Sunday, December 9, 2012

বৃষ্টি ও বন্ধু





আজ আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন। সকালে হাল্কা তুষারপাত হচ্ছিল, দুপুরে বৃষ্টির সম্ভাবনা। এমন দিনে ঘুমাতে কি যে ভাল লাগে! একসময় এমন চমৎকার পরিবেশে ঘুমাতে পারতাম না চাকরীর টানে। আর আজ গৃহিনী হয়েও ঘুমাতে পারছিনা বইটা হাত থেকে রাখতে ইচ্ছে করছেনা বলে। একেই বলে তাক্কদীর।

ছোটবেলায় আকাশ কালো হয়ে এলেই আমি যেন ময়ূরের মত পেখম তুলে নাচতাম। তখন আমরা ঢাকা থাকি। একবার দুপুরে ঘুম দিয়েছি সারাদিন বান্দরামীর পর। ঘুম থেকে যখন উঠছি তখন আসরের কিছু পর। টিভিতে তারামসজিদের আজান দেখাচ্ছে, ঐ দেখিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে বাবা। উঠে মনে হোল যেন আমি সম্পূর্ণ একরাত ঘুমিয়ে উঠেছি। এমন পরিপূর্ণ আরামের ঘুম কি বৃষ্টির দিনে ছাড়া সম্ভব?

আরেকবার পড়ার টেবিলে মনোসংযোগ করার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি অথচ আমার গল্পের বইটা আমাকে বার বার ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছে। সামনে এইচ এস সি পরীক্ষা, সুতরাং এই নীরস পাঠ্যবইয়ের প্রতি অনাগ্রহ প্রকাশ করার কোন উপায় নেই। এমন সময় আল্লাহ আমাকে উদ্ধার করলেন। বৃষ্টি নামল। সামনের বাড়ীর নারকেল গাছে হাজারে হাজারে পিচ্চি পিচ্চি গেছোব্যাঙ আর্মিস্টাইলে বেয়ে উঠতে লাগল। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখার জন্য পুরো পরিবারের সবাইকে ডেকে হুলস্থুল কান্ড করে বসলাম। ব্যাঙ বাবাজিরা সেদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাচ্চাকাচ্চা সমেত গাছে ওঠা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে আমাদের চট্টগ্রামের বাড়ীটাতে এই প্রাণের প্রাচুর্য অনেক সময়ই সমস্যার সৃষ্টি করত, বিশেষ করে যখন বাসা থেকে বের হবার সময় কেঁচো সাহেব পায়ে পড়ে মাফ চাইতে পুরো দেড়ফুট শরীর পায়ের ওপর এলিয়ে দিতেন, বা বড়ইগাছতলায় পা ধুতে গেলে শামুক বাবাজী টুপ করে ঘাড়ের ওপর পড়ে সালাম দিতে চাইতেন।

একবারের কথা খুব মনে পড়ে। তখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি। বান্ধবীরা প্রায়ই ব্রেকের সময় মোহসীন কলেজের নয়ানাভিরাম পাহাড়গুলোতে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন মোহসীন কলেজের লাইব্রেরীর সামনে দাড়িয়ে দুরে কর্ণফুলী নদী দেখছি। দূর দিগন্তে আকাশ কালো করে কর্ণফুলীতে বৃষ্টি নামছে। এই দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই দেখি বৃষ্টি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। দুপুরের ব্রেক, লাইব্রেরি বন্ধ, অন্য সব বিল্ডিং অনেক অনেক দূরে, যাব কোথায়? কাকভেজা হয়েই ক্লাসে ফিরতে হোল। সেদিনের সেই আমরা ক’জনা এখন কে কোথায় ছিটিয়ে পড়েছি ঝড়ে উড়ে যাওয়া পাতার মত!

যখন চাকরী করি, বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়া দেখলে অনেক সহকর্মীই মন খারাপ করত। আমি ইউনিভার্সিটি যেতাম মটরবাইকে চরে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে, রেইনকোট পরে, অনেক সময় রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে চুপচুপে হয়ে যেতাম, তবু আমার মনে ফূর্তির অন্ত থাকতনা। ইউনিভার্সিটি গেলেই ছাত্রীদের হাসিমুখ আর সহকর্মীদের সাথে গপ্প করার সুযোগ তো ছিলই, কিন্তু খুশীর ব্যাপারটা ঠিক তাতে সীমাবদ্ধ ছিলোনা। বৃষ্টি হলেই আমার রক্তে নাচন ওঠে, সেটাই মুখ্য।

ইউনিভার্সিটিতে আমাদের শিক্ষকদের কক্ষটা ছিল ভারী সুন্দর। বারান্দা থেকে কর্ণফুলী নদী দেখা যেত, চটগ্রাম কলেজের বিশাল ময়দান আর গাছগাছালী চোখে প্রশান্তি এনে দিত। দুর দিগন্তে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ যখন তার বুক খালি করে অশ্রু ঝরাত, কর্ণফুলীর সজীবতা তখন প্রকৃতির সবটুকুকে স্পর্শ করত। আমি যেভাবে বাসে, ট্রেনে, প্লেনে জানালার পাশে সীট দখল করতাম, সহকর্মীদের বদান্যতায় এখানেও আমার টেবিলটা ছিল জানালার পাশে। অনেক সময় ক্লাসে থাকলে বৃষ্টির ছাঁট এসে কাগজপত্র ভিজে সর্বনাশ হয়ে যেত, আবার আমি নদীভাঙ্গা কৃষকের মত নতুন আশায় বুক বাঁধতাম, সেই ভেজা কাগজ থেকেই উদ্ধার করতাম অমূল্য জ্ঞানের ফসল। আমার জানালা থেকে দেখা যেত মোহসীন কলেজের পাহাড় আর দেবপাহাড়ের নতুন পুরাতনের মিশেল দেয়া বাড়ীঘর। ইউনিভার্সিটির এ’পাশটাতে ছিল একটা বিশাল ডোবা, বিল্ডিং বানাবার জন্য মাটি খোঁড়া হলেও আর বিল্ডিং বানানো হয়নি। ঐ বিশাল গর্তে পানি জমে কোথা থেকে ওখানে বিরাট বিরাট মাছ জন্মাতে শুরু করে। বৃষ্টি হলে মাছগুলো পানা আর শ্যাওলার মাঝে ঢাঁই দিত কিছুক্ষন পরপর, দেখতেই ভাল লাগত!

একদিন দুপুরে মাস্টার্সের ক্লাস নিতে হবে বলে বসে আছি। কিন্তু তখন আমার হৃদয় ময়ূরের মত নাচছে, আকাশ কাল হয়ে ঝমঝম বৃষ্টি হচ্ছে, জানালা থেকে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। মুঠোফোনে পাখপাখালীর সম্মিলিত কুহুতান শুনে বিরক্তি সহকারে ওঠালাম, ছাত্রী, বলল, ‘ম্যাডাম, এত জোরে বৃষ্টি হচ্ছে, আজকে কেউ আসতে চাচ্ছেনা’। মনের খুশী বহুকষ্টে চেপে রেখে বললাম, ‘ঠিক আছে, তোমাদের অসুবিধা হলে আমি ক্লাসটা রিশিডিউল করে দেব’। ফোন রাখতেই শুনি, ‘মাওলা মেরে, মাওলা মেরে..., আপনি ভাই এক অদ্ভুত মানুষ! এতক্ষণ বসে অপেক্ষা করছেন, কোথায় স্টুডেন্টদের ধমক দিয়ে বলবেন, ‘আজকে না এলে ক্লাস নেবনা’, নিজেই বৃষ্টি দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছেন!’ জানালার বাইরে হৃদয়মন সব দিয়ে বসে থাকায় টের পাইনি কামরায় আমার অপকর্মের সাক্ষী রয়ে গেছে!

আবার পাখপাখালীর কুহুতান। এবার হাফিজ সাহেব। জানালাম ক্লাস হবেনা, ‘নিতে আসতে পারেন’।
উনি বললেন, ‘বৃষ্টি কমলে আসি, রেইনকোট নেই’।
‘মানে? বৃষ্টি কমার দরকার কি? বাসায়ই তো যাব!’
‘তোমার ব্যাগ, বইখাতা?’
‘পলিথিনে ভরে নেব’।
‘আচ্ছা, আমি আসছি’।

আবার ‘মাওলা মেরে, মাওলা মেরে...’ গান শুরু হোল। ‘আপা, শোনেন,আপনাকে একটা কবিতা শোনাই...’
হাসতে হাসতে বললাম, ‘শোনান’।
‘অ্যা বারিষ, তুম বার্সো তো অ্যাসে মাত বার্সো কে মেরে পিয়া আ না সাকে,
অর উয়ো আনেকে বাদ অ্যাসে বার্সো কে মেরে পিয়া যা না সাকে’।
(ভাবার্থঃ হে বৃষ্টি, তুমি এমনভাবে ঝরোনা যেন আমার প্রিয়া আসতে না পারে, আর সে আসার পর এমনভাবে ঝরো যেন সে যেতে না পারে।)
বিস্তর মজা পেলাম কবিতাটা শুনে, কবি ক’খানা মাত্র শব্দকে এদিক সেদিক করে কি চমৎকার একখানা কবিতা রচনা করে ফেলেছেন! দু’খানা লাইনে তিনি বৃষ্টি আর প্রিয় ব্যাক্তির সান্নিধ্য দু’টোই উপভোগ করার আকুতি প্রকাশ করেছেন মর্মস্পর্শীভাবে।
হেসে ফেললাম, ‘কিন্তু হাফিজ সাহেব যেতে না পারলে যে আমারও যাওয়া হবেনা!’
এবার কবি বন্ধুটিও হেসে ফেললেন।

আনমনে এই বৃষ্টির দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আজকের দিনটাও খুশীতে ভরপুর হয়ে গেল। আসলে মানুষের মন ভাল রাখার জন্য একটা উপলক্ষ্যই যথেষ্ট!

No comments:

Post a Comment