Sunday, December 9, 2012

ধোঁকা

কাজটা আমিও করি। হয়ত বাচ্চারা গন্ডগোলের চূড়ান্ত করছে, বলে দিলাম, ‘তোমরা যদি কিছুক্ষণ নিজেদের রুমে চুপচাপ বসে থাক তাহলে আব্বু বিকালে বাইরে নিয়ে যাবে’। ঐদিকে বেচারা ঘরকুনো লোকটা জানেই না তার ওপর কি বিপদ আসন্ন।

বিবাহিত মাত্রেই কখনো না কখনো নিজের কথা স্বামী বা স্ত্রীর নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়া একটা সচরাচর ব্যাপার- কখনো বাচ্চাদের শাসন করা জন্য, কখনো অনাকাংখিত দাওয়াত এড়িয়ে যাবার জন্য, কখনো স্রেফ নিজের দোষ ঢাকার জন্য। এটাকে তেমন একটা কেউ মিথ্যার মধ্যে ধর্তব্য বলেও মনে করেন না।

সৌভাগ্য হোল বাচ্চারা এই মিথ্যাগুলো ধরতে পারেনা তাই শাসন করার ক্ষেত্রে এটুকু leverage বেশ কাজে লাগে। অনেকক্ষেত্রে বাচ্চারা বাবা বা মা যাকে ভয় পায় তার কথা বলে তাদের সুপথপ্রাপ্ত করা যায়।

সামাজিক শিষ্টাচারের মধ্যে যে কিছুটা কপটতা থাকে তার অংশ হিসেবে অপ্রিয় বা অসম্ভব ব্যাপারে সরাসরি না বলা যায়না বা বলেও অনেক সময় পার পাওয়া যায়না। তাই একজন আরেকজনের নামে চালিয়ে দিলে মিথ্যা জেনেও কেউ কষ্ট পায়না, এটাকে আমরা বলি ভদ্রতা। অথচ কেউ সত্য বললে সবাই ভাবে অভদ্র। যেমন ক’দিন আগে- ঘুমোতে যাচ্ছি, প্রচন্ড ক্লান্ত, কি মনে করে যে কম্পিউটার খুললাম, আর খুলেই আটকে গেলাম। মেইল চেক করতে গিয়ে দেখি স্কাইপে মুহুর্মুহু কল আসছে। প্রথমে ঢাকা থেকে আমার সদ্যবিবাহিতা ননদিনী, ওর সাথে আমার খুব ভাব, তাই সরাসরি বললাম, ‘ওগো, আমার আর শক্তি নেই, আরেকদিন কথা বলব’। রাগ করল কিনা জানিনা কিন্তু বিদায় জানিয়ে চলে গেল। তারপর চট্টগ্রাম থেকে কাকী, কিছু বলার আগেই জানালেন সারাদিন ধরে খুঁজছেন, এবার আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই। মধ্যখানে কল এলো দাদার, অভ্র কিভাবে ডাউনলোড করতে হয়। কাকীকে হোল্ডে রেখে দাদাকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম কিন্তু দশমিনিট পর আর ধৈর্য্য রাখতে পারলাম না, দাদার কম্পিউটার স্ক্রীণ না দেখে instruction দিয়ে একটা আস্ত প্রোগ্রাম ডাউনলোড করানো... বললাম, ‘দাদা, আজ আমি বড় ক্লান্ত, কাল সকালে করিয়ে দেব’। আবার কাকীর কাছে ফিরে এলাম, জানালাম ক্লান্ত, বললেন শুধু একটা প্রবন্ধের ব্যাপারে আলাপ করবেন, তারপর আমার ছুটি। তারপর একে একে কাকা, কাকীর ছেলে, আমার ছোট্ট ননদটা (কাকী আমার শ্বশুরবাড়ীর নিকটতম প্রতিবেশী)। যখন কথা শেষ তখন রাত সাড়ে বারোটা। ঘুমোতে যাচ্ছিলাম তখন রাত সোয়া দশটা। মাঝখানে তিনজনের সাথে অভদ্র ব্যাবহারের সার্টিফিকেট জোগাড় হয়ে গেল!

তবে এই পদ্ধতি সবচেয়ে প্রচলিত বিশেষ করে লেখাপড়া বা ধর্মীয় বিষয়ে অপারগতা জানানোর জন্য। প্রায়ই মহিলারা বলেন, ‘বিয়ের পর আমার স্বামী আর আমাকে লেখাপড়া করতে দেননি’। সবার মাথায় নিশ্চয় ঐ হতভাগ্য মেয়েটির ছবি ভেসে উঠছে যার পাষন্ড স্বামী লেখাপড়া করার অপরাধে তার হাতের আঙ্গুল কেটে নিয়েছে। কিন্তু এটা exception, সচরাচর ঘটনা নয়। একজন পুরুষ যতক্ষণ অফিসে থাকেন ততক্ষণে একজন মহিলা ঘরের কাজ সেরে যদি সিরিয়াল দেখার বা ঘুমানোর সময় পান, তাহলে লেখাপড়ার সময় পেতে মানা করল কে? বইপত্র, পরীক্ষার ফিস? এমন পুরুষ কমই আছেন যারা বোঝেন না যে একজন সুশিক্ষিত স্ত্রীই গড়ে তুলতে পারে সুশিক্ষিত সন্তান। একজন পুরুষের যদি স্ত্রীর জন্য শাড়ি গয়না কিনতে টাকার অভাব না হয়, বই কেনার বেলা টাকার অভাব হয়ে যাবে এটা কিঞ্চিত বিচিত্র নয় কি? তাছাড়া বিয়ের পর তো একজন মহিলা বাবা, ভাই এর কাছেও পান আবার স্বামীর কাছেও পান। এরপর পড়াশোনা করতে না পারলে নিজের ইচ্ছার অভাবটাকেই মূখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সুতরাং, অধিকাংশ ক্ষেত্রে excuseগুলো কেবল নিজের অনিচ্ছা বা চেষ্টার অভাব ঢাকতেই দেয়া। হ্যাঁ, অবশ্যই স্বামী যদি প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন তাহলে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তুলনামুলকভাবে সহজ হয়, কিন্তু এর অভাব হলেও স্ত্রীর লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়ার মত প্রত্যক্ষ ভূমিকা মনে হয় কম লোকই পালন করেন।

একইভাবে দেখা যায় স্বামীরা দাড়ি রাখার ব্যাপারে বলে থাকেন, ‘আমার স্ত্রী পছন্দ করেন না’। কি মজার ব্যাপার! স্ত্রী তো আরো কত কিছুই পছন্দ করেন না! তিনি আপনার সিগারেট খাওয়া ঘৃণা করেন, ভাত খেয়ে এঁটোকাঁটা বোনপ্লেটে না ফেলে প্লেটে রেখে দেয়া অপছন্দ করেন, বাথরুম ভিজিয়ে প্লাবন ঘটানো পছন্দ করেন না, জোরে ফ্যান ছেড়ে ঘুমোলে তার অসুবিধা হয়, আপনার নাক ডাকায় তিনি বিরক্ত হন- কোনকিছুই তো আপনাকে আটকে রাখতে পারেনা! অথচ আপনি সুর করে পড়েন, ‘বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রসূল ও তাঁর রাহে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না' (সুরা তাওবাহঃ আয়াত ২৪) আর তারপর বলেন, ‘‘আমার স্ত্রী পছন্দ করেন না তাই আমি দাড়ি রাখতে পারিনা’!

একই কথা স্ত্রীদের জন্যও প্রযোজ্য। একবার ক্লাসে একটা নতুন মেয়েকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কবে ভর্তি হলে? চার সেমেস্টার তোমাকে দেখিনি, কোন নতুন ছাত্রীও ভর্তি হবার ব্যাপারে ডিপার্টমেন্টে কোন আলোচনা হয়নি...’। সে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি তো আপনার ক্লাসেই ছিলাম। আমি আগে নেকাব দিয়ে বোরকা পরতাম তাই আপনি কোনদিন আমার চেহারা দেখেননি। কিছুদিন আগে আমার বিয়ে হয়েছে, আমার স্বামী পছন্দ করেনা তাই আমি এখন আর পর্দা করিনা, আল্লাহ তো স্বামীর কথা শুনতে বলেছেন...’। বাহ! স্বামী পর্দা করা পছন্দ করেনা বলে সে নেকাব, বোরকা তো খুলেছেই, মাথার ওড়না পর্যন্ত খুলে ফেলেছে! আমরা সুর করে পড়ি, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা ও ভাইদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের যারা তাদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা সীমালংঘনকারী’ (সুরা তাওবাহঃ আয়াত ২৩) এবং ‘হে মুমিনগণ, তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের দুশমন। অতএব তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। যদি মার্জনা কর, উপেক্ষা কর, এবং ক্ষমা কর, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুনাময়। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষাস্বরূপ। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার’ (সুরা তাগাবুনঃ আয়াত ১৪-১৫) আর তারপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার ওপর তাদের প্রাধান্য দেই যারা বিচারদিবসে আমাদের দায়িত্ব নেবেনা!

আমাদের এক পরিচিতা তিনবছর ধরে চেষ্টা করার পরও যখন দেখল স্বামী নিজেও নামাজ পড়েনা এবং তাকেও নামাজে বাঁধা দেয় তখন এই কথা বলে চলে এলো, ‘আমি তোমাকে ছাড়তে পারব কিন্তু আল্লাহকে ছাড়তে পারবনা’। কিন্তু আমরা অধিকাংশই মুখে আল্লাহকে ভালবাসার কথা বললেও কার্যত বরং সমাজ, সংসার, সন্ততি, পরিজনকে আল্লাহর চাইতেও প্রিয় মনে করি। আশেপাশের লোকজনকে ধোঁকা দিতে গিয়ে আসলে নিজেরাই ধোঁকার মধ্যে রয়ে যাই, আর কারো কোন লাভক্ষতি হয়না।

No comments:

Post a Comment