গতকাল হাফিজ সাহেবের সাথে ব্লগ নিয়ে গল্প করছিলাম। কথাপ্রসঙ্গে বললাম ছোটভাই স্বপ্নচারীর প্রোফাইলের কথা। তিনি লিখেছেন, “অনির্দিষ্টকালের জন্য আত্মার উন্নয়ন কাজ চলিতেছে”। আমার এই ভাইটি একটি সুন্দর জগতের স্বপ্ন দেখেন। তাই বাস্তব জগতের পঙ্কিলতা আর মানুষের ক্ষুদ্রতা তাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। বার বার তাকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করি, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি মানুষের মানবতায়।
সমস্যা হোল মাঝে মাঝে নিজেই মুষড়ে পড়ি। কিন্তু বড় হবার একটা বিশেষ সমস্যা আছে। আমার বাবা বলত, “সংসারের বড় সন্তানগুলো গাধা হয়”। গাধার মতই ভারবাহী, গাধার মতই বোকা। সবার দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। সে নির্বিকারে খেটে যায় সবার প্রয়োজন এবং আবদার পূরণ করার জন্য। নিজের প্রায় শখ আহ্লাদ অপূর্ণ রয়ে যায় তার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা। সবার মনে হয়, “তার আমাদের জন্য অনেক কিছু করা উচিত, সে কিইবা এমন করেছে?” ছোট ভাইবোনেরা সেদিক থেকে অনেক চালাক হয়। ওরা নিজেদের সবকিছু আদায় করে নিয়ে যখন নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন আর কারো দায়িত্ব নেবার চেষ্টাও করেনা- দায়িত্ব নেয়ার জন্য তো বড়জনই আছে! ব্যাতিক্রম আছে, তবে সেটা নিয়মের মধ্যে ফেলা যায়না। কিন্তু ঘাতপ্রতিঘাতে বড়জনের মনটা একসময় কঠিন হয়ে যায়। সে নিজের অনুভূতিগুলোকে দমন করতে করতে একসময় সেগুলো প্রকাশ করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। মেশিনের মত নিজের কাজ করে যায়।
সংসারে সবার বড় ছিলাম, অনুভূতি জিনিসটা বাদ পড়েছে সেই ছোটবেলায়। ব্লগে এসেও সেই একই অবস্থা। সবাই আদর করে ‘আপুজি’ বলে। এখন আমিও যদি ছোটদের কান্নায় সুর মেলাই, বলি মানুষের বিবেক বুদ্ধিহীনতায় আমি স্তম্ভিত, বিস্মিত, শংকিত, আশাহত, আহত- যদি আমি তাদের জাগিয়ে না তুলে সেই হতাশা আর ব্যাথার সাগরেই ডুবিয়ে দেই…
অনেক ভাবি আর আশ্চর্য হবনা। অনুভূতির মত বিস্মিত হবার ক্ষমতাকেও বলি দিয়ে দেব। তবুও সে বার বার মৃতাবস্থা থেকে উঠে আসে। আমার ছেলেমেয়েকে বোঝাই, “এই শরীরটা তো আর আমি না, আমার ভেতর যে আত্মা আছে সেটাই আসল আমি। এই শরীরটা যেমনই হোক, এই আত্মাকে উন্নত করতে হবে। তখন আমি বলতে পারব মানুষ হবার চেষ্টা করছি। তা নইলে আমার যত বড় নামযশ হোক না কেন আমি নিজেকে মানুষ বলতে পারবনা”। অথচ চারপাশে মানুষগুলোকে দেখি কি অনায়াসে ভুলে থাকে তাদের একটা আত্মা আছে, সেই আত্মার খাবারের প্রয়োজন আছে, বেড়ে ওঠার দরকার আছে, বেঁচে থাকার অধিকার আছে! বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে মানুষ কি অনায়াসে টাকাপয়সা, খ্যাতি, ফুর্তি আর আরামের পেছনে ছুটে চলেছে! কেউ ভেবে দেখছেনা আমার কি করা উচিত, সবাই ব্যস্ত এই ভাবনায় আমার কি পাওয়া উচিত!
আমার বাসায় আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠির পয়সা বাঁচানোর জন্য কখনো চুলা নেভাইনা এটা কোন সমস্যা না, কিন্তু দেশের বাইরে গ্যাস রপ্তানী করা হবে বলে রাস্তায় গাড়ী ভাংচুর করি জ্বালাই পোড়াই! ঐ গাড়ীটা যার তিনি কি কষ্ট করে গাড়ীখানা কিনেছেন তিনিই জানেন, কিন্তু আমার তো গাড়ী নেই সুতরাং অন্যের গাড়ী ভাংতে আমার কি আসে যায়! যারা বাসে চলাফেরা করেন তারা জানেন বাসে কি ভীড়, কি কষ্ট। দেশের জনগণের কি সমস্যা হবে ক’খানা বাস কমে গেলে তা নিয়ে কার মাথাব্যাথা? আমি তো দেশকে ভালোবেসে নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বাস পোড়াচ্ছি! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় পৃথিবীতেই একমাত্র আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আমরাই কেবল দেশকে ভালোবাসি, সুতরাং আমরা যা ইচ্ছা যেমন ইচ্ছা করতে পারি- নইলে স্বাধীনতার আর কি মানে?
এক ভাই একবার বলেছিল, “আপু, আমি যখন রিক্সায় করে যাই, পাশে কোন গাড়ী দেখলে রিক্সাওয়ালাকে বলি গাড়ীতে চাকার ওপরের পাত ঘষে একটু দাগ করে দিতে, আমার গাড়ী নেই তাই অন্যলোকে গাড়ীতে চড়লে সহ্য করতে পারিনা”। আমি হতবাক হয়ে গেছিলাম! যদিও হবার কোন অধিকার আমার ছিলোনা। আমাদের দেশে যে কেউ সামনে একটা টেবিল চেয়ার পেলে আর কাউকে মানুষ বলে পাত্তা দেননা, শ্বাশুড়ী হতে পারলে কেউ আর বৌকে মানুষ মনে করেন না, রাস্তায় আর কোন রিক্সা না থাকলে রিক্সাওয়ালা দাম হাঁকেন ডাবল। আমার কি আশ্চর্য হওয়া উচিত?
এক ভাই বলছিলেন, “আপু, মানুষের জন্য করি, করতে ভালো লাগে। কিন্তু আমার যখন কোন সমস্যা হয় তখন আর আশেপাশে কাউকে পাইনা”। এতে কি আমাদের আশ্চর্য হওয়া উচিত? এই না হলে মানুষ! নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়। আমি নিজেই কি মানুষ?
তবুও আশা জাগে যখন ছোটভাই রাহাত চিঠি দেয়, “আপু আপনি সবসময় আমাদের সাহস দেন, কিন্তু আমরা কেউ কি ভাবি আমরা আপনার জন্য কি করতে পারছি?”, যখন স্বপ্নচারী বলেন, “অনির্দিষ্টকালের জন্য আত্মার উন্নয়ন কাজ চলিতেছে”। বিশ্বাস জাগে আমার ছোট ভাইবোনগুলো নিশ্চয়ই বয়ে আনবে সেই সুন্দর পৃথিবী যেখানে মানুষ নিজের জন্য না ভেবে পরের জন্য ভাববে, যেখানে সবাই সবার প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করবে, থাকবে বিশ্বাস আর মায়ার বন্ধন, যেখানে মানুষ পাওয়ার চেয়ে দিতে পছন্দ করবে, যেখানে মানুষ সুন্দর একটি জীবন গড়ার জন্য পরস্পরকে সাহায্য করবে। কিছু আত্মাসম্পন্ন ‘মানুষ’ আমাদের বড় প্রয়োজন! কি, পারবনা আমরা সবাই মিলে আমাদের আত্মার উন্নয়ন করে আগামী প্রজন্মকে এমন একটি পৃথিবী উপহার দিতে?
No comments:
Post a Comment