Sunday, April 7, 2013

‘আমি’ময় পৃথিবী

দরখাস্তটা রিভিশন দিতে গিয়ে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। ছোট ছোট তিনটা প্যারার এইটুকু অ্যাপ্লিকেশনটাতে ‘আমি’ শব্দটা এসেছে সাতবার, ‘তুমি’ শব্দটি নেই একবারও। কি আশ্চর্য! আমি একজনের কাছে কিছু চাইছি, সুতরাং চিঠিটাতে তাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত, অথচ এর সর্বত্র ‘আমি’র ছড়াছড়ি! আবার অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে বসলাম। বেশ কিছু সময় নিয়ে, অনেক অনেক কাটাকুটি আর ভাষার সতর্ক ব্যাবচ্ছেদের পরও তিনটা ‘আমি’ রয়ে গেলে যেগুলো কিছুতেই বাদ দেয়া গেলনা। ঘটনাটায় নিউরনে একটা আলোড়ন খেলে গেল, চরম লজ্জা পেলেও নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে মানুষ আসলেই বড় আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর প্রাণী!

 
কথাটা শুনতে খারাপ শোনালেও আমাদের প্রাত্যহিক বাক্যালাপের দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় আসলে তত্ত্বটা কতটা সত্য। আমাদের প্রতিদিনকার সংলাপগুলো একত্রিত করলে দেখা যায় এর অধিকাংশ বাক্যই শুরু হয় ‘আমি’ বা ‘আমার’ শব্দটি দিয়ে। আমাদের সংলাপে ‘আমি’র সাথে সংশ্লিষ্টতা ব্যাতীত ‘তুমি’ বা ‘সে’র অভাব প্রকট এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শব্দগুলো আসে ‘তুমি’ বা ‘সে’ কে নিয়ে ‘আমি’র সমস্যা কিংবা অসন্তুষ্টি কিংবা নালিশ ব্যাক্ত করতে। সংলাপের এই সংকীর্ণতা প্রতিফলিত হয় আমাদের আচরনিক জীবনেও। এই আমিময় পৃথিবীতে ‘তুমি’ বা ‘সে’র প্রতি মমতার অনুপস্থিতি আসলেই আতংকজনক! ‘আমি’র চাওয়া পাওয়া নিবৃত করার জন্য ‘তুমি’ বা ‘সে’র প্রতি নির্দয় হওয়া কিংবা তাকে মিটিয়ে দেয়ার দৃষ্টান্তও বিরল নয়।
 

যখন আমরা ‘তুমি’ বা ‘সে’কে আদৌ মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত থাকি তখন বলি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। এই কথাটাতেও আত্ম অহমিকাই  প্রকাশিত হয়, কেননা এখানে ‘আমি’র অনুভূতিটাই মুখ্য, ‘তুমি’ বা ‘সে’র অনুভূতিটা গৌণ; বরং ব্যাপারটা এমন যে আমি যে তাকে ভালবাসি তাতেই তার আনন্দিত, বিগলিত, মুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞ হয়ে যাওয়া উচিত। কি অদ্ভুত, তাইনা? যাকে মূল্যায়ন করার জন্য এই ভালোবাসা তার চেয়েও এখানে আমার অনুভূতি, আমার চাহিদা, আমার অহমিকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! তাই তো আমরা অহরহ দেখি কেউ ভালবাসায় সাড়া না দিলে তাকে অ্যাসিডদগ্ধ করতে কিংবা হত্যা করতেও মানুষ পিছপা হয়না। একে কি আসলে ভালবাসা বলা যায়? ভালবাসা তো সেটাই যেখানে অন্যের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ আমার কাছে নিজের চাহিদার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে, নইলে ‘তুমি’ বা ‘সে’র আর কি মূল্য থাকে?

 
পৃথিবীতে যত সমস্যা তার শুরু এই ‘আমি’ দিয়ে। আমাদের সারাক্ষণ ভাবনা আমি কি চাই, আমার কি পাওয়া উচিত, আমি কি পেলাম, আমার যা চাওয়া ছিল তা কেন পেলাম না। এই যাত্রাপথে আমাদের কখনো মাথায় আসেনা ‘তুমি’ কিংবা ‘সে’ কি চায়, ‘তুমি’ বা ‘সে’র কি পাওয়া উচিত, ‘আমি’ কি ‘তুমি’ বা ‘সে’কে বঞ্চিত করছি কিনা। ব্যাস্ত জীবনের অঙ্গন থেকে কিছু সময় করে নিয়ে কারো সাথে দেখা করতে গেলাম, সে প্রথমেই বলবে, ‘তুমি কি আর আমার খবর রাখো?’ একবারও ভাববেনা, আমিই তো তার সাথে দেখা করতে গেলাম কিংবা এতদিন আমি কেমন ছিলাম বা কেন তার সাথে দেখা করতে পারিনি বা সে তো একদিনও আমার কোন খবর নেয়নি! এখানেও সমস্যা ‘আমি’কে এতটা মুখ্য মনে করা যা ‘তুমি’ বা ‘সে’র সুবিধা অসুবিধা সমস্যা এমনকি তার উপস্থিতিকেও আমলেই নেয়না।


দুনিয়ার যত সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু এই ‘আমি’টা। ‘তুমি কি করে আমার জন্মদিন ভুলে গেলে?’ ‘তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমি কি পেলাম?’ ‘আমার কথা আর কে ভাবে?’ ‘আমি নিজ কানে শুনেছি এই কথা’ ‘আমার ধারণা ব্যাপারটা এমন’ ‘ওর একদিন কি আমার একদিন’ ‘আমি কম যাই কিসে?’ এই ‘আমি’কেন্দ্রিকতার কোন শেষ নেই। এই আমিত্ব আমাদের অনুদার, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, অনাস্থাশীল, অহংকারী, প্রতিশোধপ্রবণ এবং বোকার স্বর্গে বসবাসকারী করে তোলে। এই ‘আমি’কে আমরা কতটা অপরিহার্য মনে করি তা আমাদের প্রচলিত বাগধারাতেই প্রকাশ পায়।


আমরা কথায় কথায় বলি, ‘চাচা, আপন পরান বাঁচা’। বস্তুত কথাটার পেছনে স্বার্থপরতার গন্ধটা যে কত উৎকট তা কি আমাদের একটুও নাড়া দেয়না? সবাই যদি নিজের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যাস্ত থাকত তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস কতটা কলঙ্কময় হত তা কি আমাদের চিন্তায় আসে কখনো? সবাই নিজের প্রান নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে কি পৃথিবীতে কোনদিন কোন মহিমান্বিত আত্মত্যাগের ইতিহাস রচিত হত, যুদ্ধ কিংবা মহামারীর সময় সেবা করার কোন লোক পাওয়া যেত,  কেউ মৃত্যুর পারে দাঁড়িয়ে অন্যকে পানি পান করার অগ্রাধিকার দিত, জাহাজডুবির মূহূর্তে কেউ স্ত্রী পুত্র কন্যাকে লাইফবোটে তুলে দিয়ে ডুবন্ত জাহাজে রয়ে যেত, একজন মহামানবকে বাঁচাতে এগারোজন মহাত্মা নিজেদের শরীরকে ঢালে রূপান্তরিত করত, কিংবা একজন মা তার শরীর দিয়ে ঢেকে দিত তার সন্তানকে যেন ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়া দেয়াল তাকে থেঁতলে দিলেও সন্তান অক্ষত থাকে?


প্রতিদিন এই পৃথিবীটাকে দেখি, এই পৃথিবীর মানুষগুলোকে দেখি যাদের দিন শুরু হয় ‘আমি’ দিয়ে, দিন শেষ হয় ‘আমি’ দিয়ে। এই ‘আমি’র বাড়ী লাগে, গাড়ী লাগে, খাবার লাগে, পোশাক লাগে, চিকিৎসা লাগে, সম্মান লাগে, ধন সম্পদ ঐশ্বর্য্য লাগে, সমস্ত প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে আরো লাগে; তবু তার ‘তুমি বা ‘সে’র ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি নিয়েও ভাবার সময় হয়না, তাদের দুঃখ কষ্ট বেদনা তাকে নাড়া দেয়না। প্রতিটি ‘আমি’ অমর হতে চায় যেন একজন ‘আমি’ পৃথিবী থেকে চলে গেলে মানবজাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে, অথচ কত কোটি কোটি ‘আমি’ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে যাদের কেউ মনেই রাখেনি! প্রতিটি ‘আমি’ নিজেকেই সেরা মনে করে যেন পৃথিবীতে কোনদিন কোন শ্রেয়তর মানবের পদচিহ্ন পড়েনি, অথচ এই পৃথিবীর ইতিহাসে হাজার হাজার উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বমহিমায় জ্বাজল্যমান! প্রতিটি ‘আমি’র প্রয়োজনগুলি পূরণ করেন একজন ‘আমি’, অথচ সেই ‘আমি’কে কেউ ধন্যবাদ দেয়া দূরে থাক স্বীকার করার পর্যন্ত প্রয়োজন মনে করেনা!


এই বৈচিত্রময় পৃথিবীতে কিছু বিচিত্র মানুষ জীবনের লক্ষ্যস্থির করে নিয়েছেন ‘তুমি’ কিংবা ‘সে’কে নিয়ে ভাবার, তাদের স্বপ্নপূরন করার, নিজের প্রয়োজনগুলিকে সীমিত করে অপরের প্রয়োজনগুলিকে প্রাধান্য দেয়ার। সবাই তাঁদের বোকা বলে। কিন্তু এই আমিময় পৃথিবীর স্বার্থের ঈষদচ্ছ আচ্ছাদনের ভেতরে যেসব জঘন্য কীর্তিকলাপ চলে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ দেখেই আমার কেবল ইচ্ছে হয় এই বোকাদের দলে ভিড়তে। সূর্যের প্রচন্ড টান উপেক্ষা করেও কিছু কিছু উল্কা ছিটকে চলে আসে এই মাটির পৃথিবীতে, এই পৃথিবীর বায়ূমন্ডলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগে ক্ষণিকের জন্য জ্বলে ওঠে সেই মহাকাশচারী। একটি জীবনের জন্য একবার জ্বলে ওঠাই কি যথেষ্ট নয়? হাজার হাজার বছর ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকার চেয়ে ঐ এক মূহূর্তের জ্বলে ওঠাই কেন যেন কিছু কিছু মানুষকে বেশি আকর্ষন করে। কেননা ঐ একটি মূহূর্তে সে স্বার্থপরতার উর্ধ্বে উঠে আসতে পারে, আমিত্বের কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে, অন্যের আকাশটাকে আলোর মালায় সাজিয়ে দিতে পারে, অপরের মধ্য দিয়েই তৈরী করতে পারে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় – এখানেও ‘আমি’টাই উজ্জ্বল, কিন্তু সংকীর্ণ নয়। এই ‘আমি’টাই হতে ইচ্ছে করে খুব। জানিনা পারব কিনা, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই!

1 comment:

  1. khubi sundor kotha bolle appi...onkdin por tomar blog ta porlam....asolei ami moy ei priothibir kothai amra vabi...ami chara kisui nai...ektu jodi vabtam tobe onnek sundr hoto prithibi ta..

    ReplyDelete