Sunday, December 9, 2012

সন্তানদের সততা শিক্ষা দেয়ায় বাবামায়ের ভূমিকা

আজ বান্ধবী তানজিনের পরিচালনায় ছোটদের নিয়ে একটি চমৎকার অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। অনুষ্ঠানের theme ছিল honesty. ছোট ছোট শিশু কিশোররা ভারী সুন্দরভাবে honesty বলতে কি বোঝায় এবং নিজেদের জীবনে তারা কখন কিভাবে honestyর পরিচয় দিয়েছে এ’নিয়ে গল্প শোনায়। ছোট্ট সোনামনিদের মুখে সততার শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা শুনে মনটা ভরে ওঠে।

অনুষ্ঠানের সমাপনীতে বাবামা কিভাবে সন্তানদের সততা শিক্ষা দেবেন এ’বিষয়ে কিছু বলার দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। বক্তা হিসেবে চলনসই হলেও বক্তৃতা দিতে আমার প্রচন্ড অনীহা, কারণ আমার মনে হয় যে আদর্শের কথা আমি বলব তা যদি নিজের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে না পারি তাহলে এই বক্তৃতা ভন্ডামীর পর্যায়ে পর্যবসিত হয় যা আমার কাছে ভয়ানক লজ্জাজনক ব্যাপার। তবু ছাড়াছাড়ি নেই।

তবে এবার এ’বিষয়ে কিছু বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম যদিও আমাদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়েছে ‘honesty is the best policy’, কিন্তু honesty বলতে আসলে কি বোঝায় এ’সম্পর্কে আমাদের আসলে কোন concrete ধারণা দেয়া হয়নি, কেবল একটা ভাসা ভাসা ধারণা নিয়েই আমরা জীবনের অর্ধেকের বেশি পার করে এসেছি। এ’বিষয়ে গবেষনা করতে গিয়ে অনেক কিছুই শেখা হয়েছে এবং concept অনেকটাই clear হয়েছে। এই ব্যাপারে সাহায্যের জন্য ছোটভাই লালবৃত্তের কাছে ঋণস্বীকার না করলেই নয়।

বক্তৃতার বিষয়বস্তু শিশুদের জন্য বোধগম্য করে সাজানো হয়েছে, তবে এটি বাবামায়েরও কাজে আসবে আশা করি।

ইসলামের দৃষ্টিতে, ‘Honesty implies unity of behaviour, unity of standards, and integrity of personality. Honesty implies being away from internal conflicts, social conflicts and self-contradiction.’ সহজ কথায় আমাদের কথায়, কাজে, ব্যাবহারে, বিচার বিবেচনায় এবং ব্যাক্তিত্বে unity থাকতে হবে- এটাই সততা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, তা হোক private বা public, সততা বজায় রাখার ওপর জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে।

এ’প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাহাবী হজরত আবদুল্লাহ ইবন মাস’উদ (রা), যিনি ছিলেন ইসলামের বিশিষ্ট scholar, তাঁর একটি কথা মনে পড়ল। উমার (রা) একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেন আল্লাহর সম্পর্কে কুর’আনের সবচেয়ে ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত কোনটি? তিনি বলেন এটি হোল সূরা বাক্কারার ২৫৫ নং আয়াত, ‘তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়’ (Neither drowsiness overtakes Him nor sleep). তিনি সবই দেখতে পান, শুনতে পান এবং জানেন। তদুপরি এমন কোন একটি মূহূর্ত নেই যখন তিনি আমাদের পর্যবেক্ষন থেকে বিরত থাকেন। কুর’আনের বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ বার বার স্মরন করিয়ে দিয়েছেন যে তিনি আমাদের প্রকাশ্য ও গোপন সব কথা জানেন এবং বিচার দিবসে তিনিই আমাদের বিচার করবেন। সেক্ষেত্রে মানুষের কাছে ভাল হবার চেয়ে প্রকৃত অর্থে সততা অর্জন করাটাই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হওয়া উচিত, কেননা আমরা সারা পৃথিবীর সবার কাছে লুকালেও আল্লাহর কাছে কিছুই লুকাতে পারবনা। সুতরাং, আমাদের সততা শুধু লোকদেখানো হলে চলবেনা, private এবং public সব জায়গায় আমাদের honest হতে হবে, এমনকি যদি এতে আমাদের ব্যাক্তিগত স্বার্থহানি হয় তবুও।

সততা একটি blanket term যার মাধ্যমে অনেকগুলো গুণাবলীকে একটি ছাতার নীচে একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। তবে সত্যিকার সততা অর্জন করতে হলে আমাদের এই প্রত্যকেটি গুণকে এককভাবে চেনার চেষ্টা করতে হবে।

কথায় Honesty বলতে বোঝায় আমরা under all circumstances সত্য বলব, ওয়াদা রক্ষা করব এবং কেউ উপদেশ চাইলে তাকে সঠিক পরামর্শই দেব যদিও তাতে আমাদের স্বার্থে আঘাত আসে।

কাজে Honesty বলতে বোঝায় আমরা supervision ছাড়াও sincerely কাজ করব, best quality কাজ করব এবং কেউ কিছু পাওয়ার হক্কদার হলে সে চাওয়ার আগেই তার অধিকার আদায় করব।

আচরণে Honesty বলতে বোঝায় সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক কাজটি করা, বিচার করার সময় আদল বা fairness বজায় রাখা এবং আত্মীয়তা পরিচয় নির্বিশেষে যে যা deserve করে তার প্রাপ্য ensure করা।

এ’প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। ছোটবেলায় রবিন হুডের গল্প পড়ে খটকা লাগত, এই জনদরদী মানুষটা তো আসলে চোর ছিল! তার কাজ ছিল বড়লোকদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে গরীবদের মাঝে বন্টন করা। হ্যাঁ, সে নিঃস্বার্থ ছিল, সাহসি ছিল, দরিদ্রের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় মায়া- কিন্তু তাতে কি চুরি করাকে justify করা যায়? পশ্চিমা philosophyতে যায়। কারণ তারা বলে, ‘the end justifies the means’ বা ‘all’s well that ends well’. কিন্তু ইসলাম বলে শুধু নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়াটাই যথেষ্ট নয় বরং পদ্ধতিটিও সঠিক হওয়া চাই। কারণ একজন Honest ব্যাক্তি মিথ্যা বলা, hypocrisy, স্বজনপ্রীতি এবং লোকঠকানো থেকে দূরে থাকে।

সবই ঠিক আছে, কিন্তু নিজের স্বার্থ বাদ দিয়ে সততা বজায় রাখার ফলে আমরা কি কোনভাবে লাভবান হই? হ্যাঁ, Honesty র পুরস্কার আমরা দুনিয়াতেও পাই, আখিরাতেও পাই। প্রথমত, একজন honest ব্যাক্তি মানসিক প্রশান্তি উপভোগ করেন, দ্বিতীয়ত তিনি মানুষের কাছে সম্মানিত হন, সর্বোপরি তিনি আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়ে যান। এ’ধরণের মানুষ তার আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ সমাজের জন্য কল্যাণকর যদিও হয়ত তাকে এর চর্চা করতে গিয়ে সাময়িকভাবে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

অপরপক্ষে honestyর অভাবে অনেক সামাজিক ব্যাধির সৃষ্টি হয়, যেমন মিথ্যা বলা, ঘুষ দেয়া বা নেয়া, cheating, forgery, লোকঠকানো, ওয়াদা ভঙ্গ করা ইত্যাদি। একজন dishonest মানুষ, যে মিথ্যা কথা বলে বা কাউকে ঠকায় সে সাময়িকভাবে লাভবান হলেও তার বিবেক তাকে কোনভাবেই শান্তি পেতে দেয়না। অসৎ ব্যাক্তিকে মানুষ মুখের ওপর কিছু বলতে না পারলেও তাকে পছন্দ করেনা, বিশ্বাস করা তো অনেক দুরের ব্যাপার- এটা কেউ না বললেও অসৎ ব্যাক্তি নিজেই উপলব্ধি করতে পারে এবং একাকীত্বে ভোগে। সবচেয়ে বড় কথা যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলনা তার সমস্ত পার্থিব সম্পদ, সন্তান, সুখ সবই বৃথা হয়ে যায়। এ’ধরণের ব্যাক্তি তার আশেপাশের লোকজন থেকে সম্পূর্ণ সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

তাই Honestyকে আমাদের চরিত্রের মধ্যে গেঁথে দেয়ার জন্য আল্লাহ আমাদের কয়েকটি পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছেনঃ
1. Instruction: Allah orders the Muslim to be honest in all cases, in all deeds and words, to himself and to others. [প্রথমে বুঝিয়ে বলেছেন]
2. Reason: Allah shows the Muslim rationally that honesty is the best policy, even on utilitarian bases. (utilitarian: ensuring utmost happiness for the maximum number of people) [অতঃপর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন]
3. Reward: Allah promises the honest person generous rewards in the first life and in the second life. [তারপর পুরস্কারের লোভ দেখিয়েছেন]
4. Punishment: Allah threatens the dishonest person with severe punishment for his dishonest behaviour. [চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী, তাই এই ধরণের লোকদের শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন]
5. Practice: Allah develops the habit of honesty in the Muslim through actual practice, i.e., through fasting and prayer. [শেষে সততাকে ব্যাক্তিজীবনে প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন]
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আমরা যদি নামাজে সূরা পড়ার পরিবর্তে গান গাই কেউ বুঝতে পারবেনা, কিন্তু আল্লাহ ঠিকই জানবেন। একইভাবে আমরা যদি রোজা রাখার নাম করে রুমের দরজা বন্ধ করে খাওয়াদাওয়া করি কেউ জানতে পারবেনা, কিন্তু আল্লাহ দেখবেন। এই ব্যাক্তিগত সততাই পরবর্তীতে সামষ্টিক সততার রূপ ধারণ করে।




আল্লাহ বলেছেন রাসূল (সা)এর জীবনে আমাদের জন্য রয়েছে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ বা সর্বোত্তম আদর্শ। আমরা রাসূল (সা)এর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, এতিম হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র সততার কারণে তিনি উত্তম ব্যাবসায়ীতে রূপান্তরিত হন এবং মক্কাবাসীদের কাছে ‘আস সাদিক’ বা সত্যবাদী এবং ‘আল আমীন’ বা বিশ্বস্ত ব্যাক্তি হিসেবে পরিচিতি এবং সম্মান লাভ করেন। তাঁর বিবেচনার বিশুদ্ধতার কারণে কাবার মেরামতের পর হাজরে আসওয়াদ স্থাপন করা নিয়ে বিভিন্ন গোত্রে সমস্যা সৃষ্টি হলে, নবী হবার আগেই তাঁকে এর ফয়সালা করার জন্য মনোনিত করা হয়। তাঁর সততার কারণেই খাদিজা (রা)র মত ধনবতী মহিলা কপর্দকশূন্য এই যুবককে বিয়ে করতে আগ্রহী হন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হোল তিনি যখন রাসূল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন মক্কাবাসীরা তাঁর নামে যেই বদনামই করতে চেষ্টা করে তা বিফল হয়ে যায় যেহেতু তাঁর চরিত্র সম্পর্কে সবাই জানত।

একইভাবে আমাদের সন্তানদের জন্য আদর্শ কিন্তু আমরা। আমরা ওদের যতই নীতিবাক্য শোনাই না কেন, ওরা ঠিক তাই শিখবে যা ওরা আমাদের করতে দেখবে। এখানেই personal honesty সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অনেক সময় বাচ্চাদের সামনে ছোটখাট মিথ্যা কথা বলি কিন্তু মাথায় রাখিনা যে এর মাধ্যমে সে বুঝে নিচ্ছে ছোটখাট মিথ্যা বলা জায়েজ। উদাহরণস্বরূপ, নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটি গল্প আমার খুব মনে পড়ে। জানালা দিয়ে পাওনাদারকে দেখতে পেয়ে হোজ্জা ছেলেকে বলল, ‘গিয়ে বল আব্বু বাসায় নেই’। ছেলে গিয়ে বলল, ‘আব্বু বলেছে আব্বু বাসায় নেই’। এভাবে আমাদের সন্তানরা আমাদের সাথে দুর্ব্যাবহার না করেও প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আমরা তাদের কি শেখাচ্ছি। বাবা যদি ঘুষ খান, সন্তান তাঁর নীতিবাক্যে পটবে না, মা যদি সন্তানকে খাওয়াতে বা ঘুম পাড়াতে মিথ্যা বলেন সন্তান ধরে নেবে সে যা চায় তা আদায় করার জন্য মিথ্যা বলা কোন অপরাধ নয়- আর মিথ্যা ত অপরাধের প্রথম ধাপ মাত্র, এই journey যে কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা বাবামা কখনোই আন্দাজ করতে পারেন না।

সুতরাং, আমাদের honesty যেন লোকদেখানো না হয় বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়। এতে আমরা নিজেরাও উপকৃত হব এবং আমাদের সন্তানদের জন্যও good example রাখতে পারব। এভাবেই আমরা নিশ্চিত করতে পারি আমরা আমাদের সন্তানদের জান্নাতের পথে চলে আল্লাহর সন্তুষ্টি, দুনিয়ার শান্তি এবং আখিরাতের পুরস্কার অর্জন করতে সাহায্য করতে চাই নাকি সাময়িক লাভের জন্য চিরকালিন কষ্টে নিপতিত করতে চাই।

No comments:

Post a Comment