Sunday, December 9, 2012

জাররা জাররা

আমার পাগলপ্রায় অবস্থা! জীবনমরণ সমস্যা! বিশ হাজার টাকার জরুরি প্রয়োজন!

ব্যাঙ্কে একটা ফিক্সড ডিপোজিট ছিল। চাকরীর শুরুতে ঠিক করেছিলাম যত কষ্টই হোক এটা চালু রাখব। অন্তত মাসে মাসে পাঁচশ টাকা তো জমবে! নইলে এদিক সেদিক করে বাজে কাজেই খরচ হয়ে যাবে টাকাটা। আজ ঐ ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গিয়ে দশ হাজার টাকা পেলাম। কিন্তু এতে তো মাত্র অর্ধেক হোল, বাকি অর্ধেক আমি কোথায় পাই?




বাসায় এসে আলমারী খুলে মাসখরচের টাকার বান্ডিলটা বের করলাম। দৈনন্দিন খরচের জন্য রাখা টাকার মধ্যে পাঁচহাজার টাকা পেলাম, মনটা খুশিতে ভরে গেল! আমি কি কখনো ভেবেছিলাম এই টাকাও এই দুঃসময়ে কাজে লাগবে?!

কিন্তু আমার এখনো পাঁচ হাজার টাকার ঘাটতি। কি করি, কি করি? পুরা ঘর তছনছ করে ফেললাম। পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে খুচরা টাকাগুলো থাকে, ওখানে একটাকা দু’টাকা খুচরা পয়সা সব মিলিয়ে পেলাম একশ আশি টাকা। ডাইনিং রুমের শেলফে একটা বিশ টাকার নোট খুঁজে পেলাম, কবে রেখেছি মনে নেই, কিন্তু ভুলে গিয়ে ভালই হয়েছে, এখন কাজে লাগছে। কে যেন দরজায় বেল দিল। উফ! এখন কি সময় আছে? পাশের বাসার আপা। আমাকে দেখে একগাল হেসে একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেন। দৈবক্রমে প্রাপ্ত এই বরদানে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমার চেহারা দেখে উনি বললেন, ‘ঐদিন বাজারে আমার টাকা শর্ট পড়ল, তুমি আমাকে পাঁচশ টাকা দিলে, ভুলে গেছ?!’ যাব্বাবা, যেভাবেই আসুক, এখন সাতশ হোল।

আবার খোঁজ খোঁজ খোঁজ। আবার আলমারীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, এতে যদি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে কোথাও কোন টাকা রেখেছিলাম কিনা! নাহ, কিচ্ছু মনে পড়ছেনা। সামনে একটা পুরনো মানিব্যাগ চোখে পড়ল। কবে রেখে দিয়েছি কাউকে দিয়ে দেব বলে, জিনিসটা এখনো আলমারীর ভেতর কি করছে? বের করে ছুঁড়ে মারলাম বিছানার ওপর, আজই ওটার একটা ব্যাবস্থা করতে হবে। আচ্ছা, ঐ ড্রয়ারটাতে কি? একগাদা কাগজপত্র। আনমনে ঘাটতে ঘাটতে কাগজের নীচে থেকে বেরোল পাঁচটাকার একতাড়া নতুন নোট, সব মিলে দু’শ টাকা। বাহ! গত ঈদে ভাগনাভাগনিদের ঈদি দেয়ার জন্য ব্যাঙ্ক থেকে এই চকচকে নতুন নোটগুলো এনেছিলাম। আরো যে টাকা বাকি ছিল তা তো মনেই ছিলোনা! নয়শ।




ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। শুতে যেতেই হাতে কাগজের মত কি যেন ঠেকল! বিছানায় কাগজ এলো কোথা থেকে? দেখি বিছানাময় টাকা! পুরনো মানিব্যাগটাতে টাকা ছিল! সব গুণে মোট ছয়শ সত্তুর টাকা পেলাম। নব উদ্যমে উঠে গিয়ে মাটির ব্যাঙ্কটা ভেঙ্গে ফেললাম। নানারকম কয়েন আর নোট মিলে দাঁড়াল চারশ দশ টাকা। কত হোল হিসেব করার জন্য ডায়রি খুলে এর পাতার ভেতর পেলাম দু’টো দশটাকার নোট। দু’হাজার।

আরো তিনহাজার দরকার আমার। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখন আর মাথা ঠান্ডা করে কাজ করার ধৈর্য্য নেই। ভাইকে ফোন করলাম, ‘ভাই, তিনবছর হয়ে গেল, তুইও আক্কেল করে ধারের টাকা ফেরত দিসনি আমিও লজ্জা করে চাইনি। কিন্তু এখন আমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। আমি পাঁচ মিনিটের ভেতর তোর বাসায় আসছি। তুই কোথা থেকে দিবি আমি জানিনা কিন্তু আমার এক্ষুনি টাকাটা লাগবে’। ওকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রওয়ানা দিলাম ওর বাসায়।

পথে দেখা হোল এক বন্ধু তপুর সাথে। ভালই হোল। ব্যাটা দরকার লাগলে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আসে, প্রয়োজন পূরণ হয়ে গেলে তারপর আর কোন খবর থাকেনা। ওর কলার ধরে ওর কাছে আমার পাওনা দেড় হাজার টাকা আদায় করলাম। আজ আমার আর এমন স্বার্থপর বন্ধুর প্রয়োজন নেই, নিজে বাঁচলে বাপের নাম।

আমার অবস্থা দেখে ভাই টুঁ শব্দ না করে আমার একহাজার টাকা দিয়ে দিল। এবার গিয়ে হাজির হলাম আদিনাদের বাসায়, আদিনাই দরজা খুলল। ওকে বললাম, ‘তুমি আমার কাছ থেকে সেদিন যে পাঁচশ টাকা নিলে জামা কিনতে, ওটা দিয়ে দাও’। ও খুব মনে কষ্ট পেল। ‘তুমি না ঐ টাকা আমাকে গিফট করেছ?’ আমার এমন প্রেমিকার প্রয়োজন নেই যে আমার বিপদে এগিয়ে আসেনা। দিলাম এক ঝাড়ি, ‘টাকাটা আমার এক্ষুণি চাই, তুমি আহ্লাদ পরে কোর’। সে মুখ ভার করে টাকাটা এনে দিল। আমার বিশ হাজার টাকা পূরণ হোল। এবার ছুটতে হবে গন্তব্যে, নইলে সব শেষ হয়ে যাবে...


চিত্রটা পরিচিত মনে হয়? এবার আরেকটা চিত্র দেই।





পুরো পৃথিবীটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত থর থর করে কাঁপছে। কম্পনের ফলে সর্বত্র মাটিতে ফাটল ধরেছে, এগুলো দিয়ে পৃথিবীর নাড়িভূড়ি ভেদ করে লাভা উত্থিত হচ্ছে। পথে যেখানেই লাভা আর পানি মিলিত হচ্ছে সাথে সাথে পানি বাষ্পীভূত হয়ে কেটলীর ভেতর গরম পানি ফুটতে থাকার মত শব্দ হচ্ছে, শব্দের প্রচন্ডতা অনেক বেশি, এই যা। লাভার উদ্গীরনে আগ্নেয়গিরিগুলো ক্রাকাতোয়ার মত বিস্ফোরিত হয়ে ছাইভস্ম হয়ে উড়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্য পৃথিবী আগেও দেখেছে, শুধু এবার সবগুলো আগ্নেয়গিরি একইসাথে বিস্ফোরিত হচ্ছে। পৃথিবীর এই অদ্ভুত আচরনে সাগরের পানিগুলো বেসামাল হয়ে ধেয়ে আসছে বিশাল বিশাল আগুনে সুনামী হয়ে কারণ সমদ্রের নীচেও লাভার উদ্গীরন, আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে যেন সারা পৃথিবীব্যাপী কারওয়াশ করার মত করে পানি ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু আকাশ থেকে দেখা সম্ভব নয়, কারণ আজ আকাশটারও যেন কি হয়েছে। সবগুলো তারা যেন খসে খসে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ছে, ডায়নোসরদের ধ্বংস করার জন্য এমন একটিই যথেষ্ট ছিল আর আজ ওরা দল বেঁধে ছুটে আসছে। ২০১২ মার্কা মুভিগুলোতে নানারকম ফন্দীফিকির করে কিছু মানুষ বেঁচেই যায়, কিন্তু আজ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে কেউ রক্ষা পাবেনা- পৃথিবীটাই যদি না থাকে তাহলে মানুষ থাকবে কোত্থেকে? এমন ভয়াবহ দৃশ্য দেখে এতদিন বেখবরে মশগুল লোকগুলো সব ‘ওহ, মাই গড’ ‘ওহ, মাই গড’ করে ছুটোছুটি করছে, কিন্তু ‘গড’ সাড়া দিচ্ছেন না। একসময় শেষ হয়ে গেল সেই গ্রহটা যাকে আমরা চিনি, সেই সুন্দর আকাশটা যা এর শোভাবর্ধন করত- সব, সবকিছু।




কিন্তু নাহ। সব শেষ হোলনা। মানুষগুলোকে আবার দলে দলে পুণরুত্থিত করা হোল। ওরা অবাক হয়ে দেখল ‘গড’ সত্যিই আছেন! বিশাল ওয়েইং মেশিন নিয়ে তিনি সবার অণুপরমাণু পরিমাণ ভাল কাজ মন্দ কাজ সব ওজন করতে বসেছেন যেন কেউ বঞ্চিত না হয়, আবার কেউ ফাঁকিও দিতে না পারে।

তখন আপনার অবস্থা প্রথম চিত্রের মত। ভাগ্যিস, এমন ভয়াবহ বিপদের দিন আসবে বিশ্বাস করেছিলেন দেখেই না একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন! কখনো গডকে ভালবেসে, কখনো ভয় করে কিছু কাজ নিয়মিত করেছিলেন দেখে আজ একটা বড়সড় ফিক্সড ডিপোজিট পাওয়া গেল। দৈনন্দিন কাজগুলোতে গডের প্রতিনিধিদের অনুসরন করে আজ বেশ বড়রকম একটা ফায়দা পাওয়া গেল। আর যে জিনিসগুলোকে কখনও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি- ভিখারীকে ক’টা খুচরা টাকা দেয়া, কোন ভাল কাজের নিয়তে কিছু দান করা, প্রতিবেশির হক আদায় করা, যাকাত দেয়া, কারো জীবনে একটু খুশি এনে দেয়ার জন্য কিছু করা, কারো পথ থেকে একটা কাঁটা সরিয়ে দেয়া, একটু হেসে কথা বলা, কাউকে একটা ভাল উপদেশ দেয়া- সবই আজ কাজে লেগে গেল! আজ পার পাবার জন্য আপনি সব করতে রাজী, ‘চাচা আপন পরান বাঁচা’ অবস্থা আপনার। তাই ভাই বন্ধু স্ত্রী যার কাছে আপনি অধিকারবঞ্চিত হয়েছেন, যে আপনাকে কথায় কাজে বা আচরনে কষ্ট দিয়েছে সবার কাছ থেকে আপনি আজ পাওনা উসুল করতে ব্যাস্ত। যদি কোনভাবে ওয়েইং মেশিনে সঠিক ওজন দেখানো যায়! যদি কোনভাবে আপনার প্রতিপালক আপনাকে ক্ষমা করে দেন!

No comments:

Post a Comment