Sunday, December 9, 2012

বৈচিত্রময়

আজ সকালে ভারী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলাম। চোখ এবং মন দু’টোই জুড়িয়ে গেল।

স্বপ্নে দেখলাম স্বচ্ছ সুনীল সমুদ্রের মাঝে স্পিডবোট চালিয়ে বাড়ী ফিরছি। আমি সাঁতার জনিনা, কিন্তু একা একা এই বিশাল সমুদ্রের মাঝে চলতে আমার একটুও ভয় লাগছেনা। সমুদ্রের পানিতে উথালপাথাল নেই, হাল্কা একটু তরঙ্গ মাত্র, স্পিডবোটে চলছে এত মসৃনভাবে মনে হচ্ছে যেন ভেসে রয়েছে। স্ফটিকসদৃশ সেই সাগরজলের ভেতর দিয়ে গভীর সমুদ্রের তলদেশে প্রতিটা বালির চিকচিক দেখা যাচ্ছে, স্পিডবোটের নীচে কত ডলফিন আর বন্ধুসুলভ হাঙ্গর তাদের শৈল্পিক দেহাবয়ব নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে! চমৎকার আবহাওয়া, আকাশে কোন মেঘ নেই, কিন্তু সূর্যের আলোটা প্রখর নয় বরং চোখজুড়ানো।

বাড়ী পৌঁছে দেখলাম আমার বাসা হোল একটা দ্বীপ। পুরো দ্বীপটাই আমার নিজস্ব! দ্বীপের মাঝখানে একটু উঁচু, ওখানে আমার খোলামেলা বাড়ী, চারপাশে বারান্দা, চারপাশ থেকেই সমুদ্র আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র দেখা যায়।

বাড়ী ফিরে বড়শী নিয়ে বের হলাম। এবার সবচেয়ে অবাক ব্যাপার। দ্বীপের সবদিকেই দেখি পুকুর। কোন পুকুরে দেখি সবুজাভ শ্যাওলাযুক্ত পানি, কচুরিপানার ফুল ফুটে আছে একপাশে; পানিতে গুঁড়াচিংড়ি থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, শোল, মৃগেল আরো কতরকম মাছ! পুকুরের পাড়ে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, তাল আরো কত কত জাতের ফল; শিউলি, হাসনাহেনা, কামিনী, গন্ধরাজ আরো কত ফুল; আর সারিসারি বাঁশঝাড়; তার মাঝে গাইছে কোকিল, দোয়েল, পাপিয়া আর এমন সব সুকন্ঠী পাখিরা। ঘাসফুল, কাঁঠালপাতা আর কাদার সাথে ধানের নাড়া মেশানো সোঁদা গন্ধে মৌ মৌ চারিদিক। এভাবে প্রতিটা পুকুর আর পুকুরপাড়ের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য, আলাদা জীববৈচিত্র। সবশেষ দেখলাম শ্রীলঙ্কার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত পুকুরে বড়শী ফেলে মাছ ধরছি আর স্বচ্ছ পানির নীচে জীবনের আনাগোণা পর্যবেক্ষণ করে বিস্মিত হচ্ছি। যেদেশে যাইনি কোনদিন সেদেশের পানি আর জীববৈচিত্র এত কাছ থেকে দেখে এত পুলকিত হলাম যে মাছ ধরার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল!

বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস ২০, হাঁটু সমান স্নো; গাছপালা থেকে বাড়ীর চাল, বেড়া, গাড়ীর জানালা সব সাদা চাদরে আবৃত হয়ে রয়েছে আজ বহুদিন; বাতাসে চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসার উপক্রম। তাই কি এমন স্বপ্ন দেখলাম? জানিনা। কিন্তু এটুকু বুঝলাম, মানবমন বৈচিত্রপ্রিয়। আবার সেই চিত্রটা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল যা গত ক’দিন ধরেই মাথায় ঘুরছে।

ক’দিন ধরে কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম- আমি একটা টেবিল বানাচ্ছি, সুন্দর কাঠ, একেবারে মসৃন করে কাটা, উন্নতমানের পার্টস, চমৎকার যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করছি। কিন্তু আমার মন উড়ু উড়ু, বার বার কাজ ফেলে অন্যদিকে ছোটে। কিছুক্ষণ পর টেবিল হোল ঠিকই কিন্তু তাকে পায়ের ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ব্যাপার কি? হায় হায়, মনের ভুলে একেকটা পায়ের সাইজ একেকরকম হয়ে গেছে! একবার এই পা কাটি তো আরেকবার ঐ পা কাটি। শেষে টেবিলটা টেবিল না হয়ে পিঁড়িতে রূপান্তরিত হোল। সে এমন এক পিঁড়ি তাতে না যায় বসা আর না যায় টেবিলের মত তরকারী সাজানো।

আমার কেন যেন মনে হয় আমার নামাজগুলো হয় এই টেবিলের মত। নামাজ পড়ি, কিন্তু সেটা হয় দায়সারা গোছের, তাতে যত্নের কোন ছোঁয়া থাকেনা। তাই সে আমাকে আল্লাহর সামনে সম্মানিত করবে কি, তাঁর সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়েই তার দফারফা হয়ে যায় আর আমার ইজ্জতের বাজে তেরোটা।

চলুন একটু হিসেব করে দেখি আমরা কিভাবে নামাজ পড়ি। নামাজে দাঁড়িয়ে রোবটের মত মুখে সুরা এবং দু’আ পড়া চলতে থাকে আর মনে মনে হিসেব করতে থাকি আজ কার কার সাথে কি কি কথা হোল, কি কি পড়লাম, কোন মুভিটা দেখা হয়নি, কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়, তরকারীটা আরেকটু শক্ত থাকলে দেখতে আরেকটু ভাল হত, বাচ্চাগুলো এই মূহূর্তে কি করছে- অর্থাৎ পঠিত সুরাগুলোর অর্থ ছাড়া আর সবকিছুই মাথায় থাকে। আমাকে যদি প্রতিদিন লবন মরিচ আর পান্তাভাত দেয়া হয়, অপমানে চোখে ফেটে পানি আসবে। একই খাবার মানুষ প্রতিদিন খেতে পারে? অথচ আমরা বছরের পর বছর স্বল্প ক’টা সুরা একইভাবে ঘ্যানর ঘ্যানর করে যাচ্ছেতাইভাবে নামাজ সমাধা করছি। রোবটের মত একই জিনিস পুণরাবৃত্তি করতে করতে মাঝে মাঝে এটাও সিদ্ধান্ত নেয়া দুষ্কর হয়ে যায় আমি আসলে কয় রাকাত নামাজ পড়েছি। তখন হিসেব করি প্রথম রাকাতে ভাবছিলাম আমার প্রথম দোকানটার কথা, দ্বিতীয় রাকাতে ভাবছিলাম দ্বিতীয়টার কথা, তৃতীয় রাকাতে তৃতীয়টার কথা, যেহেতু চতুর্থ দোকানটার কথা ভাবা হয়নি তার মানে চার রাকাতের নামাজ আমি তিনরাকাত পড়েছি! অথচ নামাজের সময়টুকু হোল আল্লাহর সাথে আমার একান্ত সাক্ষাতের সময়, এই সময় আমার সমস্ত মনোযোগ যদি আমার শ্রোতার প্রতি নিবদ্ধ না থাকে তাহলে তাঁর কি দায় পড়েছে আমার আবোলতাবোল শুনে সময় নষ্ট করার? আমি নিজেই তো জানিনা আমি তাঁকে কি বলছি, সেক্ষেত্রে তিনি কি করে আমার বক্তব্যের মর্মোদ্ধার করবেন? কি দুঃখজনক ব্যাপার, যে বৈচিত্র আমি নিজের জন্য পছন্দ করি তা আমার সৃষ্টিকর্তার জন্য উপহার দিতে কার্পণ্য করি, অথচ তা তাঁরই দেয়া উপহার!

আমরা অধিকাংশই নামাজ পড়ি শেষ ওয়াক্তে, দুনিয়ার সব কাজ সমাপ্ত করে যখন না গেলেই নয়, সুতরাং নামাজ না হয়ে সেটা হয়ে যায় দৌড় প্রতিযোগিতা। আমরা এর ব্যাখ্যা দেই এভাবে, আমি সব কাজ শেষ করে নামাজ পড়তে যাই যেন আমার ধ্যান পুরোপুরি নামাজের প্রতি নিবিষ্ট থাকে। কিন্তু কোন দাওয়াতে গেলে মেজবান যদি আমাকে এককোণে বসিয়ে রেখে অন্য সবার সাথে কথাবার্তা সেরে শেষমূহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে আমার সাথে কিছু দুর্বোধ্য বাক্যালাপ সেরে সটকে পড়েন, আমি ঠিকই বুঝব তিনি আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা এবং অপমান করলেন। রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে আমি সেই দাওয়াতে খাবারই খাব না! অথচ আমরা আল্লাহর সাথে ঠিক এই ব্যাবহারই তো করছি! এই সামান্য বোধটুকু আমাদের মাঝে কাজ করেনা যে আমার নামাজ পড়া না পড়ায় তাঁর কিছু এসে যায়না, তাঁর মান সম্মানের ন্যূনতম কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয়না, কারণ তাঁর আমাকে প্রয়োজনে নেই বরং আমার তাঁকে প্রয়োজন। খুবই স্বাভাবিক আমরা যখন তাঁর সাথে এই বুঝ দেয়া ব্যাবহার করি তখন আমাদের বিপদের সময় তিনি আমাদের নিবিড়ভাবে সহযোগিতা করার প্রয়োজন অনুভব করবেন না। তখন কিন্তু আমরা রাগে ফেটে পড়ি কেন তিনি আমার বিপদের সময় সাড়া দিতে বিলম্ব করলেন? অথচ তিনি ছাড়া আর কোন সাহায্যকারী নেই!

অনেকসময় আমরা যে ওয়াক্তের নামাজ সে ওয়াক্তে না পড়ে পরবর্তীতে পড়ার জন্য রেখে দেই। অজুহাত থাকে ওজু করার সুব্যাবস্থা ছিলোনা, নামাজের জায়গা ছিলোনা, পোশাক পরিচ্ছদ ঠিক ছিলোনা, লোকজনের সামনে কিভাবে নামাজ পড়ব যেখানে আর কেউ পড়ছেনা ইত্যাদি। অথচ নামাজে ব্যাপারে এতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে বলা হয়েছে এটা বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীর মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। ওজু করা না গেলে তায়াম্মুম করে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে; দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে এমনকি ইশারায় নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে; শিশু পেশাব করে দিলে নোংরা হওয়া সত্ত্বেও পোশাক পরিবর্তনের পরিবর্তে শুধু সে স্থানটুকু ধুয়ে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে- কেন? শুধু এজন্যই তো যেন নামাজ পড়া আমাদের জন্য কঠিন না হয়! তবু আমরা নামাজ কাজা করি। আমার এক ছোটভাই বিরাট ব্যাবসায়ী। দেশেবিদেশে ব্যাবসা, মিটিং, ছুটোছুটি লেগেই থাকে। সে বলেছিল, একবার এক ব্যাবসায়িক মিটিংয়ে সে আশা করছিল নামাজের জন্য ব্রেক দেয়া হবে, যেহেতু মিটিং ছিল বাংলাদেশে এবং উপস্থিত ব্যাবসায়ীদের প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলিম। কিন্তু শেষ ওয়াক্তেও যখন বিরতি দেয়া হোলনা এবং কেউ এই ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুললেন না তখন সে নিজেই লজ্জা পেল। বাথরুমে যাবার কথা বলে বাইরে গিয়ে নামাজ পড়ে এলো। খুব আক্ষেপ করে বলেছিল সে, ‘এক সময় যারা নামাজ পড়তনা তারা নামাজের ওয়াক্ত হলে লজ্জায় ছাদের ওপর, গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকত। আর এখন আমরা মিথ্যা বাহানা দিয়ে নামাজ পড়ি!’ কিন্তু এখানে বড় কথা সে লোকের কথা ভেবে নিজের নামাজ ত্যাগ করেনি যেহেতু ওর নামাজের হিসেব ওকেই দিতে হবে।

এবার চলুন একটি সুন্দর নামাজের কথা বলি। গত তারাবীতে যখনই সম্ভব হত আমরা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তাম। একেকদিন একেকভাবে নামাজ হত। যেমন, একরাতে ইমাম সাহেব থিম ঠিক করলেন নবীদের কাহিনী। তারাবীর প্রতি রাকাতে তিনি একেকজন নবীকে নিয়ে কু’রআনের একেকটি অংশের তিলাওয়াত করলেন। মনেই হচ্ছিলোনা নামাজ পড়ছি, এত মজা লাগছিল যে মনে হচ্ছিল অ্যাসর্টেড চকলেট খাচ্ছি, কোনটাতে বাদাম দেয়া, কোনটাতে ক্যারামেল, আর কোনটাতে মধু। ইমাম সাহেব বিতর পড়লেন যেভাবে রাসূল (সা) পড়তে ভালবাসতেন সেভাবে- প্রথম রাকাতে সুরা আ’লা, দ্বিতীয় রাকাতে সুরা কাফিরূন, তৃতীয় রাকাতে সুরা ইখলাস- চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছিল যেন সাহাবাদের সাথে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছি। ইমাম সাহেব তৃতীয় রাকাতে যখন দু’আ পড়তে শুরু করলেন সবাই আপ্লুত হয়ে পড়ছিল, কারণ কথাগুলো ছিল হৃদয়নিঃসৃত এবং ‘আল্লাহ’ শব্দটির উচ্চারণে এত ভালবাসা মিশ্রিত ছিল মনে হচ্ছিল এই আওয়াজ তাঁর হৃদয়ের গহীন থেকে উত্থিত হয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে হাহাকার জাগিয়ে তুলছিল প্রভুর ভালবাসার তৃষ্ণায়।

এবার আমরা একটু ভেবে দেখি আমরা কতটুকু সময় ব্যায় করি আমাদের নামাজকে এভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপন করার পেছনে। আমরা প্রতি রাকাতে কতটুকু সময় নিয়ে ভাবি আজ কোন কোন সুরা দিয়ে নামাজ পড়ব, কোন সুরা আমার মনের ভাবাবেগ সবচেয়ে সুন্দরভাবে আমার প্রভুর সামনে তুলে ধরবে, সুরা ফাতিহার পর দুতিনটে অর্থপূর্ণ সুরা দিয়ে সাজাই কি কখনো আমার নামাজের ডালি, কিংবা নতুন কিছু সুরা শিখি নামাজে ব্যাবহার করে নামাজটিকে বৈচিত্রময় করে তোলার জন্য? কখনো কি চেষ্টা করি সুরাগুলোর অর্থ মনে করে করে পড়ার যেন আমার মন আমার মুখ এবং শরীরের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমার সৃষ্টিকর্তার সাক্ষাতে? কখনো কি জানার চেষ্টা করি আমার রাসূল (সা) কিভাবে নামাজ পড়তেন যেন আমি তাঁকে অনুসরন করতে পারি? কখনো কি মনে পড়ে রুকু এবং সিজদায় দু’আ কবুল হয়, এই দু’টোকে সযত্নে সাজাই ধৈর্য্য স্থৈর্য্য এবং দু’আ দিয়ে? কখনো কি মনে হয় বিভিন্ন নবীরা এবং জ্ঞানি ব্যাক্তিরা যে দু’আ করেছেন তা শিখে নিয়ে নামাজে প্রয়োগ করি আমার প্রভুকে আমার প্রতি ক্ষমা এবং সন্তুষ্টিতে বিগলিত করার জন্য? কিংবা এমনভাবে ‘আল্লাহ’ শব্দটি উচ্চারণ করি যেন আমার হৃদয় হতে ভালবাসার আর্তনাদের মতই উত্থিত হয় সে ধ্বনি? কখনো কি মনে হয় আজ একটু বেশি যত্ন নিয়ে ওজু করি? আজ একটি সুন্দর পোশাকে আমার সৃষ্টিকর্তার সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাঁর এই উপহারের জন্য? কখনো কি মনে হয় নামাজের শেষে তড়িঘড়ি উঠে না গিয়ে কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলি তাঁর সাথে যিনি আমার সকল ভালমন্দ খবর নেয়ার জন্য কান পেতে বসে আছেন নিবিড় ভালবাসার সাথে, শুধু চাইবার অপেক্ষা? কিংবা কখনো কি ইচ্ছে হয় টুক করে একটা সিজদা দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যে তিনি আজকের দিনটি আমাকে সময় দিলেন বেঁচে থাকার অথচ আজই হাজার হাজার মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে, যে তিনি আজ আমাকে ট্রাফিক জ্যাম থেকে রক্ষা করেছেন অথচ হাজার হাজার মানুষ এখনো আটকা পড়ে আছে, যে তিনি আজ আমাকে ভাল খাইয়েছেন অথচ হাজার হাজার মানুষ আজ না খেয়ে কাটাবে, যে তিনি আমাকে নামাজ পড়ার সামর্থ্য দিয়েছেন অথচ আজ রাতে হাজার হাজার মানুষ একটিও নামাজ না পড়ে শুতে যাবে?

ভাবি অনেক কিছুই, কিন্তু তবু আমার নামাজগুলো কেন যেন টেবিল না হয়ে শুধু পিঁড়ি হয়ে যায়, কিছুতেই তৃপ্তি আসেনা। যে নামাজ আমাকেই শান্তি দেয়না তা কিভাবে আমার প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে? কি করে পাব সেই স্বপ্নের পৃথিবী, সেই নীল ঢেউ সাগর, সেই বৈচিত্র্যময় দ্বীপ যার সবটুকুই আমার?

সে যাক, সে না হয় আমার প্রভুর করুণার ওপর ছেড়ে দিলাম। তবে একটু যত্নশীল হলে আমরা প্রতিটি নামাজের পরই পেতে পারি অ্যাসর্টেড চকলেটের স্বাদ, শুধু প্রয়োজন ইচ্ছার আর উদ্যোগী হবার অপেক্ষা!

দুর্ঘটনা

রায়হানের এতক্ষণ মনটা খারাপ ছিল, এখন মেজাজটাও খারাপ হচ্ছে। যতক্ষণ প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাচ্ছিল না বাবা চিন্তিত হয়ে ছুটোছুটি করছিলেন, মা বিমর্ষ হয়ে বসে চুপচাপ দু’আ পড়ছিলেন। একটু আগে ডাক্তার এসে বলে গেল পা ভাঙ্গলেও ওর শরীরের আর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। ব্যাস, আশ্বস্ত হবার সাথে সাথে বাবার বকাবকি শুরু, ‘চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটিস? এতটুকু রাস্তা হেঁটে যেতে গিয়ে এতবড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটালি। দয়াময় আল্লাহ রক্ষা করেছেন, নইলে যে কি হত!’ মমতাময়ী মায়ের মায়ার দরিয়া বিলকুল শুকিয়ে গেল, বিশেষ বিশেষ বিশেষণ সহকারে তিনি তাঁর অপদার্থ সন্তানকে নসিহত করতে শুরু করলেন, ‘এত্তবড় ঢ্যাঙ্গা ছেলে, দেখে পথ চলতে পারিস না বাছাধন? সোনার চান পিতলা ঘুঘু আমার, আসার সময় দেখি কি সুন্দর জিনিসগুলো আমার রাস্তার ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। এই না হলে রাজপুত্র!’
একটু পর বড়চাচী হন্তদন্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে হাঁসফাঁস করতে করতেই বলতে শুরু করলেন, ‘দেখ তো রাবিয়া, রাতে না তোমাকে বললাম নাফিসাকে দেখতে তোমার বড়ভাই যাবে, আমি যাবনা? সকালে উঠে তোমার ভাই বলে, ‘মেয়েটা মনে কষ্ট পাবে, চল দু’জনেই যাই, তাড়াতাড়ি চলে আসব’। মুনিয়াও বলল, ‘অসুবিধা হবে না মা, আমি তো পড়ার টেবিলেই থাকব, কোন সমস্যা হলে আমি ছোটচাচীর বাসায় চলে যাব’। সকালে আর তোমাকে ফোন দিয়ে উঠতে পারিনি বোন। একটু আগে ফিরলাম, ঘরেও ঢুকিনি বোন, ছেলেটার কথা শুনে আর মন মানলোনা, সাথে সাথে এখানে চলে এলাম। ছোট তো বলল আল্লাহর রহমতে বেশি ক্ষতি হয়নি। কি রে বাবা, চাচী একবেলা মেয়েটাকে দেখতে গেলাম আর হিংসায় এই কান্ড ঘটিয়ে রেখেছিস? রাস্তাটাও পার হতে শিখলি না বাবা!’
মুনিয়া মিচকিটা তখন থেকেই চেপে চেপে হাসছে আর বন্ধুরা যখন সব শুনবে তখন সবাই মিলে ওকে নিয়ে কি পরিমাণ হাসাহাসি করবে তা সে কল্পনার দৃষ্টিতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আল্লাহর দুনিয়া থেকে কি দয়ামায়া উঠে গেল? রায়হানের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল প্রিয় বন্ধুর ওপর, ‘হায় বন্ধু! তুমি এ কি করলে! শেষপর্যন্ত ঠেলাগাড়ী অ্যাক্সিডেন্ট!’

সকালে দিব্যি পড়ার টেবিলে বসে পড়ার ভান করে করে খোয়াব দেখছিল আর গপাগপ গরম গরম পিঠা খাচ্ছিল। একটা শেষ করেই ছোটবোনটাকে হুকুম করছিল, ‘খুশি, যা তো, আরেকটা নিয়ে আয়’।
প্রতিবারই খুশির অর্ধেক আর ওর অর্ধেক। হঠাৎ ওর স্বপ্ন দেখায় ছেদ পড়ল। মা রান্নাঘর থেকে ডাক দিলেন, ‘রায়হান, বাবা যা তো এই পিঠা কয়টা তোর বড় চাচীকে দিয়ে আয়। ভাবী পাটিসাপটা খুব পছন্দ করেন। আর মুনিয়াটার জন্য কয়টা ভাপা পিঠা দিয়ে দিয়েছি, পথে যেতে যেতে খেয়ে ফেলিস না যেন’।
মা’র কথা শুনে খুশি খিলখিল করে হেসে ফেলল। বড়চাচার বাসা গলি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তাটা পেরোলেই, ভাইয়া বুঝি এর ভেতর সব ভাপা পিঠা সাবাড় করে দেবে! দুই বাসায় প্রতিদিনই আসাযাওয়া খাওয়াদাওয়া কথাবার্তা চালু থাকে। তাই এটা কোন বিশেষ ব্যাপার না। রায়হান লুঙ্গি পরেই রওয়ানা দিল।
ওর বড়বোন হাসি আর চাচীর বড়মেয়ে নাফিসা প্রায় সমবয়সী। হাসি হবার পর মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন বড় চাচী যে হাসিকে শুধু দেখাশোনা করেছেন তাই নয়, নিজের সন্তানের মতই তাকে দুধ খাইয়েছেন। মা শুধু হাসির ব্যাপারেই নয়, তাঁর সব সন্তানের ব্যাপারেই চাচীকে মায়ের মত সম্মান দেন, চাচীর দিক থেকেও ভালবাসার কমতি হয়না। মনে মনে রায়হানের ইচ্ছা লেখাপড়া শেষ হলে মাকে সাহস করে বলেই ফেলবে মুনিয়ার প্রতি ওর সুপ্ত আকর্ষনের কথাটা। তারপর অবশ্য কি ঘটতে পারে তা বড়চাচী ছাড়া আর কেউ জানেনা।
আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে রায়হান পাহাড়ের মত উঁচু করে অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িপাতিল নিয়ে অগ্রসরমান ঠেলাগাড়িটা দেখেইনি, ঠেলাওয়ালাও হাড়িপাতিলের পাহাড়ের পেছন থেকে তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছিলনা। সামনের দোকানেই ডেলিভারী, দোকানের সামনে ঠেলা দাঁড় করিয়ে ঠেলাওয়ালা দোকানদারকে ডাকল, দোকানদার দড়ি কেটে মাল নামাতে গিয়ে আবার ভাবল গাড়ীটা সামান্য আরেকটু সামনে নিলে দোকানের মুখটা বন্ধ হয়না। ঠেলাওয়ালা দোকনদারের কথামত ঠেলাটাকে একটু সামনে নেয়ার চেষ্টা করতেই চাকা একটা মাঝারী আকারের পাথরের সাথে বেঁধে গিয়ে ঝুপঝুপ করে হাড়িপাতিল পড়তে শুরু করল। রায়হান তখন পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। আচমকা মাথার ওপর হাড়িপাতিলের বৃষ্টিতে দিশাহারা হয়ে সে রাস্তার পাশের পরিবর্তে রাস্তার মাঝে দৌড় দিল। ওদিক থেকে আসছিল আরেক ঠেলাগাড়ী, ঠেলাভর্তি আলুর বস্তা। লুঙ্গি পরে দৌড়ে অনভ্যস্ত রায়হান লুঙ্গিতে পা পেঁচিয়ে সেই আলুভর্তি ঠেলাগাড়ীর সামনে পড়ে গেল, ঠেলাওয়ালা সামাল দিয়ে ওঠার আগেই একটা চাকা এসে পড়ল ওর ডান পায়ের ওপর। অমনি মড়াৎ করে হাড় ভাঙ্গার শব্দ, প্রচন্ড ব্যাথার অনুভূতি, কোথায় গেল টিফিন ক্যরিয়ার আর কোথায় গেল খোয়াব। স্থানীয় লোকজন দ্রুত ওদের বাসার নীচে স্টেশনারীর দোকান থেকে ওর বাবাকে ডেকে নিয়ে এলো, কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে ওকে ট্যাক্সিতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে এলো, কিছুক্ষন পর মা এসে হুলস্থুল কান্না, খুশিটার চেহারাও থমথমে, বাবা পাগলের মত ছুটোছুটি করছেন আর রায়হানের ব্যাথায় দুনিয়াদারী বিস্বাদ লাগছে। এখন বিকাল, ডাক্তার বলেছেন ঐ হাড্ডি ভাঙ্গা আর কিছু কিছু জায়গায় ছড়ে যাওয়া ছাড়া তেমন বিশেষ ক্ষতি হয়নি। প্লাস্টার করে দিলে কয়েক মাসের ভেতরেই সে আবার স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে। আর তারপর শুরু হোল এই অধ্যায়।

সন্ধ্যায় প্লাস্টার করা শেষ হবার পর ডাক্তার সবাইকে চলে যেতে বললেন, রোগীর বিশ্রাম প্রয়োজন। শুধু বড়চাচা রয়ে গেলেন, খুব খুশি যে এই উসিলায় কিছুক্ষণ চাচীর খবরদারী ছাড়া একটু শান্তিমত বসে পেপার পড়বেন। সারাদিনের ধকল আর বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে যাওয়ার স্বস্তি থেকে রায়হানের চোখ লেগে এলো।

আরে! ও তো এখনো পড়ার টেবিলে! কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে ও ওর শরীরের ভেতর নেই, সব অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে, কিন্তু নিজেকে যেন সে দেখছে শরীরের বাইরে থেকে। ঐ তো খুশি আর ও মিলে পিঠা খাচ্ছে। হুকুম করা মাত্র ছুটে গিয়ে পিঠা নিয়ে আসছে খুশি, ছোট্ট বোনটার জন্য ওর মায়া উথলে উঠছে, কিন্তু চেহারায় কিছু বোঝা যাচ্ছেনা, শুধু চোখ দু’টো মায়াময় হয়ে উঠছে। ঐ যে রান্নাঘর থেকে মা ডাক দিলেন, ‘রায়হান, বাবা যা তো এই পিঠা কয়টা তোর বড় চাচীকে দিয়ে আয়। ভাবী পাটিসাপটা খুব পছন্দ করেন। আর মুনিয়াটার জন্য কয়টা ভাপা পিঠা দিয়ে দিয়েছি, পথে যেতে যেতে খেয়ে ফেলিস না যেন’। খুশিটা খিল খিল করে হাসছে। ওর মনে একটু শিহরণ দোলা দিয়ে যায়, মুনিয়াকে একনজর দেখে আসা যাবে।
রাস্তা দিয়ে হাঁটছে রায়হান আর ভাবছে লেখাপড়া শেষ হলে মাকে সাহস করে বলেই ফেলবে মুনিয়ার প্রতি ওর সুপ্ত আকর্ষনের কথাটা। তারপর অবশ্য কি ঘটতে পারে তা বড়চাচী ছাড়া আর কেউ জানেনা। পাশে একটা ঠেলাগাড়ির ওপর পাহাড়ের মত উঁচু করে অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িপাতিল রাখা, দড়ি কাটা অবস্থায় ঠেলাওয়ালা গাড়ীটাকে সরানোর চেষ্টা করছে, পাগল নাকি! রায়হান সাবধানে সরে গেল আর একটু পর টপাটপ হাঁড়িগুলো পড়তে শুরু করল বৃষ্টির মত। যাব্বাবা, বিশাল বাঁচা বেঁচে গেল!
একটু এগোতেই মোড়ের চায়ের দোকান থেকে কানে ভেসে এলো হিন্দি গানের আওয়াজ, কি বিশ্রী কথাগুলো! শুনতে এত খারাপ লাগে অথচ শরীরে শিহরণ ধরিয়ে দেয়, ওরা যদি জানত এই গানের অর্থ কি তাহলে কি এভাবে বাজাত পারত? বড় রাস্তার ওপাড়ে বিশাল বিলবোর্ডে একটা মেয়ের অর্ধনগ্ন ছবি, কি অশ্লীল বিজ্ঞাপন রে বাবা, কিন্তু চোখ ফেরানো যায়না, ওর শরীরে কাঁপন ধরে। রাস্তা পেরোতেই কয়েকটা উঠতি বয়সের মেয়ে দেখতে পেল, একটারও ওড়না নেই, রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে তরল হাস্যলহরীতে চারিদিক মুখরিত করছে, আশেপাশে লোকজন চকিতে ফিরে চাইছে, মোড়ে কয়েকটা ছেলে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কোন খবর নেই। ভাল ছেলে হলেও রায়হানের মনে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় এই মধুর আওয়াজে। সামনেই বড়চাচার বিল্ডিং। যাক, অতটুকু পৌঁছতে পারলে বড়চাচীর চেহারাটা দেখে সব শয়তান উড়ে যাবে মন থেকে।
অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজাচ্ছে রায়হান কিন্তু কেউ খুলছেনা, গেল কই সব? ফিরে যাবে ভেবে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে এমন সময় আস্তে করে দরজাটা একটু ফাঁক হোল, মুনিয়ার গলা, ‘ও, ভাইয়া তুমি? আসলে বাসায় কেউ নেই তো, তাই দরজা খুলছিলাম না, মা’র কাছে এসেছিলে? মা তো আপুকে দেখতে কুমিল্লা গেছে’।
রায়হানের মাথায় শুধু এটুকুই ঢুকল, ‘বাসায় কেউ নেই’। হিন্দি গানটা জোরে জোরে মাথার ভেতর বাজতে শুরু করল। সে বলল, ‘দরজা খোল, মা পিঠা দিয়েছে, দিয়ে যাই’।
মুনিয়া ইতস্তত করছিল, কিন্তু রায়হানের কানের ভেতর কে যেন ফিসফিস করছে, ‘এটাই সুযোগ, এখনই সুযোগ’। ওর হৃৎপিন্ডের গতিবেগ অস্বাভাবিক বেড়ে চলেছে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে সে। সে বলল, ‘দরজা খোল, মা তোর জন্য ভাপা পিঠা দিয়েছে’।
মুনিয়া দরজাটা খুলতেই ওড়নায় আবৃত ওর উজ্জ্বল চেহারাটা দেখা গেল, হাত বাড়িয়ে দিল সে টিফিন ক্যারিয়ারের জন্য। রায়হানের মাথায় বিলবোর্ডের ছবিটা ভেসে উঠল। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। তারপর আর সে জানেনা সে কি করছে। মুনিয়ার চিৎকার, কান্না, গোঙানো, ফোঁপানো সব হারিয়ে গেল রাস্তার মেয়েগুলোর হাস্যলহরীর পেছনে। যখন সে সম্বিত ফিরে পেলো তখন সে পুরোপুরি পশুতে রূপান্তরিত হয়েছে, মুনিয়ার চোখে একরাশ ঘৃণা। উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়ে পালাল রায়হান ওখান থেকে। সে তো এমন নয়, সে তো মুনিয়াকে ভালবাসে, সে তো এমন করার কথা নয়, বাবামা কি বলবেন, চাচাচাচী কি বলবেন, খুশিকে সে কিভাবে মুখ দেখাবে, আর হাসি আপার রাগী চেহারাটা মনে করে ওর অন্তরাত্মা উড়ে গেল। পাগলের মত দৌড়াচ্ছে সে, জানেনা কোনদিকে। হঠাৎ একটা ট্রাক ওকে চাপা দিল। শরীরের বাইরের রায়হান এগিয়ে গিয়ে দেখল শরীরী রায়হান পড়ে আছে বড় রাস্তার ওপর, ওকে দেখতে মনে হচ্ছে যেন ভাঙ্গা মাটির হাঁড়ি, চেহারাটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে চারিদিকে আর যে মগজটা একটু আগে পর্যন্ত ওকে পরিচালিত করছিল সেটা লেপ্টে আছে পথের ওপর।

‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ শব্দে জেগে উঠল রায়হান, সমস্ত শরীর ঘামে চুপচুপে ভেজা, হাঁপাচ্ছে সে। রুমে শুধু বড়চাচী। ওকে জেগে উঠতে দেখে তিনি চেয়ার থেকে উঠে এসে ঘাম মুছিয়ে, জামা বদলে ওজু করিয়ে দিলেন। ইশারায় নামাজ সেরে রায়হান ভাবতে লাগল সে কি দেখল।

‘কি রে, অমন ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছিস কেন?’
হাসি আপার গলা না? একটু আগে সে আবার দেখতে পাচ্ছিল সে পড়ে আছে বড় রাস্তার ওপর, ওর চেহারাটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে চারিদিকে আর মগজটা লেপ্টে আছে পথের ওপর। কিন্তু হাসি আপার চেহারাটা এই দৃশ্যের চেয়েও ভয়ংকর। আপু কখন এলো? চোখ খুলে দেখল জানালা দিয়ে আসা আলো জানান দিচ্ছে সকাল ন’টা দশটা তো হবেই। দুলাভাইকে দেখে সে বুঝতে পারল আপু নিশ্চয়ই সারারাত জার্নি করে এসেছে। আসলে যতই বকা দিক না কেন, আপু আসলে ওকে অনেক ভালবাসে।
‘কংগ্র্যাচুলেশন্স শ্যালক মহাজন!’, হাস্যোদ্দীপ্ত চেহারা দুলাভাইয়ের।
হেসে ফেলল রায়হান, ‘কেন, ঠেলাগাড়ীর নীচে পড়ে পা ভাঙ্গার জন্য?’
‘তা পা ভেঙ্গে যদি আসল উদ্দেশ্য হাসিল হয় তাতে পা ভাঙ্গার কষ্ট উসুল হয়ে যায় না?’
‘মানে?’
‘মানে তুমি মাস্টার্স পাশ করলেই তোমার শাদী মুবারাক!’
‘যাও তো, তুমি বেশি বেশি আহ্লাদ দাও ওকে’, বাঁধা দিলেন হাসি আপা, ‘শোন, আব্বাসকে ফোন করে বল আম্মাকে এতদূর থেকে টেনেহেঁচড়ে আনার দরকার নেই। বেচারী বুড়োমানুষ, কষ্ট হবে। একবারে বিয়ের সময়ই নিয়ে আসব ইনশাল্লাহ’।
‘যো হুকুম ম্যাডাম, শ্যালক মহাজন, শেখো কিভাবে বৌয়ের হুকুম তামিল করতে হয়, তোমার আর বেশি দেরী নাই’।
হাসি আপা চোখ রাঙ্গাতেই দুলাভাই রুমের বাইরে পগাড় পার।
‘শোন, আমি সকালে সবার সাথে কথা বলেছি। বড় আব্বা বড় আম্মা রাজী, বাবামা খুশি, মুনিয়ারও আপত্তি নেই। নাফিসা আর আমি এত দূরে থাকি যে আমরা সবাই চাই একটা বোন অন্তত আমাদের বাবামাদের দেখাশোনার জন্য কাছাকাছি থাকুক। তুই যে রাজী সেটা বলার দরকার নেই, ওর কথা শুনলেই তোর চেহারা ১০০ ওয়াটের বাল্বের মত জ্বলে। এখন জনাব, কষ্ট করে মাস্টার্সটা পাস কর। নে, তোর বই খাতা নিয়ে এসেছি। পা ঝোলানো তো কি হয়েছে? পা দিয়ে তো আর পড়বিনা। নে, বই হাতে নে!’

বড় আপা চলে গেলেন শাশুড়ির সাথে কথা বলতে। অবশেষে সব পরিষ্কার মনে হোল রায়হানের কাছে। যদি ওর ঠেলাগাড়ীর নীচে পড়ে ঐ অপমানজনক অ্যাক্সিডেন্টটা না হত তাহলে ট্রাকের নীচে অ্যাকসিডেন্ট হত। যদি ঐ দুর্ঘটনা না হত তাহলে আজ তার মুনিয়ার সাথে বিয়ের কথা না হয়ে কি হতে পারত তা ভাবতেই সে শিউরে ওঠে। বন্ধুর ওপর সব রাগ পানি হয়ে যায়। আপনিই নুয়ে আসে মাথাটা কৃতজ্ঞতায়। বালিশে পাশ ফিরে ইশারায় সিজদা করে রায়হান, ‘হে আমার রব্ব, নিশ্চয়ই তোমার প্রতিটি সিদ্ধান্ত কল্যাণময়। আমি তোমার সকল সিদ্ধান্ত পরিপূর্ণ বিশ্বাস এবং আনুগত্যের সাথে মেনে নিচ্ছি’।

অক্টোবরের পালাবদল




মৌসুম বদলের সময়টা আমার খুব ভাল লাগে, বিশেষ করে যখন শীত আসি আসি করে। এক একটি ঋতু তার সবকিছু উজার করে দিয়ে বিদায় নেয়, আরেকটি ঋতু আসে তার উপহারের ডালি নিয়ে, প্রকৃতির রঙ বদলায়, বদলায় মানুষের মনের রঙও। বড় হয়েছি আবুধাবীতে, উত্তপ্ত উষর মরু আবহাওয়ার মাঝে। তারপর ছিলাম মাদ্রাজ যেথা চিরবসন্ত বিরাজ করত সারাবছর, অবশ্য চিরগ্রীষ্ম বললে বেশি সঠিক হয়। তাই বৃষ্টি আর শীতের প্রতি ছিল এক অবর্ণনীয় আকর্ষন। ক্যানাডায় যখন শীত আসি আসি করে প্রকৃতি নানান রঙে সেজে ওঠে। অল্প ক’টি দিনের জন্য গাছে গাছে পাতাগুলো লাল, কমলা, হলুদ হয়ে সোনাঝরা রঙে রাঙ্গিয়ে দেয় প্রতিটি ডালপালা। তারপর একদিন হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া জানান দেয় শীতের আগমন, সোনাঝরা পাতাগুলো ঝরে গিয়ে পড়ে থাকে পথেপ্রান্তরে। তারপর একদিন সমস্ত প্রকৃতিকে শ্বেতশুভ্র বসনে আবৃত করে দেয় পুতঃপবিত্র ধবল তুষার। আবার একদিন হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে তুষার ভেদ করে বেরিয়ে আসে ডালপালা পত্রপল্লববিহীন একটি কুঁড়ি, বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে, চোখের নিমিষে কোথা হতে যেন কচি হরিৎ পত্রপল্লবে সেজে ওঠে প্রকৃতি। তারপর একদিন বহু আকাঙ্খিত বৃষ্টি প্রকৃতিকে পূর্ণতা দান করে, সজীব করে তোলে, প্রতিটি রংকে করে তোলে আরো আকর্ষনীয়, আরো মোহনীয়। কোথায় যেন এর সাথে মানুষের জীবনের মিল খুঁজে পাই। অল্প ক’দিনের যৌবন আমাদের শরীর মন মননে ফাগুনের রঙ জ্বালিয়ে দেয়, তারপরই নেমে আসে বার্ধক্যের নিস্তব্ধতা, একদিন নীরবে চলে যাব এই পৃথিবীর সমস্ত মোহমায়া ছেড়ে, তারপর যদি ওপাড়ে ফুল হয়ে ফুটতে পারি তাহলেই বর্ষিত হবে আমার প্রভুর করুণাধারা যা আদ্যোপান্ত পুরোটাকেই পূর্ণতা দান করবে, নতুবা বাঁধভাঙ্গা বন্যায় ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মত অর্থহীন হয়ে যাবে সব, কিছুই অবশিষ্ট রইবেনা।

প্রকৃতির এই বৈচিত্রকে আরো রঙিন করে তোলার উদ্দেশ্যেই বুঝি সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন যেন তারা একে অপরের মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পায়, একে অপরকে ভারসাম্য বজায় রেখে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হতে সহযোগিতা করতে পারে। প্রত্যেক স্বামীস্ত্রীর মাঝেই দেখা যায় একজন গরম পছন্দ করে, আরেকজন শীত। বলাই বাহুল্য যেহেতু আমার পছন্দ শীত এবং বর্ষা, হাফিজ সাহেবের দু’টোই খুব অপছন্দ। গত বছর প্রথম তুষারপাতের পরদিন আমরা এক জায়গায় যাচ্ছি, শীতের প্রথম ধাক্কায় কুপোকাত হাফিজ সাহেব বলছেন, ‘কবে যে গ্রীষ্ম আসবে!’
বললাম, ‘মাত্র তো শীত এলো, আমাদের কত খুশি লাগছে, আপনি কেন গ্রীষ্মের জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছেন?’
উনি বললেন, ‘গরম তবু সহ্য করা যায়, শীত একেবারেই সহ্য করা যায়না’।
বললাম, ‘কথা সত্য নয়। গায়ে কাপড় জড়িয়ে কিংবা আগুন জ্বালিয়ে শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু গরমের থেকে রক্ষা পাবার জন্য কি করা যায়? যদি বাইরে বাতাস না থাকে তাহলে পাখার বাতাসেও শরীর জুরায় না, গরম পানি খেয়েও বা কি তৃষ্ণা মেটে? সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছেন মানুষ শীত সহ্য করতে পারে কিন্তু গরম সহ্য করতে পারেনা, কারণ তিনি দোজখের শাস্তি বরফ দিয়ে নয় আগুন দিয়ে তৈরি করেছেন, ফুটন্ত গরম পানি পান করতে দেবেন বলেছেন যা দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ হয়না’।
‘হুমম, যুক্তি আছে বটে!’, স্বীকার করতে বাধ্য হলেন হাফিজ সাহেব।

অক্টোবর মাসটা ঘুরেফিরে আমার জীবনে বিদায়ী মাস হিসেবেই আসে। দশটি বছর আবুধাবীকে বাড়ী জেনে শেষে বাড়ী ফিরেছিলাম এক অক্টোবরে। সেই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা সমুদ্রের সুনীল ফেনিল জলরাশি, জানালার পাশে মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসা আজানের শব্দ, সকাল সন্ধ্যা কার্টুন দেখা, পার্কে বসে শাওয়ার্মা খাওয়ার স্মৃতি পেছনে ফেলে পাড়ি জমালাম বাংলাদেশে।

কুড়িটি বছর বাবামার বাড়ীকে নিজের ঘর জেনে আরেকজনের ঘর করতে ঘর ছেড়েছিলাম তাও এক অক্টোবরে। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দু’টো কাজের একটি করেছিলাম সেদিন। আমার বিয়েতে হলুদ, লাইটিং, গানবাজনা, যৌতুক আদানপ্রদান কিছুই হয়নি। তবে একমাত্র অনুষ্ঠানটিতে বাবা, মা, দুই ভাই, মামা, ভাইয়া, কাজের লোকজন এমনকি হবু শাশুড়ি আম্মা পর্যন্ত আমার দেয়া কাপড় পরে এসেছিলেন। তিল তিল করে বেতনের টাকা জমিয়ে জিনিসগুলো নিজে পছন্দ করে কিনেছিলাম। অন্য কাজটি করেছিলাম এর কয়েক বছর আগে। বাবামার বিয়ে হয়েছিল একাত্তরের পনেরোই ডিসেম্বর। চট্টগ্রাম শহরে তখন হুলস্থুল বোমা পড়ছে, সবাই ভাবছিল যুদ্ধ কবে না কবে শেষ হয়, মাত্র কয়েকজন মিলে বিয়ে পড়ানো হয় বাড়ির সিঁড়িঘরের নীচে, অনেকটা বোম শেল্টারের বিকল্পের মত। মা ছিল গ্রামের মেয়ে, শাড়ি গহনা যা হোক না হোক কিন্তু টিকলী দেয়া হয়নি তাতে খুব মন খারাপ হয়। ওদিকে বিয়ের পর যুদ্ধের শহর নিরাপদ নয় ভেবে মাকে বাড়ী রেখে আসতে বাবা যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ী, পকেটে মাত্র দু’খানা টাকা সম্বল। কর্ণফুলি নদী পাড় হবার আগে এক লোক নিজেকে রাজাকার পরিচয় দিয়ে টাকা দু’টো ছিনিয়ে নিয়ে যায়, নদী পাড় হয়ে বাবা শোনে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে! তখন ঐ দু’টাকার জন্য আফসোসের সীমা নেই। শ্বশুরবাড়ী গিয়ে দেখে সাধ্যমত আয়োজন করা হয়েছে কিন্তু যুদ্ধাবস্থার মাঝে জামাইকে ভাল ঘড়ি দেয়া সম্ভব হয়নি। বাবামার পঁচিশতম বিবাহ বার্ষিকী বিয়ের মত করেই আয়োজন করা হয়। দেশ বিদেশ থেকে সমস্ত আত্মীয় পরিজন বন্ধুবান্ধব একত্রিত হয় এই অনুষ্ঠানের জন্য। তার ছ’মাস আগে থেকে সিজিএসে কাজ করছিলাম, টাকা জমাচ্ছিলাম একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। অবশেষে সেবার বাবাকে একটি ভাল ঘড়ি আর ছোটভাই আহমদের পরামর্শে মাকে টিকলীর পরিবর্তে একজোড়া ভাল কানের দুল উপহার দেই আমরা তিন ভাইবোন।

দশ বছর শ্বশুরবাড়ীকে বাড়ী জেনে অবশেষে সেই বাড়ীও ছেড়ে আসি আরেক অক্টোবরের শেষে। আমি যখন সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম, সাথে বাচ্চা আর পাঁচ ছ’টা ব্যাগ, আব্বা মসজিদের পথে আধরাস্তা থেকে ফিরে এসে রাদিয়াকে কোলে তুলে নিতেন, আমাদের ওপরতলায় পৌঁছে দিয়ে আবার মসজিদে যেতেন। আম্মা মাছ বা মাংসের যে টুকরোটা আমি পছন্দ করি তা আমার জন্য তুলে রেখে শুতে যেতেন। আমার কোন বোন নেই, তাই এখানে এসে পাঁচ পাঁচটা বোন পেয়ে হৃদয়ের সমস্তটুকু ওদের উজার করে দিয়ে ভালবেসেছিলাম। বিয়ের পর আব্বার চারতলা বিল্ডিংয়ের মাথার ওপর দু’খানা রুম আর এক বাথরুমের ঘর করে নিয়েছিলাম হাফিজ সাহেব আর আমি,আমাদের কোন চুলো ছিলোনা, ছিলোনা একটা চামচও, কিন্তু এর প্রতিটি ইটের সাথে মিশে আছে আমাদের পরিশ্রম আর আব্বার মায়া। সমস্ত মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমাতে হোল বিদেশ বিভুঁইয়ে, জীবিকার তাগিদে।

আরেকটি বাড়ী ছিল আমার। ঠিক আট বছর ধরে এই বাড়ীতে হাজার হাজার মানুষের সাথে পরিচয় আর ওঠাবসা হয়েছে, স্মৃতিতে গেঁথে আছে কিছু নাম কিছু চেহারা কিছু বেদনা আর অনেক অনেক ভালবাসা, এই সেই বাড়ী যেখানে যতটুকু দিয়েছি তার চেয়েও অনেকগুন বেশি পেয়েছি। এটা ছিল আমার কর্মস্থল, কিন্তু মানুষগুলো কেবল সহকর্মী ছিলোনা, ছিল সহমর্মী এবং বিপদের বন্ধু। যখন শরীর খারাপ হয়েছে তখন টাকাপয়সা থেকে সহযোগিতা, যখন মন খারাপ হত তখন সমবেদনা থেকে সান্তনা, ঈদের বাজার করা থেকে পিয়নের বিয়ে খেতে গ্রামযাত্রার আনন্দ সবই পেয়েছি এখানে। সেই আশ্রয়স্থল ছেড়ে চলে আসি আরেক অক্টোবরে পাঁচখানা ফেয়ারয়েল নিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে কোন শিক্ষকের বিদায় উপলক্ষ্যে ফেয়ারওয়েলের তেমন একটা চল নেই। সানজিদা যখন চলে গেল তখন ইফেতেখারউদ্দীন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষকদের সবাইকে একত্রিত করে একটি রেস্টুরেন্টে বিদা‍য় সম্বর্ধনার আয়োজন করেন। আমার মহিলা সহকর্মীবৃন্দ বিদায় দেন তিনবার, যেন যেতে নাহি দিব, হায় তবু যেতে দিতে হয় তবু চলে যায়! আমরা বছরের পর বছর একসাথে কাজ করেছি, স্টাডি ট্যুরে গেছি, ট্রেনিং ক্যাম্পে রাতদিন একত্রে কাটিয়েছি, একজনের বিয়ে প্রমোশন কিংবা নতুন বাড়ী উপলক্ষ্যে দলবেঁধে আনন্দ করেছি, একের অসুস্থতা বা পরিবারে কারো মৃত্যুতে সদলবলে ছুটে গেছি সাহস জোগাতে, একের ভুলে সবাই হেসেছি আবার সবাই মিলেই ঠিক কাজটি করতে শিখেছি। সেই সাথীদের কি বিদায় জানানো যায়? তাই যেদিন চলে আসব তার আগের দিন সালমা আপা এসে কাপড় ভাঁজ করে বাক্সে ভরে দিয়েছেন, ফাহমিদা এসে বাচ্চাদের কাপড় আর চাদর পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। ডিপার্টমেন্টের সকল শিক্ষক মিলে ডিপার্টমেন্ট অফিসে বিদায় দেন একবার, কেউ কেউ বাসায় দাওয়াত করেন আবার কেউ কেউ বাসায় দেখা করতে আসেন চলে আসার অব্যবহিত পূর্বে। তবে সবচেয়ে স্পর্শ কাতর বিদায়ী অনুষ্ঠান ছিল ছাত্রীদের পক্ষ থেকে যেহেতু এটা ছিল আশাতীত। এমনটা সম্ভবত সেবারই প্রথম। আট বছরে এদের কাউকে অনার্সে পড়িয়েছি, কাউকে মাস্টার্সে পড়িয়েছি, কাউকে আদ্যোপান্ত পড়িয়েছি, কাউকে কম্পিউটার সাইন্স বা এমবিএর কোন কোর্স পড়িয়েছি, কাউকে অন্য বিষয়ে জ্ঞান দান করেছি, কাউকে কিছুই দিতে পারিনি, কারো সাথে স্টাডি ট্যুরে গছি, ওদের সম্বর্ধনা এবং বিদায় দিয়েছি, কারো বিয়ে খেতে গেছি, কাউকে হাসপাতালে দেখতে গেছি, কাউকে কবর দিতে দেখেছি, কাউকে উপদেশ দিয়েছি, কাউকে সান্তনা দিয়েছি, কাউকে বকা দিয়েছি, কেউ কেউ ছাত্রী থেকে সহকর্মীতে পরিণত হয়েছে- এই বিশাল মেলার প্রাক্তন, বর্তমান, হবু ছাত্রীদের যারাই খবর পেয়েছে ছুটে এসেছে। সবটার পেছনে প্রচ্ছন্নভাবে হাত ছিল সালমা আপার যার সাথে আট বছর ধরে একই রুমে সংসার পেতেছিলাম। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে আমাদের বিগত দিনগুলোর খন্ডচিত্র তুলে ধরে এক স্মৃতিবিধুর পরিবেশ সৃষ্টি করেন তিনি। সহকর্মী বান্ধবীরা এবং ছাত্রীরা স্মৃতিচারন করতে গিয়ে বাঁধভাঙ্গা অশ্রু দিয়ে আমার হৃদয়কেও প্লাবিত করে। কিশোরী ছাত্রীরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কত কি যে উপহার দেয়! প্রত্যেকটিই অসাধারন। তবে আমাকে সবচেয়ে স্পর্শ করে দু’টি উপহার। একটি সেমেস্টারের ছাত্রীরা আমাকে একটি তালাচাবিযুক্ত ডায়রী উপহার দেয়, এর পাতায় পাতায় তারা ময়ুরের পেখমের মত মেলে ধরেছে তাদের ধ্যানধারণা চিন্তাভাবনা অনুভূতি, আমার মনে হয় যেন ডায়রী নয় বরং ওদের হৃদয়ের চাবিটাই ওরা সমর্পণ করেছে আমার হাতে! অনুষ্ঠানের শেষে কয়েকজন ছাত্রী মুখোমুখি বসে আমার সাথে গল্প করছিল। হঠাৎ সালেহার কি মনে হোল, সে নিজের ব্রুচটা খুলে আমার স্কার্ফে লাগিয়ে দিয়ে একটা সন্তুষ্টির হাসি হেসে বলল, ‘ওটা ওখানেই বেশি ভাল মানাচ্ছে!’

আজ আরেক অক্টোবরে আমার গত চারবছরের নিবাস ছেড়ে চলে এলাম অন্যত্র। ক্যানাডায় আসার পর ওটাই ছিল আমার home away from home. এ’বাড়ীর প্রতিটি কোণে আমার সন্তানদের বিচরণের স্মৃতি, বন্ধুদের আসাযাওয়া, দাওয়াত খাওয়া, কত হাসি আনন্দ আবার দুঃখকষ্টের ভাগাভাগির কাহিনী! ঈদের আগের দিন চাবি পেলাম নতুন বাড়ীর, গত ক’দিন এ’বাড়ী ও’বাড়ী দৌড়াদোড়ি করতে করতে, জিনিসপত্র বাঁধতে আর খুলতে, গুছাতে, পরিষ্কার করতে আর সারা শরীরের প্রচণ্ড ব্যাথায় টেরই পাইনি এই বাড়ী এখন আর আমার নেই। শেষ যেদিন চাবি দিয়ে চলে এলাম তখন অনুভূতিটা ধাঁ করে ধাক্কা দিল মনে যে এ’বাড়ীর জানালা দিয়ে আমার আর আকাশ দেখা হবেনা, ট্রেনের শব্দ কিংবা পুলিশের সাইরেন শোনা হবেনা, ছেলেমেয়ে স্কুলে যাবার সময় চেয়ে থাকা হবেনা।

এভাবেই হয়ত কোন এক অক্টোবরে আমার এই অস্থায়ী জীবনের প্রথম এবং শেষ আশ্রয়স্থল, এই পৃথিবীটার সাথেও আড়ি হয়ে যাবে। আজ এক প্রাক্তন সহকর্মী ভাই যিনি ইউ কেতে পিএইচডি করছেন, বার্তা দিয়ে জানতে চাইলেন ক্যানাডায় সেটল হব কিনা। এক মূহূর্তও না ভেবে জানালাম, ‘একবারে কবরে গিয়েই সেটল হব ভাই’। তবে সেটাও অস্থায়ী। বাকীটুকু আমার প্রভুর করুণার ওপর নির্ভরশীল।

শিশুদের বিয়ে ভাবনা

আমার সদ্য ছ’বছরে পা দেয়া পুত্র রিহাম এবং ওর বন্ধুরা আজকাল ‘বিয়ে’ বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত। বিষয়টি ওদের কাছে নতুন এবং অতন্ত অস্পষ্ট ঠেকছে।
এই সেদিন পুত্র এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু, তোমার কি বিয়ে হয়েছে?’
বললাম, ‘হয়েছে তো!’
‘কবে?’
‘অনেক আগে।’
‘তুমি কাকে বিয়ে করেছ?’
‘আব্বুকে।’
‘তাই নাকি? বল কি? কখন বিয়ে করলে? হা হা হা, কি মজার ব্যাপার! আপু, আম্মু নাকি আব্বুকে বিয়ে করেছে!’

এতটুকুর ওপর ছাড়া পেয়ে বর্তে গেলাম। আমার মেয়ে রাদিয়ার তখন তিনবছর বয়স। সে বিয়েতে যেতে খুব পছন্দ করে। কার কাছে যেন আমার বিয়ের কথা শুনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু, তোমার বিয়ে হয়েছে?’
বললাম, ‘জ্বি মা, হয়েছে’।
ও বলল, ‘আমি ওদের বলেছি, ‘তোমরা কিচ্ছু জানোনা, আমার আম্মুর বিয়ে হয়নি, বিয়ে হলে আমার আম্মু আমাকে অবশ্যই নিয়ে যেত’। তুমি আমাকে না নিয়ে কি করে বিয়ে করতে যেতে পারলে?’
ওর চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে বিশ্বাস করতে পারছেনা আমি কিভাবে ওর সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলাম!

আমার পুত্র প্রচন্ড নারীবিদ্বেষী। মা আর বোন ছাড়া সে মেয়েদের সহ্য করতে পারেনা। স্কুলে ওর খেলার সাথী ছোটবড় সব ক্লাসের ছেলেরা। তাদের মাঝে ক্লাস ফোর পড়ুয়া এক আরব ছেলে হারিসকে ওর খেলার সাথী হিসেবে খুব পছন্দ। বিয়ে করলে একসাথে থাকা যায় শুনে সে প্রথমে রাদিয়ার ভারতীয় বান্ধবী ধ্যানীকে অনুরোধ করল, ‘তুমি কি ওকে বিয়ে করতে পার? তাহলে তুমি আপুর সাথে খেলতে আসলে আমি হারিসের সাথে খেলতে পারব!’
সেভেনে পড়া ধ্যানী মজা পেয়ে বলল, ‘আমি তো ওর চেয়ে অনেক লম্বা, তাই ওকে বিয়ে করতে পারবনা’।
তখন সে মরিয়া হয়ে রাদিয়াকে বলল, ‘তাহলে তুমি কি হারিসকে বিয়ে করতে পার, প্লিজ?’
রাদিয়াও যখন বলল সে হারিসকে বিয়ে করতে পারবেনা তখন রিহাম মনে বড় কষ্ট পেল।

তার ক’দিন পর রিহাম আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু, আমাদের বাসায় আরেকটা বেবি আসবে কবে?’
আমি বললাম, ‘যখন তুমি বিয়ে করবে তখন’।
রাদিয়া মজা পেয়ে বলল, ‘রিহাম, তুমি কাকে বিয়ে করবে?’
রিহাম বলল, ‘আম্মু, আমি কি হারিসকে বিয়ে করতে পারি?’
আমি বললাম, ‘ছেলেরা ছেলেদের বিয়ে করতে পারেনা, তোমার কোন মেয়েকে বিয়ে করতে হবে’।
ও মাথা চুলকে বলল, ‘তাহলে আমি আপুকে বিয়ে করব’।
রাদিয়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, বলল, ‘মানুষ নিজের পরিবারের কাউকে বিয়ে করতে পারেনা, তোমার পরিবারের বাইরে কাউকে বিয়ে করতে হবে’।
রিহাম অনেকক্ষণ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, ‘আচ্ছা, তাহলে আমি ধ্যনীকে বিয়ে করব!’

আজ আমার আট বছর বয়সী ছাত্রী শামিলা বলল, ‘আন্টি, আমি না তোমার হাজব্যান্ডকে দেখেছি!’
হাসি চেপে পাকা বুড়িটাকে বললাম, ‘তাই?’
সে বলল, ‘আন্টি, তোমাদের কোথায় দেখা হয়েছিল?’
বললাম, ‘যখন আমি ওনাকে বিয়ে করে গেলাম তখন’।
সে হতবাক হয়ে বলল, ‘বল কি? তোমাদের তার আগে দেখা হয়নি? তাহলে তুমি তাকে খুঁজে পেলে কি করে? কি করে বুঝলে যে তাকেই তোমার বিয়ে করার কথা? আমি ভীষণ কনফিউজড! ’
ওর কনফিউশন দেখে হাসি পেয়ে গেল।

আমাদের হাসি দেখে রিহামের পাকিস্তানী বন্ধু বাসিল বলল, ‘শোন, এসব সিরিয়াস কথার মাঝখানে তোমরা হাসছ কেন? আমার আম্মু শুধু আমার আব্বুকে বলে ‘আমাকে বিয়ে কর, আমাকে বিয়ে কর’। কিন্তু আমার আব্বু বলে, ‘পরে করব’। এটা কি কোন ভাল কথা?’
বুঝলাম ওর বাবামা হয়ত ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী করার কথা আলাপ করছিল, সে ধরে নিয়েছে এটাই বিয়ের অনুষ্ঠান! শামিলা আর আমি ওর কথা শুনে কিছুতেই হাসি থামাতে পারছিনা, সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি এত সিরিয়াস একটা কথা বললাম আর তোমরা হাসছ?’
আমরা খিলখিল হাসির ফাঁকেই বললাম, ‘আসলে আল্লাহ হাসিখুশি থাকা পছন্দ করেন তো, তাই আমরা হাসছি’।
সে তখন বিজ্ঞের মত বলল, ‘কংগ্র্যাচুলেশন্স!’
আমরা অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
সে বলল, ‘আন্টি, তুমি না বলেছ যারা আল্লাহর কথা শোনে তারা বেহেস্তে যাবে? তোমরা দু’জন আল্লাহর কথামত হাসিখুশি আছ, তাই তোমরা বেহেস্তে যাবে, তোমাদের বেহেস্তের অভিনন্দন!’
থ হয়ে গেলাম। শিশুরা আসলেই অনেক কিছু বোঝে যদিও আপাতদৃষ্টিতে আমরা মনে করি তারা অনেক কিছুই বোঝেনা!

কথাটি কি দয়ার্দ্র?

ছোটবেলায় Readers Digest এ একটা প্রবচন পড়েছিলাম। কথাগুলো মনে গেঁথে গেছিল: ‘According to an Islamic proverb, before you speak a single word it should cross three doors. At the first door the gatekeeper asks, ‘Is it necessary?’ At the second the gatekeeper asks, ‘Is it true?’ At the third, ‘Is it kind?’

যারা কথা বেশি বলেন তাদের সবারই অভিজ্ঞতা রয়েছে কোন না কোন সময় কোন বেফাঁস কথা বলে মাত্র ‘oops’ করে দুহাতে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরার। কিন্তু ততক্ষণে তীর ছুটে গেছে, হয়ত লক্ষ্যভেদও হয়ে গিয়েছে, সময়ের চাকা ঘুরিয়ে কোনভাবেই তাকে আর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব না।

আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ এবং প্রতিফল দিবসে বিশ্বাস রাখে তার উচিত হয় ভাল কথা বলা নয় চুপ করে থাকা’ (বুখারী)। অধিকাংশ ভুল বোঝাবুঝির সূচনা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে যা গড়াতে পারে হাতাহাতি থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত। অধিকাংশ অপ্রয়োজনীয় কথাই গীবত শ্রেণীভুক্ত, আর কিছু হোল অহেতুক আড্ডা বা হাসিঠাট্টা জাতীয় কথাবার্তা যা অনেক সময় সীমারেখা অতিক্রম করে যায়, সময়ের অপচয় ঘটায় কিংবা মানুষে মানুষে সম্পর্কের অবনতি। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই অভ্যাস থেকে উত্তরণ করা সম্ভব, প্রয়োজন শুধু মুখ থেকে কথা বের করার আগে একটি মূহূর্তের বিবেচনা। একটি কথা বলার আগে যদি আমরা একটি মূহূর্ত চিন্তা করি- কথাটি কি বলার প্রয়োজন আছে, কথাটি বলার উদ্দেশ্য কি, কথাটি বলার মাধ্যমে কি কারো কোন উপকার হতে পারে, কথাটি বলার মাধ্যমে কি কারো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে, কথাটি না বললে কি কোন সমস্যা হতে পারে?- হয়ত দেখা যাবে এমন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি যাতে কারো কোন লাভ নেই।

কখনো কখনো সত্য কোন ব্যাক্তির জন্য লজ্জার বা কষ্টের কারণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে চোরকে চোর বা মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী বলায় কোন বাহাদুরী নেই। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা) সাহাবীদের সাবধান করে দেন তাঁরা যেন ইকরিমা বিন আবু জাহল (রা)কে আল্লাহর শত্রু আবু জাহলের সন্তান হবার কারণে অপদস্থ না করেন বা তাঁর সামনে তাঁর পিতার ব্যাপারে কিছু না বলেন,‌ কেননা আবু জাহল যে তাঁর পিতা এর জন্য তিনি দায়ী নন কিন্তু এই সত্য উত্থাপন করাটা তাঁর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এমন ক্ষেত্রে সত্য উচ্চারণ না করাই সততা।

এর অর্থ কি তবে এই যে কাউকে ভুল বা অন্যায় করতে দেখেও আমরা চুপ থাকব? তা কিন্তু নয়। তাহলে মনে আঘাত না দিয়ে আমরা এই সত্য কিভাবে তাদের সামনে তুলে ধরব? আমরা কাজটি করব স্নেহের সাথে, সহমর্মীতার সাথে, সংবেদনশীলতার সাথে। প্রথমত, আমাদের কথায় কোন রাগ, ঝাল বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেতে পারবেনা; বরং বার বার শ্রোতাকে হাসিমুখে সম্বোধন করে, হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যাবহারের মাধ্যমে তাকে স্পষ্ট করে দিতে হবে যে কথাটি বলার পেছনে আমার কোন অসদুদ্দেশ্য কাজ করছেনা। কথায় নিজেকে বড় প্রমাণ করার পরিবর্তে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে যে মানুষ হিসেবে আমি নিজেও ত্রুটিমুক্ত নই, তাই আমার লক্ষ্য তার ত্রুটির অনুসন্ধান নয় বরং তাকে সংশোধিত হতে সাহায্য করা। একই কথা আমরা এমন tactlessly বলতে পারি যা কারো হৃৎপিন্ড ছ্যাঁদা করে দিয়ে যায়, আবার এত সুন্দর করে বলতে পারি যাতে তার নিজেরই মনে হয়, ‘তাই তো, আমার এই বিষয়টি সংশোধন করে নিলেই তো আমি অনেক উন্নত মানুষে রূপান্তরিত হতে পারি!’ সামান্য সময় এবং বুদ্ধি ব্যায় করলেই আমরা সুন্দরভাবে সাজিয়ে হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে কথা বলা রপ্ত করতে পারি।

খলিফা সুলায়মান যখন অনৈতিকভাবে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হত্যা করার আদেশ দেন তখন উমার বিন আব্দুল আজিজ তাঁকে শুধু প্রশ্ন করেন, ‘সুলায়মান, আল্লাহকে কি জবাব দেবে?’ কোন তর্ক নয়, অনুরোধ নয়, উপদেশও নয়, শুধু একটি প্রশ্ন- কিন্তু এই একটি প্রশ্ন একজন মানুষের সম্পূর্ন অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট।

আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা এক ধরনের সাদাকা’ (বুখারী)। সামান্য ক’টি দয়ার্দ্র বাক্য একটি জীবন রক্ষা করতে পারে, উজ্জীবিত করতে পারে একটি সম্পূর্ন জনপদকে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। পক্ষান্তরে ক’টি কর্কশ শব্দ একজন মানুষকে ঠেলে দিতে পারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, নিরাশ করতে পারে একটি জাতিকে, মৃত্যু ঘটাতে পারে সকল সম্ভাবনার।

প্রায়ই দেখা যায় আমরা নিজেদের অহমকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য, প্রতিশোধের জ্বালা মেটানোর জন্য কিংবা প্রতিপক্ষকে মোক্ষম আঘাত দিয়ে ঠান্ডা করে দেয়ার উদ্দেশ্যে অবলীলায় এমন সব কথা বলি যা কেউ আমাদের বললে আমাদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। অথচ এটা চিন্তা করিনা যে যখন আমার রাগ ঠান্ডা হয়ে যাবে, ক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাবে, তখন লজ্জা আমাকে গ্রাস করবে, নিজেই বুঝব কথাটা আদতেই বলা জরুরী ছিলোনা। কিন্তু তখন হাজার ‘sorry’ বলেও সেই ক্ষত আর মেরামত করা সম্ভব নয়- তলোয়ারের আঘাতের দাগও একসময় মুছে যায়, কিন্তু কথার আঘাতের ক্ষতে আমৃত্যু রক্তক্ষরণ হতে থাকে- চামড়ার ওপর প্লাস্টিক সার্জারী করা যায় কিন্তু হৃদয়ের ওপর তো আর ব্যান্ডেজ দেয়া যায়না!

অহংকার শয়তানের পতন ঘটিয়েছিল, আদমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহা তাকে জাহান্নামের জ্বালানী বানাবে, এভাবে নফসের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ধ্বংসই ডেকে আনে। তাই আল্লাহ বলেছেন, ‘রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম’ (সুরা ফুরকানঃ আয়াত ৬৩)। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এরা হেরে গেল, কিন্তু কার্যত এরাই জিতে গেল। কারণ তারা নিজেদের দুর্বলতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল, সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করল এবং শেষ পর্যন্ত সেই বিজয়ী হয় যে পরিস্থিতির শিকার না হয়ে পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতে পারে।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে মুখ দিয়েছেন একটি আর কান দিয়েছেন দু’টি। উদ্দেশ্য, সে যেন শোনে বেশি বলে কম। কেননা শোনার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, কিন্তু বলার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা ব্যাতীত আর কোন উদ্দেশ্য সাধন হয়না। তবু আমরা দিনরাত কথা বলি- প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, সত্যাসত্য বিচার না করেই, কথার ভারসাম্য বজায় রাখা তো অনেক পরের ব্যাপার। বার বারই আমাদের মুখের দরজা অনাহুতভাবে খুলে যায়। তাই বার বার ভুল হয়ে যায়। কখনো না কখনো কোন না কোন কথায় কেউ না কেউ আঘাত পেয়ে বসে।

সেক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব যদি ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে তাহলে মাফ চেয়ে নেয়া। মাফ চেয়ে কেউ ছোট হয়না, কারণ কার্যত বুদ্ধিমান মাত্রেই যেকোন মূল্যে কাঁধের বোঝা হাল্কা করে নিতে পছন্দ করে যেন পথ চলা সহজ হয়। তবে কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট পায় তাহলে আমাদের কথায় এবং আচরনে বুঝিয়ে দেয়া উচিত এটা আমাদের উদ্দেশ্য ছিলোনা এবং ভবিষ্যতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত যেন আমরা অযাচিতভাবে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারি। আর কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দোষ ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে কষ্টভোগ করে তাহলে সেই ব্যাক্তির কাছ থেকে সাবধান থাকা উচিত এবং তার কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রাখাই নিরাপদ।

We Love Muhammad (S)

আমার পাঁচ বছর বয়সী পুত্র কিছুদিন যাবত নিজ থেকেই চলতে ফিরতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। ওর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলাম আল্লাহর সম্পর্কে ওর ধারণা এখন যথেষ্ট স্বচ্ছ। এই ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবার পর ওকে শেখালাম, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এখন চলছে মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে জানার পর্ব। তিনি কে ছিলেন, দেখতে কেমন ছিলেন, মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, কিভাবে চলতেন, কি খেতে ভালবাসতেন, মানুষের সাথে কেমন ব্যাবহার করতেন, আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল, আমরা তাঁর কাছ থেকে কি শিখব ইত্যাদি। ঠিক এ’সময় এক ইহুদীর বানানো ছবি নিয়ে পৃথিবীব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তখন আমার পুত্রকন্যার পাশাপাশি আমার ছাত্রছাত্রীরাও জানতে চায় রাসূ্ল (সা) কে ছিলেন, কেমন ছিলেন, তাঁর শিক্ষা কি, তাঁর প্রতি আমাদের অনুভূতি কেমন হওয়া উচিত – ক্ষুদে অনুসন্ধিৎসুদের প্রশ্নের শেষ নেই।

তাদের তাই বলি যা আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। এ সত্ত্বেও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে, তবে বলে দাও, আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী নেই। আমি তাঁরই ভরসা করি এবং তিনিই মহান আরশের অধিপতি’ (সুরা তাওবাঃ আয়াত ১২৮-১২৯)। প্রথমত, তিনি আমাদের মতই প্রয়োজন এবং অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, সুতরাং তিনি আমাদের সুবিধা অসুবিধা বুঝতেন, এজন্যই তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশসমূহ আগে নিজে পালন করে নিশ্চিত করে নেন এগুলো আমাদের পক্ষে পালন করা কঠিন বা অসম্ভব নয়, কোন কাজ কঠিন মনে হলে আল্লাহকে অনুরোধ করে কমিয়ে নেন (যেমন নামায পঞ্চাশ ওয়াক্তের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত করে নেয়া- বুখারী ৩৪৫), খুঁটিনাটি থেকে বৃহৎ যেমন চুল আঁচড়ানো থেকে হাজ্জ্বের মত প্রতিটি কাজ নিজের উদাহরণ দিয়ে শিখিয়ে দেন আমরা কিভাবে করব।

তিনি মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালোবাসতেন, তবে স্বাভাবিকভাবেই বাবামা যেমন অনুগত সন্তানকে কিঞ্চিত বেশি ভালবাসে তেমনি যারা আল্লাহর দ্বীনের জন্য সর্বস্ব উজার করে দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ টান। তাঁর আচরনে এই পার্থক্য ধরা পড়তনা কেননা মনে মনে তিনি সবারই মঙ্গল চাইতেন, সবার সাথে উত্তম ব্যাবহার করতেন, সবাইকে সত্য জানানোর চেষ্টা করতেন। এমনকি তাদের মঙ্গলকামনায় তিনি মাঝে মাঝে এতটাই অধীর হয়ে পড়তেন যে আল্লাহ রাসূল (সা)কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘যদি তারা এই বিষয়বস্তুর (কুর’আনের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ আপনি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবেন’ (সুরা কাহফঃ আয়াত ৬)। একজন বাবা বা মা যদি দেখেন তাঁদের আদরের সন্তানটি না বুঝে আগুনে হাত দিতে যাচ্ছে তাহলে তাঁরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে বাঁধা দেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে রাসূল (সা) যিনি মানুষকে এতটাই ভালোবাসতেন যে নিজে অভুক্ত থেকে অপরকে খাওয়াতেন, নিজের একটিমাত্র পোশাক থাকলেও বস্ত্রহীনকে কাপড় দিতেন, নিজের ঘরে খাবার না থাকলেও একটি পয়সা নিজের জন্য সঞ্চয় করে রাখতেন না- তিনি মানুষকে মহানন্দে দোজখের জ্বালানী হবার পথে চলতে দেখলে পাগলপাড়া হয়ে তাদের রক্ষা করতে চাইবেন এটাই কি স্বাভাবিক নয়? কিন্তু আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন অধিকাংশ মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ। তাই তারা তাঁর এই কষ্টের প্রতিদান দিয়েছে তাঁকে অপমান করে, শারিরীক এবং মানসিক কষ্ট দিয়ে, রক্তাক্ত করে, হত্যার চেষ্টা করে। রাসূল (সা) তবু আমাদের ভালই বেসে গেছেন। রাতের পর রাত নামাজে দাঁড়িয়ে তিনি কেঁদেছেন তাঁর উম্মতের মুক্তির জন্য। অথচ তাঁর আগেপরের সমস্ত গুনাহ আল্লাহ মাফ করে দিয়েছেন!

এর পরে যারা তাঁর আহ্বানে সাড়া না দেয় বা তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করে তাদের সাথে বোঝাপড়া করবেন স্বয়ং আল্লাহ, যেমন তিনি করেছেন পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূলের কাওমের সাথে- নূহ (আ), হুদ (আ), সালেহ (আ) কিংবা লূত (আ)। এ প্রসঙ্গে সুরা লাহাবের কথা বলা যায়। এই সুরাটি আমি কখনোই পড়তে পারিনা, আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়। এখানে আবুলাহাবের শাস্তির কথা বলা হয়েছে যে রাসূল (সা)কে শারিরীকভাবে কষ্ট দিয়েছিল এবং তার স্ত্রীর শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে যে রাসূল (সা)কে কথা দিয়ে কষ্ট দিত। কিন্তু এগুলো তো শুধুই উদাহরণ। একই প্রকার শাস্তি কি তাদের জন্যও আসবেনা যারা পরবর্তীতে একই ধরণের কাজ করবে?

আমার পুত্রকন্যাদের শুধাই- যে মানুষটি আমাদের এতটা ভালবেসেছেন যে নিজের আরাম আয়েশ, মানসম্মান, দেশ জাতি, অর্থবিত্ত, পরিবার পরিজন সবকিছুর বিনিময়ে চেয়েছেন আমাদের সত্যপথের সন্ধান দিতে; আমাদের চিন্তায় অস্থির হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বারবার, সারারাত জেগে আমাদের পাপের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন; সমস্ত নির্যাতন সহ্য করে আমাদের জন্য অশ্রু, ঘাম আর রক্ত ঝরিয়েছেন অঝোরে- সেই রাসূল (সা)এর প্রতি আমাদের ভালবাসা কি বাবামার প্রতি ভালবাসার উর্ধ্বে হওয়া উচিত নয়? দারিদ্র এবং ক্লেশের কষাঘাত সত্ত্বেও যেকোন মূহূর্তে যেকোন স্থানে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সর্বাপেক্ষা স্মার্ট, ভদ্রতম এবং সুন্দরতম ব্যাবহারকারী ব্যাক্তি। তাঁর এই আদর্শ তাঁর শত্রুদের বন্ধুতে রূপান্তরিত করত, বিপথগামীকে পথে আনত, আবু লাহাব এবং তার স্ত্রীর মত অভিশপ্ত দম্পতির কন্যাকে সাহাবী বানাত [আসহাবে রাসূল (সা)- ৬ষ্ঠ খন্ড]।

আজ আমরা যদি বলি তার প্রতি অমুসলিমদের আচরনে আমরা ক্ষিপ্ত তবে প্রথমেই প্রমাণ করার ব্যাপার আসবে আমরা, তাঁর অনুসারীরা, তাঁর সম্মান রক্ষা করছি কিনা। যেকোন ব্যাক্তির প্রতি ভালবাসার সর্বোত্তম প্রকাশ হোল তাঁকে অনুসরন করা। রাসূল (সা) এর ব্যাপারে তো বলাই হয়েছে তিনি আমাদের জন্য ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বা সর্বোত্তম আদর্শ’। সেক্ষেত্রে আমরা যদি তাঁর আদর্শ অনুসরন করার পরিবর্তে শাহরুখ খান কিংবা অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি তাতে কি রাসূলুল্লাহর (সা) অপমান হয়না? আমরা যদি তাঁর নাম শুনেও ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ বলতে কষ্টবোধ করি তাতে কি তাঁর অপমান হয়না? আমরা যদি প্রতিকুল পরিস্থিতিতে তাঁর আদর্শ অনুসরন করার পরিবর্তে নিজের খেয়াল খুশির অনুসরন করে ইসলামের ব্যাপারে অপবাদ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেই তাতে কি রাসূল (সা)এর অপমান হয়না? নিজেরা রাসূল (সা)কে পদে পদে অপমান করে আমরা কিভাবে তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নেব?

তাহলে কি আমরা প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকব? না, কিন্তু আমরা ভাংচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে, অশালীন ভাষায় কিংবা একের পাপের বিনিময়ে অপরকে হত্যা করে প্রতিবাদ করবনা। আমরা প্রতিবাদ করব রাসূল (সা)এর প্রদর্শিত পথে- শান্তিপূর্ণভাবে, সিভিলাইজড পদ্ধতিতে। আমরা প্রতিবাদ করব রাসূল (সা)এর আদর্শ নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে, তাঁর আদর্শকে সবার মাঝে উচ্চকিত করে, এই আদর্শ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে।

গত পনেরোই সেপ্টেম্বর ক্যাল্গেরির মুসলিমদের একাংশ ক্যাল্গেরী মিউনিসিপাল বিল্ডিংয়ের সামনে প্রতিবাদ সভা করে। ডাউনটাউনের ব্যাস্ততম সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে শত শত মুসলিম জানায় আমরা এদেশের জনশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ; মুসলিমদের প্রতি এমন বৈষম্যমূলক আচরনে আমরা ক্ষুব্ধ এবং আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে প্রতিবাদ আশা করি; শত শত অমুসলিম পথচারীদের মাঝে কুর’আন, রাসূল (সা)এর জীবনী এবং ইসলাম সম্পর্কে বই বিলি করা হয়; লিবিয়াতে ইউ এস অ্যাম্বাসেডরের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়; ঘৃণার পরিবর্তে ভালবাসার বাণী শোনানো হয়; একঘণ্টার সমাবেশ শেষে সবাই ক্যাল্গেরী মিউনিসিপাল বিল্ডিংয়ের সামনে একত্রে নামায আদায় করে। নামাজের পর অনেক অমুসলিম উপস্থিত লোকজনের কাছে জানতে চায় ওজু সম্পর্কে, নামায সম্পর্কে। ঝামেলা করার মত কিছু লোক যে ছিলোনা তা নয়, কিন্তু সমাবেশকারীদের আচরন ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত যেমন রাসূল (সা) শিখিয়েছেন। যারাই ঝামেলা করতে আসে তাদের ব্যাপারে পুলিশকে জানানো হয়, তারা ঝামেলাকারীদের সাথে কথা বলে তাদের স্থানত্যাগ করার নির্দেশ দেয় এবং কয়েকজনকে গাড়িতে তুলে পুলিশ স্টেশনে চালান করে দেয়। সবচেয়ে আদর লাগে একটি ছোট্ট শিশুকে যে বুকে প্ল্যাকার্ড লাগিয়ে ঘুরছিল, ‘I love Muhammad (S), My name is Muhammad’. ছেলেটির বয়স বড়জোর সাড়ে তিন চার হবে, কিন্তু সেদিন উপস্থিত কোন শিশুই সেদিনের শ্লোগান ভুলবেনা ‘We love Muhammad (S), We hate hate’. তারা মনে রাখবে রাসূল (সা) পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলেন, হিংসার জবাব বিদ্বেষ দিয়ে দেয়ার জন্য নয়। তারা জানবে আমরা রাসূল (সা) এর অনুসারী এবং আমাদের দায়িত্ব তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত করা।

আল্লাহ রাসূল (সা)কে ওয়াদা করেছেন, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি’ (সুরা ইনশিরাহঃ আয়াত ৪)। সুতরাং, যে যতই চেষ্টা করুক না কেন কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিবার আজানে তাঁর নাম সম্মানের সাথে উচ্চারিত হতে থাকবে, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁকে নিজের পিতামাতার চেয়ে বেশি ভালবাসবে, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে সালাম পৌঁছতে থাকবে- দু’একটা মশা সামান্য ওড়াওড়ি করবে কিন্তু মশার জীবনের দৈর্ঘ্য কয়েকটি দিন মাত্র- এ’ নিয়ে এত অস্থির হবার কিছু নেই। কারণ আল্লাহর ওয়াদা সত্য, ‘নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে। নিশ্চয় কষ্টের সাথে স্বস্তি রয়েছে’ (সুরা ইনশিরাহঃ আয়াত ৫-৬)। সেই স্বস্তি সেদিন আসবে যেদিন আমরা কেবল মুখে না বলে কাজে প্রমাণ করতে পারব আমরা রসুল (সা)কে কতটা ভালবাসি।

সত্যানুসন্ধানী

টেলিভিশনে দেখেছি, গল্প শুনেছি কিংবা বইয়ে পড়েছি অনেক কিন্তু গতকালই প্রথম সরাসরি নিজের চোখে দেখলাম। আমাদের মসজিদে জুমার নামাজের পর এক শ্বেতাঙ্গ ক্যানাডিয়ান ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইমামের সাথে প্রথমে আরবীতে এবং অতঃপর ইংরেজীতে শাহাদাহর বাক্যগুলো উচ্চারণ করলেন। সাথে সাথে পুরো মসজিদ আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হোল। নবাগত মুসলিম ভাইটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইউসুফ এস্টেস সাহেব একবার এক ব্যাক্তির শাহাদাহ কবুলের পর ব্যাখ্যা করলেন, কোন ব্যাক্তি যখন সত্যকে গ্রহণ করে তখন তার হৃদয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে করুণাধারা বর্ষিত হয় সে কারণেই তার দুচোখ প্লাবিত হয়, এর দ্বারা তার অতীতের সব পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। হয়ত তাই শুধু তিনিই নন বরং যে ভাইরা তাকে জড়িয়ে ধরে নতুন জীবনের আহ্বান জানাচ্ছিলেন তাদের চোখেও অশ্রু বাঁধা মানছিলোনা।

কি আশ্চর্য, একটু আগেও যিনি আমাদের কাছে আর দশজন শ্বেতচর্ম ব্যাক্তি থেকে আলাদা কিছুই ছিলেন না তিনিই মাত্র কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে বনে গেলেন পৃথিবীব্যাপী রঙবেরঙের কোটি কোটি মানুষের ভাই! এখন তিনি পৃথিবীর যেখানেই যাবেন সেখানেই পাবেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ‘আসসালামু আলাইকুম’ অভিবাদন, সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসবে সাদা কালো লাল হলুদ আরো কত রকম মানুষ, আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন পৃথিবীর নাম না জানা কোন প্রান্তরের নাম না জানা কোন চেহারার সাথে শুধু এ কারণে যে তারা দু’জনেই বিশ্বাস করেন এবং বলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’!

ভাবছিলাম তাদের কথা যারা জীবনটাকে সাগরপাড়ে হাওয়া খেতে যাবার মত সহজ এবং লক্ষ্যহীনভাবে যাপন করে। এ’ধরণের মনোভাব আপাতদৃষ্টে আকর্ষনীয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এইভাবে যাপিত জীবনের ফলাফল শূন্য। প্রতিটি কাজের পেছনেই কোন না কোন কার্যকারণ থাকা চাই, নইলে সে কাজ করার পেছনে কোন স্পৃহা বা অনুপ্রেরণা কাজ করেনা। সেক্ষেত্রে এমন ধারণা করে নেয়া কতটা যুক্তিগ্রাহ্য যে আমরা যে নিজেদের এই পৃথিবীতে দেখতে পাচ্ছি যেখানে আসার বা যেখান থেকে যাবার পেছনে আমাদের কোন হাত নেই এর পেছনে কেউ দায়ী নয় এবং আমাদের এখানে কোন দায়দায়িত্ব নেই? গোটা একটা জীবন এভাবে লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীনভাবে কাটিয়ে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে? মানুষ স্বভাবতই মুনাফাপ্রিয়। তাই সে প্রতিটি কাজের পেছনেই লাভ খোঁজে। অথচ অসংখ্য মানুষ নিজের জীবনটাকেই সবচেয়ে নিরর্থক শূন্যতায় সমাপ্ত করে। এই সক্ষম শরীর, এই মেধাবী মস্তিষ্ক, এই কোমল মন, এই চিন্তাশীল মনন যদি অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হত তারা হয়ত সত্যানুসন্ধানকেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিত যেমন নিয়েছেন আমাদের উপরোক্ত ভাইটি।

যখন লোকজনকে দেখি দু’কানে দু’খানা ইয়ারফোন লাগিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে ভুলে থাকে তখন খুব আশ্চর্য লাগে তারা যে পৃথিবীতে বসবাস করেন সেই পৃথিবীর আসল শব্দগুলোর সাথেই তারা পরিচিত হবার সুযোগ পান না- পাখির কুহুতান, নদীর কলতান, সুমুদ্রের গর্জন, পাতার সরসর, জীবনের উচ্ছ্বাস, বেদনার দীর্ঘশ্বাস, বাতাসের হাহাকার সব সবকিছু চাপা পড়ে যায় গান নামে কিছু অহেতুক অনর্থক চিৎকারের কাছে। দিনরাত টিভি, গেম, আইফোন, আইপ্যাড আর ট্যাবলেটের রঙ্গিন চশমা পরে পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এই মানুষগুলো- মানুষের দুঃখ, মানুষের আনন্দ, শিশুদের সারল্য, স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য, রংধনুর রঙ, কিছুই দেখতে পায়না, কিছুই তাদের চশমার স্তর ভেদ করে হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনা। সমস্যা হোল, জীবনের উদ্দেশ্যবিমুখ এবং জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ এই মানুষগুলো যখন জীবনের মুখোমুখি হয় তখন আরো অনেক সাধারন মানুষের তুলনায় এরা জীবনের ব্যাখ্যা করতে ব্যার্থ হয় এবং জীবনের কাছে হেরে যায়। যারা নিজের জন্যই কিছু করতে পারেনা তারা অন্যের জন্য করবে কিভাবে?

এভাবে নিজের যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করা এবং মূল্যবান সম্পদের অপব্যায় করা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাই হয়ত আল্লাহ বলেছেন কিয়ামতে দিন যেখানে তিনি সত্যানুসন্ধানীদের সালাম সহকারে স্বাগত জানাবেন সেখানে এদের বলবেন, ‘হে অপরাধীরা, আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও’ (সুরা ইয়াসীনঃ আয়াত ৫৯)।

পৃথিবীর কোটি কোটি কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী থেকে সাধারন মানুষ- চিন্তাশীল ব্যাক্তি মাত্রেই এই সত্যের অনুসন্ধান করেছেন। কেউ খুঁজে পেয়েছেন, কেউ কাছাকাছি এসেও নিরাশ হয়েছেন, কেউ পাননি, কেউ পেয়েও বরণ করতে পারেননি। কিন্তু যে সর্বাত্মকভাবে সত্যের অনুসন্ধান করে তার পাবার আকুতি বিফলে যায়না, সে সত্যকে পাওয়ামাত্র জীবনপণ করে আঁকড়ে ধরে সকল বাঁধাবিপত্তি তুচ্ছ করে, সত্য তার কাছেই ধরা দেয়। তাই আল্লাহ বলেন, ‘যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত’ (সুরা নাহলঃ আয়াত ৯৭)। আমরা সবাই কি এই নবাগত ভাইটির মত পবিত্র জীবন এবং উত্তম পুরষ্কারের দিকে ছুটে যেতে প্রস্তুত?

নূসরাতের সাথে তিনটি দিন

আমার কেন যেন মনে হয় মানুষের জীবনগুলো ছোটবড় রঙবেরঙের সতত সঞ্চারমান বৃত্তের মত। সন্তরণশীলতার একেক পর্যায়ে এরা কখনো কখনো পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে, নিজের রঙের স্পর্শ বুলিয়ে দিয়ে যায় একে অপরের গায়ে, আবার কখনো এক বৃত্ত অপর বৃত্তের সাথে জুড়ে যায় জীবনের মত। কখনো বা কয়েকটি বৃত্ত পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে সৃষ্টি হয় একেকটি মহাবৃত্ত। আবার একই বৃত্ত বেশ কয়েকটি মহাবৃত্তের অংশ হতে পারে। সব মিলিয়ে বেশ মজার ইকুয়েশন!




কাহিনীর শুরু ব্লগার মনপবনের বিয়ে দিয়ে। বিয়েতে আমি ছিলাম মেয়েপক্ষ। মেয়ে বাংলাদেশে আর আমি ক্যানাডাতে, মেয়েকে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি, কিন্তু মনের মিল হলে রক্ত সম্পর্ক ছাড়াই বোন বানিয়ে নেয়া যায়। ব্লগার নূসরাত রহমান ছিল মনপবনের সহপাঠিনী। নূসরাত আর ওর স্বামী পি এইচ ডির ছাত্রছাত্রী, অ্যামেরিকায় পড়াশোনা করছে। মনপবনের বিয়ের পর দেশে বেড়াতে গিয়ে বৌয়ের মুখে আমার গল্প শুনে এসে নূসরাত আমাকে যোগাযোগ করে। সেটা ২০১০ সালের কথা। ওরা স্কলারশিপের স্বল্প পরিমাণ থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়েছে আইলা দুর্গতদের জন্য। জানতে চায় আমার পরিচিত কেউ আছে কিনা যে ঐ এলাকায় টাকাটা এমনভাবে বিলি করার ব্যাবস্থা করতে পারে যাতে মাত্র কয়েকটি পরিবারকে সাহায্য করা সম্ভব হলেও যে পরিবারে সহযোগিতা দেয়া হবে তাদের যেন আর কখনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়। যথাসম্ভব সহযোগিতা করলাম। এই প্রক্রিয়ায় ওর সাথে পরিচয়। পরিচিত হয়ে আমার ভীষণ ভাল লাগল যে ওরা বিদেশে থেকেও দেশের মানুষগুলোর জন্য ভাবে, অনুভব করে, কিছু করতে সচেষ্ট হয় যদিও সামর্থ্য হয়ত এখনো সীমিত।

কাজ শেষ হয়ে গেলেও ফেসবুক আর ইমেলে সম্পর্ক অগ্রসর হতে থাকে। আপনি থেকে তুমি, ফর্মাল থেকে ইনফর্মাল, কাজের কথা থেকে ব্যাক্তিগত কথাবার্তা। জ্ঞানের পথের অগ্রপথিকদের আমি শ্রদ্ধা করি, আরো বেশি সম্মানবোধ কাজ করে তাদের জন্য যারা নিজের যা কিছু আছে তাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করে মানবতার কল্যাণের জন্য, যারা অপেক্ষা করে থাকেনা এমন কোন অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতের জন্য যা বৃত্তের অন্তর্ভুক্ত হবে কি হবেনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই, বরং আজকের দিনটিকেই বেছে নেয় সমস্ত ভাল কাজের জন্য। ফেসবুকে নূসরাতের দু’একটা লেখালেখি দেখে বললাম এই লেখা ব্লগে দিলে আরো বেশি পাঠক উপকৃত হতে পারেন। ব্লগে লেখা শুরু করল নূসরাত। ব্যাস, আমরা বনে গেলাম ব্লগবন্ধুও!

এ’বছর জুনের ২৬ তারিখ নূসরাত কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ প্রসঙ্গে জানালো ঈদের পর পর ব্যানফে একটা কনফারেন্সে যাবে। শুনেই তো আমার মাথা খারাপ! ব্যানফ ক্যাল্গেরীর পাশের শহর, দেড়ঘন্টার পথ, যেতেও হবে ক্যাল্গেরি এয়ারপোর্ট হয়েই। সাথে সাথে বললাম কনফারেন্সের পর আমার বাসায় ক’দিন থেকে যেতে হবে, তখন নাহয় মেসেজের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাপ করব।

নূসরাত প্রথমদিকে কি ভাবছিল জানিনা কিন্তু পরে রাজী হয়ে গেল, ভিসার ব্যাবস্থা করল আর যতই দিন যেতে লাগল সেও দেখা হবার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠতে লাগল। রোজার সময়টা তেমন বিশেষ যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি নানান ব্যাস্ততায়। ঈদের পর পরই একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে দেখি নূসরাত! ব্যানফ থেকে ফোন করেছে!

যে মানুষটার চেহারা দেখিনি কখনো অথচ ভালবেসেছি আপন বোনের মতই, তার গলা শুনলাম প্রথমবারের মত। কি কি যে কথা বলেছি তার ঠিক নেই, কিন্তু আধঘন্টার আলাপে কিছুই যে বাদ পড়েনি তা নিশ্চিত। জিজ্ঞেস করলাম ব্যানফ গিয়ে নিয়ে আসব কিনা, বলল, ‘না আপু, আমরা নিজেরাই চলে আসতে পারব’। বললাম, ‘তাহলে তোমরা বাস থেকে নেমে ট্রেনে আমার এলাকার স্টেশনে চলে এস। স্টেশন বাসার সামনেই, আমি গিয়ে নিয়ে আসব’, বলল, ‘না আপু, আমরা নিজেরাই চলে আসতে পারব’।

সাতাশ তারিখ যখন ওর আসতে দেরি হচ্ছে হাফিজ সাহেব আর আমি টেনশনে অস্থির; যে কাজ আমার কখনো হয়না তাই হোল, মনের ভুলে হাত কেটে ফেললাম; মনে মনে ওকে বকা দিচ্ছি, ‘বেশি কাবিল, বললাম স্টেশনে গিয়ে নিয়ে আসি, নিশ্চয়ই পথ খুঁজে পাচ্ছেনা!’ সাড়ে ছ’টার পরিবর্তে সাড়ে আটটায় আমার বাসায় বেল বাজল, দরজা খুলে দেখি ওরা উপস্থিত!

বকা দেব কি, ওদের মায়া মায়া চেহারাগুলো দেখে সমস্ত উদ্বেগ মূহূর্তে উবে গেল। ওর স্বামী শামস বেচারা হাইকিং করতে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি ওদের ঘরে ঢুকিয়ে আরামের ব্যাবস্থা করলাম। বেডরুম দেখে নূসরাত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘বাহ! এ তো দেখি হোটেলের চেয়েও চমৎকার!’ তখন হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। বিয়ের চৌদ্দ বছরে আমরা কোন নতুন ফার্নিচার কিনিনি, এতেই এত প্রশংসা করার মত মন যার আছে তাকে নিয়ে তিনটি দিন ভালই কাটবে!

মাগরিবের সময় হয়ে এসেছিল। নূসরাত দেখি দ্রুত ওজু করে পাশে এসে হাজির, একসাথে নামাজ পড়বে। পুত্র মেহমান দেখে খুশিতে লাফাচ্ছে, আমাদের পেছনে বিছানায় প্রলয়নাচন চলছে, আমি মহাবিরক্ত, আর নূসরাত কি করল? নামাজ শেষ করেই আমার বাঁদর ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিল।

ঈদের খাবার, ঈদের পরের কিছু রান্না আর ওদের আসা উপলক্ষ্যে যা রান্না করেছিলাম তাই দিয়ে রাতের খাবার ব্যাবস্থা করলাম। খাবার টেবিলে বসে বুঝলাম ওরা দু’জনেই এত একহারা কেন, যা দিয়েছিলাম প্রায় সবই মনে হয় রয়ে গেল। শামস খুব কম কথা বলে। কিন্তু দু’টো কথা এমনভাবে বলল যে মনে হোল আমার ভাইটিই যেন আমার বাসায় এসেছে। প্রথমেই বলল, ‘আপু, আপনি নূসরাতকে যেমন নিজের বোন মনে করেন সেভাবে আমাকে কি ছোটভাই মনে করে নেয়া যায়না? আপনি আমাকে তুমি বলবেন’। তারপর মুরগীর মাংস খেয়ে বলল, ‘মনে হয় যেন অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি, আমার মা ঠিক এভাবেই মুরগী রান্না করেন’। চোখে পানি এনে দিল ছেলেটা, আমি নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারিনা, কিন্তু অনুভব করতে পারলাম যারা বাইরে থাকে তারা একটু স্নেহের জন্য কতটা কাতর থাকে।

আমাদের প্ল্যান ছিল ওরা সাড়ে ছ’টায় এসে পৌঁছলে ওদের কক্রেনে হাতে বানানো আইসক্রীম খেতে নিয়ে যাব। কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর এত দেরী হয়ে গেছে যে এই প্ল্যান আর সম্ভব নয়। হাফিজ সাহেব তখন বললেন, ‘চল, ওদের ক্যাল্গেরী ঘুরিয়ে দেখাই’। ওদের আসা উপলক্ষ্যে উনি সেদিন ছুটি নিয়েছিলেন। ক্যাল্গেরীর বিভিন্ন প্রধান সড়ক এবং দর্শনীয় স্থানগুলো আমরা সবাই গাড়ীতে করে ঘুরে দেখতে বেরোলাম। সেদিন ছিল প্রচন্ড গরম। পথে এক বন্ধুর বাসা থেকে ঠান্ডা কোমল পানীয় সংগ্রহ করা হোল। তারপর নিয়ে গেলাম বান্ধবী ব্লগার সুলতানার বাসায়। সুলতানা অনেক আগে থেকেই আটাশ তারিখ নূসরাতকে দাওয়াত দিয়ে রেখেছে- কিন্ত ওর আগমন উপলক্ষ্যে বেচারী এত এক্সাইটেড যে সকাল থেকেই ফোন করছে এখন কি করছি, ওরা কবে আসবে, ওরা এলো কিনা, ওদের কবে ওর বাসায় নিয়ে যাব, ওরা এখন কি করছে- তাই ভাবলাম ওদের দু’মিনিটের জন্য নিয়ে গিয়ে বেচারীর কালিজাটা ঠান্ডা করার ব্যাবস্থা করি। যখন সুলতানার বাসায় বেল দিলাম তখন সে ব্লগে বিচরণ করছে। আমাদের দেখে কি করবে না কি করবে অস্থির হয়ে পড়ল। পরে এদের ক্যাল্গেরী দর্শন অসমাপ্ত রয়ে যাবে, আগামীকাল তো ওরা আসছেই ইত্যাদি বলে সুলতানাকে নিরস্ত করা গেল।

বাসায় ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত চারজনে গল্প করলাম। বিভিন্ন ব্লগারের গল্প, ব্লগের গল্প, বাংলাদেশের গল্প। হঠাৎ খেয়াল হোল শামসের তো সকালে ভিসার জন্য এম্বাসীতে যাবার কথা। তখন সভাভঙ্গ করে ওদের ঘুমাতে পাঠালাম। রাতে হাফিজ সাহেব ওদের জন্য মিষ্টি বানালেন, কিন্তু ক্লান্তির কারণে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়ায় মিষ্টি পোড়া লেগে গেল।

সকালে ওদের নাস্তা দিতে উঠে দেখি নূসরাত আমার পেছন পেছন চলে এসেছে রান্নাঘরে। ওর একটা শর্তই ছিল মেহমানের মত ট্রিট করা যাবেনা। কি আর করা? দিলাম ডিম ভাজতে। সে ফাঁকে রিহামকে তুলে, রেডী করে স্কুলে দিয়ে এলাম। এসে দেখি নূসরাত সেই পোড়া মিষ্টি মহাযত্নে তুলে তুলে রাখছে। পরের দু’দিন এই মিষ্টি যে কি মজা করে খেয়েছে বেচারী! ঈদে বানানো ভাল মিষ্টিও ছিল, কিন্তু এটা নাকি আরো বেশি মজা! ওর স্বামীর পছন্দ বুন্দিয়া, সুলতানার তৈরী বুন্দিয়া ছিল ফ্রিজে, তাই দু’জনকেই খুশী করা সম্ভব হোল।

শামস এম্বাসীতে চলে গেলে আমরা দু’জন গল্প করতে বসলাম। পরস্পরের পরিবার সম্পর্কে জানা, জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা, মূলত পরস্পরকে বোঝার প্রয়াস। রান্নাবাড়া কিছু হোলনা। কেবল একটা ডাল করলাম শুটকী দিয়ে, চট্টগ্রামের স্থানীয় তরকারী যা ওরা কোনদিন খায়নি। পরে ভাবলাম এই তরকারী খাওয়ার সাথে অভ্যস্ততার একটা ব্যাপার আছে, আদৌ খেতে পারবে কিনা। কিন্তু খাবার টেবিলে বসে যখন দেখলাম দু’জনেই খুব আগ্রহ করে খেল তখন মজা পেলাম, আমার মেহমান এত উদারহৃদয় যে ওদের খাওয়া নিয়ে আমার কোন টেনশনই নেই!

বিকালে সুলতানার বাসায় দাওয়াত কিন্তু হাফিজ সাহেব কাজ থেকে ফিরে আমাদের নিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমরা তিনবন্ধু সবসময় সবকিছু একসাথে করি- ইফতেখার ভাই, সুলতানা আর আমরা। দু’জনের সাথে নূসরাতের আগেই পরিচয় ছিল, দাওয়াতে ইফতেখার ভাইয়ের সাথেও পরিচয় হয়ে গেল। সুলতানার বাগানে অ্যাপল গাছ থেকে অ্যাপল পেড়ে খাওয়া, বারান্দায় বসে গল্প করা, আর তারপর ওর যাদুর হাতের রান্না খাওয়া! বেশ মজার একটা সময় কাটল। বেচারী সুলতানা চেয়েছিল নূসরাতের আসা উপলক্ষ্যে ছুটি নিতে যেন মন ভরে গল্প করতে পারে। ছুটি না পাওয়ায় আমি কিছুক্ষণের জন্য ওদের নিবিড়ভাবে গল্প করার সুযোগ দিয়ে একপাশে সরে গেলাম।

তবে অতটা ভাল মানুষ আমি নই যে সময়টুকু পুষিয়ে নেবনা। বাসায় ফিরে নূসরাত আর শামস দু’জনের সাথেই শুরু হোল গল্প। ওদের বিয়ের গল্প, বাল্টিমোরে ওদের বন্ধুদের গল্প, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ওদের চিন্তাভাবনার গল্প। একপর্যায়ে দেখলাম আমার মতই শামসের পড়ার খুব শখ, সাহিত্যের প্রতি অশেষ আগ্রহ। রাশিয়া থেকে রোম, মডার্ন থেকে প্রাচীন সাহিত্য, দুই বাংলার সাহিত্য সব চষে ফেললাম কিছুক্ষণের ভেতরেই। তাই তো বলি সে এত সাহিত্যিক সাহিত্যিক ভাষায় কথা বলা শিখল কিভাবে! বললাম ওর লেখালেখি শুরু করা উচিত। তারপর ওকে ঘুমাতে পাঠিয়ে নূসরাতের সাথে গল্পে বসে পড়লাম। শামস যাবার পরই দেখি রাদিয়া চিরুনী নিয়ে এসে হাজির। কোন ফাঁকে যে নূসরাত ওর সাথে এত বন্ধুত্ব করে ফেলেছে বুঝলাম না। কিন্তু সে মহা আগ্রহে কন্যার চুল আঁচড়ে বেণী করে দিচ্ছে আর বলছে ওকে দেখলে নিজের ছোট বোনটার কথা মনে হয়! ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে শামসের খুব মন খারাপ ছিল, তাই নূসরাতকে বেশিক্ষণ আটকে রাখলাম না। ওকে বললাম পরামর্শ করে একটা উপায় নির্ধারণ করতে কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। কিন্তু পরদিন ব্লগে ওর ‘সেলফ এস্টিমঃ পর্ব ৫’ দেখে বুঝলাম ও নিজের সমস্যার চাইতে বরং জনগণের সমস্যার সমাধান করতে ব্যাস্ত ছিল।

পরদিন আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে ঠাণ্ডা ছিল, নূসরাতদের হিসেবে অতিরিক্ত ঠান্ডা। আগের ক’দিন খাবার মেন্যু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছি যেন পেটের ওপর চাপ না যায় কারণ ভ্রমণের সময় অতিরিক্ত বা তৈলসম্বৃদ্ধ খাবারে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। আজ ভাল আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে সামান্য রান্না করলাম ওদের জন্য। নূসরাত কিছুতেই আমাকে একা কাজ করতে দেবেনা। পেঁয়াজ কাটা, সব্জী কাটা সব করতে চায়, নিজেও একটা কিছু রান্না করতে চায়। শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়ে ওকে কাজ করতে দিলাম, আর সেই সাথে চলল মজার মজার গল্প। দুপুরে হাফিজ সাহেবকে লাগিয়ে দিলাম বারবিকিউ করতে। যখন খেতে বসলাম তখন টেবিলে পোলাও, বারবিকিউ, মুরগীর তরকারী, মুড়োঘন্ট, সব্জীভাজি, রাদিয়ার ডিম তরকারী আর নূসরাতের স্পেশাল বেগুনভাজি মিলে মজাদার আয়োজন। প্রশংসায় পারদর্শী শামস বলল এটা ওর জীবনে খাওয়া সেরা বারবিকিউগুলোর একটি। কিন্তু সবার আগে শেষ হয়ে গেল নূসরাতের বেগুনভাজি। খাবার পর সবারই চোখে লেগে এলো। বিকেলে আমার বাসায় সবাই ঘুম!

সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছি। বহুদিন পর আবহাওয়া একটু আরামদায়ক মনে হচ্ছে। নূসরাত এসে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এই আবহাওয়া আপনার আরামদায়ক মনে হচ্ছে?’ তখন বুঝতে পারলাম আমাদের শরীর কিভাবে এই আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে যেটা আমার আরামদায়ক মনে হচ্ছে সেটা নাতিশীতোষ্ণ মন্ডল থেকে এসে নূসরাতের প্রচন্ড শীতল মনে হচ্ছে। মাগরিবের নামাজের পর ও নতুন জামা পরে এলো ছবি তোলার জন্য। কিছুক্ষণ পর হাফিজ সাহেব এলেন। আবার সবাই মিলে জম্পেস গল্প। হাফিজ সাহেব চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ চলল মজার গল্প যদিও পরদিন সকালে নূসরাতের ফ্লাইট। মাঝখানে লালবৃত্তকে নেটে পেলাম কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু নূসরাত চলে যাবে শুনে সে আর আলাপ দীর্ঘায়িত করল না। আমার চারপাশে এত সেলফ স্যাক্রিফাইসিং মানুষ যে এদের দেখলে আমার আশা জাগে এই পৃথিবীটাতে এখনো ভাল কিছু হবার সম্ভাবনা আছে। গল্প শেষ হোল রাত দেড়টায়।

ভোরে নামায পড়ার জন্য উঠিয়ে দিলাম ওদের। সামান্য একটু নাস্তার আয়োজন করে রিহামকে স্কুলে পাঠাবার জন্য রেডী করতে চলে যেতে হোল ওপরতলায়। আমার বাসায় শেষবার ওরা কি খেল না খেল খেয়াল করতে পারলাম না। নিজে রেডি হবার সময় কি মনে করে যেন নূসরাতের দেয়া স্কার্ফটা পরলাম। বেচারি ছাত্রীমানুষ,অথচ হাফিজ সাহেবের জন্য শার্ট, আমার জন্য স্কার্ফ আর বাচ্চাদের জন্য চকলেট নিয়ে এসেছে। বকা যা দিলাম সব নিরবে হজম করল, কিন্তু মোটেও লজ্জিত মনে হোলনা ওকে।

সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। স্কার্ফটা পরতে দেখে এত খুশি হোল বেচারী! রিহামকে স্কুলে দিয়ে ওদের নিয়ে রওয়ানা হলাম এয়ারপোর্টে। যখন ওরা গাড়ী থেকে নেমে গেল, মনে হোল যেন আমার অতি আপন কেউ এসেছিল, কয়েকটা দিন রাঙিয়ে দিয়েছিল ওদের আপন আপন রঙে, আবার বৃত্তগুলো সঞ্চারমান হয়ে গেল আপন আপন পথে, কিন্তু এই রঙগুলো স্থায়ী হয়ে গেল আমার বৃত্তে, একটু পর পর চমকে চমকে ঝিলমিল করে উঠছে সে রঙ!

আমার ঈদ




ঈদ তার জন্যই আনন্দের যে রামাদানের একটি মাস ইবাদাত এবং সৎকাজের চর্চার মাধ্যমে এমন একটি জীবনাচরণ নিজের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে যা তাকে আগামী রামাদান পর্যন্ত সজীব এবং সতেজ রাখবে। যে এই মাসটি পাবার পরেও নিজের মাঝে কোন পরিবর্তন অনুভব করতে পারেনা তার জন্য রামাদানের সমাপ্তি অপরিসীম বেদনার কেননা আরো একটি বছর তার জীবন থেকে ঝরে গেল অথচ সে ক্ষমার কাছাকাছি পৌঁছতে পারলনা।

এবারের রামাদান ছিল আমার জন্য বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার। একদিকে বন্ধুমহলের প্রতিযোগিতা দেখে নিজের ক্ষুদ্রতায় মুষড়ে পড়েছি, আরেকদিকে সংযমের মাসের নানাবিধ ব্যাখ্যা বেশ মজা দিয়েছে। তবে শেষ নাগাদ কিছু শুভাকাঙ্খীর দুয়া এবং ভালবাসা ছাড়া নিজের অর্জন বলতে তেমন কিছুই সংগ্রহ করতে পারিনি, তাই রামাদানের সমাপ্তি প্রতি বছরের মতই এ’বছরও আমার জন্য ছিল বেদনার।

এখানে রোজার শুরুতে ফজর হত চারটায় এবং ইফতার হত পৌনে দশটায়- মোটামুটি আঠার ঘন্টা। রামাদানের শেষ নাগাদ এই সময় প্রায় এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট কমে যায়। রাতের পরিধি যেখানে মাত্র ছয়ঘন্টা- এরই মাঝে মাগরিব, এশা, তারাবী, ফজর, ইফতার, সেহরী, ঘুম সব কুকড়েমুকড়ে জায়গা করতে হয়- সেখানে যারা চাকরীজীবি, ভোর ছ’টায় যাদের কাজের উদ্দেশ্যে উঠে যেতে হয় এবং ফিরতে ফিরতে হয় সন্ধ্যা ছ’টা- তাদের ইবাদাতসহকারে রোজা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে দেয়। আল্লাহর প্রতি নিখাদ ভালবাসা এবং অবিচল নিষ্ঠা ব্যাতিরেকে এই কাজ সহজ নয়, সম্ভব কিনা তাও আলোচনার বিষয়।

স্বাস্থ্যগত কারণে রামাদানের একমাস আমরা দাওয়াতে যাইনা এবং দাওয়াত দেইওনা- প্রথমত সুস্থ থাকার জন্য পরিমিত এবং চর্বচোষ্যলেহ্যপেয়বর্জিত খাবার গ্রহণ করা জরুরী, দ্বিতীয়ত দাওয়াত দানকারী এবং দাওয়াত গ্রহণকারী এদের উভয়েই দাওয়াতের পর এত ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে সঠিকভাবে নামায সম্পন্ন করা সুকঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই উভয় ক্ষেত্রে আমার বন্ধুদের পারফর্মেন্স ছিল ঈর্ষা করার মত। এবারের রোজায় বন্ধুরা এত খাবার পাঠিয়েছেন যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ দিন আমাদের রান্না করতে হয়নি, বরং এই বিপুল পরিমাণ খাবার কেবল আমাদেরই নয় আমাদের প্রতিবেশীদেরও রসনাবিলাস করেছে। জুমায় এবং তারাবীতে এদের সদা উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত যার ফলে হাফিজ সাহেবের কাজ থাকলেও আমরা কোনক্রমে একবার মসজিদ পর্যন্ত পোঁছতে পারলেই হত, ফেরার সময় বাসায় নামিয়ে দেয়ার জন্য বান্ধবীদের অভাব হতনা। এদের অনেকেই নিয়মিত মসজিদের ইফতারে অংশগ্রহণ করতেন, অনেকেই সাত আটশ মানুষের খাবার প্রস্তত এবং বিলি করায় সময় এবং শ্রম দিয়েছেন। কোন কাজটি করলে আল্লাহকে বেশি পরিমাণ সন্তুষ্ট করা যায় সেভাবে পরিকল্পনামাফিক কাজ করায় তাঁদের প্রতিযোগিতা আমাকে যেন সাহাবাদের যুগের কথাই মনে করিয়ে দিত।

আমাদের এবারের প্রজেক্ট ছিল তিনজন গরীব মেয়ের বিয়ের আয়োজন, একজন রোগীর জন্য টাকা তোলা এবং আরেকজন রোগীর তদারক- এ’ব্যাপারে বন্ধুদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ এবং অকাতরে দান আমাকে অভিভূত করেছে। শনিবার দুপুরগুলো বান্ধবীরা একত্রে বসে ক্কুরআন সঠিকভাবে পড়ার চেষ্টা, পঠিত সুরাগুলোর অর্থ আলোচনা করা, নতুন সুরা শেখার সংকল্প এবং নামাযের পদ্ধতিগুলো আরেকবার সহি করে নেয়া যেমন জ্ঞানসংগ্রহের দিক থেকে আনন্দদায়ক ছিল তেমনি ছিল কলহাস্যে ভরপুর। ক্কদরের রাতটিকে পাবার আকুতি নিয়ে বাচ্চাদেরসহ মায়েদের কিয়ামুল লাইল অনুষ্ঠান ছিল বিশেষ আনন্দের উৎস। এবার তেইশের, পঁচিশের এবং সাতাশের রাত কাটে বান্ধবীদের সাথে। শুদ্ধভাবে ক্কুর’আন পড়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আয়াত নিয়ে আলোচনা, নামাজের ভুলত্রুটিগুলো শুদ্ধ করে নেয়া, টুকটাক সমস্যাগুলোর সমাধান জেনে নেয়া, প্রশ্নোত্তর, সারিবদ্ধভাবে তাহাজ্জুদ নামায পড়া, বাচ্চাদেরসহ একত্রে দুয়া করা এবং সবশেষে একেকজনের একেক তরকারী চেখে সেহরী সম্পাদন করার মধ্য দিয়ে কখন যে রাত কেটে যায় ছোট ছোট বাচ্চাগুলো পর্যন্ত টের পায়নি! এরাই আবার বাসায় গিয়ে দু’একঘন্টা ঘুমিয়ে ছুটেছে কাজে কিংবা স্কুল কলেজে।

ঈদের দু’একদিন আগে থেকে রামাদানের আসন্ন বিদায়ে মন খারাপ হতে থাকে। তাইতে আবার শুক্রবার দুপুরে রামাদানের শেষ জুমা পড়লাম আর রাতে শেষ তারাবী। তারাবীর শেষ রাকাত পড়তে পড়তে অনেকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, আগামীবার তারাবী পড়তে পারব তো? প্রতিটি রাতে তারাবীর পর, প্রতিটি জুমায় নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ সম্মিলিতভাবে দুয়া করেছে সিরিয়া, বার্মা, প্যলেস্টাইন, আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মীর, সোমালিয়াসহ বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত নিপীড়িত ক্ষুধার্ত বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের জন্য। সাহায্যের ডাক শুনে মূহূর্তে কালেকশন হয়ে যায় হাজার হাজার ডলারের ডোনেশন। দাতাদের অধিকাংশই আরবী এবং পাকিস্তানী, অনেকের নিজেদেরই হয়ত চলতে কষ্ট হয়, কিন্তু দেয়ার বেলা এদের হারাবার মত অর্থ আমাদের অনেকের থাকলেও মনমানসিকতার অভাব প্রকট।

রোজার শেষ দিকটায় আমার বিমর্ষ হৃদয় রঙ্গীন করে তোলে আমার দুই সন্তান। এরা দু’জনেই কিয়ামুল লাইলে সারারাত জেগে আলোচনা শুনেছে, নামায পড়েছে, দুয়ায় অংশগ্রহণ করেছে। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বমানবতা যেখানে সীমাহীন কষ্টে নিমজ্জিত সেখানে নিজের জন্য নতুন জামা কিনে ঈদের আনন্দ করা লজ্জার ব্যাপার। বরং তাদের টার্গেট হয়ে দাঁড়ায় ঈদের আগেই কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আরো কিছু কাজ করে নেয়া যায়। ঈদের দু’দিন আগে থেকে রাদিয়া বিভিন্ন ছোট বন্ধুদের এবং আন্টিদের হাত ঈদের আনন্দে রাঙ্গিয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে, ওর কাজ শেষ হয় ঈদের রাতে রাত সাড়ে বারোটায়। দুই ভাইবোনে সিদ্ধান্ত নেয় ওদের ঈদির টাকা সোমালিয়ায় পাঠিয়ে দেবে দুঃস্থ জনগণের সাহায্যের জন্য, আমার বারো বছরের কন্যা আর পুত্র যার এখনো ছয় বছর হয়নি- ওদের সোৎসাহ আলোচনা শুনে ভাবি, ‘আমার পিচ্চিগুলো কবে এত বড় হয়ে গেল?!’

ঈদের সকাল হয় মহাধুমধামের ভেতর দিয়ে। মহিলাদের জন্য দোতলা মসজিদ এবং জিমনেশিয়াম সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়ে পুরুষদের জন্য নামাজের আয়োজন করা হয় মাঠে তাঁবুতে। মসজিদের সামনে পৌঁছে কয়েক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে যায়। জেসমিন আপা দেখি অনেক আগে এসেও জায়গা সংরক্ষণ করার পরিবর্তে বাইরে দাঁড়িয়ে জনস্রোত দেখছেন। অভিভূত বান্ধবী বললেন, ‘এই দৃশ্য দেখে আমার হজ্জ্বের কথা মনে হচ্ছে। পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন চেহারার, বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন মনমানসিকতার নারীপুরুষ শিশু সব দলে দলে ছুটে আসছে- আজ তাদের একটাই পরিচয়- তারা এক আল্লাহয় বিশ্বাসী। কেবল আজ তারা ‘লাব্বাইক’ বলার পরিবর্তে বলছে ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। ক্যানাডার মত জায়গায় এই দৃশ্য আল্লাহ আমাদের দেখালেন, তাই চোখে মেলে দেখছি আর দেখছি...’।

ঈদ জামাতে ঘোষোনামোতাবেক চল্লিশ হাজার মানুষ হয়েছিল। অথচ কোথাও কোন বিশৃংখলা ছিলোনা, নামায শুরু হয় ঠিক সময়, নামাজের আগে ইমাম তাকবীরগুলো বুঝিয়ে দেন, অতঃপর মুনাজাতে বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের জন্য এবং আমাদের রামাদান আল্লাহ কবুল করে নেয়ার জন্য দুয়া। এই বিশাল আয়োজনকে সফল করার জন্য হাজার হাজার ভলান্টিয়ার নিযুক্ত ছিল- তাঁবু খাটানো থেকে মসজিদ পরিষ্কার করা, শৃংখলা বজায় রাখা, দানের টাকা সংগ্রহ করা থেকে সকল কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তাদের রামাদানকে সফলভাবে সমাপ্ত করে। ভলান্টিয়ারদের অধিকাংশই ছিল স্কুল কলেজগামী টিনেজার। সংকল্প করলাম আগামীবার থেকে আমরাও অংশগ্রহণ করব এই বিশাল কর্মযজ্ঞে।

মসজিদের আশেপাশে শুধু একটি হোটেল এবং একটি কফিশপ ছাড়া সকল প্রতিষ্ঠান তাদের পার্কিং ছেড়ে দেয় মুসল্লীদের গাড়ী রাখার জন্য। সরকার রাস্তায় গাড়ী রাখার ব্যাবস্থা করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে দেয়। সব মিলে চারহাজার গাড়ীর পার্কিংয়ের ব্যাবস্থা করার পরও অনেকে দূর দুরান্তে গাড়ী রেখে মসজিদ পর্যন্ত হেঁটে আসেন। ফেরার পথে রাস্তায় মুসল্লীদের গাড়ীর ভিড় দেখে মনে হয় আজ সত্যিই যেন সবাই ঈদের হৈহুল্লোড় করতে করতে ফিরে যাচ্ছে।

মসজিদে নানাবিধ খাবার দাবাড় এবং অন্যান্য আয়োজন ছিল দিনটি সবার জন্য আনন্দময় করে তোলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমরা মসজিদ থেকে বেরোবার আগেই খবর পাই মেহমান দরজায় অপেক্ষা করছে। তাই দ্রুত ফিরে আসতে হয়। তারপর একের পর এক মেহমান আসতে থাকে। তিনটার দিকে সিদ্ধান্ত নেই এবার নিজেরা বেড়াতে বের হব। ঘুরতে ঘুরতে কিভাবে যে পনেরোটা বাসা ঘোরা হয়ে গেল জানিনা। হাফিজ সাহেবের ঈদ রুটিন হোল ঘুমানো। বিয়ের পর থেকে এর ব্যাতিক্রম দেখিনি। কিন্তু এবার বান্ধবীদের প্ল্যান ছিল যে বাসায় যাব সবাই একসাথে যাব। তাই সকালে সবাই একসাথে এসে দুপুরে আমাদের নিয়ে বের হয়ে গেলেন, সবাই একসাথে গল্পগুজব করতে করতে কেউ টেরই পাইনি আমরা আসলে কতটা ক্লান্ত। আমাদের নিয়ে শহরের এমাথা ওমাথা ছুটোছুটি করতে করতে পরিশ্রান্ত ভাইরা শেষমেশ পরামর্শ দিলেন আগামীবার থেকে এত ঘোরাঘুরি না করে বরং সবাই এক জায়গায় মিলিত হয়ে খাওয়া দাওয়া করলে কেমন হয়! রাতে যখন ঘুমাতে যাব তখন মনে হচ্ছে যেন রাজ্যের ক্লান্তি চোখের পাতা দু’টো আপনি বন্ধ করে দিচ্ছে! দেশে ফোন করা আর দেশ থেকে ফোন আসার আনন্দ তো আছেই, বন্ধুদের আসা যাওয়া এবং আমাদের দাওয়াত দেয়াও এখনো অব্যাহত আছে যদিও ঈদ শেষ হয়ে গেছে সেই কবে!

সৎ এবং সাহসী মানুষ

১।
জোন অফ আর্ক, ইখতিয়ারুদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজি, উসামা বিন জায়েদ- এরা ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে জন্মেছে এবং বেড়ে উঠেছে। কিন্ত এদের মাঝে রয়েছে এক বিরল সাদৃশ্য। এরা প্রত্যেকেই জাতির সংকটময় মূহূর্তে নিজ নিজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে অকল্পনীয় পরিস্থিতির ভেতর বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এদের আরেকটা মিল হোল ওরা সবাই ছিল টিনেজার- early teenager. অথচ তাদের বোঝার ক্ষমতা, মেধা, যোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা ছিল অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ এবং পরিপক্ক লোকজনকে পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট। আজ পৃথিবীর কোথাও কি আমরা এমন একজন টিনেজার খুঁজে বের করতে পারব?

আমাদের টিনেজারদের দোষ নয়- তাদের বাবারা কলের ইঁদুরের মত টাকার পেছনে ছুটছেন, পরিবারকে এনে দিচ্ছেন সকলপ্রকার ধনসম্পদ প্রাচুর্য সম্ভার কিন্তু সন্তানের গঠনপ্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ করার সময় নেই; মায়েরা স্বাভাবিকভাবেই অনুভূতিপ্রবণ এবং সন্তানের কল্যাণকামী, কিন্তু স্বামীর অনুপস্থিতিতে সন্তানকে আগলে রাখার প্রবণতা বেড়ে এমন এক পর্যায়ে চলে যায় যা তাকে পঙ্গু করে ফেলার জন্য যথেষ্ট। আর স্বামী যখন সর্বদাই অনুপস্থিত তখন মায়ের এই অতিরিক্ত protectiveness সন্তানকে কি জোন অফ আর্ক বা বখতিয়ার খিলজি বানাবে না ভিডিও গেমে পুরো পৃথিবীকে কুপোকাত করে ফেললেও বাস্তব পরিস্থিতিতে অকেজো করে ফেলবে তা সহজেই অনুমেয়।

২।
মিশরের প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাহ ফেরাউন, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর মহান অধিপতি, ধনৈশ্বর্য্যের কোন ঘাটতি নেই তার রাজ্যে, চারিদিকে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল পিরামিড তার নিজের এবং পুর্বপুরুষদের ক্ষমতার দম্ভের স্তম্ভ হিসেবে, রাজপ্রাসাদে উপচে পড়ছে সুখের সমস্ত আয়োজন- কিন্তু সে সুখি নয়, কারণ সারা পৃথিবী স্ত্রীর পদতলে উজার করে দিলেও তার স্ত্রীর কাছে তার ক্ষমতা এবং অহংকারের কোন মূল্য নেই। স্ত্রী আসিয়া তাকে মুখের ওপরেই বলে- এই ক্ষমতার উৎস অত্যাচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত, এই প্রাসাদ আর পিরামিড দরিদ্রের অধিকার কেড়ে নিয়ে গড়ে তোলা, সে এর কোন অংশই চায়না, সে ফেরাউনকে দেবতা বলেও স্বীকার করেনা বরং সে আল্লাহর কাছে জান্নাতে একটি ঘর চায়। চূর্ণবিচূর্ণ অহংকারে, রাগে, ক্ষোভে ফেরাউন প্রিয়তমা স্ত্রীকে ফুটন্ত তেলের কড়াইয়ে চুবিয়ে মারে। আসিয়া একে ফেরাউনের সাথে বসবাসের চেয়ে শ্রেয় মনে করে মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে নেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদী এবং জীবনের প্রতি নির্মোহ মহিলা আজকে ক’জন পাওয়া যাবে?

আজকের নারী অপরিচিত পুরুষের মুখে সামান্য একটু প্রশংসা শোনার জন্য নির্দ্বিধায় পোশাক খুলে ফেলছে, সামান্য ক’টা টাকার জন্য বিকিয়ে দিচ্ছে নিজের সর্বস্ব, বাবা মা মেয়েকে মডেল বা অভিনেত্রী পরিচয় দিতে পেরে গর্বে বুক ফুলে ফেটে পড়ছেন- তারা কি জানেন না এর জন্য তাদের সন্তানটিকে কি কি করতে হচ্ছে? আজ একটা মেয়ের স্বপ্ন হয় ছোট্ট একটা ঘর, ছোট্ট একটা গাড়ী, স্বামীর ভাল চাকরী, ছোট্ট সুখের সংসার- হায়! ক’জন স্বপ্ন দেখে জান্নাতে একটি বাড়ীর?

৩।
বিখ্যাত সেনা কমান্ডার হ্যানিবলকে যখন খবর দেয়া হোল সামনে আল্পস পর্বত, এর ওপর দিয়ে কিছুতেই হাতি পার করা যাবেনা, তিনি বললেন, ‘I will either find a way or make one’.
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলতেন, ‘Impossible is a word to be found only in the dictionary of fools’.
তারিক বিন জিয়াদ অনিচ্ছুক সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার পথ রোধ করার জন্য জাহাজ জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের বললেন, ‘We now have the enemy in front of us and the deep sea behind us. We cannot return to our homes, because we have burnt our boats. We shall now either defeat the enemy and win or die a coward’s death by drowning in the sea. Who will follow me?’

আজকের যুদ্ধটা একটু অন্যরকম।
সৎভাবে উপার্জন করার কথা বললে একজন পুরুষ বলেন, ‘তাহলে আমার সংসার চলবে কি করে?’
জীবিকা এবং পরিবারের মাঝে সময় বন্টন করে দেয়ার কথা বললে বলেন, ‘দিনটা মোটে ২৪ ঘন্টার, এর মধ্যে এত কিছু কি করে ম্যানেজ করা সম্ভব?’
অন্যায় avoid করার জন্য চাকরী পরিবর্তন করার কথা বললে আঁতকে ওঠেন, ‘এই দুর্মূল্যের বাজারে চাকরী ছাড়লে আবার চাকরী পাবার নিশ্চয়তা কি?

তাদের একবারও কি মনে আসে, সন্তানকে অন্যায়ের ভিত্তির ওপর খাইয়ে পরিয়ে বড় করলে সে সৎ এবং সাহসী মানুষ হবে তার নিশ্চয়তা কি?

৪।
একজন মুহাম্মাদ, যেদিন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সেদিন অসম্ভব ভয় পেয়ে গেলেন, নিজের ওপরেই আস্থা হারিয়ে ফেললেন। তখন একজন খাদিজা তাকে আশ্বস্ত করলেন, একজন সৎ ব্যাক্তিকে কোন অন্যায় স্পর্শ করতে পারেনা, এবং জগতশ্রেষ্ঠা চার নারীর একজন হয়ে গেলেন। একজন আবু বকর দৃঢ়চিত্ত রইলেন, যে কোনদিন মিথ্যা বলেনি সে চল্লিশ বছর বয়সে মিথ্যা বলা শুরু করতে পারেনা তা তার কথাবার্তা যতই অবিশ্বাস্য শোনাক না কেন। একজন কিশোর আলী নেতৃস্থা্নীয় লোকদের পাহাড়প্রমাণ তাচ্ছিল্যের সামনে বুক চিতিয়ে বলল, ‘আপনার পাশে আর কেউ না থাকলেও আমি আছি’। একজন উমার সত্যের স্পর্শে এক মূহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠল। এভাবে একজন একজন মানুষ এক একটি বিশেষ মূহূর্তে এগিয়ে এসে সারিবদ্ধ হয়ে একটি সম্পূর্ন পৃথিবীতে পরিবর্তনের ঢেউ ছড়িয়ে দিল। এভাবেই এক একজন মানুষ শুধু নিজের দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে ভাবার মাধ্যমেও পুরো পৃথিবীর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। প্রশ্ন হোল আমরা ব্যাক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্বের কথা ভাবছি কিনা।

৫।
পরিবারে সবার বড় ছিলাম। যুদ্ধের ময়দানে সম্মুখসমরে অভ্যস্ত। তাই পরিস্থিতি যতই প্রতিকুল হোক, নৈরাশ্যবাদের বিলাসিতার সুযোগ হয়নি কখনো, রঙ্গিন চশমাও আঁটা হয়নি চোখে। জীবনকে দেখি প্রখর বাস্তবতার স্পষ্ট আলোয়।

আজকের পৃথিবীতে সৎ নেতার অভাব, সাহসী লোকের অভাব- নেতারা জনগণকে বিনোদনের রঙ্গিন চশমা পরিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখে যেন সে সুযোগে তারা ইচ্ছেমত করতে পারে, তারা কখনোই চাইবেনা সমাজের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাক, কারণ তখন সবাই তাদের পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাবে; সংসারের ঘানিটানা জনগণের মাঝে জেগে ওঠার সাহসের অভাব, স্বপ্ন দেখার সাহসের অভাব, যদি স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়! তার চেয়ে কল্পনার রঙ্গিন জগতে বসবাস করা সহজতর!

কিন্তু আসল অভাবটা অন্য জায়গায়। একটি সমাজ অনেকগুলো পরিবারের সমষ্টি। এই পরিবারকে গড়ে তোলেন একজোড়া পিতামাতা। একজন পিতা তার সন্তানকে শেখাবেন কিভাবে মাছ ধরতে হয়, কিভাবে শিকার করতে হয়, কিভাবে নদীতে সাঁতার দিতে হয়, কিভাবে নৌকা বাইতে হয়, কিভাবে গাড়ী চালাতে হয়, কিভাবে চাষ করতে হয়, কিভাবে বাজার করতে হয়, কিভাবে নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখতে হয়- এই দায়িত্বগুলো একজন মাকে দিয়ে হয়না। বাবা যদি সময় দিতে ব্যার্থ হন তখন সন্তানের পৌরুষসূচক গুণাবলীতে ঘাটতি রয়েই যায়। একজন মা সন্তানকে শেখাবেন আদবকায়দা, ভদ্রতা, কোমলতা, গৃহের প্রতি দায়িত্ব, পরিবারের সদস্যদের প্রতি সদাচরন এবং তিনিই সন্তানকে শেখাবেন একবার পড়ে গেলে কিভাবে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়। মা যদি সময় বা সাহস দিতে ব্যার্থ হন তখন এই সন্তান যতই আদরযত্নে বেড়ে উঠুক না কেন তার এই দিকগুলো বিকশিত হবার সুযোগ পায়না।

আজকের ছেলেমেয়েরা বড় হয় ফার্মের মুরগীর মত করে- ফার্মের মুরগীর মতই তাদের কেবল দেহটা বাড়ে, কিন্তু তাদের বোধবুদ্ধিতে প্রসার ঘটেনা। ফলে এরা বড় হয়ে চাকরীবাকরী করে খেয়েপরে চলতে পারে, এর বেশি আর কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তাদের জীবনে প্রতিফলিত হয়না। এদের দিয়ে সমাজপরিবর্তন তো দূরে থাক, সমাজের উপকার হবারও কোন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়না। তাই আজকাল একটি কিশোর তার ফ্লাস্ক থেকে ভিক্ষুকের গ্লাসে পানি ঢেলে দিচ্ছে দেখলে আমরা আপ্লুত হই, কেউ রাস্তায় টাকা পেয়ে মালিককে ফিরিয়ে দিলে অবাক হই, কেউ শালীনভাবে চললে তার প্রশংসা করি- আমাদের মাথায় এটা আসেনা যে এগুলো তো স্বাভাবিক মানবিকতার সর্বনিম্ন পর্যায়! অথচ পৃথিবীব্যাপী মানুষ পশুবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পন করছে; সামান্য ক’টা টাকার জন্য আমাদের আশেপাশেই মানুষ খুনজখম স্মাগলিং রাহাজানি ছিনতাই করছে; মানুষ মানুষকে মেরে ফেলছে, মাতৃগর্ভে শিশু পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছেনা- আর আমরা কি করছি? আমরা পেপার পড়ে মুখে ‘চু চু’ শব্দ করছি, নতুবা টিভিতে এই বীভৎসতা দেখে চ্যানেল পরিবর্তন করে দিচ্ছি, চায়ের কাপে ঝড় তুলে নাচগানের অনুষ্ঠানে ডুবে যাচ্ছি। ব্যাস, আমাদের দায়িত্ব শেষ! তাই ভাবি, পৃথিবীতে হয়ত এখন আর সৎ এবং সাহসী মানুষজন জন্মায়না- তাদের ধারণ করার মত মা এখন আর নেই, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার মত বাবা এখন আর নেই, তাদের গ্রহণ করার মত সমাজ এখন আর নেই, তাদের মূল্যায়ন করার মত নেতৃত্ব এখন আর নেই। এটা নৈরাশ্যের কথা নয়, এটাই বাস্তবতা।

অপেক্ষা

১।
আমার ছোট দু’ভাইকে স্কুলে দিয়ে এসে গেট বন্ধ করেছি, সাথে সাথে দরজায় করাঘাত শুনে গেট খুলে দেখি আমার খালাত ভাই, সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি এক অদ্ভুত প্রাণী! সে আমার সাথে কোন কথা বলল না, সোজা ঘরে ঢুকে মাকে বলল, ‘খালা, কি এক আশ্চর্য মেয়ে তোমার! ও যখন আহমাদ মুহাম্মদকে স্কুলে দিতে যাচ্ছে তখন আমি এদিকে আসছি। পথে ওদের দেখে সালাম দিলাম। ও কিছু বললনা দেখে ভাবলাম ওদের স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই কথা বলেনি। পথের ধারে দাঁড়িয়ে রইলাম ও আসার সময় একসাথে আসব। আসার সময় দেখি ও আমার আগে আগে হেঁটে চলে আসছে। আমরা তো জানি ও তেমন একটা কথা বলেনা। তাই ভাবলাম চুপচাপ হাঁটছে। কিন্তু ও যখন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল তখন বুঝলাম ও আমাকে আদতেই দেখেনি! আধাঘন্টা পেছনে পেছনে থাকার পরেও সে কিছু বুঝতে পারেনি! এভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটলে কোনদিন দেখ কিছু হয়ে যাবে...’
মা হেসে বলল, ‘যাক,অন্তত গর্তে পড়ে মরবেনা, তাই বা কম কি?’

২।
একটিমাত্র পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে সারি সারি লোকজন বসে আছে, আমিই একমাত্র মহিলা। বাইরের রুমে জায়গায় সংকুলান হচ্ছেনা দেখে ভেতরের একটা রুমে জায়গা পেলাম বসার। ভেতরে বসে শুনতে পাচ্ছি কারো উচ্ছাস, কারো উৎকন্ঠা, কারো উদ্বেগ আর সবকিছু ছাপিয়ে আড্ডাবাজ হাফিজ সাহেবের গপ্প করার পুঞ্জীভূত শব্দমালা। কিছুক্ষণ পর অনার্স মাস্টার্সে আমার সহপাঠী আতিককে রুমে ঢুকতে দেখে খুব আশ্চর্য হলাম। ‘কেমন আছ, ভাল আছি’ টাইপ কথাবার্তার পর সে সামনের চেয়ারটাতে বসে বলল, ‘বাইরে একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হোল...’।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না এতে ও কি বোঝাল বা আমার কি বলা উচিত, তাই বললাম, ‘তো?’
সে বলল, ‘উনি বললেন উনি নাকি তোমার হাজব্যান্ড!’
হাসি পেয়ে গেল, ‘তোমার কি মনে হয় উনি মিথ্যা বলেছেন?’
‘না, আমি কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারিনি তাই তোমার কাছে সত্যতা যাচাই করতে এলাম’।
এবার আমি সত্যিই অবাক হলাম, ‘মানে?’
‘দেখ, আমরা একসাথে ছয় বছর পড়াশোনা করেছি। এই ছয় বছরে তুমি আমার সাথে কথা বলেছ চারবার আর তানভীরের সাথে দুইবার, তাও নেহায়েত প্রয়োজনে। ক্লাসের আর কোন ছেলের সাথে কখনো কথা বলেছ বলে জানা নেই। সিনিয়র ভাইদের অনেককেই তুমি অনুষ্ঠানের সময় নিজে না খেয়ে বিরিয়ানি প্যাকেট দিয়ে দিয়েছ ওদের ক্ষুধা দেখে, তাই ওরা তোমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু তাদের সাথেও তুমি তেমন কথা বলেছ বলে শুনিনি। হ্যাঁ, জুনিয়র ছেলেরা তোমাকে আপু হিসাবে খুব পছন্দ করে কারণ তুমি ওদের সবসময় বইখাতা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু ওদের সাথেও তোমার কথাবার্তা ছিল নিয়ন্ত্রিত। তাই সত্যি বলতে কি আমরা সবাই তোমাকে খুব ভয় পেতাম। আমাদের ধারণা ছিল তোমাকে কেউ কোনদিন বিয়ে করতে সাহস করবেনা’।
আমি কি বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুবে থাকার পর আতিক অবিশ্বাসের স্বরে বলল, ‘হাফিজ সাহেব কি আসলেই তোমাকে বিয়ে করেছেন?’
আমি হেসে ফেললাম, ‘হ্যাঁ, আমার বিয়ে হোল মাস্টার্স পরীক্ষার মধ্যখানে, তাই সবাইকে বলার সুযোগ হয়নি। বান্ধবীদের কয়েকজন গিয়েছিল। কেন, বর্ণালি তো গিয়েছিল! ও তো তোমার পাশের বাসায়ই থাকে, আমার ধারণা ছিল তুমি ওর কাছে শুনেছ। আমার একটা মেয়েও আছে, আজ ওর বয়স চল্লিশ দিন হোল’।
ও মাথা ঝাড়া দিয়ে পরিষ্কার করে বলল, ‘হাফিজ ভাই অনেক সাহসী মানুষ!’
হাসতে হাসতে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম ইন্টারভিউ কেমন হোল। টুকটাক কিছু প্রশ্ন যেগুলোর উত্তরের ব্যাপারে ও নিশ্চিত ছিলোনা সেগুলো আলাপ করে জেনে নিলো। বুঝলাম ইন্টারভিউ সহজ হবেনা।
যাবার সময় সে আবার মন্তব্য করে গেল, ‘হাফিজ ভাই খুব ভাল মানুষ। যেমন হাসিখুশি তেমনি আড্ডাবাজ। আমার মনে হয় উনি খুব কেয়ারিং, তোমাকে সাহস দেয়ার জন্য উনি কাজ ফেলে এখানে এসে বসে আছেন, তাই এমন মনে হোল’।

আমার ইন্টারভিউ বরাবর ভাল হয় যেহেতু আমি চ্যালেঞ্জ ভালোবাসি। এবারের ইন্টারভিউও খুব ভাল হয়েছিল। চাকরীটা পেয়েছিলাম। পরে যখন জেনেছি ওদের একটামাত্র পদ ছিল, তাও কোন পুরুষের জন্য, তখন অর্জনটাকে একটু বেশিই মনে হয়েছিল!

৩।
স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের মাহমুদ ভাই একবার কথাপ্রসঙ্গে স্বীকার করে ফেললেন, ‘আপা, আমরা আপনাকে দূর থেকে দেখলে ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতম মিনাজ জালিমিন’ পড়ি’।
বলতে বলতে পুরো দুয়া পড়ে ফেলায় ভীষণ হাসি পেয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন ভাই, আমি কি এতই ভয়ানক?’
নিজের অপ্রত্যাশিত স্বীকারোক্তিতে মাহমুদ ভাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘আসলে তা না আপা। আপনি অনিয়ম পছন্দ করেন না, অন্যায় দেখলে সাথে সাথে প্রতিবাদ করেন, স্বাভাবিক মহিলাদের মত চুপ থাকেন না...’
এবার মেজাজটা খিঁচড়ে গেল, ‘স্বাভাবিক? তার মানে মহিলারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে এটা অস্বাভাবিক? নাকি মহিলারা সব অন্যায় মুখ বুজে মেনে নেবে এটা স্বাভাবিক?’
উনি ভড়কে গিয়ে বললেন, ‘সেটা বলিনি আপা, আমরা আমাদের আশেপাশে এমন মহিলা দেখে অভ্যস্ত না। তাই...’
বুঝলাম আমার বোনেরা ছাড় দিতে দিতে নিজেদের এমন অবস্থানে নামিয়ে ফেলেছেন যে একজন মহিলা ন্যায়ের কথা বললে, অধিকারের কথা বললে, ন্যায্য কথা বললে কিংবা অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে আমাদের ভাইদের সেটা এক ভয়াবহ অস্বাভাবিকতা মনে হয়!

৪।
আমার বন্ধুরা বলতেন, ‘আপনার সাথে কথা বললে মনেই হয়না আমরা কোন মহিলার সাথে কথা বলছি’।
বান্ধবী শিমু বলত, ‘এই গুণটি অর্জন করা আমার স্বপ্ন’।

কিন্তু আসলে এটা খুব কঠিন কিছু না। একবার টিভিতে একজন । অ্যামেরিকান বাস্কেটবল খেলোয়ারের সাক্ষাতকার দেখেছিলাম যার বক্তব্য ছিল, ‘abstention, not safe sex, is the answer’. অ্যামেরিকায় বাস্কেটবল খেলোয়ারদের প্রভাব এবং ইমেজ সম্পর্কে অনেকেই জানেন। মেয়েরা সর্বস্ব লুটিয়ে দেয় এদের সান্নিধ্য পাবার জন্য। সেক্ষেত্রে তিনি কিভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখেন জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ‘আমি তাদের সাথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও বলিনা এবং কথা বলার সময় তাদের দিকে না তাকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি’। ছয় ফুটাধিক একজন ব্যক্তির জন্য নীচের দিকে তাকিয়ে থাকা, এমনভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা যেন চোখের সামনে যা আছে তা চোখে না পড়ে, কত কঠিন তা আমাদের মত স্বাভাবিক উচ্চতার মানুষের পক্ষেও আন্দাজ করা সম্ভব যাদের দীর্ঘসময় ঘাড় নীচু করে রাখলে ঘাড় ধরে যায়। কিন্তু তিনি বললেন না তাকানোই সবচেয়ে সহজ উপায় কারণ চাহিদার সৃষ্টি চোখ থেকেই শুরু হয়। তারপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন কিভাবে দু’একটা কথা থেকেই শুরু হয়ে এক পর্যায়ে আর নিজের ওপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা, তখন চাহিদাটাই হয়ে যায় মুখ্য, সমস্ত বিবেক বিবেচনা লোপ পায়, এভাবেই ঘটে অনেক উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের অকাল মৃত্যু কিংবা চুনকালি মাখা পরিসমাপ্তি। সুতরাং, নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই। আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শ্রেষ্ঠ উপায় চোখ এবং কথাবার্তা নিয়ন্ত্রণ করা।

আমি ভাবতাম অ্যামেরিকার মত উন্মুক্ত পরিবেশে একজন বাস্কেটবল স্টার, সারা পৃথিবী যেখানে তার হাতের মুঠোয় নিজেকে জলাঞ্জলি দেয়ার অপেক্ষায়, নিজেকে সাধারন দু’টো পদ্ধতি ব্যাবহার করে নিরাপদ রাখতে পারেন, নিজের ভবিষ্যতকে ধুলিস্যাত হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেন- আমি কেন পারবনা? সুতরাং, আমি এমন কোন মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করিনি যা পৃথিবীতে আর কোনদিন ঘটেনি। বরং তাঁর এই দৃষ্টান্ত অনুসরন করার ফলে আমি কোনদিন কোন ঈভটিজারের অস্তিত্ব টের পাইনি; আমার সহপাঠীরা যখন প্রেম করে সময় নষ্ট করেছে তখন আমি লেখাপড়া করে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি; ওরা যখন লুকিয়ে লুকিয়ে পার্কে আর নদীর ধারে ঘুরেছে তখন আমি দেশবিদেশে ঘুরে বেরিয়েছি কারণ আমার বাবামার বিশ্বাস ছিল আমি কোন অন্যায় করবনা, কোথাও পছন্দ হলে তাদের জানাব; বন্ধুরা নারী হিসেবে দেখার কথা ভাবেনি তাই মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন পেয়েছি; পরিচিতজনদের কাছে সম্মান পেয়েছি, অপরিচিতজনদের কাছ থেকে সম্মান আদায় করতে পেরেছি; সবচেয়ে বড় কথা এমন একজন সাথী পেয়েছি যার বন্ধুত্ব আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

আজকাল যখন পুঁচকে পুঁচকে ছেলেমেয়েদের দেখি একদিকে ভিডিও গেম খেলে আরেকদিকে খেলার মতই হাল্কা মুডে প্রেম করে, যাদের না আছে দায়িত্ব নেয়ার যোগ্যতা আর না আছে প্রেমের ক্ষেত্রে দায়িত্ব সম্পর্কে ধারণা, তখন খুব অবাক লাগে। জীবনে কিছু অর্জন করার জন্য কিছু যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। যোগ্যতা অর্জনের আগেই যে প্রাপ্তি তাতে ফাঁকি থাকবেই যেমন স্বল্পমূল্যে কেনা জিনিস টেকসই হয়না। সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজে সৎ না হয়ে আরেকজনের কাছে কিভাবে সততা আশা করতে পারি? এমন হয়না, হতে পারেনা।

নারীপুরুষের সামাজিক সম্পর্ক স্বচ্ছ এবং ক্লেদমুক্ত রাখার জন্য স্বল্প এবং প্রয়োজনীয় কথায় কথাবার্তা সীমাবদ্ধ রাখার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং, আমরা যদি সামাজিক বিশৃংখলা বন্ধ করতে চাই তাহলে সবার আগে নারীপুরুষ নির্বিশেষে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আজকের ‘আমি’কে চিন্তা করতে হবে আগামিকালের ‘আমি’র কথা যে একদিন কারো স্ত্রী হবে, কারো মা হবে, কারো দাদী বা নানী হবে। সময় কাউকে ছেড়ে কথা কয়না। আমি যদি আজ অন্যায় করি, কাল আমার সন্তানকে আমি অন্যায় করতে দেখে বাঁধা দিতে পারবনা, কারণ সেই অধিকার আমি সেদিনই হারিয়েছি যেদিন আমি চাহিদাকে বিবেকের ওপরে স্থান দিয়েছি। সুতরাং, চাহিদার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই নির্ধারণ করবে আমার অদূর থেকে সুদূর সর্বপ্রকার ভবিষ্যত। আজকের একটু ধৈর্য্য আগামিকাল এনে দেবে অতুল বৈভব যার কাছে সব কষ্ট মলিন হয়ে যাবে। এই বিশ্বাস নিয়ে যদি আমাদের ছেলেমেয়েরা দিন গুনত তাহলে কি এমন পঙ্গপালের মত ছুটে চলত অর্থহীন পথে কিংবা হতে পারত অন্যের বিরক্তির কারণ? তখন তাদের নিয়ে আমরা সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারতাম, ওদের স্বপ্নগুলোও পূরণ হত কারণ all good things come to those who wait.

জীবনের উদ্দেশ্য

আইসল্যান্ডের এক যুবক, বয়স ২৭, পেশায় জেলে। নিজের নৌকা নেই তাই অন্যদের নৌকায় ভাড়া খাটে।

সেদিন প্রচন্ড ঠান্ডা হলেও আবহাওয়া শান্তই ছিল। ওরা চারজন যখন নৌকা নিয়ে রওয়ানা দিল তখন সমুদ্রের পানি হ্রদের মত শান্ত। আধঘন্টা পর ফিয়র্ডের খাঁজে মাছ শিকার করছিল ওরা, মাছ পাওয়া যাচ্ছিল ভালই। হঠাৎ ফিয়র্ডের পানি অশান্ত হয়ে উঠতে লাগল, কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা দেখতে পেল সাগরের শান্ত পানিগুলো নৌকার খুব কাছেই চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। ইঞ্জিনে জোর টান দিয়ে ঘুর্ণিপাকের কাছ থেকে নৌকা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল ক্যাপ্টেন। প্রাণপনে চেষ্টা করেও যখন সে বুঝতে পারল নৌকা ঘুর্ণিপাকে প্রবেশ করছে, তখন নিরুপায় হয়ে সে সবাইকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষা করার চেষ্টা করতে নির্দেশ দিল। পানি ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা, দ্রুত পানি থেকে শুকনো জায়গায় উঠতে না পারলে হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু সলিল সমাধি থেকে প্রাণরক্ষা করতে চাইলে এর কোন বিকল্প ছিলোনা। আশেপাশে কোন নৌকার চিহ্ন পর্যন্ত নেই, মাটি অনেক দূরে, সাঁতার দিতে গেলে দেহ তাপশূণ্য হয়ে নিশ্চিত মৃত্যু। তবু যদি ভাগ্যক্রমে কোন নৌকা চলে আসে! তিনজন পানিতে লাফিয়ে পড়ল, একজন নৌকা থেকে বেরোতে পারলনা, নৌকার সাথেই তার সলিল সমাধি হোল। ভেসে রইল ওরা এক জায়গায় যেন শরীরের তাপ সংরক্ষণ করতে পারে। কিন্ত দিগন্তে কোন নৌকা দেখা গেলনা।

অপেক্ষার প্রহর সাঙ্গ হোল খুব দ্রুত। সাত মিনিটের মাথায় যুবকের দুই সঙ্গীর একজন হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যু বরন করল, দশ মিনিটের মাথায় ক্যাপ্টেন। যুবক আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করল সে কবে মারা যাবে। প্রচন্ড ঠান্ডা লাগলেও সে যখন দেখল সে মারা যাচ্ছেনা তখন সে তীরের উদ্দেশ্যে সাঁতার কাটার সিদ্ধান্ত নিল যদিও পথেই হয়ত সে মারা যাবে। আড়াই মাইল সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছল সে, না সে তখনো মরেনি। প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত সে অথচ আশেপাশে কোথাও কোন জনবসতি নেই। কিছুদুর হেঁটে এক চারণভূমিতে পৌঁছল সে। দেখতে পেল গরুছাগলের জন্য বালতিতে যে পানি রাখা হয়েছিল তার ওপরটা জমে বরফ হয়ে আছে কিন্ত নীচে সামান্য পানি টলটল করছে। কোন সহায়ক বস্তুর অভাবে সে খালি হাতে বাড়ি দিয়ে এই বরফ ভেঙ্গে সেই প্রচন্ড শীতল পানি পান করল। তারপর আবার হাঁটতে লাগল। আরো প্রায় ১৬ কিলোমিটার হেঁটে সে জনপদে পৌঁছল, তারপর নিজে নিজেই গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হোল। সমুদ্রতীর থেকে হাসপাতালের দুরত্ব ছিল মোট ২৬ কিলোমিটার।

তাকে দেখে তো ডাক্তারদের চক্ষু চড়কগাছ! এই লোকের তো বেঁচে থাকারই কথা না! তাকে সম্পূর্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হোল। সামান্য সর্দিজ্বর ছাড়া এই সম্পূর্ন ঘটনায় তার আর কোন শারিরীক সমস্যা হয়নি!

কিন্তু যুবক নিজে ব্যাপারটাকে এত সহজে ছেড়ে দিতে পারলনা। তাকে জানতেই হবে সে কিভাবে বেঁচে গেল যেখানে একজন সুস্থ মানুষ এই তাপমাত্রায় দশ মিনিটের বেশি বাঁচার কথা নয়। সব ছেড়েছুড়ে সে আবার লেখাপড়া শুরু করল। প্রচন্ড অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমের ফলে আট বছরের মাথায় সে ডাক্তারী পাশ করল। ডাক্তার হবার পর সে গবেষনা করতে শুরু করল কিভাবে সে সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। বিশ্বব্যাপী নানান সময় প্রচন্ড শীতে দীর্ঘসময় এক্সপোজ হবার পরেও প্রাণে বেঁচে গেছে বা কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এমন লোকজনের রিপোর্ট নিয়ে গবেষনা করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল যারা বেঁচে যায় তাদের প্রায় সকলেই শিশু- সে ছাড়া। তখন সে গবেষনা করতে শুরু করে শিশুদের এবং বড়দের শারিরীক কাঠামোয় এমন কি পার্থক্য আছে যার ফলে শিশুরা শীতল আবহাওয়াতেও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ থাকে অথচ বড়রা মারা যায়। সমস্ত শারীরবৃত্তিয় তথ্য একত্রিত করে তুলনামুলকভাবে সাজানোর পর সে দেখতে পেল পার্থক্যটা খবই সাধারন- শিশুদের শরীরে চর্বির স্তরগুলো শরীরের প্রায় সর্বত্র সমভাবে ব্যাপ্ত থাকে, কিন্তু মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চর্বিগুলো শরীরের কিছু নির্দিষ্ট অংশে গিয়ে জমা হয় এবং কিছু কিছু জায়গা থেকে চর্বি একেবারেই সরে যায়। চর্বির স্তর সর্বত্র সমভাবে বন্টিত হওয়ায় শিশুদের শীতে মৃত্যু বা ক্ষতি হয় কম। কিন্তু বড়দের শরীরের কিছু অংশ চর্বি দ্বারা সুরক্ষিত হলেও চর্বিশূন্য অপরাপর অংশ শরীরের ভেতর হতে তাপ ঠাণ্ডা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ায় বাঁধা সৃষ্টি করতে পারেনা। তাই শীতে বড়দের মৃত্যু বা ক্ষতির পরিমাণ বেশি।

এই গবেষনার মাধ্যমে সে জানতে পারল কিভাবে শরীর শীতলতা হতে নিজকে রক্ষা করে কিন্তু সে কিভাবে রক্ষা পেল তার তো কোন সুরাহা হোলনা। সে তখন নিজের শরীরের ওপর নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে এক বিস্ময়কর তথ্য আবিষ্কার করল। ওর শরীরে চর্বির স্তরগুলো অজ্ঞাত কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হয়নি, বরং শিশুদের মত শরীরের সর্বত্র সমভাবে ব্যাপৃত! আর একারণেই সে সেদিন কোনপ্রকার সমস্যা ছাড়াই বেঁচে গেছিল, অথচ ওর সঙ্গীরা ওর চোখের সামনে মারা গেল।

যুবক তখন ভাবতে শুরু করল সৃষ্টিকর্তা কেন তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন যেখানে সে সহজেই মারা যেতে পারত, কেন সে ডাক্তার হোল যেখানে জেলে জীবনের সহজতার বাইরে জীবনের কাছে কিছুই চাওয়ার ছিলোনা তার? তার এই বর্ধিত জীবনের উদ্দেশ্য কি? তখন সে সিদ্ধান্ত নিল সৃষ্টিকর্তা তাকে যে নতুন জীবন দিয়েছেন তাকে সে সৃষ্টির সেবায় ব্যায় করবে। রোগীদের সুষ্ঠু সেবা দেয়াই হয়ে উঠল তার জীবনের নতুন লক্ষ্য।

আমাদের বাসায় আমার দাদার আমল থেকে আমার আমল পর্যন্ত রিডার্স ডাইজেস্টের কালেকশন ছিল। এগার বছর বয়সে একবার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। আবুধাবীতে নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে রোগীর সাথে কেউ দেখা করার নিয়ম ছিলোনা, তাই সময় কাটানোর জন্য বাবা ক’টা রিডার্স ডাইজেস্ট দিয়ে যায়। তখন থেকেই আমার এই ম্যাগাজিনের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ম্যাগাজিনে ‘ড্রামা ইন রিয়েল লাইফ’ নামে একটা কলাম ছাপা হত যেখানে এমন কোন সাহসী মানুষের ঘটনা দেয়া হত যে নিজের বা অপরের কোন প্রতিকুলতাকে জয় করেছে বা করতে সাহায্য করেছে। কলামটা পরে বন্ধ হয়ে গেল কেন জানিনা। হয়ত এখন আর তেমন সৎ বা সাহসি মানুষ জন্মায়না! এই ঘটনাটা মনে গেঁথে গেছিল তাই আজ এতদিন পর আবার মনে পড়ল। পড়েছিলাম বিশ বৎসরাধিক আগে, তাই কবেকার সংখ্যা মনে নেই, সম্ভবত বাবার আমলের। যুবকের নাম মনে নেই, কিন্তু ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে। মনে আছে প্রতিটি মিনিট, দুরত্ব, বছর আর বয়সের হিসেব কষা। কিন্তু ঘটনাটা শুধু পরিসংখ্যানভিত্তিক কারণে এতটা নাড়া দেয়নি। নাড়া দিয়েছিল এজন্য যে এটি কেবল একজন মানুষের বেঁচে যাবার কাহিনী নয় বরং বেঁচে যাবার উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার কাহিনী।

আমরা আমাদের জীবনটাকে বড় সহজভাবে নেই। পৃথিবীতে যেখানে প্রতিদিন জন্মের আগেই অসংখ্য মানবশিশু ভ্রূন অবস্থায় বিদায় নিচ্ছে, অসংখ্য শিশু শৈশব পেরোবার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, অসংখ্য কিশোর কিশোরি যুবক যুবতী মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পন করছে প্রতিনিয়ত, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিচ্ছে আমাদেরই চেনাপরিচিত লোকজন বয়সের হিসেব বাতিরেকে- সেখানে আমি কেন, কোন অধিকারে বেঁচে আছি, কি উদ্দেশ্যে তা নিয়ে ভাবার জন্য আমরা ঠিক কতটুকু সময় ব্যায় করি? প্রতিদিন কতটুকু সময় আমরা চিন্তা করি কিভাবে সৃষ্টিকর্তার এই উপহারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা যায়, কিভাবে একে নিজের এবং মানবতার কল্যাণে কাজে লাগানো যায়? জীবনের হিসেব বাদ দেই, সে অনেক দীর্ঘ কাহিনী- আমার আজকের এই দিনটি আমি কি ভাল কাজে লাগাতে পারি, আজ কি আমি অন্তত একটি ভাল কাজ করতে পারি কিনা- দিনের শুরুতে এই ভাবনাটুকু কি আমাদের মাথায় আসে? এলে হয়ত আমরা নিজেরাই খুঁজে পেতাম আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য- ঠিক ঐ যুবকটির মত যে বছরের পর বছর হণ্যে হয়ে খুঁজেছে সেই সোনার হরিণ কিন্তু হাল ছাড়েনি, অবশেষে সেই সোনার হরিণ তার হাতেই ধরা দিয়েছে!

জাররা জাররা

আমার পাগলপ্রায় অবস্থা! জীবনমরণ সমস্যা! বিশ হাজার টাকার জরুরি প্রয়োজন!

ব্যাঙ্কে একটা ফিক্সড ডিপোজিট ছিল। চাকরীর শুরুতে ঠিক করেছিলাম যত কষ্টই হোক এটা চালু রাখব। অন্তত মাসে মাসে পাঁচশ টাকা তো জমবে! নইলে এদিক সেদিক করে বাজে কাজেই খরচ হয়ে যাবে টাকাটা। আজ ঐ ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গিয়ে দশ হাজার টাকা পেলাম। কিন্তু এতে তো মাত্র অর্ধেক হোল, বাকি অর্ধেক আমি কোথায় পাই?




বাসায় এসে আলমারী খুলে মাসখরচের টাকার বান্ডিলটা বের করলাম। দৈনন্দিন খরচের জন্য রাখা টাকার মধ্যে পাঁচহাজার টাকা পেলাম, মনটা খুশিতে ভরে গেল! আমি কি কখনো ভেবেছিলাম এই টাকাও এই দুঃসময়ে কাজে লাগবে?!

কিন্তু আমার এখনো পাঁচ হাজার টাকার ঘাটতি। কি করি, কি করি? পুরা ঘর তছনছ করে ফেললাম। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে খুচরা টাকাগুলো থাকে, ওখানে একটাকা দু’টাকা খুচরা পয়সা সব মিলিয়ে পেলাম একশ আশি টাকা। ডাইনিং রুমের শেলফে একটা বিশ টাকার নোট খুঁজে পেলাম, কবে রেখেছি মনে নেই, কিন্তু ভুলে গিয়ে ভালই হয়েছে, এখন কাজে লাগছে। কে যেন দরজায় বেল দিল। উফ! এখন কি সময় আছে? পাশের বাসার আপা। আমাকে দেখে একগাল হেসে একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন। দৈবক্রমে প্রাপ্ত এই বরদানে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমার চেহারা দেখে উনি বললেন, ‘ঐদিন বাজারে আমার টাকা শর্ট পড়ল, তুমি আমাকে পাঁচশ টাকা দিলে, ভুলে গেছ?!’ যাব্বাবা, যেভাবেই আসুক, এখন সাতশ হোল।

আবার খোঁজ খোঁজ খোঁজ। আবার আলমারীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, এতে যদি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কোথাও কোন টাকা রেখেছিলাম কিনা! নাহ, কিচ্ছু মনে পড়ছেনা। সামনে একটা পুরনো মানিব্যাগ চোখে পড়ল। কবে রেখে দিয়েছি কাউকে দিয়ে দেব বলে, জিনিসটা এখনো আলমারীর ভেতর কি করছে? বের করে ছুঁড়ে মারলাম বিছানার ওপর, আজই ওটার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। আচ্ছা, ঐ ড্রয়ারটাতে কি? একগাদা কাগজপত্র। আনমনে ঘাটতে ঘাটতে কাগজের নীচে থেকে বেরোল পাঁচটাকার একতাড়া নতুন নোট, সব মিলে দু’শ টাকা। বাহ! গত ঈদে ভাগনাভাগনিদের ঈদি দেয়ার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে এই চকচকে নতুন নোটগুলো এনেছিলাম। আরো যে টাকা বাকি ছিল তা তো মনেই ছিলোনা! নয়শ।




ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। শুতে যেতেই হাতে কাগজের মত কি যেন ঠেকল! বিছানায় কাগজ এলো কোথা থেকে? দেখি বিছানাময় টাকা! পুরনো মানিব্যাগটাতে টাকা ছিল! সব গুণে মোট ছয়শ সত্তুর টাকা পেলাম। নব উদ্যমে উঠে গিয়ে মাটির ব্যাঙ্কটা ভেঙ্গে ফেললাম। নানারকম কয়েন আর নোট মিলে দাঁড়াল চারশ দশ টাকা। কত হোল হিসেব করার জন্য ডায়রি খুলে এর পাতার ভেতর পেলাম দু’টো দশটাকার নোট। দু’হাজার।

আরো তিনহাজার দরকার আমার। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখন আর মাথা ঠান্ডা করে কাজ করার ধৈর্য্য নেই। ভাইকে ফোন করলাম, ‘ভাই, তিনবছর হয়ে গেল, তুইও আক্কেল করে ধারের টাকা ফেরত দিসনি আমিও লজ্জা করে চাইনি। কিন্তু এখন আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর তোর বাসায় আসছি। তুই কোথা থেকে দিবি আমি জানিনা কিন্তু আমার এক্ষুনি টাকাটা লাগবে’। ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রওয়ানা দিলাম ওর বাসায়।

পথে দেখা হোল এক বন্ধু তপুর সাথে। ভালই হোল। ব্যাটা দরকার লাগলে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আসে, প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে তারপর আর কোন খবর থাকেনা। ওর কলার ধরে ওর কাছে আমার পাওনা দেড় হাজার টাকা আদায় করলাম। আজ আমার আর এমন স্বার্থপর বন্ধুর প্রয়োজন নেই, নিজে বাঁচলে বাপের নাম।

আমার অবস্থা দেখে ভাই টুঁ শব্দ না করে আমার একহাজার টাকা দিয়ে দিল। এবার গিয়ে হাজির হলাম আদিনাদের বাসায়, আদিনাই দরজা খুলল। ওকে বললাম, ‘তুমি আমার কাছ থেকে সেদিন যে পাঁচশ টাকা নিলে জামা কিনতে, ওটা দিয়ে দাও’। ও খুব মনে কষ্ট পেল। ‘তুমি না ঐ টাকা আমাকে গিফট করেছ?’ আমার এমন প্রেমিকার প্রয়োজন নেই যে আমার বিপদে এগিয়ে আসেনা। দিলাম এক ঝাড়ি, ‘টাকাটা আমার এক্ষুণি চাই, তুমি আহ্লাদ পরে কোর’। সে মুখ ভার করে টাকাটা এনে দিল। আমার বিশ হাজার টাকা পূরণ হোল। এবার ছুটতে হবে গন্তব্যে, নইলে সব শেষ হয়ে যাবে...


চিত্রটা পরিচিত মনে হয়? এবার আরেকটা চিত্র দেই।





পুরো পৃথিবীটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত থর থর করে কাঁপছে। কম্পনের ফলে সর্বত্র মাটিতে ফাটল ধরেছে, এগুলো দিয়ে পৃথিবীর নাড়িভূড়ি ভেদ করে লাভা উত্থিত হচ্ছে। পথে যেখানেই লাভা আর পানি মিলিত হচ্ছে সাথে সাথে পানি বাষ্পীভূত হয়ে কেটলীর ভেতর গরম পানি ফুটতে থাকার মত শব্দ হচ্ছে, শব্দের প্রচন্ডতা অনেক বেশি, এই যা। লাভার উদ্গীরনে আগ্নেয়গিরিগুলো ক্রাকাতোয়ার মত বিস্ফোরিত হয়ে ছাইভস্ম হয়ে উড়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্য পৃথিবী আগেও দেখেছে, শুধু এবার সবগুলো আগ্নেয়গিরি একইসাথে বিস্ফোরিত হচ্ছে। পৃথিবীর এই অদ্ভুত আচরনে সাগরের পানিগুলো বেসামাল হয়ে ধেয়ে আসছে বিশাল বিশাল আগুনে সুনামী হয়ে কারণ সমদ্রের নীচেও লাভার উদ্গীরন, আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে যেন সারা পৃথিবীব্যাপী কারওয়াশ করার মত করে পানি ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু আকাশ থেকে দেখা সম্ভব নয়, কারণ আজ আকাশটারও যেন কি হয়েছে। সবগুলো তারা যেন খসে খসে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে, ডায়নোসরদের ধ্বংস করার জন্য এমন একটিই যথেষ্ট ছিল আর আজ ওরা দল বেঁধে ছুটে আসছে। ২০১২ মার্কা মুভিগুলোতে নানারকম ফন্দীফিকির করে কিছু মানুষ বেঁচেই যায়, কিন্তু আজ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে কেউ রক্ষা পাবেনা- পৃথিবীটাই যদি না থাকে তাহলে মানুষ থাকবে কোত্থেকে? এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে এতদিন বেখবরে মশগুল লোকগুলো সব ‘ওহ, মাই গড’ ‘ওহ, মাই গড’ করে ছুটোছুটি করছে, কিন্তু ‘গড’ সাড়া দিচ্ছেন না। একসময় শেষ হয়ে গেল সেই গ্রহটা যাকে আমরা চিনি, সেই সুন্দর আকাশটা যা এর শোভাবর্ধন করত- সব, সবকিছু।




কিন্তু নাহ। সব শেষ হোলনা। মানুষগুলোকে আবার দলে দলে পুণরুত্থিত করা হোল। ওরা অবাক হয়ে দেখল ‘গড’ সত্যিই আছেন! বিশাল ওয়েইং মেশিন নিয়ে তিনি সবার অণুপরমাণু পরিমাণ ভাল কাজ মন্দ কাজ সব ওজন করতে বসেছেন যেন কেউ বঞ্চিত না হয়, আবার কেউ ফাঁকিও দিতে না পারে।

তখন আপনার অবস্থা প্রথম চিত্রের মত। ভাগ্যিস, এমন ভয়াবহ বিপদের দিন আসবে বিশ্বাস করেছিলেন দেখেই না একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন! কখনো গডকে ভালবেসে, কখনো ভয় করে কিছু কাজ নিয়মিত করেছিলেন দেখে আজ একটা বড়সড় ফিক্সড ডিপোজিট পাওয়া গেল। দৈনন্দিন কাজগুলোতে গডের প্রতিনিধিদের অনুসরন করে আজ বেশ বড়রকম একটা ফায়দা পাওয়া গেল। আর যে জিনিসগুলোকে কখনও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি- ভিখারীকে ক’টা খুচরা টাকা দেয়া, কোন ভাল কাজের নিয়তে কিছু দান করা, প্রতিবেশির হক আদায় করা, যাকাত দেয়া, কারো জীবনে একটু খুশি এনে দেয়ার জন্য কিছু করা, কারো পথ থেকে একটা কাঁটা সরিয়ে দেয়া, একটু হেসে কথা বলা, কাউকে একটা ভাল উপদেশ দেয়া- সবই আজ কাজে লেগে গেল! আজ পার পাবার জন্য আপনি সব করতে রাজী, ‘চাচা আপন পরান বাঁচা’ অবস্থা আপনার। তাই ভাই বন্ধু স্ত্রী যার কাছে আপনি অধিকারবঞ্চিত হয়েছেন, যে আপনাকে কথায় কাজে বা আচরনে কষ্ট দিয়েছে সবার কাছ থেকে আপনি আজ পাওনা উসুল করতে ব্যাস্ত। যদি কোনভাবে ওয়েইং মেশিনে সঠিক ওজন দেখানো যায়! যদি কোনভাবে আপনার প্রতিপালক আপনাকে ক্ষমা করে দেন!

আবার ডাইনোসর যুগে

বহুদিন পর আবার ড্রামহেলারের পথে রওয়ানা হলাম, রয়াল টিরেল মিউজিয়ামে (Royal Tyrell Museum) ডাইনোসরদের সাথে সাক্ষাত করতে। গতবার যখন গেলাম (ডাইনোসর যুগে ঘুরে এলাম) সেবার সাথে ক্যামেরা ছিলোনা, তাই গিয়ে আফসোসের সীমা ছিলোনা। এবার তাই সাবধান ছিলাম যেন ভুলটার পুণরাবৃত্তি না হয়। হাফিজ সাহেব, রাদিয়া আর আমি মিলে শ তিনেক ছবি তো তুলেছিই। তন্মধ্যে মাত্র ক’খানা ছবির মাধ্যমে ব্লগ বন্ধুদের মাঝে যারা ডাইনোসরদের নিয়ে ততটাই আগ্রহী যতটা আমরা, তাদের জন্য অভিজ্ঞতাটার যতটুকু আমার ভাষা এবং স্মরনশক্তিতে কুলোয় তা শেয়ার করলাম।




এখন গ্রীষ্মকাল, তাই চাষীরা সামান্য যে ক’মাস আবহাওয়া ভাল থাকে তার সুযোগ নিয়ে নানাপ্রকার চাষবাস করছে- সবই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কারণ কয়েকশ একর জমিতে হয়ত একটি পরিবারই বসবাস করে। তাদের জন্য রয়েছে সরকারের সর্বৈব সহযোগিতা, নিরাপত্তা ব্যাবস্থা এবং তাদের সন্তানদের অত্যাধুনিক স্কুলে পড়াশোনা নিশ্চিত করার সুপরিকল্পিত পন্থা। রাস্তা ভাল হওয়ায় ক্যাল্গেরী থেকে ড্রামহেলারের ১৩০ কিমি পথ আমরা গেলাম মাত্র দুই ঘন্টায়। গাড়ীর জানালা থেকে ক্যানোলা (একপ্রকার সরিষা) ক্ষেতগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ আর হলুদে মাখামাখি এক আরামপ্রদ চাদর!




দিগন্তজোড়া সরিষা ক্ষেতের সৌন্দর্য্যের মায়া কাটিয়ে এসে পৌঁছলাম রুক্ষ পাহাড়শ্রেণীর মাঝে। এগুলো একসময় নিরক্ষীয় বনাঞ্চল ছিল, ছিল ডাইনোসরদের নিরাপদ চারণভূমি। তারপর হঠাৎ একদিন আচমকা আকাশ থেকে ছুটে আসা এক উল্কাপিণ্ড সব তছনছ করে দিল, উল্কার আঘাতে পৃথিবী তাঁর অক্ষ থেকে বিচ্যূত হয়ে গেল, পৃথিবীর সব আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ একসাথে বিস্ফোরিত হোল, পৃথিবীর আকাশ ছেয়ে গেল ছাই আর ভস্মে, আর তার মাঝে বিলীন হয়ে গেল পৃথিবীর ৫০% প্রাণের অস্তিত্ব। অতিকায় ডাইনোসরদের অস্তিত্বের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল এই পাহাড়গুলোতে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত কিছু ফসিল। আশেপাশের পাহাড়শ্রেণী থেকে প্রাপ্ত ফসিলগুলো নিয়ে এসে জড়ো করা হোল এর মধ্যস্থলে অবস্থিত এই রয়াল টিরেল মিউজিয়ামে।




প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে আজ ছুটির দিন না হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর লোক এসেছে মিউজিয়ামে, অধিকাংশই তারা যাদের সাথে সন্তান বা শিক্ষার্থী রয়েছে। টিকেটের দাম অল্প হওয়ায় সপরিবারেই এসেছে বড় বড় গ্রুপ, যেমন আমরা। ড্রামহেলার শহরে প্রবেশ করার পর থেকেই পথের দু’ধারে বড় বড় ডাইনোসর মডেল দেখতে পাওয়া যায়, যেমন মিউজিয়ামের প্রবেশপথে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে এই প্যাকিরাইনোসরাস এবং এর পরিবারের মডেল।







এই গেটটি দেখলে টাইম মেশিনের কথা মনে হয়। যেন আদিযুগের পর্যায়গুলো যেমন দেয়া আছে তেমনি পছন্দমত সুইচ টিপে চলে যাওয়া যাবে ঐ যুগে, দেখে আসা যাবে তখনকার বাসিন্দাদের।




আর এরাই তাঁরা যাদের বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে আমরা আজ ডাইনোসরদের স্বরূপ দেখতে পাচ্ছি বা অন্তত এ’সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পারছি। একটি ফসিলের ব্যাপারে পড়লাম একদল বিজ্ঞানী (পেলিওন্টোলজিস্ট) তীব্র গরমে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়েও ২১ দিন প্রচন্ড পরিশ্রমের পর একে একটি কয়লাক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করতে সক্ষম হন। এটিকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার মত অবস্থায় উপনীত করতে ব্যায় হয় আরো তিনবছর। ছবিতে যে বিজ্ঞানী কাজ করছেন তিনি কাঁচের আড়ালে কাজ করছেন, তবে তিনি কি করছেন তা জানালার বাইরে শুধু নয়, একটি বড় টিভি স্ক্রীণে বড় করে দেখানো হচ্ছে যেন মানুষ এই কাজের ধরন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারে।




এটি একটি টাইরেনোসরাসের পায়ের হাড়। এটিকে দৈর্ঘ্য চিহ্নিত করে পাশে একটি প্ল্যাটফর্মে মানুষ দাড়াবার ব্যাবস্থা করে দেয়া হয়েছে যেন আপনি মেপে দেখতে পারেন ওর তুলনায় আপনার উচ্চতা কত। কল্পনা করে দেখুন তো এরা এখন বেঁচে থাকলে আমাদের কি অবস্থা হত!




মিউজিয়ামে ঢুকেই চোখে পড়বে এই অ্যালবার্টোসরাস এবং তার পরিবারের নদী পাড় হবার কাল্পনিক দৃশ্য। হয়ত হঠাৎ নদীতে বন্যা (flashflood) হয়ে পরিবারটি নদীর তলদেশে চাপা পড়ে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পর একদিন মাটি খুঁড়তে গিয়ে কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন তাদের দেহাবশেষ বা পদচিহ্ন। কালের পরিক্রমায় পরিবারটি হয়ে যায় কেবল ফসিল।







ফসিল বা জীবাশ্ম হোল কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর রেখে যাওয়া শেষ চিহ্ন। এতে আসলে প্রাণী বা উদ্ভিদটির দেহাবশেষের কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। কালক্রমে ঐ প্রাণী বা উদ্ভিদের কোষে কোষে প্রবেশ করে মাটির মধ্যস্থিত খনিজ, দখল করে নেয় এর আকার, আকৃতি বা ছাপ। একেই আমরা ফসিল বলে জানি। চিত্রে দেখা যাচ্ছে নটিলাস নামক বৃহদাকার ঝিনুকের খোলে খনিজ জমে সৃষ্টি হওয়া অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক উপাদান যার নাম অ্যামোনাইট, এটি একপ্রকার পাথর যার সৃষ্টি জীবদেহ থেকে!




এই ডাইনোসরটি কোন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা পড়ে। সূর্যের খরতাপে এর দেহখানা অদ্ভুতভাবে বেঁকে যায়, পড়ে হয়ত এর ওপর কাদা চাপা পড়ে বেচারার মরদেহখানা বাঁকানো হতে রক্ষা পায়, কিন্তু সে নিজেই পরিণত হয় পাথরের মাঝে জমে থাকা আরেক পাথরে। এই ফসিলটি ১৯৯০ সালে আবিষ্কৃত হবার পর টোকিওতে উদ্বোধন হয়ে পৃথিবীর নানা দেশ সফর করে এই মিউজিয়ামে এসে ঠাঁই পায়।




স্বাভাবিক অবস্থায় ডাইনোসরদের হাঁটার ভঙ্গি কেমন ছিল তা কিছুটা আন্দাজ করা যায় এই ফসিলটি থেকে।




এটি ট্রাইসেরাটপ্সের মাথার খুলি। এর মাঝে অনায়াসে একটি ছয়বছরের শিশু শুয়ে যেতে পারবে!




জুরাসিক পার্ক (Jurassic Park) মুভি সিরিজের কল্যাণে টাইরেনোসরাস রেক্স এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুপরিচিত ডাইনোসর। মানুষের মত ডাইনোসরদের মাঝেও ভিলেনেরই জয় হোল, হায়! মাংসাশী ডাইনোসরদের মাঝে টাইরেনোসরাস ছিল আকারে সবচেয়ে বড় তাই একে রেক্স বা রাজা উপাধি দেয়া হয়। এখানে একটি পূর্ণবয়স্ক টি রেক্সের মডেল দেয়া হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার হোল এর পায়ের তুলনায় এর হাত প্রায় অদৃশ্য!




এখানে দু’টি ছোট আকারের ডাইনোসর অরনিথোসরাসের মডেল দেখা যাচ্ছে, ধারণা করা হয় এরা ছিল সবচেয়ে বড় আকারের উড়ুক্কু ডাইনোসর।




ওপরতলা থেকে তৃণভোজী ট্রাইসেরাটপ আর মাংসাশী টাইরেনোসরাসের মাঝে কে বড় বোঝা গেলনা। আপনাদের কি মনে হয়?




এবার নীচের তলায় এসে টাইরেনোসরাস বাবাজীর আরেকখানা ছবি তোলা হোল। এটা কিন্তু মডেল না, আসল কঙ্কালের ফসিল।




এটা আরেক মাংসাশী ডাইনোসর অ্যালোসরাসের কঙ্কাল। সে দৈর্ঘ্যপ্রস্থে টাইরেনোসরাসের অর্ধেক হলেও বুদ্ধিতে ছিল অনেক অগ্রসর, দেখুন সে কিভাবে তার শিকারকে বাগে আনার সংগ্রামে লিপ্ত।







আমার প্রিয় ডাইনোসর স্টেগোসরাস- আপাদমস্তক বর্মে ঢাকা হলেও সে কিন্তু আদতেই নিরীহ, তৃণভোজী প্রাণী, কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই, কিন্তু তাকে ঘাটাতে গেলেই কাঁটাযুক্ত লেজ দিয়ে দেবে এক প্রাণঘাতি বাড়ি!




সেরাটপস পরিবারের ডাইনোসরগুলো দেখতে শিংযুক্ত ভয়ানক হলেও আসলে ছিল খুব শান্তিপ্রিয় তৃনভোজী প্রাণী।




এখানে দুই ডাইমেট্রোডন দুপুর রোদে নিজেদের শীতল করার জন্য পিঠের ওপর লাগানো পাখা দিয়ে বাতাস খাচ্ছে।




কুমিরের পুর্বপুরুষ নাকি?!




পানির নীচে কেমন ছিল তার কল্পিত মডেল তৈরী করেছেন বিজ্ঞানীরা। নানাপ্রকার মোলাস্ক আর পোকাশ্রেণীর প্রাণীই দেখা যাচ্ছে বেশি।







তবে এই মাছটি দেখুন তো! আমার তো মনে হয় এর মাথাটাই খাওয়া যাবে একমাস!




পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইকথিওসরটি পাওয়া গেছে এখানকার চিফ সিকানি নদীতে। তিনবছর চেষ্টা করার পর বিজ্ঞানীরা এর উর্ধ্বাংশের এবং লেজের দিকের অল্প ক’টি হাড় উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এখানে কালো দাগ দিয়ে এর প্রকৃত শরীরের সীমারেখা দেখানো হয়েছে। ছবিতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তা এর শরীরের এক তৃতিয়াংশ মাত্র।




আইস এজ (Ice Age) অ্যানিমেটেড সিরিজের কল্যাণে এখন ম্যামথ মোটামুটি সুপরিচিত প্রাণী তবে তারা এসেছে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পর (প্লায়োসিন যুগে) এবং বিদায় নিয়েছে বেশ তাড়াতাড়ি। হাতির মত দেখতে হলেও তারা বৈজ্ঞানিকভাবে হাতির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে পড়েনা।




ইনি গন্ডারের পুর্বপুরুষ, তখনো বেচারার চামড়া বেশ মোটাই ছিল!




এটা এতদঞ্চলে প্রাপ্ত সেবরটুথ বাঘের কঙ্কাল। বাইরের দাঁতগুলো দেখতে ভয়ানক হলেও ওর মুখের ভেতরের দাঁতগুলো ছিল যাঁতার মত পিষে ফেলার যন্ত্রসদৃশ। একে আইস এজ কার্টুনে ভিলেন হিসেবে দেখা যায় যে পরে ভাল হয়ে যায়। আমরাও যদি এভাবে নিজেকে বদলে ফেলার, ভাল হয়ে যাবার চেষ্টা করতাম বেশ হত।




প্রচন্ড গরমের মাঝেও এই গাছগুলোর মত ছায়াঘন স্নিগ্ধ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে আপনাদের জন্য এই উপহার প্রস্তুত করলাম। আশা করি ভাল লাগবে।