Sunday, December 9, 2012

একতলা দোতলা

আমাদের বাসার একটা বৈশিষ্ট্য হোল এ’বাসায় গৃহস্থ এবং ভৃত্যের মাঝে কোন ব্যাবধান নেই। আমাদের কাজের লোকজন আমাদের মতই খাটে ঘুমায়, একই মানের পোশাক পরে, একই খাবার খায় একই প্লেটে। আমার পিচ্চি ননদটা একবার এক বড়লোক বান্ধবীর বাসায় গিয়ে দেখল ওরা খাটে ঘুমায় আর কাজের লোক থাকে মাটিতে, ওরা নিজেরা ভালো কাপড় পরে কাজের লোকজনকে সর্বনিম্ন মানের কাপড় কিনে দেয়, ওদের বাসায় কাজের লোকজনের জন্য আলাদা প্লেটগ্লাস আলাদা খাবার ব্যাবস্থা। নতুনত্বের ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া পিচ্চি বোনটা বাসায় এসে আম্মাকে বলে, 'আম্মা, ওদের বুয়ার জন্য মাটিতে বিছানা পাতা হয়, আমাদের বুয়া আমাদের বিছানায় ঘুমায়। এসব কেমন কথা? চল বুয়ার জন্য আমরাও আলাদা প্লেটগ্লাস ব্যাবস্থা করি'। ওর খামখেয়ালীপনায় আমরা সবাই মুখ টিপে হাসছি। বুয়া বলে বসল, 'ছোট আপা, মরলে আমাদের কি একতলা কবরে দেবে আর তোমাদের দোতলা?' আমরা থ হয়ে গেলাম! বুয়া লেখাপড়া করেনি, ক অক্ষর গোমাংস, কিন্তু কি কঠিন ফিলসফি কত সহজেই বুঝিয়ে দিল!

বুয়ার তুলনায় আমার নিজেকে একটা ছোট্ট শিশুর মত মনে হয় যে বিরাট বিরাট কৌতুহলী চোখ মেলে এই পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, ভুলত্রুটিতে পরিপূর্ণ ছোট ছোট পা ফেলে জীবনকে আবিষ্কার করে চলেছে প্রতিনিয়ত আর আধবোলা ভাষায় নিজের মনের কথাগুলো বোঝানোর চেষ্টা করছে সবাইকে, কিন্তু খুব একটা কিছুই বোঝাতে পারছেনা। অনুভূতিগুলো নিজের কাছেই অস্পষ্ট, তাই স্পষ্ট করে ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনা। সব ছাপিয়ে আমাকে ঘিরে আছে এক সুতীব্র অবাক হবার অনুভূতি। পৃথিবীটার সাথে আমার অনেকটা আড়ি। তাই ওকে আমি দেখি এক দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে। দেখি, দেখি, দেখি… সহ্য করতে না পারলে ক’দিন চেষ্টা করি মনের কথাগুলো বলার। সেটাও হয় অবোধ শিশুর চিৎকারের মতই। সবাই শুনে সান্তনা দেয় কিন্তু তাতে কিছুই পরিবর্তন হয়না।

চারপাশের মানুষগুলোকে দেখে অবাক হই, কত অহংকার মানুষের মনে! রূপের অহংকার, গুণের অহংকার, ক্ষমতার অহংকার, টাকার অহংকার, প্রতিষ্ঠার অহংকার, বংশের অহংকার, পরিচিতির অহংকার, ছেলেমেয়ের অহংকার, শ্বশুরবাড়ীর অহংকার, যোগ্যতার অহংকার, অহংকারের শেষ নেই! আমার মতই হয়ত অবাক হয়ে আলী (রা) বলেছিলেন, 'মানুষের এত কিসের অহংকার যার শুরু একফোঁটা রক্তবিন্দুতে আর শেষ মৃত্তিকায়?' কুর’আন পড়তে গিয়ে দেখতাম একটু পর পর আল্লাহ মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে জমাট রক্ত থেকে, মাটি থেকে, নোংরা পানি থেকে ইত্যাদি। চিন্তা করতাম এই লজ্জাজনক ইতিহাস কেন বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। পরে বুঝতে পারলাম, আল্লাহ যেহেতু আমাদের সৃষ্টিকর্তা তিনিই আমাদের চরিত্র সবচেয়ে ভালো বোঝেন। তাই তিনি আমাদের অহংকারকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন আমাদের ক্ষুদ্রতা আর অপবিত্রতার চিত্র দিয়ে। জানিয়েছেন শয়তান ফেরেস্তাদের সরদার হয়েও পতিত হয়েছে কেবল অহংকারের কারণে।

চিন্তা করি বেচারা শয়তান আসলে ভয়ানক বোকা। সে যদি সাথে সাথে আল্লাহকে বলত, 'হে আল্লাহ, আমি ভুল করে ফেলেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও', আল্লাহ তাঁর স্বীয় গুণাবলীর কারণে তাকে ক্ষমা করে দিতেন। অথচ সে ব্যাটা এখনো গোঁ ধরে বসে আছে যে আদমের কারণেই সে বঞ্চিত হয়েছে সুতরাং আদম সন্তানদের ধ্বংস করতে হবে। গাধাটা বোঝেই না যে সে নিজের কারণেই স্থানচ্যূত হয়েছে। মধ্যখানে আদম (আ) ধরা খেয়েমাত্র আল্লাহকে বলেকয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। আল্লাহ যে শুধু তাঁকে ক্ষমা করলেন তাই নয়, তিনি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে সময় সময় তাঁর সন্তানদের বিচ্যূত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য পথপ্রদর্শক পাঠানো হবে যারা কেবল কি করতে হবে তাই বলে দেবেন না বরং কিভাবে করতে হবে তাও উদাহরণসহকারে বুঝিয়ে দেবেন। তাহলে শেষপর্যন্ত বেচারা শয়তানের লাভ হোল কি? সে ক’খানা মূর্খ আদম সন্তানকে সাথে নিয়ে গেল বটে কিন্তু সে নিজেও তো রক্ষা পেলনা! এ যেন মাথাব্যাথার কারণে ট্রেনের চাকার নীচে মাথা পেতে দেয়া! সম্পূর্ণ চিত্র লক্ষ্য করলে বেচারার জন্য মায়াই লাগে।

এত কিছু জেনেও আমরা অহংকার করি। সেই রূপের অহংকার যার সৃষ্টিতে আমার কোন হাত ছিলোনা। সেই রূপের অহংকার যার গভীরতা চামড়া ভেদ করে ভেতরে পৌঁছয়না। সেই রূপ যা মূহূর্তে কদাকার ধারণ করতে পারে। সেই গুণের অহংকার করা হয় যা আমি মনে করি আমার অর্জন। অথচ আমার সমযোগ্যতার আরো অনেকেই এই গুণ থেকে বঞ্চিত কেবল আল্লাহর সাহায্যের অভাবে তা বেমালুম ভুলে যাই। সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষমতার অহংকার যা বার বার ফির’আউন এবং নমরূদকে উদ্বুদ্ধ করেছে নিজেকে ‘গড’ ঘোষনা করতে। অথচ তারা নিজেরাই জানত এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা! সেই সম্পদের আমরা অহংকার করি যার অর্জনে আমাদের কোন যোগ্যতা কাজ করেনি। নইলে দুনিয়ার সব পিএইচডিধারী পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি হত। বস্তুত তেমনটা ঘটেনা- অনেক লেখাপড়া জানা শিক্ষিত মানুষ না খেয়ে মরে আবার অনেক মূর্খ মানুষ টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। সততার সাথে অর্জিত ধনরাশিতে নাহয় তবু কিছুটা আনন্দ উপভোগ করা যায়। কিন্তু সবচেয়ে অবাক লাগে তাদের অহংকার দেখে যারা অসদুপায়ে পয়সা উপার্জন করে। অভাবের তাড়নায় যে শিশুটা দু’দশটাকা চুরি করে তাকে আমরা মেরে হাড়মাংস এক করে দেই, অথচ যে লোকটা কোটি কোটি টাকা মানুষকে মেরে আত্মসাৎ করে তাকে আমরা বরমাল্য দিয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান করে নিয়ে আসি। আগুনের মালা গলায় দিয়ে একটা মানুষ দাঁত কেলিয়ে হাসছে এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করুন তো! আতংকজনক! তেমনটাই মনে হয় আমার এইপ্রকার অহংকারীদের দেখলে।

আমার এক বোন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিল, “যদি সারা দুনিয়ার মানুষ আমাকে সম্মান করে অথচ আল্লাহ আমাকে সম্মানিত না করেন তাহলে এই সম্মানের কোন মূল্য থাকেনা, আর যদি দুনিয়ার সবাই আমাকে অসম্মান করে আর আল্লাহ আমাকে সম্মানিত করেন তাহলে এই অসম্মানে আমার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হবেনা”। এর দু’টো দিক আছে। সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কোন অহংকারের বিষয় নয়। বরং যে প্রতিষ্ঠিত হয় তার সমাজের প্রতি দায়িত্বে ভারে জবুথবু হয়ে থাকার কথা। সমাজে উপরতলায় উঠে আসতে পারে হাতেগোণা ক’জন কিন্তু উঠে এলেই তাদের সেসব লোকজনকে ভুলে যাবার অধিকার নেই যারা পিঠ পেতে সিঁড়ি হয়ে তাকে ওপরে ওঠার সুযোগ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আজকের সম্মান কেবল কয়েকজন মানুষের কাছ থেকে পাওয়া এক অদৃশ্য বস্তু, কিন্তু বিচারদিবসে যাকে অসম্মানিত করা হবে তার পরিণতি ঘটবে আদম (আ) থেকে শুরু করে তাবত জনগোষ্ঠীর সামনে!

সবচেয়ে হাস্যকর মনে হয় বংশের অহংকার। আল্লাহ আমাকে খুব সহজেই সোমালিয়ার কোন জঙ্গলে না খেয়ে মরা বাপমার ঘরে জন্ম দিতে পারতেন। আমি যদি আজ ভালো বংশে জন্মে থাকি তাতে শুকরিয়ার বিষয় থাকতে পারে তবে অহংকারটা ঠিক কোন উৎস থেকে উৎসারিত বুঝতে পারিনা। তার চেয়েও হাস্যকরা শ্বশুরবাড়ীর অহংকার। আমার এক বান্ধবীর বাবা বলতেন, “উত্তম সে যে নিজের পরিচয়ে চলে, মধ্যমে সে যে বাপের পরিচয়ে চলে, অধম সে যে শ্বশুরের পরিচয়ে চলে”।

অহংকারে মানুষ হুঁশ হারিয়ে পাগলের মত আচরণ করে। মানুষকে মানুষ বলে পাত্তা দেয়না। নিজেকে এত বড় মনে করে যে অন্যকে ছোট করতে বাঁধেনা। অহংকারে মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করতে পারেনা, অন্যের দোষ না থাকলেও ত্রুটি আবিূষ্কার করতে ব্যার্থ হয়না। বিবেক বিবেচনা সব তখন গৌণ হয়ে যায়। চোখ, মুখ, নাক, অনুভূতি সব আচ্ছন্ন হয়ে যায় অহংকারে। তবু মানুষ অহংকার করে। আগুনের মত এই অহংকার ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাদের বিবেক বুদ্ধি থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ সত্ত্বাকে। সে ভুলে যায় সে কত ক্ষুদ্র, কত মূল্যহীন। কখনো কখনো এই অহংকারের আঁচ এসে অন্যের গায়েও লাগে। কিছুই করতে পারিনা। এই নাটক কেবল চোখ মেলে দেখি। নিজেকে খুব অনভিজ্ঞ, আনাড়ী, বোকা মনে হয়। তাই মাঝে মাঝে চুপ হয়ে যাই। সবাই নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্টিতে মেতে আছে, কেউ নিজেকে পরিবর্তন করা জরুরী মনে করছেনা। আমি কে তাদের এই ঘুম থেকে জাগাবার? আমি নিজেই কি অহংবোধ থেকে মুক্ত? তাই চিন্তা করছি এই পৃথিবী মনে হয় আমার মত বোকাদের উপযুক্ত স্থান নয়। র‌্যাটরেসের ইঁদুর হতে ইচ্ছে করেনা- একসময় হয়ত একেবারেই চুপ হয়ে যাব।

No comments:

Post a Comment