এই সময় খবর পেলাম আমাদের একজন বাংলাদেশী
মুরুব্বী মারা গিয়েছেন। আমি চিনিনা, হাফিজ সাহেব কোন এক সময় তাঁর নাতনীকে পড়িয়েছেন।
ঠিক করলাম জুমা পড়তে গেলে তাঁর জানাজার পর দাফনেও শরীক হব। আমি না গেলেও চলত
কিন্তু কবরস্থানে গেলে নিজের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ঠিক থাকে। তাছাড়া আমার
সন্তানদের মৃত্যুর প্রক্রিয়ার সাথে অভ্যস্ত করতে চাইছিলাম। প্রায় জুমাতেই মসজিদে জানাজা
পড়ানো হয়, কবরস্থানেও ওদের প্রায়ই নিয়ে আসি। কিন্তু এর অন্তর্বতী সময়ে কি হয় সে
প্রক্রিয়াটাও ওদের জানা থাকা দরকার। তাই সেদিনই বাসা পরিবর্তন করার কথা থাকলেও
দুপুরে সব কাজ ফেলে ছুটলাম। জুমার সময় প্রচুর পরিমান ক্রিশ্চান লোকজনের উপস্থিতি
দেখে ভাবলাম ওরা হয়ত ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য এসেছে, এখানে প্রায়ই এমন লোকজন
ইসলামী অনুষ্ঠানগুলোতে আসে যেন ইসলাম গ্রহনের ব্যাপারে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে
পারে। জুমা হোল, জানাজা হোল, তারপর আমরা শহরের বাইরে কবরস্থানে রওয়ানা হলাম। ওখানে
গিয়েও দেখি ক্রিশ্চান গোষ্ঠী উপস্থিত। কৌতুহলী হলাম। মুসলিম গোরস্থানে ওদের কি
উদ্দেশ্যে আগমন? আবার ওরা দেখি ক্যামেরা, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে প্রস্তুত, ছবি তুলবে।
মহিলারা সামান্য দূরে দাঁড়িয়েছিল। যে পরিবারের উদ্দেশ্যে আমরা গিয়েছিলাম তাঁরা
অনবরত দু’আ পড়ছেন। তাই নিজের দু’আ শেষ করে ক্রিশ্চান পরিবারটির সাথে কথা বলতে
গেলাম। দেখলাম মহিলাদের মাঝে রয়েছেন প্রয়াতের স্ত্রী, তাঁর মেয়ে এবং তাঁর ছেলের
গার্লফ্রেন্ড যে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ কেন তাকে তার বয়ফ্রেন্ডের পিতার কবরে নামতে দেয়া
হবেনা বা অন্তত পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া হচ্ছেনা। তাকে বুঝালাম,
কবরের পাশে যেতে মানা নেই, কিন্তু এই মূহূর্তে কবরের চারপাশে এতগুলো পুরুষ, আমরা
মুসলিম মহিলারা সাধারনত পুরুষদের ভিড়ে যাইনা, ভিড় কমে গেলেই কবরের পাশে গিয়ে দু’আ
করতে পারবে। প্রয়াতের মেয়েটিকে দেখছিলাম কিছুক্ষণ পর পর বাবাকে যেভাবে দেখেছে
সেভাবে মুনাজাত করার চেষ্টা করছে কিন্তু সে জানেনা মুনাজাতে কি বলতে হয়। সে জানাল
তার বাবা বসনিয়া থেকে এসে সেই পঞ্চাশ বছর আগে এখানে মুসলিম সমাজের গোড়াপত্তন করেন,
এখানকার সবচেয়ে বড় মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি। যৌবনে বিয়ে করেছিলেন এক
জার্মান ক্রিশ্চান ভদ্রমহিলাকে যিনি তাঁর চার সন্তানের জননী। কিন্তু তাঁর স্ত্রী
ইসলাম গ্রহন করেননি, চার সন্তানের মাঝে কেবল একটি পুত্র ইসলাম গ্রহন করেছে, বাকীরা
ক্রিশ্চান। তাঁরা সবাই সন্তানাদি নিয়ে এসেছেন কবরে মৃত বাবার ছবি তুলতে, তাঁকে শেষ
শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু এরা কেউ জানেনা কিভাবে বাবামায়ের জন্য কিংবা মৃত ব্যাক্তির
জন্য দু’আ করতে হয়, কারো মাথায় নেই যে বাবা গত হয়ে গেলেও তাঁর জন্য আজীবন প্রার্থনা
করা যায়। কিছুক্ষণ পর তারা তাঁকে কবরের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে শুইয়ে রেখে চলে গেল,
তাঁর জন্য প্রার্থনা করারও আর কেউ রইলোনা। তিনি সারাজীবন ইসলামের সেবা করে গেলেন,
কিন্তু নিজের একটি সিদ্ধান্ত আজ তাঁকে কবরের কঠিন মাটিতে একা করে দিলো। ফিরে আসার
সময় বুকের ভেতর মোচড় দিচ্ছিল এই ভিনদেশী মুসলিম ভাইটির জন্য যদিও যাওয়া হয়েছিল
আরেকটি পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্যে।
বাসায় ফিরে এসে উর্ধ্বশ্বাস ব্যাস্ততায়
নাভিশ্বাস অবস্থা। প্রায় সব জিনিস নতুন বাড়ীতে চলে গিয়েছে, তবু যা বাকী আছে তাতেই
মাথা খারাপ অবস্থা। তাছাড়া আমি হোটেলে থাকতে গেলেও আসার আগে সব গুছিয়ে দিয়ে আসি
যদিও কোন প্রয়োজন নেই, সেই আমি বাড়ী পরিস্কার করে না দিয়ে বাসা থেকে বেরোব? অসম্ভব!
সে বাড়ীওয়ালা আমাদের সাথে যতই বেঈমানী করুক না কেন। বিকালের দিকে আমাদের বাংলাদেশী
প্রতিবেশী আদিবার আব্বা আম্মা এবং অন্তরঙ্গ দুই বন্ধু পরিবার ইফতেখার ভাই এবং
তুহিন ভাই এলেন সাহায্য করতে। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল রান্নাঘর যেহেতু বাড়ীর
অর্ধেক জিনিসপত্র থাকে কিচেনে কিন্তু শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত এর ব্যাবহার অব্যাহত
থাকে বিধায় এই ঘরটি সবার শেষে গুছাতে হয়। আদিবার আম্মা বেচারী এখানে হাত লাগিয়ে
আমাকে নিশ্চিন্ত করলেন। তিনি আর রাদিয়া মিলে ফ্রিজের সব জিনিস বাক্সে ভরে, আধোয়া
জিনিসপত্র ধুয়ে, রান্নাঘরের ফ্লোর পর্যন্ত ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দিলেন। এই
সহযোগিতার কি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে শুকরিয়া আদায় হয়? সন্ধ্যা ছ’টায় ঘোর বৃষ্টির
মধ্যে আমরা আগের বাসা চিরতরে ছেড়ে নতুন বাসায় এসে পৌঁছলাম। এসেই আবার এই বাসা
পরিস্কার করা শুরু। আমাদের আগে যারা এ’বাড়ীতে ছিলেন তাঁরা বাড়ী ছেড়েছেন সেদিন
দুপুরে, পরিস্কার করে দিয়ে যাবার সুযোগ পাননি। শিমু আপা দু’টো মুরগী রান্না করে
দিয়েছিলেন আলু দিয়ে, সেই দিয়েই চলছিল গত দুইদিন, বাকী যা ছিল সেটাই বাচ্চাদের
খাবার। কিন্তু দু’তিন দিনের ভেতর রোজা শুরু হবে, সোমবার থেকে অফিস, এখনই অন্তত
প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে না নিলে পরে ভীষণ সমস্যায় পড়ে যাব। তাই বিছানাপত্র
গুছিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে ফ্রিজ, চুলা আর রান্নাঘরের সমস্ত তাক পরিস্কার
করে জিনিসপত্র তুলে রাখার উপযোগী করতে লেগে গেলাম। সারাদিন মালপত্র টেনে ক্লান্ত হাফিজ
সাহেব ঘুমিয়েছেন ন’টায়, বাচ্চারা সাড়ে দশটা এগারোটায়। আমি যখন একটা বাজে শুতে এলাম
তখন ভাবছি, ‘কি রে! বিছানাটা এত শক্ত হয়ে গেল কি করে?’ সবদিকেই শুধু ব্যাথা পাই।
বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল যে সমস্যাটা বিছানায় নয়, সমস্যাটা আমার কর্মক্লান্ত
শরীরের।
ভোরবেলা ঘুম ভাংলো পাখীর ডাক আর গাছের পাতার
সরসর শব্দে। দু’মাস ধরে খুঁজে কোথাও বাসা না পেয়ে অতিরিক্ত বড় হলেও এই বাসাটা নিতে
বাধ্য হয়েছিলাম, তবে এ’বাসার বাগানটা আমার খুব পছন্দ। সামনের বাগানে দু’পাশে বিরাট
বিরাট দু’টো গাছ প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে; একপাশে ঝাউগাছ আর আরেকপাশে ছোট ছোট ঝোপ দিয়ে
বেড়া দেয়া; কিন্তু আমার সবচেয়ে পছন্দ লাল লাল পাতাওয়ালা নাম না জানা গাছটা যেটা
বাচ্চাদের শোবার ঘরের জানালা দু’টো প্রতিবেশীদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছে। দরজার
সামনে গোলাপগাছ মেহমানদের স্বাগত জানাচ্ছে। পেছনে বিশাল উঠোন। উঠোনের চারপাশটাই
বেড়া আর বড় বড় গাছ দিয়ে প্রতিবেশীদের কৌতুহলী দৃষ্টি থেকে আড়াল করা। এর মধ্যে ডানপাশে
একটা ব্লুবেরী গাছ, বামদিকে আপেল গাছ, পেছনে বেড়ার সাথে অনেকগুলো বড় বড় গাছের মাঝে
একটা উইপিং বার্চ গাছ যার পাতাগুলো থরে থরে ঝুলে থাকে আর সামান্য বাতাসের ছোঁয়া পেলেই
ঝুনঝুন করে বাজতে থাকে, একটু টিলার ওপর হবার ফলে এই এলাকায় বাতাসের কমতি হয়না।
সকালে দেখলাম বাগানে অনেক পাখী আর কাঠবাড়ালী খেলে বেড়াচ্ছে, মনটা ভাল হয়ে গেল।
বাচ্চাদের বাইরে খেলতে দিয়ে এবার গেলাম
বাথরুম আর স্টোররুম পরিস্কার করতে কিন্তু মনে মনে চিন্তা ঘরে কোন তরকারী রান্না করা নেই, রান্না করার মত অবস্থাও নেই,
ক্ষিদে পেলে বাচ্চাদের শুধু ডিম ভেজে ভাত খাওয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এ’সময় জেসমিন আপা
খাবার পাঠালেন। মাছ, মাংস, সব্জী মিলিয়ে চার পাঁচরকম তরকারী, যেন আল্লাহর পক্ষ
থেকে উপহার। একটু পর পাশের বাসার প্রতিবেশি পরিচিত হতে এলেন আরবী মিষ্টি (বাকলাভা)
নিয়ে যেটা আমার বিশেষ পছন্দ।
বিকালে মোটামুটি প্রয়োজনীয় গোছগাছটুকু হয়ে গেল, বাকীটা আস্তেধীরে হলেও
চলবে। বড় মসজিদটা এখন আমাদের বাসা থেকে খুবই কাছে। আসরের নামাজের সময় মসজিদে গেলাম,
বন্ধুরাও সবাই এলেন। ফিরে আসার সময় বন্ধুরা বললেন, ‘চলেন, আপনাদের নতুন বাসা দেখে
আসি’। যা তাঁরা বলেননি তা হোল প্রত্যেকেই নানাবিধ খাবার রেঁধে নিয়ে এসেছেন-
খিচুড়ি, ডাল, মুরগী, গরুর মাংস, সব্জি, বিরিয়ানী, পায়েস কিছুই বাদ নেই। রাত
এগারোটা অবধি খাবার আসতে রইল। ততক্ষনে আমি ঘুম, হাফিজ সাহেব মেহমানদারী করছেন। সেই
খাবার আজ এক সপ্তাহ পরেও শেষ হয়নি!
মাঝে ক’দিন টেলিফোন, নেট, টিভি কিছুই ছিলোনা। সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন
হলেও একটি পরিবার হিসেবে কাছাকাছি ছিলাম সবাই। এখন আবার সবাই ব্যাস্ত। তবে প্রায়
দিনই নামাজ, জুমা বা তারাবীর জন্য সবাই মিলে মসজিদে যাওয়া হচ্ছে; বাসায় বন্ধুদের
মেলা বসছে, উইকএন্ডে রাতব্যাপী মায়েদের নামাজ পড়া আর বাচ্চাদের উঠোনে খেলার সুযোগ
হচ্ছে, ভোরবেলা পাখীরা আমাদের নামাজের জন্য ডেকে তুলছে আর পাতার সরসর শব্দে ঘুমের
রাজ্যে তলিয়ে যেতে ভালই লাগছে! কেবল অবসরে মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে,
আমাদের সেই বসনিয়ান ভাইটি কবরের মধ্যে ভাল আছেন তো?
তিনি সারাজীবন ইসলামের সেবা করে গেলেন, কিন্তু নিজের একটি সিদ্ধান্ত আজ তাঁকে কবরের কঠিন মাটিতে একা করে দিলো >>>Heart Touching
ReplyDelete