Sunday, December 9, 2012

দু’দিনের মেহমান



কক্রেনে আইসক্রীমের দোকানের সামনে সুদৃশ্য ফুলঝারি

জুলাই একুশ তারিখ বাংলাদেশ থেকে দু’জন মেহমান আসবেন, আমাদের সাথে থাকবেন। খবর পেয়ে প্রথমেই ঠিক করলাম ঘর গুছাতে হবে। নিজের মত করে থাকা একরকম। কিন্তু মেহমানের জন্য ড্রয়ার আলমারী খালি করে জিনিসপত্র রাখার জায়গা করতে হবে, তিন বেড্রুমেই জানালার ব্লাইন্ড আংশিক বা পুরোপুরি ড্যামেজড, এগুলো খুলে পর্দা লাগাতে হবে। সুতরাং, কাজে নেমে পড়লাম। কেবল প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় ছাড়া সব বাক্সে ভরে বেসমেন্টে ট্রান্সফার করলাম, কিছু কাপড় বান্ধবীদের সাথে রিসাইকেল করলাম, কিছু ফেলে দিলাম। পর্দার কাপড় কেনা হয়েছে একবছর আগে, রড কেনা হয়েছে ছ’মাস, লাগানোর সময় হয়নি। একদিনের ভেতর বিশিষ্ট পরোপকারী পাকিস্তানী প্রতিবেশী, বান্ধবী হাবিবার বর শাফকাত ভাইকে ধরে এনে পর্দার রড লাগালাম। বেচারার পায়ে ভীষণ ব্যাথা, কিন্তু আমাদের বিপদের কথা শুনে যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে উপস্থিত। ইফতেখার ভাইকে ফোন করলাম সেলাই মেশিনের জন্য যদিও সেলাই মেশিন কিভাবে কি করতে হয় সে সম্পর্কে আমার কোনপ্রকার ধারণা নেই। উনি জানালেন মেশিন আরেকজনের কাছে। হাতে সময় নেই। একদিনের ভেতর ছ’খানা পর্দা হাতে সেলাই করে ফেললাম এই আমি, যে কি’না জীবনে একখানা রুমাল সেলাই করিনি! পরদিন জানালায় নতুন পর্দা ঝুলিয়ে আমি নিজের শিল্পকর্মে নিজেই বিমোহিত শিল্পীর মত মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম, চোখের সামনে ঝুলছে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম!

একুশ তারিখ সকালে শুরু হোল যুদ্ধ। সারা ঘর পরিস্কার করে রান্না শুরু করতে করতে বেজে গেল একটা। মেহমান আসার কথা তিনটায়। ফ্লাইট দু’ঘন্টা ডিলে হয়েছে শুনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রান্না শুরু করলাম দু’টায়। হাফিজ সাহেব যখন পাঁচটায় এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছেন তখন সেদিনকার মত রান্না শেষ। কিন্তু এখানে রান্নার চাইতেও কষ্ট রান্নাঘর পরিস্কার করা। তাই ফ্লাইট আরো ডিলে হচ্ছে জানতে পেরে আরো কিছু রান্না করে রেখে দিলাম পরের দু’দিনের জন্য। সাড়ে সাতটায় রান্নাঘরের সব কাজ শেষ। শেষ কাজ বাথ্রুম পরিস্কার করা। রান্নাঘর আর বাথ্রুম- এই দু’টো রুমের ব্যাপারে আমি খুব ফিতফিতে- বাবার কাছ থেকে পাওয়া। রাত আটটায় যখন আমি গোসল সেরে রেডী তখন আর মেহমান আসেনা। সাড়ে আটটায় হাফিজ সাহেবকে ফোন করে জানতে পারলাম এয়ারপোর্টে নেমেই ওরা সদলবলে শহর পরিদর্শন করতে বেরিয়েছেন। রাত ন’টায় মেহমান এসে পৌঁছলেন। পাঁচমিনিট পর এলেন ইফতেখার ভাই পরিবার। বিদেশে বন্ধুরাই আত্মীয়। আমাদের সকল কিছুতে যে বন্ধুরা পাশে থাকেন তাদের একজন ইফতেখার ভাই। ন’টায় টেবিলে খাবার দিয়ে দিলাম ভ্রমণক্লান্ত বন্ধুদের জন্য। সেদিনের মেন্যু ছিল মোরগ বিরিয়ানী, কলিজা কারি, ডিমভূনা, গরুর মাংসের কোফতা, মাছ, ব্রকলী (সবুজ ফুলকপি) ভর্তা, সালাদ, আচার- খাবার পর হাফিজ সাহেবের বানানো রসগোল্লা, মৌসুমী ফল চেরী আর স্ট্রবেরী। সবাই তৃপ্তির সাথে খাওয়ার সময় মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলাম। আমি বিশিষ্ট রন্ধনবিশারদ কি’না- ঠেকায় না পড়লে রান্নাই করিনা! প্রথমে একমাত্র কন্যা এবং পরে একমাত্র বধু হবার সুবাদে বছরে দু’একবার ছাড়া জীবনে রান্না করার প্রয়োজন পড়েনি। ক্যানাডায় এসে সেই আমি রান্না করছি এবং লোকজন তা গলাধঃকরণ করতে পারছে! অভিভূত আমি!



আমাদের মেহমানবৃন্দ


রাত এগারোটায় মেহমান ধুয়া তুললেন তাঁরা হোটেলে থাকবেন। আমরা তো হতবাক! এত প্রস্তুতি, এত কিছু, এখন হোটেলে! অনেক চাপাচাপি করার পর জানা গেল মেহমানদের একজন সিগারেটখোর। এখানকার বাসাগুলো স্মোকিংয়ের উপযোগী নয়। উপরন্তু সিগারেট আমার জানি দুশমন। একবার এক সিগারেটখোরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলাম, “আল্লাহ যেন তোমার মনের আশা পূর্ণ করেন, তোমার যেন ক্যান্সার হয়!” পরে খুব কষ্ট লেগেছিল, কিন্তু সিগারেট এতটাই অপছন্দ করি যে ঐমূহূর্তে আর নিজেকে সামাল দেয়া সম্ভব হয়নি। ঐ ঘটনার পুণরাবৃত্তি না ঘটার লক্ষ্যে শেষমেশ মেহমানদের হোটেলে দিয়ে আসাই ঠিক হোল। রাত বারোটায় ইফতেখার ভাই আর আমরা দুই গাড়ীতে তাঁদের নিয়ে চললাম হোটেল শেরাটন- হাফিজ সাহেবের কর্মস্থল। এখানে গাড়ীতে যে ক’টা সিটবেল্ট তার অতিরিক্ত একজন যাত্রীও নিলে ফাইন হয়, ফাইন হয় সিটবেল্ট লাগানো না থাকলেও। সেই জন্যই দু’জন মেহমানের জন্য দুই গাড়ী নিয়ে আমাদের দুই পরিবারের যাত্রা। এই সুযোগে আমরা প্রথমবারের মত হাফিজ সাহেবের কর্মস্থল ঘুরে এলাম। এই ভদ্রলোককে সবাই খুব পছন্দ করে। তাই ওনার ছুটি কভার দিতে হোটেলের সবাই মিলে এগিয়ে এসেছে। রিসেপশনের একপাশে দেখলাম কাঁচের ঘেরা দিয়ে সুইমংপুল। হাফিজ সাহেবকে মেদ কমানোর জন্য সুইমিংয়ের পরামর্শ দিয়েছিলাম। নাইট শিফটে একবার রাত দু’টায় সুইমিং পুলে নেমে কিছুক্ষণ পর দেখেন এক স্বল্পবসনা মহিলা পানিতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঐ যে ভয় পেয়ে পানি থেকে উঠলেন, আর নামানো গেলনা! এই নিয়ে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম আমরা। মেহমানদের নির্ধারিত কক্ষে পৌঁছে দিয়ে চলে এলাম বাসায়। ইফতেখার ভাইদের সাথে এটাই মজা যে আমরা হুট করে কিছু করে ফেলি!

বাসায় এসে ক্লান্ত বাচ্চারা ঘুমোতে চলে গেল সাথে সাথেই- তখন বাজে একটা। আমার রান্না খাওয়া গেছে এতেই বিমুগ্ধ আমি তখনো খেতে পারিনি। ভাত নিয়ে বসলাম। হাফিজ সাহেব সঙ্গ দিচ্ছিলেন। পরদিন কক্রেন যাবার কথা, জাহাঙ্গীর ভাই নিয়ে যাবেন। হঠাৎ মাথায় এলো, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের গাড়ী তো আট সিটের। আমরা মানুষ জাহাঙ্গীর ভাইসহ সাতজন। পরদিনের রান্নাও করা আছে। বললাম, “তাহলে আমরাও যাই”। সেই প্ল্যান মোতাবেক পরেরদিনের জন্য খাবার আর কাপড় গুছিয়ে শুতে গেলাম। এখানে গরমকালেও সাথে গরম কাপড় রাখতে হয়। দশ মিনিটে তাপমাত্রা দশ ডিগ্রী নেমে যাওয়া এখানে কোন ব্যাপারই না। যখন বাতাস প্রবাহিত হয় তখন প্লাস তাপমাত্রাতেও ঠান্ডায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেতে পারে। তাই এখানে কোথাও যাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হোল গরম কাপড় সাথে নেয়া। পরদিন সকাল সাতটায় জাহাঙ্গীর ভাই এসে উপস্থিত। হোটেল কক্রেনের পথে। মেহমানদের তুলে নিয়ে অনির্বচনীয় সুন্দর দৃশ্যাবলীর মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছলাম ছোট্ট শহর কক্রেন। এখানে সবচেয়ে বিখ্যাত এক আইসক্রীমের দোকান যার সবগুলো আইসক্রীমই হাতে বানানো। ওখানে যাবার পথে আমরা কয়েক মূহূর্তের জন্য থামলাম এখানকার একমাত্র মুসলিম গোরস্থানে। জায়গাটি আরবীরা কিনে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দান করে দিয়েছে। দেখলাম ইতিমধ্যেই অনেকে এখানে বাসিন্দা হয়েছেন। নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে নানান ব্যাকগ্রাউন্ডের সংমিশ্রণ। কবরস্থানের দৃশ্য জানান দিচ্ছে এদের অনেকের ইসলাম সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞানের অভাবের। অনেক কবরেই ফুল বা মৃতের পছন্দনীয় কিছু দ্রব্যাদি রেখে গেছে দেখতে আসা আত্মীয় স্বজন। তবে সবচেয়ে মজা পেলাম একটা কবরে সেভেন আপের ইনট্যাক্ট বোতল দেখে। মৃত ব্যাক্তি হয়ত সেভেন আপ খেতে খুব ভালোবাসতেন। ইসলাম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ বংশধরেরা তাই কবরে সেভেন আপের বোতল রেখে গেছে! বাতাস বাড়ছিল, সাথে বৃষ্টি। “আমরাও কিছুদিনের মধ্যেই আসছি”, এই প্রতিজ্ঞা জানিয়ে বিদায় নিলাম কবরবাসীদের কাছ থেকে।



কবরবাসীর জন্য রেখে যাওয়া অক্ষত সেভেন আপের বোতল


এখানে বৃষ্টি দীর্ঘস্থায়ী হয়না। আইসক্রীমের দোকানে পৌঁছতে যে দশ মিনিট লাগল ততক্ষণে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আইসক্রীম নিয়ে সবাই চলে এলাম রাস্তায় পাতা বেঞ্চিতে। বসন্তে লাগানো ফুলঝাড়িগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। এই দৃশ্য দেখে আইসক্রীম হাতেই ক্যামেরা চালালাম কয়েকবার।



কক্রেন থেকে ফেরার পথে, মনে হয় যেন একটুকরো বাংলাদেশ!


ক্যাল্গেরী ফিরে আসা হোল খুব তাড়াতাড়ি, জুমার নামাজ ধরার জন্য। গাড়ীতে একটা গান শুনলামঃ
“একদিন আমি মানুষ ছিলাম,
আমার একটা নাম ছি্ল
তোমার মত আমার দেহেও
রক্ত, পানি, ঘাম ছিল …”
একটি শিশুর গলা, কিন্তু কি হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিতে যে মৃত্যুর পরবর্তী অনুভূতি আর পরিবেশ বর্ণনা করেছে গানটি!

নামাজ পড়লাম আকরাম জুমা মসজিদে। আকরাম জুমা এক আরবী ভদ্রলোকের নাম। তিনি শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক বিশাল জায়গা কিনে দান করে গেছেন। এর অর্ধেক জুড়ে মসজিদ এবং স্কুল কমপ্লেক্স, বাকীটা পার্কিং এবং মাঠ। এত বড় মসজিদেও নামাজের জন্য জায়গা পাওয়া কঠিন ব্যাপার। পুরুষদের তো বটেই- মহিলাদের অংশে চাইনীজ, সোমালিয়ান, ক্যানাডিয়ান, পাকিস্তানী, সিরিয়ান, ইন্ডিয়ান, লেবানীজ, বাংলাদেশী, ঈজিপশিয়ান সর্বপ্রকার মুসলিম বোনেরা; বাচ্চাসহ, চাকরীর ফাঁকে, প্রতিবেশীকে নিয়ে, গাড়ী চালিয়ে; প্যান্টশার্ট, বোরকা, স্কার্ট, ম্যাক্সি, সালোয়ার কামিজ ইত্যাদি নানাপ্রকার পোশাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মসজিদে প্রবেশ করছেন তো করছেন। মসজিদের দরজা পর্যন্ত মানুষ বসা তবু মানুষ আসছে তো আসছে আর সবাই চাপাচাপি করে কিভাবে যেন জায়গা হয়ে যাচ্ছে! তিনটির মধ্যে এটি ছিল শেষ জামাত, তাতেই এই অবস্থা! কল্পনাও করতে পারছিলাম না বাকীগুলোতে কি অবস্থা ছিল! আমি যখন ডাউনটাউনে জুমা পড়তাম, পাঁচ ছ জামাতে নামাজ হবার পরও ভাইদের দেখতাম রাস্তা ব্লক করে নামাজ পড়তে। তখন মনে হত এই মসজিদটি ছোট বলেই হয়ত এই অবস্থা, অন্যান্য মসজিদে মনে হয় এত ভীড় হয়না। কিন্ত আকরাম জুমার মত বিশাল মসজিদেও কখনো ঈদের নামাজ, জুমার নামাজ বা সাধারণ ওয়াক্তের নামাজেও আরাম করে বসার জায়গা পাইনি। বিদেশে এলে মনে হয় মানুষ তুলনামূলক চিত্র দেখে ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। নতুবা সন্দেহ আছে কোন মুসলিম দেশেও এই পরিমাণ ভীড় হয় কি’না।



মুসল্লীদের পুরুষদের অংশ


দুপুরে বাসায় পৌঁছে দেখি বান্ধবী তাসনীন আপা অন্তত আট দশবার কল দিয়েছেন। ফোন ধরতেই বিশাল এক ঝাড়ি, “কোথায় তুমি? সকাল থেকে ফোন করছি!” বুঝিয়ে বলার পর বললেন, “শোন, তোমার মেহমানের জন্য কিছু খাবার পাঠাচ্ছি। তোমার ভাই কিছুক্ষণের মধ্যেই দিয়ে যাবে। তুমি শুধু বেড়ে দেবে"। আমি হতবাক হয়ে কিছু বলতে যাব তার আগেই আরেক ঝাড়ি, “প্রতিবেলা রান্না করা কষ্ট তাই সামান্য কিছু পাঠালাম, তোমার এত থ্যাংক ইউ বলার প্রয়োজন নেই”। বলেই দিল ফোন রেখে। আমি হা করেই বসে রইলাম। একটু পর ভাই এলে দেখা গেল বড়, মেঝ, সেজ, ছোট, ন- নানান বাটিতে করে এসেছে থাই স্যুপ, অন্থন, প্রণ ফ্রাই, ফ্রাইড রাইস, বিফ অ্যান্ড চিলি, মিটবল, চাইনীজ ভেজিটেবল, চিকেন ফ্রাই, লেবুর সরবত, গুড়ের সন্দেশ, রসবড়া, সাথে বাচ্চাদের জন্য ঝাল কম দিয়ে সব আইটেমের নির্ঝাল সংস্করণ, ওদের জন্য সাদাভাত এবং দু’জনের জন্য খেলনা! মহিলার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বলে বকাবকি করতে করতে মেহমানদের বেড়ে দিলাম সুস্বাদু খাদ্যসম্ভার। সবাই পেট পুরে খাবার পরও রয়ে গেল অর্ধেক। আমার রান্না তো আছেই! এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা খাবার নষ্ট হওয়া। ভীষণ খারাপ লাগে যে বাংলাদেশে মানুষ খেতে পায়না আর আমরা যদি খাবার ফেলে দেই! সাথে সাথে ইফতেখার ভাইদের আর তানজীনদের দাওয়াত। আমাদের এই তিন পরিবার প্রায়ই এমন হুটপাট একত্রিত হবার প্রোগ্রাম করি। বিকেলে হাফিজ সাহেবের ছাত্র পড়ানোর কথা। ইফতেখার ভাই এলেন প্রক্সি দিতে। উনি মেহমানদের ডাউনটাউন ঘুরিয়ে নিয়ে ফেরার পথে ভাবী বাচ্চা নিয়ে এলেন। একটু পরেই তানজীনরাও পৌঁছল। ক্ষুধার্ত জনগনকে তাসনীন আপার চাইনীজ আর আমার খাঁটি বাংলাদেশী সাদাভাত, ডাল চচ্চরি (হাফিজ সাহেবের স্পেশাল আইটেম), মাছ, ঢ্যাঁড়শ ভাজি দিয়ে বসিয়ে দিলাম। কেউ খাবার সময় আমার দেখতে খুব মজা লাগে। তাই আমার বসা হয়না। সে সুযোগে মিষ্টান্ন আর ফলের ব্যবস্থা করে ফেললাম। রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত তুমুল গল্প চলল। পরদিন ইফতেখার ভাই আর হাফিজ সাহেব মেহমানদের নিয়ে আরেক ছোট্ট শহর ব্যানফে যাবেন। সুতরাং দুপুরে নাজিম ভাই যে দাওয়াত দিতে চেয়েছিলেন সেটা ক্যান্সেল করতে হোল। এই সুযোগে আমার খাওয়া, নামাজ, গোছগাছ সব সারা হয়ে গেল। ইফতেখার ভাই আর তানজীনদের জন্য ছোট ছোট বক্সে কিছু খাবার দিয়ে দিলাম। হাফিজ সাহেব গেলেন মেহমানদের হোটেলে নামিয়ে দিতে।



চাইনিজ আর বাংলাদেশী মেন্যুর সম্মেলন



বন্ধুদের আনন্দেই আমার তৃপ্তি


পরদিন সকালে ঘুম ভাংলো তানজীনের বর তুহিন ভাইয়ের ফোন পেয়ে। উনি গাড়ী নিয়ে আসছেন। ইফতেখার ভাই আর হাফিজ সাহবেকে নিয়ে হোটেল থেকে সোজা ব্যানফ রওয়ানা দেবেন। এক দৌড়ে উঠে কিছু বিস্কিট, চকলেট, মিষ্টি, ফলমূল, জুস, পানি, গ্লাস, বাটি, চামচ প্যাকেট করলাম ভাইদের সাথে দিয়ে দেয়ার জন্য। বেচারা ইফতেখার ভাই নাস্তা খাওয়ার সময় পাননি। তাড়াতাড়ি কিছু খাবার ব্যাবস্থা করলাম তুহিন ভাই আসার আগেই। রাতে ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত। ভাইয়ের সাহায্য ছাড়া রান্নাবাড়া করা ভাবীর একার পক্ষে কষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমি বললাম আমি মুরগীর মাংস আর ঢ্যাঁড়শ ভাজি করে নিয়ে যাব; তানজীন বলল মাছ আর ফিরনী করে নেবে, ভাবী করবেন ছাগলের মাংসের বিরিয়ানী আর গরুর মাংসের গ্রীল- ব্যাস সবাই মিলে জমজমাট খাবার ব্যাবস্থা। এই ‘পটলাক সিস্টেম’ আমার খুব মনে হয় বাংলাদেশে চালু করা উচিত। কেননা খাবারের আয়োজন করতে করতে গৃহকর্ত্রী এত ব্যাস্ত বা ক্লান্ত হয়ে থাকেন যে মেহমানদের সাথে কথা বলার সময় বা সুযোগ কোনটাই তাঁর হয়না। কোথাও গেলে মনে হয় শুধু খাবার জন্যই গেলাম। অথচ সবাই মিলে শেয়ার করে নিলে কারোরই তেমন কষ্ট হয়না, বরং সবাই আনন্দ করার সুযোগ পান।



কলেজপড়ুয়া মনে হচ্ছেনা?



মনোরম এই নদীটি ব্যানফ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ক্যাল্গেরী এসে পৌঁছেছে



ব্যানফ নগরীর একটি বৈশিষ্ট হোল এখানে শীতকালে স্কি এবং স্কেট করতে মানুষজন ভীড় জমায়


আমরা তিন গিন্নীই বাচ্চাকাচ্চাসহ রেডী হয়ে বসে আছি সেই সন্ধ্যা সাতটা থেকে কিন্তু কর্তাদের আর ফেরার নাম নেই। রাত ন’টায় ফিরে একেকজনকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্কুলপালানো ছাত্র, সবার মুখ ১০০ ওয়াট বাল্বের মত জ্বলজ্বল করছে, শুধু সাহস করে বলতে পারছেনা, “স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়!”

ইফতেখার ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে সেদিন ওরা যে ছবি তুলেছেন তা দেখে বুঝতে পারলাম তাঁরা কি আনন্দে কাটিয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনটি! নানান ঢংয়ে, নানান রংয়ে ছবি তুলেছেন সদ্য কলেজে পড়ুয়া তরুণদের মত! তুহিন ভাইয়ের তো ছবির পর ছবি চুল ঠিক করার দৃশ্য! আমরা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছি! ইফতেখার ভাবী বললেন, “হয়েছে হয়েছে, স্বাধীনতা দিবস পালন করেছেন আপনারা! তার চেয়ে বরং টেবিলে খাবার দেই।” সবাই মিলে হাত লাগিয়ে টেবিল রেডী হয়ে গেল অল্প সময়ের মধ্যেই। খেয়েদেয়ে ফিরনী আর আইসক্রীম পর্ব। মেহমানদের সাথে শেষ কিছু গল্প। কিছুক্ষণ পর হোটেলে রওয়ানা হয়ে গেলেন মেহমানবৃন্দ। সাথে গেলেন সব কর্তারা, শেষ একটু স্বাধীনতা উপভোগের আশায়। আমরা গিন্নীরা বসে একটু গল্পগুজব করলাম এই ফাঁকে। পরদিন ভোরেই দেশের পথে রওয়ানা হয়ে যাবেন দুই মেহমান। আমরা পড়ে থাকব এখানেই। জীবন চলে যাবে আবার নৈমিত্তিকতার ধরাবাঁধা কড়া শাসনে। গল্পগুজবের খুশীর মাঝেও একটু বিষাদ রাঙ্গিয়ে দিয়ে গেল সবার মন।

No comments:

Post a Comment