Sunday, December 9, 2012

নতুন দৃষ্টিতে দেখা

দু’দিন আগে আমার বাচ্চাদের শিক্ষক-অভিভাবক সাক্ষাতে গিয়ে কয়েকটা মজার জিনিস আবিস্কার করলাম। আমার দুই সন্তান বয়সের পার্থক্য সাড়ে ছয় বছর। ওদের দু’জনের মুলত কোনপ্রকার মিল নেই। ওরা দু’জন দেখতে দু’রকম, ওদের স্বভাব আলাদা, ওদের পছন্দ অপছন্দও ভিন্ন। এতদসত্ত্বেও, আলহামদুলিল্লাহ, দু’জনে মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। দুই ভাইবোন টুকটুক করে স্কুলে যায়, আসে, খায়, খেলে, গল্প করে, টুকটাক ফাটাফাটি করলেও আমার হস্তক্ষেপ কামনা করেনা। কিন্তু তাদের বাসার আর বাইরের চরিত্রে যে এতটা তফাত সেটা জেনে চমতকৃত হলাম।

আমার মেয়ে দেখতে হুবহু ওর বাবার মত- স্বভাবচরিত্র, স্বাস্থ্য, কথাবার্তা কোথাও এর ব্যাত্যয় ঘটেনি। আমার কন্যা ছোটবেলায় এত কথা বলত যে ওর এই অতিরিক্ত কথা বলা নিয়ে অনেক পারিবারিক গল্প প্রচলিত আছে। যেমন আমাদের বাসায় ভিখারী এলে ওর হাত দিয়ে পয়সা দেয়ানো হত। একবার এক ভিখারি এসেছে। সে ভিখারীকে রীতিমত জেরা করা শুরু করল, “আপনার নাম কি? আপনার বাড়ী কোথায়? আপনার বাসায় কে কে আছে? আপনি ভিক্ষা করেন কেন? আপনি কত টাকা পেলে খুশি হবেন?...” চার বছরের শিশুর জেরার মুখে ভিখারী বেচারা অস্থির হয়ে বলল, “মাগো, ভিক্ষা লাগবেনা, তুমি দয়া করে আমাকে প্রশ্ন থেকে রেহাই দাও, তাহলে আমি অন্য কোথাও ভিক্ষা করতে যেতে পারি!” সেই মেয়ে আমার বড় হতে হতে চুপচাপ হয়ে যেতে লাগল। ওর দায়িত্বশীলতায় মুগ্ধ সবাই। যেকোন কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য রাদিয়ার ডাক পড়ে। ছোট ভাইটিকে যেভাবে আদর দিয়ে, শাসন দিয়ে সে সামলে রাখে তাতে সবাই বলে, “আহা! আমার যদি রাদিয়ার মত একটা মেয়ে থাকত!” পাশের বাসার ভাবী ওকে দেখে মেয়ের শখ করে সম্প্রতি আবার ছেলের মা হয়েছেন!

ওর শিক্ষকের সাথে সাক্ষাত করতে গেলে তিনি জানালেন রাদিয়া ওর বয়সের তুলনায় অনেক কিছুই অভাবনীয়ভাবে ভাল পারে, ওর কাজের মান সহপাঠীদের তুলনায় অনেক উচ্চমানের, ওর সদাচরন প্রশ্নাতীত কিন্তু সে সবাইকে সাহায্য সহযোগিতা করতে গিয়ে নিজের কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করতে পারেনা, কোনক্রমে কিছু করে জমা দিয়ে দেয়, স্কুলের বাচ্চাকাচ্চা থেকে শিক্ষক পর্যন্ত সবার সে পরামর্শদাত্রী- আমি যেন ওকে নিজের স্বার্থের ব্যাপারে সচেতন হবার জন্য তাগাদা দেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালাম ওর এই স্বভাব সংশোধনযোগ্য নহে। সে মূলত একজন সৃষ্টিশীল ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন ক্ষুদ্র মানুষ যার দায়িত্বজ্ঞান কেবল বাসায়ই সীমাবদ্ধ এবং বাইরে সে পরোপকারে এত নিবেদিতপ্রাণ যে ওর নিজের কথা ভাবার সময় নেই। আমি জানি তার পরীক্ষার ফলাফল কোনদিন অভাবনীয় হবেনা কিন্তু মানুষ হিসেবে কখনো ওর বন্ধুর অভাব হবেনা। শিক্ষক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন কি করে?!” জানালাম আমার অতি পরিচিত একজন ব্যাক্তি চল্লিশ বছরেও এই স্বভাব থেকে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। সুতরাং সে এর ব্যাতিক্রম হবে আশা করিনা। ওর হতভম্ব শিক্ষককে রেখে পুত্রের ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালাম।

রিহামের ক্লাসরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবছি ওর শিক্ষক কি বলবেন। শিক্ষক আমার চেহারা দেখেই বুঝতে পারলেন আমি রিহামের মা। আমি প্রবেশ করতেই শিক্ষক বার বার বলতে লাগলেন রিহামকে পেয়ে তিনি খুব সন্তুষ্ট। সে খুব দায়িত্বশীল এবং ওর ব্যাপারে তাঁকে কোনপ্রকার চিন্তা করতে হয়না। তিনি আমাকে রিহামের খাতা দেখালেন, আমার পাঁচ বছর বয়সী পুত্র এঁকেছে ওর স্কুলে যাবার চিত্র। সেখানে রাস্তা, রাস্তার ট্রাফিক লাইট, গাছপালা আর মধ্যখান দিয়ে মাথায় ক্যাপ আর স্কুলব্যাগসমেত সে হেঁটে যাবার দৃশ্য! তারপর হঠাৎ তিনি খুব লজ্জা পেতে লাগলেন। কোনক্রমে টেবিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রিহাম ইংরেজী বোঝে কি’না। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন রিহাম ঠিকভাবে কথা বলতে পারে কিনা! প্রথম থেকেই একটু একটু হা করতে করতে, নেত্র বিস্ফারিত হতে হতে তখন আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।

খানিকক্ষন পরে কিঞ্চিত প্রকৃতিস্থ হয়ে তাকে জানালাম পুত্র বাসায় কোন কাজ করেনা, সব বোনের ওপর দিয়ে খবরদারী করে সম্পাদন করার চেষ্টা করে, কিছু করলেও অনেক তেলাতে হয়; ভীষণ একরোখা সে এবং নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে কোনকিছুই সে মেনে নিতে চায়না হোক সে কাপড় পরা বা খাবারের ব্যাপারে; আমার এই পুত্র ক্লাসে সবচেয়ে দায়িত্বশীল, শান্ত এবং ভদ্র ছেলে! সে নিজে নিজে চিত্রকর্ম সৃষ্টি করছে জানতে পেরে হতবাক হলাম কারন বাসায় সে বোনের সহকারী হিসেবে ছাড়া এককভাবে কোনদিন কোন সৃষ্টিশীল কাজ করেনি! কিন্তু আরো হতবাক হলাম ওর ভাষাজ্ঞানের ব্যাপারে শিক্ষকের সন্দেহ দেখে। রিহাম গতবছর থেকে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজী বলা শুরু করে। আমরা বাংলা বললেও ইংরেজীতে জবাব দেয়। এই নিয়ে আমরা রীতিমত চিন্তিত। আব্বা, ওর দাদা, সান্তনা দিলেন এই বলে যে সে তো বাংলা বলবেই, কিন্তু তাঁরা ছোটবেলায় ইংরেজী না বলাতে এই বয়সেও ইংরেজী বলতে লজ্জা পান, সুতরাং সে আগে ইংরেজীতে পারদর্শী হয়ে যাক তারপর সে নিজে থেকেই বাংলা বলবে। কথা বলা শেখার পর থেকে সে যতক্ষণ জাগ্রত থাকে ততক্ষণ কথা বলতে থাকে- গান গায়, গল্প বলে, বই পড়ে, বোনের ওপর খবরদারী করে, আমাকে ওর কীর্তিকলাপের বৃত্তান্ত দেয়, ঘুমের ভেতরেও কথা বলে! সে যৌগিক এবং জটিল বাক্য ব্যাবহার করে আরো দু’বছর আগে থেকে, ক্লাসের বাচ্চারা যেখানে এক থেকে বিশ শিখছে সে পঞ্চাশ পর্যন্ত সব সংখ্যা পারে এবং একশ অবধি আরো বহু সংখ্যা বোঝে। সে টেলিফোনে আলাপচারীতে করে মেসেজ দিতে পারে। আর শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন সে ইংরেজী বোঝে কি’না বা কথা বলতে অসুবিধা হয় কি’না!

চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল। বাড়ীর সবাই খাচ্ছে, গল্প করছে, হাসাহাসিতে মেতে আছে। একটা মেয়ে একটা বই নিয়ে এক কোণে বসে হারিয়ে গেছে অন্য কোথাও। সে দুনিয়ার কত কিছু আবিস্কার করছে প্রতিনিয়ত! কিন্তু পড়ার বইয়ে তার মন নেই, পরীক্ষায় ফলাফল দেখে শিক্ষকরা চিন্তিত, বাবা মায়ের কাছে নালিশের পর নালিশ- কিন্তু বাবা এই উলটচন্ডাল মেয়েটাকে কিছু বলেন না, পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে কি হবে? সে কি জানে তা তো তিনি জানেন!

শিক্ষককে বললাম, “ওর মায়ের কথা বলতে পঁচিশ বছর লেগেছে, ওর তো বয়স মোটে পাঁচ! চিন্তার কিছু নেই, সব ঠিক আছে!” ওনার হতবাক চেহারা পেছনে রেখে বেরিয়ে এলাম শ্রেণীকক্ষ থেকে।

আমরা অনেক সময় বড় হয়ে ভুলে যাই ছোটবেলায় আমরা কেমন ছিলাম, ভুলে যাই আমাদের সন্তানদের যে ঘাটতি তা তো উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের থেকেই পাওয়া, ভুলে যাই ওদেরও তো স্বপ্ন আছে আর সেটা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া নাও হতে পারে, হতে পারে সে স্বপ্ন দেখে সে শেফ হবে বা ফায়ারট্রাক ড্রাইভার- এখনই তার ব্যাপারে হতাশ বা চিন্তিত হবার কোন কারন নেই, তাকে তার মত করে বাঁচতে দিলে এমন কিছু ক্ষতি হয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই যতক্ষণ না মানুষ হিসেবে তার মধ্যে কোন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। আমাদের দায়িত্ব সন্তানদের উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে তৈরী করা, আত্মসম্মান এবং উদারতার সাথে বেঁচে থাকার স্পৃহা সৃষ্টি করে দেয়া, জ্ঞানতৃষ্ণা অবারিত করে দেয়া- পার্থিব লাভক্ষতির হিসেব করে কাজ করতে শেখালে এই গুণগুলোর বিকাশ স্বার্থের দেয়ালে বাঁধাপ্রাপ্ত হতে হতে মাথা ঠুকে মরে। আমরা আমাদের সন্তানদের ‘মানুষ’ হবার সুযোগ দেই যেন ওরা না গায়:
Give me some Sunshine
give me some rain
Give me another chance
I wanna grow up once again

ওদের প্রথমবারই জীবনের আস্বাদ গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেই যেন কোন আক্ষেপ ওদের জীবনকে অপূর্ণ না রাখে; কেবল জীবিকার উদ্দেশ্যে নয় বরং জীবনের উদ্দেশ্যে তাদের বড় করি যেন তারা অনেক অনেক বড় হতে পারে, মানবতার কল্যাণকামী হতে পারে এবং নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতে আবদ্ধ না থেকে দেশ ও দশের জন্য করা মানসিকতা ধারণ করতে পারে। হয়ত তাদের অনেক টাকাপয়সা হবেনা কখনো, হয়ত খুব একটা নামযশ হবেনা কোনদিন, কিন্তু হয়ত কারো হৃদয়ে বহু বহুদিন বেঁচে থাকার যোগ্যতা জন্মাবে- একটা জীবনের জন্য কি এর চেয়ে খুব বেশী প্রয়োজন হয়?



“Our Lord, grant us from among our wives and offspring comfort to our eyes and make us an example for the righteous.”- (Surah Furqan: Ayah 74)


উৎসর্গঃ লালবৃত্ত- আমার বাচ্চাদের মেধাবী, সৃষ্টিশীল এবং বাউন্ডুলে মামা যার মেধার হকদার আমরা সবাই

No comments:

Post a Comment