আমার সদ্য ছ’বছরে পা দেয়া পুত্র রিহাম এবং ওর বন্ধুরা আজকাল ‘বিয়ে’ বিষয়টি নিয়ে খুব চিন্তিত। বিষয়টি ওদের কাছে নতুন এবং অতন্ত অস্পষ্ট ঠেকছে।
এই সেদিন পুত্র এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু, তোমার কি বিয়ে হয়েছে?’
বললাম, ‘হয়েছে তো!’
‘কবে?’
‘অনেক আগে।’
‘তুমি কাকে বিয়ে করেছ?’
‘আব্বুকে।’
‘তাই নাকি? বল কি? কখন বিয়ে করলে? হা হা হা, কি মজার ব্যাপার! আপু, আম্মু নাকি আব্বুকে বিয়ে করেছে!’
এতটুকুর ওপর ছাড়া পেয়ে বর্তে গেলাম। আমার মেয়ে রাদিয়ার তখন তিনবছর বয়স। সে বিয়েতে যেতে খুব পছন্দ করে। কার কাছে যেন আমার বিয়ের কথা শুনে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু, তোমার বিয়ে হয়েছে?’
বললাম, ‘জ্বি মা, হয়েছে’।
ও বলল, ‘আমি ওদের বলেছি, ‘তোমরা কিচ্ছু জানোনা, আমার আম্মুর বিয়ে হয়নি, বিয়ে হলে আমার আম্মু আমাকে অবশ্যই নিয়ে যেত’। তুমি আমাকে না নিয়ে কি করে বিয়ে করতে যেতে পারলে?’
ওর চোখে স্পষ্ট দেখতে পেলাম সে বিশ্বাস করতে পারছেনা আমি কিভাবে ওর সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করলাম!
আমার পুত্র প্রচন্ড নারীবিদ্বেষী। মা আর বোন ছাড়া সে মেয়েদের সহ্য করতে পারেনা। স্কুলে ওর খেলার সাথী ছোটবড় সব ক্লাসের ছেলেরা। তাদের মাঝে ক্লাস ফোর পড়ুয়া এক আরব ছেলে হারিসকে ওর খেলার সাথী হিসেবে খুব পছন্দ। বিয়ে করলে একসাথে থাকা যায় শুনে সে প্রথমে রাদিয়ার ভারতীয় বান্ধবী ধ্যানীকে অনুরোধ করল, ‘তুমি কি ওকে বিয়ে করতে পার? তাহলে তুমি আপুর সাথে খেলতে আসলে আমি হারিসের সাথে খেলতে পারব!’
সেভেনে পড়া ধ্যানী মজা পেয়ে বলল, ‘আমি তো ওর চেয়ে অনেক লম্বা, তাই ওকে বিয়ে করতে পারবনা’।
তখন সে মরিয়া হয়ে রাদিয়াকে বলল, ‘তাহলে তুমি কি হারিসকে বিয়ে করতে পার, প্লিজ?’
রাদিয়াও যখন বলল সে হারিসকে বিয়ে করতে পারবেনা তখন রিহাম মনে বড় কষ্ট পেল।
তার ক’দিন পর রিহাম আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু, আমাদের বাসায় আরেকটা বেবি আসবে কবে?’
আমি বললাম, ‘যখন তুমি বিয়ে করবে তখন’।
রাদিয়া মজা পেয়ে বলল, ‘রিহাম, তুমি কাকে বিয়ে করবে?’
রিহাম বলল, ‘আম্মু, আমি কি হারিসকে বিয়ে করতে পারি?’
আমি বললাম, ‘ছেলেরা ছেলেদের বিয়ে করতে পারেনা, তোমার কোন মেয়েকে বিয়ে করতে হবে’।
ও মাথা চুলকে বলল, ‘তাহলে আমি আপুকে বিয়ে করব’।
রাদিয়া হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, বলল, ‘মানুষ নিজের পরিবারের কাউকে বিয়ে করতে পারেনা, তোমার পরিবারের বাইরে কাউকে বিয়ে করতে হবে’।
রিহাম অনেকক্ষণ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, ‘আচ্ছা, তাহলে আমি ধ্যনীকে বিয়ে করব!’
আজ আমার আট বছর বয়সী ছাত্রী শামিলা বলল, ‘আন্টি, আমি না তোমার হাজব্যান্ডকে দেখেছি!’
হাসি চেপে পাকা বুড়িটাকে বললাম, ‘তাই?’
সে বলল, ‘আন্টি, তোমাদের কোথায় দেখা হয়েছিল?’
বললাম, ‘যখন আমি ওনাকে বিয়ে করে গেলাম তখন’।
সে হতবাক হয়ে বলল, ‘বল কি? তোমাদের তার আগে দেখা হয়নি? তাহলে তুমি তাকে খুঁজে পেলে কি করে? কি করে বুঝলে যে তাকেই তোমার বিয়ে করার কথা? আমি ভীষণ কনফিউজড! ’
ওর কনফিউশন দেখে হাসি পেয়ে গেল।
আমাদের হাসি দেখে রিহামের পাকিস্তানী বন্ধু বাসিল বলল, ‘শোন, এসব সিরিয়াস কথার মাঝখানে তোমরা হাসছ কেন? আমার আম্মু শুধু আমার আব্বুকে বলে ‘আমাকে বিয়ে কর, আমাকে বিয়ে কর’। কিন্তু আমার আব্বু বলে, ‘পরে করব’। এটা কি কোন ভাল কথা?’
বুঝলাম ওর বাবামা হয়ত ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী করার কথা আলাপ করছিল, সে ধরে নিয়েছে এটাই বিয়ের অনুষ্ঠান! শামিলা আর আমি ওর কথা শুনে কিছুতেই হাসি থামাতে পারছিনা, সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমি এত সিরিয়াস একটা কথা বললাম আর তোমরা হাসছ?’
আমরা খিলখিল হাসির ফাঁকেই বললাম, ‘আসলে আল্লাহ হাসিখুশি থাকা পছন্দ করেন তো, তাই আমরা হাসছি’।
সে তখন বিজ্ঞের মত বলল, ‘কংগ্র্যাচুলেশন্স!’
আমরা অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’
সে বলল, ‘আন্টি, তুমি না বলেছ যারা আল্লাহর কথা শোনে তারা বেহেস্তে যাবে? তোমরা দু’জন আল্লাহর কথামত হাসিখুশি আছ, তাই তোমরা বেহেস্তে যাবে, তোমাদের বেহেস্তের অভিনন্দন!’
থ হয়ে গেলাম। শিশুরা আসলেই অনেক কিছু বোঝে যদিও আপাতদৃষ্টিতে আমরা মনে করি তারা অনেক কিছুই বোঝেনা!
No comments:
Post a Comment