নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে ‘ওশিন’ নামে একটি জনপ্রিয় জাপানী সিরিয়াল প্রচারিত হয়। আমরা তখন সম্ভবত অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বান্ধবীরা প্রায়ই এর বিভিন্ন এপিসোড নিয়ে কথা বলতাম। একবার দেখানো হোল ওশিন এমন এক নির্জন জায়গায় গিয়ে চাষবাস করতে শুরু করল যেখানে স্কুলশিক্ষক ছাড়া আর কোন উপযুক্ত পুরুষ নেই মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য। সে আর কোন উপায় না দেখে মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে স্কুলশিক্ষকের কাছে বিয়ে দিয়ে দিল। একটা সন্তান হওয়ার পর মেয়েটির এমন একজনের সাথে পরিচয় হয় যাকে তার মন থেকে পছন্দ হয়। বেশ কিছুদিন চিন্তাভাবনা করার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় যে শিক্ষক স্বামীকে ছেড়ে সে ঐ লোকের সাথে সংসার করবে। ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মধ্যে এমনভাবে তোলপাড় সৃষ্টি হোল যেন আমাদের পরিচিত কেউ এমনটা করে বসেছে!
আমার কোন বোন নেই। ভাইদের সাথে বড় হওয়াতেই কি’না জানিনা, আমার রান্নাবাড়া, সাজগোজ, প্রেম বিবাহ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিলনা কখনো। বাস্তব জীবনের চেয়ে বইপত্রের সাথে সম্পর্ক ছিল বেশী। তাই বিবাহ বিষয়ে ধারণা ছিল সিন্ডারেলা মার্কা গল্পে যা লেখা থাকে তেমন, কোনপ্রকারে একবার বিয়ে হয়ে গেলেই “happily ever after”. আমাদের অধিকাংশ মেয়েদের মধ্যেই এই ধরণের ভুল ধারণা কাজ করে। কারণ রূপকথার বইগুলো আমাদের কোনভাবেই জীবনের বাস্তবতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেনা। তাই বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুষড়ে পড়েছিলাম আমি। এমনটা তো হওয়ার কথা না!
তখন আমার ফিলসফার বান্ধবী শিমু আমাকে খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা দিল। সে বল্ল, “ইসলামে বিয়ের বিধানের ওপর এত গুরুত্ব দেয়ার একটা অন্যতম কারণ হোল চরিত্র সংরক্ষণ এবং সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখা। আমাদের সমাজে আমরা ইসলামের বিধানের চেয়েও আঞ্চলিকভাবে যা চলে এসেছে তাকে বেশী গুরুত্ব দেই, মানুষ কি বলবে তা ভেবে বেশী চিন্তিত হই। তাই দেখা যায় লোকে কি বলবে ভেবে অনেকে বছরের পর বছর এমন একজনের সাথে আপাতদৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখে যেখানে একজনের সাথে আরেকজনের আদৌ কোন সম্পর্ক থাকেনা। দু’জন মানুষ একই বাড়ীতে থাকে, একসাথে খায়, ঘোরে কিন্তু একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারেনা। কেউ কেউ সন্তানদের কথা ভেবে নিজেকে বঞ্চিত করে, চালিয়ে যায় সুখে থাকার নাটক। যারা অতটা দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন নয়, তারা ডুবে যায় ব্যাভিচার বা অনৈতিক কার্যকলাপের আবর্তে। সেক্ষেত্রে তো বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হচ্ছে! তার চেয়ে কি এটা ভালো নয় যে তারা যেভাবে নিজেদের চরিত্র সংরক্ষণ করতে পারবে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেবে? তার মানে এই নয় যে তারা যে বৈবাহিক সম্পর্ক আছে তাকে সহজভাবে নেবে। এর মানে হোল তারা সর্বোত চেষ্টা করে দেখবে এই সম্পর্ক কার্যকর করা যার কি’না আর তারপর ব্যার্থ্ হলেই কেবল আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।
“এটা অবশ্যই খুব দুঃখজনক অবস্থা যদি কোন ব্যাক্তি সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পান তাঁর বিয়ের পর। এজন্যই হয়ত পর্দার ওপর এতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এই দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। কিন্তু একইসাথে বিবাহিত ব্যাক্তির জন্য ব্যাভিচারের শাস্তি নির্ধারন করা হয়েছে মৃত্যুদন্ড যেখানে অবিবাহিত ব্যাক্তির জন্য শাস্তি অপেক্ষাকৃত কম। যেহেতু অবিবাহিত নারীপুরুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সংযমের অভাবের কারণে ঘটতে পারে। কিন্তু বিবাহিত নারীপুরুষদের ক্ষেত্রে সীমালংঘনই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পুরুষদের জন্য একাধিক বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে যদিও আল্লাহ বলেছেন এক বিয়েই তাঁর কাছে অধিক পছন্দনীয় এবং একাধিক বিয়ের শর্ত এত কঠিন করে দেয়া হয়েছে যে চিন্তাশীল ব্যাক্তি মা্ত্রেই ভয় পাবে। কিন্তু এর পেছনে উদ্দেশ্য এই যে, যদি এই দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, তাহলে ব্যাভিচারের পরিবর্তে সঠিক পথটিই যেন মানুষ বেছে নেয়।
“সুতরাং, আমাদের সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ আমাদের এমন সঙ্গী মিলিয়ে দেন যার সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য- ঐ সাত ব্যাক্তির একজনের মত যারা কেয়ামতের দিন আরশের নীচে ছায়া পাবে যখন বারোটি সূর্য ঠিক মাথার ওপর অবস্থান করবে। আল্লাহ যেন আমাদের জন্য বৈবাহিক জীবন এবং দায়িত্ব সহজ এবং আনন্দময় করে দেন যাতে ইসলামের ওপর অবস্থান করা এবং চরিত্র সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়”।
শিমুর কথায় আমার যে শুধু এই ব্যাপারে ধারণা স্পষ্ট হোল তাই নয়, আমি বুঝতে পারলাম যে আমরা অনেক ফালতু ব্যাপারে দোয়া করতে করতে অস্থির হয়ে যাই, অথচ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে আল্লাহর সাহায্য চাইতে ভুলে যাই। মজার ব্যাপার হোল, আমি যখন আমার ছাত্রীদের বলতাম সঠিক বিয়ের জন্য দোয়া করতে, তারা খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলত, “এটা কি বললেন ম্যাডাম? এ’রকম লজ্জাজনক বিষয়ে কি আল্লাহকে বলা যায়?” অথচ ভুড়ি ভুড়ি ছেলেমেয়ে দেখেছি যারা বাবামাকে লুকিয়ে প্রেম করে আর সেই প্রেমে সাফল্য আসার জন্য আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে মহাবিশ্ব ফেঁড়ে ফেলার জোগাড়!
তাদের একজনকে বলেছিলাম, “তুমি আল্লাহকে বল যেটা তোমার জন্য ভালো হবে, আল্লাহ যেন সেটাই তোমাকে দেন। তুমি নিজে নির্দিষ্ট করে দিয়োনা তুমি কি চাও। কারণ আমরা কেউ জানিনা আমরা যা চাই তাতে ভালো আছে না মন্দ”। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। শেষমেশ বহুবছর পর, বহু নিশীথ রজনী অশ্রুব্যাকুল হয়ে দোয়া করার পর আচমকা কিভাবে যেন সব বাঁধা পরিষ্কার হয়ে গেল। তার বিয়ে হয়ে গেল নিজের পছন্দমত। সে এখনো প্রতিরাতে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে, “আমি নাহয় ভুল করে তাই চেয়েছি যা আমার জন্য ভালো নয়, কিন্তু তুমি কেন আমায় তা দিলে আল্লাহ?” আপনারাই বলুন, আল্লাহ বেচারা কি করবেন?!
আরেকবার এক ভাইয়ের বৌ মারা গেলেন হঠাৎ করে। বাচ্চাদের নিয়ে বেচারা হিমশিম খাচ্ছেন। ভাইয়ের বয়স খুব বেশী না। আমরা বললাম, কত বিধবা মেয়ে আছে যাদের কোন অভিভাবক নেই, তাদের একজনকে যদি উনি বিয়ে করেন তাহলে দু’জনেরই উপকার হতে পারে। স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে অন্যজনের সব প্রয়োজন বা চাহিদা তো আর অদৃশ্য হয়ে যায়না! সংসার চালাতে হবে, সন্তানদের দেখাশোনা করতে হবে, কোনটা বাদ দেয়ার মত? একজনের জীবনাবসান হয়েছে বলে তো আরেকজন জীবিত মানুষের জীবনের ইতি টেনে দেয়া যায়না। এর মানে এই নয় যে তাদের সম্পর্কে কোন ঘাটতি ছিল। বরং কেউ যদি কারো ব্যাপারে সত্যিই ভাবে তাহলে সে চাইবে সে মারা গেলে যেন তার সঙ্গী জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ না হয়ে সুখী হয়। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা অনেকসময় ইসলামের তোয়াক্কা না করে চলতি প্রথা অনুসারে চিন্তা করেন। বিধবা বা মৃতদার বিয়ে করবেন এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। আমার এক বন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, “তারা (আত্মীয়স্বজনরা) বরং এ’টাই ভালো মনে করে যে যাদের স্বামী বা স্ত্রী মারা গেছেন তারা অবৈধ কিছু করুক, ওটা হয়ত লোকে দেখতে পাবেনা। কিন্তু বৈধ উপায়ে বিয়ে করলে যে লোকে ছি ছি করবে সেটা তারা কিছুতেই সহ্য করতে রাজী না”।
আমাদের সমাজে হয়ত অভাব, হয়ত লোভ থেকে এখন আরেকটা প্রথা প্রচলিত হয়েছে। বিয়ে করে বৌ রেখে বছরের পর বছর বিদেশ থাকা। কেউ টাকার জন্য, কেউ সিটিজেনশিপের জন্য, কেউ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য, কেউ পরিবারের প্রয়োজনে। আবার অনেকে বাড়ীতে বৌ রেখে শহরে পড়ে থাকেন মাসের পর মাস। অথচ আল্লাহ বলেছেন স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনের পরিচ্ছদস্বরূপ। পোশাক যেভাবে আমাদের শীতগ্রীষ্ম, রোদবৃষ্টি, পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে; আমাদের সৌন্দর্য বর্ধিত করে, অসৌন্দর্য ঢেকে রাখে- স্বামী স্ত্রী সেভাবেই একজন আরেকজনকে সাহায্য সহযোগিতা, আলাপ পরামর্শ, সাহস বা সান্তনা দিয়ে পরস্পরকে পরিপূরণ করবে। কিন্তু দু’জন যদি বছরের পর বছর পরস্পরকে না’ই দেখে, শুধু ফোনে কথা বলে আর আকাশপাতাল কল্পনা করে কি চরিত্র সংরক্ষণ করা যায়? এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজে পরকীয়াসহ নানাধরণের বিশৃংখলা দেখা যাচ্ছে। মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে, আবার এই অবৈধ কার্যকলাপ ঢাকতে গিয়ে আরো বড় পাপের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিদেশেও যে ভাইরা সবসময় নিরাপদ থাকেন, ব্যাপারটা তেমনও নয়। বিদেশের মাটিতে মানুষের মন প্রায়ই খারাপ থাকে, তখন প্রলোভন থেকে নিজেকে বিরত রাখা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই পা পিছলে পড়ে যান পংকিলতার পিচ্ছিল পথে। উমার (রা) মুসলিম সৈনিকদের জন্য প্রতি চারমাসে বাড়ী ফিরে আসা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন এই ধরণের সামাজিক বিপর্যয় রোধ করার জন্য। আমাদের ভাইদের ক’জন প্রতি চারমাস অন্তর স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে আসেন বা আসতে পারেন? পরিবারের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেকেই নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা সাধ আহ্লাদ কোরবানী করে দেন বছরের পর বছর। কিন্তু তাদের আত্মীয়স্বজন মনে করেন, বিদেশে তো টাকা আকাশে বাতাসে ওড়ে, তার কাছে নিশ্চয়ই আরো টাকা আছে কিন্তু সে আমাদের দিচ্ছেনা। এই পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসা কঠিন বৈকি! আর দেশে যারা দূরে থেকে কাজ করেন তাদের স্ত্রীদের অনেক সময় বাবামা আসতে দেন না, হয়ত এই মনে করে যে তাহলে ছেলে আর বাড়ীতে টাকা পাঠাবে না! তাই দেশে থেকেও তারা চরিত্র সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত!
পারিবারিক বা সামাজিক প্রয়োজনে আজকাল আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মহিলা সংসারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের সামাজিক কাঠামো এখনো তাদের এই উভয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার উপযোগী হয়ে ওঠেনি। কাজের লোকের সাহায্য ছাড়া সংসার চালানোর মত গৃহ, রান্নাঘর, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানির ব্যাবস্থা, পারিবারিক কাঠামো, বাচ্চাদের জন্য সুব্যাবস্থা এখনো সুদূরপরাহত। অনেক মহিলারাই কাজ করেন পুরুষপরিবেষ্টিত পরিমন্ডলে যেখানে নারী বলেই তাদের প্রতি সৎমাসুলভ আচরণ করা হয়। অনেকেই সারাদিন এ’ধরণের কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে একটু শান্তির আশায় ঘরে ফেরেন। কিন্তু অধিকাংশ মহিলা যৌথ পরিবারে থাকেন বিধায় ঘরে ফিরেও পারিবারিক দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি মিলেনা। শ্বাশুড়ীকেন্দ্রিক পরিবারে শ্বাশুড়ী বিবেকবতী না হলে মহিলাদের ২৪ ঘন্টাই কাটে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে। তদুপরি স্বামীও যদি তাদের সময় বা সাহচর্য না দেন, যেটা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠেনা, তখন তাদের দিক হারানোর সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। এটা শুধু নারীদের ক্ষেত্রেই নয়, যে পুরুষ সারাদিন চাকরী করে বাড়ী ফিরে দেখেন বৌ শ্বশুর শ্বাশুড়ীর সেবায় নিয়োজিত সম্পূর্ণ সময়, তাঁর সাথে দু’দন্ড বসে কথা বলার সময় নেই স্ত্রীর, তিনিও একই ভাবে পথ হারাতে পারেন।
একবার ইউনিভার্সিটিতে এক ক্লাসে ছাত্রী কথাপ্রসঙ্গে বলছিল, “ম্যাডাম, আমি ইউনিভার্সিটি আসি বলে সবদিন সকালে বাসার সবার জন্য নাস্তা বানাতে পারিনা। তাই শ্বাশুড়ী আমাকে নাস্তা খেতে দেননা। আমি এখন পাঁচমাসের প্রেগ্ন্যান্ট। প্রতিদিন খালিপেটে ক্লাসে এসে বমি করি। বাসায় গিয়ে রান্না করতে পারলে খাবার জোটে নতুবা নয়। আমার শ্বাশুড়ীর যদি ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান থাকত তাহলে কি উনি এ’রকম করতে পারতেন?” সে প্রথমে যে বর্ণনা দিল তাতে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করল- যে মহিলা তার হবু নাতি বা নাতনীর মায়ের সাথে এমন আচরণ করছেন, তিনি কি ভাবছেন তিনি এই মেয়েটাকে প্রতিদিন কি বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন? নূন্যতম মানবতাবঞ্চিত এই মেয়েটা যদি কারো কাছ থেকে ন্যূনতম মানবিক ব্যাবহার পায়, তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে বা তার সাথে পালায়, তাকে কি খুব দোষ দেয়া যাবে? কি নিশ্চয়তা আছে যে এ’রকম মানসিক তোলপাড়ের মধ্যে সে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? তার স্বামী কি ধরেই নিয়েছেন যে একটুকরা কাগজে দু’জনে সই করেছে বলে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সকলে এই মেয়েটাই সাথে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারেবন অথচ সে তাদের প্রতি অনুরক্ত থাকতে বাধ্য?!
এক বন্ধুকে একবার বলেছিলাম, “ভাই আপনি এত ভালো মানুষ, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পজিশনে চাকরী করেন, অথচ একটা মেয়েকে নিয়ে আপনাকে ঘুরতে দেখেছে অনেকেই। আপনি তাকে বিয়ে করুন বা বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কিন্তু আপনি যা করছেন তা আপনিও জানেন অন্যায়, কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা আপনার মত একজন অসাধারন মানুষ যখন এই কাজটা করছেন তখন অন্যদের আমরা আর কিছু বলতে পারছিনা যাদের বলা প্রয়োজন”। উনি কিছুক্ষণ কিভাবে বুঝিয়ে বলবেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “আমাদের বাড়ীতে সব ভাইবোন পালিয়ে বিয়ে করেছে কারণ আমাদের বাবামা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তারা নানাধরনের বাহানা দিয়ে আমাদের সময়মত বিয়ের ব্যাবস্থা করেন না। আমি একটু আধটু ইসলাম বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তাতে লাভ হয়েছে এই যে আমি পালাইনি, বাবামা’র সব আকাঙ্ক্ষা পূরন করেছি, বাড়ী বানিয়ে দিয়েছি, বোনদের বিয়ে দিয়েছি, টাকাপয়সা দিচ্ছি প্রতিমাসে- কিন্তু তারা আমাকে বিয়ে করতে দিতে রাজী নন। যদি বিয়ের পর এভাবে ওদের জন্য খরচ করতে না পারি! আমার চল্লিশ হতে খুব একটা দেরী নেই। আর চল্লিশের পর আমার আর বিয়ে করার প্রয়োজনই নেই। কিন্তু বাবামাকে কে বোঝাবে? আমি এখন আমার ‘ভুলের’ মাসুল দিচ্ছি। দুনিয়াতেও গুনাহ কামাচ্ছি, আখেরাতেও এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
“এ’ তো গেল বাবামা’র কথা। যে মেয়ের আমাকে পছন্দ তাকে বললাম, চল আমরা ছোটখাট করে বিয়ে করে ফেলি। সে তখন বেঁকে বসল। কমপক্ষে দশভরি গহনা আর বড় অনুষ্ঠান না করলে সে বিয়েই করবেনা। আপনি তো গোল্ডের দাম জানেন নিশ্চয়ই। বলেন তো আরো কত বছর চাকরী করলে আমার দশ ভরি গোল্ড কেনার সামর্থ্য হবে?” ওনাকে বিচার করা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। তাই চুপ করে রইলাম।
ছোটবেলায় এক ভদ্রমহিলার কথা শুনেছিলাম যিনি বোনকে তালাক দিইয়ে বোনের স্বামীকে বিয়ে করেছিলেন। বাংলাদেশে ফেরার পর এক পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরে জানতে পারলাম এই সেই পরিবার যার কথা আবুধাবীতে বসে শুনেছিলাম। একদিন ওনার বাবার সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম বড় বোন স্বামীকে দিয়ে ছোটবোনের আনানেয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করাতেন। অথচ হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে এই সম্পর্কগুলো থেকে ততটাই সাবধানতা অবলম্বন করতে যেভাবে আগুন থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করা হয়। যেহেতু এক্ষেত্রে পর্দা বজায় রাখা অনেক কঠিন, এখানে সাবধানতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় শ্যালিকা বা দেবরদের সাথে দুলাভাই ভাবীদের আজেবাজে দুষ্টুমী করতে, পাশে বসতে বা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলতে! এই বিষয়ে কেউ কিছু বললে আমরা খুব রেগে যাই বা অপমানিত বোধ করি। আমরা মনে করি এই বিষয়ে এভাবে ভাবাটা নোংরা মানসিকতার পরিচায়ক। কিন্তু এই কথাটা আমাদের মাথায় খেলেনা যে আমরা সবাই মানুষ, তাই কেউ মানবীয় দুর্বলতার উর্ধ্বে নই। আপনজনদের নিরাপত্তার জন্য এক্ষেত্রে আমাদের আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরন করাটাই শ্রেয় কারণ সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন সৃষ্টবস্তুর গুনাগুন সম্পর্কে।
বিয়ে কেবল একটা মৌখিক সম্মতি, একটুকরো কাগজ, একটা সামাজিক অনুষ্ঠান- যতক্ষণ না উভয় ব্যাক্তি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং এই সম্পর্ককে স্থায়ী করার জন্য বুঝেশুনে অগ্রসর হয়। নাটক সিনেমা দেখে আমাদের একটা ধারণা হয়ে যায় যে বিয়ে হোল সব সমস্যার শেষ আর সুখের শুরু। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। ব্যাপারটা এমনও নয় যে দেখতে ভালো হলে, সুন্দর জামাকাপর গহনা মেকাপ পরে সেজেগুজে থাকলেই বিয়ে সুখের হয়। দু’জন মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা দুই পরিবেশ, দু’টো পৃথক পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে এসে “happily ever after” টিকে যাওয়া এতটা সহজ নয়। এর জন্য দু’জনকেই প্রতিদিন প্রতিটা মূহূর্ত চেষ্টা করতে হবে একে অপরকে বোঝার, পরস্পরের সুবিধা অসুবিধা রুচি পছন্দ জানার এবং তাকে সম্মান করার, পরস্পরের পরিবারকে আপন করে নেয়ার। দু’জনকেই সাহায্য করতে হবে একে অপরকে আলাপ আলোচনা সহযোগিতা করে। সবচেয়ে বড় কথা প্রেম সম্পর্কে নাটক সিনেমার বানোয়াট ধারণা ঝেড়ে ফেলে বুঝতে হবে সবার আগে এটা একটা খুব ভালো বন্ধুত্ব- যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সম্প্রীতি আর সম্মানের মজবুত ভিত্তির ওপর, যা পাকা চুল আর ঝুলে পড়া চামড়ায় পরিবর্তিত হয়ে যায়না।
আমার কোন বোন নেই। ভাইদের সাথে বড় হওয়াতেই কি’না জানিনা, আমার রান্নাবাড়া, সাজগোজ, প্রেম বিবাহ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিলনা কখনো। বাস্তব জীবনের চেয়ে বইপত্রের সাথে সম্পর্ক ছিল বেশী। তাই বিবাহ বিষয়ে ধারণা ছিল সিন্ডারেলা মার্কা গল্পে যা লেখা থাকে তেমন, কোনপ্রকারে একবার বিয়ে হয়ে গেলেই “happily ever after”. আমাদের অধিকাংশ মেয়েদের মধ্যেই এই ধরণের ভুল ধারণা কাজ করে। কারণ রূপকথার বইগুলো আমাদের কোনভাবেই জীবনের বাস্তবতার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করেনা। তাই বান্ধবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুষড়ে পড়েছিলাম আমি। এমনটা তো হওয়ার কথা না!
তখন আমার ফিলসফার বান্ধবী শিমু আমাকে খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা দিল। সে বল্ল, “ইসলামে বিয়ের বিধানের ওপর এত গুরুত্ব দেয়ার একটা অন্যতম কারণ হোল চরিত্র সংরক্ষণ এবং সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখা। আমাদের সমাজে আমরা ইসলামের বিধানের চেয়েও আঞ্চলিকভাবে যা চলে এসেছে তাকে বেশী গুরুত্ব দেই, মানুষ কি বলবে তা ভেবে বেশী চিন্তিত হই। তাই দেখা যায় লোকে কি বলবে ভেবে অনেকে বছরের পর বছর এমন একজনের সাথে আপাতদৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখে যেখানে একজনের সাথে আরেকজনের আদৌ কোন সম্পর্ক থাকেনা। দু’জন মানুষ একই বাড়ীতে থাকে, একসাথে খায়, ঘোরে কিন্তু একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারেনা। কেউ কেউ সন্তানদের কথা ভেবে নিজেকে বঞ্চিত করে, চালিয়ে যায় সুখে থাকার নাটক। যারা অতটা দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন নয়, তারা ডুবে যায় ব্যাভিচার বা অনৈতিক কার্যকলাপের আবর্তে। সেক্ষেত্রে তো বিয়ের মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হচ্ছে! তার চেয়ে কি এটা ভালো নয় যে তারা যেভাবে নিজেদের চরিত্র সংরক্ষণ করতে পারবে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেবে? তার মানে এই নয় যে তারা যে বৈবাহিক সম্পর্ক আছে তাকে সহজভাবে নেবে। এর মানে হোল তারা সর্বোত চেষ্টা করে দেখবে এই সম্পর্ক কার্যকর করা যার কি’না আর তারপর ব্যার্থ্ হলেই কেবল আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।
“এটা অবশ্যই খুব দুঃখজনক অবস্থা যদি কোন ব্যাক্তি সঠিক মানুষটিকে খুঁজে পান তাঁর বিয়ের পর। এজন্যই হয়ত পর্দার ওপর এতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এই দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য। কিন্তু একইসাথে বিবাহিত ব্যাক্তির জন্য ব্যাভিচারের শাস্তি নির্ধারন করা হয়েছে মৃত্যুদন্ড যেখানে অবিবাহিত ব্যাক্তির জন্য শাস্তি অপেক্ষাকৃত কম। যেহেতু অবিবাহিত নারীপুরুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সংযমের অভাবের কারণে ঘটতে পারে। কিন্তু বিবাহিত নারীপুরুষদের ক্ষেত্রে সীমালংঘনই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পুরুষদের জন্য একাধিক বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে যদিও আল্লাহ বলেছেন এক বিয়েই তাঁর কাছে অধিক পছন্দনীয় এবং একাধিক বিয়ের শর্ত এত কঠিন করে দেয়া হয়েছে যে চিন্তাশীল ব্যাক্তি মা্ত্রেই ভয় পাবে। কিন্তু এর পেছনে উদ্দেশ্য এই যে, যদি এই দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, তাহলে ব্যাভিচারের পরিবর্তে সঠিক পথটিই যেন মানুষ বেছে নেয়।
“সুতরাং, আমাদের সবসময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত যেন আল্লাহ আমাদের এমন সঙ্গী মিলিয়ে দেন যার সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য- ঐ সাত ব্যাক্তির একজনের মত যারা কেয়ামতের দিন আরশের নীচে ছায়া পাবে যখন বারোটি সূর্য ঠিক মাথার ওপর অবস্থান করবে। আল্লাহ যেন আমাদের জন্য বৈবাহিক জীবন এবং দায়িত্ব সহজ এবং আনন্দময় করে দেন যাতে ইসলামের ওপর অবস্থান করা এবং চরিত্র সংরক্ষণ করা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায়”।
শিমুর কথায় আমার যে শুধু এই ব্যাপারে ধারণা স্পষ্ট হোল তাই নয়, আমি বুঝতে পারলাম যে আমরা অনেক ফালতু ব্যাপারে দোয়া করতে করতে অস্থির হয়ে যাই, অথচ জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোতে আল্লাহর সাহায্য চাইতে ভুলে যাই। মজার ব্যাপার হোল, আমি যখন আমার ছাত্রীদের বলতাম সঠিক বিয়ের জন্য দোয়া করতে, তারা খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলত, “এটা কি বললেন ম্যাডাম? এ’রকম লজ্জাজনক বিষয়ে কি আল্লাহকে বলা যায়?” অথচ ভুড়ি ভুড়ি ছেলেমেয়ে দেখেছি যারা বাবামাকে লুকিয়ে প্রেম করে আর সেই প্রেমে সাফল্য আসার জন্য আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে মহাবিশ্ব ফেঁড়ে ফেলার জোগাড়!
তাদের একজনকে বলেছিলাম, “তুমি আল্লাহকে বল যেটা তোমার জন্য ভালো হবে, আল্লাহ যেন সেটাই তোমাকে দেন। তুমি নিজে নির্দিষ্ট করে দিয়োনা তুমি কি চাও। কারণ আমরা কেউ জানিনা আমরা যা চাই তাতে ভালো আছে না মন্দ”। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। শেষমেশ বহুবছর পর, বহু নিশীথ রজনী অশ্রুব্যাকুল হয়ে দোয়া করার পর আচমকা কিভাবে যেন সব বাঁধা পরিষ্কার হয়ে গেল। তার বিয়ে হয়ে গেল নিজের পছন্দমত। সে এখনো প্রতিরাতে ব্যাকুল হয়ে কাঁদে, “আমি নাহয় ভুল করে তাই চেয়েছি যা আমার জন্য ভালো নয়, কিন্তু তুমি কেন আমায় তা দিলে আল্লাহ?” আপনারাই বলুন, আল্লাহ বেচারা কি করবেন?!
আরেকবার এক ভাইয়ের বৌ মারা গেলেন হঠাৎ করে। বাচ্চাদের নিয়ে বেচারা হিমশিম খাচ্ছেন। ভাইয়ের বয়স খুব বেশী না। আমরা বললাম, কত বিধবা মেয়ে আছে যাদের কোন অভিভাবক নেই, তাদের একজনকে যদি উনি বিয়ে করেন তাহলে দু’জনেরই উপকার হতে পারে। স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলে অন্যজনের সব প্রয়োজন বা চাহিদা তো আর অদৃশ্য হয়ে যায়না! সংসার চালাতে হবে, সন্তানদের দেখাশোনা করতে হবে, কোনটা বাদ দেয়ার মত? একজনের জীবনাবসান হয়েছে বলে তো আরেকজন জীবিত মানুষের জীবনের ইতি টেনে দেয়া যায়না। এর মানে এই নয় যে তাদের সম্পর্কে কোন ঘাটতি ছিল। বরং কেউ যদি কারো ব্যাপারে সত্যিই ভাবে তাহলে সে চাইবে সে মারা গেলে যেন তার সঙ্গী জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ না হয়ে সুখী হয়। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা অনেকসময় ইসলামের তোয়াক্কা না করে চলতি প্রথা অনুসারে চিন্তা করেন। বিধবা বা মৃতদার বিয়ে করবেন এটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। আমার এক বন্ধু ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, “তারা (আত্মীয়স্বজনরা) বরং এ’টাই ভালো মনে করে যে যাদের স্বামী বা স্ত্রী মারা গেছেন তারা অবৈধ কিছু করুক, ওটা হয়ত লোকে দেখতে পাবেনা। কিন্তু বৈধ উপায়ে বিয়ে করলে যে লোকে ছি ছি করবে সেটা তারা কিছুতেই সহ্য করতে রাজী না”।
আমাদের সমাজে হয়ত অভাব, হয়ত লোভ থেকে এখন আরেকটা প্রথা প্রচলিত হয়েছে। বিয়ে করে বৌ রেখে বছরের পর বছর বিদেশ থাকা। কেউ টাকার জন্য, কেউ সিটিজেনশিপের জন্য, কেউ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য, কেউ পরিবারের প্রয়োজনে। আবার অনেকে বাড়ীতে বৌ রেখে শহরে পড়ে থাকেন মাসের পর মাস। অথচ আল্লাহ বলেছেন স্বামী স্ত্রী একজন আরেকজনের পরিচ্ছদস্বরূপ। পোশাক যেভাবে আমাদের শীতগ্রীষ্ম, রোদবৃষ্টি, পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে; আমাদের সৌন্দর্য বর্ধিত করে, অসৌন্দর্য ঢেকে রাখে- স্বামী স্ত্রী সেভাবেই একজন আরেকজনকে সাহায্য সহযোগিতা, আলাপ পরামর্শ, সাহস বা সান্তনা দিয়ে পরস্পরকে পরিপূরণ করবে। কিন্তু দু’জন যদি বছরের পর বছর পরস্পরকে না’ই দেখে, শুধু ফোনে কথা বলে আর আকাশপাতাল কল্পনা করে কি চরিত্র সংরক্ষণ করা যায়? এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সমাজে পরকীয়াসহ নানাধরণের বিশৃংখলা দেখা যাচ্ছে। মানুষ তাদের প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে, আবার এই অবৈধ কার্যকলাপ ঢাকতে গিয়ে আরো বড় পাপের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিদেশেও যে ভাইরা সবসময় নিরাপদ থাকেন, ব্যাপারটা তেমনও নয়। বিদেশের মাটিতে মানুষের মন প্রায়ই খারাপ থাকে, তখন প্রলোভন থেকে নিজেকে বিরত রাখা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই পা পিছলে পড়ে যান পংকিলতার পিচ্ছিল পথে। উমার (রা) মুসলিম সৈনিকদের জন্য প্রতি চারমাসে বাড়ী ফিরে আসা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন এই ধরণের সামাজিক বিপর্যয় রোধ করার জন্য। আমাদের ভাইদের ক’জন প্রতি চারমাস অন্তর স্ত্রীর সাথে সময় কাটাতে আসেন বা আসতে পারেন? পরিবারের প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অনেকেই নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা সাধ আহ্লাদ কোরবানী করে দেন বছরের পর বছর। কিন্তু তাদের আত্মীয়স্বজন মনে করেন, বিদেশে তো টাকা আকাশে বাতাসে ওড়ে, তার কাছে নিশ্চয়ই আরো টাকা আছে কিন্তু সে আমাদের দিচ্ছেনা। এই পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে আসা কঠিন বৈকি! আর দেশে যারা দূরে থেকে কাজ করেন তাদের স্ত্রীদের অনেক সময় বাবামা আসতে দেন না, হয়ত এই মনে করে যে তাহলে ছেলে আর বাড়ীতে টাকা পাঠাবে না! তাই দেশে থেকেও তারা চরিত্র সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত!
পারিবারিক বা সামাজিক প্রয়োজনে আজকাল আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মহিলা সংসারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও কাজ করছেন। কিন্তু আমাদের সামাজিক কাঠামো এখনো তাদের এই উভয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করার উপযোগী হয়ে ওঠেনি। কাজের লোকের সাহায্য ছাড়া সংসার চালানোর মত গৃহ, রান্নাঘর, গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানির ব্যাবস্থা, পারিবারিক কাঠামো, বাচ্চাদের জন্য সুব্যাবস্থা এখনো সুদূরপরাহত। অনেক মহিলারাই কাজ করেন পুরুষপরিবেষ্টিত পরিমন্ডলে যেখানে নারী বলেই তাদের প্রতি সৎমাসুলভ আচরণ করা হয়। অনেকেই সারাদিন এ’ধরণের কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে একটু শান্তির আশায় ঘরে ফেরেন। কিন্তু অধিকাংশ মহিলা যৌথ পরিবারে থাকেন বিধায় ঘরে ফিরেও পারিবারিক দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি মিলেনা। শ্বাশুড়ীকেন্দ্রিক পরিবারে শ্বাশুড়ী বিবেকবতী না হলে মহিলাদের ২৪ ঘন্টাই কাটে এক দুর্বিসহ পরিস্থিতিতে। তদুপরি স্বামীও যদি তাদের সময় বা সাহচর্য না দেন, যেটা যৌথ পরিবারে অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠেনা, তখন তাদের দিক হারানোর সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। এটা শুধু নারীদের ক্ষেত্রেই নয়, যে পুরুষ সারাদিন চাকরী করে বাড়ী ফিরে দেখেন বৌ শ্বশুর শ্বাশুড়ীর সেবায় নিয়োজিত সম্পূর্ণ সময়, তাঁর সাথে দু’দন্ড বসে কথা বলার সময় নেই স্ত্রীর, তিনিও একই ভাবে পথ হারাতে পারেন।
একবার ইউনিভার্সিটিতে এক ক্লাসে ছাত্রী কথাপ্রসঙ্গে বলছিল, “ম্যাডাম, আমি ইউনিভার্সিটি আসি বলে সবদিন সকালে বাসার সবার জন্য নাস্তা বানাতে পারিনা। তাই শ্বাশুড়ী আমাকে নাস্তা খেতে দেননা। আমি এখন পাঁচমাসের প্রেগ্ন্যান্ট। প্রতিদিন খালিপেটে ক্লাসে এসে বমি করি। বাসায় গিয়ে রান্না করতে পারলে খাবার জোটে নতুবা নয়। আমার শ্বাশুড়ীর যদি ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান থাকত তাহলে কি উনি এ’রকম করতে পারতেন?” সে প্রথমে যে বর্ণনা দিল তাতে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করল- যে মহিলা তার হবু নাতি বা নাতনীর মায়ের সাথে এমন আচরণ করছেন, তিনি কি ভাবছেন তিনি এই মেয়েটাকে প্রতিদিন কি বিপদের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন? নূন্যতম মানবতাবঞ্চিত এই মেয়েটা যদি কারো কাছ থেকে ন্যূনতম মানবিক ব্যাবহার পায়, তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে বা তার সাথে পালায়, তাকে কি খুব দোষ দেয়া যাবে? কি নিশ্চয়তা আছে যে এ’রকম মানসিক তোলপাড়ের মধ্যে সে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে? তার স্বামী কি ধরেই নিয়েছেন যে একটুকরা কাগজে দু’জনে সই করেছে বলে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সকলে এই মেয়েটাই সাথে এমন অমানবিক আচরণ করতে পারেবন অথচ সে তাদের প্রতি অনুরক্ত থাকতে বাধ্য?!
এক বন্ধুকে একবার বলেছিলাম, “ভাই আপনি এত ভালো মানুষ, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা পজিশনে চাকরী করেন, অথচ একটা মেয়েকে নিয়ে আপনাকে ঘুরতে দেখেছে অনেকেই। আপনি তাকে বিয়ে করুন বা বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। কিন্তু আপনি যা করছেন তা আপনিও জানেন অন্যায়, কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা আপনার মত একজন অসাধারন মানুষ যখন এই কাজটা করছেন তখন অন্যদের আমরা আর কিছু বলতে পারছিনা যাদের বলা প্রয়োজন”। উনি কিছুক্ষণ কিভাবে বুঝিয়ে বলবেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “আমাদের বাড়ীতে সব ভাইবোন পালিয়ে বিয়ে করেছে কারণ আমাদের বাবামা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ এবং তারা নানাধরনের বাহানা দিয়ে আমাদের সময়মত বিয়ের ব্যাবস্থা করেন না। আমি একটু আধটু ইসলাম বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তাতে লাভ হয়েছে এই যে আমি পালাইনি, বাবামা’র সব আকাঙ্ক্ষা পূরন করেছি, বাড়ী বানিয়ে দিয়েছি, বোনদের বিয়ে দিয়েছি, টাকাপয়সা দিচ্ছি প্রতিমাসে- কিন্তু তারা আমাকে বিয়ে করতে দিতে রাজী নন। যদি বিয়ের পর এভাবে ওদের জন্য খরচ করতে না পারি! আমার চল্লিশ হতে খুব একটা দেরী নেই। আর চল্লিশের পর আমার আর বিয়ে করার প্রয়োজনই নেই। কিন্তু বাবামাকে কে বোঝাবে? আমি এখন আমার ‘ভুলের’ মাসুল দিচ্ছি। দুনিয়াতেও গুনাহ কামাচ্ছি, আখেরাতেও এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
“এ’ তো গেল বাবামা’র কথা। যে মেয়ের আমাকে পছন্দ তাকে বললাম, চল আমরা ছোটখাট করে বিয়ে করে ফেলি। সে তখন বেঁকে বসল। কমপক্ষে দশভরি গহনা আর বড় অনুষ্ঠান না করলে সে বিয়েই করবেনা। আপনি তো গোল্ডের দাম জানেন নিশ্চয়ই। বলেন তো আরো কত বছর চাকরী করলে আমার দশ ভরি গোল্ড কেনার সামর্থ্য হবে?” ওনাকে বিচার করা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা। তাই চুপ করে রইলাম।
ছোটবেলায় এক ভদ্রমহিলার কথা শুনেছিলাম যিনি বোনকে তালাক দিইয়ে বোনের স্বামীকে বিয়ে করেছিলেন। বাংলাদেশে ফেরার পর এক পরিবারের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরে জানতে পারলাম এই সেই পরিবার যার কথা আবুধাবীতে বসে শুনেছিলাম। একদিন ওনার বাবার সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম বড় বোন স্বামীকে দিয়ে ছোটবোনের আনানেয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করাতেন। অথচ হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে এই সম্পর্কগুলো থেকে ততটাই সাবধানতা অবলম্বন করতে যেভাবে আগুন থেকে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করা হয়। যেহেতু এক্ষেত্রে পর্দা বজায় রাখা অনেক কঠিন, এখানে সাবধানতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় শ্যালিকা বা দেবরদের সাথে দুলাভাই ভাবীদের আজেবাজে দুষ্টুমী করতে, পাশে বসতে বা গায়ে হাত দিয়ে কথা বলতে! এই বিষয়ে কেউ কিছু বললে আমরা খুব রেগে যাই বা অপমানিত বোধ করি। আমরা মনে করি এই বিষয়ে এভাবে ভাবাটা নোংরা মানসিকতার পরিচায়ক। কিন্তু এই কথাটা আমাদের মাথায় খেলেনা যে আমরা সবাই মানুষ, তাই কেউ মানবীয় দুর্বলতার উর্ধ্বে নই। আপনজনদের নিরাপত্তার জন্য এক্ষেত্রে আমাদের আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরন করাটাই শ্রেয় কারণ সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন সৃষ্টবস্তুর গুনাগুন সম্পর্কে।
বিয়ে কেবল একটা মৌখিক সম্মতি, একটুকরো কাগজ, একটা সামাজিক অনুষ্ঠান- যতক্ষণ না উভয় ব্যাক্তি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং এই সম্পর্ককে স্থায়ী করার জন্য বুঝেশুনে অগ্রসর হয়। নাটক সিনেমা দেখে আমাদের একটা ধারণা হয়ে যায় যে বিয়ে হোল সব সমস্যার শেষ আর সুখের শুরু। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। ব্যাপারটা এমনও নয় যে দেখতে ভালো হলে, সুন্দর জামাকাপর গহনা মেকাপ পরে সেজেগুজে থাকলেই বিয়ে সুখের হয়। দু’জন মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা দুই পরিবেশ, দু’টো পৃথক পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে এসে “happily ever after” টিকে যাওয়া এতটা সহজ নয়। এর জন্য দু’জনকেই প্রতিদিন প্রতিটা মূহূর্ত চেষ্টা করতে হবে একে অপরকে বোঝার, পরস্পরের সুবিধা অসুবিধা রুচি পছন্দ জানার এবং তাকে সম্মান করার, পরস্পরের পরিবারকে আপন করে নেয়ার। দু’জনকেই সাহায্য করতে হবে একে অপরকে আলাপ আলোচনা সহযোগিতা করে। সবচেয়ে বড় কথা প্রেম সম্পর্কে নাটক সিনেমার বানোয়াট ধারণা ঝেড়ে ফেলে বুঝতে হবে সবার আগে এটা একটা খুব ভালো বন্ধুত্ব- যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সম্প্রীতি আর সম্মানের মজবুত ভিত্তির ওপর, যা পাকা চুল আর ঝুলে পড়া চামড়ায় পরিবর্তিত হয়ে যায়না।
No comments:
Post a Comment