Sunday, December 9, 2012

আমার ঈদ




ঈদ তার জন্যই আনন্দের যে রামাদানের একটি মাস ইবাদাত এবং সৎকাজের চর্চার মাধ্যমে এমন একটি জীবনাচরণ নিজের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে যা তাকে আগামী রামাদান পর্যন্ত সজীব এবং সতেজ রাখবে। যে এই মাসটি পাবার পরেও নিজের মাঝে কোন পরিবর্তন অনুভব করতে পারেনা তার জন্য রামাদানের সমাপ্তি অপরিসীম বেদনার কেননা আরো একটি বছর তার জীবন থেকে ঝরে গেল অথচ সে ক্ষমার কাছাকাছি পৌঁছতে পারলনা।

এবারের রামাদান ছিল আমার জন্য বিচিত্র অভিজ্ঞতার সমাহার। একদিকে বন্ধুমহলের প্রতিযোগিতা দেখে নিজের ক্ষুদ্রতায় মুষড়ে পড়েছি, আরেকদিকে সংযমের মাসের নানাবিধ ব্যাখ্যা বেশ মজা দিয়েছে। তবে শেষ নাগাদ কিছু শুভাকাঙ্খীর দুয়া এবং ভালবাসা ছাড়া নিজের অর্জন বলতে তেমন কিছুই সংগ্রহ করতে পারিনি, তাই রামাদানের সমাপ্তি প্রতি বছরের মতই এ’বছরও আমার জন্য ছিল বেদনার।

এখানে রোজার শুরুতে ফজর হত চারটায় এবং ইফতার হত পৌনে দশটায়- মোটামুটি আঠার ঘন্টা। রামাদানের শেষ নাগাদ এই সময় প্রায় এক ঘন্টা চল্লিশ মিনিট কমে যায়। রাতের পরিধি যেখানে মাত্র ছয়ঘন্টা- এরই মাঝে মাগরিব, এশা, তারাবী, ফজর, ইফতার, সেহরী, ঘুম সব কুকড়েমুকড়ে জায়গা করতে হয়- সেখানে যারা চাকরীজীবি, ভোর ছ’টায় যাদের কাজের উদ্দেশ্যে উঠে যেতে হয় এবং ফিরতে ফিরতে হয় সন্ধ্যা ছ’টা- তাদের ইবাদাতসহকারে রোজা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে দেয়। আল্লাহর প্রতি নিখাদ ভালবাসা এবং অবিচল নিষ্ঠা ব্যাতিরেকে এই কাজ সহজ নয়, সম্ভব কিনা তাও আলোচনার বিষয়।

স্বাস্থ্যগত কারণে রামাদানের একমাস আমরা দাওয়াতে যাইনা এবং দাওয়াত দেইওনা- প্রথমত সুস্থ থাকার জন্য পরিমিত এবং চর্বচোষ্যলেহ্যপেয়বর্জিত খাবার গ্রহণ করা জরুরী, দ্বিতীয়ত দাওয়াত দানকারী এবং দাওয়াত গ্রহণকারী এদের উভয়েই দাওয়াতের পর এত ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে সঠিকভাবে নামায সম্পন্ন করা সুকঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই উভয় ক্ষেত্রে আমার বন্ধুদের পারফর্মেন্স ছিল ঈর্ষা করার মত। এবারের রোজায় বন্ধুরা এত খাবার পাঠিয়েছেন যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ দিন আমাদের রান্না করতে হয়নি, বরং এই বিপুল পরিমাণ খাবার কেবল আমাদেরই নয় আমাদের প্রতিবেশীদেরও রসনাবিলাস করেছে। জুমায় এবং তারাবীতে এদের সদা উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত যার ফলে হাফিজ সাহেবের কাজ থাকলেও আমরা কোনক্রমে একবার মসজিদ পর্যন্ত পোঁছতে পারলেই হত, ফেরার সময় বাসায় নামিয়ে দেয়ার জন্য বান্ধবীদের অভাব হতনা। এদের অনেকেই নিয়মিত মসজিদের ইফতারে অংশগ্রহণ করতেন, অনেকেই সাত আটশ মানুষের খাবার প্রস্তত এবং বিলি করায় সময় এবং শ্রম দিয়েছেন। কোন কাজটি করলে আল্লাহকে বেশি পরিমাণ সন্তুষ্ট করা যায় সেভাবে পরিকল্পনামাফিক কাজ করায় তাঁদের প্রতিযোগিতা আমাকে যেন সাহাবাদের যুগের কথাই মনে করিয়ে দিত।

আমাদের এবারের প্রজেক্ট ছিল তিনজন গরীব মেয়ের বিয়ের আয়োজন, একজন রোগীর জন্য টাকা তোলা এবং আরেকজন রোগীর তদারক- এ’ব্যাপারে বন্ধুদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ এবং অকাতরে দান আমাকে অভিভূত করেছে। শনিবার দুপুরগুলো বান্ধবীরা একত্রে বসে ক্কুরআন সঠিকভাবে পড়ার চেষ্টা, পঠিত সুরাগুলোর অর্থ আলোচনা করা, নতুন সুরা শেখার সংকল্প এবং নামাযের পদ্ধতিগুলো আরেকবার সহি করে নেয়া যেমন জ্ঞানসংগ্রহের দিক থেকে আনন্দদায়ক ছিল তেমনি ছিল কলহাস্যে ভরপুর। ক্কদরের রাতটিকে পাবার আকুতি নিয়ে বাচ্চাদেরসহ মায়েদের কিয়ামুল লাইল অনুষ্ঠান ছিল বিশেষ আনন্দের উৎস। এবার তেইশের, পঁচিশের এবং সাতাশের রাত কাটে বান্ধবীদের সাথে। শুদ্ধভাবে ক্কুর’আন পড়া, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আয়াত নিয়ে আলোচনা, নামাজের ভুলত্রুটিগুলো শুদ্ধ করে নেয়া, টুকটাক সমস্যাগুলোর সমাধান জেনে নেয়া, প্রশ্নোত্তর, সারিবদ্ধভাবে তাহাজ্জুদ নামায পড়া, বাচ্চাদেরসহ একত্রে দুয়া করা এবং সবশেষে একেকজনের একেক তরকারী চেখে সেহরী সম্পাদন করার মধ্য দিয়ে কখন যে রাত কেটে যায় ছোট ছোট বাচ্চাগুলো পর্যন্ত টের পায়নি! এরাই আবার বাসায় গিয়ে দু’একঘন্টা ঘুমিয়ে ছুটেছে কাজে কিংবা স্কুল কলেজে।

ঈদের দু’একদিন আগে থেকে রামাদানের আসন্ন বিদায়ে মন খারাপ হতে থাকে। তাইতে আবার শুক্রবার দুপুরে রামাদানের শেষ জুমা পড়লাম আর রাতে শেষ তারাবী। তারাবীর শেষ রাকাত পড়তে পড়তে অনেকের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, আগামীবার তারাবী পড়তে পারব তো? প্রতিটি রাতে তারাবীর পর, প্রতিটি জুমায় নামাজের পর হাজার হাজার মানুষ সম্মিলিতভাবে দুয়া করেছে সিরিয়া, বার্মা, প্যলেস্টাইন, আফগানিস্তান, ইরাক, কাশ্মীর, সোমালিয়াসহ বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত নিপীড়িত ক্ষুধার্ত বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের জন্য। সাহায্যের ডাক শুনে মূহূর্তে কালেকশন হয়ে যায় হাজার হাজার ডলারের ডোনেশন। দাতাদের অধিকাংশই আরবী এবং পাকিস্তানী, অনেকের নিজেদেরই হয়ত চলতে কষ্ট হয়, কিন্তু দেয়ার বেলা এদের হারাবার মত অর্থ আমাদের অনেকের থাকলেও মনমানসিকতার অভাব প্রকট।

রোজার শেষ দিকটায় আমার বিমর্ষ হৃদয় রঙ্গীন করে তোলে আমার দুই সন্তান। এরা দু’জনেই কিয়ামুল লাইলে সারারাত জেগে আলোচনা শুনেছে, নামায পড়েছে, দুয়ায় অংশগ্রহণ করেছে। দু’জনেই সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বমানবতা যেখানে সীমাহীন কষ্টে নিমজ্জিত সেখানে নিজের জন্য নতুন জামা কিনে ঈদের আনন্দ করা লজ্জার ব্যাপার। বরং তাদের টার্গেট হয়ে দাঁড়ায় ঈদের আগেই কিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আরো কিছু কাজ করে নেয়া যায়। ঈদের দু’দিন আগে থেকে রাদিয়া বিভিন্ন ছোট বন্ধুদের এবং আন্টিদের হাত ঈদের আনন্দে রাঙ্গিয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে, ওর কাজ শেষ হয় ঈদের রাতে রাত সাড়ে বারোটায়। দুই ভাইবোনে সিদ্ধান্ত নেয় ওদের ঈদির টাকা সোমালিয়ায় পাঠিয়ে দেবে দুঃস্থ জনগণের সাহায্যের জন্য, আমার বারো বছরের কন্যা আর পুত্র যার এখনো ছয় বছর হয়নি- ওদের সোৎসাহ আলোচনা শুনে ভাবি, ‘আমার পিচ্চিগুলো কবে এত বড় হয়ে গেল?!’

ঈদের সকাল হয় মহাধুমধামের ভেতর দিয়ে। মহিলাদের জন্য দোতলা মসজিদ এবং জিমনেশিয়াম সম্পূর্ণভাবে ছেড়ে দিয়ে পুরুষদের জন্য নামাজের আয়োজন করা হয় মাঠে তাঁবুতে। মসজিদের সামনে পৌঁছে কয়েক বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে যায়। জেসমিন আপা দেখি অনেক আগে এসেও জায়গা সংরক্ষণ করার পরিবর্তে বাইরে দাঁড়িয়ে জনস্রোত দেখছেন। অভিভূত বান্ধবী বললেন, ‘এই দৃশ্য দেখে আমার হজ্জ্বের কথা মনে হচ্ছে। পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন চেহারার, বিভিন্ন ভাষাভাষী, বিভিন্ন মনমানসিকতার নারীপুরুষ শিশু সব দলে দলে ছুটে আসছে- আজ তাদের একটাই পরিচয়- তারা এক আল্লাহয় বিশ্বাসী। কেবল আজ তারা ‘লাব্বাইক’ বলার পরিবর্তে বলছে ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। ক্যানাডার মত জায়গায় এই দৃশ্য আল্লাহ আমাদের দেখালেন, তাই চোখে মেলে দেখছি আর দেখছি...’।

ঈদ জামাতে ঘোষোনামোতাবেক চল্লিশ হাজার মানুষ হয়েছিল। অথচ কোথাও কোন বিশৃংখলা ছিলোনা, নামায শুরু হয় ঠিক সময়, নামাজের আগে ইমাম তাকবীরগুলো বুঝিয়ে দেন, অতঃপর মুনাজাতে বিশ্বমুসলিম ভ্রাতৃত্বের জন্য এবং আমাদের রামাদান আল্লাহ কবুল করে নেয়ার জন্য দুয়া। এই বিশাল আয়োজনকে সফল করার জন্য হাজার হাজার ভলান্টিয়ার নিযুক্ত ছিল- তাঁবু খাটানো থেকে মসজিদ পরিষ্কার করা, শৃংখলা বজায় রাখা, দানের টাকা সংগ্রহ করা থেকে সকল কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে তাদের রামাদানকে সফলভাবে সমাপ্ত করে। ভলান্টিয়ারদের অধিকাংশই ছিল স্কুল কলেজগামী টিনেজার। সংকল্প করলাম আগামীবার থেকে আমরাও অংশগ্রহণ করব এই বিশাল কর্মযজ্ঞে।

মসজিদের আশেপাশে শুধু একটি হোটেল এবং একটি কফিশপ ছাড়া সকল প্রতিষ্ঠান তাদের পার্কিং ছেড়ে দেয় মুসল্লীদের গাড়ী রাখার জন্য। সরকার রাস্তায় গাড়ী রাখার ব্যাবস্থা করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে দেয়। সব মিলে চারহাজার গাড়ীর পার্কিংয়ের ব্যাবস্থা করার পরও অনেকে দূর দুরান্তে গাড়ী রেখে মসজিদ পর্যন্ত হেঁটে আসেন। ফেরার পথে রাস্তায় মুসল্লীদের গাড়ীর ভিড় দেখে মনে হয় আজ সত্যিই যেন সবাই ঈদের হৈহুল্লোড় করতে করতে ফিরে যাচ্ছে।

মসজিদে নানাবিধ খাবার দাবাড় এবং অন্যান্য আয়োজন ছিল দিনটি সবার জন্য আনন্দময় করে তোলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমরা মসজিদ থেকে বেরোবার আগেই খবর পাই মেহমান দরজায় অপেক্ষা করছে। তাই দ্রুত ফিরে আসতে হয়। তারপর একের পর এক মেহমান আসতে থাকে। তিনটার দিকে সিদ্ধান্ত নেই এবার নিজেরা বেড়াতে বের হব। ঘুরতে ঘুরতে কিভাবে যে পনেরোটা বাসা ঘোরা হয়ে গেল জানিনা। হাফিজ সাহেবের ঈদ রুটিন হোল ঘুমানো। বিয়ের পর থেকে এর ব্যাতিক্রম দেখিনি। কিন্তু এবার বান্ধবীদের প্ল্যান ছিল যে বাসায় যাব সবাই একসাথে যাব। তাই সকালে সবাই একসাথে এসে দুপুরে আমাদের নিয়ে বের হয়ে গেলেন, সবাই একসাথে গল্পগুজব করতে করতে কেউ টেরই পাইনি আমরা আসলে কতটা ক্লান্ত। আমাদের নিয়ে শহরের এমাথা ওমাথা ছুটোছুটি করতে করতে পরিশ্রান্ত ভাইরা শেষমেশ পরামর্শ দিলেন আগামীবার থেকে এত ঘোরাঘুরি না করে বরং সবাই এক জায়গায় মিলিত হয়ে খাওয়া দাওয়া করলে কেমন হয়! রাতে যখন ঘুমাতে যাব তখন মনে হচ্ছে যেন রাজ্যের ক্লান্তি চোখের পাতা দু’টো আপনি বন্ধ করে দিচ্ছে! দেশে ফোন করা আর দেশ থেকে ফোন আসার আনন্দ তো আছেই, বন্ধুদের আসা যাওয়া এবং আমাদের দাওয়াত দেয়াও এখনো অব্যাহত আছে যদিও ঈদ শেষ হয়ে গেছে সেই কবে!

No comments:

Post a Comment