Sunday, December 9, 2012

প্রত্যাবর্তন

ক‘দিন আগে এক পরিচিতার মিসক্যারেজের খবর পেয়ে দেখা করতে গেলাম। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাঁর এক আত্মীয়া এসে পড়লে তাদের কিছুটা আড়াল দেয়ার জন্য উঠে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে শুনছি আগত আত্মীয়া দুঃখভারাক্রান্ত গলায় বলছেন, “আহা! আমি তো ভেবেছিলাম খালাম্মা আবার ফিরে আসছেন!” রোগিনী সজোরে শ্বাস টেনে অত্যুৎসাহী কন্ঠে বললেন, “তুমি ঠিক আমার মনের কথাটাই বলেছ! আম্মা মারা যাবার পরপরই যখন আমি অনাকাঙ্খিতভাবে প্রেগ্ন্যান্ট হয়ে পড়ি তখন এই মনে করেই সান্তনা পেলাম হয়ত আম্মা ফিরে আসছেন!...”

না, তাঁরা কেউ হিন্দু নন, আকীদাগতভাব পুণর্জন্মে বিশ্বাসী হবার প্রশ্নই আসেনা। এটা কেবল হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়ালের কারিশমা। আমি ভাবছিলাম এই আপাতদৃষ্টে সাধারণ অনুষ্ঠানগুলো কিভাবে আমাদের নিজেদের অজান্তেই ঈমান থেকে বিচ্যুত করে ফেলছে! আল্লাহ আমাদের পৃথিবীতে পাঠান একবারই, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। এই সময়ে আমরা কি করলাম তার ওপরেই আমাদের বিচার হবে। কেউ এই সুযোগ দ্বিতীয়বার পাবার সম্ভাবনা নেই। সিনেমা আর সিরিয়াল দেখে এই মূল্যবান সময় নষ্ট করার ব্যাপারটা নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু হিন্দি সিনেমার প্রভাবে যদি এভাবে আমাদের এমন একটি বেসিক আকীদার পরিবর্তন হয়ে যায় ...! এ’তো সবেমাত্র শুরু, এভাবে আমাদের আরো কত আকীদা যে এই অনুষ্ঠানগুলোর কাছে বলি হয়ে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে!

আমার এক অত্যন্ত কাছের মানুষের প্রথম সন্তান জন্মের সাতদিন পর মারা যায়। তিনি নিজেও আল্লাহর অশেষ রহমতে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে তাঁর আরো দু’টি সন্তান হয়। কিন্তু তিনি প্রতিদিন তাঁর প্রথম সন্তানটির কবরের সামনে দিয়ে অফিসে আসেন। এ’কথা শুনে এক বান্ধবী বলল, “আপনি তো চাইলেই ঐ রাস্তা দিয়ে না এসে অন্য রাস্তা দিয়ে আসতে পারেন”। তিনি স্মিত হেসে বললেন, “আমার এই সন্তানটি আমার জন্য সবচেয়ে উপকারী। কিয়ামতের দিন সে আমার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলে অথচ আমার মা শুধুমাত্র তোমার সন্তুষ্টির জন্য ধৈর্য্য ধারণ করেছিল, তুমি তার সকল গুণাহ মাফ করে দাও’। এর আগে আমি প্রায়ই নামাজ কাজা করতাম, ইবাদাতের ব্যাপারে সচেতন ছিলাম না, পর্দার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম না। ও চলে যাবার পর আল্লাহ যখন আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনেন, আমি নিয়মিত নামাজ পড়তে শুরু করি, রোজা এবং যাকাতের ব্যাপারে সচেতন হই, হজ্জ্বের জন্য টাকা জমাতে শুরু করি, আমার মেয়ে চলে যাবার পর আমি কোনদিন মাথার কাপড় ফেলে চলিনি। তাহলে আমার যত কষ্টই হোক, আমি কি করে ওকে ভুলে থাকতে পারি?...”

ওনার কথা শুনে মনে মনে পর্যালোচনা করলাম- প্রথম ইসলামগ্রহণকারী একজন মহিলা, প্রথম শাহাদাতবরণকারী একজন মহিলা, ওহুদের যুদ্ধে রাসুল (সাঃ) যখন শত্রুপরিবেষ্টিত হয়ে পড়েন তখন যে মাত্র তেরজন ব্যাক্তি তাকে ঘিরে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যায় তাদের একজন মহিলা, ইয়ারমুকের যুদ্ধের প্রচন্ডতায় পলায়নপর মুসলিম বাহিনীর উপর রাগ করে তাঁবুর খুঁটি দিয়ে নয়জন রোমান যোদ্ধাকে একাই গেঁথে ফেলেন যে সাহাবী তিনিও একজন মহিলা, সর্বাধিক হাদীসবর্ণনাকারী দুই ব্যাক্তির একজন মহিলা, হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে তার সমাধান দিলেন যিনি তিনিও এক মহিলা... এই তালিকা অন্তহীন। ইসলামের বিকাশ এবং অগ্রগতিতে মহিলাদের অবস্থান সর্বত্র দৃষ্টির সম্মুখে না হলেও এর পরিচালিকাশক্তিরূপে তাদের অবদান কোনভাবেই পেছনে নয়। একটি সমাজের প্রত্যক্ষ নির্মাতা গোষ্ঠী পুরুষ হলেও প্রকৃতপক্ষে সমাজগঠনের দায়িত্ব তো আসলে নারীর হাতেই যেহেতু এই পুরুষকেও গড়ে তোলেন এক নারীই। এ’কারণেই যেকোন জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সে জাতির মহিলাদের পথভ্রষ্ট করাই যথেষ্ট, বাকীটা আপনা আপনিই পতন ঘটবে।

তাই যেকোন জাতির পতন রোধ করতে হলে সবার আগে জানতে হবে, সচেতন হতে হবে, অতঃপর সেই অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের প্রথম যে হুকুম পাঠিয়েছেন তা হোল, “পড়”। এর উদ্দেশ্য এটা ছিলোনা যে পুরুষরা লেখাপড়া করে নারীদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে এবং নারীরা লেখাপড়া করে নিজের অবস্থান গড়ে সেই ছড়ি থেকে পরিত্রাণ পাবার চেষ্টা করবে। লেখাপড়া কোন পার্থিব বস্তু বা কোন স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে নয় বরং নিখাদ জ্ঞানলাভের জন্য করতে বলা হয়েছে। যে নারী নিজে জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত তার হাতে কি করে নির্মিত হবে একটি আলোকিত সমাজের কর্ণধার? যে পুরুষ জ্ঞানলাভ করে কিন্তু সে জ্ঞান তার নিজের ছাড়া আর কারো উপকারে আসেনা তার জ্ঞানের কি মূল্য? এজন্য শুধুমাত্র অন্তরের বিস্তৃতিকে প্রশস্ত করার জন্য নারীপুরুষ উভয়ের ওপর জ্ঞানার্জন ফরজ করা হয়েছে, নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতা করা বা জীবিকার অন্বেষনের জন্য নয়।

আল্লাহ ইসলামে নারী এবং পুরুষের অবস্থান সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। পুরুষ নারীর বন্ধু এবং দায়িত্বশীল। নারী পুরুষের বান্ধবী এবং সাহায্যকারী। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোন ব্যাপার নেই। যে সমস্যা আমাদের নেই সে সমস্যাকে আমাদের মাঝে জন্ম দেয়া একটি গোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত জরুরী। কেননা আমাদের মাঝে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ সৃষ্টি করার মাধ্যমে, আমাদের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে তারা নারীপুরুষের মাঝে এমন এক বিভেদ সৃষ্টি করতে চায় যা তাদের নিজেদের সমাজকে ঠেলে নিয়েছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, যে সংঘর্ষের অনুপস্থিতির কারণে আমাদের সমাজ আজও বহমান। সেজন্য আজ পশ্চিমাদের আমাদের হিজাবী মহিলাদের জন্য দরদ উথলে ওঠে অথচ তাদের নিজেদের সমাজে মা থেকে বোন, ভাবী থেকে শ্বাশুড়ী, বান্ধবী থেকে সহকর্মী কোন নারীই নিরাপদ নয়! সেজন্যই তারা চিন্তিত আমাদের ‘poor’ হিজাবী মহিলাদের কিভাবে উন্নয়ন হবে আর নিজেরা নারীদের উন্নতির নামে উলঙ্গ করে পণ্য বানিয়ে ছেড়েছে!

আমাদের শক্তি আমাদের বিশ্বাস এবং পারিবারিক সম্প্রীতি যা হাজার ঝড়ঞ্ঝার মাঝেও আমাদের সাহস এবং উদ্যম জিইয়ে রাখে। আজ হিন্দি সিরিয়ালগুলোর টার্গেট ঠিক এই দু’টোই। সমাজের নির্মাতারাই যদি পথচ্যূত হয় তাহলে তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সহজ হয়ে যায় অনেকখানি। আজ আমাদের মা খালারা সিরিয়ালের জালে বন্দী, সিরিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে নামাজটা কোনক্রমে চলমান রাখেন, কুর’আন বা হাদিস পড়ার অথবা বাচ্চাদের সাথে এসব আলাপ করার সময় তাদের নেই কারণ তাঁরা মূর্তির সামনে নতমস্তক বৃদ্ধাদের রঙবেরঙের পোশাক আর কথাবার্তায় কুপোকাত। গৃহিনীদের সময় নেই নিজে লেখাপড়া করার বা বাচ্চাদের নিয়ে পড়তে বসার তাই বুয়া এবং গৃহশিক্ষক রাখা হয় যে বাচ্চাকে আদৌ কিছু শেখাচ্ছে কি’না বা তাকে অ্যাবিউজ করছে কি’না অথবা মেয়ের সাথে প্রেম করছে কি’না দেখার সময় তাঁর নেই কারণ তিনি শাড়ি আর গহনার ঝিলিক দিয়ে শ্বশুরবাড়ীর সবাইকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে পরকীয়াশিল্পের বিস্তারের আরাধনায় ব্যাস্ত।

সেদিন এক আত্মীয় বলছিলেন, “বাংলাদেশে এখন একটা ভাল ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, কোন বিয়েবাড়ীতে গিয়ে বোঝা সম্ভব না এটা মুসলিম না হিন্দু বিবাহ”। কি করে বোঝা যাবে? সব তো একই পোশাক, একই সাজে সজ্জিত! রীতিরেওয়াজগুলোর মধ্যেও আর তেমন একটা তফাত দেখা যায়না। সিরিয়ালে যা দেখা যায় সেভাবেই সবকিছু সম্পন্ন করার উদগ্র আগ্রহ সর্বত্র। আমরা কোথায় চলেছি, কেনই বা চলেছি এ’ নিয়ে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কারো নেই। তবে এই গড্ডালিকা প্রবাহ আমাদের কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় হয়ত শেষ হয়ে এসেছে। এখনো যদি আমরা মাথাব্যাথার প্রয়োজন বোধ না করি পরে হয়ত মাথাটাই আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা!

No comments:

Post a Comment