Monday, July 1, 2013

বাদল দিনের বন্ধুরা

১৪ই জুন ২০১৩, শুক্রবার

আজ যখন কাজ থেকে ফিরছি তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে গায়ের জ্যাকেটটা ওয়াটারপ্রুফ আর তাতে একটা মাথার আচ্ছাদন আছে, তাতেই খানিকটা বাঁচোয়া। ট্রেন থেকে নেমে যখন বাসার দিকে আসছি তখন দেখি এক বুড়া দাদা মনের সুখে ঢাউস সাইজের একখানা গাড়ী নিয়ে যেতে যেতে হাত নাড়ছেন। চারিদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম তিনি আমাকেই হাত নাড়ছেন যেহেতু আশেপাশে আর কেউ নেই। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না তাঁকে আমি কিভাবে চিনি। রাস্তা পাড় হয়ে বাসার সামনে আসতে আসতে দেখি উনি গাড়ী ঘুরিয়ে আমার সামনে এসে পড়েছেন, জানালার কাঁচ নামিয়ে বললেন, 'আমি কি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে পারি?' চেহারা দেখে নিশ্চিত হলাম আমি তাঁকে কোনভাবেই চিনিনা। তিনি দাদা হলেও ক্যানাডিয়ান দাদা। বেরিয়েছেন বৃষ্টিতে কারো উপকার করা যায় কিনা এই উদ্দেশ্য নিয়ে। জানালাম, যে বাসার সামনে তিনি গাড়ী থামিয়েছেন এটাই আমার বাসা। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলাম, 'আহা! চাকরী তাঁকে অবসর দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তিনি কাজ থেকে অবসর নেননি, জনহিতকর কাজ থেকে অবসর না নেয়াই তো জীবনের সার্থকতা!'

 

২০শে জুন ২০১৩, বৃহস্পতিবার

আমি ডাউনটাউনের যে স্টেশনে নামি সেখানে ট্রেন থেকে নেমেই উর্ধ্বশ্বাসে কর্মস্থলের দিকের ছুটে চলা মানুষগুলোকে খবরের কাগজ বিতরণের অলোভনীয় এবং নিষ্ফল কাজটি করেন এক বুড়ো দাদা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা নির্বিশেষে প্রতিদিন সকালে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি কাগজ নিয়ে, হাতখানা বাড়িয়ে। আমি কোনদিনই কাগজ নেইনা যদিও এগুলো ফ্রি বিলি করা হয়। কাগজে কোন ভাল খবর ছাপা হয়না, দুনিয়ার যত খারাপ কাজ আর বাজে লোকজনের কীর্তিকলাপের খবর পড়ে কোন লাভ নেই তাই। আজও জানিনা দাদাটির নাম কি, কোথায় থাকেন, পরিবার পরিজন আছে কিনা। কিন্তু প্রতিদিন সকালে চলার পথে একটু হাসি কিংবা দু’টো শব্দ দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাতে ভুল হয়না।

আজ সারারাত প্রচন্ড বজ্রপাতের সাথে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সকালেও দেখি আকাশের ভান্ডারে মেঘ ফুরোয়নি। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে টের পেলাম শুধু বৃষ্টি আর বজ্রপাতই নয়, সাথে বইছে প্রবল বাতাস। এখানে সাধারনত অল্প বৃষ্টি হয়েই বন্ধ হয়ে যায়, তাই এই বৃষ্টি মাতৃভূমির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বার বার। ঝুম বৃষ্টির কারণে ট্রেনের দরজা একবার খুললে বন্ধ হতে চাচ্ছিল না যেহেতু সেন্সর দেখাচ্ছিল কেউ ঢোকার চেষ্টা করছে। শেষপর্যন্ত যখন আমার স্টেশনে পৌঁছলাম তখন দেখি কাগজ বিলি করেন যে দাদা তিনি নেই। হেঁটে যেতে যেতে তবু রেইনকোটের হুডের নীচে থেকে ইতিউতি তাকাচ্ছিলাম তাঁকে দেখা যায় কিনা। হঠাত চোখের কোণায় ধরা পড়ল পথের পাশে একটা দোকানের সানশেডের নীচে থেকে রেইনকোট পরা কেউ জোরেজোরে হাত নাড়ছে, হাতে ধরা পেপারটা দেখে বুঝলাম ইনি আমার সেই খবরের কাগজ বিলি করা দাদা, আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য হাত নাড়ছেন, ‘ভেবোনা, আমি আছি’, যদিও তিনি জানেন আমি কাগজ নেবোনা!

 

২১শে জুন ২০১৩, শুক্রবার

গতকাল দুপুর থেকে State of Local Emergency ঘোষনা করা হয়েছে। নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নাকি দু’জন মানুষসহ একটি মোবাইল হোম ভেসে গিয়েছে। অবশ্য ১৭ তলার ওপর অফিসে বসে ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। তবে অফিস থেকে আসার পথে যখন দেখলাম যে শীর্ণকায়া বো নদী দেখে বাংলাদেশের নদীগুলোর সাথে তুলনা করে হাসি পেত, যার পেটের ভেতর প্রতিটা নুড়ি পাথর পঞ্চাশ হাত ওপরে ব্রিজ থেকে দেখা যেত, তার পানি ঘোলা হয়ে প্রচন্ড বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, পানি প্রায় ব্রিজ ছুঁই ছুঁই, তখন ভাবলাম তাহলে নদীর আশেপাশে প্লাবিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আজ সকালে বাসার সামনে স্টেশনে গিয়ে একটু অবাক হলাম। গত পাঁচ বছরে কোনদিন দেখিনি সকালবেলা স্টেশন পরিস্কার করা হয়নি। সর্বত্র বাতাসে বেঁকে যাওয়া ভাঙ্গা ছাতা ছড়িয়ে রয়েছে। ভাবলাম, ‘কি জানি, আমার মত ভোর সাড়ে পাঁচটায় কাজে রওয়ানা হয় এমন পাগল ক’জন আছে? হয়ত ঝড়বৃষ্টির কারণে ওরা পরিস্কার করে কুলিয়ে উঠতে পারেনি!’

কিন্তু তিন স্টেশন গিয়ে সবাইকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়া হোল। সামনে ট্রেনের লাইন নাকি পানির নীচে, বাকী পথটুকু বাসে যেতে হবে। বাস আসে বাস যায়, আমি কিছুতেই স্বাস্থ্যবান লোকজনের ভিড় ঠেলে উঠতে পারিনা। একবার উঠলাম কিন্তু দরজা বন্ধ করা যাচ্ছেনা বলে নেমে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বাস স্টেশনে যিনি নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি জানালেন একটি রাস্তা দিয়েই ডাউনটাউনে যাওয়া যাচ্ছিল, সে রাস্তাটিও এখন ভিড়ের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সম্ভব হলে অফিসে ফোন করে ছুটি নিয়ে নিতে। তখন বাজে সাতটা। কি আর করা? জেইনকে ফোন করলাম। সে বলল আমাদের গ্রুপের প্রায় সবাই ফোন করে জানিয়েছে যাবার কোন পথ নেই। ফিরে এলাম বাসায়। বহুদিন পর বড় মসজিদটায় জুমা পড়ার সুযোগ হোল যদিও ছাতা মাথায় দিয়েও জামাকাপড় ভিজে শেষ।

রাতে ইফতেখার ভাই বললেন, ‘চলে আসুন, একসাথে খাই’। ভাবী খাবার সাজাতে সাজাতে টিভিতে খবরে দেখলাম শুধু ক্যাল্গেরী নয়, আশেপাশের সমস্ত শহর প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে নৈসর্গিক দৃশ্যের লীলাভূমি ক্যানমোরে বাড়ীঘর থেকে রাস্তা পর্যন্ত সব টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে গিয়েছে। ক্যাল্গেরীর কিছু কিছু এলাকায় নদীপাড়ে বিলাসবহুল সব বাড়ীঘর দোতলা পর্যন্ত পানির নীচে, কিছু কিছু বাড়ী ভেসে গিয়ে নদীপাড়ে কিংবা ব্রিজের সাথে প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ডাউনটাউনে তিনফুট পানি, যারা সকালে গিয়েছিল তাদের সবাইকে সাঁতার কেটে ফিরে আসতে হয়েছে, অফিসের সামনে নদীর ধারে যে পার্কে জেইন আর আমি প্রতিদিন হাঁটতে যাই সেসব জায়গায় প্রচন্ডবেগে নদী প্রবাহিত হচ্ছে আর তাতে হাঁসগুলো মনের আনন্দে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। শুনলাম চিড়িয়াখানার প্রানীগুলোকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হতে পারে। এই খবরে বেশ মজা পেলাম। কোর্ট বিল্ডিংয়ে সাধারনত এমন সব মানুষদের বিচার করা হয় যাদের মাঝে মানবিক অপেক্ষা পাশবিক গুনাবলী অধিকরূপে বিদ্যমান, আর এখন আদতেই সব পশুদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!

ক্যানমোর
 
বন্যার্ত ক্যানমোর


পানির নীচে ডাউনটাউন

রাতে সোমালী বান্ধবী আয়শার খবর নিলাম, সে বোনের বিয়ের জন্য টরোন্টোগামী, সুতরাং নিরাপদ আছে। কিছুক্ষণ পরই জেইন ফোন করে জানালো আমাদের গ্রুপের সবাই নিরাপদ আছে, শুধু হ্যাভিয়েরকে ডাউনটাউনের বাসা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে যেহেতু বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে ডাউনটাউনবাসীদের রক্ষা করার জন্য ওখানে সব বিল্ডিংয়ের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

 

২২শে জুন ২০১৩, শনিবার

বাংলাদেশের মেয়ে আমি কোনদিন বাংলাদেশে বন্যা দেখিনি। ছোটবেলায় বিদেশে ছিলাম, টিভিতে কিছু নিউজক্লিপ দেখেছি কিন্তু তখনকার রিপোর্টিং আজকালকার মত নিবিড় ছিলোনা। বিয়ের সময় দেশে বন্যা ছিল, আমরা বললাম অনুষ্ঠান লাগবেনা, অনুষ্ঠানের টাকা বন্যার্তদের দান করে দেয়া হোক, আমাদের অভিভাবকরা রাজী হলেন না। আমাদের অবিরাম চেষ্টায় হলুদ, গানবাজনা, লাইটিং সব বাদ দেয়া গেল কিন্তু আড়ম্বরহীন হলেও অনুষ্ঠান একটা হোলই। বিয়ের পর ছিলাম চট্টগ্রামে, সেখানে পাহাড়ী ঢল নামে বটে কিন্তু বন্যা হয়না। শেষমেশ বন্যা দেখলাম এই ক্যাল্গেরী এসে। ওদের খুব বড় একটা অনুষ্ঠান হোল স্ট্যাম্পিড, এই মেলার জন্য অ্যামেরিকা থেকে পর্যন্ত লোকজন আসে যদিও সে সময় মদের গন্ধে রাস্তাঘাটে হাঁটা যায়না বলে অনেকসময় ক্যাল্গেরীর সচেতন লোকজনও ক্যাল্গেরী থেকে পালিয়ে বাঁচে। সেই স্ট্যাম্পিডের মাঠ এমনভাবে পানির নীচে তলিয়ে গেল যে মাটি দেখাই যায়না। স্যাডেলডোম স্টেডিয়ামের নীচের সাতটি সারির সব সীট, প্লেয়ারদের ইকুইপমেন্ট রুম থেকে ড্রেসিং রুম সব শেষ। ক্যানাডিয়ানরা আবার অভাবকে মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয় পায়, তাই সব দোকানের মালপত্র খালি হয়ে গেল, সব জিনিস মানুষের বাসায়!
পানির নীচে স্ট্যাম্পিডের মাঠ
 
স্যাডেলডোম স্টেডিয়ামের ভেতরেও পানি
 

মেয়র বলে দিলেন ডাউনটাউন অন্তত বুধবার পর্যন্ত বন্ধ, পানির ব্যাবহার সীমিত করতে হবে এবং লোকজন যেন যথাসম্ভব ঘরেই অবস্থান করে। কিন্তু ঘরে অবস্থান করা গেলনা। বান্ধবী তানজিন বহু আগে থেকেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল আমাদের প্রায় সত্তুরজনকে। সবাই মিলে ওর বাসায় মজার মজার খাবার খেলাম তারপর মসজিদে গেলাম, বন্যার মাঝেও একটা সুন্দর দিন কাটল।

 

২৬শে জুন, ২০১৩

অপ্রত্যাশিতভাবে পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় আজ থেকে ডাউনটাউন জনসাধারনের জন্য সীমিতভাবে খুলে দেয়া হোল। ডাউনটাউনে তিনটি ট্রেনের লাইন যায়, একমাত্র আমাদের লাইনটিই সম্পূর্নরূপে চালু হোল। অফিসে পৌঁছে জানতে পারলাম আমাদের গ্রুপে শুধু হ্যাভিয়ের ছাড়া কারো কোন ক্ষতি হয়নি। সে বেচারা দু’সপ্তাহের বাজার করেছিল বন্যার দু’দিন আগে। ডাউনটাউনে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় ওর সব খাবার পঁচে গিয়েছে, তবে সে কৃতজ্ঞ বোধ করছে যে আগেভাগেই ডাউনটাউন ছেড়ে যাওয়ায় সে আরো বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে।

অফিসের ইমেলে দেখলাম অনেকেই বন্যার্তদের থাকার জন্য নিজেদের বাসা, যাতায়াতের জন্য নিজেদের গাড়ী, খাবার দাবাড় কম্বল, জিনিসপত্র সরানোর জন্য সহযোগিতা অফার করছে। খবর পেলাম ডাউনটাউনকে পুণরায় চালু করার জন্য মেয়র এক হাজার লোকের সহযোগিতা চেয়েছিলেন দু’ঘন্টার ভেতর, পাঁচ হাজার লোক হাজির হয়েছিল। বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে লোক হয়েছিল ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক কম যেহেতু অনেকেই তাদের বাড়ীঘর উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বন্যার্তদের জন্য।
গৃহহারা একজন

কিছুক্ষণ পর জেইন আমাদের নিয়ে তৎক্ষনাৎ একটি মিটিং করে জানালো অফিসের দু’জন লোকের বাড়ী এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে বাড়ী ভেঙ্গে নতুন করে তৈরী করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তারা সাহায্য চেয়েছে মালপত্রগুলো বাছাই করতে- যা রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কোথাও তুলবে আর যা ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় নেই তা রাস্তার পাশে জড়ো করবে যেন সিটি কর্পোরেশনের গাড়ী এসে তুলে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রথম নিজের শারীরিক সামর্থ্যের অভাবে দুঃখবোধ হোল। আমি যদি যথেষ্ট শক্তিশালী হতাম তাহলে হয়ত হাত লাগাতে পারতাম। কিন্তু নিজের বাসা পরিবর্তন করার প্রস্তুতি নিতে গিয়েই কাহিল অবস্থা আমার, অন্যকে সাহায্য করব কি?

 

১লা জুলাই, ২০১৩

নদীর পাশে কিছু কিছু জায়গা এখনো পানির নীচে, নদীর ভেতর ঘরের ছাদ থেকে ওয়াশিং মেশিন ফ্রিজসহ নানাবিধ বস্তু দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় এখনো ট্রেনের যাতাযাত স্বাভাবিক হয়নি, কিছু কিছু স্টেশন এখনো বন্ধ। এর ভেতর পরম করুণাময় আমাদের এতটা নিরাপদ রেখেছেন যে আমার পুত্র কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়না ক্যাল্গেরীতে বন্যা হয়েছে, সে বলে, ‘কই, আমি তো কোথাও পানি দেখলাম না, তাহলে বন্যা হোল কি করে?’ আমাদের বাসা বদলানোর প্রাথমিক ধাপও সম্পন্ন হোল কোন ঝামেলা ছাড়াই। এতকিছুর মাঝে যিনি আমাদের এতটা নিরাপদ এবং আনন্দময় রেখেছেন সেই দয়াময়ের প্রতি সম্যকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব কিভাবে?

1 comment: