ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর কি কাজ করা উচিত না’কি উচিত না? এ’নিয়ে চিন্তাগবেষনার অন্ত নেই। যারা মনে করেন নারীর কাজ করা উচিত না তাদের বক্তব্য হোল এতে নারীর মাতৃত্বের দায়িত্ব বিঘ্নিত হয়। যারা মনে করেন নারীর কাজ করা উচিত তাদের বক্তব্য হোল নইলে মেয়েদের এত কষ্ট করে লেখাপড়া করার প্রয়োজন কি? উভয়েক্ষেত্রেই এমন একটি সরল দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে বিবেচনা করা হচ্ছে যা বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক। কয়েকটি বাস্তব ঘটনা পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হবে কেন বিষয়টিকে এত সরলভাবে দেখা সম্ভব নয়। ৫ নং ঘটনা ব্যাতীত প্রতিটি ক্ষেত্রে গোপনীয়তার স্বার্থে ব্যাক্তির নাম পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছেঃ-
১. অধিকাংশেক্ষেত্রে সন্তান কিছু জিজ্ঞেস করলে মায়েদের বলতে শোনা যায়, “তোমার আব্বু এলে জিজ্ঞেস করে জানাব”। লেখাপড়ার চর্চা থেকে দূরে থাকতে থাকতে তারা একসময় অনেক সাধারন জ্ঞানের বিষয়াবলীও ভুলে যান। ফলে সন্তানের স্বাভাবিক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সন্তানের সামনে লজ্জায় পড়ে যান এবং সন্তানের শ্রদ্ধা হারান। তবে এই ভুলে যাওয়ার পরিধি যে কত ব্যাপক হতে পারে তা দেখে আমি এতটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম যে আমার প্রথম সন্তানের জন্মের দ্বিতীয় দিন থেকেই তাকে একহাতে খাওয়াতাম এবং আরেক হাতে বই নিয়ে পড়তাম। আমাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার আগে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। একবার এক শ্রদ্ধেয়া ভাবী এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে এসে কাঁদতে কাঁদতে চলে যান। ভাবী বিদেশে বড় হয়েছেন, মাস্টার্স করেছেন, বিয়ে করে ছয় ছয়টি সন্তান বড় করেছেন। সবাই আমাকে দোষারোপ করতে শুরু করে, আমি হয়ত প্রশ্নপত্র অতিরিক্ত কঠিন করেছি! খাতা চেক করতে গিয়ে দেখি খাতা সম্পূর্ণ খালি, পরীক্ষার্থীর নামের বানানটিও ভুল। পরে ভাবী ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন তিনি বিয়ের পর থেকে আর কলম হাতে নেননি; প্রথমত তিনি কলম ধরতে ভুলে গিয়েছেন এবং দ্বিতীয়ত তিনি তাঁর নামের বানান পর্যন্ত লিখতে ভুলে গেছেন! উল্লেখ্য, তাঁর স্বামী একজন প্রফেসর। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে জ্ঞানার্জন দূরে থাক, জ্ঞানের চর্চার জন্য পর্যন্ত কোনপ্রকার সহযোগিতা করেননি। ছয়টি সন্তান এবং সংসারের পরিপূর্ণ দায়িত্ব স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে তিনি নিজের জ্ঞানচর্চার জন্য সময় করে নিয়েছেন। দু’জনের জ্ঞানের পার্থক্য যত বেড়েছে, তাঁর স্ত্রীর প্রতি সম্মান তত কমেছে। একসময় তিনি স্ত্রীর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছেন এবং একপর্যায়ে তিনি শুধু ঘুমানো ছাড়া বাসায় সময় দেয়াই বন্ধ করে দেন।
২. রাহির বিয়ে হয় এক বিরাট যৌথ পরিবারে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী, পরিবারের বড় ছেলে। ঘরে বাবামা, বিবাহযোগ্যা বোন, বিভিন্ন স্তরে লেখাপড়া করা অনেকগুলো ভাইবোন এবং এই পরিবারের ওপর নির্ভরশীল ব্যাক্তিবর্গ। রাহির সামনে দু’টি পথ- স্বামীকে আরো বেশী উপার্জন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা অথবা সবার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটানো। রাহি তৃতীয় একটি পথ বেছে নিলো। সে একটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কাজ নিলো। ফলে স্বামী তার সম্পূর্ণ উপার্জন পরিবারের জন্য ব্যায় করতে সক্ষম হলেন এবং রাহির টাকায় নিজেদের চলে যা উদ্বৃত্ত থাকে তাও পরিবারের পেছনে খরচ করা সম্ভব হোল। স্বামীর সমস্যা বুঝে চলা এবং অহেতুক চাপ সৃষ্টি না করার কারণে দু’জনের বন্ধুত্ব মজবুত হোল এবং সংসারের দায়িত্ব দু’জনে ভাগ করে নেয়ায় কেউ অতিরিক্ত চাপ বা বিরক্তির সম্মুখীন হোলনা।
৩. দু’টি বাচ্চা শামার হাতে দিয়ে ওর স্বামী ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হলেন। শোকে কাতর শামা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর শ্বশুরবাড়ীর আত্মীয়স্বজন স্বামীর সমস্ত সম্পদ হস্তগত করে তাকে কেবল দয়া করে একটি রুম দিল থাকার জন্য। গ্রামের পুকুরপাড় থেকে কচুঘেচু তুলে পেট তো চলছিল কোনক্রমে কিন্তু বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবার সংস্থান নেই, বইখাতা কাপড় কিনে দেবার পয়সা নেই, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মত কোন আত্মীয়স্বজন নেই, চাকরী ছেড়ে দিয়েছে বহুদিন তাই চাকরীর জন্য যোগাযোগ করবে এমন পরিচিত কেউ নেই। বাড়ীর কাছের এক ভদ্রলোকের দয়া হোল। তিনি শিক্ষিতা মেয়েটিকে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। আজ শামা বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, ছোট মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াচ্ছে এবং শ্বশুরবাড়ীর লোকজনকেও সাহায্য সহযোগিতা করছে সেই চাকরীর বদৌলতে।
৪. কামিনীর বিয়ের পর ওর স্বামী ওর গহনাপাতি নিয়ে নেয় ওর নামে বাড়ী করার জন্য। স্বামীর পরিবারে অর্থ জোগান দেয়ার জন্য ওকে চাকরীতে ঢুকতে হয়। নতুন পরিবারে সবার জন্য কিছু করার এই সুযোগ পেয়ে খুব খুশী কামিনী। পরে সন্তানাদি হয়ে গেলে কামিনী চাকরী ছেড়ে দেয়, স্বামীও ততদিনে ভালো চাকরী পেয়েছে। একসময় সে জানতে পারে বাড়ী করা হয়েছে স্বামীর নামে। আস্তে আস্তে দেখা যায় স্বামী সব সিদ্ধান্তই ওর ওপর চাপিয়ে দিতে শুরু করেন, আলোচনার কোন সুযোগ নেই। স্বামীর কাছে মূল্য নেই বলে সন্তানদের কাছেও সে মূল্যহীন। এখন কামিনীর মা অসুস্থ, সে মায়ের চিকিৎসার জন্য স্বামীর কাছে কিছু টাকা চায়। স্বামী সাফ বলে দেন শ্বাশুড়ী বিনা চিকিৎসায় মরে গেলেও তিনি তার জন্য কোন টাকা দিতে পারবেন না, তাঁর কষ্টের টাকা তিনি কি পানিতে ফেলবেন? কান্না ছাড়া কামিনীর অসুস্থ মাকে দেয়ার আর কিছুই নেই। উল্লেখ্য, কামিনীর স্বামী একজন ইঞ্জিনিয়ার।
৫. একসময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে গৃহিনীরা হাঁসমুরগী, গরুছাগল, পায়রা পালতেন- এতে ডিমদুধের চিন্তা থাকতনা, উপরন্তু প্রয়োজনমত মাংসের জোগানও হত। একটু খোলা জায়গা পেলেই লাগানো হত শাকসব্জী, ফলমূল; অন্তত ফুলপাতালতা। আমি ঢাকার ধানমন্ডির মত অভিজাত এলাকাতেও এই প্রচলন দেখেছি ছোটবেলায়। মহিলারা পাটি বুনতেন, মোড়া বানাতেন, সেলাইফোঁড়াই করতেন সব বাসায় বসে বাচ্চাদের পড়াতে পড়াতে। আজকাল ঐ সময়টুকু গিন্নীরা আরাম করেন সিরিয়াল দেখে দেখে এবং ব্লাডপ্রেশার আর ডায়াবেটিসের বড়ি গিলে গিলে। মিসেস আনিস আন্টি ছিলেন ব্যাতিক্রম। তিনি এই সময় ব্যায় করতেন পোশাক ডিজাইন করে, বুটিক চালাতেন, অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশ চাষ করতেন, এক্সটিক পাখী চাষ করতেন- গরীব দুঃস্থদের জন্য কয়েকটি স্কুল চলত এই পয়সায়। এই বিশাল ব্যাবসা চালানোর জন্য তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন অনেক মানুষজন, অনেক ভাগ্যাহত নারীর অন্নসংস্থান হত তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করে, আমার পরিচিত লোকজনকে তিনি কাজ দিয়েছেন তাদের বিপদের সময়। সন্তানদের দেখাশোনার সুবিধার জন্যই তিনি বাইরে কাজ না করে বাসায় কিছু করেছেন। তাঁর নিজের মত করে সমাজের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন।
৬. লাকীর স্বামী ওকে বাংলাদেশে রেখে অ্যামেরিকায় গেলেন স্বপ্নের সন্ধানে। তিনটি সন্তানের দেখাশোনা নিয়েই ব্যাস্ত লাকী স্বপ্ন বোনে আজই হয়ত স্বামী তাকে নিজের কাছে ডেকে পাঠাবেন। তিনবছর পেরিয়ে যায়। স্বামী ব্যাস্ততার মাঝে ফোন করারও সময় পাননা, লাকী ফোন করলে তড়িঘড়ি রেখে দেন। স্বামী আগের মত নিয়মিত টাকা পাঠান না, যে টাকাপয়সা বিপদআপদের জন্য দিয়ে গেছিলেন তাও প্রায় শেষ। বিরহে চিন্তায় পাগলের মত হয়ে যায় সে। স্বামী অসুস্থ নয়ত? তার কোন বিপদ হয়নি তো? চতুর্থ বছরে এক অ্যামেরিকাপ্রবাসী ভাই ছুটিতে এসেছে খবর পেয়ে তাঁর কাছে ছুটে যায় স্বামীর খবর জানার জন্য। ভদ্রলোক প্রথমে কিছুতেই বলবেন না, পরে বললেন, “স্বামীকে এত বিশ্বাস করা ঠিক নয়”। “স্বামীকে বিশ্বাস করবনা তো কি আপনাকে বিশ্বাস করব?” রেগে গিয়ে বাসায় চলে যায় লাকী। পরে মাথা ঠান্ডা হলে আরেক বিদেশফেরত ভাইকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে বিয়ে করে দেদারসে সংসার করছেন স্বামী গত তিনবছর ধরে! লেখাপড়া করেনি বেশি, বাবামা বেঁচে নেই, কোন ভাই নেই। কি করবে, কোথায় যাবে লাকী?
৭. মিমি তার দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্য কোনদিন চাকরী করেনি, বন্ধুবান্ধবের সাথে যোগাযোগ রাখেনি, পৃথিবীর সব কিছু ভুলে স্বামী সংসার আর সন্তান নিয়েই সে মেতে ছিল। প্রজাপতির রঙ্গিন পাখায় ভর করে কবে যে কেটে গেল এতগুলো বছর, সে টেরই পায়নি। বছর দুই হোল ছেলে দু’টোরই বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেবৌরা ওর সাথেই থাকে। কিন্তু ছেলেরা এখন আর কাজ থেকে ফিরে সারাক্ষণ ওর গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকেনা, কিছু সময় মায়ের সাথে কাটিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বৌদের সাথে সংসারের হিসেবনিকেশ করে, বাবামা’র খবর নেয়। স্বামী থাকেন পড়াশোনা আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা নিয়ে, রিটায়ার করে আর কিইবা করার আছে সময় কাটানোর জন্য? মিমির কেমন যেন একা একা লাগে। বৌগুলো খুব লক্ষ্মী। ঘরের কোনকিছুতে হাত দিতে হয়না ওকে, দু’জনে মিলে গল্প করতে করতে টুকটুক করে সব করে ফেলে দুই বৌ। তবুও ওরা ওর কাছ থেকে ওর ছেলেদের কেড়ে নিয়েছে ভেবে ওর ওদেরকে সহ্য হয়না। মিমি পড়াশোনা ভুলে গেছে সেই ত্রিশ বছর আগে, বন্ধুদেরও ছেড়ে দিয়েছে তখনই। কি করে কাটবে ওর অফুরন্ত সময়?
৮. মনোয়ারা বেগমের বয়স হয়েছে ৫৫। শরীরে এমন এক অসুখ বাসা বেঁধেছে যার চিকিৎসা আর ঘরোয়া পদ্ধতিতে সম্ভব হচ্ছেনা। শহরে নিয়ে যাবার সামর্থ্য নেই তার দিনমজুর ছেলের। সে মাকে সাধ্যসাধনা করে গ্রামের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তারসাহেব তাকে পরীক্ষা করার জন্য বোরকা খুলতে বললে তিনি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে বাড়ী ফিরে এলেন। একবছর ভুগে, পরে শয্যাশায়ী হয় বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন মনোয়ারা বেগম। এই মৃত্যুটি কিন্তু সহজেই এড়ানো যেত বা অন্তত কিছু চিকিৎসা তিনি পেতে পারতেন যদি গ্রামে একজন নারী ডাক্তার থাকতেন।
৯. লামিয়া মাত্র বয়োঃপ্রাপ্র হয়েছে। ওর জন্য কিছু ব্যক্তিগত সামগ্রী কেনার জন্য ওর মা বাজারে গিয়ে ঘুরে ঘুরে হয়রান। সব দোকানে পুরুষ সেলসম্যান। কয়েকবার সাহস করে কাছাকাছি গেলেও লজ্জায় বলতে পারলেন না তাঁর কি প্রয়োজন। কেন যে মেয়েদের জন্য মহিলা সেলসম্যান দিয়ে দোকান করা হয়না! বিদেশে কি সুন্দর একেকটি পরিবারের সকল সদস্য মিলে দোকান চালায়। বাবা দোকানে বসলে মা গিয়ে রান্না সেরে আসেন, বড় ছেলে স্কুল থেকে ফিরে দোকানে বসলে বাবা শুতে যান, বাচ্চারা কাউন্টারে বসে হোমওয়ার্ক করে। আর একটি মুসলিম দেশে মহিলাদের পুরুষ সেলসম্যানের কাছে নারীদের জিনিস চাইতে গিয়ে বিব্রত হতে হয়!
১০. আমার ছোটবেলায় পাশের বাসায় এক দাদু থাকতেন। ওনার ফ্রিজে সবসময় আমার জন্য ফিরনী করা থাকত। বাসায় হরেক রকম বয়মে থাকত তেঁতুল, গুড়, মুড়ি, নারকেলের বরফি আরো নানারকম লোভনীয় খাবার। উনি আমাকে খাওয়াতেন আর ফাঁকে ফাঁকে নানারকম সুরা, দুয়া, নামাজ শেখাতেন। খাবার লোভে গিয়ে কতকিছু শিখে আসতাম তার ইয়ত্তা নেই। যেবার আমি প্রথম রোজা রাখি দাদু প্রায় পনেরো বিশরকম আইটেম করে ইফতার খাইয়েছিলেন। এত আদর করতেন বলে তাঁকে আমি মিষ্টিদাদু ডাকতাম। তবে উনি যে আমার কি উপকার করেছেন তা আমি বুঝতে পারি বড় হয়ে। তিনি শুধু আমাকেই নয়, পাড়ার অনেক শিশু এবং তাঁর বাসায় কাজের লোকদের নামাজদুয়া শেখাতেন। এভাবে নিজের পয়সা এবং সময় নষ্ট করে অন্যের সন্তানকে মানুষ করার মত সোনার মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সমাজ থেকে।
ওপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা একপ্রকার নিশ্চিত হতে পারি যে মানুষের জীবনকে কোন নির্ধারিত ফর্মুলায় ফেলা যায়না। সুতরাং, সবার জন্য একই সমাধান কার্যকর হতে পারেনা। তবে ইসলামে কয়েকটি ফর্মুলা নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য অবশ্যপালনীয় করে দেয়া হয়েছেঃ
১. আল্লাহ মানবজাতির জন্য রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে প্রথম যে নির্দেশ প্রেরণ করেছেন তা হলো “পড়”। এর সাথে এ’রকম বাক্যাংশ সংযোজিত হয়নি “এই নির্দেশ কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য, নারী এই নির্দেশের আওতাবহির্ভূত” অথবা “পড় এবং অতঃপর ভুলে যাও”। কেবলমাত্র এ’কারণেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে একজন ব্যাক্তির আজীবন সাধনা হতে হবে জ্ঞান অর্জন করা এবং চর্চার মাধ্যমে তাকে সতেজ রাখা। জ্ঞানার্জনকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করার পেছনে কোন অর্থনৈতিক বা পার্থিব স্বার্থকে উহ্য করা হয়নি। নারী পুরুষ উভয়কেই জ্ঞানার্জন করতে হবে নিজের স্বার্থে এবং সমাজের স্বার্থে- কেননা একজন আলোকিত মানুষ সমাজকে উপহার দেবে প্রথমত একজন আলোকিত নাগরিক যে হবে সমাজের জন্য কল্যাণকর, এবং দ্বিতীয়ত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তারা হবেন একটি আলোকবর্তিকা যা তাদের পথ দেখাতে সহায়তা করবে। জ্ঞানার্জনের জন্য এর চেয়ে বেশী আর কোন কারণ বা প্রেষণার প্রয়োজন নেই। এর বাইরে যা পাওয়া যায় সব বোনাস।
২. জ্ঞানপ্রাপ্ত হবার সাথে সাথে জ্ঞানী ব্যাক্তির দায়িত্ব হয়ে পড়ে এই জ্ঞান চতুষ্পার্শে ছড়িয়ে দেয়া যার জন্য বলা হয়েছে যে ব্যাক্তি একঘন্টা জ্ঞানসংগ্রহ করে এবং অতঃপর একঘন্টা জ্ঞানবিতরণ করে তার ঘুম মূর্খ ব্যাক্তির রাতব্যাপী নামাজের সমান। এই দায়িত্বের ক্ষেত্রেও পুরুষ এবং নারীর বিভাজন করা হয়নি। অতঃপর পুরুষের ওপর তার জ্ঞান ব্যাবহার করে অন্নসংস্থান করার দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে, নারীর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অধিকার এবং পেশা গ্রহন করার ব্যাপারে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কিন্তু তার অর্জিত অর্থ কারো জন্য ব্যায় করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। কিন্তু তাই বলে এ’কথাও কোথাও বলা হয়নি যে নারী কোন কাজ করতে পারবেনা বরং এক মহিলা সাহাবী যখন রাসুল(সাঃ)কে জানান যে তাঁর স্বামী পঙ্গু এবং তিনি কাজ করে স্বামীসন্তানের ব্যয়নির্বাহ করেন তখন রাসুল(সাঃ) তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে এর জন্য তিনি আল্লাহর কাছে উত্তম পুরস্কারের হকদার হবেন। রাসুল (সাঃ)এর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) ব্যাবসায়ী ছিলেন, আয়শা (রাঃ) কুর’আন এবং হাদীসের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষিকা ছিলেন, আয়শা (রাঃ)র বোন আসমা (রাঃ) স্বামীর ক্ষেতখামার দেখাশোনা করতেন, রাসুল(সাঃ)এর আরেক স্ত্রী হাতের কাজ করে বিক্রি করতেন অতঃপর সম্পূর্ণ উপার্জন সদকা করে দিতেন, খাওলা (রাঃ) ছিলেন কবি, যুদ্ধেক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না। রাসূল(সাঃ) এঁদের কি পরিমাণ সম্মান করতেন তা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন, আসমা (রাঃ) কেমন মা ছিলেন এবং তিনি কেমন সন্তান গড়ে তুলেছিলেন তার জন্যও ইতিহাসের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। উল্লেখ্য এই কাজগুলোর পেছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য মূখ্য ছিলোনা বরং সমাজের জন্য কিছু করার, পরিবারের সহযোগিতার, সৃষ্টিশীলতার উদ্দেশ্যই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৩. কাজ করা বলতে শুধু চাকরী করা বোঝায় এবং জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য কেবল একে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করা এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী। একজন ব্যাক্তির বেড়ে ওঠা এবং একজন ব্যাক্তিমানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পেছনে অসংখ্য মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদান থাকে। নিজের স্বার্থ লাভ হয়ে যাবার সাথে সাথে শুধুমাত্র একজন সঙ্গী এবং নিজের ক’টি সন্তান ছাড়া পৃথিবীর আর সবার অধিকার ভুলে যাওয়াটা ইসলাম কেন মানবতার সংজ্ঞায়ও সঠিক হতে পারে, এটা মেনে নেয়া কষ্টকর। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে নয়, নৈতিক কারণেই নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার কিছু করা উচিত তার নির্ধারিত কাজের বাইরে। তবে অর্থনৈতিক বিষয়টিও একেবারে ফেলনা নয়। ইসলামে নারীকে ধনসম্পদে যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা কেবল ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্যই নয় বরং দায়িত্বশীলতা শিক্ষা দেয়ার জন্যও বটে। পাশাপাশি টাকাপয়সা ছাড়া অনেক মূল ইবাদাত করা সম্ভব নয় যেমন সদকা, যাকাত এবং হাজ্জ্ব। তাছাড়া সামাজিক ক্ষেত্রে মেলামেশার কারণে মানুষের সামাজিক প্রতিভা, মনের বিস্তৃতি এবং পরিচিতের পরিধি বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে নারীর সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোতে মেধাবী এবং দায়িত্বশীলা নারীদের এগিয়ে আসা উচিত। মনে রাখা উচিত, বাবামায়ের প্রতি দায়িত্বও আল্লাহ কেবল পুরুষের জন্য নির্ধারণ করে দেননি এবং এই ব্যাক্তিগত দায়িত্বগুলোর জন্য নারীর স্বামী তাকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিতে বাধ্য নন।
সুতরাং, এই ব্যাপারে আমরা একমত হতে পারি যে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার একটি মূখ্য ক্যারিয়ার থাকতে হবে- জ্ঞানার্জন এবং জ্ঞান বিতরণের ক্যারিয়ার। দ্বিতীয়ত, জীবনধারণের জন্য কাজ করতে হবে বটে তবে ক্যারিয়ার যেন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করে বরং ক্যারিয়ার যেন ব্যাক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কেননা, নারী বলুন আর পুরুষ বলুন, কোন মানুষই টাকা কামানোর বা ঘর সংসার সামলানোর মেশিনে রূপান্তরিত হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয়। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে বিশ্রামের, আনন্দের, নিজের জন্য সময় ব্যয় করার। তৃতীয়ত, প্রত্যকেটি মানুষের চিন্তা করতে হবে আমাকে আল্লাহ কোন নিয়ামতটি দিয়েছেন যা দিয়ে আমি মানুষের সেবা করতে পারি?
এবার ক্যারিয়ারের বিষয়টিকে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করি। নারীর কাছে পারিবারিক জীবনে সফল হওয়া পূর্ণতার অনুভূতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। এর একটি বিরাট অংশ মাতৃত্ব। তবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে মাতৃত্ব একটি সাময়িক দায়িত্ব এবং সন্তান বড় হয়ে গেলে মায়ের দায়িত্ব কমে যায় এবং সে বাইরে সময় দিতে পারে। মাতৃত্বের দায়িত্ব একটি আজীবন দায়িত্ব যার শেষ কেবল কবরে গিয়ে। এর একেক পর্যায়ে একেকভাবে সময়, শ্রম এবং মেধা ব্যায় করার প্রয়োজন হয়, কিন্তু এই দায়িত্ব আমৃত্যু শেষ হয়না। সুতরাং, এর জন্য আর সব দায়িত্ব ঠেকিয়ে রাখা বা একে ব্যক্তির ব্যাক্তিগত বিকাশে প্রতিবন্ধকতা মনে করা সঠিক হতে পারেনা। ইসলামে পরিবারের ওপর এতটা গুরুত্ব দেয়ার মূল কারণই এটা যেন পুরুষ ও নারী সন্তান এবং সংসারের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে পারে, নারী যেন বিবাহিত থেকেও single mother য়ে রূপান্তরিত না হয়। দ্বিতীয়ত, সময়ের সুষ্ঠু ব্যাবহার এবং কো-অর্ডিনেশনের মাধ্যমে মানুষ অল্প সময়ে অনেক কাজ করতে পারে। আর যদি অতিরিক্ত পরিশ্রমের কথা বলা হয় তাহলে Robert Browning এর মত আমাকেও বলতে হয়ঃ
‘Ah, but a man’s reach should exceed his grasp
Or what’s a heaven for?’ (Andrea de Sarto)
জীবনটা পরীক্ষা ক্ষেত্র এবং এই পরীক্ষার সময় নির্ধারিত, তবে সনাতন পরীক্ষার মত এক্ষেত্রে আমরা জানিনা এই নির্ধারিত সময় কার জন্য কতটুকু। সেক্ষেত্রে কোন কাজটি যুক্তিযুক্ত? দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা নাকি বি সি এসের মত যে ক’টি সম্ভব প্রশ্ন একটির পর একটি উত্তর দিতে থাকা? কোন পদ্ধতিতে পাশের সম্ভাবনা বাড়ে?
সুতরাং, সন্তান লালন পালনের জন্য গৃহিনী হলেই ভালো মা হতে পারবেন আর কাজ করলে ভালো মা হওয়া যাবেনা এটা কোন যুক্তি হতে পারেনা। একজন গৃহিনী কি সারাক্ষণ সন্তান নিয়ে বসে থাকেন? প্রথমত, যদি থাকেন তাহলে এটা সুস্থতার লক্ষণ নয়। একটি শিশুর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য কিছু পরিমাণ স্বাধীনতার প্রয়োজন যখন সে দুষ্টুমী করবে, গায়ে কাদা মাখাবে, গাছে চড়বে এবং মা দেখবেন না। দ্বিতীয়ত, একজন মানুষের নিজের এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বসবাসকারী মানুষজনের প্রতি কিছু দায়িত্ব আছে। পরিপার্শ্ব হতে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ একসময় তার আশেপাশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অসচেতন হয়ে পড়েন এবং তখনই সমাজ বঞ্চিত হয়। কিভাবে তা একটু পরেই আলোচনা করছি।
একসময় মানুষের পনেরো বিশটা করে বাচ্চা হত। তাঁদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা মনেই করতে পারতেন না কি করে বড় হোল এতগুলো ছেলেপুলে। এর একটা কারণ হোল তখন মানুষ অনেক নিঃস্বার্থ ছিল। কার বাচ্চা কে খাওয়ায়, কে গোসল করায়, কে শাসন করে এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে তখন কেউ তেমন মাথা ঘামাত না। মায়েরা সন্তানদের যে সময় দিতেন তা quantity নয় quality দিক থেকে সর্বোচ্চ মানের ছিল। যেটুকু সময় তারা সন্তানদের কাছে পেতেন সে সময়টুকু তারা সন্তানদের নীতিনৈতিকতা এবং পড়াশোনা শিক্ষা দেয়ার জন্য কাজে লাগাতেন। পরম ঔদার্য্যে লালিত পালিত এইসব মানুষগুলো প্রত্যকেই সোনার মানুষ হতেন যারা দেশ এবং দশের জন্য করতেন, যাদের কথা আমরা আজও গল্পেপ্রবন্ধে পড়ে উজ্জীবিত হই।
এখন একজন মা তার সন্তানের জুতোর ফিতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান, ফলে ন্যূনতম স্বাধীনতাবঞ্চিত একটি শিশু ছোটবেলা থেকেই কষ্ট আর লাঞ্ছনা নিয়ে বেড়ে ওঠে। অধিকাংশ শিশু বাবাকে মনে করে একজন আগন্তুক যাকে মাঝেমাঝে দেখা যায় এবং যার কাছ থেকে টাকা পাওয়া যায়। তাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয় টেলিভিশন যাকে ছাড়া তারা খেতে পারেনা, ভাবতে পারেনা, চিন্তাশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারেনা। এই মায়ের নিজের শিশুটি ছাড়া আর কারো জন্য কিছু ভাবার বা করার নেই। তাই তিনি তাকে বাংলা সিনেমার নায়কের মত নাচেগানে সুপারদর্শী, তর্কালংকার, মহানহৃদয়, মারদাঙ্গা, ব্ল্যাকবেল্টধারী ডাক্তার বানাতে চান। ফলে আমাদের সমাজ আজ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, ব্যাঙ্কার, বিজনেসম্যানের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু এর মাঝে ‘মানুষ’ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অন্যদিকে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সন্তানদের জন্য যতটুকু করতে পারতাম, যা দেখে আমার সন্তান উদার হতে শিখত, তা না করে জন্ম দিচ্ছি ঈভটিজার, গুন্ডা এবং চোরডাকাতশ্রেণীকে। একদিকে আমার ছেলের জন্য ভিডিও গেম কেনা হচ্ছে হাজার হাজার টাকা খরচ করে, অন্যদিকে প্রতিবেশী বস্তির মেয়েটি না খেতে পেয়ে আত্মহত্যা করছে।
সুতরাং, মায়েদের আগে মানুষ হবার চিন্তা করা উচিত যারা শুধু নিজের সন্তানের জন্য নয়, সবার জন্য করার মানসিকতা রাখবেন। বাবাদের চিন্তা করা উচিত স্ত্রী কেবল সংসার সামলানোর মেশিন নন এবং সন্তানগুলো তিনি একা জন্ম দেননি। সুতরাং বাবাও মাঝে মাঝে রান্না করবেন, ঘরের কাজে হাত লাগাবেন, সন্তানদের নিয়ে খেলবেন, স্ত্রীর সাথে গল্প করবেন, বাচ্চাদের বাইরে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে পড়াশোনা করার সময় দেবেন। এই সন্তান বাবামা’র বন্ধুত্ব দেখে আত্মবিশ্বাস এবং নিরাপত্তার অনুভূতি নিয়ে বড় হবে এবং বাবামায়ের পারস্পরিক সম্মানবোধ তাকে উভয়কে যথাযথভাবে শ্রদ্ধা করতে শেখাবে। উভয়ে কাজ করবেন সন্তানের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য, একটি সুন্দর সমাজ তাকে উপহার দেবার জন্য- যেখানে টাকাপয়সা ও ধনসম্পদ গৌণ এবং জ্ঞান, দায়িত্বশীলতা এবং সৌহার্দ্য মূখ্য।
পরিশেষে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ দিয়ে ইতি টানছি। আমি বিয়ের আগে একটা স্কুলে চাকরী করতাম, বিয়ের পর মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হলে ইউনিভার্সিটিতে চাকরী পাই। আমার প্রথম সন্তান হলে আমি চিন্তা করি চাকরীতে একবছর গ্যাপ দেব, বাচ্চা বড় হলে আবার কাজে ফিরে যাব। হাফিজ সাহেব আমাকে বলেন, “তুমি যদি চাকরী ছেড়েও দাও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ভেবে দেখ, কর্মেক্ষেত্র তোমার উপস্থিতিই কিন্তু একটা আদর্শের প্রতীক। তোমার শূণ্যস্থান হয়ত খালি থাকবেনা। ঐ জায়গায় আরেকজন আসবে। তবে সেই ব্যাক্তি হয়ত একে নিছক পেশা হিসেবেই নেবে।তুমি যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে পড়াও, অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মত মানুষ করতে চাও, সেটা হয়ত সে অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা মনে করবে। তার চেয়ে বরং আমরা এটা করতে পারি- তুমি কাজের পরিমাণ কমিয়ে নাও, কাজের জায়গায় আমরা একটা রুমের ব্যাবস্থা করি, বাচ্চা আমাদের সাথে প্রতিদিন যাবে, একটা উদার এবং শিক্ষিত পরিবেশে সমাজের নামীদামী মানুষের সাহচর্যে বড় হবে। তোমার ক্লাস থাকলে আমি বাচ্চাকে দেখব, বাকী সময় তুমি ওর সাথে কাটাতে পারবে”।
বাচ্চা হাঁটতে শিখলে পরে এই কেন্দ্রিক একজন মহিলার কর্মসংস্থান হয় যে আমি ক্লাসে থাকাকালীন বাচ্চার সাথে থেকে ওকে পাহাড়া দেবে, ওর খাবার আর গোসলের পানি গরম করে দেবে, ওর কাঁথাকাপড় ধুয়ে দেবে। বাচ্চা বড় হয়ে গেলে আমি আবার আমার স্বাভাবিক ক্লাসলোড নিতে শুরু করি। এভাবেই বড় হয়েছে আমার দু’টি সন্তান। ঘরের সমস্ত কাজ হাফিজ সাহেব আর আমি ভাগ করে করি যাতে কেউ অতিরিক্ত কান্তি বা চাপ অনুভব না করি। উল্লেখ্য, আমি সবসময় যৌথ পরিবারে ছিলাম। কিন্তু আমার সন্তান আমার দায়িত্ব, তাকে আমি কোনদিন কারো ওপর বোঝার মত চাপিয়ে দেয়া সমীচিন মনে করিনি। দু’জনে মিলে বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়ায় আমাদের বাচ্চাদের কখনো কোন অসুবিধা হয়নি কেননা বাচ্চার দায়িত্ব, বাচ্চার অসুখ সব দু’জনে মিলেই সামাল দেয়া গেছে। আমাদের কারো কর্মেক্ষেত্রেও কোন প্রমোশন দেরী হয়নি, কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। প্রয়োজন ছিল শুধু দু’জনের কো-অর্ডিনেশন। একপর্যায়ে আমি প্রফেসর হবার পাশাপাশি ক্যাম্পাসের কোঅর্ডিনেটর ছিলাম, দায়িত্ব ছিল অনেক বেশী- কিন্তু স্বামী, সন্তান, তাঁর পরিবার এবং আমার পরিবারের সবার প্রতি দায়িত্ব জোগান দিয়েও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে কোন অসুবিধা হয়নি। আমাকে যারা চেনেন তারাই বলবেন আমার দু’টি বাচ্চা মানুষ হয়েছে কি হয়নি। তবে আমি আজ আনন্দিতচিত্তে বলতে পারি আমার হাজার হাজার সন্তান মানুষ হয়েছে!
এবার আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন নারীর কাজ করা উচিত কি উচিত নয়।
No comments:
Post a Comment