ক’দিন আগে এক বান্ধবী ফোন করে জানতে চাইলেন স্থানীয় নির্বাচনে কাকে ভোট দিচ্ছি। জানালাম আমি এখনো ক্যানাডার ভোটার হইনি। পরামর্শ চাইলেন তিনি কাকে ভোট দেবেন। বললাম, ‘সে সিদ্ধান্ত তো কেবল আপনিই নিতে পারেন! তবে যাকেই দেন, সে ব্যাক্তির ব্যাপারে ভালোভাবে জেনেশুনে, চিন্তা ভাবনা করে নির্বাচন করেন’। তিনি বললেন, ‘কেন আপা? সামান্য একটা ভোট দেয়ার ব্যাপারে এত চিন্তাভাবনা করার কি আছে?’ বুঝিয়ে বললাম, ‘ভোট শব্দটির পূর্ণাঙ্গ রূপ হোল ‘vote of confidence’. অর্থাৎ আপনার এই ভোটের মাধ্যমে আপনি সাব্যাস্ত করছেন যে আপনি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করেন এই ব্যাক্তি তাঁর ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হবে তা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে এই ব্যাক্তি যা ভাল কাজ করবে তার সুফল যেমন আপনি ভোগ করবেন, ঠিক একইভাবে সে যদি কোন অন্যায় করে তার দায়দায়িত্বও আপনার ওপর বর্তাবে। সুতরাং, ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সামান্য নয়’। তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন, ‘এভাবে তো কোনদিন ভাবিনি!’
আমাদের যুগের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট হোল আমাদের চিন্তাভাবনার অভাব। পৃথিবীব্যাপী অধিকাংশ মানুষ ধন সম্পদের ইঁদুর দৌড়, সিনেমা-টেলিভিশন, ভিডিও গেম, মোবাইল, ফেসবুক, চ্যাটিং, মাদক থেকে ক্ষমতা পর্যন্ত নানান নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। গুটিকয়েক মেধাবী মানুষ প্রত্যহ সৃষ্টি করে চলেছে সাধারন মানুষকে বুঁদ করে রাখার নানান উপাদান- আরো বড় স্ক্রীণের থ্রি ডি টিভি, আরো আধুনিক কম্পিউটার, আরো উত্তেজক ভিডিও গেম, নতুন নতুন মাদক, আরো ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র, মানুষকে মেধাশূন্য এবং অনুভূতিহীন প্রাণীতে পরিণত করার নানান যন্ত্রপাতি। আর একদল হায়েনা এই সুযোগে পৃথিবীটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। আমাদের চারপাশে নিত্য ঘটছে হরেকরকম ঘটনা কিন্তু নেশার ঘোরে আমরা ক্ষনিকের জন্য চোখ মেলে যদি বা তাকাই, লক্ষ্য করিনা কিছুই। আফ্রিকার ক্ষুধার্ত শিশু,প্যালেস্টাইনের পদদলিত মানবতা, ইরাক- আফগানিস্তানে লাশের স্তুপ, বাড়ীর পাশে বস্তির শিশুটির কান্না, ঘরের ভেতর বাবার অসুস্থতা কিছুই আমাদের খুব বেশীক্ষনের জন্য স্পর্শ করতে পারেনা। যখন বাস্তবতা কঠিন মনে হয়, আমরা পালিয়ে বাঁচি আমাদের জন্য অন্যের তৈরী করা নেশার জগতে। যদিওবা স্বল্পকালের জন্য ওখান থেকে বেরিয়ে বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়, আমরা চেষ্টা করি সিদ্ধান্তটা অন্য কেউ দিয়ে দিক যেন আমরা দ্রুত দায়িত্ব সম্পন্ন করে ফিরে যেতে পারি মোহের জগতে, সে সিদ্ধান্ত সঠিক হোক বা বেঠিক। ডেইলী স্টারের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে একজন মেধাবী কলাম লেখক ছিলেন, ‘চিন্তিত’ ছদ্মনামে লিখতেন। তিনি একবার লিখেছিলেন, আমাদের বিবিসি, সিএনএন যা গেলায় আমরা সব নির্দ্বিধায় গিলতে থাকি, কখনো ভেবে দেখিনা ক্যামেরাটা কেন সবসময় ইসরাইলী দিকে থাকে; ওরা যখন যুদ্ধের কথা বলে আমরা ভুলেও বিবেচনা করে দেখার চেষ্টা করে দেখিনা একদিকে কামান- স্টেনগান আরেকদিকে কাঠি- পাথর, একে আসলে যুদ্ধ নামে অভিহিত করা যায় কিনা। মিডিয়ার জরীপে দেখা যায় খবরের কাগজ, রেডিও ও টিভির মধ্যে অধিকাংশ মানুষ খবরের কাগজ কম বিশ্বাস করে, রেডিওর খবর ততোধিক বিশ্বাস করে এবং টেলিভিশনের সংবাদ সর্বাধিক বিশ্বাস করে। যারা খবর শুনে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে তাদের সংখ্যা আঙ্গুলে গোণা যায়। এই চিন্তাশীলতার অভাব ভয়াবহ নয় কি? ইংরেজি সিনেমাগুলোতে প্রায়ই zombie হয়ে যাওয়াটাকে (চলাফেরার ক্ষমতা থাকলেও বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা না থাকা) ভয়াবহ ব্যাপার হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু কার্যত যে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ zombie হয়েই আছে সে কথাটা ক’জনের মস্তিষ্কে উদয় হয়? আমরা সবাই খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুরছি ফিরছি, কিন্তু ক’জন চিন্তা করছি কেন আমাদের এই জীবন, আমাদের জীবনের লক্ষ্য কি? ক’জন চিন্তা করে আমাকে যা গেলানো হচ্ছে তা খাবার না অখাদ্য? তাই এখানে কিছু মানুষের মনে হয় দিন যদি আটচল্লিশ ঘন্টার হত! আর কিছু মানুষ সময় কাটানোর উপায় উপকরণের অভাবে bored হয়ে মরে।
এক ব্যাক্তি তাঁর স্ত্রীকে এমনভাবে মেরেছেন যে তাঁর বুকেপিঠে, গলায়, বাহুতে কালসিটে পড়ে গেছে। এক মানবতাবাদী রমণী এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করলেন, ‘উনি আর কি করতে পারতেন? স্ত্রীকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসেন, কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁর কথা অনুযায়ী চলেনা। ইসলামে তো নাকি অনুমতি আছে এমতাবস্থায় স্ত্রীকে প্রহার করা যায়’! আহা! ‘নাকি’ কথাটা যদি পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দেয়া যেত! সবাই কেবল ধারণা করে, ‘এমন নাকি করা যায়, এমন নাকি হয়, ... ’। কোন বিষয়ে সঠিক এবং পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভ করার আকাঙ্ক্ষার অভাব থেকেই কেবল আমরা শোনা কথায় সন্তুষ্ট থাকতে পারি। তা নইলে আমাদের তো মহাবিশ্বের তাবত জ্ঞানের সন্ধানেই জীবন কেটে যাবার কথা। আর ইসলামের অনুসারী, যে জানে একে সঠিকভাবে অনুসরণ করার ওপরেই নির্ভর করছে তার বর্তমান জীবন, কবরের শান্তি এবং আখিরাতের মুক্তি- সে কি করে সন্তুষ্ট থাকতে পারে ‘শুনেছি’, ‘অমুক বলে’, ‘নাকি’ এই জাতীয় কথার ওপর? যেখানে বলা হয়েছে শুধুমাত্র স্ত্রী ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনুসরণ না করলে তাকে বোঝানো, শয্যা পৃথক করে দেয়া এবং অতঃপর নিরুপায় হলে সর্বশেষ ধাপ হিসেবে তাকে এমনভাবে আঘাত করা যেতে পারে যাতে মুখে বা পিঠে না লাগে, কোন দাগ না পড়ে এবং সে কোন আঘাত না পায়- বোঝাই যায় তাতে শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়ার চেয়েও মানসিক তাগিদ সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য- সেখানে একজন স্বামী স্ত্রীকে দিয়ে যাচ্ছেতাই করানোর হাতিয়ার হিসেবে তাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলছে এবং মানুষ তাকে ইসলামের দোহাই দিয়ে সমর্থন করছে! যেখানে বলা হয়েছে স্ত্রীকে একেবারে সহ্য করতে না পারলেও তিনমাসে তিনবার তালাক দিতে যাতে সিদ্ধান্ত বদলাবার সুযোগ থাকে, সেখানে ডালে লবন দেয়া হয়নি এই অজুহাতে স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়ে যদি ইসলামের দোহাই দেয়া হয় তা একমাত্র তাদের পক্ষেই সম্ভব যাদের জবাবদিহিতার ভয় নেই, যারা ভাবেনা আল্লাহর নামে এ মিথ্যাচারের ফলাফল কি হবে। কিন্তু তার চেয়েও যেটা আশ্চর্যজনক তা হোল একজন মানুষের ধর্ম না থাকতে পারে কিন্তু তাই বলে বিবেকও থাকবেনা? কিন্তু সত্যিই অধিকাংশ মানুষ যেমন বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও মস্তিষ্ক ব্যাবহার করতে চায়না, তেমনি বিবেক থাকা সত্ত্বেও তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। তাই একসময় পৃথিবীর জনসমাজগুলোতে নেতা হত তাদের সবচেয়ে যোগ্যতাবান এবং জনদরদী লোকেরা, তাঁরা জনসমক্ষে আসতে চাইতেন না অথচ মানুষ তাদের ধরেবেঁধে নিয়ে আসত। আর এখন পৃথিবীর কলঙ্কসদৃশ মনুষ্যাকৃতি প্রাণীগুলো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলোকে ফাঁকি দিয়ে তাদের ঘাড়ের ওপর চড়ে বসে এবং একবার বসতে পারলে তাদের ধাক্কা দিয়ে না নামানো পর্যন্ত সিন্দবাদের বুড়োর মত থাকে ঘাড়ের ওপর বসে নিজে মজা করে খেতেই থাকে আর সাধারন মানুষগুলো তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করতে থাকে। আফ্রিকা থেকে এশিয়া, ইউরোপ থেকে আমেরিকা কেউ এর ব্যাতিক্রম নয়। এমনকি সামান্য চাকরীর ক্ষেত্রে পর্যন্ত স্বজনপ্রীতি ঘটে অথচ সবাই অল্প কিছু সময়ের জন্য চায়ের কাপে ঝড় তুলে আবার হারিয়ে যায় নেশার অতলে, কিছুই পরিবর্তন হয়না, আজ যে অন্যায় হোল কালও তার জন্য দরজা হাট করে খোলাই থাকে! বিবেক এখন মানবীয় স্বার্থের কাছে বন্দী, সত্য মিথ্যা এখন আর তার বিবেচনার বিষয় নয় যা প্রকৃতপক্ষে বিবেকের মৃত্যুই ঘোষনা করে।
কারো ব্যাপারে কিছু শুনতে পেলে- খারাপ কিছু হলে আমরা প্রথমেই ধরে নেই ঘটনা সত্য, যা রটে তার কিছুটা হলেও বটে; আর যদি ভাল খবর হয়, সন্দেহ করি সংবাদটি ভুল কি’না। কারো প্রসঙ্গে বদনাম শুনে আমরা বিশ্বাস করার আগে ভেবে দেখিনা তার ব্যাপারে আমরা যা জানি সেই মানদন্ডে এই ব্যাক্তির নামে যা বলা হচ্ছে তা সত্য হবার সম্ভাবনা কতটুকু বা আদৌ তার পক্ষে এমন করা সম্ভব কি’না। অথচ প্রতিবেশীর সাধারন মেধার ছেলেটি এ প্লাস পেয়েছে শুনলে আমরা ধারণা করি হয় খবরটি ভুল নয় এতে কিছু কারসাজি করা হয়েছে। তাই তো আমরা খবরের কাগজ,ম্যাগাজিন, ব্লগ থেকে টেলিভিশন, রেডিও বা বন্ধুর মুখে যা শুনি তার ৯৯%ই খারাপ খবর! কারণ ভাল খবরের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কম বা ক্ষেত্রবিশেষে অনুপস্থিত, কারণ আমরা খারাপ কথা শুনে এবং বলে আনন্দ পাই! ভাল খবরে নেশায় বুঁদ জনসাধারনের নেশার ঘোর কাটেনা, মাথার ভেতর মগজটাতে নাড়া দেয়া যায়না, বিবেককে স্বল্প সময়ের জন্যও জাগানো যায়না। আমরা যে নিরপেক্ষ শান্তিপ্রিয় যন্ত্রমানব! তো কি হয়েছে অ্যামেরিকা পরিবেশ দূষিত করে পৃথিবীটাকে বসবাসের অনুপযুক্ত করে ফেলছে, তো কি হয়েছে আফ্রিকায় ক্ষুধার জ্বালায় মায়েরা তাদের সন্তানদের মৃত্যুর মুখে ফেলে চলে যাচ্ছে, তো কি হয়েছে মানুষের হিংস্রতার কাছে প্রতিদিন পৃথিবী থেকে বিশটি প্রজাতির প্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তো কি হয়েছে মানুষের লোভের সামনে পৃথিবীর ফুসফুস রেইনফরেস্টগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, তো কি হয়েছে মেরু অঞ্চলগুলোর বরফ গলে সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, তো কি হয়েছে ভারত বাঁধে বাঁধে বাংলাদেশের মত ছোট্ট একটি দেশকে যদি বিরানভূমিতে পরিণত করে, তো কি হয়েছে ... পৃথিবী তো একদিন ধ্বংস হয়েই যাবে, আমরা তো তাতে সাহায্যই করছি! তাই মাঝে মাঝে চিন্তা করি আমরা আসলে কি- মানুষ না যন্ত্র?
যন্ত্রের চিন্তা করার বা বিবেক খাটানোর প্রয়োজন হয়না, তাকে যেভাবে পরিচালিত করা হয় সে সেভাবেই পরিচালিত হয়। কিন্তু যে মানুষ সে একটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে এবং সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জীবনের প্রতিটি স্তরে তার বুদ্ধি এবং বিবেককে কাজে লাগায়, কোন একটি মূহূর্ত তার মস্তিষ্ক চিন্তাশূণ্য থাকেনা, কোন একটি ক্ষণ তার বিবেক অনুভূতিশূণ্য থাকেনা, অন্যায় দেখে সে স্থির থাকতে পারেনা, লক্ষ্যহীন কাজে সে সময় নষ্ট করতে পারেনা কারণ সে জানে জীবন সীমিত অথচ কর্ম অসীম। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন আমরা কি হতে চাই- মানুষ না যন্ত্র? আমরা কি পৃথিবীটাকে নেশার ঘোরে ভেসে যেতে দেব নাকি যারা একে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তুলতে চায় তাদের পাশে এসে দাঁড়াব?
No comments:
Post a Comment