যশোরের মেয়ে রোজিনা। জীবিকার তাগিদে সে নিজের সন্তানকে যশোরে বোনের কাছে রেখে সুদুর চট্টগ্রামে আমার সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখত। নয় বোনের সংসারে পঞ্চম বোন হিসেবে জন্মের পর থেকে অভাব ছাড়া আর কিছুই দেখেনি কোনদিন। সে বলত, ‘আপা, আমার বাবামা আমাদের জন্ম দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কোনদিন একবেলার খাবারও দিতে পারেনি, আমরা ছোটবেলা থেকেই মানুষের ক্ষেতে কাজ করে নিজেরাও খেতাম তাদেরও খাওয়াতাম। আমাদের কারো পড়াশোনা হয়নি, কেবল একটা বোন ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছে আর একটা থ্রি পাশ। জানতাম আমরা মুসলিম, কিন্তু ধর্ম সম্পর্কে বাবামা নিজেও কিছু জানেনা, আমাদেরও কোনদিন শেখায়নি কিছু, কোনদিন এক রাকাত নামাজও পড়তে দেখিনি তাদের। হুজুরের কাছে পড়তে যাবার পয়সা ছিলোনা, কাজের ফাঁকে কোনদিন যাবার সময় পেলে মসজিদের হুজুর কিছু কিছু শেখাতেন আমাদের। বড় বোনগুলোকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবামার যাইবা কিছু ছিল তাও সব শেষ। সুতরাং আমাদের আর কোন উপায় ছিলোনা এখানে রিজিকের অনুসন্ধান করতে আসা ছাড়া ’।
অভাবের সুযোগ নিয়ে ওর আপন ফুপু সবার বড় বোনটিকে বিয়ে দেয়ার নাম করে নিয়ে ভারতের কোন এক পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়, তাকে আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিবাহিত বোনগুলো প্রতিবেলা ভাত রান্না করার সময় একমুষ্টি চাল তুলে রাখত, তাই জমা করে বাবামাকে দিত। মেয়ে ভাল থাকবে মনে করে রোজিনার বাবা ওকে বিয়ে দেয় এক বড়লোকের পাগল ছেলের সাথে, ভয়ানক তার চেহারাসুরত কিন্তু সাধারন বুদ্ধিও নেই। শ্বশুরবাড়ীতে সে সারাদিন দাসির মত কাজ করে রাতের বেলাও শান্তিতে ঘুমোতে পারতনা। পাগল তাকে গ্রামের সুযোগসন্ধানী পুরুষদের থেকে কোনপ্রকার protection দিতে সক্ষম ছিলোনা, সুতরাং সে নিজেই সারারাত দা হাতে বসে থাকত। একটা ছেলে হোল, কিন্তু পাগল ভাল হোলনা। একদিন কাজের ফাঁকে ছেলেকে দেখতে এসে দেখে পাগল এত্ত বড় একটা পাথর নিয়ে নিজের ছেলেকে মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারছে। সে চিন্তা করল, দিনরাত এভাবে খাটাখাটুনি করে, সমস্ত অত্যাচার নির্যাতন নীরবে সয়ে এমন পাগলের সংসার করে লাভ কি যে নিজের বৌকে রক্ষা করতে পারেনা, নিজের সন্তানকে চেনেনা? তখন সে সন্তানটিকে বিধবা মেজ বোনের কাছে দিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসে জীবিকার সন্ধানে। অভাবের তাড়নায় উদভ্রান্ত বাবার কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য পর পর দু’টো বোনকে নিয়ে আসে চট্টগ্রামে। তিন বোন গার্মেন্টসে চাকরী করে বাবামা, বিধবা মেজবোন এবং সবচেয়ে ছোট বোনটিকে চালায়, অভাবী সংসারে বিবাহিতা বাকী বোনদের যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করে, স্বপ্ন দেখে অন্তত সবচেয়ে ছোট বোনটিকে শিক্ষিত করবে।
আমার সাথে যখন রোজিনার পরিচয় ঘটে তখন রোজিনা লেখাপড়া না জানার কারণে গার্মেন্টসের চাকরী খুইয়ে দৈনিক তিন চারটা বাসায় ছুটা কাজ করছে। আমার সাথে ইউনিভার্সিটি যাবে এবং যতক্ষণ আমি ক্লাস নেব সে সময়টুকু সে আমার সন্তানকে দেখাশোনা করবে এই শর্তে ওকে কাজে রাখলাম। ওকে লেখাপড়া, নামায, পর্দা শেখালাম, ভাল জামজুতো কিনে দিলাম। যে নিজের সন্তানকে দূরে ফেলে রেখে সে মায়া আমার সন্তানকে ঢেলে দিচ্ছে তার জন্য আমার মনে হত আমার আরো অনেক বেশী কিছু করা উচিত। একসময় সে সারাদিনই আমার সাথে কাটাতে শুরু করল, কেবল রাতটুকু বোনদের সাথে বাসায় থাকত। আমার সাথে কক্সবাজার, ঢাকা সর্বত্র বেরাতে যেত। একবার যখন আমি অসুস্থতার দরুণ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলাম, সে পুরো সপ্তাহ আমার দু’বছরের শিশুটির সাথে রয়ে গেল। ক্যানাডায় চলে আসার সময় রিহামকে রাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে বেচারীর সে কি কান্না! ক্যানাডায় আসার পরও যোগাযোগ রয়েছে সবসময়। এখন তিনবোন মিলে আমাদের চট্টগ্রাম বাসার নিচতলায় একটা ফ্ল্যাটের অর্ধেক ভাড়া করে থাকে, তাই যখনই দেশে ফোন করি, প্রায়ই কথা হয়। শুনে খুশি হই যে সে ওর সাথে চট্টগ্রাম আসা ছোট বোন দু’টিকে বিয়ে দিয়েছে, এখন লেখাপড়া জানায় গার্মেন্টসে ভাল চাকরী পেয়েছে, বাবামাকে দেখাশোনা করতে আর চিকিৎসা করাতে পারে মোটামুটি, পর্দা করে বলে গার্মেন্টসে সবাই ওকে সম্মানের সাথে দেখে, নামায পড়ার পাশাপাশি এখন কুর’আন পড়াও শিখছে।
ক’দিন আগে ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি মন খুব খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, বলল, ‘আপা, গরীবের দুঃখের কাহিনী শেষ হয়না’।
ওর সবসময়ই একটু কাব্যিক স্টাইলে কথা বলার ঝোঁক; ওর যে পরিমাণ মেধা, ছোটবেলা থেকে সুযোগ পেলে বড় কবি বা লেখিকা হয়ে যাওয়াও অসম্ভব ছিলোনা। বললাম, ‘বলই না শুনি’।
ওর কাহিনী শুনে তো আমি থ! চট্টগ্রামে ওর দুই বোনের বড়টা হামিদা, অসম্ভব রূপবতী, ক্লাস সিক্স পাশ, কিন্তু আমার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে পড়ে ভালই জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে, চেহারা সুরত কথাবার্তা রুচি আচার আচরণে সহজেই কোন বড়লোকের মেয়ে বা বৌ হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। ওর জন্য প্রায়ই নানান প্রস্তাব আসত। রোজিনা বহু বাছাবাছির পর এমন একটি ছেলে নির্বাচন করে যে তাদের দারিদ্রের কথা জেনেই হামিদাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। পারিবারিকভাবে প্রস্তাব আদান প্রদানের পর ছোটখাটভাবে বিয়ে হয়। একমাস পর থেকে শাশুড়ি বৌকে চাপ দিতে শুরু করেন এই বলে যে অন্তত একশ মানুষ না খাওয়ালে তাঁদের মানসম্মান বাঁচেনা। বৌ অবাক হয়ে বলল ওর বাবামার তো নিজেদেরই পেট চলেনা, বোনেরা যা দেয় তাই দিয়ে চলেন তাঁরা আর বোনরাও চলে পেটেভাতে, ওরা একশ লোকের দাওয়াত খাওয়ানোর পয়সা পাবেন কোথায়?! শাশুড়ি তখন ছেলেকে চাপ দেন এই বৌ ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করতে যারা খাওয়াতে পারবে। ছেলে এতে রাজী না হলে তিনি ছেলেসহ বৌকে বাড়ি থেকে এই কথা বলে বের করে দেন, ‘একশ লোক যখন খাওয়াতে পারবে তখন এসো’।
ছোটবোন ঝর্ণা, হাসিখুশি উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়েটি, ক্লাস থ্রি পাশ, বড় বোনের মত সুন্দরী নয় তবে সুশ্রী, স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে, তাই বিয়ে করার জন্য টাকা জমাচ্ছে চট্টগ্রাম আসার পর থেকেই। ভাল পরিবার, ভাল ছেলে দেখে বিয়ে দেয়া হোল। বিয়ের ক’মাস পর ছেলে ঝর্ণার জমানো টাকা দিয়ে বিদেশ যাত্রা করল। এদিকে শাশুড়ি বলতে শুরু করলেন তাঁর বাসায় ফার্নিচার দরকার, ঝর্ণা যেন ওর বাবামাকে বলে ফার্নিচার দিতে। বেচারি একটু বোকাসোকা ধরণের, প্রথমে বুঝতেই পারলনা তিনি রসিকতা করছেন কিনা, যখন বুঝতে পারল তখন চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ওমা, ওরা আমাকে ফার্নিচার দেবে কোত্থেকে? ওদের নিজেদের তো একটা শোবার খাট পর্যন্ত নেই!’
শাশুড়ি বললেন, ‘তাহলে তুমি নিজেই আবার গার্মেন্টসে ফিরে যাও, যখন ফার্নিচার কিনে আনতে পারবে তখন আবার এসো’। মায়ের এহেন আব্দারে যে জামাই ওর সমস্ত টাকা নিয়ে বিদেশ চলে গেল সে সম্পূর্ন নিশ্চুপ! তাই এখন আবার তিনবোন একসাথে বাসা ভাড়া নিয়ে আছে, যে যে তার ভাগ্য নিয়ে।
এই কাহিনী এখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। সেদিন এক বান্ধবী ফোন করে বললেন, ‘আমাদের এক গরীব আত্মীয়, ছয় ছয়টা মেয়ে আর একটা মাত্র ছেলে। প্রত্যেক মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়েছে আত্মীয় স্বজনের কাছে হাত পেতে। এখন পঞ্চম মেয়ের বিয়ের জন্য বিয়ের খরচ ছাড়াই তিনলাখ টাকার যৌতুক দরকার। একবার ভাবি যাকাতের টাকা এমন একটা কাজে দেব যেটা আদতেই অবৈধ, আবার চিন্তা করি না দিলে তো মেয়েটার বিয়ে হবেনা, আগের চারটাও তো এভাবেই পার করতে হয়েছে, কেউ ওদের দারিদ্রের প্রতি মায়া করেনি! একমাত্র ছেলেটা বিয়ে করেছে, কিন্তু আজ এত বছরেও বৌ ঘরে তুলে আনার ব্যাবস্থা করতে পারেনি, এতবড় সংসার টানতে টানতে বেচারার নিজের জীবন বলতে আর কিছু নেই। অথচ বাবামা, বোনরা মনে করছে ওর ওদের জন্য যতটুকু করা উচিত সে ততটা করছেনা। আসলে অভাবে মানুষের বিচারবোধ নষ্ট হয়ে যায়। ওর জন্য মায়া করেই ভাবছি মন সায় না দিলেও যাকাতের টাকাটা এখানেই দেব’।
আরেকটি মেয়ের কথা শুনলাম। লেখাপড়া, স্বভাবচরিত্র, পরিবার, চাকরী কোনদিক থেকেই সে বাছার মত নয়। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েও বিয়ে ভেঙ্গে গেল। তার অপরাধ সে পাত্রপক্ষের চাহিদার তুলনায় এক ইঞ্চি কম লম্বা! উচ্চশিক্ষিত পাত্র এবং তার উচ্চবিত্ত পরিবার এক ইঞ্চি দৈর্ঘ্য হিসেব করলেন কিন্তু হিসেব করলেন না মেয়েটা এবং ওর পরিবারের ওপর এর কি প্রভাব পড়বে বা তাঁরা সমাজে কি ধরণের উদাহরণ স্থাপন করছেন। তাঁরা কেবল ভাবলেন সব গুণের পাশাপাশি যদি যৌতুকসহ পাত্রী পাওয়া যায় তাহলে বড় মাছ না ধরে ছোটমাছ ধরব কেন? এই যদি হয় তাদের মানসিকতা যাদের টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি, সামাজিক মানমর্যাদা সব আছে; তাহলে আমি ঐ নিম্নবিত্তদের কি দোষ দেব যাদের শিক্ষা বা সম্ভ্রমবোধ নেই; বা ঐ মধ্যবিত্তদের কি বলব যাদের শিক্ষা এবং সম্ভ্রম ছাড়া আর কিছুই নেই?
আমরা এখন সামাজিকতাকে যেকোন নীতিনৈতিকতা এমনকি স্রষ্টার চাইতেও বেশি ভয় করি। তাই হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি নিয়মে বিয়ে হয় যাতে পর্বের পর পর্ব অনুষ্ঠান চলতে থাকে, দেয়ানেয়ার শেষ থাকেনা, অথচ এর কিছুই বিয়ের জন্য অত্যাবশ্যক কোন ব্যাপার না। যাদের আছে বা ন্যুনতম ধার করার উপায় আছে তারা মুখ বুজে মেয়েও দেয়, দাওয়াতও খাওয়ায়, ফার্নিচারও দেয় এবং সম্ভব হলে নগদ টাকাও বাদ পড়েনা, যেন মেয়ে জন্ম দিয়ে মহাপাপ করে ফেলেছে! অথচ ধর্মানুযায়ী এর কোনটাই মেয়েপক্ষের করার কথা নয়! উচ্চবিত্তের শানশওকতের পেছনে লুক্কায়িত কষ্টের সম্পর্কে বেখবর মধ্যবিত্ত এই জৌলুস দেখে ভাবে, ‘আমি যদি কিছু কম করি তাহলে তো আর মানসম্মান থাকেনা’। এই মানসম্মানের খোলস আমাদের এক অদৃশ্য ছিপে আটকানো মাছের মত টেনে নিয়ে চলে অসম্ভব সব আচার অনুষ্ঠান খরচাদির ভেতর দিয়ে, অথচ আমরা নিজেদের একবারও প্রশ্ন করে দেখিনা এর আদৌ কোন যৌক্তিকতা আছে কিনা, এসব আদৌ ভাবী সংসারে সুখের জন্য অপরিহার্য কিনা। অন্যদের দেখে গরীবেরও চোখ টাটায়। অন্যদের ক্ষেত্রে যেটা নির্যাতন, গরীবের বেলা এসে সেটা হয়ে যায় অমানুষিক আচরণ। ওরা ভুলে যায় ওরা মানুষ, ভুলে যায় মানুষ হিসেবে ওদের কিছু মানবীয় দায়িত্ব আছে, ভুলে যায় যে মেয়েটা এখন ওদের সংসারে এসেছে সে এখন ওদের সংসারের অংশ। আর নইলে নিজের মেয়েকে কি কেউ লোক খাওয়ানোর জন্য বা ফার্নিচার কেনার জন্য ঘর থেকে বের করে দিত? কিন্তু এখানে ওদের চাইতেও বেশি অন্যায়কারী সেই বড়লোকেরা যাদের এক পর্বের ফালতু অনুষ্ঠানের খরচ দিয়ে তিনটা দরিদ্র মেয়ের বিয়ে দেয়া সম্ভব, অন্যায়কারী তারা যাদের সামর্থ্য আছে বলে তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পরিবর্তে ভুরি ভুরি দিচ্ছেন বটে কিন্তু যৌতুকের বলি হচ্ছে তাদের দেখে যে গরীবের সাধ জাগে কিন্তু সামর্থ্য হয়না তাদের মেয়েরা।
আর ছেলেরা, তারাও সামাজিকতার শিকার। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়া শিখে ওরা উন্নত মানুষ হবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু কার্যত সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মত সাহস সংগ্রহ করতে পারেনা। ওরা যদি যৌতুকবিহীন বিয়ে করতে চায় তাহলে পরিবারের সদস্যরা বেজার হন, বন্ধুবান্ধবদের সামনে মান ইজ্জত থাকেনা, পাশের বাড়ীর এত্ত এত্ত যৌতুক নিয়ে আসা বৌটা যেখানে সকালবিকাল কথা শোনে সেখানে নিজের যৌতুকবিহীন বৌয়ের কি হবে এই চিন্তা, অনেক ক্ষেত্রে পরের খরচে নিজেকে একটু এগিয়ে নেয়ার সুপ্ত লালসা- অনেক কিছুই তাদের ফিরিয়ে আনে এসব চিন্তা থেকে। অনেকে ভাবে, পরিবার থেকে যেখানে বয়স গড়িয়ে যাবার পরও তার আয়ের টাকা ভাগ হয়ে যাবার ভয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছেনা, সেখানে উচ্চবাচ্য না করে ভাববাচ্য বজায় রেখে যেকোনপ্রকারে বিয়ে করে ফেলাটাই যুক্তিযুক্ত। অনেকে মনে করেন এই মেয়েকে আজীবন খাওয়াব, এত এত গহনাপত্র দেব, কিছু যদি উসুল করে নেয়া যায় তাহলে যতটুকু পাওয়া যায় ততটাই লস সামাল দেয়া যায়। কিন্তু ভাবতেই কি আশ্চর্য লাগেনা যে যাকে জীবনসঙ্গী করা হতে যাচ্ছে তার ব্যাপারে প্রথম থেকেই একটা ব্যাবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করা হচ্ছে! একই ব্যাপার পাত্রীপক্ষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিয়ে দেয়ার সময় ছেলে কি চাকরী করে, কত টাকা কামায়, মেয়েকে কি দিতে পারবে না পারবে এইসব যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় তার তুলনায় ছেলের চরিত্র কেমন, ছেলে নামাজি কিনা, ছেলের আচার ব্যাবহার কেমন এগুলো বিবেচনায় স্থানই পায়না। সব মিলে বিয়ে এখন আর কোন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নয় বরং একটি লাভজনক লেনদেন, কোন বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধন নয় বরং সামাজিকতার চাপে জোরপূর্বক সহাবস্থান।
ফলাফল, রোজিনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিয়ে করবে? আমি নিজে ছেলে দেখে তোমাকে বিয়ে দেব’।
সে হেসে বলে, ‘আপা, আপনি কি আমার সাথে রসিকতা করেন? একবার বিয়ে করে ছয়বছর ভুগলাম। বোনদের বিয়ে দিয়ে দেখছি ওরা কত সুখে আছে। তারপর আবার বিয়ে। না বাবা, কানমলা খাই, ঐদিকে আমি আর নাই। স্বপ্ন দেখা বাদ দিয়েছি অনেক আগে’।
রোজিনা ইসলামের যতটুকু বুঝেছে সে কষ্ট হলেও নিজেকে পদস্খলন হতে রক্ষা করে চলবে, কিন্তু যারা বোঝেনা বা মানার আগ্রহে যাদের কিঞ্চিত ঘাটতি আছে তারা যদি বিয়ের এই ভয়াবহ চিত্র দেখে বিপথে পা বাড়ায়, তাদের আমরা কতদিন নৈতিকতার দোহাই দিয়ে আটকে রাখতে পারব যেখানে একপক্ষকেই কেবল নৈতিকতার বাণী শোনানো হচ্ছে এবং অপরপক্ষ স্বেচ্ছাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে? ওদের স্বপ্নের অকালমৃত্যু রোধ করার জন্য কি আমাদের কোনই দায়িত্ব নেই? আমরা কি পারিনা চারপাশে বাঁধার প্রাচীর রচনা করে ওদের স্বপ্নগুলোকে বন্দী না করে বার্লিনের দেয়ালের মত প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে দিতে যেন তারা শ্বাস নিতে পারে, যেন স্বপ্নের সাথে সাথে ওরাও অকালমৃত্যুর শিকার না হয়? আমাদের একটি হলুদের অনুষ্ঠান বা একটি শাড়ি কেনা বাদ দেয়া যদি একজনের সংসার বাঁচাতে পারে, একটি পরিবারের একমাসের অন্নসংস্থান করতে পারে, সংঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায় করে যদি আমরা একটি দরিদ্র মেয়ের বিয়ে দিতে পারি, একজন অভাবগ্রস্তের চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে পারি, তবে কেন আমরা অবহেলা বা গড়িমসি করে তাদের অসহায়ত্ব মুখ বুজে দেখে যাই? আর কতকাল দেখতে থাকব আমরা? এখনই ভাবার সময় কেননা বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ছেলেমেয়েরা বিয়ের প্রতি বিমুখ হয়ে বরং সহজতর উপায়গুলোর দিকেই ঝুঁকে পড়ছে, মানুষ হতাশার আবর্তে ঘুরে ঘুরে নিজের মনুষ্যত্ব খুইয়ে বসছে, বাইরে প্রানবন্ত মানুষগুলোর ভেতরে ক্ষয়ে জালি জালি হয়ে যাচ্ছে। এদের জন্য কিছু না করে আমরা কি নিজেদের মানুষ বলে দাবী করতে পারি?
No comments:
Post a Comment