আমার বহুবছরের একটা শখ শেষপর্যন্ত পূরণ হোল। ডাইনোসরের ফসিল দেখলাম, হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম! ছ’সাত বছর বয়সে প্রথম ডাইনোসরের ওপর লেখা একটা বই কিভাবে যেন আমার হাতে লেগে যায়। বড়দের জন্য লেখা সে বইয়ে দাঁতভাঙ্গা উচ্চারণের ডাইনোসরদের কঠিন কঠিন সব বর্ণনা। তবুও আমার উৎসাহের কোন ঘাটতি নেই। তারপর যে আরো কত বই পড়া হোল! কত নতুন নতুন ডাইনোসরদের কথা জানলাম। কিন্তু তাদের চোখে দেখার যতটুকু কাছাকাছি যাওয়া যায়, ফসিল দেখা, সেটা স্বপ্নই রয়ে গেল। ক’দিন আগে একটা খামারে যাচ্ছিলাম। যাবার পথে ‘ব্যাডল্যান্ডস’ এলাকার সাইনবোর্ড দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! ব্যাডল্যান্ডসের কথা পড়েছিলাম- উত্তর আমেরিকার ফসিলের খনি। সেই ব্যাডল্যান্ডসের একাংশ যে ক্যানাডায় তা কে জানত? খবর নিয়ে জানলাম ক্যানাডিয়ান ব্যাডল্যান্ডসের প্রাণকেন্দ্রে ড্রামহেলার এলাকায় অবস্থিত ‘রয়াল টিরেল মিউজিয়াম’- পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডাইনোসর মিয়জিয়ামগুলোর একটি। ব্যাস, আর পায় কে? সাথে সাথে ড্রামহেলারের প্রোগ্রাম। বুধবার, জুলাই ৬ তারিখ সকাল সাড়ে সাতটায় বাসা থেকে বের হলাম। শহর থেকে বের হতেই দিগন্তজোড়া ঢেউখেলানো সবুজ আর হলুদের সমারোহ। শত শত একর জুড়ে এক একটা ফসলের ক্ষেত, একটিমাত্র পরিবার চাষাবাদ করে। সব কাজ হয় মেশিনে- লাঙ্গল দেয়া থেকে বীজ বোনা, আগাছা পরিস্কার করা, ফসল তোলা পর্যন্ত। হয়ত বিশেষ বিশেষ সময় লোক ভাড়া করা হয়। যোগাযোগ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত হবার ফলে মাইলের পর মাইল জুড়ে কেউ না থাকলেও চাষী পরিবারগুলোর তেমন কোন অসুবিধা হয়না। পথের বিভিন্ন স্থানে আগাছার ঝোপের মনমাতানো গন্ধ, শীত শেষে ঘরে ফেরা পাখীদের ঝাঁক, কোথাও গরু কোথাও ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে- তবে সবচেয়ে মোহনীয় দিগন্তবিস্তৃত সরিষা ক্ষেতের দৃশ্য। ব্যাডল্যান্ডসের কাছাকাছি যেতেই দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটলো। নীচু পাহাড়শ্রেণী দেখা দিতে লাগল। এগুলোর মাথায় সামান্য ঘাস থাকলেও পাহাড়গুলো মূলত ন্যাড়া। তাদের শরীরের একেকখানে একেক রঙের মাটি একেক প্রাগৈতিহাসিক যুগের সাক্ষ্য দিচ্ছে। ভাবতেই অবাক লাগে এখানে একসময় ঘন বনভূমি ছিল, ডাইনোসরদের চারণভূমি ছিল এসব, ট্রাইসেরাটপরা এখানে ফার্ণ খেত আর টাইরেনোসরাসরা দূর থেকে লোলুপ হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পেতে থাকত কখন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে! রাস্তার দু’ধারে ডাইনোসরদের অতিকায় মূর্তি এই দৃশ্য কল্পনা করার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছিল বটে। মিউজিয়াম ড্রামহেলার শহরের উপকন্ঠে। আশেপাশে থাকার বা ব্যাডল্যান্ডসের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পিং বা ট্রেকিং করার সুযোগ আছে। মিউজিয়ামে ঢুকে প্রথমেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের জীবন্ত দৃশ্য দেখতে পাবেন। লাইফসাইজ মডেল দিয়ে দেখানো হচ্ছে ডাইনোসর পরিবার শুকনো নদী পাড় হচ্ছে, পাশে ঘন ফার্ণ আর প্রাগৈতিহসিক গাছপালার জঙ্গল। ওরা জানেনা একটু পরেই নদীতে ঢল নামবে, ওরা সবাই মারা পড়বে, কাদার নীচে তাদের দেহ পচে যাবে, কিন্তু ওদের হাড় প্রতিস্থাপিত হবে কাদা আর খনিজ পদার্থ দিয়ে, হাড়ের আকৃতিসম্পন্ন এই ফসিল বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাবে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর পর, তারা আশ্চর্য হয়ে ভাববে এই অতিকায় প্রাণী একসময় পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াত! সম্পূর্ণ উত্তর আমেরিকা একসময় পানির নীচে ছিল। এই মহাদেশীয় প্লেট যখন পানির ওপর উঠে আসে ততদিনে ব্রন্টসরাসের মত বিশাল ডাইনোসরদের সংখ্যা কমে এসেছে। উত্তর আমেরিকার ডাইনোসরগুলো তাই পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের ডাইনোসরদের থেকে আকারে ছোট, আকৃতিতেও অনেক পার্থক্য আছে। পাশের রুমে একটি মাঝারী আকারের সরোপডের পায়ের হাড়ের মডেল রাখা হয়েছে যাতে আপনি পাশে দাঁড়িয়ে মাপ দিয়ে দেখে নিতে পারেন তার তুলনায় আপনি কতটুকু লম্বা। ঐ রুমে সবচেয়ে লম্বা যে ক্যানাডিয়ান ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন তার দৈর্ঘ ছয়ফুটের বেশী হবে। কিন্তু বেচারা ঐ পায়ের হাঁটু পর্যন্তও পৌঁছতে পারলেননা! এই মিউজিয়ামে ৪০টিরও বেশী ডাইনোসর মডেল এবং সাড়ে ১১হাজারের মত ফসিল রয়েছে। সুতরাং সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারগুলো ছাড়া অন্যান্য অনেক ব্যাপারে হয়ত বলা সম্ভব হবেনা। দ্বিতীয় রুমের একপ্রান্তে কাঁচ দিয়ে ঘেরা, ওদিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা সদ্যপ্রাপ্র ফসিল প্রসেস করছেন। একজন শিক্ষানবীশ জনগণের সামনে বসে একটি ছোট্ট ফসিল পরিস্কার করছে, ওভারহেড প্রজেক্টরে সে কি করছে তা বড় করে দেখানো হচ্ছে। একেকটি ফসিল যে কি যত্ন করে কত সাবধানে পরিস্কার করা হচ্ছে তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু ফসিল যেহেতু মূলত হাড়ের বা গাছের আকৃতিতে জমে যাওয়া মাটি অথবা মাটিতে মৃতদেহের ছাপ, সাবধানে কাজ না করলে ওপরস্থ মাটি সরাতে গিয়ে মূল জিনিসটিই নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রকট। তৃতীয় রুমে ঢুকে থমকে গেলাম। একখানা ফুলসাইজ টাইরেনোসরাস রেক্সের সম্পূর্ণ কংকাল বিশাল রুমের মধ্যখান বরাবর দাঁড়িয়ে। মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত একখানা ট্রাকের সমান, লম্বায় দোতলা বরাবর, ওর দুই দাঁতের মধ্যখানে সহজেই ফিট করা যাবে আমাদের ছ’ফুটাধিক ঐ বন্ধুকে। এর গায়ে যখন মাংস ছিল তখন সে দেখতে কেমন ছিল তাই ভাবছিলাম। রুমের চারপাশে দেয়ালে ওর দাঁত, নখর আলাদা করে প্রদর্শনীতে দেয়া। আমার এগার বছর বয়সী মেয়ে হাতের সাথে মাপ দিয়ে দেখল ওর একখানা দাঁত ওর হাতের মাপের সমান- লম্বায় এবং চওড়ায়! মাঝে একখানা রুমে বিজ্ঞানী ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিশিস’-এর প্রথম প্রকাশিত একখানা বই, খোলা ডায়রী, গবেষণার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সম্বলিত চার্ট এবং বিভিন্ন যুগের মানুষের মাথার খুলি দিয়ে সাজানো একটি শেলফ। একপাশে ডাইনোসর যুগের কুমির আর এখনকার কুমিরের মাথার খুলি। আমার এগার বছর বয়সী কন্যা অনায়াসে ডাইনো কুমিরের খুলির ভেতর বিছানা পেতে শুতে পারবে! ঐ রুম থেকে বেরোবার পথটি খুব সুন্দর। প্রাগৈতিহাসিক বিভিন্ন যুগ এবং ঐসব যুগের শ্রেণীবিভাগ দিয়ে গেট তৈরী করা হয়েছে। একটি শিশু সহজেই শিখে নিতে পারবে সব যুগের নাম, তবে উচ্চারণ করতে পারবে কিনা তাতে সন্দেহ আছে। গেট পেরিয়ে প্রাগৈতিহাসিক যুগের জলজ প্রাণীদের মডেল সাজানো, পোকাগুলোই ছবছরের বাচ্চার চেয়ে বড়! অতিকায় সব নটিলাস ঝিনুক। কিছু নটিলাস ঝিনুকের ফসিল রাখা। নটিলাসের ভেতরে অ্যামোনাইট জমে অসাধারণ লালসবুজ রঙ ঝকঝক করছে। রকি মাউন্টেন দূর থেকে দেখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল আইনের পাহাড়গুলোর মত মনে হয়েছিল। দেখলেই বোঝা যায় ঢেউয়ের ধাক্কায় সবগুলো পাহাড় একদিকে ফিরে গেছে। আল আইনের পাহাড়গুলোর উচ্চতা ছিল একহাজার ফুট। একহাজার ফুট ওপরে অসংখ্য ঝিনুক সাক্ষ্য দিচ্ছে এই পাহাড় একসময় পানির নীচে ছিল। প্রায় তের হাজার ফুট উঁচু রকি পর্বতশ্রেণী থেকে সংগৃহিত ঝিনুকভর্তি পাথরগুলোও দেখলাম একই কথা বলে। অনেক পাথরে প্রাগৈতিহাসিক মাছের ছাপ, পাতলা পাখনাগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যেন সে এখনই লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে পাথর থেকে। অনেক পাথরে প্রাগৈতিহাসিক পাতার ছাপ, মনে হচ্ছে পাথরে আঁকা ছবি! নীচতলায় গিয়ে মনে হোল আমি পাগল হয়ে যাব। ওপরতলায় অনেকগুলোই প্লাস্টিক মডেল থাকলেও এখানে সব আসল ফসিল। বিরাট মাছের ফসিল, চারমানুষ সমান লম্বা। বেচারার গায়ে যখন মাংস ছিল তখন সে নিশ্চয়ই আরো লম্বা ছিল। সত্যিকার টাইরেনোসরাস, অ্যালোসরাস, ট্রাইসেরাটপ, স্টেগোসরাস আরো অনেক ডাইনোসরদের সম্পূর্ণ ফসিল- দাঁড়ানো, বসা, শোয়া কত যে ভঙ্গিতে! মনে হচ্ছিল খুশীতে পাগল হয়ে যাব! ডাইনোসর দেখার এর চেয়ে কাছাকাছি আসা তো আর সম্ভব না! একপাশে একটা দরজা দেখে কৌতুহলী হয়ে ঢুকে দেখি প্রাগৈতিহাসিক বনভূমির একাংশ তৈরী করা হয়েছে, আসল নকল সব মিলিয়ে, তাতে গ্রামের পাতাঝরা বনভূমির মত একটু ভেজা একটু মদির পাতাপঁচা গন্ধ। এই ধরণের বনভূমিতে একসময় চরে বেড়াত এসব অতিকায় প্রাণী! মিউজিয়াম শেষ হয়ে গেল। বাইরে এসে দেখা পেলাম সেই বস্তুর যার মোহনীয় সৌন্দর্য নিজ চোখে দেখার স্বপ্ন দেখেছি কত- পেট্রিফাইড গাছের প্রস্থচ্ছেদ। এই গাছগুলো ঝড়ে বা বন্যায় নদীর তলদেশে চাপা পড়ে গেছিল। তাদের খাজে খাজে মাটি আর খনিজ জমে মূল গাছ পচে গেলেও তার আকৃতি ধারণ করে জন্ম নিয়েছে ফসিল। এই ফসিলের মধ্যস্থিত খনিজ লবণের কারণে এতে নানান রঙের খেলা। এগুলো আবার ঠিক জাইলেম ফ্লোয়েম যেভাবে ছিল সেভাবেই সেজেছে! কি যে অদ্ভুত তা বর্ণনা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে যখন ডাইনোসরদের পতন হয় তখন তারা পৃথিবীতে বসবাস করছে ১৬০ মিলিয়ন বছর ধরে। কিন্তু তাদের ধ্বংস করতে আল্লাহর প্রয়োজন হয়েছে কেবল একটিমাত্র পাথরখন্ড (অ্যাস্টেরয়ড) যার অসংখ্য নমুনা পৃথিবীর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সময় লেগেছে মোটে একদিন। এদের মাংস আর চারণভূমি এখন আমরা গাড়ীতে পেট্রোল আর ডিজেল হিসেবে ব্যাবহার করছি, আকাশে প্লেন ওড়াচ্ছি, রকেটে পুরে চলে যাবার স্বপ্ন দেখছি গ্রহান্তরে। কিন্তু কেউ ভাবছি না মূহূর্তের জন্য- এই পরিণতি কিন্তু আমার জন্যও অপেক্ষা করছে! |
No comments:
Post a Comment