Sunday, December 9, 2012

কতটুকু?

‘বুঝলে রাহী, আমি যতই নামাজদোয়া করিনা কেন, তোমার আন্টি আর আমার ছেলেমেয়েদের কারণে আমি দোজখেই যাব!’
মজার আলাপ হচ্ছিল নীলার বাবামার সাথে। মধ্যখানে হঠাৎ এমন গুরুগম্ভীর পারিবারিক প্রসঙ্গে নিজের অযাচিত উপস্থিতিতে বিব্রত বোধ করে রাহী- সচকিত হয়ে সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবী টুপি পরিহিত, শ্বেতশশ্রূমন্ডিত আংকেলের দুঃখী দুঃখী চেহারা থেকে আন্টির দিকে চোরাদৃষ্টিতে তাকায়- আন্টির হাসি হাসি মুখটা দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা তিনি কি ভাবছেন।
আংকেল বলতে থাকেন, ‘রাকিবের বিয়েতে তো তুমি আসনি, যে পরিমাণ অপচয় হয়েছে মা, আমি জানিনা আমি আল্লাহর কাছে কি জবাব দেব! পুরো বিয়েতে তোমার আন্টি আর আমার মেয়েরা যে পোশাক পরেছে... আমি তোমার আন্টিকে শুধু পায়ে ধরতে বাকী রেখেছি যে তুমি শাশুড়ি হয়ে গেছ, এবার তো মাথায় কাপড় তোল! কে শোনে কার কথা! তাই বলি, আমি বেহেস্তে যেতে গেলেও এরা আমাকে ওদের সাথে দোজখে টেনে নিয়ে যাবে’।
ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে রাহী, কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে কি বলা যায়? ভাগ্য ভাল এ’সময় নীলা একটা ছুতা করে ওকে অন্য ঘরে নিয়ে যায়।

রাহীর বিয়েতে যেতে ভাল লাগেনা, তাই নীলার ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়া হয়নি। ওর রাগ ভাঙ্গাতেই আসা। দুপুরে খাবার আগে বিয়ের ছবি দেখছিল রাহী- পরবে পরবে অনুষ্ঠান; প্রতিটি পরবের ছবি দেখেই মনে হচ্ছিল যেন কোন রাজরাজড়ার সভাকক্ষের ছবি যেখানে দেশবিদেশের রাজন্যবর্গ তাদের পোশাকপরিচ্ছদের বাহার আর গহনার ঝিলিকের মাধ্যমে তাদের অবস্থান আর ধনৈশ্বর্য্যের প্রদর্শনী দিতে ব্যাস্ত; চারিদিকে ফুলের ঝালর, আলোর ঝলকানি, খাবারের স্তুপ; পরীর মত ছেলেমেয়েদের স্বর্গীয় পোশাকে ছুটোছুটি। আন্টি আর নীলা বাসায় সার্বক্ষনিক শালীনতা বজায় রাখলেও বাংলাদেশের সনাতন পদ্ধতিতে বিয়েবাড়ীতে গিয়ে পোশাকের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন এবং প্রদর্শনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যান্য বান্ধবীদের নীলা চিনিয়ে না দিলে রাহী ছবি দেখে কিছুতেই তাদের চিনতে পারতনা, কারণ সবাইকেই হিন্দি সিনেমার নায়িকা বলে ভ্রম হচ্ছিল। এসবের মধ্যে আগত অতিথিদের কারো যে বরবধূর আগামী দিনগুলোতে সুখী হবার জন্য প্রার্থনা করতে মনে ছিল তা রাহীর ঠিক বিশ্বাস হোলনা, অথচ এটাই বিয়েতে মেহমান খাওয়ানোর উদ্দেশ্য! দুপুরে খাবার পর আংকেল আন্টি বিয়ের গল্প করতে রাহীকে ডেকে পাঠালেন। কথাবার্তায় সে বুঝতে পারল এই বিয়েতে যে ধুমধাম হয়েছে তাতে আন্টি অহংবোধ করলেও, যিনি খরচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট এবং বিয়েতে তাঁর পরিবারবর্গের বাড়াবাড়িতেও তাঁর সমর্থন ছিলোনা, কিন্তু পরিবারের অবুঝ সদস্যদের কাছে তিনি নিজেকে জিম্মি বোধ করছেন।

মানুষের ভাবনাগুলো টারজানের মত চিন্তার শাখাপ্রশাখায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। রাহীর মন চলে যায় আরেক ঠিকানায়। ওর মনে পড়ে, কিছুদিন আগে মামা মামী অ্যামেরিকা থেকে ঘুরতে এলেন। এবার এলেন প্রায় পাঁচবছর পর। সে দেখেছে যারা বিদেশ থেকে আসে তারা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের জন্য প্রচুর উপহার আনে, আর আনে নিয়ে যাবার জিনিসের বিশাল তালিকা। এই উপহারগুলি তাদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে বিলি করতে হয়, কিন্তু এতে কেউ তেমন খুশি হয় বলে মনে হয়না। এখন বাংলাদেশে যা পাওয়া যায় তা হয়ত অ্যামেরিকাতেও পাওয়া যায়না, তাই উপহারগুলো কারো তেমন চোখে লাগেনা। তাছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা চলেন ছাপোষা নিয়মে, প্রতিটি কানাকড়ি হিসেব করে; কারণ আয় যেমন নির্দিষ্ট, ব্যায়ের খাতটিও ভাগ হয়ে যায় নিজের এবং দেশের আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনের মাঝে। পার্থক্যটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে মামীর সাথে কেনাকাটা করতে গিয়ে। নিজের খুব একটা ঘোরাঘুরির অভ্যাস না থাকলেও মামীর বিশাল তালিকার জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে মামীর সাথে ক’দিন বিভিন্ন প্লাজা এবং মলগুলোতে ঘুরাঘুরি করতে হয়েছে রাহীর। মলগুলোতে বড়লোকদের বৌরা এসে দরদাম না করেই বস্তায় বস্তায় জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে, সেলসম্যানরা তাদের একটার পর একটা জিনিস দেখাচ্ছে আর প্রতিটাই তাদের প্রয়োজন হচ্ছে, দোকানদার হাঁক দিয়ে দোকানের বাইরে গরমে সেদ্ধ হওয়া হাড়জিরজিরে পিচ্চি ছেলেটাকে বলে, ‘আপার জন্য কেক আর কোক নিয়ে আয়’।
রাহীদের চেহারা দেখেই দোকানদার বা সেলসম্যানরা খুব একটা পাত্তা দেয়না, এতিমের মত বসে অপেক্ষা করে তারা। মেজাজ খারাপ হয় রাহীর, ‘তুমি বিদেশে থাকো মামী, এক ডলার ভাঙ্গালে সত্তুর টাকা হয়, তুমি ওদের মত করে জিনিস কিনতে পারোনা? এত দরদাম কর কেন?’
মামী হাসে, ‘আহারে কন্যা আমার! আমি নিজেই তো অবাক হয়ে যাই! ওখানে শুনি দেশের মানুষ খেতে পায়না, বিভিন্ন জায়গায় চ্যারিটি কালেকশন করা হয়; আর এখানে এসে মনে হয় আমরাই সবচেয়ে দরিদ্র, অভাব কোথায়? আমরা বেহিসেবী এক দিনও তো চলতে পারিনা। ক’টা পয়সা সস্তা পাবার জন্য, টাকাটা দেশের মানুষের কাজে লাগার জন্য, এত কষ্ট করে এখানে কেনাকাটা করে ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাই। এখন দেখি আমাদের টাকা এখানে দরকার নেই, আমাদের চেয়ে বহু বড়লোক এখানে বাস করে’।

আসলেই সমাজটার কোন আগামাথা ঠাহর করতে পারেনা রাহী। মলের ভেতর সময় কাটানোর জন্য অযথা ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা করা বড়লোকের বৌদের দেখলে মনে হয় দেশটা উত্তরোত্তর ধনী হয়ে উঠছে, একেবারে ফুলেফেঁপে একাকার! আরেকদিকে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাওয়া কিছু মানুষকে বেমানান মনে হয় এই প্রাচুর্যের মাঝে। হিসেবটা মেলাতে বড় কষ্ট হয়।

সেদিন রাতে শোবার ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে চিন্তার জগতে হারিয়ে যায় রাহী। বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে। শরতের মেঘগুলো ভেসে যেতে যেতে চাঁদের আলোয় নিজেকে খানিকটা আলোকিত করে নিচ্ছে। বাইরে সামান্য একটু হাওয়া বইছে, তাতে নারকেল আর সুপারী গাছের পাতাগুলো সরসর শব্দ তুলছে। বাগান থেকে হাস্নাহেনা আর কামিনীর মাতাল করা গন্ধ ভেসে আসছে। একটু পর পর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, হঠাৎ একটা দু’টো কুনোব্যাঙের থপ করে লাফিয়ে পড়া, বড়ইগাছতলার কলটায় থেকে থেকে টুপ টুপ করে পানির ফোঁটা ঝরে পড়ছে। এতটুকু একটা জানালার ফাঁকে যে সৌন্দর্যের অবগাহন, তার মাঝে নিজের ক্ষুদ্রতা অনুধাবন না করে পারে না রাহী। তাই সে আবার হিসেব মেলাতে চেষ্টা করে, একটা মানুষের আসলে কতটা লাগে, কতটুকু হলে তার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে, কতটা হলে সে অনুভব করে এবার অন্যদের পালা? আসলে একটা মানুষের প্রয়োজন কতটুকু, বাহুল্যই বা কতটুকু এবং একজন মানুষের ওপর আরেকজন মানুষের অধিকারই বা কতটুকু? এই কতটুকুর হিসেব করতে করতে ভোর হয়ে আসে... কিন্তু হিসেব মেলেনা।

No comments:

Post a Comment