Tuesday, August 3, 2010

মো


“টিং টং”

বেল বাজতেই আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আমরা মাত্র ক্যাল্গেরীতে নতুন বাসায় উঠেছি। মালপত্র সব ঘরময় ছড়ানো। দরজার ফ্রস্টেড গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি আমার ফুপু বা ফুপা নয়। ড্রয়িংরুমে সমস্ত জিনিস টালানো, একপাশে বিছানা যা তখনো গুছানো হয়নি। রাদিয়াকে বললাম, “দরজা না খুলে জিজ্ঞেস করে দেখ তো কে এসেছে?” ও এসে বল্ল, “একটা লোক জানতে চাচ্ছে আব্বু বাসায় আছে কি’না”।

কি আর করা, ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে সামান্য দরজা ফাঁক করলাম যাতে ঘরের ভেতরে দেখা না যায়। দেখি একজন লম্বাচওড়া মাঝবয়সী লোক, উস্কোখুস্কো চুল আর অযত্নে বেড়ে ওঠা মোচ, একটা বিদ্ঘুটে সবুজ আর নীল জ্যাকেট পরা, হাতের চামড়ার ফাটা দেখে বোঝা যাচ্ছে এই মাইনাস ৪০ ডিগ্রীতেও বেচারার হাতে কোনদিন ক্রীমের ছোঁয়া লাগেনি, চেহারায় ভারতীয় মনে হোল। বললাম, “উনি তো বাসায় নেই ভাই, আপনার নাম ঠিকানা দিয়ে যান, এলেই আমি জানাব যেন আপানার সাথে যোগাযোগ করেন”।

“আমার নাম মো”, বলে আমার দিকে তাকিয়ে সংশোধন করলেন, “মোহাম্মদ। আমার কাছে একসেট সোফা আছে, আপনারা কিনতে চাইলে আমি দেখাতে পারি। মোহাম্মদ এলে জানাবেন”।

এখানে আসার পর থেকে হাফিজ সাহেবকে সবাই ওনার প্রথম নামেই ডাকে, তাই বুঝতে অসুবিধা হোলনা। কিন্তু ওনার নাম শুনে যখন আমি ওনাকে সালাম দিলাম উনি আমার দিকে এত অদ্ভুতভাবে তাকালেন যে বুঝতে পারলাম উনি সালামে অভ্যস্ত না। তারপর আবার লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বরফের স্তুপের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হাফিজ সাহেব যখন বাসায় এলেন মো’র কথা বললাম। উনি বললেন, “এই লোকই আমাদের বাড়ীওয়ালা। এই পাড়ায় যে ১৯৭ টা বাড়ী, এগুলো ওনার আর ওনার দুই ভাইয়ের প্রপার্টি। এই সবগুলো বাড়ীর যাবতীয় মেন্টেনেন্সের কাজ উনি নিজে করেন। আর ওনার একটা সাইড বিজনেস হোল নতুন ভাড়াটিয়াদের ফার্নিচার আর অ্যাপ্লায়েন্স সাপ্লাই দেয়া”। আমি তো শুনে থ!

তারপর থেকে উনি ঘনঘন আসতে লাগলেন ওনার সোফা বিক্রি করার উদ্দেশ্যে। তিনশ ডলার থেকে সোফার দাম নেমে এলো একশ ডলারে। শেষমেশ একদিন বাসায় এসে আমাদের ধরে নিয়ে গেলেন সোফা দেখাতে। ওনার গাড়ী সেভেন সীটার, ভেতরে টিভি লাগানো আর সিডি প্লেয়ারে শুধু রানী মূখার্জীর গান আর ছবি! বললেন ওনাদের আদি বাড়ী ছিলো হায়দ্রাবাদে। ওনার দাদা দেশ ছেড়ে বাস গড়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওনার বাবা আফ্রিকা থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন লন্ডনে আর ভাইরা এসে সেটেল করেছে ক্যানাডায়! আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা তো দেশছাড়া, তাই এখানে পড়ে আছি। আপনারা এখানে এসেছেন কেন? এখানে শুধু পয়সা কামাবেন আর বিল দেবেন। এ’ছাড়া তো এখানে আর কোন জীবন নেই”। আমরা আর কিছু বললাম না।

সোফা রাখা ছিল ওনার বোনের বাসায়। কথায় কথায় বললেন ওনার বাড়ী কাছেই, ঘেরা দেয়া বাংলো বাড়ী (এখানে অধিকাংশ বাড়ীই জায়গা বাঁচানোর জন্য এমনভাবে বানানো হয় যে বেডরুমগুলো ওপরতলায় আর ড্রয়িং ডাইনিং কিচেন নীচতলায়, অধিকাংশ বাড়ীতেই ঘেরা দেয়া থাকেনা, তাই ওনার বাড়ীর বর্ণনা শুনেই বুঝলাম বিশাল ব্যাপার), দাম ৮ মিলিয়ন ডলার! আমার মনে হোল একটা মানুষ এত টাকাপয়সা থাকতে বৌ বাচ্চার সাথে আনন্দে সময় না কাটিয়ে এই বয়সে কেন এত কষ্ট করছেন? কিন্তু সোফায় বসে সব ভুলে গেলাম, মনে হোল এত আরাম যে এর থেকে আর উঠতেই ইচ্ছা করছেনা! ব্যাস, উনি খুশী হয়ে প্রথমে আমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলেন, তারপর নিজ উদ্যোগেই সোফা নিয়ে এসে ওনার কর্মচারীদের একজনের সাথে নিজেই ধরাধরি করে আমাদের ড্রয়িং রুমে আমার সুবিধামত সেট করে দিয়ে গেলেন।

তারপর থেকে কল থেকে ফ্লাশ, দরজা থেকে জানালা, ডিশওয়াশার থেকে ফ্রিজ, সব প্রয়োজনেই উনি সাথে সাথে সাড়া দেন। সবসময় মুখখানা হাসি হাসি, বলেন্, “আপনারা রানী মূখার্জীর দেশের মানুষ!” ওনাকে বোঝাতেই পারিনা যে আমরা দুই দেশের মানুষ। ওনার কথা, “বাংলাভাষী তো!” আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ওনাকে শীত গ্রীষ্ম, দিনরাত, সকাল বিকাল, সপ্তাহে সপ্তাহান্তে, এখানে সেখানে সেই একই বিদ্ঘুটে জ্যাকেট পরে দৌড়ে বেড়াতে দেখি। ঘরে ঘরে মেন্টেনেন্স আর ওয়াশিং মেশিন, ফার্নিচার সাপ্লাই দেন নিজে আর সেভেন সীটার গাড়ী থামিয়ে যেখানে যা ময়লা দেখেন নিজ হাতে তুলে ডাস্টবিনে ফেলেন। বিভিন্ন বাসার টালির ছাঁদ ঠিক করা থেকে পাড়াময় বিশাল এলাকার ঘাস কাটা সর্বত্রই ওনার অংশগ্রহন সেই অযত্ন্রক্ষিত অথচ হাসিখুশী চেহারা নিয়ে। কখনোই কোন ক্লান্তি নেই যেন!

আমাদের পাড়ার অফিসে যারা ভাড়া নেন তারা সবসময় বলেন ওনার মা প্রায়ই সবাইকে দাওয়াত করে বিরিয়ানী খাওয়ান। ক্যানাডিয়ানরা আমাদের খাবার এত পছন্দ করে যে আমার মত আনকোড়া রাঁধুনীও তাদের বিরিয়ানী করে খাওয়াতে বাধ্য হয়েছি।সুতরাং, মো’র মায়ের অবস্থা বুঝতে পারলাম।

একদিন আমাদের বারান্দার দরজা ঠিক করতে করতে উনি বললেন, “দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে, আমি খেয়ে আসি, তারপর বাকীটা করব”। আমরা ভদ্রতা করে বললাম, “আজ নাহয় আমাদের সাথেই খান”। উনি বললেন, “নাহ, আমার মা চিন্তা করবেন”।

খেয়েদেয়ে এলে দুষ্টুমী করে বললাম, “আপনার কি ভাগ্য, এই বয়সে মায়ের হাতের রান্না খেতে পারছেন!” উনি বললেন, “সত্যিই আমার ভাগ্য, আমি প্রতিদিন প্রতিবেলা আমার মায়ের বাসায় খাই!” বললাম, “আপনার বৌ বাচ্চারা কিছু মনে করেনা?” তারপর উনি যে কাহিনী বললেন তার মোটামুটি সারমর্ম হোল, বেচারা বিয়ে করেছেন তিনবার, কিন্তু কোনবারই বৌ টেকেনি। একটা বা দু’টো বাচ্চা আর অনেক অনেক টাকা নিয়ে বৌগুলো ওনাকে ছেড়ে চলে গেছে। চার চারটা ছেলেমেয়ে, কিন্তু শুধু ওনার মেয়েটা ছাড়া আর কোন সন্তান ওনার চেহারা পর্যন্ত দেখতে রাজী না! এতবড় বাংলো বাড়ীতে উনি একা থাকেন। আর মায়ের বাসায় খান। আপাতত ওনার উদ্দেশ্য হোল রানী মূখার্জীকে বিয়ে করা!

একবার আমার বাসায় কি যেন খারাপ হয়েছে কিন্তু মোকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যেখানে উনি রবিবারের ছুটির দিন পর্যন্ত আমার ডিশওয়াশার ঠিক করতে এসেছেন, সেখানে ওনাকে ফোন করে পর্যন্ত পাচ্ছিনা! পাড়ায় এক বান্ধবীর বাসা থেকে ঘরে ফিরছি। দূর থেকে ওনাকে দেখে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। আমাকে দেখে উনি ডাস্টবিনের পেছনে লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। যখন অনেক কাজ থাকে তখন উনি প্রায়ই লোকজন দেখে লুকিয়ে যান। কিন্তু আমার কাজটা জরুরী ছিলো তাই ডাস্টবিনের পেছন থেকেই ওনাকে খুঁজে বের করলাম। উনি বললেন, “শো্নেন, আমার অপারেশন হয়েছে, তাই আমি শুধু গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ছাড়া আর কোন কাজ করছিনা”। আমার শুনে মায়া লাগল, “ওহ, কিসের অপারেশন হয়েছে? আমরা তো জানতাম না!” উনি বললেন, “আমাকে দেখে ৪০/৪৫ মনে হয়না? (আমি মনে মনে বললাম, “হ্যাঁ, বলেছে!”) আমার বয়স কিন্তু আসলে ৬৫। মাত্র ৫০০০ ডলার খরচ করে চুল লাগিয়েছি। মাথার চামড়া তুলে নীচে রুট প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে চুল গজানো হবে। নইলে রানী মূখার্জীকে বিয়ে করব কি করে?” আমি তো হা! বলে কি? আমার ৩৫ না হতেই সব চুল পেকে গেল তাই নিয়ে কোন চিন্তা নাই আর উনি কিনা … বললাম, “আমার কাজটা জরুরী বটে, চলেন, করে দিয়ে যান!” বাসায় ঢুকে উনি হাফিজ সাহবেকে বললেন, “আপনার বৌ মহা জাঁদরেল মহিলা! পুলিশের মত ধরে নিয়ে এল! এবার তো আপনাকে আমার কাজটা করেই দিতে হবে!”

মো চলে গেলে হাফিজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘটনা কি? কি কাজ করে দিতে হবে?” উনি হাসতে হাসতে বললেন, “মো’র ধারণা সব বাঙ্গালী একজন আরেকজনকে চেনে। তাই আমাকে ধরেছে রানী মূখার্জীর সাথে বিয়ের একটা ব্যাবস্থা করে দিতে!” পাগল নাকি লোকটা?

আরেকবার উনি দাঁতের অপারেশন করে মুখটুখ ফুলিয়ে ফেললেন। ডাক্তার নাকি মাড়ির ভেতরে পাত বসিয়ে তার ওপর দাঁত বসিয়ে দিয়েছে! ৮০০০ ডলার। কি অসহনীয় কষ্ট! কাউকে বিয়ে করার জন্য আমি আমার শরীরকে এই কষ্ট দিতে রাজী হতামনা! জ্বী হাফিজ সাহেব, আপনাকেও না!

তার কিছুদিন পর টুকটাক কিছু কাজের জন্য এসে উনি দেখলেন যে কাজগুলো করা হয়ে গেছে। বললেন, “কি মোহাম্মদকে দিয়ে করিয়েছেন?” আমি বললাম, “নাহ, আমিই করেছি। আমার বাবার সাথে করতে করতে আমি মোটামোটি অনেক কাজ শিখেছি। তাই স্পেশাল যন্ত্রপাতি প্রয়োজন না হলে আমি আপনাকে ডাকিনা”। উনি দুষ্টুমী করে বললেন, “আমার তো এরকম একটা বৌ দরকার, সে সব কাজ করবে আর আমি শুধু ঘুমাব!” আমি বললাম, “হাফিজ সাহেব তো তাই করেন! অল্প কাজ করেন, অল্প খান, অনেক গল্প করেন, অনেক ঘুমান! এত টাকা দিয়ে কি হবে যদি জীবনকে উপভোগ করা না যায়?” উনি আর কিছু বল্লেন না।

কয়েকদিন আগে শপিং করতে গিয়ে দোকানে মো’র সাথে দেখা হয়ে গেল। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একা। আমার ছেলেকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। দুর পেছনে আমাকে আসতে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন। কেন যেন ভালোভাবে হাসতে পারলেননা।

হঠাৎ করে একটা রিয়ালাইজেশন আমাকে ধাঁ করে ধাক্কা দিল। উনি জীবনে অনেক ভুল করেছেন। শুধু সুন্দর দেখে বিয়ে করেছেন তাদের চালচরিত্র খেয়াল না করেই। সুতরাং, ঠকেছেন বারবার। আজ এই বৃদ্ধ বয়সে ওনার বাড়ী আছে, গাড়ী আছে, টাকা আছে। কিন্তু কাজ ছাড়া সময় কাটানোর মত কেউ নেই। একটা কল্পনাকে আঁকড়ে ধরে উনি বেঁচে আছেন। একটা ব্যাস্ত দিনের শেষে যখন আর সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে মলে আইসক্রীম কিনতে যায় তখন তিনি বসে বসে তাদের দেখে আনন্দ পান। তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাড়ী ফিরে যান যেখানে কেউ তাঁর জন্য বসে নেই।

নিজেকে খুব নিষ্ঠুর মনে হোল। আমি কখনোই এই ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। বুঝতে চাইওনি হয়ত। বুঝিনি যে নিজের জাতিসত্ত্বা, নিজের ধর্মকে ভুলে যায় সে আর কোন কিছুই ধরে রাখতে পারেনা। সবই এক এক করে তার কাছ থেকে ছুটে যায়। আর শেষপর্যন্ত তার সাথী হয় এক নিরবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গতা। খুব নীচ মনে হোল নিজেকে বেচারার এই কষ্ট না বুঝেই তাকে কখনো পাগল আর কখনো ছিটগ্রস্ত ভাবার জন্য!

1 comment:

  1. aha!!!!!! ki shundor lekha!!!! rridoy jurie gelo!!

    MOr jonno kharap lagtese.. asholei manusher jibon kotto odbhut! :(

    ReplyDelete