Tuesday, September 21, 2010

অনেক কিছুই আসে যায়


লেকচারার হওয়ার একটা বিশেষ সমস্যা হোল অনেক সময় নিজের অজান্তেই লেকচার দেয়া হয়ে যায়। এই যেমন আমি আই আই ইউ সি’র বেতনের জন্য ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে গেলাম। তখন আমার বিয়ে হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করছি। হাফিজ সাহেবের মত লোকের সাথে বিয়ে হওয়ার একটা বিশেষ সমস্যা হোল ওনার এত বেশী বন্ধু-পরিচিত যে কোথাও গিয়ে একটু প্রাইভেসী পাওয়া যায়না। আমরা দু’জনেই এত ব্যস্ত থাকতাম যে দু’জনের দেখাসাক্ষাতই হতনা। বাসায় যেটুকু সময় থাকতাম সেটাও থাকত ওনার বন্ধুদের টেলিফোনের দখলে। ব্যাংকে এসেও দেখি যে ভদ্রলোক আমার অ্যাকাউন্টের কাজ করছেন তিনি হাফিজ সাহেবকে চেনেন। আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ফর্ম ফিলাপ করতে লাগলাম। কথায় কথায় ব্যাংকার ভাই বললেন, “ভাবী তো দেখছি নাম চেঞ্জ করেননি!” আর পায় কে? কলম রেখে বলা শুরু করলাম, “ভাই, আপনি এ’কথা বলবেন তা আশা করিনি। আমার বাপ আমাকে জন্ম দিল, পেলেপুষে বড় করল, লেখাপড়া শেখালো, বিয়ে দিল আর আমি আজকে একটা স্বামী পেয়ে বাপের নাম বাদ দিয়ে দেব?! পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো স্বামী কে ছিল বলেন তো? রাসূল (সা), তাইনা? অথচ আয়শা (রা)’র নাম তো মিসেস আয়শা মুহাম্মাদ ছিলোনা! তাঁর নাম বিয়ের আগে পরে আয়শা বিন্ত আবু বকরই ছিল। নাম পরিবর্তন করে ফেলা আমাদের সংস্কৃতি না। আমরা অকৃতজ্ঞ নই। স্বামীর সাথে সম্পর্ক তিনটা শব্দ উচ্চারণ করলে পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু বাপের সাথে সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়না”। উনি ভড়কে গিয়ে, “ঠিক, ঠিক” বলতে বলতে তাড়াতাড়ি আমার অ্যাকাউন্ট করিয়ে দিলেন।

আমার মেয়ের জন্মের পর আমি ঠিক উলটো সমস্যায় পড়লাম। মেয়ে হবার আগে কুর’আন থেকে সুন্দর সুন্দর শব্দগুলো বেছে বেছে দশটা ছেলের আর দশটা মেয়ের নাম ঠিক করলাম। মেয়ের নাম নির্বাচন করা হোল ঐ তালিকা থেকেই। কিন্তু শেষের নাম কি হবে তা নিয়ে বিশাল গোলযোগ বেঁধে গেল। ওদের পরিবারে ট্রেডিশনালি ছেলেদের নামের সাথে পারিবারিক টাইটেল যোগ করা হয়, কিন্তু মেয়েদের নামের সাথে ‘সুলতানা’ লাগিয়ে দিয়েই কর্মসম্পাদন করা হয়। আমি হাফিজ সাহেবকে বললাম, “আজকে যদি আমার ছেলে হত তাহলে তার নাম হত অমুক রাহমান, কিন্তু আমার মেয়েকে যদি রাদিয়া সুলতানা ডাকা হয় তাহলে তার পরিচয় কি? সে কার মেয়ে, কোন পরিবারের মেয়ে? সুলতানা মানে রাজকন্যা খুব ভালো কথা কিন্তু এটা একটা মেয়ের প্রথম নাম হতে পারে, শেষ নাম হিসেবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা। ফাতিমা (রা)’র নাম কি ফাতিমা খাতুন বা বেগম বা সুলতানা ছিল? তাঁর নাম ছিল ফাতিমা বিন্ত মুহাম্মাদ। তাঁর পিতৃপরিচয় ছিল তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে আমার মেয়ে কেন তার হক থেকে বঞ্চিত হবে?” বেচারা পড়ে গেলেন সমস্যায়। আম্মা কিছুতেই সুলতানার দাবী ছাড়বেন না আর আমি কিছুতেই আমার মেয়েকে পারিবারিক নাম থেকে বঞ্চিত হতে দেবনা কারণ নিজেকে বঞ্চিত করা যায় কিন্তু সন্তানকে বঞ্চিত হতে দেয়া যায়না। পরে আমিই আম্মাকে বোঝালাম যে আমার বিয়ের পর থেকে আমি কোন ব্যাপারে ন্যূনতম কোন অধিকার দাবী করিনি, আজ শুধু অনুরোধ করছি আমার মেয়েকে যেন তার হক থেকে বঞ্চিত না করা হয়। শেষপর্যন্ত উনি রাজী হলেন।

আমাদের এস. এস. সি. পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা ছিল আমাদের এক বান্ধবীর নামের এন্ট্রি। ওর বাবা লিখে দিয়েছেন ওর নাম ‘স্বর্না’, শুধুই স্বর্না! প্রিন্সিপাল স্যার পর্যন্ত আংকেলকে ফোন করে বললেন ওকে একটা ‘লাস্ট নেম’ দেয়ার জন্য। কিন্তু উনি শুধু বললেন, “ওর কিছুদিন পর ‘লাস্ট নেম’ হয়ে যাবে, এখন শুধু স্বর্নাই যথেষ্ট”! বেচারীর এই নামে বোঝার কি কোন উপায় আছে ও কার মেয়ে, কোন পরিবারের মেয়ে, মুসলিম না হিন্দু? এটা তো শুধু একটা ঘটনা। এরকম যে আরো কত দেখেছি! সেদিক থেকে চিন্তা করলে আমি খুব ভাগ্যবতী ছিলাম। কেবল নামের ব্যাপারেই নয়, সন্তান হিসেবে প্রাপ্তির দিক থেকেও। বরং আমার ভাইরা হিংসা করে বলত, “আহা! আমরা যদি মেয়ে হতাম!”

আমরা প্রায়ই ছেলেদের নাম রাখার সময় অনেক চিন্তাভাবনা করে সুন্দর নাম রাখার চেষ্টা করি। তার নামের সাথে কি করে পরিবারের বা অন্তত বাপের নামের যোগসূত্র স্থাপন করা যায় তা নিয়ে ভাবিত হই। অথচ মেয়েদের নাম রাখার সময় প্রায়ই তাতে ইসলামের ছোঁয়া থাকেনা। নামের শেষেও কোনরকমে একটা কিছু দিয়ে দেয়া হয়। ধরে নেয়া হয় বিয়ের পর তো তার নাম পরিবর্তন হয়েই যাবে। তাকে কোন এক সময় অন্য পরিবারে স্থানান্তর করা হবে ভেবে প্রথম থেকেই তাকে পরিবারের নাম থেকে পর্যন্ত বঞ্চিত করা হয়। অথচ সে যাকেই বিয়ে করুক না কেন আল্লাহ তাকে আমার ঘরেই পাঠিয়েছেন। তার প্রতি আমি ন্যায় আচরন করলাম কি’না তার ওপর আমার বেহেস্ত দোজখ নির্ভর করছে। একটা মেয়ের আগমনের সাথে সাথে তাকে পর করে না দিয়ে যদি সে কোনদিন চলে যাবে ভেবে তাকে আমরা আরেকটু বেশী আদর করতাম তাহলে কি আমাদের খুব ক্ষতি হত? সামান্য একটা নাম, তাতে আমার উভয়প্রকার সন্তানের সমাধিকার নিশ্চিত করাটা কি খুব কঠিন কোন কাজ? আমাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন হোক। আমরা যেন এই ব্যাপারে আরো সচেতন হই।

Saturday, September 18, 2010

CRTP’র বন্ধুরা


সংকল্প করেছিলাম রোজায় কোথাও দাওয়াত খাবোনা, কাউকে দাওয়াত দেবোওনা। ভাবছেন কিপ্টা? হয়ত! এখানে রোজা শুরুর সময় ছিল প্রায় ১৮ ঘন্টা আর শেষের সময় প্রায় ১৬ ঘন্টা। মাত্র ছয়ঘন্টার ব্যাবধানে তিন ওয়াক্তের নামাজ, তারাবী, তাহাজ্জুদ, ইফতার, সেহরী, বাচ্চাদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, খাবার সামলে রাখা। সকালে উঠে সবাইকে স্কুলে পাঠানো, চাকরীতে পাঠানো আর চাকরীতে যাওয়া, এসে সেহরী আর ইফতারের জন্য রান্না করা। তারপর যদি মহিলারা একহাতে ঘর গোছানো, রান্না করা, বাচ্চা সামলানো নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন, যিনি দাওয়াত দেন তিনি তো নামাজ বাদ দিতে বা শর্টকাট করতে বাধ্য হবেন সন্দেহ নেই, যারা দাওয়াত খাবেন তাঁরাও এত অল্প সময়ের মধ্যে এত এত খেয়ে হজম করতে পারবেন না। এত দীর্ঘ সময় রোজা রেখে, সব কাজ সামলে ইফতারের পর অন্তত আধঘন্টা বিশ্রাম না নিলে সঠিকভাবে সব নামাজ পড়া মুশকিল হয়ে যায়। পড়লেও মন থাকে বিছানায়। তাই এই পরিকল্পনা।

প্রথম সংকল্প কৃতিত্বের সাথে পূরন করলাম। কিন্তু দ্বিতীয় সংকল্পে ব্যাঘাত ঘটলো পাত্রিসিওর উপর্যুপরি চিঠির কারণে। তিনি বৌ নিয়ে আমার বাসায় আসতে চাইছিলেন প্রায় একমাস ধরে। শেষমেশ ভাবলাম শেষের দশ রোজার আগেই তাঁকে দাওয়াত করে ফ্রি হয়ে যেতে হবে। বললাম ১৮ রোজায় আসতে। ইফতেখার ভাইকে ফোন করে বললাম, “আপনিও চলে আসেন, আপনারা গল্প করবেন, আমি আর হাফিজ সাহেব ততক্ষণে কাজ সামলে নেব”। ইফতেখার ভাই নিতান্ত ভদ্রলোক। বললেন, “আপা, আমিও একটা বা দু’টো ডিশ করে আনি। আপনার কাজ কমে যাবে”। ওনাদের আমার এজন্যই খুব ভালো লাগে। নির্দ্বিধায় সব বলা যায় ওঁদের। আমাদের মধ্যে মাইন্ড করাকরির কোন ব্যাপার নেই।

নির্দিষ্ট দিনে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম আমাদের খাবার বিদেশী অতথিরা খেতে পারবেন কি’না। কিন্তু পাত্রিসিও আর ভাবীর খাওয়া দেখে বুঝলাম বাংলাদেশী খাবার ওঁদের খুব পছন্দ হয়েছে। হাফিজ সাহেব রসগোল্লা আর মিষ্টিদই বানিয়েছিলেন। বাংলাদেশী মিষ্টিও দেখলাম ওঁদের খুব পছন্দ হোল। ইফতেখার ভাই চিকেন ফ্রাই করে এনেছিলেন। আর আমরা চা খাইনা বলে ভাবী চায়ের সমস্ত সরঞ্জামাদি বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ওনার চা খেয়ে ওঁরা মুগ্ধ হয়ে চলে গেলেন। আরো কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে ইফতেখার ভাই আর ভাবীও বাসায় রওয়ানা দিলেন।

পাত্রিসিওর সাথে আমার বন্ধুত্বের সূচনা খুব মজার। CRTP র অরিয়েন্টেশনের সময় যখন সবাই পরিচয় দিচ্ছে দেশে থাকতে কে কি কাজ করত তখন রুমের মাঝামাঝি এসে ইফতেখার ভাই আর তানজীন বাংলাদেশী শুনেও আমার মন খারাপ হতে শুরু করল কারণ সব ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, অ্যাকাউন্টেন্ট ছিল। আমি ছাড়া আর একজনও শিক্ষক ছিলোনা। আমি ছিলাম রুমের এক কোণায়। পরিচিতিপর্ব অন্যপ্রান্তে অগ্রসর হতে হতে যখন আমি হতাশার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছি তখন রুমের শেষপ্রান্তে পাত্রিসিও দাঁড়িয়ে বললেন উনি ইকুয়েডরে এক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। আমার কি যে খুশী লাগল! অন্তত একজন মানুষ পাওয়া গেল যিনি আমার প্রফেশনে ছিলেন। কিন্তু পরে যখন জানানো হোল আমাদের দুই সেকশনে ভাগ করে দেয়া হবে তখন ভাবলাম কি জানি কে কোথায় পড়ি!

যেদিন ক্লাস শুরু সেদিন গিয়ে দেখি অনেকের সাথে উনিও খুঁজছেন উনি কোন রুমে। তখন আমার ওনার চেহারা মনে আছে কিন্তু নাম ভুলে গেছি। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোন রুমে?” উনি বললেন, “খুঁজে পাচ্ছিনা”। বললাম, “আপনি কোন শিক্ষকের ক্লাসে?” উনি বললেন, “আমি জানিনা”। বললাম, “আপনার নাম বলুন”। উনি হেসে ফেললেন, “আমার নাম আমার মনে আছে!” দরজার বাইরে তালিকায় ওনার নাম দেখে ক্লাস বাতলে দিলাম। আমরা দু’জন একই ক্লাসে। আমাদের ক্লাসে তিনজন দক্ষিণ আমেরিকান পুরুষ ছিলেন। ভাগ্য ভালো দক্ষিণ আমেরিকান মহিলারা সব অন্য ক্লাসে ছিল। ওদের পুরুষরা ভীষণ ভদ্র আর মহিলারা পোশাক আশাকে ভীষণ উগ্র হয়। ক্লাসের তিন দক্ষিণ আমেরিকান- পাত্রিসিও, পাবলো আর ইগরের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেল।

আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের পার্টনার পড়ল পাত্রিসিও। আমাদের ডিবেট টিমেও আমি প্রথম প্রেসিডেন্ট আর উনি প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন; ইফতেখার ভাইও আমাদের টিমে পড়লেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম পাত্রিসিওর ছেলেরা ইউনিভার্সিটি শেষ করতে যাচ্ছে। মূলত তাদের সেটল করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই উনি ইউনিভার্সিটির চাকরী ছেড়ে ক্যানাডা এসেছেন। সে হিসেবে ওনার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। কিন্তু ওনার কথাবার্তায়, চিন্তাচেতনায় কোন অহংকার নেই। ওনার সাথে চুক্তি হোল উনি আমাকে ওনার মাতৃভাষা স্প্যানিশ শেখাবেন আর আমি ওনাকে ইংরেজী ঝালাই করতে সাহায্য করব।

আমার দক্ষিণ আমেরিকার লোকজনের জন্য খুব মায়া লাগে। যখন স্পেনের পতনের ইতিহাস পড়লাম তখন জানলাম, যে ইসাবেলা আর ফার্ডিনান্ড কলাম্বাসকে অর্থায়ন করেছিল আমেরিকা (ভারতে যাবার বিকল্প পথ) আবিষ্কার করতে তারাই স্পেনের মুসলিমদের পরাজিত করেছিল, তারপর সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার আবাদ ঘটিয়েছিল। কিন্তু প্রথমেই ইসলাম থেকে বিচ্যূত এই নেতৃত্বহীন জনগোষ্ঠী পাদ্রীদের চাপে আর বিজয়ী রাজতন্ত্রের অত্যাচারে শেকড়বিহীন হয়ে পড়ল। এখন কেবল কয়েকটা ইসলামী নামের প্রচলন ছাড়া এই ক্যাথলিক জনগণের কোন ধারণাই নেই যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলিম ছিলেন। আমার দক্ষিণ আমেরিকান ক্যাথলিক প্রতিবেশী রোকসানা নিজেই বলে ওর নামের কারণে সবাই তাকে মুসলিম বলে ভুল করে, কিন্তু সে জানেনা এই নামের উৎস কি।

যাই হোক, একসপ্তাহ যেতে না যেতেই পাত্রিসিওর চাকরী হয়ে গেল। যেহেতু CRTP তে লোকে আসেই চাকরীর খোঁজে, ওনার অ্যাডমিশন ক্যান্সেল হয়ে গেল। সবার ইমেল আর ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে উনি চলে গেলেন। ক’দিন পর সবাইকে ইমেলে এই তালিকা সরবরাহ করে উনি আমার সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করলেন। তারপর থেকে মাঝেমধ্যে গণ-ইমেল করে উনি সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। একমাত্র আমার সাথেই ওনার আলাদা করে যোগাযোগ হত। কোন কাজে ডাউনটাউন এলে উনি আগে থেকে আমার সাথে সময় মিলিয়ে নিয়ে লাইব্রেরীতে দেখা করতেন যেহেতু লাইব্রেরী ছিল আমাদের কলেজের ঠিক উল্টোদিকেই। তেমন জরুরী কোন কথাবার্তা না, সবার খবর নিতেন, ওনার নিজের ব্যাবসায়িক কোম্পানীর স্বার্থে বাংলাদেশের সাথে ইকুয়েডরের কি ব্যাবসা হতে পারে খবর নিতেন, বৌছেলেদের কথা বলতেন।

উনি যাবার পরই প্রথম খেয়াল করলাম যে আমি ক্লাসের আর কারো সাথে তেমন একটা মিশছিলাম না। মূলত পলের আগ্রহের কারণেই নাইজেরিয়ার পল, তুরষ্কের হাসান আর ইগরের গ্রুপের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। এরা তিনজনই ছিল ভীষণ ভদ্র আর হাসিখুশী। তানজীন অরিয়েন্টেশনের দিন লাঞ্চের সময় পরিচয়ের পর থেকে প্রায় সবসময়ই আমার সাথে সাথে থাকত। আর ইফতেখার ভাই আমার শ্বশুরবাড়ীর এলাকা থেকে। তাই এই দু’জনের সাথেও মিশে গেলাম। ক্লাসের চাইনীজ মেয়েরা- জেনী, লুসি আর ক্রিস্টি আমাকে ইংরেজীর শিক্ষক নিয়োগ দিল! জেনী কেন যেন আমাকে ভীষণ পছন্দ করত। লুসি এত হাসিখুশী ছিল যে ওকে দেখলেই যেকোন মানুষ ফুরফুরে বোধ করবে। ক্রিস্টি ছিল আবিবাহিতা, সাংঘাতিক পরিশ্রমী আর কিঞ্চিত পাগলাটে- কিন্তু ওকে ক্লাসের সবাই খুব আদর করতাম। একমাত্র চাইনীজ পুরুষ স্যাম ইংরেজীতে দুর্বলতার কারণে কারো সাথেই খুব একটা কথা বলতনা। কিন্তু ওর চেহারায় কেমন একটা যেন গ্রামীন ভাব আছে যেটা আমাদের খুব ভালো লাগত। আলজেরিয়ার সামীর আর আমি কেন যেন কখনো এক টেবিলে বা এক গ্রুপে কখনোই পড়িনি যদিও পরে বুঝলাম বেচারা ভীষণ লাজুক বলেই তাকে ক্লাসে খুব একটা চোখে পড়তনা। সে ছিল প্রশংসনীয় মেধার অধিকারী কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে তার ছিল ভীষণ অনীহা। বাকী রইলো ইরানের আফশীন আর ইন্ডিয়ার আফতাব। এ’ দু’জনের একজনকেও ক্লাসের কেউ খুব একটা পছন্দ করতনা।

আফশীন ইরানে এক বিরাট গাড়ী কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। শুধুমাত্র ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের কারণে উনি দেশ ছেড়ে ক্যানাডায় চলে এসেছেন। ওনার কথাবার্তা চেহারায় প্রখর বুদ্ধিমত্তার ছাপ। আমার মেধাবী লোকজনের প্রতি বরাবরই দুর্বলতা। তাই আফশীনের সাথে বলতে গেলে সেধে সেধে বন্ধুত্ব করলাম। ওনার বয়স পাত্রিসিওর চাইতেও বেশী। কিন্তু জানার প্রতি, শেখার প্রতি ওনার অশেষ আগ্রহ আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিত। উনি প্রচন্ড ইসলামবিরোধী লোক বলে আমাদের এই বন্ধুত্বের কেউ আগামাথা বুঝতে পারতনা। পাশের ক্লাসের পাকিস্তানীরা আমাকে জিজ্ঞেস করত, “তোমাকে দেখে তো ইসলামিক মনে হয়, আফশীনের সাথে তোমার এত কিসের বন্ধুত্ব?” আমি কাউকে বোঝাতে পারতাম না যে উনি আর আমি সম্পূর্ণ উলটো মতামতের মানুষ হতে পারি কিন্তু ওনার জ্ঞানান্বেষাকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং আমার সাথে একমত না হয়েও আমার ইসলামপ্রীতিকে উনি সম্মান করেন। পরবর্তীতে ক্লাসের প্রায় সব বড় বড় প্রজেক্টে কিভাবে যেন আফশীন আর আমি একই গ্রুপে পড়তে শুরু করলাম। ওনার সাথে কাজ করার একটা মজা ছিল আমার মতই উনি নিজ দায়িত্বে অধিকাংশ কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। বয়জ্যেষ্ঠ হয়েও ওনার মধ্যে খবরদারী বা মাতব্বরীর কোন অভ্যাস ছিলোনা। গ্রুপের অন্যদের সাথে কো-অর্ডিনেশনের ব্যাপারেও উনি শুধু আমি ছাড়া আর কারো থেকেই পিছিয়ে ছিলেন না। অন্য গ্রুপে ইফতেখার ভাই ছিলেন বিশেষ উৎসাহী। ওনার আর আমার কো-অর্ডিনেশনে সমস্যা না থাকায় আমাদের ক্লাসটা ছিল ভীষণ বুন্ধুত্বপূর্ণ, হাসিখুশী আর প্রাণচঞ্চল।


কিন্তু সবকিছু তো আর মানুষ নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা! আমাদের ক্লাসের আফতাব ছিল একটা অদ্ভুত চিজ। তার নিজের ব্যাপারে তার ধারণা ছিল আকাশছোঁয়া। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আর কারোর তার ব্যাপারে এর কাছাকাছিও ধারণা ছিলোনা। নিজেকে প্রচার করার জন্য সে সারাক্ষণ উন্মুখ থাকত। তাই সে যখন পরিকল্পনা করল দুঃস্থদের সহযোগিতার জন্য ক্যালগেরীতে যে ক্যাম্পেন চলছে তাতে সে অংশগ্রহন করবে, আমাদের ক্লাসের কেউ সাড়া দিলোনা। কি মনে করে জানিনা সে আমাকে ধরল এতে অংশগ্রহন করার জন্য। আফতাবের জন্য নয়, দুঃস্থ মানুষের কথা শুনে আমি রাজী হলাম। আমাদের এবং পাশের ক্লাসের বন্ধুরা সবাই যে যার সামর্থ্যমত সাড়া দিলেন। আফতাব, আমি আর ক্লাসের বাকীদের যখন যে সময় দিতে পারল- আমরা তিন তিনবার গিয়ে সব জিনিসপত্র কেনাকাটা করলাম। ক্যাম্পেনের দায়িত্বশীল জিনিসপত্র নিতে এসে ত্রানের পরিমাণ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন কারণ এগুলো সব তাদের দেয়া যাদের নিজেদেরই চাকরী নেই। কিন্তু ত্রানসামগ্রী বুঝিয়ে দেয়ার সময় আফতাব ক্লাসের আর কারো কথা উল্লেখ করলনা। পরে যখন ছবি তোলার সময় প্যাটের উৎসাহে সবাই দাঁড়ালো ব্যাপারটা ওর পছন্দ হোলনা। আমার যে চেহারা, আমি তো এমনিতেই ছবি তুলিনা, আর সেদিন শরীর খুব একটা ভালো লাগছিলোনা তাই আমি ছবিতে অংশগ্রহন করলাম না। কিন্তু তাতে লাভ হোল এই যে, আফতাবকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সময় পেলাম। মানুষের এই লোভী এবং স্বার্থপর রূপ আমাকে বরাবরই ভীষণ পীড়া দেয়। অসুস্থ শরীরে এই নোংরামী সহ্য করতে না পেরে সেই একদিনই আমি তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে চলে গেছিলাম।

বাসায় যাবার জন্য স্টেশনে যাব, ঠিক এ’সময় পল ফোন করল আমি যেন অফিসে যাই, খুব জরুরী প্রয়োজন। গিয়ে দেখি পল, হাসান আর ইগর মিলে এক পা ভাঙ্গা কবুতরের পা ঠিক করার জন্য সাহায্য চাইছে। জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও কবুতরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এ’ঘটনায় আমার আবার মানুষের ওপর আস্থা ফিরে এলো।

পরবর্তীতে আফতাবের হিংসা আর অহংকারে ক্লাসের সবাই অস্থির হয়ে উঠলো। বিশেষ করে একবার পল আর আমার প্রেজেন্টেশনের পর শিক্ষক প্যাট প্রশংসা করায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে শিক্ষক ছাত্র সবার সামনে আমাদের প্রেজেন্টেশনের এমনভাবে সমালোচনা করল যে সবাই বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল এর কোন ভিত্তি নেই। আমি খুব শক্ত মানুষ তাই এসব ছোটলোকামী পাত্তা দিলামনা। কিন্তু পল বেচারার মনটা বাচ্চাদের মত নরম। সে পারলে কেঁদেই ফেলে। ওর অবস্থা দেখে ইফতেখার ভাই সেদিন একটা কাজের বাহানায় পল, আমি আর তানজীনকে ক্লাসের পর আরবী রেস্টুরেন্টে খাওয়ালেন। ওনার এই সহানুভূতি আমাদের ভীষণ স্পর্শ করল।

কয়েকমাস পর আমাদের কোর্স শেষ হওয়া উপলক্ষ্যে ইফতেখার ভাই আর আমি ক্লাসের সবাইকে আবার একত্রিত করে পাশের ক্লাস, শিক্ষক, কর্মচারী সবাইকে খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করলাম। ক্যানাডিয়ানরা দু’জনে একসাথে কফি খেতে যায় সেও যে যার পয়সায়। তাই ওরা এই ধরণের আতিথেয়তায় যারপরনাই আনন্দিত হোল। সেদিনই আমরা শেষবারের মত সবাই একত্রিত হলাম। সবার খাওয়া শেষে যখন ইফতেখার ভাই, আমি আর পল খাবার নিতে গেলাম তখন হঠাৎ আফতাবকে দেখে খেয়াল হোল, তাইত, সবাই আফতাব সামনে থাকা অবস্থায়ই তার অস্তিত্ব ভুলে গেছিল! ওর প্রতি সকল বিতৃষ্ণা দূর হয়ে গেল আমার। এই ধরণের মানুষগুলো শেষপর্যন্ত কারো কাছেই কিছু পায়না। তাদের মত দুঃখী আর কে আছে? তাদের প্রতি রাগ রেখে কি লাভ?

আজ একবছর পর ইফতেখার ভাই আর তানজীনের সাথে আমার রেগুলার যোগাযোগ হয়। আমরা কিছুদিন পর পর একত্রিত হই যেমন এবারের ঈদে সবাই ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় একত্রিত হলাম। পল, হাসান আর ইগরের সাথে ফোনে বা ইমেলে কথা হয়। পল আমাকে এখনো “‘ইউর ফ্রেন্ড’ আফতাব কেমন আছে?” বলে ক্ষেপায়। লুসি আর জেনী ফোন করে সবসময়। ওদের কাছে ক্রিস্টির খবর পাই। বেচারী লেখাপড়া করতে করতে ওর আর অবস্থা নাই! এমনকি আমাদের লাজুক চাইনীজ বন্ধু স্যাম আর আলজেরিয়ার সামীরও ইমেল বা নেটে চ্যাট করে। আফশীন চাকরী পেয়ে অন্য প্রভিন্সে চলে গিয়েছেন। কিন্তু গিয়েই দাওয়াত করলেন ওখানে বেড়াতে গেলে ওনার বাসায় থাকার। আমাদের সত্তরোর্ধ পাবলো মেল করে জানালেন চিলির ভূমিকম্পে ওনার ঘরবাড়ী অক্ষত আছে, উনি ভালো আছেন। পাশের ক্লাসের লোকজনেরও খবরাখবর পাই, মাঝেমাঝে যোগাযোগও হয়। শেষে পাত্রিসিও পর্যন্ত বেড়াতে এলেন। কিন্তু আফতাব … সে আমাদের মধ্যে থেকেও আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল!



আজান

আল্লাহু আকবার (৪ বার)- আল্লাহ মহান
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (২ বার)- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (২ বার)- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর রাসূল
হাইয়া আলাস সালাহ (২ বার)- নামাজের জন্য এসো (জাগো)
হাইয়া আলাল ফালাহ (২ বার)- সাফল্যের পথে এসো
আল্লাহু আকবর (২ বার)- আল্লাহ মহান
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (১ বার)- আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই
(শুধুমাত্র ফজর নামাজে)
আস সালাতু খাইরুম মিনান্নাউম (২ বার)- নামাজ নিদ্রা অপেক্ষা উত্তম

জন্মের সময় মুসলিম শিশুর কানে যে আজান দেয়া হয়, তারপর থেকে কত লক্ষবার যে আজানের ধ্বনি তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে তা আমরা হিসেব করে দেখিনা কখনো। আজান শুনতে শুনতে আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে যাই যে এর কথাগুলো আমাদের কাছে আর দশটা শব্দ থেকে পৃথক করে ধরা পড়েনা। কথাগুলোর অর্থ কি আমরা ভেবেও দেখিনা হয়ত! অথচ এই আজানের প্রতিটি শব্দ যে কত অর্থপূর্ণ … আরেকবার পড়ে দেখুন! আমরা যদি মহান আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য স্বীকার করে নেই, নামাজের মাধ্যমে প্রতিদিন পাঁচবার তাঁর কাছে জবাবদিহিতার তাগাদা অনুভব করি – আমরা কাউকে ভয় করবনা সঠিক কাজটি করার ব্যাপারে, কোন চেষ্টার ত্রুটি রাখবনা অন্যায় থেকে দূরে থাকার। মুহাম্মাদ (সা)কে রাসূল হিসেবে মেনে নিলে আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথের ওপর অবস্থান করার চেষ্টা করব সদাসর্বদা। এই পথ ধরেই আমাদের জীবনে আসবে পরম সাফল্য। ভোরবেলা নরম বিছানা ছেড়ে উঠে শুরু হবে প্রবৃত্তির দমন, তাহলে দিনব্যাপী আর কোন প্রবৃত্তি কি আমাদের কাবু করতে পারবে?

এই আজানের পেছনে যে চমকপ্রদ কাহিনী তা আমরা অনেকেই জানি। বিলাল (রা) যখন ইসলাম গ্রহন করেন তখন তিনি উমাইয়া ইবন খালফের ক্রীতদাস। উমাইয়া ছিলেন ইসলামের প্রধানতম শত্রুদের একজন। তিনি ইসলামকে নির্মূল করার প্রচেষ্টায় রত আর তাঁরই ঘরে কি’না ক্রীতদাস ইসলাম গ্রহন করে বসে আছে! তিনি প্রথমে বিলাল (রা) কে নানা প্রলোভন দিয়ে ইসলাম হতে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। বিলাল (রা)র এককথা, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ”। ব্যর্থতার জ্বালা সইতে না পেরে উমাইয়া বিলাল (রা)কে নানাভাবে নির্যাতন করতে শুরু করেন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে বিলাল (রা)কে মরুভূমির উত্তপ্ত বালুর ওপর বুকে ভারী পাথর চাপা দিয়ে শুইয়ে রাখা হত। তিনি পানি চাইলে তাঁকে বলা হত ইসলাম এবং রাসূল (সা)কে অস্বীকার করতে। তিনি কালেমা বলা শুরু করতেন। যখন গলা শুকিয়ে আর কালেমা বলতে পারতেন না তখনো তিনি বুজে আসা গলায় ‘আহাদ, আহাদ’ বলতে থাকতেন। কিছুদিন পর এই খবর রাসূল (সা)এর কানে পৌঁছলে তিনি এই ব্যাপারে প্রিয় বন্ধু এবং ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক আবু বকর (রা)র সাথে আলাপ করেন। আবু বকর (রা) উমাইয়ার সাথে কথা বলেন। কিন্তু উমাইয়া কোন মূল্যেই বিলাল (রা)কে ছাড়তে রাজী হচ্ছিলেননা। তখন আবু বকর (রা) অনেক বেশীগুন মূল্যে, একটি খেজুর বাগানের বিনিময়ে বিলাল (রা)কে উমাইয়ার কাছ থেকে মুক্ত করে আজাদ করে দেন।

মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (সা) একদিন সাহাবাদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন, এবার যেহেতু ইসলামের চর্চায় আর কোন বাঁধা নেই, সকলকে একসাথে নামাজে সমবেত করার জন্য কি পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। একেকজন একেক পরামর্শ দিচ্ছিলেন। তখন আবু বকর (রা), মতান্তরে আব্দুল্লাহ ইবন জায়েদ (রা) বলেন আজানের কথাগুলো তিনি স্বপ্নে শুনেছেন। তখন বিলাল (রা)র পাথরচাপা অবস্থায় এই কথাগুলো বারবার বলতে থাকার স্মৃতি অনেকের মনে পড়ে যায়। তাছাড়া তাঁর সুললিত কন্ঠ ছিল সর্বজনবিদিত। সর্বসম্মতিক্রমে বিলাল (রা)কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করা হয়। আল্লাহর কি মহিমা, একজন হাবশী ক্রীতদাসকে আল্লাহ সেই সম্মান দান করলেন যার জন্য হয়ত অনেক সাহাবী প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হতেন না! মক্কাবিজয়ের পরও প্রথম আজান দেন বিলাল (রা)। বেচারার জন্ম যেহেতু আরবের বাইরে, তাঁর আরবী উচ্চারণ বিশুদ্ধ ছিলোনা। কিন্তু এ’ বিষয়ে রাসূল (সা)কে বলতে গেলে তিনি বলেন, “আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চারণ স্পষ্ট কেননা আল্লাহ নিয়ত দেখেন, উচ্চারণ তাঁর কাছে মূখ্য নয়”। রাসূল (সা)এর মৃত্যুর পর বিলাল (রা) আর কখনো আজান দিতে রাজী হতেন না। দামেস্ক বিজয়ের পর সাহাবীবৃন্দ উমার (রা)কে গিয়ে ধরেন বিলাল (রা)কে আজান দিতে অনুরোধ করার জন্য। খলিফার অনুরোধে বিলাল (রা) জীবনে আর একবার তাঁর অসাধারণ কন্ঠে আজান দিলেন, কিন্তু তাঁর অনুভূতির প্রাবল্যে সমবেত সাহাবাবৃন্দ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

আজানের ব্যাপারে আমাদের অনুভূতি এতখানি তীব্র না হলেও, আজান আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে নানান স্মৃতি আর হরেক অভিজ্ঞতার হাত ধরে। ছোটবেলা থেকে আজানের শব্দ আমাদের রক্তে ঝংকার তোলে আল্লাহর কাছে ছুটে যাওয়ার উদগ্র আকাংক্ষায়। আজানের শব্দ শুনে আমরা বুঝতে পারি, জাগার সময় হোল, খাবার সময় হোল, বা বাড়ী ফেরার সময় হোল। আমার কাছে আজানের গুরুত্ব আরেকটু বেশী কারণ এই বিদেশের মাটিতে আজান শুনিনা বহুদিন। আজানের প্রতি আমার অনুভূতি সেই ব্যক্তির মত যে দীর্ঘকাল অভুক্ত রয়েছে অথচ খাবার পাবার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা।

আমার প্রথম আজানের স্মৃতি অনেক ছোটবেলার। হয়ত ছয় বা সাত বছর বয়সের। ঢাকা তখন অনেক সুন্দর খোলামেলা নগরী যেখানে চোখ খুললেই আকাশ দেখা যায়, গাছপালা আর খোলা প্রান্তর-জলাশয় অহরহ, বাড়ীর আশেপাশেই আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বরই, কলা, ডালিম, কৎবেল, বাতাবীলেবু নানান ফলের গাছ আর নানান ফুলের সমারোহ। ভোরের আজানের সাথে সাথেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা পড়িমরি করে নামাজ পড়ে ছুটতাম মালা গাঁথার জন্য হিজল আর শিউলি ফুল কুড়াতে, সাথে কখনো কয়েকটা গোলাপ, গাঁদা, বেলী, জবা, মালতী বা কাঠগোলাপ। ঢাকা তখন এতখানি নিরাপদ যে ছোট ছেলেমেয়েদের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে মায়েরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিত আরো কিছুক্ষণ। কখনো গাছতলা থেকে ফুলগুলো গামলায় ভরে বাসায় নিয়ে আসতাম। কখনো সুঁইসুতা সাথে নিয়ে যেতাম। পাড়ার সবাই গাছতলে বসে মালা গাঁথতাম একসাথে। কিছুক্ষণ পরে এগুলো হাতের কানের গলার পায়ের গহনায় রূপান্তরিত হয়ে যেত। মাকে নানীকে বুয়াকে সাজাতাম স্কুলে যাওয়ার আগে। কখনো আমাকে সাজিয়ে ছবি তুলে দিত মা। হিজলের তুলতুলে লালসুতোর মত পাপড়ি, শিউলির নরম স্পর্শ, কাঠগোলাপের মনমাতানো গন্ধ সবই আজও ফিরে আসে আজানের শব্দের সাথে। এখন যখন ঢাকায় যাই, আমার মেয়েকে বলি আমার ছোটবেলার ঢাকার গল্প, সে মুচকি মুচকি হাসে। আম্মু মনে হয় পাগল হয়ে গেছে! এখানে তো সব বিল্ডিং, মানুষগুলো পর্যন্ত ইটপাথরের মত নিষ্প্রান! এখানে কি কোন প্রাণের ছোঁয়া আছে, কোন খোলা জায়গা আছে, গাছপালা কোথায় যে তুমি ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, এই শহর এখন এত ব্যস্ত যে এখানে মানুষ নিয়তই ছুটে চলেছে জীবিকার উদ্দেশ্য, যেখানে জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে মাঝপথে কোথাও। এখানে মানুষের এখন আজানের শব্দ শোনার সময় নেই, ফুলগাছ লাগানোর জায়গা নেই, মালা গাঁথার শখের তো প্রশ্নই ওঠেনা। শিশুরা এখানে জেগে ওঠে কাক ডাকার শব্দে। আমাদের ছোটবেলার মত পায়রা, ঘুঘু, টিয়ে, ময়না, দোয়েল, শালিক, চিল এই ঢাকা শহরে আর দেখা যায়না। তাই আমার কথাগুলো এখন আমার নিজের সন্তানের কাছেই রূপকথার মত লাগে!

সেই ঢাকাতেই, আরেকদিন আকাশে মেঘের সতত পরিবর্তন দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি। মেঘগুলো যখন গর্জন করে বর্ষন শুরু করল তখন আমি ঘুম। ঘুমের মধ্যে মনে হোল যেন দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে গিয়েছে। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি বিটিভিতে আসরের আজান দেখাচ্ছে যদিও আকাশের রঙ দেখে মনে হচ্ছিল এশার আজান। বাইরে মেঘের গর্জন আর প্রবল বর্ষনের শব্দের সাথে আজানের শব্দ মিলে এক অদ্ভুত আবহের সৃষ্টি হোল। যে মসজিদটা দেখাচ্ছিল তার সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে যেন তারার মেলা। সাদা দেয়ালের ওপর নীল সবুজ অসংখ্য তারা! বাবা বল্ল এটা বিখ্যাত তারা মসজিদের আজানের ছবি। মন ছুটে গেল সেই মসজিদে যেখানে হাজার তারার মেলার মাঝে মুসল্লীরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে আসেন। বাবাকে বললাম আমি ঐ মসজিদে যেতে চাই। আপাতত আমার জ্বালাতন থেকে বাঁচার জন্য বাবা বল্ল, “ঠিক আছে, নিয়ে যাব একদিন”। কিন্তু আমার আজও সেই তারা মসজিদ দেখা হয়নি।

এর কিছুদিন পর আমরা ফিরে গেলাম আবুধাবী। আমাদের সব বেডরুমের জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যেত। আমার জানালার সামনে রাস্তা, রাস্তার আইল্যান্ডে এই বালুকাময়, উষর, নিষ্প্রাণ নগরীতে প্রকৃতির সাথে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ করত পাঠান মালি একমুঠো ঘাস আর কয়েকটা খেজুর গাছকে জিইয়ে রাখার জন্য, ২৪ ঘন্টা ঘাসের ওপর স্প্রিঙ্কলার দিয়ে আর প্রতিটি গাছের নীচে পাইপ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দেয়া হত। রাস্তার পরে কর্নিশ রোডের বাগান, তারপরই ঘেরা দেয়া সমুদ্র যেখানে বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম প্রায়ই। বিকেল হলেই নানা দেশের মানুষে ছেয়ে যেত এলাকাটা। দিনের অস্বস্তিকর গরমের পর বিকেল বেলা একটু বাতাসে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসতেন সবাই। তখন আবুধাবীতে একটাই ঋতু ছিল- গরমকাল। ঘরে চারটা এসি চলত ২৪ ঘন্টা। কিন্তু কেউ বেল দিলে ঝগড়া লেগে যেত কে দরজা খুলবে। কেউ রাজী হতনা। কারণ ঐ কয়েক সেকেন্ডে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘেমে যাবে।

আরবীরা মসজিদ বানাতে খুব ভালোবাসে। যে যার সামর্থ্যমত মসজিদ বানিয়ে দেয় কিছু টাকা জড়ো করতে পারলেই। তাই শেখদের বিশাল বিশাল মসজিদের পাশাপাশি দেখা যায় রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর বানানো মসজিদ যেখানে হয়ত চারজনের বেশী লোকের জায়গাই হবেনা! ভারী সুন্দর কিছু মসজিদ দেখেছি আবুধাবীতে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগত ভোরবেলা। যখন ফজরের আজান শুরু হত তখন মনে হত সম্পূর্ণ নগরীতে আজানের শব্দ যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়ছে। আমার জানালার পাশেই ছিল এক মসজিদের মিনার। তাই নামাজ মিস হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিলনা। ক্লাস নাইনে একবার আমার গান শোনার শখ বাড়াবাড়ি রকম বেড়ে গেল। রাতে গান না শুনলে ঘুমই হতনা। আবার গান শুনতে শুনতে কবে যে অনেক রাত হয়ে যেত কিছুতেই ঠিক করতে পারতাম না। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি সূর্য উঠে গিয়েছে। আমার জানালার পাশে মসজিদের মিনার আর আমি সেই শব্দ শুনতেই পাইনি! এত মেজাজ খারাপ হোল গানের ওপর! মনে হোল এটা শয়তানের অস্ত্র মানুষকে আল্লাহর স্মরন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। সুন্নত নফল তো পালন করার প্রশ্নই ওঠেনা, ফরজটুকুও যদি ছেড়ে দেই- আমার তো আর মুক্তির কোন আশাই থাকবেনা! দিলাম ছেড়ে গান গাওয়া শোনা সব! সেই প্রথম আমার প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন। তাই এই ঘটনাটা আমার জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আমাদের বাসার পেছনদিকে ছিল আবুধাবীর সবচেয়ে বড় বাগান যেখানে কয়েকটা বাদামগাছ আর নানা ধরণের ঝোপঝাড় বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশাল এক দঙ্গল মালী কাজ করতেন প্রায় চব্বিশঘন্টাই। বিকেল বেলা বা ছুটির দিনে সময় কাটাতে বা ছোটখাট পিকনিক করতে অসংখ্য মানুষ আসত এই বাগানে। এই বাগানে ঢোকার মুখেই ছিল ছোট্ট একটা মসজিদ। এই মসজিদের মুয়াজ্জিনকে আমি কোনদিন দেখিনি। কিন্তু অসংখ্যবার দেখেছি আজান শুরু হওয়ার সাথে সাথে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকলে সব ভুলে কোন এক অদৃশ্য টানে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে যেতে, শিশুদের কান্না বন্ধ করে তন্ময় হয়ে শুনতে, ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা বন্ধ করে আজান উপভোগ করতে। ওনার আজানে কি যে ছিল আজও জানিনা, কিন্তু সেই আজানের সুরের সাথে কোন গানের তুলনা হয়না, হাজারবার শোনার পরও প্রতিবারই এই আজান মানুষের অন্তরকে বিমোহিত করে ফেলত যদিও সে আজানের অর্থ না বোঝে। মনে হত এটি বেহেস্ত থেকে ভেসে আসা আলৌকিক কোন শব্দ। আমি অনেক মানুষকে এই আজান শুনে প্রকৃতিস্থ হবার পর দোয়া করতে শুনেছি, “হে আল্লাহ, তুমি এই মুয়াজ্জিনকে বেহেস্তে আজান দেয়ার তৌফিক দিয়ো”। এই আজানের তুলনায় আমার অন্যান্য মুয়াজ্জিনের আজান কর্কশ, বেসুরো মনে হত। তাই প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোরে আমি ছুটে যেতাম পেছনের বারান্দায়, বাগানের মসজিদের আজান শোনার জন্য। দিনের বেলা গাড়ীর শব্দের জন্য ঐ মসজিদের আজানের শব্দ আমাদের বাসা থেকে শোনা যেতনা। কিন্তু ফজরের সময় যখন চারিদিক নিরিবিলি তখন স্পষ্ট শোনা যেত। যতবারই শুনতাম, মন অতৃপ্ত রয়ে যেত। মনে হত আরো একবার যদি উনি আজান দিতেন! আজান শেষে যখন ঘরে ঢুকতাম তখম মাথা থেকে পা পর্যন্ত টপটপ করে ঘাম ঝরত!

এই আজান যে শুধু আমাকেই নয়, আরো অনেককে একইভাবে প্রভাবিত করেছে তার প্রমান মিলল কিছুদিন পর যখন অনেক বড় বড় মসজিদের আজান বাদ দিয়ে আবুধাবী টিভিতে এই মসজিদের আজান দেখাতে শুরু করল। আমরা আজান দেখার জন্য দুপুরে যখন টিভি ছেড়ে রাখতাম, আমার দুই বছরের পিচ্চি ভাই মোহাম্মদ আজান শুরু হতেই খেলা বাদ দিয়ে টিভির পাশে দাঁড়িয়ে যেত। মাথায় টুপি দিয়ে সুরে সুরে আজান দেয়ার চেষ্টা করত, “আন্নাবাব্বা!” আজও ঐ মুয়াজ্জিন সাহেবের কথা মনে পড়ে, ওনার জন্য বেহেস্তের দোয়া করি। মনে হয় আর একবার যদি ঐ আজান শুনতে পেতাম!

আজানের ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি ইণ্ডিয়ায় বসবাসের দিনগুলো। দিল্লী যখন যাই তখন মাত্র বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে। চারদিকে খুব টেনশান। কিন্তু এর মধ্যেও ওখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী দাপটের সাথে চলছে। মাদ্রাজ এসে দেখলাম, এখানে কোন জাতিগত সমস্যা নেই। এখানকার মুসলিম এবং হিন্দু জনগোষ্ঠী যুগ যুগ একত্রে বসবাস করতে করতে একীভুত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু একীভুত হওয়ার ধরণটা এমন যে তাদের খাবার দাবাড়, পোশাক আশাক, চলাফেরা কিছু দেখেই তাদের মুসলিম বলে সনাক্ত করার উপায় নেই। মসজিদ এত কম যে আমি চারবছরে হয়ত দশটা মসজিদও দেখিনি যেখানে আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মসজিদ ছিল এগারোটা। আমাদের পাড়াটা ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে। বিশাল বিশাল সব বাড়ী চারটা রাস্তার দুই ধারে বিন্যস্ত। পাড়ার নিজস্ব দোকানপাট, খেলার মাঠ, দু’টো দুধের রেশনকেন্দ্র সব ছিল। কিন্তু পুরো এলাকা জুড়ে কোথাও কোন মসজিদ ছিলনা। আজানের শব্দবিহীন পরিবেশে এ’ আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। দিনের বেলা গরমের কারণে ঘরে থাকা যেতনা, বারান্দায় কাটত আমাদের অধিকাংশ সময়। সব বাড়ীর লোকজনই থাকত বারান্দায় তাই প্রতিবেশীদের সাথে কথা হত প্রচুর। মাদ্রাজীরা ভীষণ শিক্ষিত আর ভদ্র। তাই ওদের সাথে বন্ধুত্ব করা ছিল সহজ। মাদ্রাজ খুব পরিবেশসচেতন নগরী যদিও কোন অজ্ঞাত কারণে এখানকার ৫০% মানুষ ঘরে বাথরুম করার চেয়ে রাস্তায় হাগু করতে পছন্দ করে বেশী। ফুটপাথে হাঁটা অসম্ভব। সবাই তাই রাস্তায় হাঁটে। এখানে শহরের মধ্যখানে বিশাল বিশাল সব গাছপালা, গাছে গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়াপাখীর বসবাস, বানর অসংখ্য। কিছুদিন পর পর সমুদ্রের পাড়ে, বড় বড় মন্দির দেখতে, প্ল্যানেটেরিয়ামে বা আশেপাশের শহরগুলিতে বেড়াতে চলে যেতাম আমরা। এতকিছুর মধ্যে থেকেও কেমন যেন শুন্যতা অনুভব করতাম। মনে হত কি যেন নেই।

একদিন বাবার সাথে কোথায় যেন যাচ্ছি। সময়স্বল্পতার কারনে বাবা পাড়ার বাউন্ডারীর বাইরে কোন এক গলি দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হোল যেন আজানের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত চেহারা দেখে বাবা দেখালো গলির একপাশে গাছপালার পেছনে ছোট্ট, প্রায় অদৃশ্য একটা মসজিদ। আর পায় কে? প্ল্যান করা শুরু করলাম কি করা যায়। দিনের বেলা টিয়ের চেঁচামেচি, বানরের নাচানাচি, গাড়ীর ক্যাঁচক্যাঁচানির জন্য কিছু শোনা সম্ভব না। সুতরাং আমার একমাত্র সুযোগ হোল ভোরবেলা উঠে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এসি থেকে বেরিয়ে এই গরমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা মনে হতেই সারা গা শিউরে উঠলো। কিন্তু আর কোন উপায় নেই। প্রথমদিন পরীক্ষামূলকভাবে দাঁড়িয়ে দেখলাম খুব ভালোভাবে কান পেতে শুনলে, খুব হাল্কাভাবে আজানের শব্দ ভেসে আসে। ঐ হাল্কা একটু শব্দ কান পেতে শুনে থাকতাম যতক্ষণ শোনা যায়। মনে হত পিপাসার্তের মত ঐ শব্দ শুষে নিতাম সারাদিনের জন্য। তারপর ঘাম মুছতে মুছতে নামাজ পড়তে চলে যেতাম।

আজানের শব্দের অভাব যে কাউকে এভাবে তাড়িত করতে পারে, নিজে অনুভব না করলে কখনো বিশ্বাস করতাম না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কখনো এই কষ্ট করবনা। কিন্তু আমার ইচ্ছায় তো আর পৃথিবী চলেনা! তাই আবার এসে পড়েছি ক্যানাডায়। কতগুলো মসজিদ! অথচ আজানের শব্দ নেই। মসজিদের ভেতরে আজান শোনা যায়, কিন্তু বাইরে নিস্তব্ধ। কেউ কেউ কম্পিউটারে আজান শোনার ব্যবস্থা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান। আমি ভাবি আমার ছেলেমেয়েদের কথা। ওরা কি কখনো অনুভব করবে “আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম”- এর সেই অদৃশ্য টান যা বিছানার আরাম থেকে আমাদের টেনে নিয়ে যায় ‘সাফল্যের পথে’? ওরা কি কোনদিন শুনবে সেই আলৌকিক শব্দ যা তাদের এই পৃথিবীর ক্লান্তিহীন ব্যস্ততা থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাবে বেহেস্তের কোন এক প্রান্তরে? ওরা কি কখনো জানবে ওরা কিভাবে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিদিন, দিনে পাঁচবার করে এক অসাধারন আহবান থেকে যার সাথে সময় দেখে নামাজ পড়ার কোন তুলনা হয়না!

Tuesday, September 14, 2010

অদ্ভুত চিন্তা!


রাস্তায় বেরোলেই আমার প্রাত্যহিক দোয়াগুলো সেরে নিতে খুব ভালো লাগে। প্রথমত সময়টা কাজে লাগানো হয়। দ্বিতীয়ত ভ্রমণকালীন দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশী। সেদিন এক বান্ধবীর বাসায় যেতে যেতে কালেমা পড়ছিলাম, “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লাশারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু”। ইদানিং আমরা বান্ধবীরা চেষ্টা করছি তোতাপাখীর মত গড়গড় করে নামাজ বা দোয়া না পড়ে নিয়ম অনুযায়ী কি পড়ছি বুঝে বুঝে পড়ার। তাই মুখে বলতে বলতে মনে মনে অনুবাদ করছি, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই এবং সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ (সা) আল্লাহর দাস এবং বার্তাবাহক”।

পড়তে পড়তে হঠাৎ আমার মাথায় এলো যে এখানে কিন্তু মূল কথা একটাই। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, এই কথাটার স্বীকৃতি। সম্পূর্ন কোর’আনেরও মূল বক্তব্য এটাই। আর এই নিয়ে দুনিয়ার যত সমস্যা! কথাটা চিন্তা করে আমার খুব হাসি পেল। এটা একটা সমস্যা হওয়ার মত ব্যাপার? আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে কবিতাটিকে তাঁর কবিতা আর রবীন্দ্রনাথকে কবি বলে স্বীকৃতি দেই তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? তাহলে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্যে এত ঝামেলার কি আছে? অথচ এই তুচ্ছ ব্যাপারটা নিয়ে মানুষের যে কত সমস্যা!

সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করার জন্য বিজ্ঞানের প্রয়োগ করা হচ্ছে অথচ বিজ্ঞান হোল সৃষ্টিকর্তারই সৃষ্টি নিয়ে গবেষনার ত্রুটিপূর্ণ ফলাফল! বিজ্ঞানীরা সৃষ্টবস্তুর ব্যাবহার ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননা অথচ এতেই তাদের অহংকারে মাটিতে পা পড়েনা! কিন্তু যিনি সৃষ্টি করলেন সবকিছু, তাকে অস্বীকার করে তাঁরা নিজেদের ‘গড’ বানাতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন!

একজন মানুষ যখন আমাদের একগ্লাস পানি দেয় তখন তাকে মিষ্টি করে ‘ধন্যবাদ’ না বললে সে রাগ করে যদিও পানি বা পানির গ্লাস কোনটাই তার বানানো নয়। অথচ যিনি আমাদের এই প্রাণ, এই শরীর, পরিবার, লেখাপড়া, জ্ঞান বুধি বিবেক, খাবার দাবাড়, এই সুন্দর পৃথিবী মায় নিঃশ্বাসের বাতাসটা পর্যন্ত দিলেন তাকে ধন্যবাদ বলতে আমাদের মানসম্মান সব শেষ হয়ে যায়!

একবছরের মধ্যে ছয়মাস ফাঁকি দিয়ে যে শিক্ষক পড়ান তিনি আমাদের পরীক্ষা নিলে আমরা বিরক্ত হইনা বরং শ্রদ্ধা এবং ভয় নিয়ে ফলাফলের অপেক্ষা করি। অথচ যে আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করলেন তাঁর কাছে কেন জবাবদিহি করতে হবে, ফলাফল পেতে হবে তাই নিয়ে আমাদের বিরক্তির শেষ নেই! আল্লাহ যতক্ষণ দেন ততক্ষণ আমরা একটা ‘থ্যাংক ইউ’ বলারও প্রয়োজন মনে করিনা, কিন্তু তিনি কেবল একটা কিছু না দিলে বা নিয়ে নিলেই আমরা আক্রোশে ফেটে পড়ি, “আল্লাহ আমার প্রতি অন্যায় করেছেন তাই তাকে মানার কোন প্রয়োজন নেই!”

ভাবছিলাম আমাদের কথা। আজকে যে সারা বিশ্ব মসলিমদের ওপর হামলে পড়েছে, সবাই মানুষ অথচ আমাদের কেউ মানুষ বলে মনেই করছেনা, তাদের সাথে কিন্তু আমাদের আর কোন সমস্যা নেই। আমরা সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করে নিয়েছি এটা ছাড়া কিন্তু আমাদের সাথে তাদের আর কোন পার্থক্য নেই! শুধু এই কারণেই আমাদের পরিবারের আধুনিকতাবাদীরা আমাদের ব্যাকওয়ার্ড মনে করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। সমাজের নানান স্তরের লোকজন আমাদের নিয়ে খুব চিন্তিত যে আমাদের নিয়ে দেশের উন্নতি কিভাবে হবে? অথচ আমরা কারো পাকা ধানে মই দিইনি বা বাড়া ভাতে ছাই দিইনি যেহেতু সৃষ্টিকর্তা বলেছেন আমাদের প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তাহলে আমাদের অপরাধ কি? আমরা কেন সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকার করলাম, এটাই? এটুকুর জন্য আমাদের পৃথিবীব্যাপী গালি দেয়া, মেরে ফেলা, খারাপ মনে করা জায়েজ হয়ে গেল?!

আমার দ্বিতীয় সন্তান যখন আমার ভেতরে, আমার ভীষণ শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। আমি এতে অভ্যস্ত ছিলাম না, তাই খুব ভয় পেতাম। মনে হত আল্লাহর এই পৃথিবীতে এত বাতাস, অথচ আমার ছোট্ট দু’টো ফুসফুস কিছুতেই বাতাসে পূর্ণ হচ্ছেনা! একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। দুপুর দু’টার সময় যে শ্বাসকষ্ট শুরু হোল রাত দশটা পর্যন্ত আটটা ঘন্টা – আমার দুই ননদ পালা করে আমার পিঠে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে, তাহলে কিছুটা শ্বাস নিতে পারি, হাত সরালেই দম বন্ধ হয়ে যায়! মনে হোল এই যে আমরা শক্তি সাহস আর বীরত্বের বড়াই করি, অথচ সামান্য একটু বাতাস বুকের ভেতর টেনে নিতে পারিনা আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া। এভাবেই একদিন শেষ নিঃশ্বাসটাও আমাদের দেহ ছেড়ে চলে যাবে, আর ফিরে আসবেনা! তাহলে কিসের আমাদের এত অহংকার? কি ভেবে আমরা তাঁকে অস্বীকার করি যাকে ছাড়া এক ফুসফুস বাতাস আমাদের দেহে প্রবেশ করেনা সকল চেষ্টা সত্ত্বেও?

একদিন আমার ক্লাস শেষে হাফিজ সাহেব আমাকে আনতে গিয়েছেন ইউনিভার্সিটি থেকে। সেদিন শুক্রবার, রাস্তাঘাট ফাঁকা। তাই আমার সেই দুষ্ট দ্বিতীয় সন্তান রিহামকে নিয়ে গিয়েছেন। ওর বয়স তখন দেড়বছর হবে। মাত্র হাঁটতে আর কথা বলতে শিখেছে। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি এসে একপাল গরু দেখে ওর যে কি হোল, চলন্ত মটরসাইকেলে আমার কোল থেকে নেমে খালি পায়ে সে গরুগুলোর পিছু ধাওয়া করতে লাগল। আমি দৌড়ে গিয়ে ধরার আগেই সে চলে গিয়েছে বহুদুর। কিন্তু গরু দেখা শেষে ওকে সেই আমার কাছেই ফিরে আসতে হোল।

এভাবেই আমরা যতদুরই চলে যাইনা কেন, শেষপর্যন্ত ফিরে আসতে হবে সৃষ্টিকর্তার কাছেই। তাই এই ব্যাপারে দ্বিমত করে সময় নষ্ট করার বোকামী মানুষ কেন করে, তা আজও বুঝতে পারলাম না! কি জানি? হয়ত যারা এই দ্বিমতের ওপর ভিত্তি করে আমাদের হত্যা করে ফেলাও কোন অন্যায় মনে করেন না, তাদের নিশ্চয়ই খুব ভালো কোন যুক্তি আছে!

বিয়ে - একটি উত্তম বন্ধুত্ব

নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে ‘ওশিন’ নামে একটি জনপ্রিয় জাপানী সিরিয়াল প্রচারিত হয়। আমরা তখন সম্ভবত অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বান্ধবীরা প্রায়ই এর বিভিন্ন এপিসোড নিয়ে কথা বলতাম। একবার দেখানো হোল ওশিন এমন এক নির্জন জায়গায় গিয়ে চাষবাস করতে শুরু করল যেখানে স্কুলশিক্ষক ছাড়া আর কোন উপযুক্ত পুরুষ নেই মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য। সে আর কোন উপায় না দেখে মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে স্কুলশিক্ষকের কাছে বিয়ে দিয়ে দিল। একটা সন্তান হওয়ার পর মেয়েটির এমন একজনের সাথে পরিচয় হয় যাকে তার মন থেকে পছন্দ হয়। বেশ কিছুদিন চিন্তাভাবনা করার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় যে শিক্ষক স্বামীকে ছেড়ে সে ঐ লোকের সাথে সংসার করবে। ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মধ্যে এমনভাবে তোলপাড় সৃষ্টি হোল যেন আমাদের পরিচিত কেউ এমনটা করে বসেছে!

আমার কোন বোন নেই। ভাইদের সাথে বড় হওয়াতেই কি’না জানিনা, আমার রান্নাবাড়া, সাজগোজ, প্রেম বিবাহ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিলনা কখনো। বাস্তব জীবনের চেয়ে বইপত্রের সাথে সম্পর্ক ছিল বেশী। তাই বিবাহ বিষয়ে ধারণা ছিল সিন্ডারেলা মার্কা গল্পে যা লেখা থাকে তেমন, কোনপ্রকারে একবার বিয়ে হয়ে গেলেই “happily ever after”. আমাদের অধিকাংশ মেয়েদের মধ্যেই এই ধরণের ভুল ধারণা কাজ করে। কারণ রূপকথার বইগুলো আমাদের কোনভাবেই জীবনের বাস্তবতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেনা। তাই বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুষড়ে পড়েছিলাম আমি। এমনটা তো হওয়ার কথা না!

তখন আমার ফিলসফার বান্ধবী শিমু আমাকে খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা দিল। সে বল্ল, “ইসলামে বিয়ের বিধানের ওপর এত গুরুত্ব দেয়ার একটা অন্যতম কারণ হোল চরিত্র সংরক্ষণ এবং সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখা। আমাদের সমাজে আমরা ইসলামের বিধানের চেয়েও আঞ্চলিকভাবে যা চলে এসেছে তাকে বেশী গুরুত্ব দেই, মানুষ কি বলবে তা ভেবে বেশী চিন্তিত হই। তাই দেখা যায় লোকে কি বলবে ভেবে অনেকে বছরের পর বছর এমন একজনের সাথে আপাতদৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখে যেখানে একজনের সাথে আরেকজনের আদৌ কোন সম্পর্ক থাকেনা। দু’জন মানুষ একই বাড়ীতে থাকে, একসাথে খায়, ঘোরে কিন্তু একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারেনা। কেউ কেউ সন্তানদের কথা ভেবে নিজেকে বঞ্চিত করে, চালিয়ে যায় সুখে থাকার নাটক। যারা অতটা দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন নয়, তারা ডুবে যায় ব্যাভিচার বা অনৈতিক কার্যকলাপের আবর্তে। সেক্ষেত্রে তো বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হচ্ছে! তার চেয়ে কি এটা ভালো নয় যে তারা যেভাবে নিজেদের চরিত্র সংরক্ষণ করতে পারবে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেবে? তার মানে এই নয় যে তারা যে বৈবাহিক সম্পর্ক আছে তাকে সহজভাবে নেবে। এর মানে হোল তারা সর্বোত চেষ্টা করে দেখবে এই সম্পর্ক কার্যকর করা যার কি’না আর তারপর ব্যার্থ্ হলেই কেবল আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।

“এটা অবশ্যই খুব দুঃখজনক অবস্থা যদি কোন ব্যাক্তি সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পান তাঁর বিয়ের পর। এজন্যই হয়ত পর্দার ওপর এতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এই দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। কিন্তু একইসাথে বিবাহিত ব্যাক্তির জন্য ব্যাভিচারের শাস্তি নির্ধারন করা হয়েছে মৃত্যুদন্ড যেখানে অবিবাহিত ব্যাক্তির জন্য শাস্তি অপেক্ষাকৃত কম। যেহেতু অবিবাহিত নারীপুরুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সংযমের অভাবের কারণে ঘটতে পারে। কিন্তু বিবাহিত নারীপুরুষদের ক্ষেত্রে সীমালংঘনই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পুরুষদের জন্য একাধিক বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে যদিও আল্লাহ বলেছেন এক বিয়েই তাঁর কাছে অধিক পছন্দনীয় এবং একাধিক বিয়ের শর্ত এত কঠিন করে দেয়া হয়েছে যে চিন্তাশীল ব্যাক্তি মা্ত্রেই ভয় পাবে। কিন্তু এর পেছনে উদ্দেশ্য এই যে, যদি এই দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, তাহলে ব্যাভিচারের পরিবর্তে সঠিক পথটিই যেন মানুষ বেছে নেয়।

“সুতরাং, আমাদের সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ আমাদের এমন সঙ্গী মিলিয়ে দেন যার সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য- ঐ সাত ব্যাক্তির একজনের মত যারা কেয়ামতের দিন আরশের নীচে ছায়া পাবে যখন বারোটি সূর্য ঠিক মাথার ওপর অবস্থান করবে। আল্লাহ যেন আমাদের জন্য বৈবাহিক জীবন এবং দায়িত্ব সহজ এবং আনন্দময় করে দেন যাতে ইসলামের ওপর অবস্থান করা এবং চরিত্র সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়”।

শিমুর কথায় আমার যে শুধু এই ব্যাপারে ধারণা স্পষ্ট হোল তাই নয়, আমি বুঝতে পারলাম যে আমরা অনেক ফালতু ব্যাপারে দোয়া করতে করতে অস্থির হয়ে যাই, অথচ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে আল্লাহর সাহায্য চাইতে ভুলে যাই। মজার ব্যাপার হোল, আমি যখন আমার ছাত্রীদের বলতাম সঠিক বিয়ের জন্য দোয়া করতে, তারা খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলত, “এটা কি বললেন ম্যাডাম? এ’রকম লজ্জাজনক বিষয়ে কি আল্লাহকে বলা যায়?” অথচ ভুড়ি ভুড়ি ছেলেমেয়ে দেখেছি যারা বাবামাকে লুকিয়ে প্রেম করে আর সেই প্রেমে সাফল্য আসার জন্য আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে মহাবিশ্ব ফেঁড়ে ফেলার জোগাড়!

তাদের একজনকে বলেছিলাম, “তুমি আল্লাহকে বল যেটা তোমার জন্য ভালো হবে, আল্লাহ যেন সেটাই তোমাকে দেন। তুমি নিজে নির্দিষ্ট করে দিয়োনা তুমি কি চাও। কারণ আমরা কেউ জানিনা আমরা যা চাই তাতে ভালো আছে না মন্দ”। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। শেষমেশ বহুবছর পর, বহু নিশীথ রজনী অশ্রুব্যাকুল হয়ে দোয়া করার পর আচমকা কিভাবে যেন সব বাঁধা পরিষ্কার হয়ে গেল। তার বিয়ে হয়ে গেল নিজের পছন্দমত। সে এখনো প্রতিরাতে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে, “আমি নাহয় ভুল করে তাই চেয়েছি যা আমার জন্য ভালো নয়, কিন্তু তুমি কেন আমায় তা দিলে আল্লাহ?” আপনারাই বলুন, আল্লাহ বেচারা কি করবেন?!

আরেকবার এক ভাইয়ের বৌ মারা গেলেন হঠাৎ করে। বাচ্চাদের নিয়ে বেচারা হিমশিম খাচ্ছেন। ভাইয়ের বয়স খুব বেশী না। আমরা বললাম, কত বিধবা মেয়ে আছে যাদের কোন অভিভাবক নেই, তাদের একজনকে যদি উনি বিয়ে করেন তাহলে দু’জনেরই উপকার হতে পারে। স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে অন্যজনের সব প্রয়োজন বা চাহিদা তো আর অদৃশ্য হয়ে যায়না! সংসার চালাতে হবে, সন্তানদের দেখাশোনা করতে হবে, কোনটা বাদ দেয়ার মত? একজনের জীবনাবসান হয়েছে বলে তো আরেকজন জীবিত মানুষের জীবনের ইতি টেনে দেয়া যায়না। এর মানে এই নয় যে তাদের সম্পর্কে কোন ঘাটতি ছিল। বরং কেউ যদি কারো ব্যাপারে সত্যিই ভাবে তাহলে সে চাইবে সে মারা গেলে যেন তার সঙ্গী জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ না হয়ে সুখী হয়। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা অনেকসময় ইসলামের তোয়াক্কা না করে চলতি প্রথা অনুসারে চিন্তা করেন। বিধবা বা মৃতদার বিয়ে করবেন এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। আমার এক বন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, “তারা (আত্মীয়স্বজনরা) বরং এ’টাই ভালো মনে করে যে যাদের স্বামী বা স্ত্রী মারা গেছেন তারা অবৈধ কিছু করুক, ওটা হয়ত লোকে দেখতে পাবেনা। কিন্তু বৈধ উপায়ে বিয়ে করলে যে লোকে ছি ছি করবে সেটা তারা কিছুতেই সহ্য করতে রাজী না”।

আমাদের সমাজে হয়ত অভাব, হয়ত লোভ থেকে এখন আরেকটা প্রথা প্রচলিত হয়েছে। বিয়ে করে বৌ রেখে বছরের পর বছর বিদেশ থাকা। কেউ টাকার জন্য, কেউ সিটিজেনশিপের জন্য, কেউ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য, কেউ পরিবারের প্রয়োজনে। আবার অনেকে বাড়ীতে বৌ রেখে শহরে পড়ে থাকেন মাসের পর মাস। অথচ আল্লাহ বলেছেন স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনের পরিচ্ছদস্বরূপ। পোশাক যেভাবে আমাদের শীতগ্রীষ্ম, রোদবৃষ্টি, পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে; আমাদের সৌন্দর্য বর্ধিত করে, অসৌন্দর্য ঢেকে রাখে- স্বামী স্ত্রী সেভাবেই একজন আরেকজনকে সাহায্য সহযোগিতা, আলাপ পরামর্শ, সাহস বা সান্তনা দিয়ে পরস্পরকে পরিপূরণ করবে। কিন্তু দু’জন যদি বছরের পর বছর পরস্পরকে না’ই দেখে, শুধু ফোনে কথা বলে আর আকাশপাতাল কল্পনা করে কি চরিত্র সংরক্ষণ করা যায়? এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজে পরকীয়াসহ নানাধরণের বিশৃংখলা দেখা যাচ্ছে। মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে, আবার এই অবৈধ কার্যকলাপ ঢাকতে গিয়ে আরো বড় পাপের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিদেশেও যে ভাইরা সবসময় নিরাপদ থাকেন, ব্যাপারটা তেমনও নয়। বিদেশের মাটিতে মানুষের মন প্রায়ই খারাপ থাকে, তখন প্রলোভন থেকে নিজেকে বিরত রাখা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই পা পিছলে পড়ে যান পংকিলতার পিচ্ছিল পথে। উমার (রা) মুসলিম সৈনিকদের জন্য প্রতি চারমাসে বাড়ী ফিরে আসা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন এই ধরণের সামাজিক বিপর্যয় রোধ করার জন্য। আমাদের ভাইদের ক’জন প্রতি চারমাস অন্তর স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে আসেন বা আসতে পারেন? পরিবারের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেকেই নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা সাধ আহ্লাদ কোরবানী করে দেন বছরের পর বছর। কিন্তু তাদের আত্মীয়স্বজন মনে করেন, বিদেশে তো টাকা আকাশে বাতাসে ওড়ে, তার কাছে নিশ্চয়ই আরো টাকা আছে কিন্তু সে আমাদের দিচ্ছেনা। এই পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসা কঠিন বৈকি! আর দেশে যারা দূরে থেকে কাজ করেন তাদের স্ত্রীদের অনেক সময় বাবামা আসতে দেন না, হয়ত এই মনে করে যে তাহলে ছেলে আর বাড়ীতে টাকা পাঠাবে না! তাই দেশে থেকেও তারা চরিত্র সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত!

পারিবারিক বা সামাজিক প্রয়োজনে আজকাল আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মহিলা সংসারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের সামাজিক কাঠামো এখনো তাদের এই উভয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার উপযোগী হয়ে ওঠেনি। কাজের লোকের সাহায্য ছাড়া সংসার চালানোর মত গৃহ, রান্নাঘর, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানির ব্যাবস্থা, পারিবারিক কাঠামো, বাচ্চাদের জন্য সুব্যাবস্থা এখনো সুদূরপরাহত। অনেক মহিলারাই কাজ করেন পুরুষপরিবেষ্টিত পরিমন্ডলে যেখানে নারী বলেই তাদের প্রতি সৎমাসুলভ আচরণ করা হয়। অনেকেই সারাদিন এ’ধরণের কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে একটু শান্তির আশায় ঘরে ফেরেন। কিন্তু অধিকাংশ মহিলা যৌথ পরিবারে থাকেন বিধায় ঘরে ফিরেও পারিবারিক দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি মিলেনা। শ্বাশুড়ীকেন্দ্রিক পরিবারে শ্বাশুড়ী বিবেকবতী না হলে মহিলাদের ২৪ ঘন্টাই কাটে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে। তদুপরি স্বামীও যদি তাদের সময় বা সাহচর্য না দেন, যেটা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠেনা, তখন তাদের দিক হারানোর সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। এটা শুধু নারীদের ক্ষেত্রেই নয়, যে পুরুষ সারাদিন চাকরী করে বাড়ী ফিরে দেখেন বৌ শ্বশুর শ্বাশুড়ীর সেবায় নিয়োজিত সম্পূর্ণ সময়, তাঁর সাথে দু’দন্ড বসে কথা বলার সময় নেই স্ত্রীর, তিনিও একই ভাবে পথ হারাতে পারেন।

একবার ইউনিভার্সিটিতে এক ক্লাসে ছাত্রী কথাপ্রসঙ্গে বলছিল, “ম্যাডাম, আমি ইউনিভার্সিটি আসি বলে সবদিন সকালে বাসার সবার জন্য নাস্তা বানাতে পারিনা। তাই শ্বাশুড়ী আমাকে নাস্তা খেতে দেননা। আমি এখন পাঁচমাসের প্রেগ্ন্যান্ট। প্রতিদিন খালিপেটে ক্লাসে এসে বমি করি। বাসায় গিয়ে রান্না করতে পারলে খাবার জোটে নতুবা নয়। আমার শ্বাশুড়ীর যদি ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান থাকত তাহলে কি উনি এ’রকম করতে পারতেন?” সে প্রথমে যে বর্ণনা দিল তাতে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করল- যে মহিলা তার হবু নাতি বা নাতনীর মায়ের সাথে এমন আচরণ করছেন, তিনি কি ভাবছেন তিনি এই মেয়েটাকে প্রতিদিন কি বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন? নূন্যতম মানবতাবঞ্চিত এই মেয়েটা যদি কারো কাছ থেকে ন্যূনতম মানবিক ব্যাবহার পায়, তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে বা তার সাথে পালায়, তাকে কি খুব দোষ দেয়া যাবে? কি নিশ্চয়তা আছে যে এ’রকম মানসিক তোলপাড়ের মধ্যে সে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? তার স্বামী কি ধরেই নিয়েছেন যে একটুকরা কাগজে দু’জনে সই করেছে বলে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সকলে এই মেয়েটাই সাথে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারেবন অথচ সে তাদের প্রতি অনুরক্ত থাকতে বাধ্য?!

এক বন্ধুকে একবার বলেছিলাম, “ভাই আপনি এত ভালো মানুষ, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পজিশনে চাকরী করেন, অথচ একটা মেয়েকে নিয়ে আপনাকে ঘুরতে দেখেছে অনেকেই। আপনি তাকে বিয়ে করুন বা বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কিন্তু আপনি যা করছেন তা আপনিও জানেন অন্যায়, কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা আপনার মত একজন অসাধারন মানুষ যখন এই কাজটা করছেন তখন অন্যদের আমরা আর কিছু বলতে পারছিনা যাদের বলা প্রয়োজন”। উনি কিছুক্ষণ কিভাবে বুঝিয়ে বলবেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “আমাদের বাড়ীতে সব ভাইবোন পালিয়ে বিয়ে করেছে কারণ আমাদের বাবামা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তারা নানাধরনের বাহানা দিয়ে আমাদের সময়মত বিয়ের ব্যাবস্থা করেন না। আমি একটু আধটু ইসলাম বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তাতে লাভ হয়েছে এই যে আমি পালাইনি, বাবামা’র সব আকাঙ্ক্ষা পূরন করেছি, বাড়ী বানিয়ে দিয়েছি, বোনদের বিয়ে দিয়েছি, টাকাপয়সা দিচ্ছি প্রতিমাসে- কিন্তু তারা আমাকে বিয়ে করতে দিতে রাজী নন। যদি বিয়ের পর এভাবে ওদের জন্য খরচ করতে না পারি! আমার চল্লিশ হতে খুব একটা দেরী নেই। আর চল্লিশের পর আমার আর বিয়ে করার প্রয়োজনই নেই। কিন্তু বাবামাকে কে বোঝাবে? আমি এখন আমার ‘ভুলের’ মাসুল দিচ্ছি। দুনিয়াতেও গুনাহ কামাচ্ছি, আখেরাতেও এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

“এ’ তো গেল বাবামা’র কথা। যে মেয়ের আমাকে পছন্দ তাকে বললাম, চল আমরা ছোটখাট করে বিয়ে করে ফেলি। সে তখন বেঁকে বসল। কমপক্ষে দশভরি গহনা আর বড় অনুষ্ঠান না করলে সে বিয়েই করবেনা। আপনি তো গোল্ডের দাম জানেন নিশ্চয়ই। বলেন তো আরো কত বছর চাকরী করলে আমার দশ ভরি গোল্ড কেনার সামর্থ্য হবে?” ওনাকে বিচার করা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। তাই চুপ করে রইলাম।

ছোটবেলায় এক ভদ্রমহিলার কথা শুনেছিলাম যিনি বোনকে তালাক দিইয়ে বোনের স্বামীকে বিয়ে করেছিলেন। বাংলাদেশে ফেরার পর এক পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরে জানতে পারলাম এই সেই পরিবার যার কথা আবুধাবীতে বসে শুনেছিলাম। একদিন ওনার বাবার সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম বড় বোন স্বামীকে দিয়ে ছোটবোনের আনানেয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করাতেন। অথচ হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে এই সম্পর্কগুলো থেকে ততটাই সাবধানতা অবলম্বন করতে যেভাবে আগুন থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করা হয়। যেহেতু এক্ষেত্রে পর্দা বজায় রাখা অনেক কঠিন, এখানে সাবধানতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় শ্যালিকা বা দেবরদের সাথে দুলাভাই ভাবীদের আজেবাজে দুষ্টুমী করতে, পাশে বসতে বা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলতে! এই বিষয়ে কেউ কিছু বললে আমরা খুব রেগে যাই বা অপমানিত বোধ করি। আমরা মনে করি এই বিষয়ে এভাবে ভাবাটা নোংরা মানসিকতার পরিচায়ক। কিন্তু এই কথাটা আমাদের মাথায় খেলেনা যে আমরা সবাই মানুষ, তাই কেউ মানবীয় দুর্বলতার উর্ধ্বে নই। আপনজনদের নিরাপত্তার জন্য এক্ষেত্রে আমাদের আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরন করাটাই শ্রেয় কারণ সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন সৃষ্টবস্তুর গুনাগুন সম্পর্কে।

বিয়ে কেবল একটা মৌখিক সম্মতি, একটুকরো কাগজ, একটা সামাজিক অনুষ্ঠান- যতক্ষণ না উভয় ব্যাক্তি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং এই সম্পর্ককে স্থায়ী করার জন্য বুঝেশুনে অগ্রসর হয়। নাটক সিনেমা দেখে আমাদের একটা ধারণা হয়ে যায় যে বিয়ে হোল সব সমস্যার শেষ আর সুখের শুরু। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। ব্যাপারটা এমনও নয় যে দেখতে ভালো হলে, সুন্দর জামাকাপর গহনা মেকাপ পরে সেজেগুজে থাকলেই বিয়ে সুখের হয়। দু’জন মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা দুই পরিবেশ, দু’টো পৃথক পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে এসে “happily ever after” টিকে যাওয়া এতটা সহজ নয়। এর জন্য দু’জনকেই প্রতিদিন প্রতিটা মূহূর্ত চেষ্টা করতে হবে একে অপরকে বোঝার, পরস্পরের সুবিধা অসুবিধা রুচি পছন্দ জানার এবং তাকে সম্মান করার, পরস্পরের পরিবারকে আপন করে নেয়ার। দু’জনকেই সাহায্য করতে হবে একে অপরকে আলাপ আলোচনা সহযোগিতা করে। সবচেয়ে বড় কথা প্রেম সম্পর্কে নাটক সিনেমার বানোয়াট ধারণা ঝেড়ে ফেলে বুঝতে হবে সবার আগে এটা একটা খুব ভালো বন্ধুত্ব- যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সম্প্রীতি আর সম্মানের মজবুত ভিত্তির ওপর, যা পাকা চুল আর ঝুলে পড়া চামড়ায় পরিবর্তিত হয়ে যায়না।