সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার বিরাট একটা অংশ রোমান্স বিষয়ক, তাই তাদের প্রায়ই এ’বিষয়ে নানাবিধ প্রশ্ন থাকে যার বিস্তৃতি পারস্য থেকে রোম, রাশিয়া থেকে ভারতবর্ষ, আইন থেকে ধর্ম, সমাজ থেকে ব্যাক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত। সাহিত্যের শিক্ষককেও তাই অনেকসময় অনেক অদ্ভুতুরে প্রশ্নের উত্তর অবলীলাক্রমে দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। যেমন অ্যান্ড্রু মার্ভেলের একটি কবিতা পড়াতে গিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন আসত ‘love’ এবং ‘lust’ এর পার্থক্য নিয়ে। তাদের বলতে হত জীবনের কিছু রূঢ় বাস্তবতার কথা। Lust হোল এমন প্রেম বাহ্যিক আকর্ষনই যার সারসর্বস্ব, প্রাপ্তিতেই যার সমাপ্তি, স্বার্থপরতাই যার প্রধান পরিচয়। Love এমন এক পবিত্র বন্ধন যার সাথে দেনাপাওনার কোন সম্পর্কে নেই, এতে পাওয়ার আকাঙ্খা যতটুকু দেয়ার আকাঙ্খা তার চেয়ে অনেক বেশী, অপরের মঙ্গলকামনাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। এতটুকুতেই বেচারারা চিন্তার আবর্তে হারিয়ে যেত। কারণ সস্তা আবেগের বাজারজাতকরণের জন্য নির্মিত সব নাটকসিনেমা, বইপত্র তাদের শিখিয়েছে প্রেমের শুরু দৃষ্টিতে, উত্থান পৃথিবীর তাবত বাঁধানিষেধকে কাঁচকলা দেখানোয় এবং সমাপ্তি ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ নীতিতে। যে আসলেই ভালবাসে সে প্রাপ্তির চেয়ে অপেক্ষা, নিজের চেয়ে অপরকে, স্বাদগ্রহনের চেয়ে সম্মানকে প্রাধান্য দেয় কারণ ‘Love is patient, love is kind and is not jealous; love does not brag and is not arrogant’ (1 Corinthians 13:4). স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মাঝে যে পবিত্র বন্ধন, পিতামাতা এবং সন্তানের মাঝে যে নিঃস্বার্থ সম্পর্ক, ভাইবোনের মাঝে যে টান, স্বামীস্ত্রীর মাঝে যে বন্ধুত্ব এগুলোও যে Love শব্দটির আওতাভুক্ত এই ব্যাপারটি তাদের অনেকের কাছেই নতুন আবিস্কার।
জানা কথা ছিল এদের অনেকেরই ছেলেবন্ধু বা মেয়েবন্ধু আছে। এ’ব্যাপারে যদি তাদের অভিভাবকদের কিছু বলার না থাকে, আমার কিছু বলার উপায় ছিলোনা যদি রেজাল্ট নিয়ে সমস্যা না হয়। কিন্তু যখন দেখি একটি ছেলে বা মেয়ে যার এখনই নিজেকে গড়ে তোলার সময়, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রথম ধাপে অবস্থান করছে সে, বাবামায়ের কত আশাভরসা স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বিচরণ করছে সে, দেশের লক্ষকোটি জনগনের মাঝে সে একাই মেধাবী নয় কিন্তু সে একাই ভাগ্যবান- অথচ সে এই সুযোগকে নিজ হাতে নষ্ট করে দিচ্ছে একটি লক্ষ্যবিহীন সম্পর্কের জন্য যার ব্যাপ্তি বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, পার্ক আর মোবাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে দায়িত্ব না নিয়েই স্বাদগ্রহণকে অতিক্রম করেনা, তখন মাথাটা গরম হয়ে যেত বৈকি! রাস্তায় যে কিশোর ছেলেটি রিক্সা চালায়, গার্মেন্টের মেশিনপত্রের মাঝে দিনরাত খেটে মরে যে মেয়েটি, তারা এই সুযোগের জন্য প্রাণোৎসর্গ করে দিত। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত দুলাল দুলালীদের এতটুকু মেধা নেই যে তারা love এবং lustএর মাঝে পার্থক্য করতে পারে! যে তার বাবামায়ের ভালবাসা এবং বিশ্বাসের মূল্যায়নকে নিজের সাময়িক আনন্দের ওপর প্রাধান্য দিতে পারেনা, যার কাছে love একটা টাইমপাস ছাড়া আর কিছুই নয়, যার নিজের প্রতি বা তার আশেপাশের মানুষগুলোর প্রতি এতটুকু সততা নেই, তার কাছে দেশ বা জাতি কি আর আশা করতে পারে?
একদিন এক ছাত্রী পড়ার মধ্যখানে হুট করে প্রশ্ন করল, ‘ম্যাডাম, হিন্দু মুসলিম বিয়ে কি বৈধ?’ গুরুত্বপূর্ণ কোন তত্ত্ব বা তথ্যের আলোচনার মধ্যখানে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলে কেমন লাগে শিক্ষক মাত্রই জানেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দেয়াটাও শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কোন point of view থেকে জানতে চাইছ?’
সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘মানে?’
‘মানে আইনগত, সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক- কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ কি’না জানতে চাইছ?’
‘ম্যাডাম, ধর্মীয়’।
‘ধর্মীয় দিক থেকে অবৈধ’।
আবার ‘ম্যাডাম’ ডাক শুনে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালাম।
‘কোন ধর্মে নিষেধ?’
‘হিন্দু ধর্মেও নিষেধ, ইসলাম ধর্মেও নিষেধ’।
পড়ানো শুরু করতে যাব, আবার বিভ্রাট, ‘ম্যাডাম, কাল রাতে নাটক দেখছিলাম। একটা হিন্দু-মুসলিম প্রেমের গল্প। ওরা পরে হুজুরের কাছে গেল সমাধান চাইতে। নাটকের হুজুর বলল, ‘মানুষ হওয়াটাই বড় কথা, হিন্দু মুসলিম কোন ব্যাপার না’’।
হেসে ফেললাম, ‘নাটকের হুজুর তো আসলে হুজুরই না! তুমি ফতোয়া নেবে কুর’আন এবং হাদীস থেকে। নাটকে তো নাটকের কথা বলেছে, নিজে পড়ে জেনে নেবে যা তোমার জানার। তোমরা যদি নাটক সিনেমা দেখে ধর্ম শিখতে যাও তাহলে তো...’
সে কাতর হয়ে বলল, ‘তাহলে ম্যাডাম, বীর-জারা যে বিয়ে করল!’
কি বোঝাব আমি এই পাগলকে? ‘শোন, কেউ যদি এভাবে বিয়ে করতে চায় তাকে আইনগতভাবে কেউ বাঁধা দিতে পারবেনা। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন কোন ব্যাক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলিম হতে পারবেনা যে পর্যন্ত না সে আল্লাহ এবং তার রাসূলের প্রতি ভালবাসাকে অন্য সবকিছুর ওপর প্রাধান্য না দেয়। হিন্দু ধর্মেও নিজ জাতের বাইরে বিয়ের অনুমতি নেই। যে অন্য কোন ব্যাপারে ধর্ম অনুসরন করেনা তার তো এই ব্যাপারে ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আর যে ধর্ম মানে তাকে তাঁর প্রভু এবং প্রেমের মাঝে একটি বেছে নিতে হবে। যে প্রভুকে ভালবাসে সে কখনোই তাঁর ধর্মে যা অবৈধ তাকে বৈধ করার জন্য জাস্টিফিকেশন তৈরী করার চেষ্টা করবেনা’।
শেষপর্যন্ত ওর মাথায় ঢুকল। কিন্তু আমি চিন্তায় ডুবে গেলাম, আমাদের সন্তনেরা কি তবে ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তে সিনেমা আর টেলিভিশন থেকে ধর্ম শিখবে?!
এর ফলাফল হোল, এমনকি যারা ধর্মচর্চা করে তারাও এখন আর love এবং lust এর তফাত করতে পারেনা। এদের প্রায়ই দেখা যায় বোরকা পরেও ছেলেবন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকতে, দাড়ি টুপি পাঞ্জাবী আর বিশ্বাস নিয়ে এমন মেয়েদের বিয়ে করতে যারা ধর্মের ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নয়, ফেসবুকে দেখা যায় নানাবিধ relationship status: ‘engaged’, ‘in a relationship’, ‘its complicated’! সুতরাং সম্পর্কগুলো বাস্তবেও complicated হতে থাকে। যখন অনার্সে পড়ি, বিটিভিতে একটা সিরিজ দেখাত Northern Exposure, ওখানে এক DJ দুঃখ করে বলেছিল, ‘When you finally win that girl of your dreams, the first thing you do is try to change her. That little thing she does with her hair, the way she wears her clothes, the way she chews her gum. Until eventually, what you like, what you don't like and what you change all merges into one. Like a watercolor in the rain’. ‘When you finally win that girl of your dreams, the first thing you do is try to change her’ কারণ পছন্দগুলোর ভিত্তিই বাহ্যিক বৈশিষ্টাবলী যেগুলো সতত পরিবর্তনশীল। সুতরাং, প্রেম এখানে দন্ডায়মান হবার মত মাটি খুঁজে পায়না। তাই আমরা পছন্দের মানুষটিকে বারবার পরিবর্তন করে দেখার চেষ্টা করি কি করলে আরাম লাগে কিন্তু ভালবাসার রঙ কিছুতেই টেকসই হয়না, ‘Like a watercolor in the rain’.
এর চেয়ে আমি আমাদের সেই বড় আপুকে শ্রদ্ধা করি যিনি সর্বসমক্ষে বুক ফুলিয়ে হিন্দু বয়ফ্রন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, অন্তত তিনি যা করেন এই ব্যাপারে তাঁর মাঝে কোন ভন্ডামী ছিলোনা, তিনি ধর্ম অনুসরন করেননা সুতরাং এর কোন অংশই করেন না। আমি শ্রদ্ধা করি সেই দু’টি ছেলেমেয়েকে যারা যখন বুঝতে পারল সাবধানতা অবলম্বন সত্ত্বেও তারা একে অপরকে পছন্দ করে ফেলেছে তখন বাবামার কাছে সাহায্য চাইল তাদের গুনাহ থেকে রক্ষা করতে; বাবামা এই শর্তে তাদের বিয়ে করিয়ে দিলেন যে লেখাপড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা নিজের নিজের বাসায় থাকবে কিন্তু দেখাসাক্ষাত করলে যেন বাবামাকে লুকিয়ে পার্কে, রেস্টুরেন্টে বা কবরস্থানে করতে না হয়, মিথ্যা বলতে না হয়, সারারাত মোবাইলে খুটখুট করে লেখাপড়ার তেরোটা বাজাতে না হয়। আমাদের অধিকাংশ বাবামায়েরা নিজেরা বেড়া পার হয়ে সন্তানদের জন্য বেড়া তুলে দেন। সন্তানের লেখাপড়া, ল্যাপটপ, আইফোন, আইপ্যাড আর দুনিয়ার তাবত সুখসম্বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কার্পণ্য করেন না; কিন্তু তার চরিত্র, যা দুনিয়া এবং আখিরাতে তার মুক্তি এবং সুখসম্বৃদ্ধি নির্ণয় করবে, এই ব্যাপারে তাঁদের কোন মাথাব্যাথা নেই। পার্থিব উপকরণ তো চোখে দেখা যায়, লোকে বাহ বাহ করবে! চরিত্র তো অদৃশ্য ব্যাপার, চোখে পর্দা দিয়ে রাখলেই হোল, কেউ দেখবেনা, এর জন্য পরের সন্তানকে খাওয়াবো নাকি? তখন আমাদের টাকাপয়সার অভাব প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু এর মাধ্যমে যে নিজের সন্তান চারিত্রিক স্খলন হতে রক্ষা পাবে, আমার একটির পরিবর্তে দু’টি সন্তান লাভ হবে, এই কথাটা আমরা প্রায়ই ভাবিনা! আর ভাববই বা কিভাবে? বিয়ের মত একটি সরল, সহজ, স্বাভাবিক অনুষ্ঠানকে আমরা বেকার আনুষ্ঠানিকতা আর ব্যায়বহুল বিলাসিতার মারপ্যাঁচে এত কঠিন করে ফেলেছি... যে বিয়ে জনাপাঁচেক লোকে খেজুর খেয়ে সম্পন্ন করা যায় তা ভয়াবহ ভীতিকর ব্যাপারে পরিণত হয়েছে! কিছুদিন পর যদি বাবামায়েরা পশ্চিমা দেশগুলোর মত পণ করে বসেন, ‘বাবাগো, তোমরা প্রেম কর যা কর, বিয়ের খরচটা নিজেরা জোগাড় করে নিজেই বিয়ে করে নিয়ো, আমাদের দাওয়াত করলে আমরা আসব’, তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
এক বান্ধবী মনে বড় কষ্ট পেয়েছিল তাকে ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে উইশ করিনি বলে। বললাম, ‘আমি তো কোন ডেতেই উইশ করিনা কারণ আমি তোমাদের সবাইকে সারা বছর একইভাবে ভালবাসি। এখন আমাদের বাবা মাকে ভালবাসার জন্য ফাদারস ডে, মাদার্স ডে প্রয়োজন হয়; শিক্ষকের প্রতি সম্মানের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য টিচার্স ডে লাগে; পরিবারের প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরন করিয়ে দিতে ফ্যামিলি ডে লাগে আর বেচারা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁর নামে যেসব অনাচার হচ্ছে তা দেখে আত্মহত্যা করতেন! ভালবাসার অর্থই আমাদের কাছে পরিবর্তিত হয়ে গেছে!’ তবু আমরা স্রোত পেলেই গা ভাসিয়ে দেই গড্ডালিকা প্রবাহে। স্রোত আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভেবে দেখারও প্রয়োজন মনে করিনা। এই ভেসে যাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, ঐতিহ্য, ধর্ম, পরিবার সব সবকিছু বিপন্ন করে ফেলছি আমরা। তবু আমাদের এই কুম্ভকর্ণমার্কা ঘুম ভাঙ্গার কোন লক্ষণ নেই? এই ঘুম যখন ভাংবে তখন বাঁচার সময় পাওয়া যাবে তো? এই ঘুম আদৌ ভাংবে তো?
No comments:
Post a Comment