Saturday, September 18, 2010

CRTP’র বন্ধুরা


সংকল্প করেছিলাম রোজায় কোথাও দাওয়াত খাবোনা, কাউকে দাওয়াত দেবোওনা। ভাবছেন কিপ্টা? হয়ত! এখানে রোজা শুরুর সময় ছিল প্রায় ১৮ ঘন্টা আর শেষের সময় প্রায় ১৬ ঘন্টা। মাত্র ছয়ঘন্টার ব্যাবধানে তিন ওয়াক্তের নামাজ, তারাবী, তাহাজ্জুদ, ইফতার, সেহরী, বাচ্চাদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, খাবার সামলে রাখা। সকালে উঠে সবাইকে স্কুলে পাঠানো, চাকরীতে পাঠানো আর চাকরীতে যাওয়া, এসে সেহরী আর ইফতারের জন্য রান্না করা। তারপর যদি মহিলারা একহাতে ঘর গোছানো, রান্না করা, বাচ্চা সামলানো নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন, যিনি দাওয়াত দেন তিনি তো নামাজ বাদ দিতে বা শর্টকাট করতে বাধ্য হবেন সন্দেহ নেই, যারা দাওয়াত খাবেন তাঁরাও এত অল্প সময়ের মধ্যে এত এত খেয়ে হজম করতে পারবেন না। এত দীর্ঘ সময় রোজা রেখে, সব কাজ সামলে ইফতারের পর অন্তত আধঘন্টা বিশ্রাম না নিলে সঠিকভাবে সব নামাজ পড়া মুশকিল হয়ে যায়। পড়লেও মন থাকে বিছানায়। তাই এই পরিকল্পনা।

প্রথম সংকল্প কৃতিত্বের সাথে পূরন করলাম। কিন্তু দ্বিতীয় সংকল্পে ব্যাঘাত ঘটলো পাত্রিসিওর উপর্যুপরি চিঠির কারণে। তিনি বৌ নিয়ে আমার বাসায় আসতে চাইছিলেন প্রায় একমাস ধরে। শেষমেশ ভাবলাম শেষের দশ রোজার আগেই তাঁকে দাওয়াত করে ফ্রি হয়ে যেতে হবে। বললাম ১৮ রোজায় আসতে। ইফতেখার ভাইকে ফোন করে বললাম, “আপনিও চলে আসেন, আপনারা গল্প করবেন, আমি আর হাফিজ সাহেব ততক্ষণে কাজ সামলে নেব”। ইফতেখার ভাই নিতান্ত ভদ্রলোক। বললেন, “আপা, আমিও একটা বা দু’টো ডিশ করে আনি। আপনার কাজ কমে যাবে”। ওনাদের আমার এজন্যই খুব ভালো লাগে। নির্দ্বিধায় সব বলা যায় ওঁদের। আমাদের মধ্যে মাইন্ড করাকরির কোন ব্যাপার নেই।

নির্দিষ্ট দিনে আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম আমাদের খাবার বিদেশী অতথিরা খেতে পারবেন কি’না। কিন্তু পাত্রিসিও আর ভাবীর খাওয়া দেখে বুঝলাম বাংলাদেশী খাবার ওঁদের খুব পছন্দ হয়েছে। হাফিজ সাহেব রসগোল্লা আর মিষ্টিদই বানিয়েছিলেন। বাংলাদেশী মিষ্টিও দেখলাম ওঁদের খুব পছন্দ হোল। ইফতেখার ভাই চিকেন ফ্রাই করে এনেছিলেন। আর আমরা চা খাইনা বলে ভাবী চায়ের সমস্ত সরঞ্জামাদি বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ওনার চা খেয়ে ওঁরা মুগ্ধ হয়ে চলে গেলেন। আরো কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে ইফতেখার ভাই আর ভাবীও বাসায় রওয়ানা দিলেন।

পাত্রিসিওর সাথে আমার বন্ধুত্বের সূচনা খুব মজার। CRTP র অরিয়েন্টেশনের সময় যখন সবাই পরিচয় দিচ্ছে দেশে থাকতে কে কি কাজ করত তখন রুমের মাঝামাঝি এসে ইফতেখার ভাই আর তানজীন বাংলাদেশী শুনেও আমার মন খারাপ হতে শুরু করল কারণ সব ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, অ্যাকাউন্টেন্ট ছিল। আমি ছাড়া আর একজনও শিক্ষক ছিলোনা। আমি ছিলাম রুমের এক কোণায়। পরিচিতিপর্ব অন্যপ্রান্তে অগ্রসর হতে হতে যখন আমি হতাশার দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছি তখন রুমের শেষপ্রান্তে পাত্রিসিও দাঁড়িয়ে বললেন উনি ইকুয়েডরে এক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। আমার কি যে খুশী লাগল! অন্তত একজন মানুষ পাওয়া গেল যিনি আমার প্রফেশনে ছিলেন। কিন্তু পরে যখন জানানো হোল আমাদের দুই সেকশনে ভাগ করে দেয়া হবে তখন ভাবলাম কি জানি কে কোথায় পড়ি!

যেদিন ক্লাস শুরু সেদিন গিয়ে দেখি অনেকের সাথে উনিও খুঁজছেন উনি কোন রুমে। তখন আমার ওনার চেহারা মনে আছে কিন্তু নাম ভুলে গেছি। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোন রুমে?” উনি বললেন, “খুঁজে পাচ্ছিনা”। বললাম, “আপনি কোন শিক্ষকের ক্লাসে?” উনি বললেন, “আমি জানিনা”। বললাম, “আপনার নাম বলুন”। উনি হেসে ফেললেন, “আমার নাম আমার মনে আছে!” দরজার বাইরে তালিকায় ওনার নাম দেখে ক্লাস বাতলে দিলাম। আমরা দু’জন একই ক্লাসে। আমাদের ক্লাসে তিনজন দক্ষিণ আমেরিকান পুরুষ ছিলেন। ভাগ্য ভালো দক্ষিণ আমেরিকান মহিলারা সব অন্য ক্লাসে ছিল। ওদের পুরুষরা ভীষণ ভদ্র আর মহিলারা পোশাক আশাকে ভীষণ উগ্র হয়। ক্লাসের তিন দক্ষিণ আমেরিকান- পাত্রিসিও, পাবলো আর ইগরের সাথে আমার খুব ভাব হয়ে গেল।

আমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্টের পার্টনার পড়ল পাত্রিসিও। আমাদের ডিবেট টিমেও আমি প্রথম প্রেসিডেন্ট আর উনি প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন; ইফতেখার ভাইও আমাদের টিমে পড়লেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম পাত্রিসিওর ছেলেরা ইউনিভার্সিটি শেষ করতে যাচ্ছে। মূলত তাদের সেটল করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই উনি ইউনিভার্সিটির চাকরী ছেড়ে ক্যানাডা এসেছেন। সে হিসেবে ওনার বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। কিন্তু ওনার কথাবার্তায়, চিন্তাচেতনায় কোন অহংকার নেই। ওনার সাথে চুক্তি হোল উনি আমাকে ওনার মাতৃভাষা স্প্যানিশ শেখাবেন আর আমি ওনাকে ইংরেজী ঝালাই করতে সাহায্য করব।

আমার দক্ষিণ আমেরিকার লোকজনের জন্য খুব মায়া লাগে। যখন স্পেনের পতনের ইতিহাস পড়লাম তখন জানলাম, যে ইসাবেলা আর ফার্ডিনান্ড কলাম্বাসকে অর্থায়ন করেছিল আমেরিকা (ভারতে যাবার বিকল্প পথ) আবিষ্কার করতে তারাই স্পেনের মুসলিমদের পরাজিত করেছিল, তারপর সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার আবাদ ঘটিয়েছিল। কিন্তু প্রথমেই ইসলাম থেকে বিচ্যূত এই নেতৃত্বহীন জনগোষ্ঠী পাদ্রীদের চাপে আর বিজয়ী রাজতন্ত্রের অত্যাচারে শেকড়বিহীন হয়ে পড়ল। এখন কেবল কয়েকটা ইসলামী নামের প্রচলন ছাড়া এই ক্যাথলিক জনগণের কোন ধারণাই নেই যে তাদের পূর্বপুরুষেরা মুসলিম ছিলেন। আমার দক্ষিণ আমেরিকান ক্যাথলিক প্রতিবেশী রোকসানা নিজেই বলে ওর নামের কারণে সবাই তাকে মুসলিম বলে ভুল করে, কিন্তু সে জানেনা এই নামের উৎস কি।

যাই হোক, একসপ্তাহ যেতে না যেতেই পাত্রিসিওর চাকরী হয়ে গেল। যেহেতু CRTP তে লোকে আসেই চাকরীর খোঁজে, ওনার অ্যাডমিশন ক্যান্সেল হয়ে গেল। সবার ইমেল আর ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে উনি চলে গেলেন। ক’দিন পর সবাইকে ইমেলে এই তালিকা সরবরাহ করে উনি আমার সাথে কৃত ওয়াদা পূরণ করলেন। তারপর থেকে মাঝেমধ্যে গণ-ইমেল করে উনি সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। একমাত্র আমার সাথেই ওনার আলাদা করে যোগাযোগ হত। কোন কাজে ডাউনটাউন এলে উনি আগে থেকে আমার সাথে সময় মিলিয়ে নিয়ে লাইব্রেরীতে দেখা করতেন যেহেতু লাইব্রেরী ছিল আমাদের কলেজের ঠিক উল্টোদিকেই। তেমন জরুরী কোন কথাবার্তা না, সবার খবর নিতেন, ওনার নিজের ব্যাবসায়িক কোম্পানীর স্বার্থে বাংলাদেশের সাথে ইকুয়েডরের কি ব্যাবসা হতে পারে খবর নিতেন, বৌছেলেদের কথা বলতেন।

উনি যাবার পরই প্রথম খেয়াল করলাম যে আমি ক্লাসের আর কারো সাথে তেমন একটা মিশছিলাম না। মূলত পলের আগ্রহের কারণেই নাইজেরিয়ার পল, তুরষ্কের হাসান আর ইগরের গ্রুপের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার। এরা তিনজনই ছিল ভীষণ ভদ্র আর হাসিখুশী। তানজীন অরিয়েন্টেশনের দিন লাঞ্চের সময় পরিচয়ের পর থেকে প্রায় সবসময়ই আমার সাথে সাথে থাকত। আর ইফতেখার ভাই আমার শ্বশুরবাড়ীর এলাকা থেকে। তাই এই দু’জনের সাথেও মিশে গেলাম। ক্লাসের চাইনীজ মেয়েরা- জেনী, লুসি আর ক্রিস্টি আমাকে ইংরেজীর শিক্ষক নিয়োগ দিল! জেনী কেন যেন আমাকে ভীষণ পছন্দ করত। লুসি এত হাসিখুশী ছিল যে ওকে দেখলেই যেকোন মানুষ ফুরফুরে বোধ করবে। ক্রিস্টি ছিল আবিবাহিতা, সাংঘাতিক পরিশ্রমী আর কিঞ্চিত পাগলাটে- কিন্তু ওকে ক্লাসের সবাই খুব আদর করতাম। একমাত্র চাইনীজ পুরুষ স্যাম ইংরেজীতে দুর্বলতার কারণে কারো সাথেই খুব একটা কথা বলতনা। কিন্তু ওর চেহারায় কেমন একটা যেন গ্রামীন ভাব আছে যেটা আমাদের খুব ভালো লাগত। আলজেরিয়ার সামীর আর আমি কেন যেন কখনো এক টেবিলে বা এক গ্রুপে কখনোই পড়িনি যদিও পরে বুঝলাম বেচারা ভীষণ লাজুক বলেই তাকে ক্লাসে খুব একটা চোখে পড়তনা। সে ছিল প্রশংসনীয় মেধার অধিকারী কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে তার ছিল ভীষণ অনীহা। বাকী রইলো ইরানের আফশীন আর ইন্ডিয়ার আফতাব। এ’ দু’জনের একজনকেও ক্লাসের কেউ খুব একটা পছন্দ করতনা।

আফশীন ইরানে এক বিরাট গাড়ী কোম্পানীতে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। শুধুমাত্র ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের কারণে উনি দেশ ছেড়ে ক্যানাডায় চলে এসেছেন। ওনার কথাবার্তা চেহারায় প্রখর বুদ্ধিমত্তার ছাপ। আমার মেধাবী লোকজনের প্রতি বরাবরই দুর্বলতা। তাই আফশীনের সাথে বলতে গেলে সেধে সেধে বন্ধুত্ব করলাম। ওনার বয়স পাত্রিসিওর চাইতেও বেশী। কিন্তু জানার প্রতি, শেখার প্রতি ওনার অশেষ আগ্রহ আমাকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দিত। উনি প্রচন্ড ইসলামবিরোধী লোক বলে আমাদের এই বন্ধুত্বের কেউ আগামাথা বুঝতে পারতনা। পাশের ক্লাসের পাকিস্তানীরা আমাকে জিজ্ঞেস করত, “তোমাকে দেখে তো ইসলামিক মনে হয়, আফশীনের সাথে তোমার এত কিসের বন্ধুত্ব?” আমি কাউকে বোঝাতে পারতাম না যে উনি আর আমি সম্পূর্ণ উলটো মতামতের মানুষ হতে পারি কিন্তু ওনার জ্ঞানান্বেষাকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং আমার সাথে একমত না হয়েও আমার ইসলামপ্রীতিকে উনি সম্মান করেন। পরবর্তীতে ক্লাসের প্রায় সব বড় বড় প্রজেক্টে কিভাবে যেন আফশীন আর আমি একই গ্রুপে পড়তে শুরু করলাম। ওনার সাথে কাজ করার একটা মজা ছিল আমার মতই উনি নিজ দায়িত্বে অধিকাংশ কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। বয়জ্যেষ্ঠ হয়েও ওনার মধ্যে খবরদারী বা মাতব্বরীর কোন অভ্যাস ছিলোনা। গ্রুপের অন্যদের সাথে কো-অর্ডিনেশনের ব্যাপারেও উনি শুধু আমি ছাড়া আর কারো থেকেই পিছিয়ে ছিলেন না। অন্য গ্রুপে ইফতেখার ভাই ছিলেন বিশেষ উৎসাহী। ওনার আর আমার কো-অর্ডিনেশনে সমস্যা না থাকায় আমাদের ক্লাসটা ছিল ভীষণ বুন্ধুত্বপূর্ণ, হাসিখুশী আর প্রাণচঞ্চল।


কিন্তু সবকিছু তো আর মানুষ নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা! আমাদের ক্লাসের আফতাব ছিল একটা অদ্ভুত চিজ। তার নিজের ব্যাপারে তার ধারণা ছিল আকাশছোঁয়া। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আর কারোর তার ব্যাপারে এর কাছাকাছিও ধারণা ছিলোনা। নিজেকে প্রচার করার জন্য সে সারাক্ষণ উন্মুখ থাকত। তাই সে যখন পরিকল্পনা করল দুঃস্থদের সহযোগিতার জন্য ক্যালগেরীতে যে ক্যাম্পেন চলছে তাতে সে অংশগ্রহন করবে, আমাদের ক্লাসের কেউ সাড়া দিলোনা। কি মনে করে জানিনা সে আমাকে ধরল এতে অংশগ্রহন করার জন্য। আফতাবের জন্য নয়, দুঃস্থ মানুষের কথা শুনে আমি রাজী হলাম। আমাদের এবং পাশের ক্লাসের বন্ধুরা সবাই যে যার সামর্থ্যমত সাড়া দিলেন। আফতাব, আমি আর ক্লাসের বাকীদের যখন যে সময় দিতে পারল- আমরা তিন তিনবার গিয়ে সব জিনিসপত্র কেনাকাটা করলাম। ক্যাম্পেনের দায়িত্বশীল জিনিসপত্র নিতে এসে ত্রানের পরিমাণ দেখে হতবাক হয়ে গেলেন কারণ এগুলো সব তাদের দেয়া যাদের নিজেদেরই চাকরী নেই। কিন্তু ত্রানসামগ্রী বুঝিয়ে দেয়ার সময় আফতাব ক্লাসের আর কারো কথা উল্লেখ করলনা। পরে যখন ছবি তোলার সময় প্যাটের উৎসাহে সবাই দাঁড়ালো ব্যাপারটা ওর পছন্দ হোলনা। আমার যে চেহারা, আমি তো এমনিতেই ছবি তুলিনা, আর সেদিন শরীর খুব একটা ভালো লাগছিলোনা তাই আমি ছবিতে অংশগ্রহন করলাম না। কিন্তু তাতে লাভ হোল এই যে, আফতাবকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য সময় পেলাম। মানুষের এই লোভী এবং স্বার্থপর রূপ আমাকে বরাবরই ভীষণ পীড়া দেয়। অসুস্থ শরীরে এই নোংরামী সহ্য করতে না পেরে সেই একদিনই আমি তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে চলে গেছিলাম।

বাসায় যাবার জন্য স্টেশনে যাব, ঠিক এ’সময় পল ফোন করল আমি যেন অফিসে যাই, খুব জরুরী প্রয়োজন। গিয়ে দেখি পল, হাসান আর ইগর মিলে এক পা ভাঙ্গা কবুতরের পা ঠিক করার জন্য সাহায্য চাইছে। জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও কবুতরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এ’ঘটনায় আমার আবার মানুষের ওপর আস্থা ফিরে এলো।

পরবর্তীতে আফতাবের হিংসা আর অহংকারে ক্লাসের সবাই অস্থির হয়ে উঠলো। বিশেষ করে একবার পল আর আমার প্রেজেন্টেশনের পর শিক্ষক প্যাট প্রশংসা করায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে শিক্ষক ছাত্র সবার সামনে আমাদের প্রেজেন্টেশনের এমনভাবে সমালোচনা করল যে সবাই বিরক্ত হয়ে বলতে লাগল এর কোন ভিত্তি নেই। আমি খুব শক্ত মানুষ তাই এসব ছোটলোকামী পাত্তা দিলামনা। কিন্তু পল বেচারার মনটা বাচ্চাদের মত নরম। সে পারলে কেঁদেই ফেলে। ওর অবস্থা দেখে ইফতেখার ভাই সেদিন একটা কাজের বাহানায় পল, আমি আর তানজীনকে ক্লাসের পর আরবী রেস্টুরেন্টে খাওয়ালেন। ওনার এই সহানুভূতি আমাদের ভীষণ স্পর্শ করল।

কয়েকমাস পর আমাদের কোর্স শেষ হওয়া উপলক্ষ্যে ইফতেখার ভাই আর আমি ক্লাসের সবাইকে আবার একত্রিত করে পাশের ক্লাস, শিক্ষক, কর্মচারী সবাইকে খাওয়ানোর ব্যাবস্থা করলাম। ক্যানাডিয়ানরা দু’জনে একসাথে কফি খেতে যায় সেও যে যার পয়সায়। তাই ওরা এই ধরণের আতিথেয়তায় যারপরনাই আনন্দিত হোল। সেদিনই আমরা শেষবারের মত সবাই একত্রিত হলাম। সবার খাওয়া শেষে যখন ইফতেখার ভাই, আমি আর পল খাবার নিতে গেলাম তখন হঠাৎ আফতাবকে দেখে খেয়াল হোল, তাইত, সবাই আফতাব সামনে থাকা অবস্থায়ই তার অস্তিত্ব ভুলে গেছিল! ওর প্রতি সকল বিতৃষ্ণা দূর হয়ে গেল আমার। এই ধরণের মানুষগুলো শেষপর্যন্ত কারো কাছেই কিছু পায়না। তাদের মত দুঃখী আর কে আছে? তাদের প্রতি রাগ রেখে কি লাভ?

আজ একবছর পর ইফতেখার ভাই আর তানজীনের সাথে আমার রেগুলার যোগাযোগ হয়। আমরা কিছুদিন পর পর একত্রিত হই যেমন এবারের ঈদে সবাই ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় একত্রিত হলাম। পল, হাসান আর ইগরের সাথে ফোনে বা ইমেলে কথা হয়। পল আমাকে এখনো “‘ইউর ফ্রেন্ড’ আফতাব কেমন আছে?” বলে ক্ষেপায়। লুসি আর জেনী ফোন করে সবসময়। ওদের কাছে ক্রিস্টির খবর পাই। বেচারী লেখাপড়া করতে করতে ওর আর অবস্থা নাই! এমনকি আমাদের লাজুক চাইনীজ বন্ধু স্যাম আর আলজেরিয়ার সামীরও ইমেল বা নেটে চ্যাট করে। আফশীন চাকরী পেয়ে অন্য প্রভিন্সে চলে গিয়েছেন। কিন্তু গিয়েই দাওয়াত করলেন ওখানে বেড়াতে গেলে ওনার বাসায় থাকার। আমাদের সত্তরোর্ধ পাবলো মেল করে জানালেন চিলির ভূমিকম্পে ওনার ঘরবাড়ী অক্ষত আছে, উনি ভালো আছেন। পাশের ক্লাসের লোকজনেরও খবরাখবর পাই, মাঝেমাঝে যোগাযোগও হয়। শেষে পাত্রিসিও পর্যন্ত বেড়াতে এলেন। কিন্তু আফতাব … সে আমাদের মধ্যে থেকেও আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল!



1 comment:

  1. অসাধারণ লেখা, অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
    এত্তো বড় লেখাটা কিভাবে যে শেষ হয়ে গেলো বুঝলামনা, সত্যিই দারুণ অভিজ্ঞতা!!
    বিদেশী ফ্রেন্ডদের আমার এজন্যই ভালো লাগে কারণ ওদের মধ্যে গর্ব-অহংকার-পণ্ডিতগিরি এসব অভ্যাস নেই, সবার সাথে মিলেমিশে হাসিমুখে কাজ করে এবং ওদের এ গুণটাই আমি এখন সবচাইতে বেশি শেখার চেষ্টা করি।

    ReplyDelete