Tuesday, July 23, 2013

লাইসেন্স টু কিল

১/

ছেলেটির শীর্ণ হাতখানা আমার হাতখানি আঁকরে ধরে আছে পরম নির্ভরতায়, মোটা চশমাটার আড়ালে বড় বড় চোখ দু’টোতে গভীর বিশ্বাস। কিন্তু ওর এই উদার হৃদয়খানির উৎস যেখানটাতে, সে ছোট্ট বুকটার ভেতর হৃৎপিন্ডটাতে একটা ফুটো যা তাকে এতটা অসুস্থ করে রেখেছে যে স্বাভাবিক কাজগুলো করাও ওর জন্য এক একটা পরীক্ষা। ও যখন ওর মায়ের ভেতরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে তখন ডাক্তার তাঁকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন সামান্য সর্দিজ্বর ভাল হয়ে যাবার জন্য। সর্দিজ্বর ভাল হয়ে গেল কিন্তু বাচ্চাটার হৃৎপিণ্ডে একটা ফুটো রেখে দিয়ে গেল সেই অ্যান্টিবায়োটিক। সেটা সারাবার জন্য বাবামা ওকে নিয়ে কোথায় ছুটোছুটি করেননি! মাদ্রাজ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ওর হার্টের গঠনেই সমস্যা। এভাবেই বাঁচতে হবে তাকে যে ক’বছর বাঁচে। ডাক্তারের একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একটি সম্পূর্ন সুস্থ শিশু পৃথিবীতে আসার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ল।

 

২/

মেয়েটির মা বাড়ী বাড়ী গিয়ে শাড়ি বিক্রি করত। ছোটখাট মহিলাটি রুচিশীলা। গরীব হলেও ফিটফাটভাবে চলে। মেয়েটিও সাথে আসত মাঝেমাঝে। আট বছর বয়সী চঞ্চলা মেয়েটি একদিন রাস্তা পাড় হতে গিয়ে গাড়ীচাপা পড়ল। ডাক্তার বলল ওর আহত পা টি কেটে ফেলতে হবে। মেয়েটির বাবামা নানাভাবে ডাক্তারকে বোঝানোর চেষ্টা করল- আট বছর বয়সের একটি মেয়ে এক পায়ে কিভাবে বাকী জীবনটা পাড় করবে? গরীবের মেয়ে, কে বিয়ে করবে ওকে? বিয়ে না হলে সে নিজেই বা কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে? কোন কথা শুনলো না ডাক্তার, পা খানি কেটে ফেলে দিল। যেদিন মেয়েটাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেবে সেদিন ডাক্তার ওর বাবামাকে জানালো, ‘বিশ হাজারটা টাকা হলে আমরা ওর পাটা বাঁচাতে পারতাম’। কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগল ওর মা, ‘মাত্র বিশ হাজারটা টাকার জন্য ওরা আমার মেয়েটার পা কেটে তাকে চিরতরে পঙ্গু করে দিলো। আমার স্বামী বাবুর্চি, প্রতিবার রান্না করলে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পায়। কতদিন লাগত আমাদের বিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে? দরকার হলে আমরা ভিক্ষা করে এই টাকা জোগাড় করতাম। বিশ হাজারটা টাকার জন্য ডাক্তার আমার মেয়েটাকে পঙ্গু করে দিল। এখন আমি ডাক্তারকে কত টাকা দিলে সে ওর পা ফিরিয়ে দিতে পারবে?’

 

৩/

মেয়েটির আনন্দের সীমা নেই। সে প্রথমবারের মত মা হতে চলেছে। ডাক্তার বলেছে বাচ্চার সবকিছু ঠিক আছে, ডেলিভারীতেও কোন কমপ্লিকেশন হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। তাই সময় হলে সে ভর্তি হোল বাড়ীর পাশে ক্লিনিকে। ইন্টার্নী ডাক্তাররা ভাবল সহজ ডেলিভারী কেস, বড় ডাক্তারকে কল দিয়ে লাভ কি? বরং নিজেরা ডেলিভারী করে ফেলতে পারলে পুরো টাকাটা বেঁচে গেল। মাঝপথে সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে বড় ডাক্তারকে ডাকার সময় নেই, ওরা নিজেরাই যেমন বোঝে তেমন করে কার্যোদ্ধার করল। বাচ্চা ডেলিভারী হোল বটে কিন্তু মেয়েটা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত দিয়েও তাকে বাঁচানো গেলনা। বাচ্চাটাও বেঁচে থাকার আপ্রান চেষ্টা করে ক’দিন পর মারা গেল। ভেঙ্গে গেল একটি সুখস্বপ্ন, চলে গেল দু’টি প্রান।

 

আমার বান্ধবী ডাক্তারী পাস করে আমার সাথে দেখা করতে এলো। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপাল লেঃ কঃ জিয়াউদ্দীন বীরোত্তম। তিনি বললেন, ‘So, you have got your licence to kill? আমি জীবনে অনেক মানুষ মেরেছি কিন্তু তাদের কষ্ট দেইনি। তুমি তো কষ্ট দেবে আবার সেজন্য পয়সাও নেবে!’ বান্ধবী খুব লজ্জা পেল।

 

কথাটা অবশ্য সবার ক্ষেত্রে সত্য নয়। আমার বান্ধবী নাহিদ আপা একজন আদর্শ ডাক্তার। তিনি একজন শিশু ক্যান্সার স্পেশালিস্ট। তাঁর আয়ের অধিকাংশ ব্যায় হয় রোগীদের ওষুধ পথ্য ইত্যাদির পেছনে। এমনকি যখন তিনি মাত্র ক্যারিয়ার শুরু করেছেন তখনো তিনি নিজের চেয়ে রোগীদের কথা ভাবতেন বেশি। আমার প্রথম সন্তান হবার সময় আমি ডাক্তারের কাছে যেতে চাইতাম না, ফাঁকি দিতাম। তিনি তখন আমাকে ক্লাসের ভেতর থেকে পাকড়াও করে চেকাপ করতেন (আমি তখন শিক্ষকতা করতাম এবং তিনি ছিলেন সেই স্কুলের ডাক্তার, সপ্তাহে একদিন স্কুলের সমস্ত বাচ্চাদের চেকাপ করতে আসতেন)। দিন নেই রাত নেই ফোন করে যেকোন সমস্যার ব্যাপারে পরামর্শ নিতে পারতাম। যেদিন রাদিয়া পৃথিবীতে আগমন করল সেদিন তিনি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমার পাশে আমার হাত ধরে ছিলেন। হাফিজ সাহেবকে বলে রেখেছিলেন, ‘দেখুন, যারা রেহনুমাকে দেখতে আসবেন তাঁরা সবাই আমার স্যার ম্যাডাম। তাঁরা টাকার জন্য সিজারিয়ান করতে চাইবেন। আমিও তাদের সাথে সাথে বলব, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হাফিজ ভাই, সিজার করা ছাড়া কোন উপায় নেই’। কিন্তু আপনি কিছুতেই রাজী হবেন না। যদি সত্যিই প্রয়োজন হয় তাহলে আমি আপনাকে বলব’। রাদিয়ার জন্মের পর বাচ্চাকে কিভাবে যত্ন নিতে হয়, নিজের কিভাবে যত্ন নিতে হয় সব শিখিয়ে দিয়ে তিনি গেলেন একটি বিয়ের দাওয়াত খেয়ে নিজের বিবাহবার্ষিকী পালন করতে। আবার সন্ধ্যার পর বাচ্চার জন্য জামাকাপড় কাঁথা নিয়ে ফিরে এলেন। আমি বাসায় ফিরে যাবার পর আমাকে আর হাসপাতালে যেতে হয়নি কারণ তিনি বাসায় এসে চেকাপ করে যেতেন। ভাবছেন, বান্ধবী বলে তিনি এই কাজ শুধু আমার জন্য করতেন? না, তিনি প্রতিটা রোগীকে এভাবেই খেয়াল করতেন, রোগীদের নবাগত সন্তানদের জন্য গ্রামের এক দর্জীকে দিয়ে নরম ধুতি কাপড়ের কাঁথা আর পাতলা সুতি জামা বানিয়ে বাসায় জমা করে রাখতেন। বাংলাদেশে এমন ডাক্তারও আছে।

 

কিন্তু প্রথমে যেসব উদাহরণ দিলাম তেমন ডাক্তারেরও অভাব নেই, এটাই দুঃখের কথা।

 

ছোটবেলায় রিডার্স ডাইজেস্ট আদ্যোপান্ত গিলে খেতাম। তখনকার পড়া কয়েকটি ঘটনা আজও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

 

১/

দক্ষিণ আমেরিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক ডাক্তার জনসেবামূলকভাবে স্থানীয় রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়েছেন। এক কিশোরীকে দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, মেয়েটি পোকার কামড়ে উদ্ভটভাবে ফুলে যাওয়া ঠোঁটের চিকিৎসা করতে এলেও ওর মস্তিষ্কের ভেতর একটি প্রমান সাইজের টিউমার টাইম বোমার মত টিক টিক করছে, যেকোন মূহূর্তে ফেটে গিয়ে অঘটন ঘটতে পারে। এই অস্থায়ী হাসপাতালে টিউমারের অপারেশন করার মত ব্যাবস্থা নেই। ঠোঁটের অপারেশনটুকুই কেবল করতে পারেন তারা। মেয়েটিকে অপারেশন টেবিলে শোয়ানো হোল। কিন্তু অপারেশন শুরু করার আগেই মৃত্যু হোল মেয়েটির। যেখানে মৃত্যু একটি প্রাত্যহিক ঘটনা সেখানে কিশোরীটিকে নিয়ে হা হুতাশ করার সময় নেই কারো। মেয়েটির পরিবার দূরে বসে কাঁদছে। এত রোগীর ভিড়ে লাশ হস্তান্তর করার সময় নেই কারো। লাশ পরে দেয়া হবে। কিন্তু পরে লাশ হস্তান্তর করতে গিয়ে অস্থায়ী হাসপাতালের কর্মীরা এবং মেয়েটির পরিবারের সবাই হতবাক হয়ে গেল। তারা দেখতে পেলো মেয়েটির ঠোঁট দু’টো নিখুঁত যেন ওর ঠোঁটে কোনকালে কিছু হয়নি। এত রোগীর ভিড়েও ডাক্তার কোন এক ফাঁকে মৃত কিশোরীর শেষ ইচ্ছাটি পূরণ করে দিয়ে গেছেন।

 

২/

একুশ বছর বয়সী ছেলেটির একমাস পর বিয়ে হবে, খুশির অন্ত নেই। সহকর্মীর সাথে এই নিয়ে আলাপ করছিল। সহকর্মীটি চলে যাবার সময় সে দেখতে পেলো যে নির্মানস্থলে তারা কাজ করে সেখানে একটি ক্রেন থেকে আচমকা ছুটে যাওয়া একটি লোহার পাত বন্ধুটিকে দ্বিখন্ডিত করে দিতে যাচ্ছে। সে ছুটে গিয়ে বন্ধুটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। সহকর্মী বেঁচে যান, ছেলেটিও বেঁচে যায়, কিন্তু লোহার পাতের আঘাতে ওর দুটো হাতই কব্জী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব লোকজন দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। একজন সহকর্মী বুদ্ধি করে হাত দু’টো কুড়িয়ে নিয়ে, ধুয়ে, একটি প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে, বরফ দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তাররা টানা ৯০ ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে ছেলেটির হাতের প্রতিটি রক্তনালী এবং স্নায়ু যথোপযুক্তভাবে জোড়া দিয়ে হাত দু’টোকে আবার সচল করতে সক্ষম হন। তিনমাস পর ছেলেটির বিয়ে হয় এবং সে নিজ হাতে নববধূকে কোলে করে ঘরে তোলে।

 

৩/

তিনি ছিলেন দক্ষিন আমেরিকার একজন বিখ্যাত সার্জন। শহরটিকে যখন ভূমিকম্প নাড়া দিয়ে যায় তখন তিনি পঞ্চম তলায় রোগীর অপারেশনে ব্যাস্ত। ভূমিকম্পে ছয়তলা হাসপাতালটি সম্পূর্ন মাটিতে শুয়ে পড়ে। তাঁর বাবা ভাই মিলে ছয়জনে এসে বুঝার চেষ্টা করে পঞ্চম তলার ধ্বংসাবশেষ কোথায় থাকতে পারে এবং সেই বরাবর তারা খুঁড়তে থাকেন। একে একে চারদিন পার হয়ে যায়। অধিকাংশ লোকজন ততদিনে ধ্বংসাবশেষে আত্মীয় বন্ধুদের খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের অনেকেই পাগল ভেবে এই বাপ ভাইদের কান্ড দেখছে যারা চারদিন যাবত দিনেরাতে ধ্বংসাবশেষের মাঝে খুঁড়ে চলেছে। পঞ্চমদিন তারা তাঁকে উদ্ধার করতে সক্ষম হোল। আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর শরীরের কোথাও কোন ক্ষতি হয়নি, সম্ভবত হাসপাতালের একটি বিছানার নীচে তিনি লুকিয়েছিলেন যা কংক্রিটের ভার সামলেছিল। কিন্তু তাঁর হাত দু’টি দিনের পর দিন কংক্রিটের নীচে চাপা পড়ে থাকায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসার পর হাতের তালু দু’টি বাঁচানো গেলেও আঙ্গুল সব কেটে ফেলতে হোল। তাঁর বাবা ভাইরা মিলে তাঁকে বুঝালেন তিনি বেঁচে আছেন সেটাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় কথা। কিন্তু তিনি মনে শান্তি পেলেন না। তিনি ভাবলেন এতগুলো মানুষের মাঝে গড তাকে বাঁচিয়ে রাখলেন, সবার আত্মীয় স্বজন যখন হাল ছেড়ে দিলো তখনো তাঁর বাবা ভাইরা দিনরাত পরিশ্রম করে তাঁকে খুঁজে বের করলেন – এর পেছনে সৃষ্টিকর্তার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আবার ডাক্তারী শুরু করবেন- রোগী দেখা ডাক্তারী নয়, তিনি আবার সার্জন হিসেবেই কাজ করবেন। কিন্তু একটিও আঙ্গুল ছাড়া তিনি এই কাজ কিভাবে করবেন? এক বন্ধু সার্জনের সাথে কথা বলে তিনি নিজের ওপর অপারেশনের ব্যাবস্থা করলেন। তাঁর পায়ের সমস্ত আঙ্গুল কেটে নিয়ে তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলোর জায়গায় বসিয়ে দেয়া হোল। কয়েক মাসের ভেতর তিনি প্র্যাক্টিস করতে করতে এই আঙ্গুল দিয়ে স্ক্যাল্পেলের মত সুক্ষ্ম জিনিস ধরতে এবং তা দিয়ে কাজ করতে সক্ষম হলেন। ফিরে এলেন জনসেবায়। সৃষ্টিকর্তা যে জীবন তাকে দিয়েছেন তা স্রষ্টার সৃষ্টির সেবার নিয়োজিত করলেন।

 

এমন লোকজনেরই ডাক্তার পড়া উচিত যারা ডাক্তারীকে জনসেবার একটি মাধ্যমে হিসেবে নেন। তাহলে হয়ত তারা যখন একজন রোগীর দিকে দৃষ্টিপাত করবে তখন চোখে একজন বৃদ্ধ বাবা, একজন ছোট বোন, একজন কর্মঠ ভাইকে দেখবে – ডাইনিং টেবিলে মুরগীর রান, নতুন ফার্নিচার কিংবা দেয়ালজোড়া টিভি নয়। তাহলেই হয়ত এই মহৎ পেশাটি প্রথম প্রকার ডাক্তারদের মত লোকজনের দ্বারা সৃষ্ট দুর্নাম হতে রক্ষা পাবে, রক্ষা পাবে অনেক জীবন, বৃদ্ধি পাবে সমাজের মানুষগুলোর সুস্থতা এবং একজন ডাক্তারের লাইসেন্স টু কিল হয়ে যাবে তাঁর লাইসেন্স টু সার্ভ।

Saturday, July 20, 2013

আমার বাড়ী পরিবর্তন এবং একটি আহলে কিতাব বিবাহ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা

মনে হচ্ছে যেন টাইটানিক ডুবে যাচ্ছে। পরিণতির পূর্বে এক মূহূর্তের জন্য ভেসে থাকা, অতঃপর সর্বগ্রাসী নৈরাজ্য। পুরাতন বাড়ীওয়ালা বেঈমানী করে বাড়ী বিক্রি করে দেয়াতে আট মাসের ব্যাবধানে আবার বাড়ী পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আমার মায়ের এবং আম্মার (শ্বাশুড়িমাতা) সংসারে দীর্ঘ সংসার জীবনের পরিক্রমায় সঞ্চিত বস্তুসামগ্রীর পরিমাণ দেখে সংকল্প করেছিলাম জীবনেও প্রয়োজনাতিরিক্ত একটি জিনিসেরও মালিক হতে চাইনা। বাজারে ঘুরাঘুরি করার কিংবা অহেতুক জিনিসপত্র কেনার অভ্যাস নেই মোটেই বরং অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দেয়ার কিংবা দিয়ে দেয়ার অভ্যাস বিদ্যমান। তবু আল্লাহ যাকে বরকত দেন সে কিভাবে জিনিস কমাবে? শেষ দিন পর্যন্ত মনে হচ্ছিল চারিদিক থেকে জিনিস বেরোচ্ছে, কেবল জিনিস আর জিনিস, John Donne এর A Hymn to God the Father কবিতার মত। মৃত্যুর পূর্ব মূহূর্তে তিনি ভয় পাচ্ছেন তাঁর পাপরাশি তাঁর ধ্বংসের কারণ হবে। তাই তিনি গডের কাছে নিজের পাপমোচন করিয়ে নিয়ে অতঃপর মৃত্যু দান করার আবেদন জানাচ্ছেন। কিন্তু গড যতই পাপরাশি ক্ষমা করে তাঁকে আশ্বস্ত করতে যান ততই তিনি নিজের নতুন নতুন পাপের তালিকা বের করেন যেগুলো থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত না হলে তাঁর মুক্তি নেই। ভাবছি এই জিনিসগুলো সব নতুন বাসায় গিয়ে বাছাই দিতে হবে। গতবার বাসা পরিবর্তনের সময় দুই ডাস্টবিন জিনিস ফেলে দিয়েছি এবং অন্তত বিশ পঁচিশ বস্তা জিনিস দান করেছি, তবু জিনিস কমেনা।

 

এই সময় খবর পেলাম আমাদের একজন বাংলাদেশী মুরুব্বী মারা গিয়েছেন। আমি চিনিনা, হাফিজ সাহেব কোন এক সময় তাঁর নাতনীকে পড়িয়েছেন। ঠিক করলাম জুমা পড়তে গেলে তাঁর জানাজার পর দাফনেও শরীক হব। আমি না গেলেও চলত কিন্তু কবরস্থানে গেলে নিজের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক থাকে। তাছাড়া আমার সন্তানদের মৃত্যুর প্রক্রিয়ার সাথে অভ্যস্ত করতে চাইছিলাম। প্রায় জুমাতেই মসজিদে জানাজা পড়ানো হয়, কবরস্থানেও ওদের প্রায়ই নিয়ে আসি। কিন্তু এর অন্তর্বতী সময়ে কি হয় সে প্রক্রিয়াটাও ওদের জানা থাকা দরকার। তাই সেদিনই বাসা পরিবর্তন করার কথা থাকলেও দুপুরে সব কাজ ফেলে ছুটলাম। জুমার সময় প্রচুর পরিমান ক্রিশ্চান লোকজনের উপস্থিতি দেখে ভাবলাম ওরা হয়ত ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য এসেছে, এখানে প্রায়ই এমন লোকজন ইসলামী অনুষ্ঠানগুলোতে আসে যেন ইসলাম গ্রহনের ব্যাপারে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। জুমা হোল, জানাজা হোল, তারপর আমরা শহরের বাইরে কবরস্থানে রওয়ানা হলাম। ওখানে গিয়েও দেখি ক্রিশ্চান গোষ্ঠী উপস্থিত। কৌতুহলী হলাম। মুসলিম গোরস্থানে ওদের কি উদ্দেশ্যে আগমন? আবার ওরা দেখি ক্যামেরা, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে প্রস্তুত, ছবি তুলবে। মহিলারা সামান্য দূরে দাঁড়িয়েছিল। যে পরিবারের উদ্দেশ্যে আমরা গিয়েছিলাম তাঁরা অনবরত দু’আ পড়ছেন। তাই নিজের দু’আ শেষ করে ক্রিশ্চান পরিবারটির সাথে কথা বলতে গেলাম। দেখলাম মহিলাদের মাঝে রয়েছেন প্রয়াতের স্ত্রী, তাঁর মেয়ে এবং তাঁর ছেলের গার্লফ্রেন্ড যে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ কেন তাকে তার বয়ফ্রেন্ডের পিতার কবরে নামতে দেয়া হবেনা বা অন্তত পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া হচ্ছেনা। তাকে বুঝালাম, কবরের পাশে যেতে মানা নেই, কিন্তু এই মূহূর্তে কবরের চারপাশে এতগুলো পুরুষ, আমরা মুসলিম মহিলারা সাধারনত পুরুষদের ভিড়ে যাইনা, ভিড় কমে গেলেই কবরের পাশে গিয়ে দু’আ করতে পারবে। প্রয়াতের মেয়েটিকে দেখছিলাম কিছুক্ষণ পর পর বাবাকে যেভাবে দেখেছে সেভাবে মুনাজাত করার চেষ্টা করছে কিন্তু সে জানেনা মুনাজাতে কি বলতে হয়। সে জানাল তার বাবা বসনিয়া থেকে এসে সেই পঞ্চাশ বছর আগে এখানে মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন করেন, এখানকার সবচেয়ে বড় মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি। যৌবনে বিয়ে করেছিলেন এক জার্মান ক্রিশ্চান ভদ্রমহিলাকে যিনি তাঁর চার সন্তানের জননী। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ইসলাম গ্রহন করেননি, চার সন্তানের মাঝে কেবল একটি পুত্র ইসলাম গ্রহন করেছে, বাকীরা ক্রিশ্চান। তাঁরা সবাই সন্তানাদি নিয়ে এসেছেন কবরে মৃত বাবার ছবি তুলতে, তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু এরা কেউ জানেনা কিভাবে বাবামায়ের জন্য কিংবা মৃত ব্যাক্তির জন্য দু’আ করতে হয়, কারো মাথায় নেই যে বাবা গত হয়ে গেলেও তাঁর জন্য আজীবন প্রার্থনা করা যায়। কিছুক্ষণ পর তারা তাঁকে কবরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে শুইয়ে রেখে চলে গেল, তাঁর জন্য প্রার্থনা করারও আর কেউ রইলোনা। তিনি সারাজীবন ইসলামের সেবা করে গেলেন, কিন্তু নিজের একটি সিদ্ধান্ত আজ তাঁকে কবরের কঠিন মাটিতে একা করে দিলো। ফিরে আসার সময় বুকের ভেতর মোচড় দিচ্ছিল এই ভিনদেশী মুসলিম ভাইটির জন্য যদিও যাওয়া হয়েছিল আরেকটি পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে।

 

বাসায় ফিরে এসে উর্ধ্বশ্বাস ব্যাস্ততায় নাভিশ্বাস অবস্থা। প্রায় সব জিনিস নতুন বাড়ীতে চলে গিয়েছে, তবু যা বাকী আছে তাতেই মাথা খারাপ অবস্থা। তাছাড়া আমি হোটেলে থাকতে গেলেও আসার আগে সব গুছিয়ে দিয়ে আসি যদিও কোন প্রয়োজন নেই, সেই আমি বাড়ী পরিস্কার করে না দিয়ে বাসা থেকে বেরোব? অসম্ভব! সে বাড়ীওয়ালা আমাদের সাথে যতই বেঈমানী করুক না কেন। বিকালের দিকে আমাদের বাংলাদেশী প্রতিবেশী আদিবার আব্বা আম্মা এবং অন্তরঙ্গ দুই বন্ধু পরিবার ইফতেখার ভাই এবং তুহিন ভাই এলেন সাহায্য করতে। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল রান্নাঘর যেহেতু বাড়ীর অর্ধেক জিনিসপত্র থাকে কিচেনে কিন্তু শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত এর ব্যাবহার অব্যাহত থাকে বিধায় এই ঘরটি সবার শেষে গুছাতে হয়। আদিবার আম্মা বেচারী এখানে হাত লাগিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন। তিনি আর রাদিয়া মিলে ফ্রিজের সব জিনিস বাক্সে ভরে, আধোয়া জিনিসপত্র ধুয়ে, রান্নাঘরের ফ্লোর পর্যন্ত ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিলেন। এই সহযোগিতার কি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শুকরিয়া আদায় হয়? সন্ধ্যা ছ’টায় ঘোর বৃষ্টির মধ্যে আমরা আগের বাসা চিরতরে ছেড়ে নতুন বাসায় এসে পৌঁছলাম। এসেই আবার এই বাসা পরিস্কার করা শুরু। আমাদের আগে যারা এ’বাড়ীতে ছিলেন তাঁরা বাড়ী ছেড়েছেন সেদিন দুপুরে, পরিস্কার করে দিয়ে যাবার সুযোগ পাননি। শিমু আপা দু’টো মুরগী রান্না করে দিয়েছিলেন আলু দিয়ে, সেই দিয়েই চলছিল গত দুইদিন, বাকী যা ছিল সেটাই বাচ্চাদের খাবার। কিন্তু দু’তিন দিনের ভেতর রোজা শুরু হবে, সোমবার থেকে অফিস, এখনই অন্তত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে না নিলে পরে ভীষণ সমস্যায় পড়ে যাব। তাই বিছানাপত্র গুছিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে ফ্রিজ, চুলা আর রান্নাঘরের সমস্ত তাক পরিস্কার করে জিনিসপত্র তুলে রাখার উপযোগী করতে লেগে গেলাম। সারাদিন মালপত্র টেনে ক্লান্ত হাফিজ সাহেব ঘুমিয়েছেন ন’টায়, বাচ্চারা সাড়ে দশটা এগারোটায়। আমি যখন একটা বাজে শুতে এলাম তখন ভাবছি, ‘কি রে! বিছানাটা এত শক্ত হয়ে গেল কি করে?’ সবদিকেই শুধু ব্যাথা পাই। বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল যে সমস্যাটা বিছানায় নয়, সমস্যাটা আমার কর্মক্লান্ত শরীরের।

 

ভোরবেলা ঘুম ভাংলো পাখীর ডাক আর গাছের পাতার সরসর শব্দে। দু’মাস ধরে খুঁজে কোথাও বাসা না পেয়ে অতিরিক্ত বড় হলেও এই বাসাটা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, তবে এ’বাসার বাগানটা আমার খুব পছন্দ। সামনের বাগানে দু’পাশে বিরাট বিরাট দু’টো গাছ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে; একপাশে ঝাউগাছ আর আরেকপাশে ছোট ছোট ঝোপ দিয়ে বেড়া দেয়া; কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দ লাল লাল পাতাওয়ালা নাম না জানা গাছটা যেটা বাচ্চাদের শোবার ঘরের জানালা দু’টো প্রতিবেশীদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছে। দরজার সামনে গোলাপগাছ মেহমানদের স্বাগত জানাচ্ছে। পেছনে বিশাল উঠোন। উঠোনের চারপাশটাই বেড়া আর বড় বড় গাছ দিয়ে প্রতিবেশীদের কৌতুহলী দৃষ্টি থেকে আড়াল করা। এর মধ্যে ডানপাশে একটা ব্লুবেরী গাছ, বামদিকে আপেল গাছ, পেছনে বেড়ার সাথে অনেকগুলো বড় বড় গাছের মাঝে একটা উইপিং বার্চ গাছ যার পাতাগুলো থরে থরে ঝুলে থাকে আর সামান্য বাতাসের ছোঁয়া পেলেই ঝুনঝুন করে বাজতে থাকে, একটু টিলার ওপর হবার ফলে এই এলাকায় বাতাসের কমতি হয়না। সকালে দেখলাম বাগানে অনেক পাখী আর কাঠবাড়ালী খেলে বেড়াচ্ছে, মনটা ভাল হয়ে গেল। বাচ্চাদের বাইরে খেলতে দিয়ে এবার গেলাম বাথরুম আর স্টোররুম পরিস্কার করতে কিন্তু মনে মনে চিন্তা ঘরে কোন তরকারী রান্না করা নেই, রান্না করার মত অবস্থাও নেই, ক্ষিদে পেলে বাচ্চাদের শুধু ডিম ভেজে ভাত খাওয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এ’সময় জেসমিন আপা খাবার পাঠালেন। মাছ, মাংস, সব্জী মিলিয়ে চার পাঁচরকম তরকারী, যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার। একটু পর পাশের বাসার প্রতিবেশি পরিচিত হতে এলেন আরবী মিষ্টি (বাকলাভা) নিয়ে যেটা আমার বিশেষ পছন্দ।

 

বিকালে মোটামুটি প্রয়োজনীয় গোছগাছটুকু হয়ে গেল, বাকীটা আস্তেধীরে হলেও চলবে। বড় মসজিদটা এখন আমাদের বাসা থেকে খুবই কাছে। আসরের নামাজের সময় মসজিদে গেলাম, বন্ধুরাও সবাই এলেন। ফিরে আসার সময় বন্ধুরা বললেন, ‘চলেন, আপনাদের নতুন বাসা দেখে আসি’। যা তাঁরা বলেননি তা হোল প্রত্যেকেই নানাবিধ খাবার রেঁধে নিয়ে এসেছেন- খিচুড়ি, ডাল, মুরগী, গরুর মাংস, সব্জি, বিরিয়ানী, পায়েস কিছুই বাদ নেই। রাত এগারোটা অবধি খাবার আসতে রইল। ততক্ষনে আমি ঘুম, হাফিজ সাহেব মেহমানদারী করছেন। সেই খাবার আজ এক সপ্তাহ পরেও শেষ হয়নি!

 

মাঝে ক’দিন টেলিফোন, নেট, টিভি কিছুই ছিলোনা। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও একটি পরিবার হিসেবে কাছাকাছি ছিলাম সবাই। এখন আবার সবাই ব্যাস্ত। তবে প্রায় দিনই নামাজ, জুমা বা তারাবীর জন্য সবাই মিলে মসজিদে যাওয়া হচ্ছে; বাসায় বন্ধুদের মেলা বসছে, উইকএন্ডে রাতব্যাপী মায়েদের নামাজ পড়া আর বাচ্চাদের উঠোনে খেলার সুযোগ হচ্ছে, ভোরবেলা পাখীরা আমাদের নামাজের জন্য ডেকে তুলছে আর পাতার সরসর শব্দে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যেতে ভালই লাগছে! কেবল অবসরে মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, আমাদের সেই বসনিয়ান ভাইটি কবরের মধ্যে ভাল আছেন তো?

Thursday, July 4, 2013

একটি উত্তম বৃক্ষ


ছাত্রজীবনে ভাল তার্কিক ছিলাম, চ্যাম্পিয়ন হয়েছি কয়েকবারই। তবে বাস্তবজীবনে আমি একজন উত্তম শ্রোতা, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে মৌন থাকতেই ভালবাসি। ঝগড়ার অভ্যাস নেই, যারা বকতে চায় তাদের ইচ্ছেমত বকতে দেই, উত্তর না পেয়ে একসময় তারা নিজেরাই চুপ হয়ে যায়। শুধুমাত্র ভদ্রতা বজায় রাখা এবং অন্যের প্রয়োজনে সাড়া দেয়া ব্যাতীত কথা বলে সময় নষ্ট করার চেয়ে কিছু পড়া বা কোন গঠনমূলক কাজ করায় সময় দেয়াটাই শ্রেয় মনে হয়। সেই নবম শ্রেনীতে কঠোর সংকল্প করেছিলাম কথা বলা কমিয়ে দেব। দীর্ঘ সময় সাধনা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে এই পর্যায়ে এসে হাতেগোণা কিছু মানুষ ছাড়া সবার সাথেই আমি খুব ভেবেচিন্তে, মেপেঝুঁকে, যুক্তি দিয়ে কথা বলি। তারপরও যারা তর্ক করতে চায় তাদের ক্ষেত্রে ইমাম গাজ্জালীর পদ্ধতি অনুসরন করার চেষ্টা করি। তাঁর শব্দগুলো হুবহু মনে নেই তবে কথাগুলো ছিল মোটামুটি এরকম, ‘কেউ যদি আমাকে জানার জন্য প্রশ্ন করে তবে আমি তাদের সাধ্যমত উত্তর দেই; কেউ যদি তর্ক করার উদ্দেশ্যে আমাকে কিছু বলে আমি তাকে বলি ‘সালাম’ এবং অতঃপর তার কথার কোন উত্তর দেইনা; কোন পাগল যদি আমাকে কোন প্রশ্ন করে আমি তাকে কোন উত্তর দেইনা যেহেতু তার বোঝার ক্ষমতা নেই; কোন মূর্খ ব্যাক্তি আমাকে কোন প্রশ্ন করলে আমি তাকেও কোন জবাব দেইনা কারণ ঈসা (আ) অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন কিন্তু কোন মূর্খ ব্যাক্তিকে জ্ঞানী বানাতে পারেননি’।

 

খুব অবাক হই যখন দেখি মানুষ তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বিতর্ক করে সময়, মেধা এবং শ্রম নষ্ট করে; কাউকে দু’কথা শুনিয়ে দিয়ে তৃপ্তিলাভ করার উদ্দেশ্যে নিজের মুখ এবং অন্যের চরিত্রের পবিত্রতা নষ্ট করে; নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠিক এবং অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতেও পিছপা হয়না। আমার এক অতি জ্ঞানী মামা একবার আমার বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ের আনন্দে পানি ঢেলে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘বিতর্ক একটা বাজে জিনিস। তুমিই বল, বিতর্কে কে জেতে? যে সত্য বলল সে না যে যুক্তিতর্ক দিয়ে মিথ্যাটাকেও সত্য প্রমাণ করতে পারল সে?’ সেদিন থেকেই বিতর্ক বাদ দিলাম। উকিল হবার শখ ছিল Paper Chase আর L.A. Law তে তুখোর সব উকিলদের অকাট্য সব যুক্তি দেয়া দেখে, সেই ইচ্ছাও বাদ দিলাম। জীবনে একটি কাজ করতে কখনো পিছিয়ে যাইনি তা সে যতই কঠিন হোক না কেন, তা হোল সত্যকে গ্রহণ করা। মতের অমিল সত্ত্বেও অন্যের ভালোটুকু গ্রহণ করতে পারলে লাভ আমারই, আর ভাল সবার মাঝেই আছে, এমনকি শয়তানের মাঝেও শিক্ষণীয় অনেক গুন আছে-  সে অন্যকে পথভ্রষ্ট করলেও নিজে একজন উত্তম ইবাদাতকারী, সে তার সৃষ্টিকর্তাকে উত্তমরূপে জানে এবং তার অধ্যাবসায় অতুলনীয়, সে কখনোই হাল ছেড়ে দেয়না।

 

একবার আই আই ইউ সি অফিসে বসে আছি, একটা ফোন এলো, রঙ নাম্বার, কিন্তু লোকটা ইংরেজীতে ক’খানা অশ্রাব্য শব্দ উচ্চারণ করে নিজের পরিচয় উপস্থাপন করল, তারপর লাইন কেটে দিল। ফাহমিদা শুনে বলল, ‘আপনি হলেন ইংরেজীর মাস্টার, সে দু’টো কথা শোনালে আপনি তাকে পনেরো মিনিট লেকচার শোনাতে পারতেন। অথচ আপনি কিছুই বললেন না?!’ বেচারী আমাকে বড় ভালোবাসে তাই এটুকুও ওর সহ্য হোলনা। কিন্তু আমি তাকে বোঝালাম, ‘বললে কি হত বল? আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করা হত, ব্যাপারটা নিয়ে একটু অহংকারের প্রকাশ ঘটত, ওর দু’টো গুনাহর বদলে আমি পনেরোটা গুনাহ সঞ্চয় করতাম। এই তো? কিন্তু আমি ওর সাথে পনেরো মিনিট নষ্ট করার পরিবর্তে দশ মিনিটে কুর’আনের দু’টো পৃষ্ঠার অনুবাদ পড়লাম, তারপর পাঁচ মিনিটে তোমাকে এর সারাংশ শোনালাম। কোনটাতে লাভ বেশি হোল বল দেখি?’ ফাহমিদা একা নয়, চুপ করে থাকি বলে অনেকেই আমাকে বোকা ভাবে, ‘এ’ কেমন প্রানী, চোখের সামনে লোকে বলে যায় অথচ সে একটা টুঁ শব্দ করেনা?’ কিন্তু দেখুন আল্লাহ কি বলছেন, ‘রহমান-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন মুর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম’ (সূরা ফুরক্কানঃ আয়াত ৬৩)। একজন বিশ্বাসীর মাঝে কাঙ্খিত গুনাবলীর একটি হোল, তারা ‘অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত’ (সূরা মুমিনূনঃ আয়াত ৩) এবং ‘যখন তারা কোন বাজে কাজ কিংবা অসাড় কথাবার্তার নিকটবর্তী হয় তখন তারা এতে যোগ না দিয়ে সম্মানের সাথে চলে যায়’ (সূরা ফুরক্কানঃ আয়াত ৭২)।

 

‘পরম করুণাময় আল্লাহ, যিনি কুর’আন শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’ (সূরা রাহমানঃ আয়াত ১-৪)। সেই ভাষার উদ্দেশ্য তিনি উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখাপ্রশাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল দান করে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন-যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। এবং নোংরা বাক্যের উদাহরণ হলো নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির উপর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। এর কোন স্থিতি নেই’ (সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত ২৪-২৬)। সুতরাং, ভাষার উদ্দেশ্য হোল এর মাধ্যমে উত্তম ফললাভ করা, যে কথার উদ্দেশ্য বিধেয় ঠিক নেই সে কথা থেকে কোন ফল আশা করা যায়না, এমনকি আল্লাহ বলছেন, ‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম অবয়বে, অতঃপর তাকে পৌঁছে দিয়েছি নিকৃষ্টতম পর্যায়ে’ (সূরা ত্বীনঃ আয়াত ৪-৫)। সেই পর্যায়ে পৌঁছনোর জন্য কথাও একটি মাধ্যমে বটে!

 

ফলের কথায় জান্নাতের প্রসঙ্গ মনে এলো। এর বর্ণনায় বিবিধপ্রকার খাবার, পোশাক, বাড়ীঘর এবং সম্পদের চাকচিক্যের কথা এসেছে। স্বভাবজাতভাবে আমি অত্যন্ত নীরস প্রকৃতির, খাবার দাবাড় এবং চাকচিক্যময় বস্তুসমূহের প্রতি আমার আকর্ষন কম। তাছাড়া নিজের কর্মকান্ডে আমি নরকে না যাওয়া নিয়ে এতটা চিন্তিত যে স্বর্গে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ বিশেষ একটা হয়ে ওঠেনা। তাই জান্নাতের বর্ণনাসম্বলিত আয়াতগুলো পড়ে যতটা না উজ্জীবিত হই তার চেয়েও বেশি হতাশ হই যে এখানে আমি কিছুতেই প্রবেশাধিকার পাবোনা। তবে আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি সূরা হোল সূরা গাশিয়াহ, এই সূরার দু’টো আয়াত আমাকে বেহেস্তে যাবার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আমি অত্যন্ত আরামপ্রিয়। তাই যতবারই পড়ি, ‘সেখানে সারি সারি বালিশ সাজানো থাকবে’ (আয়াত ১৫), নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায়, স্বর্গীয় বালিশের সারির প্রতি প্রলুব্ধ হই। অপর যে বিষয়টি আমাকে স্বর্গীয় উদ্যানসমূহের প্রতি আকর্ষন করে তা হোল, ‘সেখানে তারা কোন অসাড় কথাবার্তা শুনবেনা’ (আয়াত ১১)। চুপ করে থাকি তার অর্থ তো আর এই নয় যে মানুষের কথায় কষ্ট পাইনা! সৃষ্টিকর্তা যে মুখখানা দিয়েছেন অপরের প্রয়োজনে সাড়া দিতে, দু’টো মায়াভরা কথা বলে সমবেদনা জানাতে, ক’টা বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শের মাধ্যমে অন্যের সমস্যার সমাধান দিতে সে মুখখানা দিয়ে মানুষ কি ভয়ানক সব অস্ত্র ছুঁড়ে মারে, কি অশ্লীল সব শব্দাবলী উচ্চারণ করে, কি নির্লিপ্তভাবে অন্যের হৃদয়ে মারিয়ানার গহ্বর সৃষ্টি করে দিয়ে অহংবোধ করে! হৃদয় তো ভারাক্রান্ত হবেই। তখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় সেই উদ্যানে যেখানে ‘তাদের সম্ভাষন হবে ‘সালাম’ (সূরা ইবরাহীমঃ আয়াত ২৩)। কতইনা সুন্দর সে সম্ভাষন! অথচ তারা বোঝেনা, আজ যারা ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে অন্যের মনে কষ্ট দিচ্ছে তাদের নিক্ষেপ করা হবে এমন এক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে, ‘যা তাদের হৃদয় পর্যন্ত পৌছবে’ (সুরা হুমাযাহঃ আয়াত ৭), শুধু শরীর দাহ করে ক্ষান্ত হবেনা।

 

আল্লাহ বলেন, ‘ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তাআলা দয়া করবেন’ (সূরা তাওবাহঃ আয়াত ৭১)। রাসূল (সা), যিনি ছিলেন কুর’আনের বাস্তব প্রতিবিম্ব, তাঁকে আমরা দেখি তিনি ছিলেন মিতবাক, হাসিমুখে কথা বলতেন, অতিরিক্ত জোরেও কথা বলতেন না আবার অতিরিক্ত নীচুস্বরেও নয়, প্রয়োজনীয় কথা সর্বোচ্চ তিনবার বলতেন, রেগে গেলেও কথাবার্তায় মাত্রা ছাড়িয়ে যেতেন না, মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র আচরন করতেন, অন্যায়কারীর প্রতি ছিলেন ক্ষমাশীল, উপদেশদানে অগ্রগামী। তিনিই আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে সকল পরিস্থিতিতে ভাল কথা বলতে হয়, ভাল আচরন করতে হয়। কিন্তু আমরা, তার অনুসারীরা, তাঁকে কতটুকু অনুসরন করি?

 

রাসূল (সা) বলেছেন, যদি আমরা জানতে পারি আগামীকাল কিয়ামত হবে তবু যেন আমরা ভাল কাজ করা বন্ধ না করি, এমনকি যদি তা হয় একটি চারাগাছ লাগানো, যদিও আগামীকালের কিয়ামতে তা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু আমার উত্তম নিয়াতটি আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকবে, হয়ত এই চারাগাছটিই আমাকে বাঁচাবে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি থেকে! তাই প্রতিদিন এখানে সেখানে ছোট ছোট চারাগাছ লাগাই- ট্রেনে দশ মিনিটের জন্য পরিচয় হওয়া মেয়েটির মনে, অফিসের লিফটে এক মিনিটের সাহচর্য পাওয়া মহিলাটির মানসে, খাবার দোকানের দোকানীটির মাথায়, বন্ধুদের আসরে, পথচলতি পথিকের হৃদয়ে- হয়ত একদিন এই চারাগাছগুলো ডালপালা মেলে দাঁড়াবে, হয়ত একদিন এদের শাখাপ্রশাখায় পাখীরা আশ্রয় খুঁজে নেবে, হয়ত একদিন এর বীজগুলো ছড়িয়ে পড়বে আরো হাজারো হৃদয়ে, আবার হয়ত কিছুই জন্মাবেনা এগুলো থেকে, মুকুলেই ঝরে যাবে সব। কিন্তু হয়ত আমার প্রতিপালক আমার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে বলবেন, ‘যাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম!’ সেদিনের আশায় চলুন আমরা সবাই উত্তম বৃক্ষসমূহের চারাগাছ বুনি। হয়ত আমারটি প্রস্ফুটিত হবেনা, হয়ত আপনারটি হবে। তখন নাহয় উত্তম পরামর্শের বাহানায় সেখানে আমিও কিছু ভাগ বসাব!


 

Monday, July 1, 2013

বাদল দিনের বন্ধুরা

১৪ই জুন ২০১৩, শুক্রবার

আজ যখন কাজ থেকে ফিরছি তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে গায়ের জ্যাকেটটা ওয়াটারপ্রুফ আর তাতে একটা মাথার আচ্ছাদন আছে, তাতেই খানিকটা বাঁচোয়া। ট্রেন থেকে নেমে যখন বাসার দিকে আসছি তখন দেখি এক বুড়া দাদা মনের সুখে ঢাউস সাইজের একখানা গাড়ী নিয়ে যেতে যেতে হাত নাড়ছেন। চারিদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম তিনি আমাকেই হাত নাড়ছেন যেহেতু আশেপাশে আর কেউ নেই। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না তাঁকে আমি কিভাবে চিনি। রাস্তা পাড় হয়ে বাসার সামনে আসতে আসতে দেখি উনি গাড়ী ঘুরিয়ে আমার সামনে এসে পড়েছেন, জানালার কাঁচ নামিয়ে বললেন, 'আমি কি তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে পারি?' চেহারা দেখে নিশ্চিত হলাম আমি তাঁকে কোনভাবেই চিনিনা। তিনি দাদা হলেও ক্যানাডিয়ান দাদা। বেরিয়েছেন বৃষ্টিতে কারো উপকার করা যায় কিনা এই উদ্দেশ্য নিয়ে। জানালাম, যে বাসার সামনে তিনি গাড়ী থামিয়েছেন এটাই আমার বাসা। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলাম, 'আহা! চাকরী তাঁকে অবসর দিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তিনি কাজ থেকে অবসর নেননি, জনহিতকর কাজ থেকে অবসর না নেয়াই তো জীবনের সার্থকতা!'

 

২০শে জুন ২০১৩, বৃহস্পতিবার

আমি ডাউনটাউনের যে স্টেশনে নামি সেখানে ট্রেন থেকে নেমেই উর্ধ্বশ্বাসে কর্মস্থলের দিকের ছুটে চলা মানুষগুলোকে খবরের কাগজ বিতরণের অলোভনীয় এবং নিষ্ফল কাজটি করেন এক বুড়ো দাদা। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা নির্বিশেষে প্রতিদিন সকালে তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি কাগজ নিয়ে, হাতখানা বাড়িয়ে। আমি কোনদিনই কাগজ নেইনা যদিও এগুলো ফ্রি বিলি করা হয়। কাগজে কোন ভাল খবর ছাপা হয়না, দুনিয়ার যত খারাপ কাজ আর বাজে লোকজনের কীর্তিকলাপের খবর পড়ে কোন লাভ নেই তাই। আজও জানিনা দাদাটির নাম কি, কোথায় থাকেন, পরিবার পরিজন আছে কিনা। কিন্তু প্রতিদিন সকালে চলার পথে একটু হাসি কিংবা দু’টো শব্দ দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাতে ভুল হয়না।

আজ সারারাত প্রচন্ড বজ্রপাতের সাথে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সকালেও দেখি আকাশের ভান্ডারে মেঘ ফুরোয়নি। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে টের পেলাম শুধু বৃষ্টি আর বজ্রপাতই নয়, সাথে বইছে প্রবল বাতাস। এখানে সাধারনত অল্প বৃষ্টি হয়েই বন্ধ হয়ে যায়, তাই এই বৃষ্টি মাতৃভূমির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বার বার। ঝুম বৃষ্টির কারণে ট্রেনের দরজা একবার খুললে বন্ধ হতে চাচ্ছিল না যেহেতু সেন্সর দেখাচ্ছিল কেউ ঢোকার চেষ্টা করছে। শেষপর্যন্ত যখন আমার স্টেশনে পৌঁছলাম তখন দেখি কাগজ বিলি করেন যে দাদা তিনি নেই। হেঁটে যেতে যেতে তবু রেইনকোটের হুডের নীচে থেকে ইতিউতি তাকাচ্ছিলাম তাঁকে দেখা যায় কিনা। হঠাত চোখের কোণায় ধরা পড়ল পথের পাশে একটা দোকানের সানশেডের নীচে থেকে রেইনকোট পরা কেউ জোরেজোরে হাত নাড়ছে, হাতে ধরা পেপারটা দেখে বুঝলাম ইনি আমার সেই খবরের কাগজ বিলি করা দাদা, আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য হাত নাড়ছেন, ‘ভেবোনা, আমি আছি’, যদিও তিনি জানেন আমি কাগজ নেবোনা!

 

২১শে জুন ২০১৩, শুক্রবার

গতকাল দুপুর থেকে State of Local Emergency ঘোষনা করা হয়েছে। নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে নাকি দু’জন মানুষসহ একটি মোবাইল হোম ভেসে গিয়েছে। অবশ্য ১৭ তলার ওপর অফিসে বসে ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল কোথাও কোন ভুল হচ্ছে। তবে অফিস থেকে আসার পথে যখন দেখলাম যে শীর্ণকায়া বো নদী দেখে বাংলাদেশের নদীগুলোর সাথে তুলনা করে হাসি পেত, যার পেটের ভেতর প্রতিটা নুড়ি পাথর পঞ্চাশ হাত ওপরে ব্রিজ থেকে দেখা যেত, তার পানি ঘোলা হয়ে প্রচন্ড বেগে প্রবাহিত হচ্ছে, পানি প্রায় ব্রিজ ছুঁই ছুঁই, তখন ভাবলাম তাহলে নদীর আশেপাশে প্লাবিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

আজ সকালে বাসার সামনে স্টেশনে গিয়ে একটু অবাক হলাম। গত পাঁচ বছরে কোনদিন দেখিনি সকালবেলা স্টেশন পরিস্কার করা হয়নি। সর্বত্র বাতাসে বেঁকে যাওয়া ভাঙ্গা ছাতা ছড়িয়ে রয়েছে। ভাবলাম, ‘কি জানি, আমার মত ভোর সাড়ে পাঁচটায় কাজে রওয়ানা হয় এমন পাগল ক’জন আছে? হয়ত ঝড়বৃষ্টির কারণে ওরা পরিস্কার করে কুলিয়ে উঠতে পারেনি!’

কিন্তু তিন স্টেশন গিয়ে সবাইকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়া হোল। সামনে ট্রেনের লাইন নাকি পানির নীচে, বাকী পথটুকু বাসে যেতে হবে। বাস আসে বাস যায়, আমি কিছুতেই স্বাস্থ্যবান লোকজনের ভিড় ঠেলে উঠতে পারিনা। একবার উঠলাম কিন্তু দরজা বন্ধ করা যাচ্ছেনা বলে নেমে গেলাম। কিছুক্ষণ পর বাস স্টেশনে যিনি নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি জানালেন একটি রাস্তা দিয়েই ডাউনটাউনে যাওয়া যাচ্ছিল, সে রাস্তাটিও এখন ভিড়ের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সম্ভব হলে অফিসে ফোন করে ছুটি নিয়ে নিতে। তখন বাজে সাতটা। কি আর করা? জেইনকে ফোন করলাম। সে বলল আমাদের গ্রুপের প্রায় সবাই ফোন করে জানিয়েছে যাবার কোন পথ নেই। ফিরে এলাম বাসায়। বহুদিন পর বড় মসজিদটায় জুমা পড়ার সুযোগ হোল যদিও ছাতা মাথায় দিয়েও জামাকাপড় ভিজে শেষ।

রাতে ইফতেখার ভাই বললেন, ‘চলে আসুন, একসাথে খাই’। ভাবী খাবার সাজাতে সাজাতে টিভিতে খবরে দেখলাম শুধু ক্যাল্গেরী নয়, আশেপাশের সমস্ত শহর প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে নৈসর্গিক দৃশ্যের লীলাভূমি ক্যানমোরে বাড়ীঘর থেকে রাস্তা পর্যন্ত সব টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে গিয়েছে। ক্যাল্গেরীর কিছু কিছু এলাকায় নদীপাড়ে বিলাসবহুল সব বাড়ীঘর দোতলা পর্যন্ত পানির নীচে, কিছু কিছু বাড়ী ভেসে গিয়ে নদীপাড়ে কিংবা ব্রিজের সাথে প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ডাউনটাউনে তিনফুট পানি, যারা সকালে গিয়েছিল তাদের সবাইকে সাঁতার কেটে ফিরে আসতে হয়েছে, অফিসের সামনে নদীর ধারে যে পার্কে জেইন আর আমি প্রতিদিন হাঁটতে যাই সেসব জায়গায় প্রচন্ডবেগে নদী প্রবাহিত হচ্ছে আর তাতে হাঁসগুলো মনের আনন্দে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। শুনলাম চিড়িয়াখানার প্রানীগুলোকে কোর্ট বিল্ডিংয়ে স্থানান্তর করা হতে পারে। এই খবরে বেশ মজা পেলাম। কোর্ট বিল্ডিংয়ে সাধারনত এমন সব মানুষদের বিচার করা হয় যাদের মাঝে মানবিক অপেক্ষা পাশবিক গুনাবলী অধিকরূপে বিদ্যমান, আর এখন আদতেই সব পশুদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!

ক্যানমোর
 
বন্যার্ত ক্যানমোর


পানির নীচে ডাউনটাউন

রাতে সোমালী বান্ধবী আয়শার খবর নিলাম, সে বোনের বিয়ের জন্য টরোন্টোগামী, সুতরাং নিরাপদ আছে। কিছুক্ষণ পরই জেইন ফোন করে জানালো আমাদের গ্রুপের সবাই নিরাপদ আছে, শুধু হ্যাভিয়েরকে ডাউনটাউনের বাসা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে যেহেতু বিদ্যুতায়িত হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে ডাউনটাউনবাসীদের রক্ষা করার জন্য ওখানে সব বিল্ডিংয়ের বিদ্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

 

২২শে জুন ২০১৩, শনিবার

বাংলাদেশের মেয়ে আমি কোনদিন বাংলাদেশে বন্যা দেখিনি। ছোটবেলায় বিদেশে ছিলাম, টিভিতে কিছু নিউজক্লিপ দেখেছি কিন্তু তখনকার রিপোর্টিং আজকালকার মত নিবিড় ছিলোনা। বিয়ের সময় দেশে বন্যা ছিল, আমরা বললাম অনুষ্ঠান লাগবেনা, অনুষ্ঠানের টাকা বন্যার্তদের দান করে দেয়া হোক, আমাদের অভিভাবকরা রাজী হলেন না। আমাদের অবিরাম চেষ্টায় হলুদ, গানবাজনা, লাইটিং সব বাদ দেয়া গেল কিন্তু আড়ম্বরহীন হলেও অনুষ্ঠান একটা হোলই। বিয়ের পর ছিলাম চট্টগ্রামে, সেখানে পাহাড়ী ঢল নামে বটে কিন্তু বন্যা হয়না। শেষমেশ বন্যা দেখলাম এই ক্যাল্গেরী এসে। ওদের খুব বড় একটা অনুষ্ঠান হোল স্ট্যাম্পিড, এই মেলার জন্য অ্যামেরিকা থেকে পর্যন্ত লোকজন আসে যদিও সে সময় মদের গন্ধে রাস্তাঘাটে হাঁটা যায়না বলে অনেকসময় ক্যাল্গেরীর সচেতন লোকজনও ক্যাল্গেরী থেকে পালিয়ে বাঁচে। সেই স্ট্যাম্পিডের মাঠ এমনভাবে পানির নীচে তলিয়ে গেল যে মাটি দেখাই যায়না। স্যাডেলডোম স্টেডিয়ামের নীচের সাতটি সারির সব সীট, প্লেয়ারদের ইকুইপমেন্ট রুম থেকে ড্রেসিং রুম সব শেষ। ক্যানাডিয়ানরা আবার অভাবকে মৃত্যুর চেয়েও বেশি ভয় পায়, তাই সব দোকানের মালপত্র খালি হয়ে গেল, সব জিনিস মানুষের বাসায়!
পানির নীচে স্ট্যাম্পিডের মাঠ
 
স্যাডেলডোম স্টেডিয়ামের ভেতরেও পানি
 

মেয়র বলে দিলেন ডাউনটাউন অন্তত বুধবার পর্যন্ত বন্ধ, পানির ব্যাবহার সীমিত করতে হবে এবং লোকজন যেন যথাসম্ভব ঘরেই অবস্থান করে। কিন্তু ঘরে অবস্থান করা গেলনা। বান্ধবী তানজিন বহু আগে থেকেই দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল আমাদের প্রায় সত্তুরজনকে। সবাই মিলে ওর বাসায় মজার মজার খাবার খেলাম তারপর মসজিদে গেলাম, বন্যার মাঝেও একটা সুন্দর দিন কাটল।

 

২৬শে জুন, ২০১৩

অপ্রত্যাশিতভাবে পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় আজ থেকে ডাউনটাউন জনসাধারনের জন্য সীমিতভাবে খুলে দেয়া হোল। ডাউনটাউনে তিনটি ট্রেনের লাইন যায়, একমাত্র আমাদের লাইনটিই সম্পূর্নরূপে চালু হোল। অফিসে পৌঁছে জানতে পারলাম আমাদের গ্রুপে শুধু হ্যাভিয়ের ছাড়া কারো কোন ক্ষতি হয়নি। সে বেচারা দু’সপ্তাহের বাজার করেছিল বন্যার দু’দিন আগে। ডাউনটাউনে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় ওর সব খাবার পঁচে গিয়েছে, তবে সে কৃতজ্ঞ বোধ করছে যে আগেভাগেই ডাউনটাউন ছেড়ে যাওয়ায় সে আরো বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে।

অফিসের ইমেলে দেখলাম অনেকেই বন্যার্তদের থাকার জন্য নিজেদের বাসা, যাতায়াতের জন্য নিজেদের গাড়ী, খাবার দাবাড় কম্বল, জিনিসপত্র সরানোর জন্য সহযোগিতা অফার করছে। খবর পেলাম ডাউনটাউনকে পুণরায় চালু করার জন্য মেয়র এক হাজার লোকের সহযোগিতা চেয়েছিলেন দু’ঘন্টার ভেতর, পাঁচ হাজার লোক হাজির হয়েছিল। বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে লোক হয়েছিল ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক কম যেহেতু অনেকেই তাদের বাড়ীঘর উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন বন্যার্তদের জন্য।
গৃহহারা একজন

কিছুক্ষণ পর জেইন আমাদের নিয়ে তৎক্ষনাৎ একটি মিটিং করে জানালো অফিসের দু’জন লোকের বাড়ী এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে বাড়ী ভেঙ্গে নতুন করে তৈরী করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তারা সাহায্য চেয়েছে মালপত্রগুলো বাছাই করতে- যা রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কোথাও তুলবে আর যা ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় নেই তা রাস্তার পাশে জড়ো করবে যেন সিটি কর্পোরেশনের গাড়ী এসে তুলে নিয়ে যেতে পারে। এই প্রথম নিজের শারীরিক সামর্থ্যের অভাবে দুঃখবোধ হোল। আমি যদি যথেষ্ট শক্তিশালী হতাম তাহলে হয়ত হাত লাগাতে পারতাম। কিন্তু নিজের বাসা পরিবর্তন করার প্রস্তুতি নিতে গিয়েই কাহিল অবস্থা আমার, অন্যকে সাহায্য করব কি?

 

১লা জুলাই, ২০১৩

নদীর পাশে কিছু কিছু জায়গা এখনো পানির নীচে, নদীর ভেতর ঘরের ছাদ থেকে ওয়াশিং মেশিন ফ্রিজসহ নানাবিধ বস্তু দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় এখনো ট্রেনের যাতাযাত স্বাভাবিক হয়নি, কিছু কিছু স্টেশন এখনো বন্ধ। এর ভেতর পরম করুণাময় আমাদের এতটা নিরাপদ রেখেছেন যে আমার পুত্র কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়না ক্যাল্গেরীতে বন্যা হয়েছে, সে বলে, ‘কই, আমি তো কোথাও পানি দেখলাম না, তাহলে বন্যা হোল কি করে?’ আমাদের বাসা বদলানোর প্রাথমিক ধাপও সম্পন্ন হোল কোন ঝামেলা ছাড়াই। এতকিছুর মাঝে যিনি আমাদের এতটা নিরাপদ এবং আনন্দময় রেখেছেন সেই দয়াময়ের প্রতি সম্যকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব কিভাবে?