Sunday, December 9, 2012

ভালো শাশুড়ীদের গল্প







সমাজের কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে অনেক ব্লগার ভাইবোনের ধারণা হয়ে গিয়েছে আমি কেবল সমস্যাগ্রস্ত শাশুড়িদের কথা বলি। ছোটবোন নূসরাত তো রাগ করে বলেই ফেলল, ‘যদি সব শাশুড়িরা এমনই হয় তাহলে দুয়া করি আমার যেন ছেলে না হয়’! তবে যারা আমার আগের লেখাগুলো মনোযোগ সহকারে পড়েছেন তাঁরা জানেন আমি কেবল এতটুকুই আহ্বান জানাই যে একজন নারী যেন নিজেকে কেবল শাশুড়ি না ভেবে একটি বাড়তি সন্তানের মা ভাবেন, বৌকে পরের মেয়ে না ভেবে নিজের নবজাতক কন্যা ভাবেন। যেহেতু পরিবারে তিনিই বড়, তিনি যেন কেবল আশা এবং ত্রুটিবিশ্লেষণ না করে উদাহরণ স্থাপন করে বৌকে শেখান কি ধরণের আচরণ তিনি আশা করেন।

একটি নতুন সম্পর্কের গোড়াপত্তন কখনোই সহজ হয়না। একটি নতুন পরিবারে গিয়ে নতুন মানুষগুলোর সাথে সাথে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে মানিয়ে নেয়া একটি মেয়ের জন্য যতটা কঠিন, যে সন্তানকে একজন মা তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন তাকে অন্যের সাথে ভাগ করে নেয়া মায়ের জন্য তার চেয়ে কিছু কম কষ্টের নয়। এখানেই উদারতার প্রয়োজন হয়, নিজের নতুন বৌ হয়ে আসার দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে নিতে হয় তিনি কি ধরণের ব্যাপারগুলোতে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সহযোগিতা পেতেন, কিসে কষ্ট পেতেন, সে সময় তাঁর সাথে কেমন আচরণ করা হলে সে কষ্ট লাঘব হতে পারত এবং সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। তাঁর ছেলের হাত ধরে তাঁর সংসারে আসা নতুন মানুষটার সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে তাঁকে যে কষ্ট করতে হয় তা প্রশস্ত হৃদয়ের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখা চাই কারণ তিনি নিজের বাড়িতে একজন নবাগতের সাথে অ্যাডজাস্ট করছেন; আর মেয়েটির কাছে তো সবই নতুন, পুরাতনকে ছেড়ে আসার বেদনার দগদগে ঘাটাও!

আজ দু’জন শাশুড়ির কথা বলব যাদের খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং ভেবেছি আমিও যেন তাঁদের মতই আমার আগত দু’টি সন্তানের জন্য যেমন, আমার অনাগত দু’টি সন্তানের জন্যেও শাশুড়ি না হয়ে মা হতে পারি। নামগুলো গোপনই থাক, ভালমানুষগুলো লুকিয়ে থাকতেই পছন্দ করেন। তাই আমরা কেবল তাদের বৌদের বক্তব্য দিয়েই তাদের ব্যাপারে আলোচনা করব। বলাবাহুল্য বৌদের নামগুলোও বদলে দিলাম।


যৌথ পরিবারেঃ

বাহারের বিয়ে হয়ে যায় অনার্স প্রথম বর্ষে। বাবা বা বড়ভাই ছিলোনা, তাই অনাড়ম্বর বিয়ে। শাশুড়ি ওকে বাসার কাছে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সুযোগ পেয়ে বন্ধুরা প্রায়ই ক্যান্টিনের খাবার পছন্দ না হলে দলবেঁধে বাহারের বাসায় হানা দিত ভরদপুরে। শ্বাশুড়ি তখন ঘরে যাই যতটুকু থাকত তাই দিয়ে সবাইকে অপ্যায়ন করতেন, সবার সাথে গল্প করতে করতে বাহারকে পাঠিয়ে দিতেন নিজের ঘরে, মুখহাত ধুয়ে খেয়ে নেয়ার জন্য। কখনো বিরক্ত হতেন না বৌ কেন বিশ বাইশজন বন্ধু নিয়ে ভরদুপুরে ঘরে এলো।

একদিন বাহারের বাসায় অনেক মেহমান। সবাইকে বিদায় দিতে দিতে রাত বারোটা বেজে গেল। শাশুড়ি দেখলেন বাহার সামান্য মন খারাপ করে ড্রয়িং রুমে বসে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার মা? তোমার মন খারাপ কেন?’ সে মুখটা হাসি হাসি করে বলল, ‘কিছু না মা’। কিন্তু তিনি ছাড়লেন না। তখন সে বলল, ‘কাল শুনেছিলাম আম্মুর শরীরটা একটু খারাপ, কিন্তু আজ আর কথা বলার সুযোগ হয়নি, তাই একটু চিন্তা লাগছিল’। শাশুড়ি সাথেসাথে ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি বের করতে বললেন। বাহারের স্বামীর পরদিন অফিস, তাকে ঘুমাতে পাঠিয়ে দিয়ে শাশুড়ি নিজেই বাহারকে নিয়ে গেলেন ওর আম্মুর বাসায়। রাত দুটো পর্যন্ত আম্মুর সাথে কাটিয়ে যখন ওর মন ভরল তখন তিনি বাহারকে সাথে করে নিয়ে এলেন পরদিন ক্লাস আছে তাই।

অনার্স প্রথম বর্ষ পরীক্ষার ক’দিন আগে বাহারের প্রথম সন্তানের জন্ম হোল। কিন্তু শাশুড়ি তাকে বলে দিলেন শুধু বাচ্চাকে মাঝেমাঝে খাওয়ানো ব্যাতীত সে যেন পড়াশোনা ছাড়া কোনপ্রকার কাজে সময় নষ্ট না করে। পরবর্তীতে বাহার অনার্সের প্রত্যেক বছর এভাবেই পরীক্ষা দিয়েছে কারণ কিভাবে কিভাবে যেন প্রতিবারই ওর সন্তানের আগমন এবং ওর পরীক্ষার তারিখ মিলে যেত। একবার পরীক্ষার মধ্যখানে ওকে নোট দিতে গিয়ে দেখলাম ওর এক বাচ্চা শাশুড়ির কোলে, আরেক বাচ্চা বুয়ার কোলে আর তিনি বুয়াকে ওর রুমের সামনে থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন বাচ্চা শব্দ করতে পারে ভেবে। আমি বললাম, 'বাহারকে একটু ডেকে দিন,আমি নোটটা দিয়েই চলে যাব যেহেতু আমার পড়তে হবে'। কিন্তু খালাম্মা কিছুতেই ওকে ঘুম থেকে ওঠাবেন না, ‘বেচারী এতক্ষন পড়াশোনা করে একটু ঘুমিয়েছে, তুমি বরং নোটটা আমাকে দিয়ে যাও। ও উঠলে আমি দিয়ে দেব’।

একবার বাহার আর ওর জা মিলে ঠিক করল বাহারি জিনিসের দোকান করবে। ওর শাশুড়ি ওদের একটা ফ্ল্যাট খালি করে দিলেন। আবার দোকান যখন চললনা বলে বন্ধ করে দিতে হোল তখনও তিনি তাদের কিছু বললেন না। মেয়েকে আর বৌদের একই দৃষ্টিতে দেখতেন বলে বৌরা যেমন তাকে ভালবাসত, তেমনি ভালবাসত একমাত্র ননদিনীকেও। তিনি যখন ছেলেদের মাঝে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে দিলেন তখন বৌদের মাঝে নিজের ফ্ল্যাটে ওঠার উদ্দীপনার চাইতেও কাড়াকাড়ি লেগে গেল কে তাকে সাথে রাখবে। বাহার এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে এমন গর্বিত হোল যেন সে অলিম্পিকের একশ মিটার দৌড়ে স্বর্ণ জিতেছে!

সন্তানদের প্রতি অত্যধিক ভালবাসার কারণে বাহার আর আমাদের সাথে মাস্টার্স করলনা। শাশুড়ির উৎসাহে নয় বছর পর সে আমার ছাত্রি হিসেবে মাস্টার্স সম্পন্ন করে। শাশুড়ি সম্পর্কে সে বলে, ‘উনি আমার জন্য আল্লাহর রহমতস্বরূপ, তিনিই আমার আলোর দিশারী এবং তাঁর উৎসাহই আমার অনুপ্রেরণা, আমার সংসারের জন্য তিনি বরকতময় এবং আমার সন্তানদের জন্য তিনি ছায়াস্বরূপ’।


একক পরিবারেঃ

সাফিনার বিয়ের আগে দুইপক্ষই রাজী থাকলেও শাশুড়ি ছিলেন বিয়ের ঘোর বিরোধী। তবু যখন বিয়ে হয়ে গেল, কি হবে ভেবে সাফিনা খুব ভয় পেল। কিন্তু বিয়ের পর তাঁর কোন আচরণে সাফিনা কোনদিন বুঝতে পারেনি যে তিনি বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলেন। ওর স্বামীর চাকরীর কারণে ওদের শাশুড়ির কাছ থেকে দূরে থাকতে হত। কিন্তু তিনি সবসময় ওর সাথে যোগাযোগ রাখতেন, সুযোগ পেলেই ওর বাসায় বেরাতে যেতেন। সাফিনা বলত, ‘আমার বাসায় যত দামী জিনিস আছে সব আমার শাশুড়ির দেয়া- কম্পিউটার, ফ্রিজ, টিভি সব’।

একদিন সাফিনা ভারী সুন্দর একজোড়া রূপার কানের দুল পরে এলো। ক’দিন পর একই কানের দুল সোনায় রূপান্তরিত হতে দেখে তো সবাই হতবাক! তখন সে খুলে বলল, ‘মা কদিন আগে আমার কানের দুলটা দেখে নিতে চাইলেন। উনি পরবেন ভেবে আমি ওটা তাঁকে দিয়ে দিলাম। গতকাল উনি আমাকে ঐ কানের দুল ফেরত দিলেন, সাথে একই দুল সোনা দিয়ে তৈরি করে!’

সাফিনা একবার এক বিশেষ কাজের জন্য ওর সমস্ত সোনার জিনিস বিক্রি করে দিল। তার কিছুদিন পর এক বিয়েতে ওকে ভারী সুন্দর দুটো চুড়ি পরে আসতে দেখে সবাই জিজ্ঞেস করল সে চুড়ি কিনল কবে। তখন সে বলল, ‘আরে এগুলো আমার না। বিয়েতে আসার আগে শাশুড়ির বাসায় গেছিলাম। আমার হাত খালি দেখে মা জোর করে নিজের দুখানা চুড়ি পরিয়ে দিয়েছেন’।

আরেকবার সাফিনা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। বিছানা থেকেই সে উঠতে পারেনা। শাশুড়ি ওকে ওর বাসা থেকে নিজের বাসায় নিয়ে এলেন। ওর বাচ্চাদের গোসল করানো, খাওয়ানো থেকে ওকে রুমে খাবার এনে দেয়া সবই উনি খুশী হয়ে করছেন। তার ওপর আমি ওকে দেখতে গেলে উনি আমাকে নাস্তা দিয়ে বাচ্চাদের ওনার রুমে নিয়ে গেলেন যাতে আমরা আরাম করে কথা বলতে পারি। উল্লেখ্য উনি অত্যন্ত বড় পদে কর্মরত একজন মহিলা। সুতরাং, উনি কাজ নেই বলে বদান্যতা দেখাচ্ছেন ব্যাপারটা তেমন নয় বরং তিনি সত্যই ওর ব্যাপারে চিন্তিত বলেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

সাফিনা বলে, ‘উনি যা বলেন বা করেন তাতে কোন বক্রতা নেই, সরাসরি কথা বলতে ভালবাসেন কিন্তু কাউকে মনে কষ্ট দেননা, যা ভাল মনে করেন তা করা থেকে কেউ তাঁকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা কিন্ত তিনি কারো ক্ষতি করেন না’।


একজন ভালো মনের মানুষ সবসময় প্রতিটি কথা বা কাজে receiving end এ নিজেকে কল্পনা করার চেষ্টা করেন, ভাবার চেষ্টা করেন তাঁর সাথে কেমন কথাবার্তা বলা বা আচরণ করা হলে তিনি আনন্দিত হবেন, কিসে তিনি কষ্ট পাবেন এবং সেভাবেই অন্যের সাথে কথা বলার বা ব্যাবহার করার চেষ্টা করেন। সুতরাং, একজন ভালো মানুষ কেবল একটি ভূমিকায় নয় বরং সকল ভূমিকাতেই নিজের পূর্ণ প্রচেষ্টা দিয়ে পরিস্থিতিকে জয় করার চেষ্টা করে যান। পৃথিবীতে কেউ ত্রুটিমুক্ত নয়, উল্লেখিত দুই শাশুড়িও নন। কিন্তু তাঁরা অপরের ত্রুটি অনুসন্ধান করেন না তাই অন্যরাও অনুভব করেনা যে তাদের সারাক্ষণ scrutinize করা হচ্ছে, ফলে তাদের আশেপাশের মানুষজন তাদের উপস্থিতিতে আরাম বোধ করেন। যেহেতু তাঁরা সম্পর্কগুলোকে নিজের ১০০% প্রচেষ্টা, মনোযোগ এবং আন্তরিকতা দিচ্ছেন ফলে অপরপক্ষও এর চেয়ে কম দেয়ার কথা ভাবতে পারেনা। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁরা ভাবেন না ‘আমাদের কি পাওয়া উচিত’, তাঁরা ভাবেন ‘আমাদের কি দেয়া উচিত’, তাই কার্যত তাঁরা অনাকাঙ্খিতভাবে যাই পান তাই লাভ মনে করেন। সর্বাবস্থায় অন্যের মঙ্গলচিন্তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়। যারা স্বার্থের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে এই কাজটুকু করতে পারেন তাঁরা পৃথিবীতেও বিজয়ী হন, পরকালেও বিজয়ী হবার মত পাথেয় সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।

No comments:

Post a Comment