Friday, August 6, 2010

Practise Random Kindness


রিডার্স ডাইজেস্টের কোন এক সংখ্যায় পড়েছিলাম, এক মহিলা পার্কিং টিকেটের পয়সা দিয়ে চলে যাওয়ার পর পেছনের গাড়ীগুলো এসে দেখতে পেলো উনি নিজের পর আরো পাঁচটা গাড়ীর পার্কিং-এর পয়সা দিয়ে গেছেন। কে সেই মহিলা বা কেন তিনি অন্যের পয়সা দিয়ে দিলেন কেউ জানতেও পারলনা। এ থেকে শিক্ষনীয় ছিল যে ভালো কাজ করার পেছনে কোন উদ্দেশ্য থাকা জরুরী নয় বা এর কোন নির্দিষ্ট সময়ও থাকার দরকার নেই। যখন তখন যে কারো জন্য কিছু করার মধ্যেই মানবতা নিহিত।

বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু কার্যত দেখলাম আমি বুঝতেই পারিনা কি করা যায়, কখন করব আর কার সাহায্যের প্রয়োজন আছে! তাই হাফিজ সাহেবের কিছু কিছ কাজ দেখে যেমন অবাক হই তেমনি মুগ্ধ হয়ে যাই।


একদিন দুপুরে হাফিজ সাহেব আর আমি মটরসাইকেল ভ্রমণে বেরিয়েছি। আগ্রাবাদের মোড়ের বাজারে তাজা মাছ দেখে উনি সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। বরিশালের লোকজনের এই এক স্বভাব! মাছ দেখলেই দাঁড়িয়ে যাবে, তা যদি পেছনে ট্রাক মারে তো মারুক! আমাকে বাইকে বসিয়ে উনি চলে গেলেন মাছ দেখতে। এই মাছ, সেই মাছ দেখছেন তো দেখছেন – যেন মাছের সাথে বিয়ে হবে ওনার! কতক্ষণ পর এসে আমাকেও ডেকে নিয়ে গেলেন কোন মাছ আমি খাই আর কোনটা খাইনা জিজ্ঞেস করতে। মনে মনে গর্জাচ্ছি, “আপনার খেতে ইচ্ছে করছে, আপনার পছন্দমত নিলেই তো হয়! আমাকে আবার এর মধ্যে টানাটানি কেন বাবা?” গিয়ে দেখি আসলেই অনেকরকম মাছ এসেছে, একদম তাজা, মাছগুলো তখনো নড়াচড়া করছে আর নড়লেই তাদের শরীরে আলোর ঝিলিক লেগে চকচক করে উঠছে। আমি তখন খাওয়ার কথা ভুলে তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নদী নালা খাল বিল সমুদ্রে হারিয়ে গেছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাফিজ সাহেব কার সাথে যেন কথা বলছেন। পেছন ফিরে দেখি এক মহিলা, একপ্যাঁচে শাড়ি পরা, শাড়িটা দেখে বোঝা যাচ্ছে এর যথেষ্ট ব্যবহার হয়েছে, আঁচলটা মহিলার মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে একপাশ তাঁর মুখে ধরা। কথা বার্তা এগোচ্ছিলো এভাবে,
“বাসায় কি আছে?”
“একটা মানকচু।“
“কদ্দুর চিংড়ি মাছ হলে হবে?”
“হ্যাঁ।“
“মসলা আছে?”
“হ্যাঁ।”
হাফিজ সাহেব দোকানদারের দিকে ফিরে বললেন, “ওনাকে ২৫ টাকার চিংড়ি মাছ দিয়ে দাও তো!”
তারপর সব মাছের জন্য একত্রে টাকা পরিশোধ করে আমরা আমাদের গন্তব্য বাদ দিয়ে মাছ নিয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাজার থেকে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কে?”
“আমি কি জানি উনি কে?”
“মানে? আপনিই তো ওনার সাথে কথা বললেন!”
“আচ্ছা, মহিলাকে দেখে তোমার কি মনে হয় উনি আমার পরিচিতা?”
“তাহলে আপনি কি করে বুঝেলেন ওনার কি লাগবে?”
তখন হাফিজ সাহেব আমাকে বুঝিয়ে বললেন, মহিলাকে দেখে উনি বুঝতে পারলেন যে উনি অভাবগ্রস্ত কিন্তু নিজের অভাবের কথা কাউকে বলতে লজ্জা পান। বাসায় কিছু আছে আর বাজারে এসেছেন যদি কিছু সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া যায়। বললেন, “এদেরই সাহায্য করার উচিৎ কারণ এরা নিজেদের অভাবের কখা কখনো প্রকাশ করেনা”।
আমি বললাম, “আমিও আপনার সাথে একমত, কিন্তু উনি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, কাউকে কিছু বলছেনা। আমরা কেউ খেয়াল করতে পারলাম না, আপনি কি করে বুঝলেন যে ওনার কিছু প্রয়োজন?”
উনি হেসে ফেললেন, “তোমরা যে সময়টা অনেক অনেক বই পড়ে কাটিয়েছ, আমি সে সময়টা অনেক অনেক মানুষের সাথে মিশে কাটিয়েছি। দেখলাম উনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু কাউকেই কিছু বলছেন না। তাই বুঝলাম ওনার কিছু প্রয়োজন কিন্তু লাজ্জায় বলতে পারছেন না। তাই জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম। এবার বুঝেছ কিভাবে বুঝলাম?”
কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু মাথা নাড়লাম।


একদিন আমাদের বাসার পাঁচতলা থেকে দোতলায় নামছি, দেখি আব্বা যেসব দরজা জানাল এনে তিনতলার সিঁড়িতে রেখেছেন চারতলার কোন ফ্ল্যাটে লাগানোর জন্য, কেউ একজন ওগুলো নিয়ে নীচে নামাচ্ছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাই আমার একটু সন্দেহ লাগল। আমি আব্বাকে গিয়ে বললাম, “আব্বা, আপনি কি কাউকে বলেছেন দরজা জানালাগুলো নীচে নামাতে? ওগুলো না চারতলায় লাগাবেন?” আব্বা কোন কথা না বলে সোজা লোকটাকে ক্যাঁক করে ধরলেন। ঘটনা খারাপ বুঝতে পেরে আমি তাড়াতাড়ি হাফিজ সাহেবকে ডাক দিলাম, “আব্বার বয়স হয়ে গেছে, চোর যদি ভয় পেয়ে ধাক্কাটাক্কা দেয়, উনি সিরিয়াস ব্যাথা পাবেন, আপনি তাড়াতাড়ি যান”।

উনি গিয়ে আব্বাকে নীচে পাঠিয়ে দিলেন। কাকাও দৌড়ে এসেছিলেন। ওনাকেও বললেন চলে যেতে। আমি তখন ওপরে যাচ্ছি। উনি ঐ চোরকে পাঁচতলায় নিয়ে এলেন। পাঁচতলার বাগানে বসিয়ে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চুরি কর কেন?” সে অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে যখন বুঝতে পারল যে উনি সত্যি সত্যিই জানতে চান, তখন সে বল্ল সংসারে অভাব অনটন আর অশান্তির কথা। সব শুনে উনি বললেন, “ঠিক আছে, কাল সকাল ন’টায় তুমি আমার সাথে দেখা করবে, আমি সবাইকে বলে রাখব, কেউ তোমাকে কিছু বলবেনা। কাল আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। ওখানে নিলে তোমার চাকরী হবে। তারপর আর তুমি চুরি করবেনা, ঠিক আছে?” সে মাথা নীচু করে চলে গেল।
আমি বললাম, “সে যদি আপনাকে মিথ্যা কথা বলে? কাল যদি সে না আসে?”
উনি বললেন, “সে যদি স্বভাবে চুরি করে তাহলে সে হয়ত কাল আসবেনা। কিন্তু তাকে একটা সুযোগ দেয়া আমার দায়িত্ব, আমি আমার চেষ্টা করলাম।”


আরেকদিন উনি আমাকে আনতে গেছেন আই আই ইউ সি থেকে, ছুটির পর। তখন প্রায় সাড়ে তিনটা-চারটা। মেডিকাল কলেজের পেছনে তখন সম্পূর্ণ রাস্তা ফাঁকা। ছেলেদের হোস্টেলের ঐখানে কে যেন রাস্তায় বাঁশ ঝুলিয়ে রেখে গেছে যাতে ট্রাক বা বাস জাতীয় যানবাহন যেতে না পারে। হঠাৎ উনি দ্রুতবেগে বাইক চালিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বাঁশটা তুলে ধরলেন। আমি বললাম, “এটা তোলার দরকার নেই তো। আমরা এমনিই যেতে পারব”। উনি বললেন, “চুপচাপ বসে থাকো”।

আমি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে যাব, এমনসময় দেখি একজন ঠেলাগাড়িওয়ালা ঠেলাগাড়ীর ওপর বিশাল একটা ফ্রিজ দাঁড় করিয়ে নিয়ে আসছেন রাস্তার ওপাড়ে। উনি বাঁশটা আরেকটু উঁচু করে ধরে বললেন, “যেতে পারবে তো?” ঐ লোক ঠেলাগাড়ী অনায়াসে পাড় করে চলে যাওয়ার পর হাফিজ সাহেব বাঁশটা আবার নামিয়ে দিয়ে বাড়ীর পথে চল্লেন। এ’ কথাটা ওনাকে বলাই যাবেনা, বললে দাম বেড়ে যাবে, কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিলো টেডি বেয়ারের মত এই লোকটাকে আদর করে দেই!


এভাবে বহুবার ওনাকে দেখেছি, দেখে চলেছি – নির্দিষ্ট উপার্জন করেও অকাতরে টাকা খরচ করতে; মানুষের মধ্যে খারাপ কিছু দেখেও তাদের বিশ্বাস করতে, না বলা কষ্টগুলোও বুঝে নিতে। আর প্রতিদিন হিংসে হয়, আমি কেন এমন করে সব বুঝতে পারিনা? কেন?

1 comment:

  1. আহা আমার ভাইয়াটা কত্তো ভালো :D

    আচ্ছা আপু, আপনি ভাইয়াকে "আপনি" করে বলেন ক্যানো? :P

    ReplyDelete