ছোটবেলায় একবার কয়েকমাস গ্রামে থাকার সুযোগ হয়েছিল। অনেক সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতার মাঝে একটি অভিজ্ঞতা ছিল- সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে মায়েরা তাদের ঘর্মক্লান্ত কর্দমাক্ত সব পিচ্চি ছেলেমেয়েদের হাতমুখ ধুইয়ে বা এক বদনা পানি দিয়েই একখানা মিনি গোসল দিয়ে ভাল কাপড়চোপড় পরিয়ে বারান্দায় বসিয়ে দিতেন। মাগরিব হতেই সব বাড়ীর বারান্দা থেকে শোনা যেত বাচ্চারা উচ্চস্বরে সমবেত কন্ঠে যতপ্রকার দুয়া জানা আছে গড়গড় করে বলতে থাকত- বাবা মায়ের জন্য, দাদা দাদীর জন্য, নানা নানীর জন্য, আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কেউ বাদ যেত না। শহুরে আমি এতে খুব মজা পেতাম। কিন্তু এখন মনে হয় এটা এমন এক ট্রেডিশন ছিল যার মাধ্যমে আর কিছু হোক বা না হোক, যেসব বাচ্চা এখনো নামাজ পড়তে শেখেনি তাদের পরিবারের ইবাদাত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার একটা সুন্দর প্রয়াস ছিল।
আজকাল এমনটা শহরে গ্রামে কোথাও আর তেমন দেখা যায়না। সন্ধ্যা হলে কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে বসে, আর কিছু বসে পড়ে ‘ইডিয়ট বক্স’এর সামনে। কিন্তু পারিবারিক প্রক্রিয়া হিসেবে ইবাদাত অনেকাংশে হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি হয়ে দাঁড়াচ্ছে কেবল মুরুব্বীশ্রেণীর লোকজনের করণীয় অথবা ব্যাক্তিগত পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে অপশনাল বিষয়। সামষ্টিকভাবে ইবাদাত এখন প্রায় অদৃশ্য হতে চলেছে। এর মাধ্যমে দু’টি ব্যাপার প্রতিভাত হচ্ছে- এক, ধর্মীয় বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা; দুই, ধর্মচর্চার প্রতি আমাদের অনীহা।
প্রথমত, আমরা চিন্তা করছিনা যে শেষবয়সে গিয়ে কুর’আন পড়ে যদি আমি জানতে পারি যে সারাজীবন যা ভেবে এসেছি বা করে এসেছি তা ভুল ছিল, আমি কি আমার জীবনটাকে রেকর্ডের মত রিওইয়ান্ড করে পুরো জীবনটাকে সংশোধন করার সুযোগ পাব? উত্তর স্পষ্ট। তাহলে কেন আমি আমার প্রাণপ্রিয় শিশুটিকে ছোটবেলা থেকেই কুর’আন পড়ার, জানার, বোঝার, সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেবনা? আমি শিশুদের নিজের মতামত ইসলাম বলে গিলিয়ে দেয়ার পক্ষপাতি নই, কিন্তু সে কুর’আন হাদীস যদি জানার সুযোগ না পায় তাহলে সে ধর্ম কতটুকু প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় তা সিদ্ধান্ত নেবে কিসের ভিত্তিতে? ধর্ম পালনের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে কি করে?
দ্বিতীয়ত, চর্চা। ইবাদাত মূলত কন্ডিশনিং-এর বিষয়। আমার স্বল্পজ্ঞানে বিশ্লেষণ করে যতটুকু বুঝি, ইবাদাতের জন্য দু’ধরণের কন্ডিশনিং প্রয়োজন হয়- মানসিক এবং শারিরীক। মানসিক কন্ডিশনিং মূখ্য। কেননা আপনি যদি মনে করেন ধর্ম একটা ভুয়া বিষয় তাহলে আপনি ইবাদাত করার ইন্সপিরেশন পাবেন কি করে? কিন্তু আপনি যদি নিজে পড়ে, জেনে, বুঝে চর্চা করার সিদ্ধান্ত নেন তাহলে পাহাড়সম বাঁধাও আপনাকে আটকে রাখতে পারবেনা।
এজন্যই একজন আব্দুর রহীম গ্রীণ পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ে তৃপ্তি পান অথচ একজন জন্মসূত্রে মুসলিম নামধারী নামাজ পড়ার টান অনুভব করেন না; এ’কারণেই যে মেয়েটি গতকালও বিকিনি পরত সে একঝটকায় বোরকা পরে ফেলতে পারে অথচ অনেকেই মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেও মাথায় ওড়না দিতে পারেনা; এজন্যই একজন ইউসুফ এস্তেস ইসলাম গ্রহণ করেই বাড়ী বিক্রি করে ভাড়া বাড়ীতে ওঠেন অথচ একজন জন্মগত মুসলিম সুদভিত্তিক পদ্ধতিতে বাড়ী কেনেন। পাশাপাশি প্রয়োজন শারীরিক কন্ডিশনিং। আপনার চৌদ্দ বছর বয়সী গাবলু গুবলু ছেলেটিকে আপনি আদর করে কোনদিন রোজা রাখতে দেননি অথবা শুধুমাত্র ছুটি বা বিশেষ দিনগুলোতে সারাদিন শুয়ে বসে কাটানোর শর্তে রোজা রাখতে দিয়েছেন। সে চল্লিশ বছর বয়সেও শারীরিকভাবে সব রোজা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারবেনা কারণ তার শরীর এই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়নি। রোজার সমস্ত উপকারীতার কথা ছেড়ে দিলাম, কেবল এটুকু যদি আমরা চিন্তা করি যে আমার সন্তানকে আমি জন্ম দেয়ার নিমিত্ত ছিলাম বটে কিন্তু তার সৃষ্টিকর্তা আমি নই। সুতরাং, তার প্রতি আমার যতটুকু ভালোবাসা, অবশ্যই তার সৃষ্টিকর্তা তাকে এর চেয়ে কোটিগুণ বেশী ভালোবাসেন, তার শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু তিনি আমার চেয়ে ভালো জানেন। সেক্ষেত্রে তিনি যদি তাকে নামাজ পড়তে আদেশ করেন, আমি তাকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে রেখে কি তার উপকার করছি? তিনি যদি তাকে রোজা পালন করতে বলেন, আমি তাকে খাইয়ে দাইয়ে ফার্মের মুরগী বানিয়ে তার কি উপকার করছি? তিনি যদি তাকে পর্দা করতে বলেন, আমি তার গরম লাগবে বলে তাকে ফ্রিলি চলতে দিয়ে তার কি উপকার করছি? আমি যদি আমার সন্তানটি একটু কাঁদবে বলে বা একবেলা অভিমান করে না খেয়ে থাকবে বলে জেনেশুনে তাকে হারাম খাবার খেতে দেই, আমি আসলে তাকে কতটুকু ভালোবাসি? নিজেকে এই প্রশ্ন করি। জবাবটা নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায়। কি করছি আর কি করনীয় সে ব্যাপারে আর কোন দ্বিধাদ্বন্দ থাকেনা।
আমাদের সন্তানেরা এখন ঈদ বলতে বোঝে টিভিতে ভাল ভাল প্রোগ্রাম আর কে ক’খানা জামাজুতো কিনল তার হিসেব। কিন্তু এত চমৎকার অনুষ্ঠানমালা, এত এত জামাজুতো কিছুই তাদের মন ভরাতে পারেনা। কারন আমাদের ক্রিয়াকর্মে কোনভাবেই ঈদের মূল স্পিরিটটা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়না। তারা দেখে সংযমের মাসে অসংযমের জোয়ারে গা ভাসানো, ঈদের দিনে তার হাজার টাকা দামের জামার দিকে বস্তির ছেলেটির করুণ চাহনী, তার টেবিলে খাদ্যসম্ভারে সে খাবার প্রস্তুতকারী কাজের লোকের ভাগ না পাওয়া। তাহলে সে কি করে বুঝবে যে ঈদ হোল এমন একটি দিন যেদিন আমরা আমাদের যা আছে তা তাদের সাথে শেয়ার করব যাদের সাথে আমাদের পথে ঘাটে দেখা হয় অথচ আমরা তাদের দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাবার উপযুক্ত মনে করিনা? ঈদ হোল নিজের জন্য জামা না কিনে সেই পাতাকুড়ানী শিশুটির জন্য জামা কেনার দিন যে অভাবের তাড়নায় ভরদুপুরে রোদবৃষ্টি উপেক্ষা করে বস্তা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে; ঈদ সেই ছেলেটির জন্য বই কেনার দিন যে স্কুলে যাবার পরিবর্তে ওয়ার্কশপে গাড়ী ঠিক করে; ঈদ সেই বুয়ার বাচ্চার জন্য খেলনা কেনার দিন যে বাড়ীতে তার ছোট্ট শিশুটিকে ভুলে ঈদের দিনটি পর্যন্ত আমার পরিবারের সাথে কাটায়। এই প্রক্রিয়ায় আমি আমার সন্তানকে অন্তর্ভুক্ত করব। সে মাসের পর মাস প্ল্যান করবে কিভাবে ওয়ার্কশপে তার সমবয়সী ছেলেটিকে বুক অফ নলেজ উপহার দিয়ে চমকে দেয়া যায়, পাতাকুড়ানী মেয়েটির বাসায় জামা নিয়ে উপস্থিত হলে সে কেমন সারপ্রাইজড হবে, বুয়ার ছেলের জন্য কি খেলনা দিলে বুয়া আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরবেন। সে নিজ হাতে প্রত্যেকটি উপহার তুলে দেবে চারপাশের মানুষগুলোর হাতে, নিজ চোখে দেখবে তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ, নিজ কানে শুনবে তাদের উচ্ছ্বাস। দেয়ার আনন্দে ভরপুর ঈদ তখন তার কাছে হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে মহিমান্বিত।
চলুন আমরা আমাদের প্রত্যেকটি ইবাদাতে আমাদের সন্তানদের অন্তর্ভুক্ত করি। আপনি যখন কুর’আন পড়তে বসেন আপনার সন্তানকে পাশে ডেকে বসান, নামাজ পড়ার সময় আপনার ছেলেমেয়েকে সাথে ডেকে নিন, সেহরীতে তাকে ডেকে তুলুন, রোজা রাখতে তাকে উৎসাহিত করুন, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা শিক্ষা দিন, চারপাশের মানুষের জন্য করতে উদ্বুদ্ধ করুন, সর্বোপরি তার জীবনকে নিশ্চিন্ত ও পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার উপায়টি শিখিয়ে দিন। আপনার সন্তানকে বাবা বা মা হিসেবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার হতে বঞ্চিত করবেন না।
No comments:
Post a Comment