ওর সাথে আমার দেখা
হয়েছে সাকুল্যে দু’বার। আমি সুন্দরভাবে কথা বলতে পারিনা, ইমোশনাল পরিস্থিতিতে
একেবারেই কথা বলতে পারিনা, মানুষ যে কি করে এত সুন্দর করে কথা বলে তাই বুঝে পাইনা।
তাই আড়ালে থেকে পর্যবেক্ষণ করে যাই।
মেয়েটি ছিল
সৌভাগ্যবতী। ওর ক্যান্সার হয়েছিল। তার আগে আর দশটা সাধারন মেয়ের সাথে ওর কোন
পার্থক্য ছিলোনা। স্বামী, সন্তান, সংসার, জামাজুতোর শখ, সাজগোজ -এর বাইরে ওর কোন
পৃথিবী ছিলোনা। কিন্তু ক্যান্সার ওকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিল
ক্যান্সার ধরা পড়ার আগেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা গেলে হয়ত
কিছু করা যেত কিন্তু এত দুর্বল শরীরে চিকিৎসা প্রয়োগ করলেও শরীর রোগের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহজনক। তখন থেকেই সে পৃথিবীর মোহমায়া থেকে নিজেকে
মুক্ত করে নিয়েছে। প্রভুর সাথে মহামিলনের প্রস্তুতি তখন থেকে
শুরু। দেড় বছর কম সময় নয়। এই সময়ে সে
নিজের এক একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাপের জন্য মার্জনা চেয়ে নিয়েছে, জনে জনে ডেকে
বুঝিয়েছে, ‘দেখ, আমাকে দেখ। কুড়িটি বছর যখন আমি সুস্থ ছিলাম তখন আমার প্রভুর আদেশ
নিষেধের তোয়াক্কা করিনি। আজ যাবার বেলা আমার কাছে তাঁর সামনে ন্যূনতম সম্মানজনক
অবস্থান নিয়ে দাঁড়াবার মত কোন সঞ্চয় নেই, হয়ত কেবল মার্জনাটুকুই চাইতে পারব কিন্তু
তা নিশ্চিত করার সময়টুকুও নেই। যেকোন দিন আজরাইল (আ) আমার বিছানার পাশে এসে
দাঁড়াবেন, আমার বুকের ওপর হাত রেখে আমার রূহকে আহ্বান করবেন, আমার দম বন্ধ হয়ে
আসবে, আমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করব কিন্তু আমার শরীর সেদিন আমাকে সহযোগিতা করবেনা,
তারপর আমাকে হাজির করা হবে আমার সৃষ্টিকর্তার সামনে। সেই মূহূর্তে তিনি আমার সামনে পরম করুণাময় রূপে বিরাজ করবেন
না কি আমাকে দেখে চরম রাগান্বিত হবেন সে কথা ভাবতেই অন্তরাত্মা ভয়ে উড়ে যায়। মনে
হয় আমি যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম, মিশে যেতে পারতাম মাটির সাথে! তোমরা সেই সময়ের
আগেই সাবধান হও যা অবশ্যম্ভাবী। তোমরা আমার মত
ভুল কোরোনা। তোমরা তার আগেই পরকালের
পাথেয় সংগ্রহ কর। এটাই একমাত্র বাস্তবতা। আর সব ভুল। সারাটা জীবন আমরা কেবল ভ্রমে
ডুবে থাকি। তোমরা এখনই এই ভুল সংশোধন কর। তোমরা এখনই সাবধান হও’।
ওর মত হাজারটা মেয়ে পৃথিবীর
আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সারা
ক্যাল্গেরী ওর এই যাত্রায় যেভাবে সঙ্গ দিয়েছে
তার তুলনা নেই। প্রথম যখন ওর অসুস্থতা ধরা পড়ে তখন ওর বড় মেয়েটির বয়স মাত্র ছয়
বছর, ছোট সন্তানটির মাত্র কয়েক মাস। আত্মীয় পরিজনহীন এই বিদেশ বিভুঁইয়ে স্বামী
বেচারা বৌ নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াবে না বাচ্চা সামলাবে, চাকরী করবে কিভাবে আর রান্নাই
বা করবে কিভাবে তা নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে গেল। ক্যাল্গেরীর ভাবীরা ফেরেস্তার মত
নাজিল হলেন এ’সময়। কেউ চেনেন কেউ চেনেন না তাদের, কিন্তু সবাই নির্দ্বিধায় এগিয়ে
এলেন। কেউ বাচ্চাদের দেখাশোনা করলেন, কেউ রান্না করে পাঠালেন, কেউ অর্থ সংগ্রহ
করলেন যেন ভাই কাজ করার পরিবর্তে স্ত্রী সন্তানদের নিবিড়ভাবে সময় দিতে পারেন।
একদিন দু’দিন নয়, দেড়টা বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁরা সহযোগিতা করে গিয়েছেন এই
পরিবারটিকে।
প্রথম যেবার তার
সাথে দেখা করার সাহস সংগ্রহ করতে সক্ষম হই সাথে বান্ধবী জেসমিন আপা আর স্বপ্না
আপাকে নিয়ে যাই কথা বলার জন্য। সে মাত্র মাস দু’তিন আগের কথা। স্নিগ্ধ হাসিমুখখানা
দেখে কে বলবে বেচারী এত অসুস্থ? বাচ্চা দু’টো এসে ওদের আঁকা ছবি দেখাচ্ছে, আধো আধো
বোলে কথা বলছে। সে আমাদের বলল, ‘আমি এখন অর্থসহ কু’রআন পড়ছি। কিন্তু বড়ই আফসোস
হচ্ছে যে অনেক দেরী করে ফেলেছি। এটা তো আমার প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের সহজ
রোডম্যাপ। কিন্তু আমি এমন সময় এটা পড়ছি যখন আমার পথ শেষ হয়ে এসেছে। কত ভুল পথ
মাড়িয়ে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি! যদি শুরু থেকেই এই মানচিত্র অনুসরন করতাম কত সময়
বাঁচত আমার, আরো কত দূর অগ্রসর হতে পারতাম, কত ভুলভ্রান্তি এড়িয়ে চলতে পারতাম!
আপনারা এই ভুল করবেন না। জীবনটাকে এখনই সংশোধন করুন যেন আমার মত পথের শেষে দাঁড়িয়ে
হায় হায় করতে না হয়’। তাকে সাহস দিলাম, ‘ডাক্তার তো আর গড নয়, তুমি সাহস হারিয়োনা।
চিকিৎসা চলুক, পাশাপাশি তোমার সৃষ্টিকর্তার সাথে একটা চুক্তি করা যায় কিনা দেখ যে
এই মূহূর্ত থেকে তোমার জীবন, মৃত্যু, নামাজ এবং ত্যাগ হবে কেবল তাঁর সন্তুষ্টির
জন্য। তিনি রাজী হয়ে গেলে এই রোগ সেরে যাওয়া কোন ব্যাপার নয়। যিনি রোগ সৃষ্টি
করেছেন তিনি রোগ নিরাময় করতেও সক্ষম। তিনি আইয়ুব (আ)কেও তো আরোগ্য দান করেছিলেন’।
দু’সপ্তাহ আগে
বান্ধবী তাসনীন আপা জানালেন ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছে, সে বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে
পরিবার পরিজনের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য। সবাইকে খবর দেয়ার পর বান্ধবীরা সাহায্যের
বন্যা বইয়ে দিলেন। সামনাসামনি সাহায্য দিতে লজ্জা লাগে, তাই তাসনীন আপার মাধ্যমে
আরেকজনকে দিয়ে টাকা দেয়ার ব্যাবস্থা করলাম। সকালে ছাত্রছাত্রী ছিল আমার, তাই বিকালে তাসনীন আপার সাথে যাবার আয়োজন করলাম। বিকালে ফারজানা আপা ফোন করে বললেন তিনি যেতে চান
কিন্তু ঠিকানা চেনেন না। উভয়কেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি পুরো
ক্যাল্গেরীর বাংলাদেশী সমাজের এমন কেউ নেই যে দেখা করতে আসেনি। এদের অনেকেই
রবাহূত। চেনেনা, জানেনা কিন্তু
শুনে ছুটে এসেছে। কেউ সান্তনা দিচ্ছে, কেউ কাঁদছে। আমাকে দিয়ে দু’টোর একটাও হয়না। তাছাড়া
আমি কান্নাকাটি করে রোগীর মনোবল হ্রাস করাটা সঙ্গত মনে করিনা। ওকে দু’জন ডাক্তারের
ঠিকানা দিলাম, বললাম, ‘ডাক্তার তো আর গড নয়। বাংলাদেশে গিয়েমাত্র এদের সাথে
যোগাযোগ করে দেখ। হয়ত আল্লাহ চাইলে সুস্থ হয়ে যেতে পারো। তবে প্রতিটা মূহূর্ত
ইস্তেগফার পড়তে থাকো। যদি যাবার সময় হয়েই যায় তার জন্যও প্রস্তুতি থাকা চাই। যদি
তুমি আগে যাও তাহলে আমার পালনকর্তাকে বোলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে, তবে এমনটাও
বিচিত্র নয় যে গিয়ে দেখলে আমি তোমার আগেই গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি’। সে মৃদু
হাসল, ‘কথা দু’রকম হয়ে গেলনা আপা?’ কিন্তু এটাই যে বাস্তবতা! উভয় পরিণতির জন্যই তো
আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয় প্রতিটা মূহূর্ত। ওর মত সৌভাগ্য ক’জনার হয় যে দেড়বছর আগে
থেকেই প্রস্তুত হবার সময় পাওয়া যায়?
আজ নববর্ষের প্রথম
দিনটিতে, যখন সবাই হাসিখেলায় মত্ত, সে তার মা ভাইবোন, স্বামী সন্তান আর এতগুলো
শুভাকাঙ্খীকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল আপন গন্তব্যে। আল্লাহ তাকে তার ধৈর্য্যের জন্য
পুরস্কৃত করুন, তার ছোটবড় সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিন, তাঁর জান্নাতে তাকে স্থায়ী করে
নিন। পাশাপাশি মৃত্যুর পূর্বমূহূর্ত পর্যন্ত যে সত্যটি সে আমাদের কাছে পৌঁছনোর
আপ্রান চেষ্টা করছিল তা আমাদের অনুধাবন এবং অনুসরন করার সামর্থ্য দিন, সকল অন্যায়
এবং ভুলভ্রান্তি থেকে আমাদের পবিত্র করে দিন। এটুকু প্রার্থনা। ভাল থেকো বোন আমার, বন্ধু
আমার! আমার জন্য অপেক্ষা কোর, আমিও আসছি শীঘ্রই।