যারা কথা বেশি বলেন তাদের সবারই অভিজ্ঞতা রয়েছে কোন না কোন সময় কোন বেফাঁস কথা বলে মাত্র ‘oops’ করে দুহাতে নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরার। কিন্তু ততক্ষণে তীর ছুটে গেছে, হয়ত লক্ষ্যভেদও হয়ে গিয়েছে, সময়ের চাকা ঘুরিয়ে কোনভাবেই তাকে আর ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব না।
আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ এবং প্রতিফল দিবসে বিশ্বাস রাখে তার উচিত হয় ভাল কথা বলা নয় চুপ করে থাকা’ (বুখারী)। অধিকাংশ ভুল বোঝাবুঝির সূচনা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে যা গড়াতে পারে হাতাহাতি থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত। অধিকাংশ অপ্রয়োজনীয় কথাই গীবত শ্রেণীভুক্ত, আর কিছু হোল অহেতুক আড্ডা বা হাসিঠাট্টা জাতীয় কথাবার্তা যা অনেক সময় সীমারেখা অতিক্রম করে যায়, সময়ের অপচয় ঘটায় কিংবা মানুষে মানুষে সম্পর্কের অবনতি। অথচ একটু সতর্ক হলেই এই অভ্যাস থেকে উত্তরণ করা সম্ভব, প্রয়োজন শুধু মুখ থেকে কথা বের করার আগে একটি মূহূর্তের বিবেচনা। একটি কথা বলার আগে যদি আমরা একটি মূহূর্ত চিন্তা করি- কথাটি কি বলার প্রয়োজন আছে, কথাটি বলার উদ্দেশ্য কি, কথাটি বলার মাধ্যমে কি কারো কোন উপকার হতে পারে, কথাটি বলার মাধ্যমে কি কারো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে, কথাটি না বললে কি কোন সমস্যা হতে পারে?- হয়ত দেখা যাবে এমন অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা থেকে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি যাতে কারো কোন লাভ নেই।
কখনো কখনো সত্য কোন ব্যাক্তির জন্য লজ্জার বা কষ্টের কারণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে চোরকে চোর বা মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাবাদী বলায় কোন বাহাদুরী নেই। মক্কা বিজয়ের পর রাসূল (সা) সাহাবীদের সাবধান করে দেন তাঁরা যেন ইকরিমা বিন আবু জাহল (রা)কে আল্লাহর শত্রু আবু জাহলের সন্তান হবার কারণে অপদস্থ না করেন বা তাঁর সামনে তাঁর পিতার ব্যাপারে কিছু না বলেন, কেননা আবু জাহল যে তাঁর পিতা এর জন্য তিনি দায়ী নন কিন্তু এই সত্য উত্থাপন করাটা তাঁর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এমন ক্ষেত্রে সত্য উচ্চারণ না করাই সততা।
এর অর্থ কি তবে এই যে কাউকে ভুল বা অন্যায় করতে দেখেও আমরা চুপ থাকব? তা কিন্তু নয়। তাহলে মনে আঘাত না দিয়ে আমরা এই সত্য কিভাবে তাদের সামনে তুলে ধরব? আমরা কাজটি করব স্নেহের সাথে, সহমর্মীতার সাথে, সংবেদনশীলতার সাথে। প্রথমত, আমাদের কথায় কোন রাগ, ঝাল বা হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেতে পারবেনা; বরং বার বার শ্রোতাকে হাসিমুখে সম্বোধন করে, হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যাবহারের মাধ্যমে তাকে স্পষ্ট করে দিতে হবে যে কথাটি বলার পেছনে আমার কোন অসদুদ্দেশ্য কাজ করছেনা। কথায় নিজেকে বড় প্রমাণ করার পরিবর্তে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে হবে যে মানুষ হিসেবে আমি নিজেও ত্রুটিমুক্ত নই, তাই আমার লক্ষ্য তার ত্রুটির অনুসন্ধান নয় বরং তাকে সংশোধিত হতে সাহায্য করা। একই কথা আমরা এমন tactlessly বলতে পারি যা কারো হৃৎপিন্ড ছ্যাঁদা করে দিয়ে যায়, আবার এত সুন্দর করে বলতে পারি যাতে তার নিজেরই মনে হয়, ‘তাই তো, আমার এই বিষয়টি সংশোধন করে নিলেই তো আমি অনেক উন্নত মানুষে রূপান্তরিত হতে পারি!’ সামান্য সময় এবং বুদ্ধি ব্যায় করলেই আমরা সুন্দরভাবে সাজিয়ে হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে কথা বলা রপ্ত করতে পারি।
খলিফা সুলায়মান যখন অনৈতিকভাবে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হত্যা করার আদেশ দেন তখন উমার বিন আব্দুল আজিজ তাঁকে শুধু প্রশ্ন করেন, ‘সুলায়মান, আল্লাহকে কি জবাব দেবে?’ কোন তর্ক নয়, অনুরোধ নয়, উপদেশও নয়, শুধু একটি প্রশ্ন- কিন্তু এই একটি প্রশ্ন একজন মানুষের সম্পূর্ন অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট।
আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলা এক ধরনের সাদাকা’ (বুখারী)। সামান্য ক’টি দয়ার্দ্র বাক্য একটি জীবন রক্ষা করতে পারে, উজ্জীবিত করতে পারে একটি সম্পূর্ন জনপদকে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। পক্ষান্তরে ক’টি কর্কশ শব্দ একজন মানুষকে ঠেলে দিতে পারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, নিরাশ করতে পারে একটি জাতিকে, মৃত্যু ঘটাতে পারে সকল সম্ভাবনার।
প্রায়ই দেখা যায় আমরা নিজেদের অহমকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য, প্রতিশোধের জ্বালা মেটানোর জন্য কিংবা প্রতিপক্ষকে মোক্ষম আঘাত দিয়ে ঠান্ডা করে দেয়ার উদ্দেশ্যে অবলীলায় এমন সব কথা বলি যা কেউ আমাদের বললে আমাদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। অথচ এটা চিন্তা করিনা যে যখন আমার রাগ ঠান্ডা হয়ে যাবে, ক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাবে, তখন লজ্জা আমাকে গ্রাস করবে, নিজেই বুঝব কথাটা আদতেই বলা জরুরী ছিলোনা। কিন্তু তখন হাজার ‘sorry’ বলেও সেই ক্ষত আর মেরামত করা সম্ভব নয়- তলোয়ারের আঘাতের দাগও একসময় মুছে যায়, কিন্তু কথার আঘাতের ক্ষতে আমৃত্যু রক্তক্ষরণ হতে থাকে- চামড়ার ওপর প্লাস্টিক সার্জারী করা যায় কিন্তু হৃদয়ের ওপর তো আর ব্যান্ডেজ দেয়া যায়না!
অহংকার শয়তানের পতন ঘটিয়েছিল, আদমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহা তাকে জাহান্নামের জ্বালানী বানাবে, এভাবে নফসের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ধ্বংসই ডেকে আনে। তাই আল্লাহ বলেছেন, ‘রাহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম’ (সুরা ফুরকানঃ আয়াত ৬৩)। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এরা হেরে গেল, কিন্তু কার্যত এরাই জিতে গেল। কারণ তারা নিজেদের দুর্বলতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল, সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন করল এবং শেষ পর্যন্ত সেই বিজয়ী হয় যে পরিস্থিতির শিকার না হয়ে পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতে পারে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে মুখ দিয়েছেন একটি আর কান দিয়েছেন দু’টি। উদ্দেশ্য, সে যেন শোনে বেশি বলে কম। কেননা শোনার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, কিন্তু বলার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা ব্যাতীত আর কোন উদ্দেশ্য সাধন হয়না। তবু আমরা দিনরাত কথা বলি- প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, সত্যাসত্য বিচার না করেই, কথার ভারসাম্য বজায় রাখা তো অনেক পরের ব্যাপার। বার বারই আমাদের মুখের দরজা অনাহুতভাবে খুলে যায়। তাই বার বার ভুল হয়ে যায়। কখনো না কখনো কোন না কোন কথায় কেউ না কেউ আঘাত পেয়ে বসে।
সেক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব যদি ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে তাহলে মাফ চেয়ে নেয়া। মাফ চেয়ে কেউ ছোট হয়না, কারণ কার্যত বুদ্ধিমান মাত্রেই যেকোন মূল্যে কাঁধের বোঝা হাল্কা করে নিতে পছন্দ করে যেন পথ চলা সহজ হয়। তবে কেউ যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কষ্ট পায় তাহলে আমাদের কথায় এবং আচরনে বুঝিয়ে দেয়া উচিত এটা আমাদের উদ্দেশ্য ছিলোনা এবং ভবিষ্যতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত যেন আমরা অযাচিতভাবে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারি। আর কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দোষ ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে কষ্টভোগ করে তাহলে সেই ব্যাক্তির কাছ থেকে সাবধান থাকা উচিত এবং তার কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রাখাই নিরাপদ।
No comments:
Post a Comment