলকে কিছু উপহার দিক। আমার তখন ধর্ম সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিলোনা। কিন্তু আমি এমন সম্পর্কে কখনো আস্থাশীল ছিলাম না যার কোন নীতিগত ভিত্তি নেই। যার অস্তিত্ব তাদের ঠকিয়ে টিকে থাকে যাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস আমাদের বড় হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে সম্পর্কে আনন্দ আছে কিন্তু দায়িত্ব নেই তাকে আমি সম্মান করতে পারতাম না। তাছাড়া আমি নিজে গান ছেড়ে দিয়েছিলাম। যা আমি নিজে বিসর্জন দিয়েছি তাতে আমি আরেকজনকে কি করে উৎসাহিত করি? বান্ধবীকে বললাম, “আমি টাকা দিতে পারবনা”। সে বল্ল, “তুমি না এলে না এসো, পাঁচটাকা কোন ব্যাপার?” আমি বলেই ফেললাম, “পাঁচশ টাকাও কোন ব্যাপার না যদি আমি বিশ্বাস করি আমার এ’টাকায় কারো উপকার হবে। কিন্তু হুঁশজ্ঞান হারিয়ে পাগলের মত নাচানাচি করার জন্য পাঁচটাকা কেন একপয়সাও আমি দেবনা”। বেচারী মুখ বেজাড় করে চলে গেল।

তাই বলি আমি খুব কিপটা। রিক্সাওয়ালা ভাইরা উলটাপালটা ভাড়া বললে আমি ঐ রিক্সায় উঠিনা তা সে আমার যত কষ্টই করতে হোকনা কেন, পেছনে পেছনে এসে ঠিক ভাড়া বল্লেও আমি আর তাদের দিকে ফিরে তাকাইনা। অথচ যারা ঠিক ভাড়া বলে তাদের নিজ থেকে কিছু বেশী দিতে আমার খারাপ লাগেনা। এটা কি অস্বাভাবিক নয়? একবার কলেজ থেকে বেরিয়ে দেখি প্রচন্ড ভীড়- অনেক ছাত্রছাত্রী, মাত্র কয়েকটা রিক্সা। ভাবছি কি কর্‌ব, এমনসময় এক রিক্সাওয়ালা ভাই দূর থেকে ডাক দিয়ে বললেন, “এই যে জুবিলী রোড আপা, মিনারা বোর্ডিঙ্ এর গলি, ছয়টাকা- আপা এদিকে আসেন”। বান্ধবীরা হতবাক হয়ে বল্ল, “আমরা রিক্সা পাইনা আর তোকে কি’না রিক্সাওয়ালা নিজে সেধে নিয়ে যায়!” এ’ঘটনা একবার নয় বহুবার ঘটেছে। তাই মনে হয় আমার ভাগ্যটা খুব ভালো। আমি নিজে যেমনই হইনা কেন, আল্লাহ সর্বস্তরের ভালোমানুষগুলোকে পথেপ্রান্তরে আমার সাথে মিলিয়ে দেন- হয়ত আমাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য!

একবার খবর পেলাম এক মেট্রিক পরিক্ষার্থী মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওর গার্মেন্টসকর্মী বিধবা মা এসে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ওর চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করার পর জানা গেল ওরা যে এলাকায় থাকে সেখানে বখাটে ছেলেরা মায়ের অনুপস্থিতিতে ওর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। সে ভয়ে বেহুঁস হয়ে পড়ার পর থেকেই অসুস্থ। হাফিজ সাহেবের সাথে পরামর্শ করে ওদের আমাদের বিল্ডিং এ নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আব্বা কিছুতেই ভাড়া দেবেন না যেহেতু আমাদের বাসার যে ভাড়া মহিলা ঐ পরিমাণ বেতনও পান না। উনিও জাস্টিফাইড কেননা রিটায়ার করার পর থেকে বিল্ডিং এর ভাড়াই আব্বার একমাত্র নিজস্ব ইনকাম। তখন কত যে মিথ্যা কথা বলে আব্বাকে রাজী করলাম! মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ওরা আমার নীচতলায় থাকত। এত বছর ঐ ভাড়া কে চালিয়েছে আব্বা আজ পর্যন্ত জানেন না।

এভাবে পরীক্ষার্থীদের জন্য, বিয়ে দেয়ার জন্য, চিকিৎসার জন্য, ছোটছোট ছেলেমেয়েদের ম্যাগাজিন চালানোর জন্য, নলকূপ বসানোর জন্য, বাংলাদেশে ফেঁসে যাওয়া বিদেশীকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আরো নানান কাজে আল্লাহ একবারে সর্বোচ্চ ৫০,০০০ পর্যন্ত খরচ করার তাওফিক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। অনেক প্রজেক্টে নিজের টাকার পাশাপাশি সাহায্য পেয়েছি বাবামা, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এমনকি ছাত্রছাত্রীদের থেকে। এক ছাত্রীর কথা খুব মনে পড়ে। আমার প্রায় প্রজেক্টেই সে কন্ট্রিবিউট করত, প্রচুর পরিমাণে, যেমন একসাথে ত্রিশহাজার টাকাও সে দিয়েছে। কিন্তু এমন গোপনে সে টাকা দিত যেন সে চুরি করছে। সবসময় নতুন করে রিমাইন্ডার দিত যেন তার নাম কেউ না জানে। বাংলাদেশে এমন কত যে ভালো মানুষ আছে!

একবার এক মহিলাকে নিয়ে এক গার্মেন্টস মালিক ভাইয়ের কাছে গেলাম তাঁকে একটা চাকরী দেয়ার জন্য। উনি সম্ভ্রান্ত গৃহবধু ছিলেন কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশরের সম্পত্তির পাশাপাশি তাঁর স্বামীর অর্জিত বিশাল সম্পদ সব ভাসুর দেবররা দখল করে নিয়ে ওনাকে বঞ্চিত করেছে। ভাই সব শুনে বললেন, “রেহনুমা, আমি তাকে এই মূহূর্তেই চাকরী দিতে পারি। কিন্তু তিনি ঘর ছেড়ে চাকরী করতে আসছেন কেন বল? স্বামী মারা গিয়েছে, বাচ্চা দু’টোকে মানুষ করতে হবে, তাইত? কিন্তু উনি যদি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাইরে থাকেন তাহলে বাচ্চাগুলোকে মানুষ করবে কে?” আমি বললাম, “তাহলে কি করতে পারি ভাই? পরামর্শ দিন।” উনি বললেন, “উনি কি কি কাজ পারেন?” আমি বললাম, “উনি খুব ভালো সেলাই করতে পারেন”। ভাই বললেন, “ওনাকে বল বাজারের সেরা সেলাই মেশিন যেটা ওনার আরাম লাগে দেখে আমাকে জানাতে কত লাগবে”। ভদ্রমহিলাকে জানালাম। উনি সাতদিন মার্কেট সার্ভে করে ভয়ে ভয়ে জানালেন সবচেয়ে ভালো মেশিনটার দাম ১০,০০০ টাকা। আমি নিজেও একটু শংকিত বোধ করলাম কেননা ঐ মূহূর্তে ভাই কিছু দিলে বাকীটা আমার দেয়ার মত হাতে টাকা ছিলোনা। কিন্তু ভাইকে বলার সাথে সাথে উনি চেকবুক বের করে দশহাজার টাকার চেক সাইন করে দিলেন। শুধু চুপিচুপি বললেন এ’ব্যপারে যেন কেউ না জানে।

এসব কাজ করতে গিয়ে যে কত অসংখ্য অসাধারন মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে! এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাই আমি কিপটা এ’ নিয়ে আমার কোন লজ্জা নেই। আমার বাবামা, জীবনসঙ্গী এবং যাদের সাথে আমার ওঠাবসা তারা এত ভালো এবং আমার এসব কাজের ব্যাপারে এত উৎসাহ দেন যে এতেই আমার জীবন সার্থক!

1 comment:

  1. সত্যিই আপনার জীবন সার্থক আপু! :)

    ReplyDelete