Sunday, December 9, 2012

অল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফা

শনিবার দুপুরে শেষ ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের বিদায় করতে না করতে এক আপা ফোন করলেন, তারপর আরেকজন। তাঁদের সাথে আলাপ করছিলাম, ‘বুঝতে পারছিনা কেন এত ক্লান্ত লাগছে!’ কন্যার গলার আওয়াজ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখি ভাত তরকারী গরম করে প্লেটে নিয়ে আমার পেছনে পেছনে ঘুরছে, ‘আম্মু, তুমি সকালে নাস্তা খাওনি। এবার টেলিফোন রাখ তো! আগে খেয়ে নাও, তারপর জনসংযোগ কর’। আমার মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই ভুলোমনা মায়ের জন্য মায়ের ভূমিকা পালন করে আসছে। মা-মেয়ের এই ভালবাসার বন্ধন এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতার অনুভূতিকে বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ তরজমা করেছেন এভাবে, ‘আহারে! মেয়েটার মা সারাদিন শুয়েবসে কাটায় আর মেয়েটাকে দিয়ে সংসারের সব কাজ করায়!’ এই আচরণে কষ্ট পেয়ে সেদিন আমার ননদের সাথে আলাপ করছিলাম। কাঁচের মত স্বচ্ছ অন্তরবিশিষ্ট এই ননদিনী দুঃখ করে বলল, ‘কি করবেন ভাবী? রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যাক্তি তার মুখ এবং লজ্জাস্থানের গ্যারান্টি দেবে তাকে তিনি বেহেস্তের গ্যারান্টি দেবেন। অথচ আমরা অধিকাংশই লজ্জাস্থানের হেফাজতের ব্যাপারে সচেতন হলেও মুখের ব্যাপারে সচেতন নই। তাই প্রায়ই দেখা যায় মিথ্যা ধারণাপ্রসূত গীবত, বাজে চিন্তা, বাজে কথা, কষ্টদায়ক কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে আমাদের যৎসামান্য সৎকাজগুলো অর্থহীন হয়ে যায়!’




আমার এক ছাত্রী ক’দিন আগে একটা হাদিস উল্লেখ করল যার সারবস্তু হোল, ‘দুই মহিলা ছিলেন যাদের একজন প্রচুর নামায পড়ত, রোজা রাখত এবং নফল ইবাদত করত কিন্তু তাঁর জিহ্বা ছিল ক্ষুরধার। অপরজন কেবল ফরজ ইবাদতটুকুই করত কিন্তু সে মানুষের সাথে অত্যন্ত ভাল ব্যাবহার করত এবং কাউকে জিহ্বা দ্বারা কষ্ট দিতনা। প্রথমজন ছিল জাহান্নামী এবং দ্বিতীয়জন ছিল জান্নাতী’। এতে অবাক হবার কিছুই নেই কারণ ইবাদত আল্লাহর হক্ক, এতে কমবেশি হলে আল্লাহ চাইলে মাফ করে দিতে পারেন। কিন্তু বান্দার হক্কের ব্যাপারে তিনি বার বার সাবধান করেছেন কারণ আল্লাহ সুবিচারক, সুতরাং অন্যের হক্ক মাফ করার মত অবৈধ হস্তক্ষেপ তিনি করবেন না। এর অর্থ এই নয় যে আপনার ওপর স্টীমরোলার চালানো হবে অথচ আপনি ‘উহ’ পর্যন্ত করবেন না, কিন্তু আপনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কারো কষ্টের কারণ হবেন না। আমি যখন আব্বাকে (আমার শ্বশুর) দেখি, আমার সেই দ্বিতীয় নারীর উদাহরণটাই মনে আসে। তিনি সময়মত নামায পড়েন, ভাড়াটিয়াদের সবার সুবিধা অসুবিধার খবর রাখেন, তাঁর মটরসাইকেলটা নিয়ে খুটখাট করেন, কারো যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে ঠিকঠাক করে দেন, ক্রিকেট দেখেন, পত্রিকা পড়েন, দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুম দেন এবং অত্যন্ত অল্প কথা বলেন- কিন্তু কারো প্রয়োজনে সবার আগে এগিয়ে আসেন। রিটায়ার্ড হলেও টায়ার্ড নন মোটেই। কারণ তাঁর মাথায় কোন বাজে চিন্তা গিজগিজ করেনা। তিনি নিজের জন্য এমন এক পৃথিবী গড়ে নিয়েছেন যা থেকে তাঁর অবসরই মেলেনা, তো ফাউ চিন্তা করবেন কখন?

বাজে চিন্তা অনেকাংশে মানুষের জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ফেলে অথচ অধিকাংশ মানুষই এর থেকে মুক্ত হতে পারেনা। আমার মা এবং খালা যথাক্রমে লো এবং হাইপ্রেসারের রোগী কিন্তু দু’জনেরই মূল সমস্যা অতিরিক্ত চিন্তা করা। একদিন ভাবলাম দু’জনকে বসিয়ে একখানা লেকচার দেই। বললাম, ‘তোমরা দু’জন কি নিয়ে চিন্তা কর বল তো?’ দু’বোনে মিলে এক বিশাল তালিকা পেশ করল যে তালিকায় এমন কিছু বাদ নেই যা এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে বিদ্যমান অথচ এমন কিছুই নেই যা তারা প্ল্যানিং,অ্যাকশন বা রি-অ্যাকশনের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। আমি টেবিলের ওপর গ্লাস দেখিয়ে বললাম, ‘তোমরা যদি দু’জনে সম্মিলিতভাবে এই মূহূর্ত থেকে কিয়ামত পর্যন্ত চিন্তা কর, এই গ্লাসটাকে এক মিলিমিটার নাড়াতে পারবে?’ দু’জনেই না-বোধক উত্তর দিল। আমি বললাম, ‘তাহলে আর কিসের চিন্তা কর? আমাদের কাজ চেষ্টা করা এবং দুয়া করা, এরপর পজিটিভ নেগেটিভ যাই হয় তাতে আমাদের কিছু বলার বা করার নেই’। যাই হোক, লেকচারে তাদের কারো বিশেষ উপকার হয়েছে বলে মনে হয়না কারণ তাঁরা দু’জনেই এখনো দ্বিবিধ প্রেসারের রোগী। আর আমি? সময় যত কঠিন হতে থাকে, আমার ঘুম তত বাড়তে থাকে, কারণ আমি জানি আমার এক্ষেত্রে করণীয় কিছু নেই যার দায়িত্ব তিনি সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত। জীবনের অর্ধেকের বেশি পার করে এসেছি এই পদ্ধতিতে, কোন সমস্যা হয়নি, বরং সাময়িকভাবে কষ্ট পেলেও জীবন পানির মত সহজ হয়ে গিয়েছে এবং আমি পালকের মত হাল্কা হয়ে গিয়েছি।

বাজে চিন্তার আরেকটি বাজে ধরণের খোরাক হচ্ছে মানুষের ব্যাপারে বাজে চিন্তা করা। একবার কোন এক ব্যাক্তি রাসূল (সা)কে কারো নামে শোনা কথা বলতে এলে তিনি বলেন, ‘তুমি কেন তার ব্যাপারে ভালটাই ধারণা করলেনা?’ যেখানে অন্য কেউ বাজে ধারণা করলেও প্রত্যুত্তরে ভাল ধারণা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে সেখানে বেকার প্রকৃতির লোকজন বই পড়া, কাজ করা বা ন্যূনতম নিজের উন্নতির দিকে নজর দেয়ার চেয়ে অপরের ত্রুটিবিশ্লেষণ এবং প্রচার নিয়ে ব্যাস্ত থেকেই আনন্দ পায়। অথচ আল্লাহ বলছেন, ‘হে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা বেশী বেশী ধারণা-অনুমান করা থেকে দূরে থাকো, কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। আর তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পিছনে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা ঘৃণ্যই মনে করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো; আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু। [সূরা হুজুরাত: ১২]। মৃত ভাইয়ের মাংস খাবার মত ভয়ানক কাজের সাথে তুলনা করা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ এবং বিশেষ করে মহিলারা পড়াশোনাসহ অনেক জরুরী কাজের সময় না পেলেও অন্যের ব্যাপারে নানাবিধ ধারণা করার সময় ঠিকই পান! কিন্তু আমাদের সৃষ্টিশীল এবং জ্ঞানানুসন্ধানী প্রবৃত্তিগুলোকে উৎসাহিত এবং নিজের দুর্বল দিকগুলোকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। যেমন, আমি একদিন আমার ছাত্রীদের প্রশ্ন করলাম, ‘ধর, তুমি নিজ চোখে দেখলে তোমার পরিচিত একটা মেয়ে একজন অপরিচিত লোকের সাথে রিক্সায় চড়ে কোথাও যাচ্ছে। তোমরা কি ধারণা করবে?’ অধিকাংশই বলল, ‘ম্যাডাম, ঘটনা পরিষ্কার। সে কারো সাথে অ্যাফেয়ার করছে’। আমি বললাম, ‘এখানেই তোমাদের রুচিশীলতা, বুদ্ধি এবং বিবেচনার পরিচয় দেয়ার সুযোগ। লোকটা ওর ভাই, মামা বা চাচা হতে পারেনা? এমনও তো হতে পারে লোকটা ওর বর কিন্তু ওর বিয়ের খবর তুমি পাওনি। এমন হতে পারে ওর পরিবারের কারো কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ওর নিরুপায় হয়ে কারো সাথে ঘটনাস্থলে যেতে হচ্ছে, আর কোন বাহন পাওয়া যাচ্ছেনা। আমরা কারো ব্যাপারে কিছু শুনলে বা দেখলে কেন প্রথমে নিজের মনেই যাচাই করে নেইনা এই ব্যাক্তির পক্ষে আদতেই এমন কিছু করা সম্ভব কিনা? কেন আনন্দে গদ গদ হয়ে খারাপটাই সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নেই সমস্ত যুক্তির বিরুদ্ধে?’

আমরা নিজের হক্কের ব্যাপারে সর্বাবস্থায়ই সচেতন কিন্তু কেন অপরের হক্কের ব্যাপারে এত অসচেতন? একবার কর্তৃপক্ষের অসাধুতার কারণে আমি এবং এক সহকর্মী ভাই আমাদের প্রাপ্য হতে বঞ্চিত হলাম। পরে পত্রিকায় তাদের সমাজসেবী কর্মকান্ডের কথা পড়ে আশ্চর্য হয়ে বললাম, 'ওরা আমাদের প্রাপ্য হতে আমাদের বঞ্চিত করছেন অথচ ওদিকে সমাজসেবা করছেন!' ভাই বললেন, 'আপা, মনখারাপ করবেন না, দুয়া করেন তারা আরো ভাল ভাল কাজ করুক'। আমি বললাম, 'তাতে আমাদের কি লাভ?' উনি বললেন, 'আমরা যখন কিয়ামতের দিন আমাদের প্রাপ্য বুঝে নেব তখন ওদের সবচেয়ে ভাল ভাল কাজগুলো আমরা নিয়ে নেব, তখন পেলেই তো লাভ বেশী, কি বলেন?' মনটা খুব ভাল হয়ে গেছিল সেদিন। তার কিছুদিন পর পড়েছিলাম হাদিসটা যেখানে রাসূল (সা) বলেছেন, কিয়ামতের দিন অনেক ব্যাক্তি পাহাড়প্রমাণ সাওয়াবের স্তুপ নিয়ে উত্থিত হবে। তারা আত্মতুষ্টিতে ভুগবে যে তাদের বেহেস্তপ্রাপ্তি নিশ্চিত, চিন্তার কিছুই নেই। কিন্তু একটু পর আগন্তুকের দল এসে দাবী করতে শুরু করবে সে বিভিন্নসময় তাদের ছোটখাট অধিকার হরণ করেছে, মনে কষ্ট দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা করেছে ইত্যাদি। আল্লাহ বলবেন তাদের দাবী অনুযায়ী সাওয়াব দিয়ে তাদের বিদায় করে দিতে। তারা ভাববে এই বিশাল পাহাড়সম স্তুপ থেকে ক’খানা কমে গেলে কিইবা এমন আসে যায়? কিন্তু দলে দলে আগত দাবীদারদের সন্তুষ্ট করতে করতে তাদের সম্পূর্ণ স্তুপ নিঃশেষ হয়ে যাবে। তারপরও কিছু দাবীদার আসবে। তখন তারা বলবে, আমাদের তো দেবার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই! তখন আল্লাহ বলবেন, তাহলে তাদের দাবী অনুযায়ী গুনাহ তারা তোমাকে দিয়ে নিজেদের গুনাহ কমিয়ে নিক। পরিশেষে তারা একপাহাড় গুনাহ নিয়ে দোজখে প্রবেশ করবে! পড়ে শিউরে উঠেছিলাম শঙ্কায়।




কিন্তু গতরাতে ভাইয়ের কথাগুলো মনে পড়ে মনটা বেজায় খুশী হয়ে গেল। যারা আমার প্রতি অযাচিতভাবে অন্যায় করছে, আমাকে কষ্ট দিচ্ছে- দুয়া করি তারা আরো বেশী বেশী নামাজ, রোজা, দানসদকা, আর নফল ইবাদাত করুন। কারণ এগুলো কিয়ামতের দিন আমার সম্পদ হবে!

No comments:

Post a Comment