Saturday, August 28, 2010

এক রাত্রির ইবাদাত

কয়েকদিন আগে আমার বান্ধবী তিথি ফোন করে বল্ল কেয়া আপার বাসায় প্রতি রামাদানের মত এবারেও দশম রামাদানের রাত্রিতে ক্যল্গেরীর ধর্মপ্রান মহিলাদের জন্য সালাতুত তাসবীহর আয়োজন হচ্ছে, ও যাচ্ছে, আমি যাব কি’না। আমি বললাম, “আমার বাচ্চা ছোট, আমি মনে হয় পারবনা”।

তার দু’তিনদিন পর আরেক বান্ধবী তানজীন ফোন করে বল্ল আসমা আপার সাথে কেয়া ভাবীর বাসায় যাবে রামাদানের ত্রিশটি রাত্রির মধ্যে অন্তত এক রাত্রির ইবাদাতের আশায়। বললাম, “ছোট বাচ্চা নিয়ে আমি মনে হয় পারবনা”।

পরশু বিকেলে হঠাৎ আমিনা আপা ফোন করে বললেন, “এই বিদেশের মাটিতে রামাদান উপলক্ষ্যে আমরা সবাই একত্রিত হয়ে একটি রাত ইবাদাত করতে যাচ্ছি, আপনিও চলে আসেন”। আমার সেই ক্লাসিক এক্সকিউজ ঝাড়লাম। কিন্তু এবার আর কাজ হোলনা। কারণ ওনার বাচ্চা আরো ছোট। তদুপরি উনি মস্ত সাহসের পরিচয় দিয়ে আমার মত অপদার্থ ব্যক্তিকে একটা গুরু দায়িত্ব দিয়ে দিলেন।

আমার মিস্টারের রাতে কাজ। উনি দিয়ে আসতে পারবেন কিন্তু ফজরের সময় নিয়ে আসতে পারবেন না। আমিনা আপা তারও ব্যবস্থা করলেন। আসমা আপা নামিয়ে দিয়ে যাবেন। এবার তো আর পালানোর উপায় নেই।

রাত ন’টায় ইফতার। দশটায় হাজির হলাম কেয়া আপার বাসায়। গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড। সম্পূর্ণ বেসমেন্ট জুড়ে কার্পেটের ওপর চাদর পেতে নামাজের ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য আলাদা রুমে বিছানা পেতে খেলনা, কম্বল সব রাখা। বেসমেন্টের রান্নাঘরে চা পানি নাস্তার ব্যবস্থা। সবাই মিলে চল্লিশ জন! মহিলারা অনেকেই দিনে চাকরী করে এসেছেন। অনেকে বাসায় মেহমান খাইয়ে এসেছেন। তারপরও তাদের উৎসাহের কোন ঘাটতি নেই। একেকজন হরেকরকম মিষ্টি পিঠা ভাত তরকারী আর পানীয় এত বেশী এনেছে যে সারারাত খেয়েও শেষ হোলনা।

রাত সাড়ে দশটার ভেতর সবাই এশার নামাজ সেরে ফেলল। সাড়ে দশটায় এডমন্টনে ডাক্তার নাজমা আপাকে ফোন করা হোল। ফোন স্পীকারে দিয়ে আমরা তাঁর মুখে কুর’আন থেকে রামাদান বিষয়ে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা শুনলাম। রাসূল (সা) এবং তাঁর সাহাবীগণ রামাদানের জন্য যে প্রস্তুতি নিতেন, একে সফল করার জন্য যে আকুতি নিয়ে তাঁরা ইবাদাত করতেন তার সাথে আমাদের রোজা রাখার তুলনা করে লজ্জা পাব না হাসব বুঝে পেলাম না। আমাদের রামাদানের প্রস্তুতি হোল ইফতারে কে কত পদ রান্না করে টেবিল ভরিয়ে ফেলবে তার পরিকল্পনা, সারাদিন বাজারে বাজারে ঘুরে নামাজ খুইয়ে ঈদের ব্যপারে কম্পিটিশন দেয়া যে কে কত বাহারী আর দামী জামাজুতা কিনতে পারে, তারপর বাসায় এসে কাজের লোকের সাথে চেঁচামেচি করা কেন এখনো ইফতার রেডী হয়নি, দাওয়াত খেয়ে এবং খাইয়ে নামাজ ঠিকমত পড়তে না পারা, কুর’আনের সাথে নিঃসম্পর্ক রোজা রাখা নতুবা কোনরকমে কিছু না বুঝে আরবীতে গড়গড় করে খতম দেয়া। রাসূল (সা) ইফতার আর সেহরী দু’বেলা সাধারণ খাবার খেয়ে স্বাভাবিক সকল কাজকর্ম করে রোজা রাখতেন। আর আমরা সামান্য কয়েক ঘন্টা না খেয়ে হাভাতের মত অর্ধরাত্রির মধ্যে তিনবেলা নানানরকম তৈলাক্ত আর ভারী খাবার গাপুস গুপুস খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। হায়রে! মানুষ একফোঁটাও পানি না খেয়ে দশদিন আর কোনপ্রকার খাবার না খেয়ে ত্রিশ দিন বেঁচে থাকে। আর আমরা মাত্র কয়েক ঘন্টা না খেয়ে নড়তে পারিনা, কাজ করতে পারিনা, আর খেতে বসলে থামতে পারিনা! ফরজ নামাজ পড়তেই আমাদের কষ্ট হয়ে যায়, বাজারে বাজারে ঘুরে লেটেস্ট মডেলের জামাজুতার খোঁজে আমাদের সেই নামাজও মিস হয়ে যায়, মহিলারা রান্না করতে করতে কবে যে নামাজের ওয়াক্ত চলে গেল খেয়াল করার সুযোগই পাননা, আর কাজের লোকের সাথে দুর্ব্যবহার করতে করতে তাঁদের রোজা আদৌ হয় কি’না তার খোঁজ কে রাখে? এত কাজের পর বুঝে বুঝে কুর’আন পড়ে, কুর’আনের মর্মার্থ অনুধাবন করে তাকে নিজের জীবনে অ্যাপ্লাই করার সময় করা তো একেবারেই অসম্ভব! অফিসে যাব লেট করে, ফিরে আসব তাড়াতাড়ি, কাজ করব না পারতে – আমি যে রোজা!

বড়রা তো তবুও ঠেকায় পড়ে রোজা রাখেন, কিন্তু বাচ্চাদের আমরা এত ভালোবাসি যে তারা আধাদিন না খেয়ে থাকবে এটা আমরা সহ্যই করতে পারিনা হোক না সেটা ফরজ ইবাদাত। বাচ্চাদের আরেকটু বেশী খাওয়ানোর চেষ্টায় আমরা অহরহই আফ্রিকার বাচ্চাদের উদাহরণ দেই যে ওরা বছরের পর বছর খেতে পায়না। মজার ব্যপার হোল, কথাগুলো বলতে বলতে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আমরা ভেবেও দেখিনা যে বছরের পর বছর খেতে না পেয়েও বাচ্চাগুলো দিব্যি বেঁচে আছে সুতরাং আমার সন্তানকে আমি ফরজ ইবাদাত শিক্ষা দেয়ার জন্য এক মাস আধাদিন ভালো খাইয়ে, আধাদিন অভুক্ত রাখলে সে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম কেননা কার্যত রোজা রাখলে শরীর সুস্থ থাকে। আমাদের এই আদিখ্যেতার কারণে আমাদের বাচ্চারা আজ ধর্ম থেকেও ধর্মহীন হয়ে বড় হচ্ছে! আরেকটা মজার জিনিস হোল আমাদের সব ভালোবাসা আস্তে আস্তে কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আফ্রিকার বাচ্চারা তো কোন ছাড়, আমরা নিজের বাচ্চা ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসতে পারিনা যেন! আমার একটা বাচ্চার ঈদের জামাজুতার বাজেট থেকে যে পাশের বস্তির সবগুলো বাচ্চার জন্য জামাজুতা কেনা যায় সেটা আমাদের মনেই আসেনা। সুতরাং, আমাদের ভালোবাসা আমাদের সন্তানদের অমানুষ বানাচ্ছে যারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেনা। এই সন্তানেরা স্বাভাবিকভাবেই বড় হলে বাবামাকেও দেখবেনা কারণ তারা শুধু খেতে আর পেতে শিখেছে, খাওয়াতে বা দিতে তো তাদের শেখানো হয়নি!


কুর’আনের আলোচনা শেষ হলে আমরা সবাই আমিনা আপার নেতৃত্বে তারাবী নামাজের জন্য দাঁড়ালাম। ছোটবেলায় আবুধাবীতে স্কুলে পড়তাম যখন, ছুটির আগে স্কুলের অডিটরিয়ামে জামাতে জুহরের নামাজ হত। এই সময়টা আমার এত ভালো লাগত, এত পবিত্র মনে হত! এতগুলো মানুষ একত্রে আল্লাহর সামনে হাজির হয়েছে আল্লাহর রহমতের আশায়। আল্লাহ কি তাদের ফেরাতে পারেন? বাংলাদেশে ফেরার পর আমার বিদেশী মুসলিম বান্ধবীদের সাথে কয়েকবার ছাড়া খুব একটা জামাতে নামাজ পড়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্যল্গেরীতে সর্বত্র মহিলাদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা থাকায় এখানে ঈদ, জুমা বা প্রাত্যহিক নামাজ পড়া মহিলাদের জন্য সহজ। এখানে এসেই আমি প্রথম ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ পাই। অথচ রাসূল (সা) বলতেন বিশেষ করে ঈদের জামাতে যেন এমনকি অসুস্থ মহিলারা পর্যন্ত সামিল হন খুতবা শোনার জন্য এবং মুনাজাতে শরীক হওয়ার জন্য। দুঃখ হয় যে ৮০% মুসলিম জনসংখ্যা নিয়েও বাংলাদেশে এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য যে একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে দোকানে বা রাস্তার ওপর রেখে নিজে নামাজ পড়তে যায় অথচ মহিলাদের নামাজ পড়ার সুযোগ হয়না যেন নামাজ শুধু পুরুষদের জন্যই ফরজ! আমার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমরা যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন প্রায়ই পথে নামাজের সময় হলে আমরা জামাত শেষ হয়ে গেলে কোন মসজিদে নেমে নামাজ পড়ে নিতাম। তাই আমি যখন চট্টগ্রাম অঁলিয়স ফ্রঁসেজ-এ ক্লাস করছিলাম, প্রথমদিন মাগরিবের জামাত শেষে পাশের খালি মসজিদে গেলাম নামাজ পড়তে। নামাজের মধ্যে থাকা অবস্থায়ই শুনতে পেলাম দুই ব্যক্তি প্রচন্ড তর্ক করছে। তর্কের বিষয় আমি। একজন বলছে, “মহিলা কেন মসজিদে নামাজ পড়বে?” আরেকজন বলছে, “পুরুষদের তো নামাজ শেষ, সে এক কোণায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে তাতে তো কারো কোন সমস্যা হচ্ছেনা। তাছাড়া আমি মক্কা শরীফে দেখেছি পুরুষ নারী একত্রে নামাজ পড়ছে”। অন্যজন বল্ল, “মক্কা শরীফে কি হয় না হয় আমার কোন আগ্রহ নেই। দরকার হলে সে নামাজ পড়বেনা, কিন্তু মসজিদে আমি কোন মহিলাকে নামাজ পড়তে দেবনা”। সত্যি সত্যি পরদিন গিয়ে দেখলাম মসজিদের দরজায় ইয়া বড় একটা তালা ঝুলানো! পরে অঁলিয়স ফ্রঁসেজের পাশে একটা হাসপাতালের ইবাদাতখানায় গিয়ে নামাজ পড়তাম। একটা মুসলিম দেশে আমার মত মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য এক চিলতে মাটি হয়না। অথচ আমি যখন ক্যানাডায় চাকরীতে প্রথমদিন গিয়েই বললাম নামাজের জায়গা চাই, আমার বস দুটো বিশাল বিশাল মিটিং রুম দেখিয়ে দিয়ে বল্ল, “এর যেটাতে তোমার ইচ্ছা তুমি নামাজ পড়তে পার”!

তারাবীর পর সালাতুত তাসবীহ। সম্পূর্ণ রুম আল্লাহর প্রশংসায় মৃদু গুঞ্জরনে ভরে উঠলো। এতগুলো মহিলা একটি রাতের জন্য স্বামীসন্তান ভুলে কেবল আল্লাহর গুনগানে মেতে উঠলো! কিছুক্ষণের জন্য মনে হোল আমরা আরশের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছি। নামাজ শেষ হলে অদ্ভুত একটা ভালো লাগার সমাপ্তি ঘটলো। অনেকে কাঁদতে শুরু করলেন।

এরপর আমার দায়িত্ব শুরু হোল। বহুদিন পর বকবকালাম। বক্তব্যের বিষয় ছিল যাকাত। এটি ফরজ ইবাদাত হওয়া সত্ত্বেও আমরা একে যথাযথ গুরুত্বের সাথে পালন করিনা। যাকাতের মাসয়ালাগুলো আমরা অনেকেই সঠিকভাবে জানিনা। কিন্তু আগত আপাদের জানার আগ্রহ আমাকে অভিভূত করল। প্রশ্নের তোড়ে শেষপর্যন্ত আমিনা আপা আর আমি মিলে সামাল দিতে হোল! একজন প্রশ্ন করলেন, “মহিলাদের গোল্ডের যাকাত কে দেবে?” বললাম, “আইনত স্বামী স্ত্রীর যার যার যাকাতের দায়িত্ব তার নিজের। স্বামী যদি দিয়ে দেন তাতে কোন দোষ নেই। নতুবা স্ত্রীকে তার হাতখরচ থেকে টাকা জমিয়ে যাকাত আদায় করতে হবে”। একজন বললেন, “কিন্তু আপা, একজন কাজের লোকও তার কাজের বিনিময়ে বেতন পায়। অথচ বিয়ের কাবিনে স্পষ্ট লেখা থাকার পরও আমাদের স্বামীরা আমাদের খাবার, শাড়ি, গহনা সব দিলেও হাতখরচ তো দেয়না! আমি টাকা পাব কোথায়?” মুশকিলের প্রশ্ন! আমরা তো ইসলামের যেটা সুবিধা হয় সেটা মানি আর যেটা অসুবিধা লাগে সেটা না জানার চেষ্টা করি। তাহলে তো এসব ঝামেলা থাকবেই। কেয়া আপা বললেন, “আপা, আমি আপনাকে নেক্সট লেখার বিষয় ঠিক করে দিচ্ছি- ভরনপোষণ”। দুঃখে হাসলাম কিছুক্ষণ সবাই মিলে।

তারপর তাহাজ্জুদের নামাজ। নামাজের পর সবাই মিলে দোয়া। রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবীবৃন্দ, জীবিত মৃত সুস্থ অসুস্থ বাবামা সন্তান আত্মীয় স্বজন দেশ বিদেশ দুনিয়া আখেরাত কিছুই বাদ গেলনা। অধিকাংশ মহিলারাই কাঁদলেন। সবারই কিছু না কিছু দুঃখ কষ্ট আছে যা তারা আল্লাহকে জানালেন, সমাধানের জন্য সাবমিট করলেন। আমার ওপর শয়তানের আসর খুব বেশী। তাই আমি কাঁদতেও পারলামনা, বলার মত কিছু মনেও করতে পারলামনা। খেতে বসে আসমা আপাকে বললাম, “আপনি তো কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে দিলেন, আমার জন্য কিছু দোয়া করেছিলেন তো? আমি নিজে তো কিছুই করতে পারলামনা”। উনি কিছু বলার আগেই তানজীন বল্ল, “শুনেন, আপনার কেস হোল অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর”। তার মানে কি এই যে আমি এত গুনাহ করেছি যে … আল্লাহই ভালো জানেন।

এরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব। হাতে সময় ছিল কম তাই সবাই টেবিলের পাশে ভিড় জমিয়েছেন। আমাদের মত কম স্বাস্থ্যবতীরা সেই ভিড় ঠেলে কিছুতেই টেবিলের কাছে পৌঁছতে পারছিনা। তখন আসমা আপা বললেন, “কেয়ামত তো বহুদূর। খাবার টেবিলেই আমরা এতক্ষণ যাদের সাথে সময় কাটালাম তাদের চিনতে পারছিনা। সুতরাং আল্লাহ যে বলেছেন কেয়ামতের দিন বাবা মা স্বামী স্ত্রী সন্তান কেউ কাউকে চিনবেনা, ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করতে থাকবে, উনি অবশ্যই ঠিক বলেছেন”। চিন্তা করলাম কত সহজেই উনি একটা কঠিন সত্যকে ব্যাখ্যা করে দিলেন!

খাওয়া শেষে যাদের বাসা কাছে তাদের অধিকাংশ বাসায় চলে গেলেন। আমরা যারা দূরে থাকি তারা ফজরের নামাজের জন্য বেসমেন্টে রওয়ানা দিলাম। গিয়ে দেশি কেয়া আপার ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মেয়ে ঐশী চাদর কম্বল ভাঁজ করে গোছগাছ করতে শুরু করেছে। এই ছোট্ট মেয়েটা আমাদের আসা থেকে যাওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা মায়ের সাথে সাথে সব বাচ্চাদের দেখাশোনা, পানি আনা, খাবার দিতে সাহায্য করা, নামাজ পড়া সব কিছুতেই অংশগ্রহন করেছে। এই বিদেশের মাটিতে ওর মত কেয়ারিং, কন্সিডারেট, সামাজিক আর বিশেষ করে ইসলামিক ছেলেমেয়ে খুব কম দেখে যায়। এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য আপনা আপনিই অনেক দোয়া এলো মন থেকে।

রাত্রি জাগা এই কয়েকজন ইবাদাতকারিনীকে একটু মজা দেয়ার জন্য একটা গল্প বললাম যেটা অনুষ্ঠানের কথা শোনার পর থেকেই মনে আসছিল। আমি যখন আই আই ইউ সি তে কাজ করতাম তখন একবার আমাদের সম্পূর্ণ ইউনিভার্সিটির একটা তিনদিনব্যাপী ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছিল কক্সবাজারে। পুরুষদের আলাদা ব্যবস্থা আর মহিলাদের আলাদা। এই ক্যাম্পের একটা অংশ ছিল ‘কিয়ামুল লাইল’। রাসূল (সা) প্রায়ই রাত্রির কিয়দংশ বা কখনো কখনো সারারাত জেগে ইবাদাত করতেন। এই রাত জেগে ইবাদাতকে আরবীতে বলা হয় ‘কিয়ামুল লাইল’। এটি ছিল আমাদের ক্যাম্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশ। রাতের অন্ধকারে কিছু ইবাদাত, কিছু গল্পসল্প, চা খাওয়া, ফজরের পর কুর’আন পড়তে পড়তে একপাশে সমুদ্র আর আরেকপাশে পাহাড়ের ওপর সূর্য ওঠার দৃশ্য - মনে হত এই পৃথিবীর বাইরের কিছু মূহূর্ত। পরে আমাদের ফাজিল বান্ধবী ফাহমিদা এর নাম দিয়েছিল ‘কেয়ামতের লাইল’ যদিও সে’ই সবচেয়ে পছন্দ করেছিল এই পর্ব! ‘কিয়ামূল লাইলে’ চা খাওয়ানোর জন্য সে ইলেকট্রিক কেটেল বহন করে নিয়ে এসেছিল চট্টগ্রাম থেকে। এই কাহিনী শুনে আমিনা আপা থেকে শুরু করে সবাই হেসেই খুন! ফাহমিদার জন্য খুব মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও আজ উপস্থিত থাকতে পারলে অভিভূত হয়ে বলত, “আপা, চলেন আবার কেয়ামতের লাইল করি!”

ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে এলাম। একটা অসম্ভব সুন্দর রাত শেষ হয়ে গেল।

Saturday, August 14, 2010

ওরা পাকিস্তানী


২০০৮ সালের নভেম্বরে আমরা যখন ক্যাল্গেরী এসে পৌঁছলাম তখন শীত শুরু হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় লোকজনের মতে সেবারের শীত ছিল গত দশ বারো বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। বাংলাদেশের ভয়াবহ গরম থেকে সবেমাত্র এসে হঠাৎ মাইনাস ৪০ ডিগ্রীতে তখনো আমরা কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় খুব একটা বুঝে উঠতে পারিনি। একদিন মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য ছেলেকে স্ট্রলারে নিয়ে বেরিয়েছি। তাপমাত্রা মাইনাস ৩০/৩৫ হবে। কিন্তু মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো বরফের স্তুপ। তখন মাত্র একপশলা স্নো পড়েছে। সাধারণত স্নো পড়া বন্ধ হলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা শুরু হয়। কিন্তু দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত বরফ তখনো সরানোর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছেনা। বহু কষ্টে বরফের স্তুপ ঠেলে ঠেলে স্ট্রলার নিয়ে পাড়ার ভেতর দিয়ে রাস্তার কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছলাম। কিন্তু রাস্তা থেকে তিনচারহাত দূরে স্ট্রলার যে আটকে গেল, সামনেও নিতে পারিনা, পেছনেও আসেনা। নির্জন রাস্তা, বরফের মৌসুমে লোকজন দেখাই যায়না, মেয়ের স্কুলের ছুটির সময় হয়ে এলো প্রায়, ছেলেকে কোলে নিয়ে এতদুর যেতে পারবনা, কিন্তু ছেলে এই বরফের মধ্যে হাঁটতে গেলে ডুবে যাবে – ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম। ব্যাতিব্যস্ত হওয়াতে খেয়ালই করিনি কখন এক ক্যানাডিয়ান লোক রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে বিরাট পা ফেলে বরফের দেয়াল পেরিয়ে আমাদের কাছে চলে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছ?” বললাম, “রাস্তার ওপাড়ের স্কুলে”। সে বাচ্চাসহ স্ট্রলার খেলনার মত তুলে নিয়ে রাস্তার ওপাড়ে নামিয়ে দিয়ে বল্ল, “তুমি বললে আমি তোমাদের স্কুলের সামনে নামিয়ে দিতে পারি”। এদের সাহায্য করার স্বভাব এত বেশী যে ওর অফারে মোটেই আশ্চর্য হলাম না। তবুও ধন্যবাদ দিয়ে তাকে যেতে দিলাম।

লোকটা চলে যেতেই দেখলাম রাস্তার অন্যপাড়েও একই সমস্যা। স্ট্রলার সামনেও যায়না, পেছনেও যায়না! কি করব ভাবছি এমন সময় দেখি একজন লোক মুখেচোখে মাফলার বেঁধে দৌড়াতে দৌড়াতে কাছে এলেন। আমাদের দেশে হলে ভয় পেতাম। কিন্তু এখানে তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ থেকে নীচে চলে গেলে এটা না করে উপায় নেই, মুখের মাংসপেশী জমে যেতে পারে। লোকটা বল্ল, “তুমি মনে হয় নতুন এসেছ, নইলে এমন আবহাওয়ায় কেউ স্ট্রলার নিয়ে বের হয়? তুমি কিছুতেই এই স্নোর ভেতর স্ট্রলার ঠেলতে পারবেনা। যাচ্ছ কোথায় তুমি এই ঠান্ডার ভেতর এত ছোট বাচ্চা নিয়ে? বাচ্চা বাসায় রেখে এলেনা কেন?” এতগুলো প্রশ্নের জবাব দেয়ার মত অবস্থা তখন নেই আমার। বললাম, “মেয়েকে আনতে স্কুলে যাচ্ছি। বাসায় কেউ নেই যার কাছে বাচ্চা রেখে আসতে পারি”। লোকটা বল্ল, “আমিও স্কুলে যাচ্ছি আমার ছেলেমেয়েদের আনতে। এক কাজ কর। তোমার ছেলেকে আমি কোলে নিয়ে নিচ্ছি। তুমি খালি স্ট্রলার ঠেলে নিয়ে আস। তাহলে তোমার আর কষ্ট হবেনা”।

অনেক রাতে যেমন লোকজনের কথা বলার মুড থাকেনা, অনেক ঠান্ডায়ও ঐরকম হয়। উনি আমার ছেলেকে ওনার জ্যাকেটের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন, উষ্ণতার স্পর্শে যেন সে একটু প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। আমি খালি স্ট্রলার ঠেলে নিয়ে চল্লাম। স্কুলে গিয়ে দেখি ওনার বড় মেয়ে জায়নাব আমার মেয়ের এক ক্লাস জুনিয়র আর ছেলে তার এক ক্লাস নীচে। ফেরার পথে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাসা কোথায়?” আমি ঠিকানা বললে উনি বললেন, “আমরাও তো ঐপাড়ায় থাকি! চল, একসাথে যাওয়া যাক”। আমার ছেলেকে এতদুর কোলে নিয়ে উনি একটু কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। তাই এবার ওকে স্ট্রলারে বসিয়ে উনি গলা থেকে মাফলার খুলে স্ট্রলারের সামনে বেঁধে নিলেন। তারপর উনি সামনে থেকে টেনে নিয়ে চল্লেন আর আমি পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে চল্লাম। দেখলাম ওনাদের বাসা আমাদের পাড়ার পেছন দিকটায়। বাসার কাছাকাছি গিয়ে উনি ওনার স্ত্রীকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্ত্রীর পোশাক দেখে এতক্ষণে বুঝলাম ওঁরা পাকিস্তানী। শীতকালে কেউ দরজা বেশীক্ষণ খুলে রাখতে চায়না ঘর ঠান্ডা হয়ে যায় বলে। কিন্তু ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই ওনার স্ত্রী বললেন আমি চাইলে রাদিয়াকে ওনার বাচ্চাদের সাথে স্কুলে পাঠাতে পারি অথবা রিহামকে ওঁদের বাসায় রেখে রাদিয়াকে আনতে যেতে পারি। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বাসায় চলে গেলাম।

আমরা যারা একাত্তুরের অব্যবহিত আগে বা পরে হয়েছি, পাকিস্তানীদের প্রতি বিদ্বেষ তাদের মন মগজ মজ্জায় মিশে আছে। ৫২র ভাষা আন্দোলনের সময় আমার দাদার ছোটভাই, আমার প্রিয় ছোটদাদা ঢাকা মেডিকালের ছাত্র। পাকিস্তানীরা যখন গুলি চালালো তখন একটুর জন্য দাদা রফিক সালাম বরকতদের সারিতে গিয়ে মেশেনি। একাত্তরে ওরা আমার বাবা আর আমার চাচাকে ধরে নিয়ে যায় মেরে ফেলার জন্য। বাবা যদি পাকিস্তানে পড়াশোনার সুবাদে উর্দু বলতে বা বুঝতে না পারত আর এফ কে চৌধুরী যদি দাদার বন্ধু না হতেন, তাহলে আমার আর পৃথিবীতে আসতে হতনা। আমি নিজেও তাদের জ্বালা কম ভোগ করিনি যদিও আমার জন্ম স্বাধীনতার পরে। আবুধাবীতে আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে ছিল যার বাবাকে মুক্তিযোদ্ধারা ঠ্যাং ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। সেই মেয়ে সুযোগ পেলেই আমার পেছনে লাগত যেন আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওর বাবার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিয়েছি!

পাকিস্তানের পাঠানদের খুব ভালো দেখেছি। তাদের আহামরি কোন জ্ঞানবুদ্ধি নেই। কিন্তু আমি আবুধাবীতে প্রায়ই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম রাস্তার আইল্যান্ডে যে খেজুর বাগান, তাতে একজন পাঠান সকালসন্ধ্যা কাজ করতেন। প্রতিদিন আজানের সাথে সাথে উনি জামা বদলে ওজু করে বাগানেই নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমার দেখতে যে কি ভালো লাগত! জুমার রাত এবং জুমার দিন পাঠান ট্যাক্সিচালকরা মুসলমানদের থেকে কোন টাকাপয়সা নিতেন না। ঈদের দিন খেজুরবাগানে যেসব পাঠান কাজ করতেন তারা বাবাকে নামাজ শেষে বাসায় যাবার পথে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে ভোজ খাইয়েছিলো। আর আমার ক্লাসের ঐ বজ্জাত মেয়েটার থেকে আমাকে সারাক্ষণ ছায়ার মত আগলে রাখত বিশালকায় একটা পাঠান মেয়ে। কিন্তু পাঞ্জাবীরা হাড়বজ্জাত। ওরা আমাদের যেমন জ্বালিয়েছে, পাকিস্তানের বাকী অঞ্চলের লোকজনকে ঠিক সেভাবেই জ্বালিয়ে খাচ্ছে। সব মিলে সাধারণভাবে পাকিস্তানীদের আমার খুব একটা পছন্দ না। তাই ওদের সাথে আর যোগাযোগ হয়ে উঠলোনা।

শীত যাই যাই করছে এমন সময় একদিন ঐ লোক একবাটি ফিরনী নিয়ে উপস্থিত, সাথে বন্ধুত্বের আহবান! ততদিনে স্কুলে আমার মেয়ের সাথে জায়নাবের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। ওনাদের মিষ্টি আহবানে আমি ঝাল ঝাল পাকোড়া দিয়ে সাড়া দিলাম। পরে জানতে পারলাম ওনাদের বাড়ী পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে। তখন নিজেই লজ্জা পেলাম। ঐ অঞ্চলের লোকজন খুব সহজসরল আর ভালো হয়। যেমন তার কিছু দিন পর আমরা পাড়ার মধ্যেই আরেকটা বাসায় শিফট করলাম। বেচারা, ওনার নাম শাফকাত, বৃষ্টির মধ্যে নিজে মাথায় করে ভারী বিছানা আগের বাসা থেকে নতুন বাসায় এনে আমাদের সাথে ধরাধরি করে সেট করে দিলেন। শিফট করার শেষদিন রান্না করতে কষ্ট হবে দেখে ওনার স্ত্রী হাবিবা আমাদের বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ালেন। আমাদের পাড়ায় দু’টো বাংলাদেশী পরিবার আছে। তাদের কাছেও আমরা এই সহযোগিতা আশা করিনি। তাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই সাহায্য আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে দিল।

বাসা গোছগাছ হওয়ার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমরা তাঁদের দাওয়াত দিলাম। আমার জানা ছিলোনা যে ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সের লোকজন ঝাল খায়না। ঝাল কমিয়ে রান্না করার পরও তাঁদের মুখ ঝালে লাল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁরা আচার আচরণ কথাবার্তায় বুঝতেই দিলেন না যে তাঁদের খেতে কষ্ট হয়েছে। যখন ধারণা করলাম ঘটনা কি, আমি নিজেই লজ্জায় মারা যাচ্ছি। কিন্তু তাদের ভদ্রতায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

কিছিদনের মধ্যে দেখা গেল হাবিবা পাড়ার ছেলেমেয়েদের ক্কুর’আন পড়তে শেখায়। আমাদের বাংলাদেশীদের অধিকাংশই বিদেশে এসে হালাল হারামের ধার ধারেননা আর ইসলামিক লোকজন আমরা তখনো খুঁজে পাইনি। তাই আমরা খুব বিপদে পড়ে গেছিলাম যে কাকে জিজ্ঞেস করলে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। প্রত্যেকটা খাবার কেনার জন্য প্যাকেটের ওপর ইনগ্রেডিয়েন্টস পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। প্রতিবেলা বাসায় রান্না করতে করতে মনে হচ্ছিল এর থেকে বুঝি আর নিস্তার নেই। শাফকাত ভাই আমাদের অনেক মসজিদ, হালাল দোকানপাট চিনিয়ে দিলেন। দেখলাম ক্যাল্গেরীতে ভুড়ি ভুড়ি মুসলিম দোকানপাট আর হালাল রেস্টুরেন্ট আছে। বিভিন্ন দোকানে যে কাঁচা খাবারের প্যাকেট পাওয়া যার তার ওপরেই কোম্পানীর ফোন নাম্বার দেয়া থাকে। ফ্যাক্টরীতে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া যায় এতে শুকরজাত কোন উপাদান বা জেলাটিন আছে কি’না ইত্যাদি। শিখলাম নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলো কোনটা কোন কোম্পানীর কিনলাম সেটা মুখস্ত করে ফেলতে হবে আর তার পর থেকে সবসময় একই কোম্পানীর কিনতে হবে, নতুবা নতুন ব্র্যান্ড কিনতে হলে আবার ফ্যাক্টরীতে ফোন করতে হবে। আমাদের যতদিন গাড়ী ছিলনা ততদিন উনি আমাদের বাজারে নিয়ে যেতেন আবার বাসার সামনে বাজার নামিয়ে দিয়ে যেতেন নিজের হাতে।

সেবার স্কুল শুরু হওয়ার পর থেকে রাদিয়ায় তাদের সাথে স্কুলে যেতে শুরু করল। হাবিবা প্রায়ই নানারকম তরকারী নাস্তা বানিয়ে পাঠায়। পরে দেখলাম শুধু আমাদের নয়, পাড়ার যত পরিচিত লোকজন, অসুস্থ রোগী সবাইকে সে নিয়মিত খাবার পাঠায়, কারো অসুবিধা থাকলে তাদের বাচ্চাদের ওদের বাসায় রেখে যায়। আমি নিজেও একবার এক মৃত ব্যাক্তিকে দেখতে যাওয়ার সময় আমার ছেলেমেয়েদের হাবিবার কাছে রেখে গেলাম। তখন রাদিয়া জানালো শাফকাতভাই বাচ্চাদের জন্য নানারকম খেলনা বানান আর পাড়ার তাবৎ বাচ্চাদের খেলতে দেন। বিশেষ করে ওনার হাতে বানানো প্লেন আর অটোমেটিক স্কিপিং রোপ বাচ্চাদের খুব পছন্দ হোল।

কিছুদিনের মধ্যে আমার হাবিবার সাথে এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে রান্নার মাঝে লবণ মরিচ পেঁয়াজ শেষ হয়ে গেলে আমি নির্দ্বিধায় ওর বাসা থেকে নিয়ে আসতে শুরু করলাম। বাচ্চাদের খেলনা, রিহামের সেই বিখ্যাত স্ট্রলার আদানপ্রদান হোল।

এর কিছুদিন পর আমি একটা কোর্সে ভর্তি হলাম। হাবিবা বারবার অনুরোধ করল রিহামকে ওর কাছে রেখে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি পারতপক্ষে লোকজনকে কষ্ট দিতে পছন্দ করিনা। তাই ওকে ডে-কেয়ারে রাখার ব্যাবস্থা করলাম। কোর্সের শেষাংশে দেড়মাস চাকরী ছিল। আমার ভাগ্য ভাল। একটা বড় গ্যাস কোম্পানীতে কাজ পেলাম। যাওয়া হত সকাল সাতটায় যেখানে সূর্যোদয় হয় সকাল ন’টায়। বাচ্চাদের ঘুমে দেখে যেতাম। বাড়ী ফিরতাম সন্ধ্যা পাঁচটায় অথচ সূর্যাস্ত হত সাড়ে চারটায়। চাকরীটা ভালোই ছিল। নামাযের ব্যাপারে কোন অসুবিধা ছিলনা। আমাদের বাসা রেলস্টেশন থেকে দুই মিনিটের হাঁটাপথ। তাই মাইনাস ৪০ ডিগ্রীতেও যাওয়া আসাতে খুব একটা কষ্ট হতনা। ডাউনটাউনের সব বিল্ডিং কাঁচের টানেল দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত। তাই বাইরে যখন মাইনাস ৪০ তখন লোকজন টানেলে +১৫ ডিগ্রীতে চলাফেরা করতে পারে যে কারণে এই টানেলগুলোর নামই প্লাস ফিফটিন। কিন্তু দেখা গেল কাজ করে এসে, ঘর গুছিয়ে, রান্না করে বাচ্চাদের কিছুতেই সময় দিতে পারছিনা। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম দেড়মাস পূর্ণ হয়ে গেলে আর চাকরীর নামও নেবনা।

আমাদের পাঁচটা ছ’টার মধ্যে খেয়ে ফেলার অভ্যাস। দেখা গেল পাঁচটায় এসে ছ’টার ভেতর রান্না করে বাচ্চাদের খাইয়ে সব গুছিয়ে দশটার মধ্যে শুতে গিয়ে কিছুতেই আর কুলিয়ে উঠতে পারিনা। আমার বাচ্চাদের কখনো বাইরের খাবার, ফাস্টফুড বা প্যাকেটজাত খাবারের অভ্যাস করাইনি। তাই টেনশানটা ছিল বেশী। এ’সময় হাবিবা প্রতি সপ্তাহে নিজে থেকেই দু’তিনবার করে খাবার পাঠাতে শুরু করল। একদিন শরীর খারাপ ছিল। সাধারণত আমি আর কিছু না হোক ভাত রান্না করে যেতাম যেন সাড়ে তিনটায় আমার মেয়ে যখন আসে তখন অন্তত ডিম ভেজে হলেও যেন খেয়ে নিতে পারে। সেদিন ভাতও রান্না করা হয়নি। অফিসে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছিনা। চারটা বাজতেই ছুটলাম রেল স্টেশনের দিকে। মনে মনে ভাবছি আমার ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে নিশ্চয়ই শুকনো মুখে বসে আছে। যাব, রান্না করব, তারপর ওরা খাবে, কত দেরী হয়ে যাবে! আমার মেয়েটা আবার ক্ষিদে সহ্য করতে পারেনা। এত কষ্ট লাগছিল আমার বাচ্চাদের জন্য যে নিজেকে অপদার্থ মা হিসেবে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। সেদিন বরফ পড়ে রেললাইন স্লিপারী হয়ে গিয়েছে, সব চলছে ধীরগতিতে আর আমার হার্টবিট বেড়ে চলেছে প্রতি সেকেন্ডে। স্টেশনে যখন নেমেছি তখনই অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি বাসায় উড়ে চলে যাই। স্টেশনের ওপরতলায় উঠতেই শুনি কেউ ডাকছে, “রেহনুমা!” তাকিয়ে দেখি সামির, আমাদের ক্লাসের আলজিরিয়ান ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার। সে স্টেশন পরিবর্তন করতে নেমেছে। পথে আমাকে দেখে খবর নিতে ডাক দিল। সামিরকে আমি খুব পছন্দ করতাম তার শান্ত স্বভাব আর ইসলামপ্রীতির জন্য। কিন্তু সেদিন মনে হচ্ছিল এই দেখাটা আরেকদিন হলে ভালো হত। অনেকটা অভদ্রভাবেই ওর সাথে বাক্যালাপ সংক্ষিপ্ত করে বাসার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। মনে মনে পরিকল্পনা করলাম সামিরকে একদিন দাওয়াত খাইয়ে এর প্রায়শ্চিত্ত করে নেব।

বাসার দরজায় এসে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখের চামড়া টেনশানে চড়চড় করছে। নামাজ আগে পড়ব না ভাত আগে বসাব? চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি আমার ছেলেমেয়ে কিচেনের ডাইনিং টেবিলে বসে মহা উৎসাহে কথাবার্তা বলছে। ভীষণ অপরাধবোধ হোল যে বেচারারা নিশ্চয়ই উল্লসিত যে মা এসেছে, এবার রান্না হবে, খাওয়া দাওয়া হবে! তাকিয়ে দেখি ওরা অলরেডী খাচ্ছে। হাঁফ ছেড়ে ভাবলাম হাফিজ সাহেবকে আল্লাহ রহমত করুন। আমি বাসায় থাকলে উনি প্রায়ই রান্না করেন কিন্তু না থাকলে কেন যে করেন না আল্লাহ জানেন! শেষপর্যন্ত আল্লাহ ওনাকে হেদায়েত করেছেন। রাদিয়াকে বললাম, “কি খাচ্ছ আম্মু?” ও মহা আনন্দে বল্ল, “বিরিয়ানী”। হাফিজ সাহেব তো বিরিয়ানী রান্না করতে পারেন না! “তোমরা বিরিয়ানী পেলে কোথায়?” “হাবিবা আন্টি পাঠিয়েছে”, বলেই আবার খাওয়া দাওয়ায় মনোনিবেশ করল দুই ভাইবোন।

কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে এলো। আল্লাহ তোমাকে ধন্যবাদ এই পাকিস্তানীদের জন্য!

Tuesday, August 10, 2010

রামাদানে জন্মদিন


আমার বয়স তখন সাত বা আট। তখন মাত্র বাংলাদেশে জন্মদিনের অনুষ্ঠান করার চল শুরু হয়েছে। সেবারে আমার জন্মদিন পড়ল রোজার মধ্যে। আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সারাবছর সব বন্ধুদের জন্মদিনের দাওয়াত খেয়েছি আর আমার বেলা এসে খাওয়াতে পারবনা!

বাবা তখন বিদেশে। আর আমরা আমার ছোটভাইয়ের জন্ম উপলক্ষ্যে দেশে আসার পর মগবাজারে দাদার বাসায় আছি। কি আর করা? শেষমেশ মা’র সাথেই আলাপ করলাম।

মা বল্ল, “তোমার বার্থডের জন্য আমার একটা বাজেট আছে। তবে আমি তোমাকে তিনটা চয়েস দেব। এর মধ্যে তোমার যেটা পছন্দ হবে, সেটাই তুমি পাবে”।
“কি কি?”, বললাম আমি।
“এক, তুমি তোমার সব বন্ধুদের দাওয়াত করে খাওয়াতে পারো কিন্তু কেউ কোন গিফট আনতে পারবেনা। দুই, তুমি যে সবসময় বই বই কর, ঐ টাকা দিয়ে তুমি তোমার পছন্দমত বই কিনতে পারো। তিন, রেললাইনের ধারে যে বস্তি আছে, ওখানকার বাচ্চাদের জন্য ঈদের জামা কিনে দিতে পারো”।
“ঠিক আছে। আমি একটু চিন্তা করে দেখি”।

চিন্তা করতে বসে দেখি আমার ছোট্ট মাথায় কিছুতেই হিসাব মেলেনা। গিফটের ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যাথা ছিলোনা, কিন্তু সবার বাসায় খেয়ে এসেছি, তাদের খাওয়ানোটা একটা দায়িত্ব, এই নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা ছিল। কিছুক্ষণ ভাবার পর এই বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে এলাম। যাদের খাওয়াবো তারা সবাই বড়লোক, তারা প্রতিদিনই ভালো খায়। তাছাড়া তাদের তো সারাবছরই খাওয়ানো হয় নানান সময়। সুতরাং তাদের খাওয়ালে বা না খাওয়ালে তেমন কিছু আসবে যাবেনা। একবার জন্মদিন বাদ গেলে এটা তেমন কোন বিরাট ব্যাপার হবেনা। একটা অপশন বাদ দিতে পেরে উৎফুল্ল বোধ করতে শুরু করলাম যে আমি এখন সিদ্ধান্তের অনেক কাছাকাছি।

কিন্তু বাকী দু’টো চয়েস নিয়ে ভাবতে গিয়ে মুষড়ে পড়লাম – কোনটা রাখি আর কোনটা বাদ দেই!

আমি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসার পথে মগবাজারের মোড়ে নতুন লাইব্রেরীটার দিকে হাভাতের মত তাকিয়ে থাকতাম। প্রতিবছর বইমেলা থেকে বই কেনা হত। আমার দাদার ভাইবোন আমাকে বই দিয়ে ভাসিয়ে দিত। তারপরও মনে হত ঐ লাইব্রেরীতে না জানি কি কি বই আছে! একটা বই নিয়ে আমি পড়ে থাকতাম দিনের পর দিন। পৃথিবীর সবকিছু ভুলে গিয়ে এক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম যেখানে কোন দুঃখ কষ্ট আমাকে স্পর্শ করতে পারতনা। তাই বই কেনার লোভটা ছিল সংযমাতিত।

আবার মগবাজার রেললাইনের ধারে এখন যেখানে বিরাট একটা প্রাইভেট হাসপাতাল সেখানে তখন একটা বিরাট বস্তি ছিলো। আমাদের কলোনীর ভেতর ফেরীওয়ালা বা বস্তির লোকজনের প্রবেশ ছিলোনা। কিন্তু আমাদের বাউন্ডারীর পেছনে যে বাসা ছিলো সে বাসায় অনায়াসে বস্তির লোকজন ভিক্ষা চাইতে আসতে পারত। তাদের শরীরে হাড়চামড়া ছাড়া মাংস থাকত কদাচিৎ। পরনের কাপড় শতছিন্ন। মাথায় তেলের অভাবে চুল হয়ে যেত লালচে জটযুক্ত। আমি আমার টিফিনের টাকা থেকে তাদের টাকা পয়সা ছুঁড়ে দিতাম। শেষ হয়ে গেলে মা আবার টাকা দিত। কিন্তু দু’টো ঘটনা আমার খুব মনে গেঁথে গিয়েছিল।

আমার বয়স যখন ছয়, তখন একবার একটা লোক পেছনের বাসায় এসে ভীষন করুণভাবে ভিক্ষা চাইতে শুরু করল। বেচারাকে ওরা রুটি দিলো, তরকারী দিলো শেষপর্যন্ত তার কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে ঝাঁটার বাড়িও দিলো। কিন্তু বেচারা বার বার বলতে লাগল, “আমাকে একটা লুঙ্গি দেন মা!” লোকটার পরনে ছিলো একটা শতছিন্ন ছালা। বাবা বিদেশে, আমি জানিনা বাসায় আদৌ বাবার কোন লুঙ্গি আছে কি’না। নানীকে জিজ্ঞেস করলাম। নানীও বলতে পারলোনা। মা তখন বাজারে। আমি বারবার তাকে জানালা দিয়ে বলতে লাগলাম, “আপনি একটু অপেক্ষা করেন। আমার মা বাজার থেকে এলে আমি মা’কে বলব আপনাকে একটা লুঙ্গি দিতে”। লোকটা কি ভাবল কে জানে, হয়ত ভাবল একটা বাচ্চা জানালা দিয়ে হাঁক দিয়ে বলেছে আর কি! আমি বারবার আমার রুমের জানালা আর বাসার দরজার মধ্যে ছুটোছুটি করতে লাগলাম, যদি মা চলে আসে! কিন্তু আমার শত অনুনয় বিনয় উপেক্ষা করে লোকটা চলে গেল। তার প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর মা বাসায় এলো। আমার চোখমুখ বিশুষ্ক দেখে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার?” আমার হৃদয় তখন ছিন্নবিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত। কথা বলতে গেলে চোখে পানি চলে আসবে তাই চুপ করে রইলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি ঐ কষ্ট ভুলতে পারিনা – একটা লোক একটা লুঙ্গি চেয়েছিলো তার লজ্জা ঢাকার জন্য, খাবার পেয়েও কেঁদেছিল, “খাবার চাইনা, একটা লুঙ্গি দাও মা” – অথচ আমি তাকে কোন সাহায্য করতে পারিনি।

আরেকবার আমার নানার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার মা বস্তির লোকজনকে গরুর মাংস দিয়ে আলু রান্না করে ভাত খাইয়েছিল। কলোনীর ভেতরে বস্তির লোকজনের প্রবেশ নিষেধ। তাই গেটের কাছে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হোল। ছোটবেলা থেকেই আমার মানুষের খাওয়া দেখতে খুব ভালো লাগে। তাই মা’কে বহুকষ্টে রাজী করে আমিও গিয়ে দারোয়ান ভাইদের সাথে গেটে দাঁড়ালাম। সবাই বসে খেতে শুরু করল। খাচ্ছে, নিচ্ছে, খাওয়া শেষ করে চলে যাচ্ছে। যখন প্রায় সবার খাওয়া শেষ, তখন একজন বৃদ্ধ এলেন। লোকটা লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা, ঘাড়ে একটা গামছা। প্রথমে আমি খেয়াল করিনি, পরে হঠাৎ চোখে পড়ল ওনার প্লেটে শুধু আলু, কোন মাংস নেই। আমি দারোয়ান ভাইকে বললাম, “ওনাকে মাংস দেন, ওনার প্লেটে সব আলু”। দারোয়ান ভাই বললেন, “আমি দিতে গেছিলাম, কিন্তু উনি শুধু আলু ছাড়া আর কিছু নিচ্ছেন না”। আমার কথাটা পুরাপুরি বিশ্বাস হোলনা। তাই আমি ওনার কাছে গেলাম জিজ্ঞেস করতে, “আপনি মাংস নিচ্ছেন না কেন?” কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, “মা আমাকে কয়টা কাঁচামরিচ দেবে?” আমাদের বাসা ছিল গেট থেকে অনেক দূরে। যে বুয়া পানি দিতে এসেছিলেন তাঁকে বললাম, “তাড়াতাড়ি বাসা থেকে কয়টা কাঁচামরিচ নিয়ে আসেন”। উনি বললেন, “আমি আবার এতদূর যাব আসব?” আমি ক্ষেপে গিয়ে বললাম, “ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি”। মা বকা দেবে ভেবে বুয়াই তাড়াতাড়ি কাঁচামরিচ নিয়ে এলো। আমি মরিচ নিয়ে ওনার কাছে গিয়ে বললাম, “কাঁচামরিচের সাথে কয়েটা টুকরা মাংস খান”। উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন, “মা রে, আমি বস্তিতে থাকি, কিন্ত আমার ভিক্ষার অভ্যাস নাই। আজ ক’দিন কোথাও কাজ না পেয়ে লজ্জাশরম বাদ দিয়ে খেতে এসেছি। মাংস খেয়েছি সেই কবে আমার মনেও নাই। তাই এখন আর মাংস খেলে হজম হয়না”। আমার মনে হোল কষ্টে আমার হৃৎপিন্ডটা যেন দোফালা হয়ে গেল। আমি কোন কথা না বলে এক দৌড়ে বাসায় চলে এলাম। আমার বিছানা আর জানালার মাঝখানে জায়গাটায় লুকিয়ে গেলাম যেন কেউ আমাকে দেখতে না পায়। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো, আমরা কত খাবার ফেলে দেই আর কতলোক না খেতে খেতে খাবার পেলেও আর খেতে পারেনা! আমি যদি কাঁদতে পারতাম তাহলে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি লোকটার জন্য কাঁদতে থাকতাম – এত কষ্ট সেদিন আমার ছোট্ট বুকটায় জমা হয়েছিল।

সিদ্ধান্ত নিলাম, বইয়ের মায়া ছাড়তে হবে। মন শক্ত করে মা’কে গিয়ে বললাম, “বস্তির ছেলেমেয়েদের ঈদের জামা দিলে আমি সবচেয়ে খুশী হব”।

পরদিনই মা হোসেন ভাইয়াকে নিয়ে গিয়ে বাজার থেকে এক বস্তা জামাকাপড় নিয়ে এলো। লালনীল, চকমকে ঝকঝকে, ছোটবড়, ফ্রক শার্ট। হোসেন ভাইয়া আমার ছোটবেলা থেকে আমাদের বাসায় কাজ করে। ওর একমাত্র কাজ ছিল আমাকে ক্ষেপানো। তাই ও যখন বল্ল, “এখানে সব না, আরো কাপড় আসছে”, আমি ভাবলাম ও আবার আমার সাথে ফাজলামী করছে। কিন্তু প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর দেখলাম অনেক অনেক কাপড়সহ একটা ঠেলাগাড়ী আমাদের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন তো আমি খুশীতে দিশাহারা! হোসেন ভাইয়া আর বুয়ার সাথে আমিও দো’তলায় কাপড় ওঠাতে চাইলাম। মা বল্ল, “ওগুলো সব বস্তা করে বাঁধা, এত ওজন তুমি আলগাতে পারবেনা। সব তোলা হলে আমি তোমাকে দেখাব”। আস্তে আস্তে আমার রুমের অর্ধেকটাই ভরে উঠলো নানান রঙের নানান ধরণের কাপড়ে।

সব কাপড় একত্রিত হওয়ার পর মহা উৎসাহে মা, নানী আর আমি মিলে এগুলো খুলে ছেলেদের কাপড়, মেয়েদের কাপড়, বড় কাপড়, ছোট কাপড় সব আলাদা করলাম। এগুলো নিয়ে আমার জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই! এগুলো কবে দেয়া হবে, কিভাবে দেয়া হবে, দুষ্ট বাচ্চাদের দেয়া হবে কি’না। মা বল্ল, “রোজা শুরু হলে যখন ওরা ইফতার নিতে আসবে তখন প্রতিদিন ইফতারের প্যাকেটের সাথে ওদের কাপড় ছুঁড়ে দেয়া হবে। অন্যরা খবর পেয়ে আসবে। এভাবে রোজার ভেতরেই সবাইকে কাপড় দেয়া হয়ে যাবে। আমি মহা উৎসাহে রোজার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আমি রোজা রাখা শুরু করেছি ছ’বছর বয়স থেকে। তখন মা নানী সেহরীতে ডাকতে চাইতনা। আমি কান্নাকাটি করতাম, রাগ করতাম। কখনো আধাদিন রোজা রাখার পর চালাকি করে রোজা ভাঙ্গিয়ে দিত। শেষমেশ পাশের বাসার মিষ্টিদাদু, যিনি আমাকে নামাজ শিখিয়েছেন, আমার পক্ষে এলেন। মা’কে বোঝালেন, “একটা রোজা রাখতে দাও। ওর শখটা পূরণ হোক”। প্রথম যেদিন রোজা রাখলাম আমার স্ফূর্তি দেখে কে? খেলতে খেলতে টেরই পেলাম না দিন কোনদিক দিয়ে গেল! মিষ্টিদাদু খবর দিলেন, প্রথম রোজা রাখার উপহার হিসেবে ওনার বাসায় ইফতারের দাওয়াত। উনি আমাকে খুব আদর করতেন। ওনার ফ্রিজে আমার জন্য সবসময় ফিরনী করা থকত, বড় বড় বয়মে গুড় আর তেঁতুল। এইসব লোভ দেখিয়ে উনি আমাকে নামাজ শেখাতেন! তাই জানতাম ইফতারের দাওয়াত ভালোই হবে। কিন্তু ওনার বাসায় গিয়ে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! টেবিল ভর্তি করে ফেলেছেন উনি বুট পেয়াজু হালিম মিষ্টি পিঠা কেক বানিয়ে! জীবনের প্রথম রোজা সার্থক করে খেলাম। নিজেকে এত স্পেশাল মনে হোল যে তার পর থেকে রোজা রাখা আমার জীবনের লক্ষ্যে রূপান্তরিত হয়ে গেল!

সেবারও খুব উৎসাহ নিয়ে ইফতারের অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। ইফতারের সময় ওরা দল বেঁধে আসত ইফতার নিতে। মা ওদের সাইজ দেখে কাপড় ঠিক করে দিত। তারপর আমরা ইফতার আর কাপড় একসাথে প্যাকেট করে ছুঁড়ে দিতাম। একেকদিন একেক গ্রুপ আসত। অনেক ছেলেমেয়েদের দেখলাম যারা আগে কোনদিন আসেনি। ইফতারের সাথে কাপড় পেয়ে প্রথমে ওরা খুব অবাক হয়ে যেত। তারপর যখন ওরা বুঝতে পারত এটা নতুন কাপড় আর কাপড়টা ওদের, ওদের মুখটা খুশীতে জ্বলে উঠত। ওদের মুখের হাসি দেখে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যেত। ওরা কোনদিন ধন্যবাদ বা থ্যাংক ইউ বলতে শেখেনি, কিন্তু ওদের চেহারার ঝলকানি অনেক বিরস থ্যাংক ইউর চেয়ে অনেক মুল্যবান ছিল কারণ এতে ছিল অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া।

এভাবেই চলছিল রোজার সুন্দর দিনগুলো। একসপ্তাহ বা দু’সপ্তাহ পর একদিন মা হুড়োহুড়ি করে আমাকে রেডি করে বাইরে নিয়ে চল্ল। কিছুতেই বলবেনা কোথায় যাচ্ছি। গেটের কাছে গিয়ে দেখি রিক্সাও নিলোনা। হাঁটতে হাঁটতে আমার বুক ধকধক করতে শুরু করল। তারপর দেখি সত্যি সত্যিই আমরা লাইব্রেরীতে ঢুকলাম! প্রথমে আমি খুব ভদ্রভাবে মা’কে বললাম, “আমি কয়টা বই কিনতে পারব?” মা যখন বল্ল, “তোমার ইচ্ছামত”, আমি সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেলাম! আমি জীবনে অনেক বই কিনেছি। কিন্তু সেদিন যে বইগুলো কিনেছিলাম আমার আজও তাদের নাম মনে আছে। যা কখনো কল্পনাও করিনি তা পেলে কেমন লাগে তা সেদিনই বুঝেছিলাম।

রোজার তৃতীয় সপ্তাহে আমার জন্মদিন ছিলো। সেদিন দেখি মা অনেক রান্না করতে শুরু করল। আমি বারবার গিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করছি, “এত রান্না করছ কেন, কেউ আসবে?” মা বলছে, “আজকে তোমার জন্য স্পেশাল রান্না, তুমি যা যা খেতে পছন্দ কর”। কিন্তু পরিমাণ দেখে আমার কেমন যেন খটকা লাগছে! বিকেলে আমি ঘুমাচ্ছি। নানী এসে বল্ল, “ওঠো, তোমার বন্ধুরা এসেছে!” আমি ভাবলাম ওরা হয়ত খেলতে এসেছে। সবাই মিলে খেলতে খেলতে দেখি মাগরিবের আজান দিয়ে দিল। ভাবলাম, এখন কি হবে? এতগুলো ছেলেমেয়ের ইফিতারের কথা তো মা’কে বলা হয়নি! দেখি মা সবাইকে ইফতারের প্লেট দিতে লাগল। আমি তো হতবাক! কিছুক্ষণ পর শবনম মুশতারী আন্টির মেয়ে টোরী বল্ল, “আন্টিই তো আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন, তাই তো আমরা সেজেগুজে বিকেলেই চলে এসেছি!” কি মজা!

চতুর্থ সপ্তাহে বাবা ছুটিতে এলো। আমার তো সেদিনই ঈদ! তার ওপর বাবা আমার পছন্দে সন্তুষ্ট হয়ে সেবারের মত একটা নিয়ম ভঙ্গ করল। বাবা সবসময় বলত, “আমরা তো সারাবছরই ভালো জামাজুতা কিনি। ঈদের সময় নিজেদের জন্য কিনতে হয়না। এ’সময় তাদের দিতে হয় যারা সারাবছর কিনতে পারেনা। সেসব আত্মীয়স্বজনকে দিতে হয় যারা আমাদের কাছে থাকে সবসময়”। সেবার বাবা আমার জন্য ভারী সুন্দর একটা ঈদের জামা এনেছিলো আবুধাবী থেকে। বুঝে নিলাম আমি সবার কথা ভেবেছি দেখে আল্লাহ আমার জন্য খুশীর পাত্র পরিপূরণ করে দিয়েছেন!

কিন্তু সবচেয়ে ভালোটা তখনো বাকী ছিল।

আমি বরাবরই ঘুমকাতুরে ছিলাম। ঈদের দিন মা আমাকে ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে ডাকাই বন্ধ করে দিয়েছে। ন’টার সময় নানী এসে বল্ল, “তাড়াতাড়ি ওঠো, জানালা দিয়ে দেখ!” ভাবলাম নানী আমাকে ওঠানোর জন্য চালাকি করছে। কিন্তু বাইরে অনেক শব্দ হচ্ছে। কৌতুহলী হয়ে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। তখনো চোখে ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিনা। লালনীল, সবুজ, হলুদ, কমলা, গোলাপী অনেক রঙের মেলা দেখতে পাচ্ছি। প্রত্যেকটা রঙের মাঝখানে একটা করে ছোট্ট মাথা! আমাকে জানালায় দেখামাত্র কোরাস শুরু হোল, “ঈদ মুবারক!” ঘুম ছুটে গেল। দেখি বস্তির সব ছেলেমেয়েরা ঈদে নতুন জামা পরে বাউন্ডারীর বাইরে এসেছে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে। মনে হোল ঈদ আসলেই ভারী সুন্দর একটা দিন। চোখ মুছে বললাম, “ঈদ মুবারক!”

Friday, August 6, 2010

Practise Random Kindness


রিডার্স ডাইজেস্টের কোন এক সংখ্যায় পড়েছিলাম, এক মহিলা পার্কিং টিকেটের পয়সা দিয়ে চলে যাওয়ার পর পেছনের গাড়ীগুলো এসে দেখতে পেলো উনি নিজের পর আরো পাঁচটা গাড়ীর পার্কিং-এর পয়সা দিয়ে গেছেন। কে সেই মহিলা বা কেন তিনি অন্যের পয়সা দিয়ে দিলেন কেউ জানতেও পারলনা। এ থেকে শিক্ষনীয় ছিল যে ভালো কাজ করার পেছনে কোন উদ্দেশ্য থাকা জরুরী নয় বা এর কোন নির্দিষ্ট সময়ও থাকার দরকার নেই। যখন তখন যে কারো জন্য কিছু করার মধ্যেই মানবতা নিহিত।

বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু কার্যত দেখলাম আমি বুঝতেই পারিনা কি করা যায়, কখন করব আর কার সাহায্যের প্রয়োজন আছে! তাই হাফিজ সাহেবের কিছু কিছ কাজ দেখে যেমন অবাক হই তেমনি মুগ্ধ হয়ে যাই।


একদিন দুপুরে হাফিজ সাহেব আর আমি মটরসাইকেল ভ্রমণে বেরিয়েছি। আগ্রাবাদের মোড়ের বাজারে তাজা মাছ দেখে উনি সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। বরিশালের লোকজনের এই এক স্বভাব! মাছ দেখলেই দাঁড়িয়ে যাবে, তা যদি পেছনে ট্রাক মারে তো মারুক! আমাকে বাইকে বসিয়ে উনি চলে গেলেন মাছ দেখতে। এই মাছ, সেই মাছ দেখছেন তো দেখছেন – যেন মাছের সাথে বিয়ে হবে ওনার! কতক্ষণ পর এসে আমাকেও ডেকে নিয়ে গেলেন কোন মাছ আমি খাই আর কোনটা খাইনা জিজ্ঞেস করতে। মনে মনে গর্জাচ্ছি, “আপনার খেতে ইচ্ছে করছে, আপনার পছন্দমত নিলেই তো হয়! আমাকে আবার এর মধ্যে টানাটানি কেন বাবা?” গিয়ে দেখি আসলেই অনেকরকম মাছ এসেছে, একদম তাজা, মাছগুলো তখনো নড়াচড়া করছে আর নড়লেই তাদের শরীরে আলোর ঝিলিক লেগে চকচক করে উঠছে। আমি তখন খাওয়ার কথা ভুলে তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নদী নালা খাল বিল সমুদ্রে হারিয়ে গেছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হাফিজ সাহেব কার সাথে যেন কথা বলছেন। পেছন ফিরে দেখি এক মহিলা, একপ্যাঁচে শাড়ি পরা, শাড়িটা দেখে বোঝা যাচ্ছে এর যথেষ্ট ব্যবহার হয়েছে, আঁচলটা মহিলার মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে একপাশ তাঁর মুখে ধরা। কথা বার্তা এগোচ্ছিলো এভাবে,
“বাসায় কি আছে?”
“একটা মানকচু।“
“কদ্দুর চিংড়ি মাছ হলে হবে?”
“হ্যাঁ।“
“মসলা আছে?”
“হ্যাঁ।”
হাফিজ সাহেব দোকানদারের দিকে ফিরে বললেন, “ওনাকে ২৫ টাকার চিংড়ি মাছ দিয়ে দাও তো!”
তারপর সব মাছের জন্য একত্রে টাকা পরিশোধ করে আমরা আমাদের গন্তব্য বাদ দিয়ে মাছ নিয়ে বাসায় চলে গেলাম।

বাজার থেকে বেরিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কে?”
“আমি কি জানি উনি কে?”
“মানে? আপনিই তো ওনার সাথে কথা বললেন!”
“আচ্ছা, মহিলাকে দেখে তোমার কি মনে হয় উনি আমার পরিচিতা?”
“তাহলে আপনি কি করে বুঝেলেন ওনার কি লাগবে?”
তখন হাফিজ সাহেব আমাকে বুঝিয়ে বললেন, মহিলাকে দেখে উনি বুঝতে পারলেন যে উনি অভাবগ্রস্ত কিন্তু নিজের অভাবের কথা কাউকে বলতে লজ্জা পান। বাসায় কিছু আছে আর বাজারে এসেছেন যদি কিছু সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া যায়। বললেন, “এদেরই সাহায্য করার উচিৎ কারণ এরা নিজেদের অভাবের কখা কখনো প্রকাশ করেনা”।
আমি বললাম, “আমিও আপনার সাথে একমত, কিন্তু উনি এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, কাউকে কিছু বলছেনা। আমরা কেউ খেয়াল করতে পারলাম না, আপনি কি করে বুঝলেন যে ওনার কিছু প্রয়োজন?”
উনি হেসে ফেললেন, “তোমরা যে সময়টা অনেক অনেক বই পড়ে কাটিয়েছ, আমি সে সময়টা অনেক অনেক মানুষের সাথে মিশে কাটিয়েছি। দেখলাম উনি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু কাউকেই কিছু বলছেন না। তাই বুঝলাম ওনার কিছু প্রয়োজন কিন্তু লাজ্জায় বলতে পারছেন না। তাই জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম। এবার বুঝেছ কিভাবে বুঝলাম?”
কিছুই বুঝলাম না, কিন্তু মাথা নাড়লাম।


একদিন আমাদের বাসার পাঁচতলা থেকে দোতলায় নামছি, দেখি আব্বা যেসব দরজা জানাল এনে তিনতলার সিঁড়িতে রেখেছেন চারতলার কোন ফ্ল্যাটে লাগানোর জন্য, কেউ একজন ওগুলো নিয়ে নীচে নামাচ্ছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাই আমার একটু সন্দেহ লাগল। আমি আব্বাকে গিয়ে বললাম, “আব্বা, আপনি কি কাউকে বলেছেন দরজা জানালাগুলো নীচে নামাতে? ওগুলো না চারতলায় লাগাবেন?” আব্বা কোন কথা না বলে সোজা লোকটাকে ক্যাঁক করে ধরলেন। ঘটনা খারাপ বুঝতে পেরে আমি তাড়াতাড়ি হাফিজ সাহেবকে ডাক দিলাম, “আব্বার বয়স হয়ে গেছে, চোর যদি ভয় পেয়ে ধাক্কাটাক্কা দেয়, উনি সিরিয়াস ব্যাথা পাবেন, আপনি তাড়াতাড়ি যান”।

উনি গিয়ে আব্বাকে নীচে পাঠিয়ে দিলেন। কাকাও দৌড়ে এসেছিলেন। ওনাকেও বললেন চলে যেতে। আমি তখন ওপরে যাচ্ছি। উনি ঐ চোরকে পাঁচতলায় নিয়ে এলেন। পাঁচতলার বাগানে বসিয়ে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চুরি কর কেন?” সে অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে যখন বুঝতে পারল যে উনি সত্যি সত্যিই জানতে চান, তখন সে বল্ল সংসারে অভাব অনটন আর অশান্তির কথা। সব শুনে উনি বললেন, “ঠিক আছে, কাল সকাল ন’টায় তুমি আমার সাথে দেখা করবে, আমি সবাইকে বলে রাখব, কেউ তোমাকে কিছু বলবেনা। কাল আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। ওখানে নিলে তোমার চাকরী হবে। তারপর আর তুমি চুরি করবেনা, ঠিক আছে?” সে মাথা নীচু করে চলে গেল।
আমি বললাম, “সে যদি আপনাকে মিথ্যা কথা বলে? কাল যদি সে না আসে?”
উনি বললেন, “সে যদি স্বভাবে চুরি করে তাহলে সে হয়ত কাল আসবেনা। কিন্তু তাকে একটা সুযোগ দেয়া আমার দায়িত্ব, আমি আমার চেষ্টা করলাম।”


আরেকদিন উনি আমাকে আনতে গেছেন আই আই ইউ সি থেকে, ছুটির পর। তখন প্রায় সাড়ে তিনটা-চারটা। মেডিকাল কলেজের পেছনে তখন সম্পূর্ণ রাস্তা ফাঁকা। ছেলেদের হোস্টেলের ঐখানে কে যেন রাস্তায় বাঁশ ঝুলিয়ে রেখে গেছে যাতে ট্রাক বা বাস জাতীয় যানবাহন যেতে না পারে। হঠাৎ উনি দ্রুতবেগে বাইক চালিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বাঁশটা তুলে ধরলেন। আমি বললাম, “এটা তোলার দরকার নেই তো। আমরা এমনিই যেতে পারব”। উনি বললেন, “চুপচাপ বসে থাকো”।

আমি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে যাব, এমনসময় দেখি একজন ঠেলাগাড়িওয়ালা ঠেলাগাড়ীর ওপর বিশাল একটা ফ্রিজ দাঁড় করিয়ে নিয়ে আসছেন রাস্তার ওপাড়ে। উনি বাঁশটা আরেকটু উঁচু করে ধরে বললেন, “যেতে পারবে তো?” ঐ লোক ঠেলাগাড়ী অনায়াসে পাড় করে চলে যাওয়ার পর হাফিজ সাহেব বাঁশটা আবার নামিয়ে দিয়ে বাড়ীর পথে চল্লেন। এ’ কথাটা ওনাকে বলাই যাবেনা, বললে দাম বেড়ে যাবে, কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিলো টেডি বেয়ারের মত এই লোকটাকে আদর করে দেই!


এভাবে বহুবার ওনাকে দেখেছি, দেখে চলেছি – নির্দিষ্ট উপার্জন করেও অকাতরে টাকা খরচ করতে; মানুষের মধ্যে খারাপ কিছু দেখেও তাদের বিশ্বাস করতে, না বলা কষ্টগুলোও বুঝে নিতে। আর প্রতিদিন হিংসে হয়, আমি কেন এমন করে সব বুঝতে পারিনা? কেন?

Wednesday, August 4, 2010

শিমু আমি আর সেই লোকটা

জীবনে একবারই প্রেমে পড়েছিলাম। তাও শিমু আর আমি একসাথে, একইসময়, একই লোকের …

ছোটবেলা থেকেই আমার কোনকিছুতে আগ্রহের ঘাটতি ছিলোনা। বাবার সাথে পাখী শিকার, মাছ ধরতে যাওয়া, কাঠ কেটে ফার্নিচার বানানো, ছবি আঁকা, চিঠি লেখালেখি – নিজে নিজে লুকিয়ে চুরিয়ে গল্পকবিতা লেখালেখি, গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা – স্ট্যাম্প, কার্ড, পাথর জমানো- কেক, বিস্কুট, পুডিং বানানো – আর দিনরাত বই পড়া …

বই পড়তে পড়তে আমি নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতাম; দেশ, বিদেশ আর মহাবিশ্ব ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম; নানান আশ্চর্য, অদ্ভুত আর আজগুবি জিনিস দেখতে দেখতে অভিভুত হয়ে যেতাম; নিউটন, সক্রেটিস আর শেক্সপিয়ারের সাথে আলাপ শেষই হতনা; কখনো রূপকথার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম আর কখনো ইদ্রিস (আ) এর সাথে বেহেস্ত দোজখ ঘুরে আসতাম!

তরপরে সময় পেলে বুয়াদের প্রিয় ছবি দেখতাম, “বন্ধু হতে গিয়ে আমি শত্রু বলেই গণ্য হলাম” বা “কিয়া হুয়া তেরা ওয়াদা, উয়ো কাসাম, উয়ো ইরাদা”। ভাইদের সাথে কার্টুন দেখতাম সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত!

আমার নিজের পৃথিবী নিয়ে আমি এত ব্যাস্ত ছিলাম যে এর বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে আমার কখনো মনেই হয়নি। মাত্র কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়েই আমি পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে জীবন কাটাচ্ছিলাম।

তারপর অনার্সে ভর্তি হলাম। ক্লাসের সবাই বলতে লাগল, “আমাদের ক্লাসে ঠিক তোমার মত আরেকটা মেয়ে আছে”। আমি একটু আশ্চর্য হলাম। ক্লাস শুরু হওয়ার পর একমাস চলে গেল, আমার মত আরেকটা মেয়ে, আমারই ক্লাসে পড়ে, অথচ তাকে আমি কোনদিন দেখিনি! তার কয়েকদিন পর ক্লাসের অন্যান্য বন্ধুরা পরিচয় করিয়ে দিলো, “এই যে, শিমু, যার কথা বলছিলাম তোমাকে!” দেখলাম আমার মতই লম্বা, চওড়ায় আমার চাইতেও কম, আমার মতই সাদা অ্যাপ্রন সাদা স্কার্ফ পরা একটা মেয়ে। আমি দেখতে ভালো না কিন্তু ও দেখতে বেশ সুন্দর। পরিচিতি পর্ব শেষ হতে না হতেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল। আমরা যে যে যার যার জায়গায় বসে পড়লাম। বাসায় যাওয়ার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে আছি সে সময় আবার শিমুর সাথে দেখা। ও বল্ল, “তুমি নামাজ পড় তো?” আমি একটু আশ্চর্য হলাম, তারপরও বললাম, “হ্যাঁ, তুমি?” ও বল্ল, “আমিও। আমাদের মনে হয় বন্ধুত্ব হবে”। তারপর দু’জনে রিক্সা নিয়ে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে রওয়ানা দিলাম। যেতে যেতে ভাবলাম এমন অদ্ভুত মানুষ কোনদিন দেখিনি!

কয়েকদিন যেতে না যেতেই টের পেলাম কেন শিমুকে কোনদিন দেখিনি। আমি ক্লাসে যেতাম ক্লাস শুরু হবার অন্তত আধঘন্টা আগে, সবার সাথে কথা বার্তা বলতাম, তারপর ধীরে সুস্থে সেলিনার পাশে গিয়ে বসতাম। অনার্সের প্রথম দিন থেকে মাস্টার্সের শেষদিন পর্যন্ত সেলিনার পাশেই বসেছি। আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে কম কথা হত ওর সাথে আর তাই ওর সাথে বসলে ক্লাসের মাঝখানে ডিস্টার্ব হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সবচেয়ে কম। সেলিনাও আগে আসলে আমার জন্য ফার্টবেঞ্চে জায়গা রাখত। শিমু আসত থার্ড পিরিয়ডে, ঘুম থেকে উঠে আরাম আয়েশ করে, ঢুলতে ঢুলতে। স্যার/ম্যাডাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে আস্তে করে থার্ড বেঞ্চে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে বসত। গল্প করত পুরা ক্লাস আর ক্লাসের ওপর কমেন্ট্রি লিখত। ওর নামই হয়ে গেল “থার্ড পিরিয়ড শিমু”।

কিন্তু ক্লাসের সবাই ওকে খুব পছন্দ করত। কিছুদিন পর আমিও এর কারণটা বুঝতে পারলাম। ওর মানুষের সাথে মেশার, চিন্তা করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমার চেহারায়ই মনে হয় কিছু একটা সমস্যা আছে। আমি দুষ্টুমী করলেও মানুষ অনেকক্ষণ চিন্তা করে আমি সত্যিই দুষ্টুমী করছি কি’না, যেন আমি শুধু সিরিয়াস কথাই বলতে পারি, আমি দুষ্টুমী করব এটা অসম্ভব ব্যাপার! আর ও দুষ্টুমী করতে করতে অনেক কড়া কড়া কথা বলে ফেলত অথচ কেউ কিছু মনে করতনা। যেমন একদিন এক বান্ধবী বল্ল,”তোদের প্র্যাক্টিকাল খাতাটা দিস তো, আমি কাল ক্লাস করতে পারিনি”। আমি বললাম, “ঠিক আছে, কোন সমস্যা নাই”। শিমু বল্ল, “কেন, কাল কই ছিলি?” সেই বান্ধবী বল্ল, “কাল ‘ও’র সাথে বাইরে গেছিলাম”। আমি জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম কার সাথে, তার আগেই শিমু বল্ল, “আমরা তোকে খাতা দিতে পারবনা। আমরা শুধু ভদ্র মেয়েদের খাতা দেই আর তুই হলি স্বরে অ ভদ্র”। অথচ সেই বান্ধবী হাসতে হাসতে চলে গেল!

কিভাবে যেন শিমুর সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের একটা গল্প ছিলো, দুই বুড়োর যারা পরস্পরকে সহ্য করতে পারেনা কিন্তু একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতেও পারেনা। আমাদের ক্লাসের সুতপা প্রায়ই বলত, “তোদের দু’জনকে দেখলেই আমার ঐ দুই বুড়ার কথা মনে হয়”। সেকন্ড ইয়ারে উঠে আমরা হয়ে গেলাম ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর কোলরিজ, দুই পার্টনার! শিমু ছিল ফিলসফার প্রকৃতির তাই ওর নাম ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর আমার ছিল প্রচন্ড মেজাজ তাই আমার নাম কোলরিজ! আর থার্ড ইয়ারে ও আমার চেয়েও আমার ভাইকে নিয়ে বেশী ব্যাস্ত ছিল। ওর বিয়ে হয়েছে আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের সাথে।

ক্লাসে ছাড়া আর সব জায়গায় আমরা একসাথে ঘুরতাম। একদিন কমনরুমে আপুরা আমাদের জিজ্ঞেস করল আমরা জমজ কি’না! আরেকবার একব্যাক্তি তার এক বান্ধবীকে বললেন অমুক ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে আছে যে দেখতে এমন এমন। কিন্তু বান্ধবী এটাই নির্ধারণ করতে পারলেন না যে মেয়েটা শিমু না আমি! তাই ঐযাত্রা আমরা দু’জনেই কোরবানী হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম। আমার বিয়ের বহু পরে একদিন আগ্রাবাদ হোটেলে গেছি হাফিজ সাহেবের সাথে। ওখানকার এক কর্মকর্তা দূর থেক আমাকে দেখে হাফিজ সাহেবকে বললেন, “আপনার বৌ তো আমার কাজিন হয়!” আমি তো হতবাক! কাছে যাওয়ার পর উনি বললেন, “আপনি শিমু না?” বেচারাকে নিরাশ করে বলতে হোল, “না ভাই আমি শিমুর বান্ধবী”।

ওর সাথে ঘুরতে ঘুরতে আমার অনেক মানুষজনের সাথে পরিচয় হোল। আর আমার বান্ধবীর সাথে চলতে চলতে বুঝতে পারলাম ও কেন এত অন্যমনষ্ক থাকে। আমি পৃথিবীর শুধু ইনোসেন্ট দিকটাই দেখেছি। কিন্তু ও আরো অনেক কিছু জানত যা আমি কখনো কোন বইয়ে পড়িনি। সমাজ সংসারের এই পঙ্কিলতা নিয়ে ও অনেক ভাবত। আর ওর এই ভাবনা আমকেও অনেক ভাবতে শেখালো। আমি আমার নিরাপদ বুদবুদ থেকে কিছুটা বেরিয়ে এলাম যদিও ওর মত করে পৃথিবীটাকে জড়িয়ে ধরতে আমি কখনোই পারিনি, পারবনা।

ও আমাকে বিভিন্ন ইসলামী অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত আর আমার পরিবার যেহেতু ঠিক ইসলামিক ছিলোনা, আমার সবরকম চেষ্টায় ও সবসময় উৎসাহ দিত। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি বক্তৃতা দেয়ার সময় ও আমাকে ইশারা করে হাসতে মনে করিয়ে দিত। কলেজের বাইরেও আমরা প্রতিদিন প্রায় দু’ঘন্টা কথা বলতাম পৃথিবীর তাবৎ বিষয় নিয়ে যেন আমাদের আলাপ আলোচনার ফসল হিসেবে পৃথিবী সুন্দর, শংকামুক্ত, স্বপ্নীল হয়ে যাবে! আমরা যখন সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে গেলাম, তখন দেখা গেল দেশে আসলে অধিকাংশই আমরা কলেজ থেকে ওর বাসায় চলে যেতাম। কখনো অন্যান্য বান্ধবীদের নিয়ে আমরা স্টাডি গ্রুপ করে পড়তাম বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে বিবিধ সাব্জেক্টে নিয়ে গবেষনা করতাম। কখনো শপিং করতে যেতাম যা আমাকে কোনদিন করতে হয়নি, সুতরাং শিমুই ছিল ভরসা। কখনো দু’জনে মিলে ওর সমস্ত মামাখালাদের বাসায় বেড়াতে বের হতাম। দিনের কিয়দংশ ওর বাসায় কাটিয়ে বাসায় ফিরেই আবার ফোনে আলাপ শুরু হত। পরীক্ষার সময় একবার ও আমাকে হাইজ্যাক করে ওর বাসায় নিয়ে গেল দু’জনে মিলে পড়ার জন্য।

এভাবেই চলছিল জীবন।

একদিন শুক্রবারের মুভি দেখছি অলস সময় কাটানোর জন্য। কোন বিখ্যাত কিছু না। বিটিভির সাপ্তাহিক মুভি। গল্পটাও এমন বিশেষ মনে রাখার মত কিছু ছিলোনা বা হয়ত খেয়াল করে দেখিনি বলেই মনে নেই। কিন্তু ছবিটাতে একজন ল্যাংড়া সৈনিক ছিলো। ঐ অভিনেতাও তেমন আহামরি কেউ নয় নিশ্চয়ই কারণ এর আগে বা পরে তাকে আর কোথাও দেখিনি। দেখতেও তেমন কিছু না। কিন্তু বেচারার জন্য আমার এমন কষ্ট লাগছিল!

ছবি শেষ হতেই শিমুর সাথে যোগাযোগ। কে ফোন করেছিলাম তাও মনে নেই। ফোন করেই ও বল্ল, “রেহনুমা, আমি প্রেমে পড়ে গেছি!” আমি বললাম, “আমিও!” ও বল্ল, “কার সাথে?” আমি বললাম, “আগে বল তুমি কার সাথে?” ও বল্ল, “একজন সৈনিকের সাথে …” আমি বললাম, “লোকটা ল্যাংড়া, তাই তো?” ও প্রথমে বল্ল, “হ্যাঁ”, তারপর একটু পর যখন খেয়াল করল আমি কি বলেছি, অবাক হয়ে বল্ল, “তুমি কি করে জানলে?” “সেটাই তো দুঃখ হে বন্ধু!”, বললাম আমি, “আমরা দুজনেই একই লোকের প্রেমে পড়েছি!” এই নিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টুমী করার পর শিমু বল্ল, “হায় রে! হলিউড, বলিউড মায় ঢালিউদের কোন হিরোদের দেখে আমাদের অ্যাকশন রি-অ্যাকশন কিছুই হোলনা, আর একজন ল্যাংড়া সৈনিককে নিয়ে আমাদের দুই বান্ধবীর টানাটানি!” অনেকক্ষণ হাসলাম দু’জনে।

ক’দিন আগে ক্যানাডিয়ান কোন পুরাতন ছবির চ্যানেলে দেখাচ্ছিলো ছবিটা। ছবিটা দেখার মত কিছু না। কিন্তু ঐ ল্যাংড়া সৈনিককে দেখে আবার আগের মতই মায়া লাগল। কিন্তু এবার আরো বেশী মায়া লাগল শিমুর জন্য যে আজ আমার কাছ থেক অনেক অনেক দূরে, ইচ্ছা হলেও ফোন করে যাকে বলতে পারিনা, “শিমু আম প্রেমে পড়ে গেছি!”

Tuesday, August 3, 2010

মো


“টিং টং”

বেল বাজতেই আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আমরা মাত্র ক্যাল্গেরীতে নতুন বাসায় উঠেছি। মালপত্র সব ঘরময় ছড়ানো। দরজার ফ্রস্টেড গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি আমার ফুপু বা ফুপা নয়। ড্রয়িংরুমে সমস্ত জিনিস টালানো, একপাশে বিছানা যা তখনো গুছানো হয়নি। রাদিয়াকে বললাম, “দরজা না খুলে জিজ্ঞেস করে দেখ তো কে এসেছে?” ও এসে বল্ল, “একটা লোক জানতে চাচ্ছে আব্বু বাসায় আছে কি’না”।

কি আর করা, ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে সামান্য দরজা ফাঁক করলাম যাতে ঘরের ভেতরে দেখা না যায়। দেখি একজন লম্বাচওড়া মাঝবয়সী লোক, উস্কোখুস্কো চুল আর অযত্নে বেড়ে ওঠা মোচ, একটা বিদ্ঘুটে সবুজ আর নীল জ্যাকেট পরা, হাতের চামড়ার ফাটা দেখে বোঝা যাচ্ছে এই মাইনাস ৪০ ডিগ্রীতেও বেচারার হাতে কোনদিন ক্রীমের ছোঁয়া লাগেনি, চেহারায় ভারতীয় মনে হোল। বললাম, “উনি তো বাসায় নেই ভাই, আপনার নাম ঠিকানা দিয়ে যান, এলেই আমি জানাব যেন আপানার সাথে যোগাযোগ করেন”।

“আমার নাম মো”, বলে আমার দিকে তাকিয়ে সংশোধন করলেন, “মোহাম্মদ। আমার কাছে একসেট সোফা আছে, আপনারা কিনতে চাইলে আমি দেখাতে পারি। মোহাম্মদ এলে জানাবেন”।

এখানে আসার পর থেকে হাফিজ সাহেবকে সবাই ওনার প্রথম নামেই ডাকে, তাই বুঝতে অসুবিধা হোলনা। কিন্তু ওনার নাম শুনে যখন আমি ওনাকে সালাম দিলাম উনি আমার দিকে এত অদ্ভুতভাবে তাকালেন যে বুঝতে পারলাম উনি সালামে অভ্যস্ত না। তারপর আবার লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বরফের স্তুপের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হাফিজ সাহেব যখন বাসায় এলেন মো’র কথা বললাম। উনি বললেন, “এই লোকই আমাদের বাড়ীওয়ালা। এই পাড়ায় যে ১৯৭ টা বাড়ী, এগুলো ওনার আর ওনার দুই ভাইয়ের প্রপার্টি। এই সবগুলো বাড়ীর যাবতীয় মেন্টেনেন্সের কাজ উনি নিজে করেন। আর ওনার একটা সাইড বিজনেস হোল নতুন ভাড়াটিয়াদের ফার্নিচার আর অ্যাপ্লায়েন্স সাপ্লাই দেয়া”। আমি তো শুনে থ!

তারপর থেকে উনি ঘনঘন আসতে লাগলেন ওনার সোফা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। তিনশ ডলার থেকে সোফার দাম নেমে এলো একশ ডলারে। শেষমেশ একদিন বাসায় এসে আমাদের ধরে নিয়ে গেলেন সোফা দেখাতে। ওনার গাড়ী সেভেন সীটার, ভেতরে টিভি লাগানো আর সিডি প্লেয়ারে শুধু রানী মূখার্জীর গান আর ছবি! বললেন ওনাদের আদি বাড়ী ছিলো হায়দ্রাবাদে। ওনার দাদা দেশ ছেড়ে বাস গড়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওনার বাবা আফ্রিকা থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে আর ভাইরা এসে সেটেল করেছে ক্যানাডায়! আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা তো দেশছাড়া, তাই এখানে পড়ে আছি। আপনারা এখানে এসেছেন কেন? এখানে শুধু পয়সা কামাবেন আর বিল দেবেন। এ’ছাড়া তো এখানে আর কোন জীবন নেই”। আমরা আর কিছু বললাম না।

সোফা রাখা ছিল ওনার বোনের বাসায়। কথায় কথায় বললেন ওনার বাড়ী কাছেই, ঘেরা দেয়া বাংলো বাড়ী (এখানে অধিকাংশ বাড়ীই জায়গা বাঁচানোর জন্য এমনভাবে বানানো হয় যে বেডরুমগুলো ওপরতলায় আর ড্রয়িং ডাইনিং কিচেন নীচতলায়, অধিকাংশ বাড়ীতেই ঘেরা দেয়া থাকেনা, তাই ওনার বাড়ীর বর্ণনা শুনেই বুঝলাম বিশাল ব্যাপার), দাম ৮ মিলিয়ন ডলার! আমার মনে হোল একটা মানুষ এত টাকাপয়সা থাকতে বৌ বাচ্চার সাথে আনন্দে সময় না কাটিয়ে এই বয়সে কেন এত কষ্ট করছেন? কিন্তু সোফায় বসে সব ভুলে গেলাম, মনে হোল এত আরাম যে এর থেকে আর উঠতেই ইচ্ছা করছেনা! ব্যাস, উনি খুশী হয়ে প্রথমে আমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলেন, তারপর নিজ উদ্যোগেই সোফা নিয়ে এসে ওনার কর্মচারীদের একজনের সাথে নিজেই ধরাধরি করে আমাদের ড্রয়িং রুমে আমার সুবিধামত সেট করে দিয়ে গেলেন।

তারপর থেকে কল থেকে ফ্লাশ, দরজা থেকে জানালা, ডিশওয়াশার থেকে ফ্রিজ, সব প্রয়োজনেই উনি সাথে সাথে সাড়া দেন। সবসময় মুখখানা হাসি হাসি, বলেন্, “আপনারা রানী মূখার্জীর দেশের মানুষ!” ওনাকে বোঝাতেই পারিনা যে আমরা দুই দেশের মানুষ। ওনার কথা, “বাংলাভাষী তো!” আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ওনাকে শীত গ্রীষ্ম, দিনরাত, সকাল বিকাল, সপ্তাহে সপ্তাহান্তে, এখানে সেখানে সেই একই বিদ্ঘুটে জ্যাকেট পরে দৌড়ে বেড়াতে দেখি। ঘরে ঘরে মেন্টেনেন্স আর ওয়াশিং মেশিন, ফার্নিচার সাপ্লাই দেন নিজে আর সেভেন সীটার গাড়ী থামিয়ে যেখানে যা ময়লা দেখেন নিজ হাতে তুলে ডাস্টবিনে ফেলেন। বিভিন্ন বাসার টালির ছাঁদ ঠিক করা থেকে পাড়াময় বিশাল এলাকার ঘাস কাটা সর্বত্রই ওনার অংশগ্রহন সেই অযত্ন্রক্ষিত অথচ হাসিখুশী চেহারা নিয়ে। কখনোই কোন ক্লান্তি নেই যেন!

আমাদের পাড়ার অফিসে যারা ভাড়া নেন তারা সবসময় বলেন ওনার মা প্রায়ই সবাইকে দাওয়াত করে বিরিয়ানী খাওয়ান। ক্যানাডিয়ানরা আমাদের খাবার এত পছন্দ করে যে আমার মত আনকোড়া রাঁধুনীও তাদের বিরিয়ানী করে খাওয়াতে বাধ্য হয়েছি।সুতরাং, মো’র মায়ের অবস্থা বুঝতে পারলাম।

একদিন আমাদের বারান্দার দরজা ঠিক করতে করতে উনি বললেন, “দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে, আমি খেয়ে আসি, তারপর বাকীটা করব”। আমরা ভদ্রতা করে বললাম, “আজ নাহয় আমাদের সাথেই খান”। উনি বললেন, “নাহ, আমার মা চিন্তা করবেন”।

খেয়েদেয়ে এলে দুষ্টুমী করে বললাম, “আপনার কি ভাগ্য, এই বয়সে মায়ের হাতের রান্না খেতে পারছেন!” উনি বললেন, “সত্যিই আমার ভাগ্য, আমি প্রতিদিন প্রতিবেলা আমার মায়ের বাসায় খাই!” বললাম, “আপনার বৌ বাচ্চারা কিছু মনে করেনা?” তারপর উনি যে কাহিনী বললেন তার মোটামুটি সারমর্ম হোল, বেচারা বিয়ে করেছেন তিনবার, কিন্তু কোনবারই বৌ টেকেনি। একটা বা দু’টো বাচ্চা আর অনেক অনেক টাকা নিয়ে বৌগুলো ওনাকে ছেড়ে চলে গেছে। চার চারটা ছেলেমেয়ে, কিন্তু শুধু ওনার মেয়েটা ছাড়া আর কোন সন্তান ওনার চেহারা পর্যন্ত দেখতে রাজী না! এতবড় বাংলো বাড়ীতে উনি একা থাকেন। আর মায়ের বাসায় খান। আপাতত ওনার উদ্দেশ্য হোল রানী মূখার্জীকে বিয়ে করা!

একবার আমার বাসায় কি যেন খারাপ হয়েছে কিন্তু মোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যেখানে উনি রবিবারের ছুটির দিন পর্যন্ত আমার ডিশওয়াশার ঠিক করতে এসেছেন, সেখানে ওনাকে ফোন করে পর্যন্ত পাচ্ছিনা! পাড়ায় এক বান্ধবীর বাসা থেকে ঘরে ফিরছি। দূর থেকে ওনাকে দেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। আমাকে দেখে উনি ডাস্টবিনের পেছনে লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। যখন অনেক কাজ থাকে তখন উনি প্রায়ই লোকজন দেখে লুকিয়ে যান। কিন্তু আমার কাজটা জরুরী ছিলো তাই ডাস্টবিনের পেছন থেকেই ওনাকে খুঁজে বের করলাম। উনি বললেন, “শো্নেন, আমার অপারেশন হয়েছে, তাই আমি শুধু গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ছাড়া আর কোন কাজ করছিনা”। আমার শুনে মায়া লাগল, “ওহ, কিসের অপারেশন হয়েছে? আমরা তো জানতাম না!” উনি বললেন, “আমাকে দেখে ৪০/৪৫ মনে হয়না? (আমি মনে মনে বললাম, “হ্যাঁ, বলেছে!”) আমার বয়স কিন্তু আসলে ৬৫। মাত্র ৫০০০ ডলার খরচ করে চুল লাগিয়েছি। মাথার চামড়া তুলে নীচে রুট প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে চুল গজানো হবে। নইলে রানী মূখার্জীকে বিয়ে করব কি করে?” আমি তো হা! বলে কি? আমার ৩৫ না হতেই সব চুল পেকে গেল তাই নিয়ে কোন চিন্তা নাই আর উনি কিনা … বললাম, “আমার কাজটা জরুরী বটে, চলেন, করে দিয়ে যান!” বাসায় ঢুকে উনি হাফিজ সাহবেকে বললেন, “আপনার বৌ মহা জাঁদরেল মহিলা! পুলিশের মত ধরে নিয়ে এল! এবার তো আপনাকে আমার কাজটা করেই দিতে হবে!”

মো চলে গেলে হাফিজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘটনা কি? কি কাজ করে দিতে হবে?” উনি হাসতে হাসতে বললেন, “মো’র ধারণা সব বাঙ্গালী একজন আরেকজনকে চেনে। তাই আমাকে ধরেছে রানী মূখার্জীর সাথে বিয়ের একটা ব্যাবস্থা করে দিতে!” পাগল নাকি লোকটা?

আরেকবার উনি দাঁতের অপারেশন করে মুখটুখ ফুলিয়ে ফেললেন। ডাক্তার নাকি মাড়ির ভেতরে পাত বসিয়ে তার ওপর দাঁত বসিয়ে দিয়েছে! ৮০০০ ডলার। কি অসহনীয় কষ্ট! কাউকে বিয়ে করার জন্য আমি আমার শরীরকে এই কষ্ট দিতে রাজী হতামনা! জ্বী হাফিজ সাহেব, আপনাকেও না!

তার কিছুদিন পর টুকটাক কিছু কাজের জন্য এসে উনি দেখলেন যে কাজগুলো করা হয়ে গেছে। বললেন, “কি মোহাম্মদকে দিয়ে করিয়েছেন?” আমি বললাম, “নাহ, আমিই করেছি। আমার বাবার সাথে করতে করতে আমি মোটামোটি অনেক কাজ শিখেছি। তাই স্পেশাল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন না হলে আমি আপনাকে ডাকিনা”। উনি দুষ্টুমী করে বললেন, “আমার তো এরকম একটা বৌ দরকার, সে সব কাজ করবে আর আমি শুধু ঘুমাব!” আমি বললাম, “হাফিজ সাহেব তো তাই করেন! অল্প কাজ করেন, অল্প খান, অনেক গল্প করেন, অনেক ঘুমান! এত টাকা দিয়ে কি হবে যদি জীবনকে উপভোগ করা না যায়?” উনি আর কিছু বল্লেন না।

কয়েকদিন আগে শপিং করতে গিয়ে দোকানে মো’র সাথে দেখা হয়ে গেল। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একা। আমার ছেলেকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। দুর পেছনে আমাকে আসতে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন। কেন যেন ভালোভাবে হাসতে পারলেননা।

হঠাৎ করে একটা রিয়ালাইজেশন আমাকে ধাঁ করে ধাক্কা দিল। উনি জীবনে অনেক ভুল করেছেন। শুধু সুন্দর দেখে বিয়ে করেছেন তাদের চালচরিত্র খেয়াল না করেই। সুতরাং, ঠকেছেন বারবার। আজ এই বৃদ্ধ বয়সে ওনার বাড়ী আছে, গাড়ী আছে, টাকা আছে। কিন্তু কাজ ছাড়া সময় কাটানোর মত কেউ নেই। একটা কল্পনাকে আঁকড়ে ধরে উনি বেঁচে আছেন। একটা ব্যাস্ত দিনের শেষে যখন আর সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে মলে আইসক্রীম কিনতে যায় তখন তিনি বসে বসে তাদের দেখে আনন্দ পান। তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাড়ী ফিরে যান যেখানে কেউ তাঁর জন্য বসে নেই।

নিজেকে খুব নিষ্ঠুর মনে হোল। আমি কখনোই এই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। বুঝতে চাইওনি হয়ত। বুঝিনি যে নিজের জাতিসত্ত্বা, নিজের ধর্মকে ভুলে যায় সে আর কোন কিছুই ধরে রাখতে পারেনা। সবই এক এক করে তার কাছ থেকে ছুটে যায়। আর শেষপর্যন্ত তার সাথী হয় এক নিরবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গতা। খুব নীচ মনে হোল নিজেকে বেচারার এই কষ্ট না বুঝেই তাকে কখনো পাগল আর কখনো ছিটগ্রস্ত ভাবার জন্য!