১/
গতকাল অফিস থেকে
বেরোবার সাথে সাথে হাফিজ সাহেবের ফোন, ‘আমি হয়ত চাকরীটা ছেড়ে দিচ্ছি’।
বুঝলাম কিছু একটা
সমস্যা হয়েছে। জানি উনি অন্যের সমস্যা
সমাধান করার জন্য পাহাড় কেটে সমান করে ফেলবেন, কিন্তু নিজের বেলা যদি একটা ‘উহ’ শব্দ করলে জান বাঁচে সেটুকুও করবেন না। বললাম, ‘সমস্যা
হলে ছেড়ে দেন, রিজিকের মালিক আল্লাহ, যেখানে রিজিক থাকবে সেখানে ব্যাবস্থা হয়ে
যাবে’।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে
এলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি অবস্থা?’
বললেন,
‘সমস্যা মিটে গেছে’।‘কি হয়েছিল?’
‘জেনারেল ম্যানেজার insist করছিল হোটেলের সমস্ত পণ্য আমাদের ব্যাবহার করে দেখা উচিত যেন আমরা গেস্টদের এর গুনগত মানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারি। যখন সে জানলো আমরা হাতেগোণা কয়েকজন মদ্যপান করিনা তখন সে বলল, ‘অন্তত এক sip খেয়ে দেখ! নইলে বুঝবে কি করে এটার গুনগত মান কেমন?’ এই মহিলার অন্য দেশ বা সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। কে বোঝাবে তাকে কেন আমি এই বস্তু এক sipও পান করে দেখতে পারবনা? আমি তখনই সিদ্ধান্ত নেই কিচ্ছু না বলে চাকরীটা ছেড়ে দেব। কিন্তু আমাদের হোটেলের এক শ্বেতাঙ্গিনী নিকোল এগিয়ে এসে বলল, ‘শোন, আমি একজন practicing ক্রিশ্চান। আমার বয়স ২৪ এবং আমি এখনও কুমারী, কোন পুরুষ আমাকে বিয়ের আগে স্পর্শ করতে পারবেনা। একইভাবে মদ এবং শুকরের মাংস আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, কেউ আমাকে এগুলো পান করতে বা খেতে বাধ্য করতে পারবেনা, এক sip কেন এক ফোঁটাও না’। এ’সময় আমাদের আরেক ম্যানেজার ডেভিড এগিয়ে এলো। সে আমাকে গত চারবছর ধরে দেখছে। সে জেনারেল ম্যানেজারকে বোঝালো, ‘শোন, তুমি এই ব্যাপারটা ছেড়ে দাও। হাফিজ এখানে গত চারবছর ধরে কাজ করছে, সে নিজেও একজন ম্যানেজার, এখানকার সব প্রোডাক্ট সম্পর্কে ওর ভাল ধারণা রয়েছে, সুতরাং এই একটি বস্তু সে পান করে না দেখলে কোন সমস্যা হবেনা। তাছাড়া তুমি যদি এই ব্যাপারটি নিয়ে বাড়াবাড়ি কর আর ওরা ধর্মীয়ভাবে নিগৃহিত হবার কারণে হোটেলের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয় তাহলে আমরা ভীষণ সমস্যায় পড়ে যাব। আর্থিকভাবে কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তা না হয় বাদই দিলাম, বদনাম হয়ে গেলে আমাদের হোটেলে আর লোকজন আসবেনা’। এভাবেই জেনারেল ম্যানেজার ঠান্ডা হয়ে গেল, সে আমতা আমতা করতে শুরু করল, ‘আমি তো ওদের বাধ্য করছিলাম না, কেবল বলছিলাম হোটেলের সব প্রোডাক্ট ব্যাবহার করে দেখতে! ওরা না চাইলে কোন সমস্যা নেই।’
ডেভিড ধর্মের চর্চা করেনা, কিন্তু অন্যের ধর্মবোধকে
শ্রদ্ধা করে। আমার বিগত জীবনের অভিজ্ঞতা এটাই যে আপনি যখন কোন ধর্ম চর্চা করার
সিদ্ধান্ত নেবেন, ধর্মকে মনে প্রানে শরীরে এবং জীবনে ধারণ এবং প্রতিষ্ঠিত করতে
চাইবেন, তখন বিধর্মীদের সাথে আপনার যতটা না সমস্যা হবে তার চেয়ে বহুগুন বেশি
সমস্যা হবে আপনার কাঙ্ক্ষিত ধর্মের সেসব লোকজনের সাথে যারা ধর্মচর্চা করেনা। আপনি
হয়ত কেবল আপনার নিজের ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছেন, প্রয়াস চালিয়ে
যাচ্ছেন যেন আপনার কাজটি ত্রুটিমুক্ত হয়, ঘাটতি কিংবা বাহুল্য দোষে দুষ্ট না হয়, আর
কেউ কি করছে না করছে তার প্রতি আপনার দৃকপাত করার সময় বা আকাঙ্খা কোনটিই নেই,
কিন্তু তবু সেই ব্যাক্তি আপনার ওপর ক্ষিপ্ত
হয়ে যাবে যে নিজে ধর্মপালন করেনা কিংবা আংশিকভাবে করে, এই ভেবে যে ধর্ম পালন করার
মাধ্যমে আপনি তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। আপনি তো পুরোই বোকা বনে
গেলেন, ‘আমি কি করলাম?!’
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্নের উদয় হয়, ওরা কি এজন্য এমন করে যে
ওরা অন্তরের অন্তঃস্থলে অনুভব করে তাদের নিজেদেরও এই কাজগুলো করা উচিত ছিল কিন্তু পৃথিবীর
প্রতি লোভ, মোহ, কামনা তাদের ফিরিয়ে রেখেছে? কিংবা ভাবে আপনার নিষ্ঠা তাদের ফাঁকিবাজিটাকে
প্রকাশ করে দিচ্ছে? এজন্যই হয়ত লেজকাটা শেয়াল চায় সব শেয়ালেরই লেজ কাটা যাক। তাই
হয়ত আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবী শিখা সাহা কিংবা ফ্যাং মে কিংবা ডনা জ্যাকসনের সাথে
কোনদিন কোন সমস্যা হয়নি অথচ বানু, খানম আর খাতুনেরা মনে করে শুধু নামাজ পড়া আর
নিজেকে আবৃত করাও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি! এজন্যই হয়ত বিধর্মীরা অন্য ধর্মকে ততটা অবমাননা
করেনা যেভাবে সেই ধর্মে জন্মগ্রহনকারী অথচ পালন করতে অনিচ্ছুক ব্যাক্তিরা আক্রমন
করে থাকে। তাই যুগে যুগে জন্ম হয় সালমান রুশদী আর তাসলিমা নাসরিনদের। কেন যে তাঁরা
ধর্ম পালনে ইচ্ছুক ব্যাক্তিদের তাঁদের মত চলতে দিয়ে নিজেরা নিজেদের মত চলতে পারেন
না কে জানে!
২/
আমার পূর্বতন
কর্মস্থলে আমি যখন নামাজের জায়গা খুঁজছি তখন পরিচয় হয় সোমালিয়ার বান্ধবী আয়শার সাথে। সে
জানায় এখানে এক ঈজিপশিয়ান ভাই নোমাইর মু’মিন কোম্পানীর সাথে কথা বলে একটি রুম
নামাজের জন্য নির্দিষ্ট করে নেন এবং সেখানে জায়নামাজ কিনে জমা করে নামাজের
ব্যাবস্থা করেন। আমাদের বাংলাদেশীদের অধিকাংশই হয় নামাজ পড়েনা, কিংবা বাসায় গিয়ে
পড়ে অথবা নিজের ডেস্কে বসে পড়ে নেয়। তাই এই রুমে সচরাচর বাংলাদেশীদের আগমন ঘটেনা। আয়শা আমাকে জানায় এই রুমে আগে কেবল পুরুষদের
নামাজ হত। এখন মহিলাদের জন্য আলাদা করে সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে এবং এর জন্য
উদ্যোগ নিয়েছে ফিয়োনা রোচ। নাম শুনে একটু আশ্চর্য হলাম। বললাম, ‘ওর কি সম্ভাব্য
স্বার্থ থাকতে পারে যে সে মহিলাদের নামাজের
জন্য আলাদা সময় নির্ধারনের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলো?’
আয়শা বলল, ‘কেন, সে নামাজ পড়ে তো!’
আমি তো হতবাক! ফিয়োনা ... রোচ ... নামাজ পড়ে! আমি তো পুরাই কনফিউজড!
ফিয়োনার নাম যেমন তেমনি ওর পোশাক আশাক দেখেও ধারণা করার কোন কারণ নেই যে
সে মুসলিম। বুঝলাম, সম্ভবত সে নও মুসলিম এবং ইসলামের সকল ব্যাপারে তার
পরিপূর্ণ ধারণা নেই। তবে সে এটুকু বুঝেছে যে নামাজ মুসলিম এবং অমুসলিমদের মাঝে
পার্থক্য নির্ণয়কারী। তাই অফিসে সে যেভাবেই চলুক না কেন প্রতিদিন নামাজের সময় হবার সাথে সাথে সে ওজু করে নিজেকে সম্পূর্ন আবৃত করে
নেয় এবং অফিসের কে কি ভাবল, কোন দৃষ্টিতে দেখল কোনকিছুর তোয়াক্কা না করে নিজেকে
স্রষ্টার সামনে সমর্পন করে দেয়।
আমার বর্তমান কর্মস্থলের পাশের বিল্ডিংয়েই মসজিদ।
এখানে ওজু করার সুব্যাবস্থার কারণে আমি অফিসে জায়গা থাকা সত্ত্বেও মসজিদে নামাজ
পড়তে পছন্দ করি। তাছাড়া জুমার দিন এই মসজিদের খুতবাটাও দারুন হয়। মসজিদে গেলে প্রায়ই দেখি ডাউনটাউনের বিভিন্ন এলাকা যেখানে
কাছাকাছি মসজিদ নেই কিংবা যেসব অফিসে নামাজের জায়গা নেই সেখান থেকে মহিলারা হেঁটে আসেন লাঞ্চটাইমে নামাজ পড়ার
জন্য। এক ইরাকী মহিলা চারব্লক হেঁটে আসতেন আবার চারব্লক হেঁটে ফিরে যেতেন প্রতি
ওয়াক্তে যেটা শীতকালে তিন ওয়াক্তও হতে পারে। ইদানিং আমি যে সময় বের হই তখন এক
আফ্রিকান মহিলা আসেন যিনি কোর্টে কাজ করেন। প্রতিদিন দুপুরে যুহরের সময় পৃথিবীর
দুই প্রান্ত থেকে আসা দু’টি মানুষ একত্রিত হই একই সত্ত্বার সামনে। এভাবেই আমাদের
সকল পার্থক্য ঘুচে গিয়ে কেবল একটা পরিচয়ই অবশিষ্ট থাকে - আমরা দু’জনই একই সত্ত্বাকে ভালোবাসি এবং তাঁরই জন্য পরস্পরকে ভালোবাসি এবং এতটা ভালোবাসি যে
একে অপরের জন্য যেকোন কিছু করতে পারি যদিও আমরা একে অপরের নামটিও জানিনা!
৩/
কিছুদিন
আগে এক
বান্ধবীর বাসায়
দাওয়াত খেতে
গিয়ে দেখি
কিছু অতিথি
এসেছেন যারা
অপরিচিত। তাঁদের
দেখে কিছুতেই
অনুমান করতে
পারলাম না
সালাম দেব
না আদাব
বলব। তাই
কোনপ্রকার সম্ভাষনের
পরিবর্তে কেবল
হাসি দিয়ে
আগে বান্ধবীকে
খুঁজে বের
করলাম। তারপর
কানে কানে
জিজ্ঞেস করে
নিলাম, ‘সালাম
দেব না
আদাব বলব?’
সে বলল,
‘দেখে বোঝার
উপায় না
থাকলেও ওরা
মুসলিম। আপনি
সালাম দিতে
পারেন’।
এঁরা
আশ্চর্যজনক কৃতিত্বের
সাথে নিজেদের
অস্তিত্ব থেকে
তাঁদের ধর্মীয়
পরিচয় বাদ
দিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের
নামধাম, চেহারাসুরত,
কথাবার্তা, পোশাক
আশাক থেকে
সন্তান সন্ততি
পর্যন্ত কিছুই
দেখে বোঝার
উপায় নেই
তাঁরা মুসলিম।
দাওয়াতে যাবার
আগে থেকেই
অত্যন্ত ক্লান্ত
ছিলাম। দাওয়াতে
উপস্থিত সুধীমন্ডলীর
সাহচর্যও তেমন স্বস্তিকর
ছিলোনা। তাই
বান্ধবী এবং
আমাদের খুব
কাছের এক
ভাবীকে বিদায়
জানিয়ে বাসায়
এসে ঘুমিয়ে
সময়ের সদ্ব্যাবহার
করলাম।
পরে
বান্ধবী ফোন
করে জানালেন
আমাদের ভাবীসাহেবা,
যিনি নিজেও
আধুনিকা, এক
মজার কান্ড
করেছেন। ভাবীও
এসে আমার
মতই কনফিউজড
ছিলেন। তবে
তিনি এই
সমস্যার সমাধান
করেছেন অন্যভাবে।
গৃহকর্ত্রীর ব্যাস্ততা
দেখে তিনি
তাঁকে বিরক্ত
না করে
অতিথিদের সন্তানদের
সাথে খানিকক্ষণ
কথা বললেন,
তাদের নামধাম জিজ্ঞেস
করলেন। তারপর
তিনি গিয়ে
অতিথিদের নমস্কার
করেন। খাওয়াদাওয়ার
পর গল্প
করতে করতে
তিনি তাঁদের
বার বার
বৌদি সম্ভাষন করতে থাকলে তাঁরা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে থাকেন। তাঁরা গৃহকর্ত্রীকে অনুরোধ করেন ভাবীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার জন্য। বান্ধবী নিজেও ভাবীকে এই বিষয়ে বলতে বিব্রত বোধ করতে থাকেন। তাই তিনি ইশারায় বলার চেষ্টার করেন। কিন্তু ভাবী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘না ভাবী, আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি বাচ্চাদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছি যে এঁরা হিন্দু। তাঁদের প্রতি আমার ব্যাবহারে আপনি কোন ত্রুটি খুঁজে পাবেন না’।
এভাবেই সমাপ্ত হয় বান্ধবীর অভূতপূর্ব দাওয়াতপর্ব!
No comments:
Post a Comment