Sunday, December 9, 2012

সুবিচার

আজ সারাদিন মাথাটা প্রচন্ড গরম ছিল, কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল!

আমি নিজের এই রুদ্রমূর্তি প্রচন্ড ভয় পাই কেননা তখন আমি কি বলি, কি করি তার ঠিক থাকেনা। পরে কিছুতেই ঐ সময়ের কথা স্মরন করতে পারিনা। অনেকটা ইনক্রেডিবল হাল্কের মত। কেবল আমার স্বাস্থ্যটাই যা এর উপযোগী নয়। মাথায় আগুন ঠান্ডা হলে যে পরে মাথাটা এত ব্যাথা করে সে ভয়েই সুবোধ হয়ে থাকার চেষ্টা করি সবসময়।

একবার এইরকম রাগের মাথায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে রাগের কারণ থেকে পালাবার জন্য রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলাম। কেবল বেরোবার সময় দরজা বন্ধ করেছিলাম মনে আছে। পরে শুনলাম আমার দরজা বন্ধ করার ফলে দরজাসংলগ্ন সুইচবোর্ডের সবগুলো ইলেকট্রিক সুইচের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছিল। শেষে ইলেক্ট্রিশিয়ান এনে তাদের অপারেশন করে পুণরুজ্জীবিত করার ব্যাবস্থা করা হয়।

তাই সবসময় নিজের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করি যেন আমার ভেতর সুপ্ত দানবটা জেগে ওঠার সুযোগ না পায়। তবুও শেষরক্ষা হয়না অনেক সময়। আমার চতুষ্পার্শ্বে অসঙ্গতিগুলো মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়! প্রায়ই আগুনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এই দেখে যে এই ব্যাপারগুলো আর কাউকে বিব্রত করছেনা! ভাবি আমিই কি তবে অস্বাভাবিক?!

আমার খুবই অপছন্দের একটি ব্যাপার হোল দায়িত্বহীনতা। আমি কখনো দায়িত্ব নিতে পছন্দ করিনা কেননা আমি কতটা অলস এবং অনুপযুক্ত এই ব্যাপারে আমার ধারণায় কোন অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু আমাকে যখন কোন দায়িত্ব দেয়া হয় তখন তাকে পরিপূর্ণ করার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমার কেবল মনে হয় আমার মত নির্গুন মানুষের পক্ষে যদি চেষ্টার মাধ্যমে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুনো সম্ভব হয় তাহলে যাদের গুন আমার চেয়ে বেশী, স্বাস্থ্য আমার চেয়ে ভাল, সময় আমার চেয়ে প্রশস্ত এবং মনোবল আমার চেয়ে দৃঢ় তাদের পক্ষে কেন কোন দায়িত্ব সুসম্পন্ন করা সম্ভব হবেনা?

তবে যে ব্যাপারটি আমার সবচেয়ে অসহ্য তা হোল অবিচার, তা সে যতই ক্ষুদ্র বা বৃহৎ পরিসরে হোক না কেন। প্রত্যেক ব্যাক্তিই তার আশেপাশের সবার প্রতি সুবিচার করার জন্য দায়বদ্ধ। আল্লাহ আমাদের উপমা দিয়েছেন পাখির, যে প্রতিদিন ভোরে কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই নীড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভরপেটে নীড়ে ফিরে আসে। আল্লাহ যদি চাইতেন, তিনি আমাদের সবাইকে এভাবে জীবিকা সরবরাহ করতে পারতেন, নিশ্চয়ই এটা তাঁর জন্য দুঃসাধ্য নয়। তবে কি’না আমাদের এই পৃথিবীতে বসবাসকাল একটি পরীক্ষা মাত্র। পাখিদের কোন আদানপ্রদান নেই তাই কোন পরীক্ষাও নেই, আখিরাতের হিসেব নিকেশের বালাইও নেই। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা এটাই যে আমরা এই পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট সময় কাটাব পরস্পরনির্ভরশীল হয়ে। এই নির্ভরশীলতা একটি আদানপ্রদানের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করবে। এক্ষেত্রে আমরা কে কার প্রতি কতটুকু সুবিচার বা কতটুকু অন্যায় করলাম তার ওপরেই আল্লাহ আমাদের বিচার করবেন। ক্ষুদ্রতম কণিকা পরিমাণ ন্যায়কাজেরও পুরস্কার পাওয়া যাবে। তবে ক্ষুদ্রতম কণিকা পরিমাণ অন্যায়েরও শাস্তি হবে।





যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কি করে আমাদের কথায় বা কাজে অসংযত হতে পারি? বুঝলাম, সংযত হবার পরেও আমাদের দ্বারা সীমাহীন ভুলত্রুটি সংঘটিত হবে, হওয়াটাই স্বাভাবিক যেহেতু আমরা কেউ ফেরেস্তা নই, বা এর আগে একবার পৃথিবীতে এসে প্র্যাক্টিস করে দেখে যাইনি কিভাবে কি করলে ভুলত্রুটি এড়িয়ে চলা যায়। আমরা সবাই অন্ধকারে হাতড়ে পথ খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি, সবাই সাঁতরে চলেছি ভুলের সাগরে। কিন্তু আমাদের কাছে রয়েছে বিশুদ্ধতার একটি মানদন্ড যার কষ্টিপাথরে আমরা নিজেদের পরখ করে নিতে পারি। আমি ভুল করব, অতঃপর এই মানদন্ডে নিজেই নিজেকে যাচাই করে নেব, অতঃপর প্রয়াস চালাব যেন এই ভুল থেকে আমি পবিত্র থাকতে পারি। কিন্তু আমি যদি ভুল করে অনুতপ্ত হতে না শিখি তাহলে আমি কাল যে সাগরে ডুবে মরছিলাম আজও সে সাগর থেকে সাঁতরে বেরোবার পথ খুঁজে পাবনা।

আমি যখন শিক্ষকতা করতাম, আমার সবচেয়ে কঠিন মনে হত খাতা কাটার ব্যাপারটি। বিচারকের দায়িত্ব সে যেক্ষেত্রেই হোক না কেন, গুরুদায়িত্ব। আমার মনে হত আমার খামখেয়ালীর কারণে যদি একজন ছাত্র বা ছাত্রী আধনম্বর কমবেশী পায় তার জন্যও তো আমাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অথচ মানুষ কি অনায়াসে সামান্য ড্রয়িং কম্পিটিশন থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পর্যন্ত সর্বত্র স্বজনপ্রীতি করে! যে যেক্ষেত্রে ক্ষমতাধর সে সেক্ষেত্রে একে এক পবিত্র দায়িত্ব মনে না করে নিজের এবং পরিবারের লোকজনের উত্তরণের জন্য একটি হাতিয়ার মনে করতে শুরু করে, এর জবাবদিহিতার ভয় না করে এর থেকে কি সুবিধা আদায় করা যায় তা ভাবতে থাকে। তাই দেখা যায় আমরা কোনক্রমে একটা চেয়ার টেবিল পেলে ঘুষ খাবার পাঁয়তারা করতে থাকি, শাশুড়ি হতে পারলে ক্ষমতার অপব্যাবহার করি, ননদের সাথে বোনের মত ব্যাবহার করার প্রয়োজন মনে করিনা, নিজের সন্তানের প্রতি যে দায়িত্ব অনুভব করি প্রতিবেশীর সন্তানের প্রতি সে মায়া অনুভব করিনা, নিজে কম্বলের মধ্যে শুয়ে কংক্রীটের রাস্তার ওপর শুয়ে থাকা মানুষগুলোর কষ্ট ভুলে যাই, নিজের ঘরে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আত্মতৃপ্তি লাভ করি কিন্তু বস্তিবাসী মেয়েটির টাকার অভাবে বিয়ে হচ্ছেনা এ’ব্যাপারে কোন দায়িত্বানুভূতি আমাকে পেরেশান করেনা ... এই তালিকার শেষ নেই।

উমার (রা) কে যখন মৃত্যুশয্যায় পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করতে অনুরোধ করা হোল তিনি কিছুতেই তার দায়িত্ব নিতে রাজী হলেন না। কথাপ্রসঙ্গে তাঁর ছেলের কথা বলা হলে তিনি উত্তপ্ত হয়ে বলেন, 'আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন। কসম আল্লাহর, আমি এমনটি চাইনা। খিলাফতের এ দায়িত্বের মধ্যে যদি ভাল কিছু থাকে, আমার বংশের থেকে আমি তা লাভ করেছি। আর যদি তা মন্দ হয় তাও আমরা পেয়েছি। উমারের বংশের থেকে এক ব্যাক্তির হিসেব নিকেশই এজন্য যথেষ্ট। আমি আমার নিজের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি, আমার পরিবারবর্গকে মাহরূম করেছি, কোন পুরস্কার নয় এবং কোন তিরস্কারও নয় এমনভাবে যদি আমি কোনমতে রেহাই পেয়ে যাই, নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব'। অথচ তিনি দায়িত্বশীল থাকা অবস্থায় তাঁর উম্মাহর জন্য কি করেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি কিভাবে দারিদ্র, কষ্ট এবং বঞ্চনা বরণ করে নিয়েছেন সেই ইতিহাসও অজানা নয়। তিনি তাঁর ব্যাবসা বাণিজ্য থেকে এমনকি রাতের ঘুম পর্যন্ত জনস্বার্থে কুরবান করে দেন। তিনি এমন ব্যাক্তি যিনি জীবিত অবস্থায় বেহেস্তের সুসংবাদ পেয়েছেন এবং শাহাদাতের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। তার পরেও তিনি তাঁর নেতৃত্বের দায়িত্ব নিয়ে ভীত ছিলেন। হায়! আমরা তাঁর একই দ্বীনের ধারক বাহক, আমরা কি করছি?

খলিফা দ্বিতীয় উমারকে যখন খিলাফতের দায়িত্ব দেয়া হয় তিনি সেই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন এবং উপায়ান্তর না দেখে মুষড়ে পড়ে কান্না শুরু করেন, 'হায়! কাল পর্যন্ত আমি কেবল আমার হিসেব দেয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আজ যদি ফোরাতের তীরে একটা কুকুরও না খেয়ে মারা যায়, তার জন্যও আমার হিসেব দিতে হবে!' সুবিচারের ভয় তাদের ক্ষমতা পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হবার পরিবর্তে মাতম করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। হায়! আমরা সেই একই দ্বীনের ধারক বাহক হয়ে কি করছি?

সেদিন এক বন্ধুর সাথে ফিলসফিকাল তর্ক হোল। সে বলল, 'আল্লাহ আমাদের দুর্বলতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আমরা এই দুর্বলতা থেকে উত্তরণ করতে সক্ষম নই'। এর অর্থ দাঁড়ায়, 'আমাদের দুর্বলতা যেহেতু আল্লাহর সৃষ্ট, সুতরাং এর জন্য আমাদের কোন বিচার হওয়া উচিত নয়'। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তেমন? সুলায়মান (আ) এর এক হাজার স্ত্রী ছিলেন। সুতরাং, বোঝা গেল একজন পুরুষের পক্ষে এক হাজার নারীকে ভালবাসা সম্ভব, তাঁদের সাথে সুখে সংসার করাও সম্ভব, এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অপরপক্ষে রাসূল (সা) তাঁর যৌবনের পঁচিশ বছর কাটিয়েছেন তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড় একজন বৃদ্ধার সাথে, যাঁর সাথে তিনি এতটা সুখী হয়েছিলেন যে তাঁর মৃত্যুর তের বছর পরেও তিনি দৈনিক ন্যূনতম একশ বার তাঁকে মনে করতেন, যা তাঁর সুন্দরী এবং কমবয়সী স্ত্রীর হিংসার উদ্রেক করত। সুতরাং, বোঝা যায় পুরুষের স্বভাব মূলত বহুগামী হলেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নইলে নারীবাদীরা কোন যুক্তিতে দাবী করবেন পুরুষ একবিবাহ করবে? এমন মজ্জাগত স্বভাব যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় তাহলে বাদবাকী ত্রুটিসমূহ থেকে উত্তরণের প্রশ্ন এলে কোন যুক্তিতে আমরা বলতে পারি এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যাপার নয়?!

ইসলামে ‘সুবিচার’ শব্দটির মাধ্যমে সাদা বা কালো নির্ধারন করার কথা বলা হয়নি। বরং এতে মানবীয় দুর্বলতার জন্য provision রাখা হয়েছে। ক্ষমা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে কিন্তু প্রতিশোধ নিতে নিষেধ করা হয়নি। সাথে এই সাবধানতাও উচ্চারিত হয়েছে যে প্রতিশোধ মাত্রা অতিক্রম করে গেলে ফলাফল উলটো আপনার বিপক্ষে চলে যেতে পারে যেটা প্রকৃতপক্ষে প্রতিশোধ নিতে নিরুৎসাহিত করার নামান্তর। কিন্তু আজকালকার বই-নাটক-সিনেমা যেগুলো আমাদের শিক্ষাগুরুর ভূমিকা পালন করে সেগুলো আমাদের কি শেখাচ্ছে? একদিকে দেখানো হয় একজন নাবিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একখানা লাইফবোটে সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা বুঝতে পেরে যেসব যাত্রীদের বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ বা অনুপস্থিত তাদের লাইফবয় দিয়ে সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে বাকীদের রক্ষা করলে তার ফাঁসির আদেশ হয়; আরেকদিকে একজন ব্যাক্তির হত্যার প্রতিশোধে ঠগ বাছতে গাঁ উজার করে সবাইকে মেরে নায়ক মৃতের রক্তমাখা শরীরে হাসতে হাসতে চলে যায়। এর কোনটি সুবিচার? এগুলো দেখে আমাদের ‘সুবিচার’ শব্দটির concept বুঝতেই কষ্ট হয়ে যায়। আর আমরা যখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপারে এই জাতীয় নীতি অবলম্বন করি তখন আমরা আসলে কি ধরণের উদাহরণ স্থাপন করছি?

আল্লাহ বলেছেন প্রত্যেক ব্যাক্তিকে তার প্রতিটি কাজের জন্য বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আমাদের অনেকের ভুল ধারণা সেটা হবে কেবল আখিরাতে। অথচ প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা দুর্ঘটনা অবিরত আমাদের জানান দিয়ে যাচ্ছে আখিরাত তো জমা, এই পৃথিবীতেও শাস্তি হয়ে যায় অনেকের। তারপরও আমাদের বোধোদয় হয়না, আমরা দেখেও দেখিনা, শুনেও শুনিনা, অন্তর আছে অথচ অনুভব করিনা, ভেসে চলি গড্ডালিকা প্রবাহে।

আজ একটা আয়াত পড়ে মাথা ঠান্ডা হোলঃ What is [the matter] with you? How do you judge? Or do you have a scripture in which you learn That indeed for you is whatever you choose? (Surah Al Qalam: Ayah 36-38). আপাতত নিজের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়েছি, আর কেউ কি করছে দেখার সময় বা সুযোগ নেই। আসুন, আমরা সবাই পাঁচমিনিট সময় নিয়ে ভেবে দেখি আমি কি করছি!

No comments:

Post a Comment