সময় সময় আমার মাথায় অদ্ভুত সব খেয়াল চাপে। যেমন আজ ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পী সোনু নিগামের ভারী দরদমাখা একখানা গান শুনে ভাবছিলাম এই লোকটার গলায় আল্লাহ এত দরদ ঢেলে দিয়েছেন, এত সুন্দর স্পষ্ট উচ্চারণ মাশাল্লাহ! পরে মসজিদে জুমার নামাজের সময় ইমাম সাহেবের ভারী তাৎপর্যপূর্ণ অথচ ভাঙ্গা গলায় ভুল উচ্চারণে খুতবা শোনার সময় মনে হোল সোনু নিগাম যদি এই অসাধারন গলায় পার্ফেক্ট উচ্চারণে কুর’আন তিলাওয়াত করতেন বা খুতবা দিতেন কেমন হত? হাসি পেল? কল্পনার ডানায় ভর করে যেকোন জায়গায় উড়ে যাওয়া যায়, ভাগ্যিস কল্পনাতে কেউ শেকল পরিয়ে দিতে পারেনা!
এমনই সব বিচিত্র খেয়ালী ভাবনা বসবাস করে আমার এলোমেলো মাথাটায়। এমন সব জিনিসে হাসি পায় যেটা কেউ দেখতেই পায়নি বরং কাউকে বোঝাতে গেলে হাসির মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়, এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব ঘটনায় অনুভূতিতে ভারাক্রান্ত হই যেগুলো হয়ত স্বাভাবিকভাবে কারো মাঝে কোন অনুভূতির উদ্রেক করেনা, আবার এমন সব কঠিন পরিস্থিতিতে শক্ত এবং অনড় থাকি যেখানে অনেকেই স্থির থাকতে পারেনা। আমার ধারণা এই বিচিত্র ব্যাপারগুলো হয় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে। একই বস্তুতে একজন খুশি এবং আরেকজন বিরক্ত হতে পারে, যেমন যে সিগারেট খায় সে নিশ্চয়ই এতে আনন্দদায়ক কিছু একটা খুঁজে পায় যদিও আমার মনে হয় পয়সা দিয়ে এমন বিষ কিনে খেয়ে লাভ কি যা ধুঁকে ধুঁকে মারে, একবারে মরে গেলে নাহয় একটা কথা ছিল। এটা কারো উদার বা সংকীর্ণ হবার ব্যাপার নয়, বড় বা ছোট হবার মত কোন কিছু নয়, এমনকি ভাল বা খারাপের কোন সংজ্ঞায়ও একে সংজ্ঞায়িত করার কোন কারণ নেই। এটা কেবল নিজের জীবনকে সহজ বা কঠিন করে দেখার বিষয়।
আজকাল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যখন বলতে শুনি সবকিছু ‘বোরিং’, ‘আগের দিনগুলো মিস করি’ বা ‘এমন হলে কতই না ভাল হত’; অথবা বন্ধুদের চিন্তা করতে দেখি ‘আহা, এমন যদি হত’, ‘এমন হলে কি হবে’ বা ‘কেন যে এমন হোলনা’ আমার খুব হাসি পায় আবার দুঃখও লাগে। আত্মসমালোচনা মানুষকে উত্তরোত্তর উন্নততর মানুষে রূপান্তরিত করে কিন্তু জীবনের সমালোচনা মানুষকে কেবল হতাশাই দেয়। জীবনের কোন এক পর্যায়ের বা ঘটনার সাথে আরেক পর্যায়ের বা ঘটনার তুলনা করা অসুখী হবার সবচেয়ে কার্যকর রেসিপি। যেমন অনেক মেয়েদেরই বলতে শোনা যায়, ‘আহারে, বিয়ের আগে এমন ছিল, আর বিয়ের পর আরেকরকম’। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা মনে হয় সবুজ আর লাল আপেলের মাঝে তুলনা করার মত- দু’টোই আপেল, কিন্তু চেহারা এবং স্বাদের দিক থেকে দু’টো অনেক আলাদা। তার মানে এই নয় যে একটি ভাল এবং অপরটি খারাপ, বরং দু’টো দু’রকম ভাল। এখানে তুলনা করাটাই অবান্তর এবং এই তুলনার শেষফল হতাশা। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের স্বাদ আলাদা, চ্যালেঞ্জ আলাদা, তাৎপর্য আলাদা। সুতরাং, কোন পর্যায় কেমন তা তুলনা না করে বরং প্রতিটি পর্বকে যথাসম্ভব উপভোগ সহকারে কার্যকর করার মাঝেই সার্থকতা নিহিত।
অনেক সময় কাউকে আফসোস করতে দেখা যায়, 'কেন এমন না হয়ে তেমন হোল, এমন হলে কতই না ভাল হত!' এটা আমার কাছে একপ্রকার অকৃতজ্ঞতা মনে হয়। প্রথমত, আমরা জানিনা কি হলে কেমন হত এবং যিনি বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি এবং পরিচালনা করছেন তিনিই ভাল জানেন কি হলে কি হত, এতটুকু বিশ্বাস মনে হয় আমরা তাঁর ওপর রাখতে পারি। দ্বিতীয়ত, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে আমি এক বন্ধুর সাথে থাকি কিন্তু আমি কেবল তার দোষগুলোই দেখতে পাই; অথচ সে আমার প্রতি কতটা সহৃদয় বা সহানুভূতিশীল, সে আমার কতখানি উপকারী বন্ধু তা আমার চোখেই পড়েনা। সেক্ষেত্রে আমাদের মাঝে সম্পর্ক কতদিন ভাল থাকবে তা হিসেব কষে বের করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবেনা। একইভাবে আমাদের ফোকাস করা উচিত এমন সব জিনিসের প্রতি যেগুলো আমরা পেয়েছি বা পাচ্ছি যা হয়ত অনেকের নেই, অথচ তাদের যোগ্যতা বা অধিকার কোনদিক থেকেই আমাদের চেয়ে কম নয়। সেক্ষেত্রে যতটুকু যা পেলাম তার সবই লাভ, সবই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎস মনে হবে। আর জীবনের খুঁত খুঁজতে গেলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে, ‘আমার যা আছে তা পাবার মত কি যোগ্যতা আছে আমার, বা কি এমন মহৎ কাজ আমি করেছি যে লক্ষ লক্ষ মানুষের তা নেই যা আমার আছে? এগুলোর হিসেব না কষে কি পাইনি তার হিসেব করতে বসার কি অধিকার আছে আমার?’
সৃষ্টিকর্তা কাউকে কম বেশি দেননা, তিনি সুবিবেচক তাই বিবেচনা করে যার যেটা প্রয়োজন তাকে সেটাই দেন। আবার লাল আর সবুজ আপেলের তুলনায় ফিরে যেতে হয়। তিনি কাউকে ধনসম্পদ দেন, কাউকে জ্ঞানবুদ্ধি দেন, কাউকে দেন শারীরিক সৌন্দর্য, কাউকে দেন সুন্দর স্বভাব- সবাইকে সব দেয়া নিষ্প্রয়োজন আবার যাকে যেটা দেন সেটা তার জন্য পরীক্ষার নিমিত্তও বটে। যার যেটা নেই সেটা নিয়ে সে কতটা ধৈর্য্যশীল থাকে সেটা যেমন তার জন্য পরীক্ষা, একইভাবে যার যেটা আছে সেটা সে কতটা কাজে লাগায় সেটা তার জন্য আরো বড় পরীক্ষা। যেমন, কেউ একজন জীবনে অনেক প্রতিকুলতা এবং সংঘর্ষের সম্মুখীন হোল- ধৈর্য্য এবং সাহসের সাথে এই পরিস্থিতির মুকাবিলা করা তার জন্য একপ্রকার পরীক্ষা। কিন্তু সে যদি ভাল বুঝতে এবং বুঝাতে পারে সেক্ষেত্রে সে এই মেধা অন্যের উপকারে ব্যাবহার করল কিনা, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্যকে একই পরিস্থিতির মুকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করল কিনা, নাকি মর্মাহত হৃদয়ের খোরাক জুগিয়ে নিজের প্রতি করুণায় মূর্চ্ছা যেয়ে জীবন কাটিয়ে দিল এবং অন্যের সহযোগিতার চেষ্টাকে দায়িত্ব মনে করলনা এটাও তার জন্য পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় কার প্রশ্নপত্রে কি আছে তা খুঁজে বের করার চেয়ে নিজের প্রশ্নে কি আছে এবং এর উত্তর কিভাবে দিলে বেশি মার্কস পাওয়া যেতে পারে এই পদ্ধতি অবলম্বন করাই অধিকতর কার্যকর। সেক্ষেত্রে নিজের সীমাবদ্ধতাকে উত্তরণ করা যেমন সহজ হয় তেমনি অন্যের যোগ্যতাকে সম্মান করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়।
আজ এমন একজনের কথা খুব মনে পড়ছে যার কথা মনে হলেই অনুভূতিগুলো গলায় দলা পাকিয়ে যায়। ছোটবেলায় আবুধাবীতে ছিলাম। সকালের অধিবেশন শুরু হবার আগেই আমরা টিভি ছেড়ে বসে যেতাম যেন কার্টুন মিস না হয়। প্রতিদিন অধিবেশন শুরু হত কুর’আন তিলাওয়াত দিয়ে। একেকদিন একেকজন ক্কির’আত করতেন। এক ব্যাক্তি প্রায়ই কুর’আন তিলাওয়াত করতেন গাঢ় কালো চশমা পরে। আমরা ভাইবোনরা এই মডার্ন ক্কারীকে দেখে খুব মজা পেতাম। পরে একদিন বুঝতে পারলাম তিনি স্টাইলের জন্য চশমা পরেন না, চশমা পরেন কারণ তিনি অন্ধ। তাঁকে দেখে হঠাৎ নিজের প্রতি করুণা উৎলে উঠল। হ্যাঁ, তাঁর প্রতি নয়, নিজের প্রতি। কেউ দেখে দৃষ্টি দিয়ে, আর কেউ দেখে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। আল্লাহ তাঁকে দৃষ্টি দেননি কিন্তু তাঁর অন্তর এতখানি প্রশস্ত করে দিয়েছেন যে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোকিত কিতাবটি তিনি দৃষ্টিহীন হয়েও হৃদয়ে ধারণ করে আছেন। অথচ আল্লাহ আমাকে সুস্থ সবল করে তৈরী করেছেন, চোখে কোনদিন চশমা লাগেনি, হাজার হাজার বই পড়েছি দিনরাত বসে অথচ আল্লাহর বইটি পড়ার সময় হয়নি। তাহলে আমি এই চোখের কি কৃতজ্ঞতা আদায় করলাম?
এভাবে দৈনন্দিন জীবনের এক একটি উপহার নিয়ে যদি এক একটি মূহূর্তও চিন্তা করি আমরা- কৃতজ্ঞতার জোয়ারে ভেসে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবেনা, আর কিছু চিন্তা করার সময় থাকবেনা, জীবনের প্রতি কোনপ্রকার অসন্তুষ্টি অনুভব করার উপায় থাকবেনা।
তাই জীবনে যতই হতাশা আসুক বা কঠিন মূহূর্ত, আমরা ঐ মূহূর্তটিকে যদি যথার্থ সম্মান করতে পারি, ঐ মূহূর্তের চ্যালেঞ্জটিকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে মুকাবিলা করতে পারি, ঐ সময়টিই যে আমার জীবনের সুন্দর সময়গুলোর সৌন্দর্য আমার কাছে সম্যকরূপে তুলে ধরে তা অনুধাবন করতে পারি- তাহলে শেলীর মত আমরাও বলতে পারব- ‘Our sweetest songs are those that tell of saddest thought’. তখন আমাদের হৃদয়ে ঘাসফুলের মোহনীয় গন্ধ, রংধনুর মনকাড়া রঙ, মেঘের আকারের সতত পরিবর্তনশীলতা, তেঁতুলের স্বাদ, বৃষ্টির ঝরঝর শব্দ, বন্ধুর হাসি, শিশুর পেলব ত্বকের ছোঁয়া- সবই আনন্দের উৎস হয়ে ব্যাথাবিনাশকরূপে আবির্ভূত হবে; এই ভগ্ন অন্তকরণকে প্রতিদিন রিচার্জ করে তাকে সজীব করে তুলবে। তখন আমরা চোখে অশ্রু নিয়েও মন খুলে হাসতে পারব, মনে কষ্ট নিয়েও জীবনের মর্মার্থ খুঁজে পাব, জীবনের বন্ধুর পথ সাহসের সাথে পাড়ি দিতে পারব, কেউ পাশে না থাকলেও সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধুর হাত ধরে এগিয়ে যেতে পারব। চাই শুধু দৃষ্টিভঙ্গির একটু পরিবর্তন আর সর্বক্ষণ পাশে থাকা বন্ধুর ওপর বিশ্বাস।
No comments:
Post a Comment