Tuesday, June 25, 2013

প্রেম ২

‘আপু, একটা বিষয়ে আপনার পরামর্শ চাচ্ছিলাম’।
‘বল’।
‘হয়েছে কি, আমি একটা মেয়েকে পড়াই। মেয়েটার বাবামা খুব বিশ্বাস করে আমাকে এই দায়িত্বটি দিয়েছেন। মেয়েটির স্বভাব চরিত্র অত্যন্ত ভাল। আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছি। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই’।
‘ছাত্রীদের বিয়ে করা কোন ভাল কথা নয়, এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। শিক্ষক যে বয়সেরই হোক না কেন তাঁকে আমি সবসময়ই পিতৃসম সম্মানার্হ মনে করি। শিক্ষকরা যদি ছাত্রীদের দিকে নজর দেয়া শুরু করেন তাহলে তো সমাজে বিশ্বাসের কোন মূল্য থাকবেনা। তবু যদি তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও তাহলে তোমার অবিলম্বে কথা বলা উচিত’।
‘তাহলে কি আমি ওকে প্রপোজ করব?’
‘কাকে?!’
‘মেয়েটিকে’।
এবার সত্যি সত্যি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
‘মেয়েটিকে কেন প্রপোজ করবে? মেয়েটিকে কি প্রপোজ করবে?!’
‘বলব তাকে আমার ভাল লাগে, আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। এই উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে কিছুদিন ঘুরাঘুরি করে, তার সাথে কথা বলে দেখতে চাই আমাদের কতটুকু বনবে’।
‘বাবারে! এই নিয়ম কোথায় পেলে ভাই? ইসলামের নিয়ম হোল তোমার কাউকে পছন্দ হলে তার বাবা, ভাই বা যিনি অভিভাবক তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ওরা তোমার সাথে কথা বলে, তোমার এবং তোমার পরিবারের সম্পর্কে খোঁজখবর করে বিবেচনা করে অতঃপর মেয়েকে জানাবেন। তারপর মেয়ের পছন্দ হলে বিয়ে হবে। তারপর তোমরা সারাজীবন ঘুরে ঘুরে প্রেম করতে পারো, দিনরাত কথাবার্তা বলতে পারো মনের সুখে। বিয়ের আগেই কেন সব করে ফেলতে চাও?’  
‘বিয়ের পর না বনলে?’
‘বিয়ের আগে কারো সাথে যতই ঘোরাফেরা কর না কেন তোমাদের উভয়ের উদ্দেশ্য থাকবে পরস্পরকে ইমপ্রেস করা। ক’দিন সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় পরে দামী দামী রেস্টুরেন্টে বসে কটা শানিত বুদ্ধিদীপ্ত কথা বললে কি বোঝা যায় সেই মানুষটা কিভাবে রি-অ্যাক্ট করবে যখন তোমার সাথে সংসার করতে গিয়ে তোমার দামী শার্টের নীচে গেঞ্জির বিশাল ফুটোটা ওর চোখে পড়বে, কিংবা যখন ঘরে চিনি ফুরিয়ে গেলে আবার কেনার জন্য পরবর্তী বেতনের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে, কিংবা সে বুঝতে পারবে তুমি একটা বাল্ব পর্যন্ত মিস্ত্রীর সাহায্য ছাড়া নিজে বদলাতে জানোনা? কিন্তু যে মেয়েটা তোমার বৌ হয়ে আসবে সে তোমার ভালমন্দ সবটুকু গ্রহন করার মানসিকতা নিয়েই আসবে। তাকে ইমপ্রেস করার জন্য তোমার প্রতিনিয়ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবেনা। বরং তোমার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তার সন্তুষ্টির কারণ হবে, তোমার বৃহৎ বৃহৎ ভুলগুলোও সে নিজ চেষ্টায় শুধরে নেবে যেহেতু সে তোমাকে জীবনের একমাত্র অপশন মনে করে’।
‘কিন্তু আপু, তারপরও তো অনেকের বিবাহবিচ্ছেদ হয়’।
‘হুমম, তা হয়। হবেনা কেন? দু’জন মানুষ সম্পূর্ন ভিন্ন দু’টি পরিবার এবং পরিবেশ থেকে এসে একসাথে মিলে যাওয়া কি এতই সহজ? দু’জনের মাঝেই প্রয়োজন ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সংবেদনশীলতা এবং অপর ব্যাক্তিটির প্রতি বিশ্বাস ও সহমর্মিতা। আবার ধর, একটি ছেলে বা মেয়ে যে বিয়ের আগেই অনেককে পরখ করে নিয়েছে, সে তার পার্টনারের মাঝে সেই সকল গুন খুঁজবে কিংবা তাকে তাদের সাথে তুলনা করবে অবচেতনেই। তখন বর্তমান পার্টনারের গুনগুলো তার যতটা না চোখে পড়বে বরং তার ঘাটতিগুলোই তার কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। তখন বিচ্ছেদ হবে বৈকি! কিন্তু কি জানো?’
‘কি?’
‘সামাজিকভাবে বিবাহিতা একটি মেয়ের যদি বিচ্ছেদ হয়ে যায় তবে তার পরিবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, আবার বিয়ে দেয় কিংবা প্রয়োজন হলে আজীবন তার দেখাশোনা করে কিংবা অন্তত তার বিপদ আপদে পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বিয়ের আগে তুমি যদি একটি মেয়ের সঙ্গ উপভোগ করে অতঃপর বনবেনা ভেবে ফিরিয়ে দাও সে পরিবার পরিজন বন্ধুবান্ধব কারো কাছে সহানুভূতি বা সহায়তা পাবেনা, তদুপরি মেয়েটিকে বিয়ে দেয়াও মুশকিল হয়ে যাবে। তুমি যদি কাউকে সত্যিই ভালোবাসো তাহলে তার দায়িত্ব নিতে বা দায়িত্ব নেয়ার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তোমার আপত্তি কোথায়? এ’ কেমন প্রেম যেখানে শুধু ভোগ আছে অথচ ত্যাগ নেই?’
‘কিন্তু আমি তো তাকে বিয়ে করতে চাই!’
‘কিন্তু করবে কি’না তা নিশ্চিত নও’।
‘আমার উদ্দেশ্যটা তো তাই’।
‘ভাইরে, শোন। প্রবাদে যাই বলুক না কেন, the end does NOT justify the means. এই যে সমাজে প্রেমের নামে এত বিশৃংখলা আর কষ্টের ছড়াছড়ি – নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে ধর্ষন, নিজের চাহিদায় লাগাম দিতে না পেরে অনাকঙ্খিতভাবে সন্তানধারণ, প্রেমে ব্যার্থ হয়ে আত্মহত্যা, বিয়ের পর প্রাক্তন প্রেমিক প্রেমিকার প্রতি আবেগ উথলে ওঠার কারণে বর্তমান সম্পর্কের প্রতি অমনোযোগী হয়ে সংসারে অশান্তি – এখানে কোনটার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল ভাই? কিন্তু এখানে end বা means কোনটি justify করা যায়? আমাদের নিজেদের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণের মাত্রা সম্পর্কেও তো কোন ভুল ধারণা থাকা উচিত না। আমাদের ভেতর থেকে নাফস এবং বাইরে থেকে চিরশত্রু ইবলিস সারাক্ষণ ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের সূঁচ পরিমাণ ছাড় দিলে তারা কোদাল দিয়ে আমাদের কবরের মাটি খুঁড়তে থাকে’।
‘এভাবে তো ভাবা হয়নি!’
‘এখন ভাবো। তুমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসো সে তো হবে তোমার সম্মানের পাত্রী যার প্রতি তোমার কল্পনাগুলোও হবে পবিত্র এবং সংযত, সেখানে তোমার আচরনে যদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় তাতে কি ভালোবাসার সম্মান রক্ষা হয় ভাই? বিয়ের পর সে হবে তোমার দূর্গ যেখানে তুমি শয়তানের কবল থেকে আশ্রয় খুঁজে পাবে। কিন্তু সেই দূর্গের দ্বার যদি তুমি আজ নিজ হাতে ভেঙ্গে ফেল তাহলে সেই দূর্গের ওপর কি তুমি কোনদিন আর আস্থা রাখতে পারবে?’
অনেকক্ষণ ভাবল সে।
‘ঠিক বলেছেন আপু। তখন আমার কেবল মনে হবে আমার আগে সে কার কার সাথে মিশেছে, ওদের সাথে ওর কতটুকু ভাব ছিল, কাউকে ওর আমার চেয়ে বেশি পছন্দ ছিল কিনা। আমি তার জীবনে একমাত্র পুরুষ হতে চাই। কিন্তু সত্যিই যদি আমি তাই হই তবু আমার মনে হবে সে আমার মন ভোলানোর জন্য এমন বলছে, নিশ্চয়ই সে যেমন আমার সাথে মিশেছে তেমনি অন্য কারো সাথেও মিশে থাকবে’।
‘তাহলে কেন জেনেশুনে একটি সহজসরল মেয়েকে এমন পথে পরিচালিত করতে চাও ভাই যেখানে তার জীবনটা সাজাতে গিয়ে জীবনটা শেষও করে ফেলতে পারো তুমি? তার চেয়ে তুমি ওর বাবার সাথে কথা বল। তুমি বলেছ তিনি তোমাকে বিশ্বাস করেন। তিনিও খুশি হবেন যে তুমি তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছ, তিনিই তখন মেয়েটিকে তোমার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট হবেন। তুমি তোমার লক্ষ্যে উপনীত হবে নির্ঝঞ্ঝাটে এবং মেয়েটিরও সম্মানের কোন ক্ষতি হবেনা’।
‘কিন্তু আপু, ধরেন আমি প্রস্তাব করলাম কিন্তু ওরা রাজী হলেন না?’
‘শোন ভাই, তুমি কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস কর?’
‘অবশ্যই’।
‘তুমি কি বিশ্বাস কর যে তিনি তোমাকে এবং তোমার লাইফ পার্টনারকে জোড়া মিলিয়ে সৃষ্টি করেছেন?’
‘জ্বী’।
‘তাহলে বিশ্বাস রাখো, এই মেয়েটি যদি তোমার নির্ধারিত লাইফ পার্টনার হয় তাহলে সে তোমার কাছেই আসবে। তা নইলে তোমার সততা এবং উত্তম নিয়াতের জন্য আল্লাহ তোমাকে এর চেয়ে ভাল লাইফ পার্টনার দান করবেন’।
‘আমার যদি অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ না হয়?’
‘তুমি যদি একজনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখো তাহলে অন্যের দিকে তাকাবে কি করে? তাকে যাচাই করবেই বা কিভাবে? কিন্তু তুমি যদি সাদা মন নিয়ে তার কাছে যাও, তাকে সুযোগ দাও, তাহলে সে তোমার মনের সাদা ক্যানভাসে রঙিন তুলি দিয়ে ছবি আঁকবে, তুমি বুঝতে পারবে তুমি যা চেয়েছিলে তার তুলনায় তুমি কত বেশি পেয়েছ। নইলে তুমি অন্য কারো লাইফ পার্টনারকে নিজের করে নেয়ার প্রচেষ্টায় কি পেয়েছ তা অ্যাপ্রিশিয়েট করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে’।
‘হুমম’।
‘এবার একটু ভেবে দেখ তো তোমার লাইফ পার্টনার নিয়ে অন্য কেউ টানাটানি করছে এমনটা কল্পনা করতে তোমার কেমন লাগছে?’
কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল, ‘ভীষণ খারাপ লাগছে আপু। আমি ভাবতেই পারছিনা। কিন্তু আমি কি করে বুঝব যে আসলেই আমার লাইফ পার্টনার আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে আমি তার কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত?’
‘একটাই উপায় আছে ভাই। যিনি সর্বস্রষ্টা এবং সর্বদ্রষ্টা তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হবে যেন আমাদের পছন্দের মানুষটি নিজেকে সংরক্ষণ করে কেবল আমাদের জন্যই। সাথে নিজেকেও এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যেন আমি তাকে গিয়ে বলতে পারি, ‘এই যে দেখ, আমার সবটুকু আমি বাঁচিয়ে রেখেছি কেবল তোমার জন্য। এর কোথাও কখনো তোমার ছাড়া আর কারো অধিকার ছিলোনা, আজ থেকে আমার সবকিছুর ওপর তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোল’। কি, বল? এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারবে তো?’
লাজুক হেসে ভাইটি বলে, ‘জ্বী আপু, এটুকু যে আমাকে পারতেই হবে!’
আসলে আমরা সবাই সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই কাজ করতে চাই, কিন্তু অনেকসময় লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং পন্থা মিলাতে পারিনা। এত সীমিত বুদ্ধি এবং ক্ষমতা নিয়ে আমাদের এমন অনিশ্চিত পথে যাত্রা করার চেয়ে যিনি সর্বজ্ঞানী তাঁর জ্ঞানের ওপর ভরসা রেখে তাঁর নির্দেশিত পন্থায় পথ চলাই শ্রেয় নয় কি?
 

Monday, June 24, 2013

প্রেম ১

আমার এক ক্যানাডিয়ান সহকর্মী আলাপ করছিল, ওর বাবামার যখন বিয়ে হয় তখন ওর মায়ের বয়স আঠারো আর বাবার বয়স বিশ। বিয়ের তিনমাসের মাথায় ওর বড়বোনের জন্ম। বোঝাই যায় বিয়েটা ছিল সামাজিকতা রক্ষার তাগিদে, সুখের টানে নয়। বিয়ের পর ওর বাবা সংসারের দায়িত্বের চাপে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ব্যার্থ হয়, ওর মা পড়াশোনা করে উকিল হন। এক পর্যায়ে এই শিক্ষিতা, স্মার্ট এবং মোটা টাকা উপার্জনকারী মহিলার এই অশিক্ষিত এবং স্বল্প উপার্জনকারী স্বামীকে নিজের সাথে বড় বেমানান মনে হতে থাকে। বিয়ের একুশ বছর পর স্ত্রী এক পুরুষকে এবং স্বামী আরেক মহিলাকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান। আমার সহকর্মী মেয়েটির বয়স তখন সতেরো। সতেরো বছর বয়সে সে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। এ’সময় থেকে সে অসহায়ত্ব এবং একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে এক বয়ফ্রেন্ড থেকে আরেক বয়ফ্রেন্ডের আশ্রয় নিতে থাকে। তবে গত বারো বছর যাবত সে একজনের সাথে বসবাস করছে। আমার চাইনিজ বান্ধবী জেইন বলল, ‘তুমি তাকে বিয়ে করলেই পারো’। সে বলে, ‘পাগল! আমার মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাবার পর আমি কিছুদিন জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি পারিবারিক আইন অফিসে কাজ করেছি। সেখানে আমার বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে এমন সব ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে যে আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই আমি কোনদিন বিয়ে করবনা’। ওর বড়বোনের বিয়ে হোল মাত্র ক’দিন আগে। বিবাহভীতি কাটিয়ে উঠতে উঠতে তাঁর বেয়াল্লিশ বছর বয়স হয়ে যায়। এখন তিনি বিবাহিত হলেও সন্তানধারনে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। আমার সহকর্মীরও সন্তান নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এমন উপাখ্যান এখানকার ঘরে ঘরে। সচেতন বাবামায়েরা সন্তানদের চার্চে নিয়ে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করান তারা বিয়ের আগে পর্যন্ত কুমারী থাকবে যেন বুঝেশুনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার অবকাশ থাকে এবং এমন দুঃখজনক পরিণতি এড়ানো যায়। কিন্তু প্রচলিত সমাজব্যাবস্থা এবং দৃঢ় নৈতিক বন্ধনের অভাবের কারণে অনেকেই এই প্রতিজ্ঞা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনা। ফলে ভুগতে হয় সারাজীবন।

 

প্রেম একটি অসাধারন এবং মোহময় অনুভূতি। সেদিন দেখলাম এক বুড়ো দাদা যিনি নিজেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে একহাতে তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রীকে শক্ত করে ধরে আরেক হাত মাথার ওপর দিয়ে অতি সাবধানে গাড়ীতে বসিয়ে দিচ্ছেন যেন তিনি পিঠে ব্যাথা না পান, আবার পিঠ সোজা রাখতে গিয়ে মাথায় বাড়ি না খানএকইভাবে আমরা যখন গর্ভবতী স্ত্রীর পাশে চিন্তাক্লিষ্ট স্বামীটিকে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে দেখি কিংবা সুন্দরী হবু স্ত্রীর দিকে তাকাতে গিয়েও যুবকটিকে চোখে নামিয়ে নিতে দেখি তাতে যে ভালোবাসা প্রকাশ পায় তা যেকোন হৃদয়কেই আপ্লুত করে।

 

কিন্তু প্রেমের সবটুকুই দৃষ্টিনন্দন নয়। এর একটি পাশবিক দিকও আছে যেটি বন্ধ দরজার আড়ালেই পরিতৃপ্ত করা শ্রেয়। যেমন ক’দিন আগে কাজে যাবার পথে দেখি এক ট্রেন মানুষের সামনে, যেখানে কয়েকমাসের শিশু থেকে কয়েক দশকের বৃদ্ধরাও আছেন, দু’জন যুবক যুবতী নিজেদের একটিমাত্র জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে শারীরিক প্রয়োজন পূরণ করছে! ঘটনাটি এতটাই পশুপ্রবৃত্তি প্রকাশক ছিল যে দৃশ্যটি এমনকি কোন নিম্নতর রুচির মানুষের কাছেও উপভোগ্য ছিলোনা বরং সবাই হতভম্ব এবং বিরক্ত হলেও এই ব্যাপারে আইনত কারো কিছু করার নেই বলেই কেউ বাঁধা দিতে পারছিলোনা। ভাবছিলাম, এরা কি করে পারে দাদাদাদীর বয়সী লোকজনের সামনে এত নির্লজ্জ হতে? কিন্তু ব্যাপারটা আসলে সহজবোধ্য।

 

মানুষের বংশরক্ষার তাগিদেই সৃষ্টিকর্তা এই জৈবিক তাড়না মানুষের মাঝে দিয়ে দিয়েছেন নইলে কে সেধে স্ত্রীপুত্রকন্যার দায়িত্ব মাথায় নিত? কেইবা বুঝেশুনে সারাজীবন ধরে এতগুলো মানুষের জন্য প্রতিবেলা রান্না করা, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিস্কার করার কাজ করত? এটি ক্ষুধা কিংবা তৃষ্ণার চেয়ে অধিক বা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। তবে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে, সমস্ত সৃষ্টিকুল হতে স্বতন্ত্র এবং বিশেষায়িত করেপ্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারে আমরা এই পার্থক্য দেখতে পাই। যেমন পশুদের মাঝে পুরুষ প্রানী অধিকতর সুন্দর, মানুষের মাঝে নারী; বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেছেন পশুরা বাঁহাতি কিন্তু মানুষকে তাদের প্রভু বলে দিয়েছেন ডানহাতে অধিকাংশ কাজ করতে; পশুরা কাঁচা খাবার খায় আর মানুষ খায় সেদ্ধ করে। একইভাবে পশুরা বাড়ীঘর না থাকায় সর্বসমক্ষে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে বাধ্য হলেও মানুষকে বলা হয়েছে এর জন্য বিশেষ পন্থা এবং পদ্ধতি অবলম্বন করতে যেন এর মাধ্যমে যে জীবন পৃথিবীতে আগমন করবে তা বেড়ে ওঠার একটি সুস্থ এবং সুষ্ঠু পরিবেশ পায়

 

এই প্রক্রিয়াকে সহজ এবং স্বাভাবিক করার জন্যই সৃষ্টিকর্তা নির্দেশ দিয়েছেন নিজেকে সর্বসমক্ষে কামনার বস্তুরূপে উপস্থাপন না করে নিজের আকর্ষনী শক্তিকে আড়াল করে রাখতে। চাহিদার সৃষ্টি দৃষ্টি থেকে। আমরা যদি না জানি বাসায় মিষ্টি আছে, আমাদের মিষ্টি না খেলেও দিব্যি দিন কেটে যায়। কিন্তু টেবিলের ওপর মিষ্টি আছে অথচ আমি খাবনা তা কি হয়? যদি বলেন, ‘তোমার ডায়াবেটিস, খেলে ক্ষতি হবে’, উত্তর আসবে, ‘আরে ডাক্তার কি জানে? আগে তো খেয়ে নেই, তারপর দেখা যাবে যা হবার হবে!’ একটি মেয়ের সৌন্দর্য যদি কেউ না দেখে তাহলে কেউ জানবেনা মেয়েটি কতটা আকর্ষনীয় এবং তার সবটুকু আবেদন সংরক্ষিত হবে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিটির জন্য। আবার যে মেয়েটির পুরুষদের সাথে মেলামেশা স্বল্প পরিসরে সে স্বামীর প্রতিটি সদ্গুনকেই অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারবে। কিন্তু যে মেয়েটি বহু পুরুষের সাথে মিশে অভ্যস্ত সে বিয়ের পর প্রতিটি মূহূর্ত মনে মনে তুলনা করবে আমার স্বামী দেখতে অমুকের মত সুন্দর না, তমুকের মত সুন্দর করে কথাবার্তা বলতে জানেনা, অমুকের মত গাইতে জানেনা, তমুকের মত স্মার্ট নয়, অমুকের মত বিত্তশালী নয় কিংবা তমুকের মত শক্তিশালী নয় - তখন মনের আক্ষেপ দূর করে সেই লোককে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা কঠিন ব্যাপার বৈকি!

 

যার আকর্ষনী শক্তি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত সে নিজেও ভুলের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। একটি প্রজাপতি উড়ে এলে তার সৌন্দর্য যাচাই বাছাই কিংবা পরখ করে নেয়া যায়, কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল উড়ে এলে আর বাছাই করার সুযোগ থাকেনা। প্রজাপতিকে মানুষ যত্ন করে ঘরের দেয়ালে বসতে দেয় কিন্তু কারো ঘরে পঙ্গপাল প্রবেশ করবে তা মানুষ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। নিজেকে প্রদর্শনীতে দিয়ে সাড়া পেলে প্রথম প্রথম সবারই ভাল লাগে। কিন্তু তারপর যখন ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল এসে চারিদিকে ঘিরে ফেলে তখন আর সামাল দিয়ে ওঠা যায়না। তাই এদের জৈবিক তাড়না চরিতার্থ করার কোন নির্দিষ্ট স্থান থাকেনা, কোন বৈধ পন্থাও থাকেনা যেহেতু এরা কেবল ভোগ করতে চায় কিন্তু দায়িত্ব নিতে চায়না। এই চাহিদাপূরনের ফলাফল হিসেবে যে সন্তানের জন্ম হয় তারও কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা গড়ে ওঠেনা কারণ সে কেবল একটি জৈবিক প্রক্রিয়ায় ফলাফল, কাঙ্খিত নয় মোটেই। অথচ এই পৃথিবীতে আসার পেছনে বেচারার না হাত ছিল, না ছিল ইচ্ছাশুরু হয় আরেকটি কষ্টের উপাখ্যান

 

খুব কম মানুষের বোধের আয়নায় এই সত্য প্রতিফলিত হয় যে প্রেম কেবল জৈবিক তাড়নার বহিঃপ্রকাশ নয় বরং একটি পবিত্র মানসিক বন্ধন এই বন্ধনকে মজবুত করার জন্য একে একটি সামাজিক রূপ দেয়া জরুরী যাতে উভয়পক্ষের সামাজিক নিরাপত্তা এবং অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান হয়। তাই প্রেমের সৃষ্টিকর্তা প্রনীত এবং সবচেয়ে শ্বাশ্বত রূপ বিয়ে। এর অর্থ এই নয় যে বিয়ে করলে কোন সমস্যাই হবেনা। দু’জন মানবমানবী যারা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গনে পৃথক পৃথক পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তারা মিলিত হলেও দু’টি নদীর মতই সমান্তরালে বহমান থাকবে, একীভূত হবেনা। কিন্তু একটি বিবাহিত দম্পতিকে তাদের পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব থেকে সম্পূর্ন অপরিচিত লোকজন পর্যন্ত একত্রে বসবাস করতে, নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে সহযোগিতা করে। অপরদিকে একটি অনৈতিক বন্ধনে জড়িত দুই ব্যাক্তি - যাদের সম্পর্কের কোন গন্তব্য নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই শুধু নিজেদের চাহিদা পূরণ করা ব্যাতীত - হাতেগোনা কিছু লোকজন ছাড়া কেউ সাহায্য করেনা। ফলে ঠুনকো সম্পর্কটি জোরদার হবার কোন ভিত্তি খুঁজে পায়না। নাটকে সিনেমায় এমন সম্পর্কগুলোর ট্রাজেডি, কমপ্লিকেশন কিংবা হঠাৎ করে সব মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য হেসে ওঠা দেখতে যতই ভাল লাগুক না কেন বাস্তবে কেউ এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে চায়না, বাস্তবে এমন আলৌকিকভাবে সমস্যার সমাধান কমই ঘটে।

 

সুতরাং, আমরা সাবধান হই। একটিমাত্র জীবন আমাদের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য আমরা যেন আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে পাহাড়ের ওপর থেকে গিরিখাদে ধারালো পাথরের ওপর আছড়ে পড়ে জীবনাবসানকে বেছে না নেই। বরং আমাদের পছন্দগুলোর ভিত্তি হোক মানবিক গুনের সমাহার, বিশ্বাসের একাত্মতা, পারস্পরিক সম্মানবোধ এবং প্রতিকুলতায় বন্ধুত্বের ছায়া যেন বার্ধক্যের দিনগুলোতে আমরা পরস্পরের হাত ধরে অস্তমিত সূর্যের  দিকে হেঁটে যেতে পারি এই প্রগাঢ় বিশ্বাসে যে ওপাড়েও সে আমার হাত ছেড়ে দেবেনা।

Sunday, June 16, 2013

কন্যা ও পুত্রের কীর্তিকলাপ


আমার কন্যার বয়স এখন তেরো আর পুত্রের বয়স ছয়। চেহারায় এবং স্বভাবচরিত্রে দু’জন একেবারেই স্বতন্ত্র। কন্যা পুরোপুরি বাপের মত আর পুত্র উল্টো। স্কুলে সবাই ওদের জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের দু’জনের চেহারা মোটেই মিলেনা। Are you sure you are brother and sister?’ এতদসত্ত্বেও ওরা দু’জন একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকতে পারেনা, দুইজনে ঝগড়া লাগলে যদি বলি আলাদা রুমে যেতে তবু কেউ একে অপরকে রেখে নড়তে চায়না, আবার একজনকে বকা দিলে অন্যজন এসে তার তরফদারী করে। বয়সের অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও দু’জনে একসাথে অনেক মজার মজার কান্ড করে। তার কিছু কিছু এখানে শেয়ার করলাম।

 
১/

‘আম্মু, আম্মু’, করে ডাকতে ডাকতে কন্যা আমার রুমে ঢুকে নিজে নিজেই বলল, ‘ওহ! নামাজ পড়ছে। আলহামদুলিল্লাহ, ভাল মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে!’ ওর কথা শুনে হাসি চেপে রেখে বাকী নামাজটা শেষ করতে খুব কষ্ট হয়েছে!
 

২/

জুতো কিনতে গিয়েছি, সাথে পুত্র এবং কন্যা। কন্যা আমার উপর মহাবিরক্ত, ‘তুমি সব বুড়া মানুষদের জিনিস পছন্দ কর’। বুঝাতে ব্যার্থ হলাম যে আমার বয়স হয়েছে, ওরা মাকে এখনো যথেষ্ট ইয়াং মনে করে। তবে আসল কথা হোল, বুড়ো মানুষের সামগ্রী আরামের কথা খেয়াল রেখে তৈরী করা হয়, আমার মত আরামপ্রিয় মানুষের জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কি হতে পারে? যাই হোক, এক দোকানে ঢুকে একটা ঘিয়ে রঙের জুতো দেখে হাতে নিলাম। এবার পুত্র সোচ্চার হয়ে উঠল। জুতোটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে রেখে দিতে দিতে বলল, ‘No, no, no, definitely not!’ ওর কান্ড দেখে দোকানী পর্যন্ত হাসতে লাগল!

 
৩/

রান্নাঘরে কাজ করছি, কিন্তু ঘাড়ের ব্যাথার জন্য যুৎ করতে পারছিনা। রাদিয়াকে বললাম, ‘ঘাড়ে ক’টা চাপ দে তো মা!’ তো রিহাম কিছুতেই মাতৃসেবা থেকে পিছিয়ে থাকতে রাজী না। রাদিয়াকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, ঘাড়ের নাগাল পাচ্ছেনা বলে টুল নিয়ে এসে ঘাড় টিপে দিতে প্রস্তুত হয়ে পড়ল। বললাম, ‘বাবা, তুমি এত ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ঠিকমত চাপ দিতে পারবেনা, রাদিয়া আপুকে দিতে দাও’। সে অপমানিত বোধ করল, ‘What do you mean?’  তারপর ঐ পিচ্চি পিচ্চি হাত দু’টো দিয়ে রাদিয়ার চেয়েও জোরে জোরে ঘাড় টিপে দিল! ওর হাত মাশাল্লাহ অনেক ভাল, ঘাড়ের ব্যাথাটা আসলেই সেরে গেছিল!

 
আরেকদিন রাদিয়াকে বললাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সাথে সাথে রিহাম এসে হাজির, ‘রাদিয়া আপু, তুমি সর, আমি আমার আম্মুকে হাত বুলিয়ে দিব’। বললাম, ‘তুমি পারবেনা বাবা, রাদিয়া আপুকে দিতে দাও’। তখন পুত্র বলল, ‘ না আমি দিব’। বললাম, ‘কেন বাবা? রাদিয়া আপু দিক না!’ সে তখন বলল, ‘Because you are My Mummy! I love you!’ এর পর আর কি বলার আছে? এলোমেলো হাত বুলানোর মাঝেই প্রশান্তির ঘুম ঘুমিয়ে পড়লাম!
 

৪/ আমার একটা বদ অভ্যাস হোল, আমার বাচ্চারা যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণ আমি ঘুমাতে পারিনা সে ঘুমের যতই ঘাটতি হোক না কেন। এমনকি রাতে ঘুমের মধ্যে ওরা ওদের রুমে বিছানায় পাশ ফিরলেও আমি জেগে উঠি। তবে ইদানিং মাঝে মাঝে রিহামকে রাদিয়ার জিম্মায় দিয়ে বিশ্রাম নেই। সেদিন বিকালে রাদিয়া ঘুমাচ্ছে, তাই আমি বসে আছি রাদিয়া উঠলে রিহামকে ওর তত্ত্বাবধানে রেখে শোব, নইলে এশার নামাজ পর্যন্ত এনার্জি ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে (এখন এখানে এশা রাত সাড়ে এগারোটার পর)। রিহাম এসে বলে কিনা, ‘Mummy, go to sleep, don’t worry about me, I’ll be fine by myself!’ বুড়ো বাবাটার কথা শুনে ভাবলাম উনি যে কবে এত বড় হয়ে গেলেন তা তো টেরই পাইনি!
 

৫/

রাদিয়াকে বিবাহের মাসয়ালাগুলো বুঝাচ্ছিলাম, কাদের বিয়ে করা যাবে, কাদের যাবেনা ইত্যাদি। রিহাম বলে, ‘আম্মু, আপুর সাথে তোমার এত কথা বলার দরকার নেই, তুমি আমার সাথে কথা বল’। রিহাম যখন এমন করে তখন আমি সাধারনত ওর দিকে তাকিয়ে ওর সাথে কথা বলার ভঙ্গীতে রাদিয়ার সাথে কথা চালিয়ে যাই। কিছুক্ষণ মনোযোগসহকারে আলোচনা শোনার পর রিহাম বলল, ‘আম্মু, তুমি এসব কথা আমাকে কেন বলছ? আমি তো এখনো অনেক ছোট, আমি বুঝি এখন বিয়ে করতে পারব?!’
 

৬/

রিহামকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি আল্লাহকে ভালোবাস?’
সে বলল, ‘Of course I do!’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আল্লাহকে কতটা ভালোবাস?’
সে নির্দ্বিধায় বলল, ‘A lot.
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি আল্লাহকে আম্মুর চাইতে বেশি ভালোবাস?’
সে চিন্তা করে জানাল, ‘No, I love you both the same amount.
বুঝিয়ে বললাম, ‘কিন্তু তোমার আল্লাহকে আব্বু, আম্মু, আপু সবার চাইতে বেশি ভালবাসতে হবে’।
সে কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। বললাম, ‘তুমি আস্তে আস্তে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে শিখবে, ঠিক আছে?’
সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘okay!’



৭/

আমার কন্যা নিজের রুমটাকে এত অগোছালো করে রাখে যে গুছাতে বললে আর নিজেই কুলকিনারা করতে পারেনা কোথা থেকে শুরু করবে। একদিন শুদ্ধি অভিযান চালাতে গিয়ে সে মাঝপথে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। পুত্র গিয়ে বলে, ‘রাদিয়া আপু, you are not a muslim!’ রাদিয়া তো থ! বলে, ‘কেন? আমি আবার কি করলাম?’ রিহাম বলে, ‘মুসলিমদের ডানপাশে ফিরে শুতে হয়, তুমি বামদিকে ফিরে শুয়েছ!’

 
আজ আমার এক নয় বছর বয়সী ছাত্রী দেখাচ্ছিল সে ডে-কেয়ারে ক্রিসমাস ট্রি বানিয়েছে। পরে সে ভুলে ওর শো পিসটি ডাইনিং টেবিলের ওপর ফেলে রেখে চলে যায়। আমি রিহামকে ভাত মেখে দিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে পড়ছি। পুত্র জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু এটা এখানে কে এনেছে?’ বললাম, ‘আমার ছাত্রী’। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ছাত্রী কি মুসলিম?’ বললাম, ‘হ্যাঁ?’ সে বলল, ‘তাহলে সে কি জানেনা মুসলিমরা ক্রিসমাস করেনা?’ বললাম, ‘আব্বু, আসলে ও অনেক ছোট তো, ও বুঝতে পারেনি’। পুত্র অবশ্বাসের সুরে বলে, ‘What?! আমি তো ওর চেয়েও ছোট, কিন্তু আমি তো জানি আমরা ঈদ করি, ক্রিসমাস করিনা!’

এত বিজ্ঞ আলেমদের নিয়ে যে কি করব!

 
এদের দু’জনের জন্য দু’আ করবেন।

আত্মপরিচয়


১/

গতকাল অফিস থেকে বেরোবার সাথে সাথে হাফিজ সাহেবের ফোন, ‘আমি হয়ত চাকরীটা ছেড়ে দিচ্ছি’।

বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা  হয়েছে। জানি উনি অন্যের সমস্যা সমাধান করার জন্য পাহাড় কেটে সমান করে ফেলবেন, কিন্তু নিজের বেলা যদি একটা ‘উহ’ শব্দ করলে জান বাঁচে সেটুকুও করবেন না। বললাম, ‘সমস্যা হলে ছেড়ে দেন, রিজিকের মালিক আল্লাহ, যেখানে রিজিক থাকবে সেখানে ব্যাবস্থা হয়ে যাবে’।
 

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি অবস্থা?’
বললেন, ‘সমস্যা মিটে গেছে’।
‘কি হয়েছিল?’
‘জেনারেল ম্যানেজার insist করছিল হোটেলের সমস্ত পণ্য আমাদের ব্যাবহার করে দেখা উচিত যেন আমরা গেস্টদের এর গুনগত মানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি। যখন সে জানলো আমরা হাতেগোণা কয়েকজন মদ্যপান করিনা তখন সে বলল, ‘অন্তত এক sip খেয়ে দেখ! নইলে বুঝবে কি করে এটার গুনগত মান কেমন?’ এই মহিলার অন্য দেশ বা সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। কে বোঝাবে তাকে কেন আমি এই বস্তু এক sipও পান করে দেখতে পারবনা? আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই কিচ্ছু না বলে চাকরীটা ছেড়ে দেব। কিন্তু আমাদের হোটেলের এক শ্বেতাঙ্গিনী নিকোল এগিয়ে এসে বলল, ‘শোন, আমি একজন practicing ক্রিশ্চান। আমার বয়স ২৪ এবং আমি এখনও কুমারী, কোন পুরুষ আমাকে বিয়ের আগে স্পর্শ করতে পারবেনা। একইভাবে মদ এবং শুকরের মাংস আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, কেউ আমাকে এগুলো পান করতে বা খেতে বাধ্য করতে পারবেনা, এক sip কেন এক ফোঁটাও না’। এ’সময় আমাদের আরেক ম্যানেজার ডেভিড এগিয়ে এলো। সে আমাকে গত চারবছর ধরে দেখছে। সে জেনারেল ম্যানেজারকে বোঝালো, ‘শোন, তুমি এই ব্যাপারটা ছেড়ে দাও। হাফিজ এখানে গত চারবছর ধরে কাজ করছে, সে নিজেও একজন ম্যানেজার, এখানকার সব প্রোডাক্ট সম্পর্কে ওর ভাল ধারণা র‍য়েছে, সুতরাং এই একটি বস্তু সে পান করে না দেখলে কোন সমস্যা হবেনা। তাছাড়া তুমি যদি এই ব্যাপারটি নিয়ে বাড়াবাড়ি কর আর ওরা ধর্মীয়ভাবে নিগৃহিত হবার কারণে হোটেলের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয় তাহলে আমরা ভীষণ সমস্যায় পড়ে যাব। আর্থিকভাবে কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা না হয় বাদই দিলাম, বদনাম হয়ে গেলে আমাদের হোটেলে আর লোকজন আসবেনা’। এভাবেই জেনারেল ম্যানেজার ঠান্ডা হয়ে গেল, সে আমতা আমতা করতে শুরু করল, ‘আমি তো ওদের বাধ্য করছিলাম না, কেবল বলছিলাম হোটেলের সব প্রোডাক্ট ব্যাবহার করে দেখতে! ওরা না চাইলে কোন সমস্যা নেই।’

 
ডেভিড ধর্মের চর্চা করেনা, কিন্তু অন্যের ধর্মবোধকে শ্রদ্ধা করে। আমার বিগত জীবনের অভিজ্ঞতা এটাই যে আপনি যখন কোন ধর্ম চর্চা করার সিদ্ধান্ত নেবেন, ধর্মকে মনে প্রানে শরীরে এবং জীবনে ধারণ এবং প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবেন, তখন বিধর্মীদের সাথে আপনার যতটা না সমস্যা হবে তার চেয়ে বহুগুন বেশি সমস্যা হবে আপনার কাঙ্ক্ষিত ধর্মের সেসব লোকজনের সাথে যারা ধর্মচর্চা করেনা। আপনি হয়ত কেবল আপনার নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছেন, প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন যেন আপনার কাজটি ত্রুটিমুক্ত হয়, ঘাটতি কিংবা বাহুল্য দোষে দুষ্ট না হয়, আর কেউ কি করছে না করছে তার প্রতি আপনার দৃকপাত করার সময় বা আকাঙ্খা কোনটিই নেই, কিন্তু তবু সেই ব্যাক্তি  আপনার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে যাবে যে নিজে ধর্মপালন করেনা কিংবা আংশিকভাবে করে, এই ভেবে যে ধর্ম পালন করার মাধ্যমে আপনি তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। আপনি তো পুরোই বোকা বনে গেলেন, ‘আমি কি করলাম?!’

 
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্নের উদয় হয়, ওরা কি এজন্য এমন করে যে ওরা অন্তরের অন্তঃস্থলে অনুভব করে তাদের নিজেদেরও এই কাজগুলো করা উচিত ছিল কিন্তু পৃথিবীর প্রতি লোভ, মোহ, কামনা তাদের ফিরিয়ে রেখেছে? কিংবা ভাবে আপনার নিষ্ঠা তাদের ফাঁকিবাজিটাকে প্রকাশ করে দিচ্ছে? এজন্যই হয়ত লেজকাটা শেয়াল চায় সব শেয়ালেরই লেজ কাটা যাক। তাই হয়ত আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবী শিখা সাহা কিংবা ফ্যাং মে কিংবা ডনা জ্যাকসনের সাথে কোনদিন কোন সমস্যা হয়নি অথচ বানু, খানম আর খাতুনেরা মনে করে শুধু নামাজ পড়া আর নিজেকে আবৃত করাও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি! এজন্যই হয়ত বিধর্মীরা অন্য ধর্মকে ততটা অবমাননা করেনা যেভাবে সেই ধর্মে জন্মগ্রহনকারী অথচ পালন করতে অনিচ্ছুক ব্যাক্তিরা আক্রমন করে থাকে। তাই যুগে যুগে জন্ম হয় সালমান রুশদী আর তাসলিমা নাসরিনদের। কেন যে তাঁরা ধর্ম পালনে ইচ্ছুক ব্যাক্তিদের তাঁদের মত চলতে দিয়ে নিজেরা নিজেদের মত চলতে পারেন না কে জানে!

 
 

২/

মার পূর্বতন কর্মস্থলে আমি যখন নামাজের জায়গা খুঁজছি তখন পরিচয় হয় সোমালিয়ার বান্ধবী আয়শার সাথে। সে জানায় এখানে এক ঈজিপশিয়ান ভাই নোমাইর মু’মিন কোম্পানীর সাথে কথা বলে একটি রুম নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেন এবং সেখানে জায়নামাজ কিনে জমা করে নামাজের ব্যাবস্থা করেন। আমাদের বাংলাদেশীদের অধিকাংশই হয় নামাজ পড়েনা, কিংবা বাসায় গিয়ে পড়ে অথবা নিজের ডেস্কে বসে পড়ে নেয়। তাই এই রুমে সচরাচর বাংলাদেশীদের আগমন ঘটেনা আয়শা আমাকে জানায় এই রুমে আগে কেবল পুরুষদের নামাজ হত। এখন মহিলাদের জন্য আলাদা করে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং এর জন্য উদ্যোগ নিয়েছে ফিয়োনা রোচ। নাম শুনে একটু আশ্চর্য হলাম। বললাম, ‘ওর কি সম্ভাব্য স্বার্থ থাকতে পারে যে সে মহিলাদের নামাজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারনের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলো?’

আয়শা বলল, ‘কেন, সে নামাজ পড়ে তো!’

আমি তো হতবাক! ফিয়োনা ... রোচ ... নামাজ পড়ে! আমি তো পুরাই কনফিউজড!

ফিয়োনার নাম যেমন তেমনি ওর পোশাক আশাক দেখেও ধারণা করার কোন কারণ নেই যে সে মুসলিম। বুঝলাম, ম্ভবত সে নও মুসলিম এবং ইসলামের সকল ব্যাপারে তার পরিপূর্ণ ধারণা নেই। তবে সে এটুকু বুঝেছে যে নামাজ মুসলিম এবং অমুসলিমদের মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। তাই অফিসে সে যেভাবেই চলুক না কেন প্রতিদিন নামাজের সময় হবার সাথে সাথে সে ওজু করে নিজেকে সম্পূর্ন আবৃত করে নেয় এবং অফিসের কে কি ভাবল, কোন দৃষ্টিতে দেখল কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজেকে স্রষ্টার সামনে সমর্পন করে দেয়।
 

আমার বর্তমান কর্মস্থলের পাশের বিল্ডিংয়েই মসজিদ। এখানে ওজু করার সুব্যাবস্থার কারণে আমি অফিসে জায়গা থাকা সত্ত্বেও মসজিদে নামাজ পড়তে পছন্দ করি। তাছাড়া জুমার দিন এই মসজিদের খুতবাটাও দারুন হয়। মসজিদে গেলে প্রায়ই দেখি ডাউনটাউনের বিভিন্ন এলাকা যেখানে কাছাকাছি মসজিদ নেই কিংবা যেসব অফিসে নামাজের জায়গা নেই সেখান থেকে মহিলারা হেঁটে আসেন লাঞ্চটাইমে নামাজ পড়ার জন্য। এক ইরাকী মহিলা চারব্লক হেঁটে আসতেন আবার চারব্লক হেঁটে ফিরে যেতেন প্রতি ওয়াক্তে যেটা শীতকালে তিন ওয়াক্তও হতে পারে। ইদানিং আমি যে সময় বের হই তখন এক আফ্রিকান মহিলা আসেন যিনি কোর্টে কাজ করেন। প্রতিদিন দুপুরে যুহরের সময় পৃথিবীর দুই প্রান্ত থেকে আসা দু’টি মানুষ একত্রিত হই একই সত্ত্বার সামনে। এভাবেই আমাদের সকল পার্থক্য ঘুচে গিয়ে কেবল একটা পরিচয়ই অবশিষ্ট থাকে - আমরা দু’জনই একই সত্ত্বাকে ভালোবাসি এবং তারই জন্য পরস্পরকে ভালোবাসি এবং এতটা ভালোবাসি যে একে অপরের জন্য যেকোন কিছু করতে পারি যদিও আমরা একে অপরের নামটিও জানিনা!

 

/

কিছুদিন আগে এক বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে দেখি কিছু অতিথি এসেছেন যারা অপরিচিত। তাঁদের দেখে কিছুতেই অনুমান করতে পারলাম না সালাম দেব না আদাব বলব। তাই কোনপ্রকার সম্ভাষনের পরিবর্তে কেবল হাসি দিয়ে আগে বান্ধবীকে খুঁজে বের করলাম। তারপর কানে কানে জিজ্ঞেস করে নিলাম, ‘সালাম দেব না আদাব বলব?’ সে বলল, ‘দেখে বোঝার উপায় না থাকলেও ওরা মুসলিম। আপনি সালাম দিতে পারেন

 
এঁরা আশ্চর্যজনক কৃতিত্বের সাথে নিজেদের অস্তিত্ব থেকে তাঁদের ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিয়ে দিয়েছেন তাঁদের নামধাম, চেহারাসুরত, কথাবার্তা, পোশাক আশাক থেকে সন্তান সন্ততি পর্যন্ত কিছুই দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁরা মুসলিম। দাওয়াতে যাবার আগে থেকেই অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। দাওয়াতে উপস্থিত সুধীমন্ডলীর সাহচর্যও তেমন স্বস্তিকর ছিলোনা। তাই বান্ধবী এবং আমাদের খুব কাছের এক ভাবীকে বিদায় জানিয়ে বাসায় এসে ঘুমিয়ে সময়ের সদ্ব্যাবহার করলাম।
 

পরে বান্ধবী ফোন করে জানালেন আমাদের ভাবীসাহেবা, যিনি নিজেও আধুনিকা, এক মজার কান্ড করেছেন। ভাবীও এসে আমার মতই কনফিউজড ছিলেন। তবে তিনি এই সমস্যার সমাধান করেছেন অন্যভাবে। গৃহকর্ত্রীর ব্যাস্ততা দেখে তিনি তাঁকে বিরক্ত না করে অতিথিদের সন্তানদের সাথে খানিকক্ষণ কথা বললেন, তাদের নামধাম জিজ্ঞেস করলেন। তারপর তিনি গিয়ে অতিথিদের নমস্কার করেন। খাওয়াদাওয়ার পর গল্প করতে করতে তিনি তাঁদের বার বার বৌদি সম্ভাষন করতে থাকলে তাঁরা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে থাকেন। তাঁরা গৃহকর্ত্রীকে অনুরোধ করেন ভাবীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্য। বান্ধবী নিজেও ভাবীকে এই বিষয়ে বলতে বিব্রত বোধ করতে থাকেন। তাই তিনি ইশারায় বলার চেষ্টার করেন। কিন্তু ভাবী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘না ভাবী, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি বাচ্চাদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছি যে এঁরা হিন্দু। তাঁদের প্রতি আমার ব্যাবহারে আপনি কোন ত্রুটি খুঁজে পাবেন না
 

এভাবেই সমাপ্ত হয় বান্ধবীর অভূতপূর্ব দাওয়াতপর্ব!