Monday, April 15, 2013

বিদায়, বন্ধু আমার

আজ হতে ঠিক দু’সপ্তাহ আগে এই সময় ওর হাত দু’টো আমার হাতের মুঠোয় ধরা ছিল, আমরা কথা বলছিলাম অন্তরঙ্গভাবে, সে হাতের স্পর্শ এখনো আমার হাতে লেগে রয়েছে, কিন্তু হাত দু’টি এখন সাড়ে তিনহাত মাটির নীচে। আজ সকালে সে মারা গিয়েছে। 

ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে সাকুল্যে দু’বার। আমি সুন্দরভাবে কথা বলতে পারিনা, ইমোশনাল পরিস্থিতিতে একেবারেই কথা বলতে পারিনা, মানুষ যে কি করে এত সুন্দর করে কথা বলে তাই বুঝে পাইনা। তাই আড়ালে থেকে পর্যবেক্ষণ করে যাই।
মেয়েটি ছিল সৌভাগ্যবতী। ওর ক্যান্সার হয়েছিল। তার আগে আর দশটা সাধারন মেয়ের সাথে ওর কোন পার্থক্য ছিলোনা। স্বামী, সন্তান, সংসার, জামাজুতোর শখ, সাজগোজ -এর বাইরে ওর কোন পৃথিবী ছিলোনা। কিন্তু ক্যান্সার ওকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। ডাক্তাররা বলে দিয়েছিল ক্যান্সার ধরা পড়ার আগেই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা গেলে হয়ত কিছু করা যেত কিন্তু এত দুর্বল শরীরে চিকিৎসা প্রয়োগ করলেও শরীর রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহজনক। তখন থেকেই সে পৃথিবীর মোহমায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেপ্রভুর সাথে মহামিলনের প্রস্তুতি তখন থেকে শুরু। দেড় বছর কম সময় নয়। এই সময়ে সে নিজের এক একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পাপের জন্য মার্জনা চেয়ে নিয়েছে, জনে জনে ডেকে বুঝিয়েছে, ‘দেখ, আমাকে দেখ। কুড়িটি বছর যখন আমি সুস্থ ছিলাম তখন আমার প্রভুর আদেশ নিষেধের তোয়াক্কা করিনি। আজ যাবার বেলা আমার কাছে তাঁর সামনে ন্যূনতম সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে দাঁড়াবার মত কোন সঞ্চয় নেই, হয়ত কেবল মার্জনাটুকুই চাইতে পারব কিন্তু তা নিশ্চিত করার সময়টুকুও নেই। যেকোন দিন আজরাইল (আ) আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াবেন, আমার বুকের ওপর হাত রেখে আমার রূহকে আহ্বান করবেন, আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে, আমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করব কিন্তু আমার শরীর সেদিন আমাকে সহযোগিতা করবেনা, তারপর আমাকে হাজির করা হবে আমার সৃষ্টিকর্তার সামনেসেই মূহূর্তে তিনি আমার সামনে পরম করুণাময় রূপে বিরাজ করবেন না কি আমাকে দেখে চরম রাগান্বিত হবেন সে কথা ভাবতেই অন্তরাত্মা ভয়ে উড়ে যায়। মনে হয় আমি যদি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম, মিশে যেতে পারতাম মাটির সাথে! তোমরা সেই সময়ের আগেই সাবধান হও যা অবশ্যম্ভাবীতোমরা আমার মত ভুল কোরোনা। তোমরা তার আগেই পরকালের পাথেয় সংগ্রহ কর। এটাই একমাত্র বাস্তবতা। আর সব ভুল। সারাটা জীবন আমরা কেবল ভ্রমে ডুবে থাকি। তোমরা এখনই এই ভুল সংশোধন কর। তোমরা এখনই সাবধান হও’।

ওর মত হাজারটা মেয়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেকিন্তু সারা ক্যাল্গেরী ওর এই যাত্রায় যেভাবে সঙ্গ দিয়েছে তার তুলনা নেই। প্রথম যখন ওর অসুস্থতা ধরা পড়ে তখন ওর বড় মেয়েটির বয়স মাত্র ছয় বছর, ছোট সন্তানটির মাত্র কয়েক মাস। আত্মীয় পরিজনহীন এই বিদেশ বিভুঁইয়ে স্বামী বেচারা বৌ নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াবে না বাচ্চা সামলাবে, চাকরী করবে কিভাবে আর রান্নাই বা করবে কিভাবে তা নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে গেল। ক্যাল্গেরীর ভাবীরা ফেরেস্তার মত নাজিল হলেন এ’সময়। কেউ চেনেন কেউ চেনেন না তাদের, কিন্তু সবাই নির্দ্বিধায় এগিয়ে এলেন। কেউ বাচ্চাদের দেখাশোনা করলেন, কেউ রান্না করে পাঠালেন, কেউ অর্থ সংগ্রহ করলেন যেন ভাই কাজ করার পরিবর্তে স্ত্রী সন্তানদের নিবিড়ভাবে সময় দিতে পারেন। একদিন দু’দিন নয়, দেড়টা বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে তাঁরা সহযোগিতা করে গিয়েছেন এই পরিবারটিকে।
প্রথম যেবার তার সাথে দেখা করার সাহস সংগ্রহ করতে সক্ষম হই সাথে বান্ধবী জেসমিন আপা আর স্বপ্না আপাকে নিয়ে যাই কথা বলার জন্য। সে মাত্র মাস দু’তিন আগের কথা। স্নিগ্ধ হাসিমুখখানা দেখে কে বলবে বেচারী এত অসুস্থ? বাচ্চা দু’টো এসে ওদের আঁকা ছবি দেখাচ্ছে, আধো আধো বোলে কথা বলছে। সে আমাদের বলল, ‘আমি এখন অর্থসহ কু’রআন পড়ছি। কিন্তু বড়ই আফসোস হচ্ছে যে অনেক দেরী করে ফেলেছি। এটা তো আমার প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের সহজ রোডম্যাপ। কিন্তু আমি এমন সময় এটা পড়ছি যখন আমার পথ শেষ হয়ে এসেছে। কত ভুল পথ মাড়িয়ে আজ এখানে এসে পৌঁছেছি! যদি শুরু থেকেই এই মানচিত্র অনুসরন করতাম কত সময় বাঁচত আমার, আরো কত দূর অগ্রসর হতে পারতাম, কত ভুলভ্রান্তি এড়িয়ে চলতে পারতাম! আপনারা এই ভুল করবেন না। জীবনটাকে এখনই সংশোধন করুন যেন আমার মত পথের শেষে দাঁড়িয়ে হায় হায় করতে না হয়’। তাকে সাহস দিলাম, ‘ডাক্তার তো আর গড নয়, তুমি সাহস হারিয়োনা। চিকিৎসা চলুক, পাশাপাশি তোমার সৃষ্টিকর্তার সাথে একটা চুক্তি করা যায় কিনা দেখ যে এই মূহূর্ত থেকে তোমার জীবন, মৃত্যু, নামাজ এবং ত্যাগ হবে কেবল তাঁর সন্তুষ্টির জন্য। তিনি রাজী হয়ে গেলে এই রোগ সেরে যাওয়া কোন ব্যাপার নয়। যিনি রোগ সৃষ্টি করেছেন তিনি রোগ নিরাময় করতেও সক্ষমতিনি আইয়ুব (আ)কেও তো আরোগ্য দান করেছিলেন’

দু’সপ্তাহ আগে বান্ধবী তাসনীন আপা জানালেন ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছে, সে বাংলাদেশে চলে যাচ্ছে পরিবার পরিজনের সাথে শেষ সাক্ষাতের জন্য। সবাইকে খবর দেয়ার পর বান্ধবীরা সাহায্যের বন্যা বইয়ে দিলেন। সামনাসামনি সাহায্য দিতে লজ্জা লাগে, তাই তাসনীন আপার মাধ্যমে আরেকজনকে দিয়ে টাকা দেয়ার ব্যাবস্থা করলাম। সকালে ছাত্রছাত্রী ছিল আমার,  তাই বিকালে তাসনীন আপার সাথে যাবার আয়োজন করলামবিকালে ফারজানা আপা ফোন করে বললেন তিনি যেতে চান কিন্তু ঠিকানা চেনেন নাউভয়কেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি পুরো ক্যাল্গেরীর বাংলাদেশী সমাজের এমন কেউ নেই যে দেখা করতে আসেনি। এদের অনেকেই রবাহূত। চেনেনা, জানেনা কিন্তু শুনে ছুটে এসেছে। কেউ সান্তনা দিচ্ছে, কেউ কাঁদছে। আমাকে দিয়ে দু’টোর একটাও হয়না। তাছাড়া আমি কান্নাকাটি করে রোগীর মনোবল হ্রাস করাটা সঙ্গত মনে করিনা। ওকে দু’জন ডাক্তারের ঠিকানা দিলাম, বললাম, ‘ডাক্তার তো আর গড নয়। বাংলাদেশে গিয়েমাত্র এদের সাথে যোগাযোগ করে দেখ। হয়ত আল্লাহ চাইলে সুস্থ হয়ে যেতে পারো। তবে প্রতিটা মূহূর্ত ইস্তেগফার পড়তে থাকো। যদি যাবার সময় হয়েই যায় তার জন্যও প্রস্তুতি থাকা চাই। যদি তুমি আগে যাও তাহলে আমার পালনকর্তাকে বোলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে, তবে এমনটাও বিচিত্র নয় যে গিয়ে দেখলে আমি তোমার আগেই গিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি’। সে মৃদু হাসল, ‘কথা দু’রকম হয়ে গেলনা আপা?’ কিন্তু এটাই যে বাস্তবতা! উভয় পরিণতির জন্যই তো আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয় প্রতিটা মূহূর্ত। ওর মত সৌভাগ্য ক’জনার হয় যে দেড়বছর আগে থেকেই প্রস্তুত হবার সময় পাওয়া যায়?
আজ নববর্ষের প্রথম দিনটিতে, যখন সবাই হাসিখেলায় মত্ত, সে তার মা ভাইবোন, স্বামী সন্তান আর এতগুলো শুভাকাঙ্খীকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল আপন গন্তব্যে। আল্লাহ তাকে তার ধৈর্য্যের জন্য পুরস্কৃত করুন, তার ছোটবড় সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিন, তাঁর জান্নাতে তাকে স্থায়ী করে নিন। পাশাপাশি মৃত্যুর পূর্বমূহূর্ত পর্যন্ত যে সত্যটি সে আমাদের কাছে পৌঁছনোর আপ্রান চেষ্টা করছিল তা আমাদের অনুধাবন এবং অনুসরন করার সামর্থ্য দিন, সকল অন্যায় এবং ভুলভ্রান্তি থেকে আমাদের পবিত্র করে দিন এটুকু প্রার্থনা। ভাল থেকো বোন আমার, বন্ধু আমার! আমার জন্য অপেক্ষা কোর, আমিও আসছি শীঘ্রই।

Sunday, April 7, 2013

‘আমি’ময় পৃথিবী

দরখাস্তটা রিভিশন দিতে গিয়ে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। ছোট ছোট তিনটা প্যারার এইটুকু অ্যাপ্লিকেশনটাতে ‘আমি’ শব্দটা এসেছে সাতবার, ‘তুমি’ শব্দটি নেই একবারও। কি আশ্চর্য! আমি একজনের কাছে কিছু চাইছি, সুতরাং চিঠিটাতে তাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত, অথচ এর সর্বত্র ‘আমি’র ছড়াছড়ি! আবার অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে বসলাম। বেশ কিছু সময় নিয়ে, অনেক অনেক কাটাকুটি আর ভাষার সতর্ক ব্যাবচ্ছেদের পরও তিনটা ‘আমি’ রয়ে গেলে যেগুলো কিছুতেই বাদ দেয়া গেলনা। ঘটনাটায় নিউরনে একটা আলোড়ন খেলে গেল, চরম লজ্জা পেলেও নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম যে মানুষ আসলেই বড় আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর প্রাণী!

 
কথাটা শুনতে খারাপ শোনালেও আমাদের প্রাত্যহিক বাক্যালাপের দিকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় আসলে তত্ত্বটা কতটা সত্য। আমাদের প্রতিদিনকার সংলাপগুলো একত্রিত করলে দেখা যায় এর অধিকাংশ বাক্যই শুরু হয় ‘আমি’ বা ‘আমার’ শব্দটি দিয়ে। আমাদের সংলাপে ‘আমি’র সাথে সংশ্লিষ্টতা ব্যাতীত ‘তুমি’ বা ‘সে’র অভাব প্রকট এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শব্দগুলো আসে ‘তুমি’ বা ‘সে’ কে নিয়ে ‘আমি’র সমস্যা কিংবা অসন্তুষ্টি কিংবা নালিশ ব্যাক্ত করতে। সংলাপের এই সংকীর্ণতা প্রতিফলিত হয় আমাদের আচরনিক জীবনেও। এই আমিময় পৃথিবীতে ‘তুমি’ বা ‘সে’র প্রতি মমতার অনুপস্থিতি আসলেই আতংকজনক! ‘আমি’র চাওয়া পাওয়া নিবৃত করার জন্য ‘তুমি’ বা ‘সে’র প্রতি নির্দয় হওয়া কিংবা তাকে মিটিয়ে দেয়ার দৃষ্টান্তও বিরল নয়।
 

যখন আমরা ‘তুমি’ বা ‘সে’কে আদৌ মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত থাকি তখন বলি, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। এই কথাটাতেও আত্ম অহমিকাই  প্রকাশিত হয়, কেননা এখানে ‘আমি’র অনুভূতিটাই মুখ্য, ‘তুমি’ বা ‘সে’র অনুভূতিটা গৌণ; বরং ব্যাপারটা এমন যে আমি যে তাকে ভালবাসি তাতেই তার আনন্দিত, বিগলিত, মুগ্ধ এবং কৃতজ্ঞ হয়ে যাওয়া উচিত। কি অদ্ভুত, তাইনা? যাকে মূল্যায়ন করার জন্য এই ভালোবাসা তার চেয়েও এখানে আমার অনুভূতি, আমার চাহিদা, আমার অহমিকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! তাই তো আমরা অহরহ দেখি কেউ ভালবাসায় সাড়া না দিলে তাকে অ্যাসিডদগ্ধ করতে কিংবা হত্যা করতেও মানুষ পিছপা হয়না। একে কি আসলে ভালবাসা বলা যায়? ভালবাসা তো সেটাই যেখানে অন্যের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দ আমার কাছে নিজের চাহিদার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে, নইলে ‘তুমি’ বা ‘সে’র আর কি মূল্য থাকে?

 
পৃথিবীতে যত সমস্যা তার শুরু এই ‘আমি’ দিয়ে। আমাদের সারাক্ষণ ভাবনা আমি কি চাই, আমার কি পাওয়া উচিত, আমি কি পেলাম, আমার যা চাওয়া ছিল তা কেন পেলাম না। এই যাত্রাপথে আমাদের কখনো মাথায় আসেনা ‘তুমি’ কিংবা ‘সে’ কি চায়, ‘তুমি’ বা ‘সে’র কি পাওয়া উচিত, ‘আমি’ কি ‘তুমি’ বা ‘সে’কে বঞ্চিত করছি কিনা। ব্যাস্ত জীবনের অঙ্গন থেকে কিছু সময় করে নিয়ে কারো সাথে দেখা করতে গেলাম, সে প্রথমেই বলবে, ‘তুমি কি আর আমার খবর রাখো?’ একবারও ভাববেনা, আমিই তো তার সাথে দেখা করতে গেলাম কিংবা এতদিন আমি কেমন ছিলাম বা কেন তার সাথে দেখা করতে পারিনি বা সে তো একদিনও আমার কোন খবর নেয়নি! এখানেও সমস্যা ‘আমি’কে এতটা মুখ্য মনে করা যা ‘তুমি’ বা ‘সে’র সুবিধা অসুবিধা সমস্যা এমনকি তার উপস্থিতিকেও আমলেই নেয়না।


দুনিয়ার যত সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু এই ‘আমি’টা। ‘তুমি কি করে আমার জন্মদিন ভুলে গেলে?’ ‘তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমি কি পেলাম?’ ‘আমার কথা আর কে ভাবে?’ ‘আমি নিজ কানে শুনেছি এই কথা’ ‘আমার ধারণা ব্যাপারটা এমন’ ‘ওর একদিন কি আমার একদিন’ ‘আমি কম যাই কিসে?’ এই ‘আমি’কেন্দ্রিকতার কোন শেষ নেই। এই আমিত্ব আমাদের অনুদার, স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, অনাস্থাশীল, অহংকারী, প্রতিশোধপ্রবণ এবং বোকার স্বর্গে বসবাসকারী করে তোলে। এই ‘আমি’কে আমরা কতটা অপরিহার্য মনে করি তা আমাদের প্রচলিত বাগধারাতেই প্রকাশ পায়।


আমরা কথায় কথায় বলি, ‘চাচা, আপন পরান বাঁচা’। বস্তুত কথাটার পেছনে স্বার্থপরতার গন্ধটা যে কত উৎকট তা কি আমাদের একটুও নাড়া দেয়না? সবাই যদি নিজের প্রাণ বাঁচাতেই ব্যাস্ত থাকত তাহলে পৃথিবীর ইতিহাস কতটা কলঙ্কময় হত তা কি আমাদের চিন্তায় আসে কখনো? সবাই নিজের প্রান নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লে কি পৃথিবীতে কোনদিন কোন মহিমান্বিত আত্মত্যাগের ইতিহাস রচিত হত, যুদ্ধ কিংবা মহামারীর সময় সেবা করার কোন লোক পাওয়া যেত,  কেউ মৃত্যুর পারে দাঁড়িয়ে অন্যকে পানি পান করার অগ্রাধিকার দিত, জাহাজডুবির মূহূর্তে কেউ স্ত্রী পুত্র কন্যাকে লাইফবোটে তুলে দিয়ে ডুবন্ত জাহাজে রয়ে যেত, একজন মহামানবকে বাঁচাতে এগারোজন মহাত্মা নিজেদের শরীরকে ঢালে রূপান্তরিত করত, কিংবা একজন মা তার শরীর দিয়ে ঢেকে দিত তার সন্তানকে যেন ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়া দেয়াল তাকে থেঁতলে দিলেও সন্তান অক্ষত থাকে?


প্রতিদিন এই পৃথিবীটাকে দেখি, এই পৃথিবীর মানুষগুলোকে দেখি যাদের দিন শুরু হয় ‘আমি’ দিয়ে, দিন শেষ হয় ‘আমি’ দিয়ে। এই ‘আমি’র বাড়ী লাগে, গাড়ী লাগে, খাবার লাগে, পোশাক লাগে, চিকিৎসা লাগে, সম্মান লাগে, ধন সম্পদ ঐশ্বর্য্য লাগে, সমস্ত প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে আরো লাগে; তবু তার ‘তুমি বা ‘সে’র ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি নিয়েও ভাবার সময় হয়না, তাদের দুঃখ কষ্ট বেদনা তাকে নাড়া দেয়না। প্রতিটি ‘আমি’ অমর হতে চায় যেন একজন ‘আমি’ পৃথিবী থেকে চলে গেলে মানবজাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে, অথচ কত কোটি কোটি ‘আমি’ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে যাদের কেউ মনেই রাখেনি! প্রতিটি ‘আমি’ নিজেকেই সেরা মনে করে যেন পৃথিবীতে কোনদিন কোন শ্রেয়তর মানবের পদচিহ্ন পড়েনি, অথচ এই পৃথিবীর ইতিহাসে হাজার হাজার উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বমহিমায় জ্বাজল্যমান! প্রতিটি ‘আমি’র প্রয়োজনগুলি পূরণ করেন একজন ‘আমি’, অথচ সেই ‘আমি’কে কেউ ধন্যবাদ দেয়া দূরে থাক স্বীকার করার পর্যন্ত প্রয়োজন মনে করেনা!


এই বৈচিত্রময় পৃথিবীতে কিছু বিচিত্র মানুষ জীবনের লক্ষ্যস্থির করে নিয়েছেন ‘তুমি’ কিংবা ‘সে’কে নিয়ে ভাবার, তাদের স্বপ্নপূরন করার, নিজের প্রয়োজনগুলিকে সীমিত করে অপরের প্রয়োজনগুলিকে প্রাধান্য দেয়ার। সবাই তাঁদের বোকা বলে। কিন্তু এই আমিময় পৃথিবীর স্বার্থের ঈষদচ্ছ আচ্ছাদনের ভেতরে যেসব জঘন্য কীর্তিকলাপ চলে তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ দেখেই আমার কেবল ইচ্ছে হয় এই বোকাদের দলে ভিড়তে। সূর্যের প্রচন্ড টান উপেক্ষা করেও কিছু কিছু উল্কা ছিটকে চলে আসে এই মাটির পৃথিবীতে, এই পৃথিবীর বায়ূমন্ডলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগে ক্ষণিকের জন্য জ্বলে ওঠে সেই মহাকাশচারী। একটি জীবনের জন্য একবার জ্বলে ওঠাই কি যথেষ্ট নয়? হাজার হাজার বছর ধরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকার চেয়ে ঐ এক মূহূর্তের জ্বলে ওঠাই কেন যেন কিছু কিছু মানুষকে বেশি আকর্ষন করে। কেননা ঐ একটি মূহূর্তে সে স্বার্থপরতার উর্ধ্বে উঠে আসতে পারে, আমিত্বের কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে পারে, অন্যের আকাশটাকে আলোর মালায় সাজিয়ে দিতে পারে, অপরের মধ্য দিয়েই তৈরী করতে পারে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় – এখানেও ‘আমি’টাই উজ্জ্বল, কিন্তু সংকীর্ণ নয়। এই ‘আমি’টাই হতে ইচ্ছে করে খুব। জানিনা পারব কিনা, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই!