Thursday, November 25, 2010

ভয়

আমি সচরাচর ভয় পাইনা। তবে একবার সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। ঐ ঘটনার কথা মনে হলে আমার এখনো বুক কেঁপে ওঠে।

আমার প্রথম সন্তানের সময় পুরুষ ডাক্তারের কাছে আল্ট্রাসাউন্ড করবনা বলে শেষমূহূর্তে ঢাকা গিয়েছিলাম সবার আদেশ অনুরোধ উপেক্ষা করে। দ্বিতীয়বার ডাক্তার বান্ধবী নাহিদ আপা জানালেন চট্টগ্রামে তাঁর পরিচিতা এক সনোলজিস্ট আছেন, তাঁর সাথে দেখা করতে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাঁর নামও রেহনুমা! নিজের নামে আরেকজনকে ডাকতে কেমন লাগে সে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। তবে এবারে কিভাবে যেন আমার মিতার সাথে ভীষণ মিতালী হয়ে গেল। তাঁর যেকোন সমস্যা বা প্রয়োজনের কথা তিনি আমাকে জানাতেন, আমিও তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারতাম আমার যেকোন সমস্যার কথা।

একদিন রেহনুমা আপার কাছে গিয়েছি এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে। কথায় কথায় বান্ধবী বল্ল, “আমার বুয়ার কিছুদিন যাবৎ গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে। আগে কোনদিন হয়নি তাই ভেবেছিলাম কয়েকদিন ওষুধ খেলে সেরে যাবে। কিন্তু কিছুতেই ভালো হচ্ছেনা। আপনি কি মনে করেন ওর একটা আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখা দরকার ভেতরে কি অবস্থা?” রেহনুমা আপা বললেন, “আমি আপাতত ফ্রি আছি, যদি তাকে তাড়াতাড়ি আনতে পারেন তবে দেখে দিতে পারি”। বুয়া কাছেই ছিল। তাঁকে নিয়ে এসে পরীক্ষা করতে করতে বান্ধবী চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, আমি রেহনুমা আপার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আমাদের দু’জনেরই কথা বন্ধ হয়ে গেল! আমার হাতপা কাঁপতে শুরু করল। রেহনুমা আপা ডাক্তার হয়েও ভড়কে গেলেন। উনি কোনক্রমে সনোগ্রাম শেষ করে বুয়াকে রুমের বাইরে চলে যেতে বললেন। বান্ধবী আমাদের চেহারা দেখে আন্দাজ করল কিছু একটা গুরুতর সমস্যা হয়েছে। রেহনুমা আপা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বুয়ার স্বামী এসেছে কতদিন হোল?”
বান্ধবী বল্ল, “বুয়া তো বিধবা, ৪৫ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে তাই আর বিয়ে করেনি”।
রেহনুমা আপা এবার আমার দিকে তাকালেন। উভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শেষে যথাসম্ভব নরমভাবে বান্ধবীকে বললাম, “তোমার বুয়া প্রেগন্যান্ট”।
সে প্রথমে হেসে ফেল্ল। তারপর আমাদের উভয়ের দিকে তাকিয়ে যখন বুঝতে পারল আমরা ঠাট্টা করছিনা, সে কোনক্রমে চেয়ারের হাতল ধরে ধপ করে বসে পড়লো। আমি গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত দিতেই সে উদ্ভ্রান্তের মত বলতে শুরু করল, “এই মহিলাকে আমি মায়ের মত বিশ্বাস করেছি… আমার সবচেয়ে দামী জিনিস, আমার সন্তান, আমি তার হাতে দিয়ে কাজে আসি… কোনদিকে তার সুবিধা বা টাকাপয়সার কোন ঘাটতি রাখিনি… ড্রাইভার তো সারাদিন আমার সাথে থাকে… তাহলে কি সে আমার অনপস্থিতিতে…” রেহনুমা আপার চেম্বারে যদি বান্ধবীর প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয় তাহলে কি হবে ভেবে আপাকে বললাম, “তাড়াতাড়ি সনোগ্রাম আমার হাতে দিন। আমি পরে ওকে বুঝিয়ে দেব। আপাতত আমাদের এখান থেকে দ্রুত সরে পড়া দরকার”। রেহনুমা আপা খুব দুঃখী মন নিয়ে রিপোর্টটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।

বান্ধবীকে বাসায় যেতে দিলে কি হতে পারে ভেবে আমার ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম যতক্ষণ না তাকে কিছুটা প্রকৃতিস্থ মনে হোল। সে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলতে লাগল, “একজন বয়স্কা মহিলা… আমি তাকে মায়ের মত বিশ্বাস করেছি… আমার সন্তান তার কাছে রেখে আমি কাজে আসতাম… সে কাকে ঘরে এনেছে… সে লোক যদি আমার সন্তানের কোন ক্ষতি করত… এমন মহিলার হাতে আমি কি করে আমার সন্তানকে রেখে এলাম…”।

পরে তাকে বললাম ভাইয়াকে বলতে যেন তিনি আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘরে আসেন। তারপর ওকে বাসায় দিয়ে আমি বাড়ী ফিরে গেলাম।

বান্ধবী মহিলাকে অনেক বোঝানোর পর মহিলা স্বীকার করলেন আরেক বাসায় ষোল বছর বয়সী কাজের ছেলে এই সন্তানের বাবা। ঐ বাসার লোকজনের সাথে কথা বলে সাব্যাস্ত হোল এদের বিয়ে দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হবে। বান্ধবী কাজ থেকে ছুটি নিল আরেকজন বুয়া না পাওয়া পর্যন্ত।

এটা হয়ত একরকম সমাধান হোল। কিন্তু আমি বুঝে পাইনা, একজন মানুষ কি করে এমন কাউকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বাস করতে পারে যে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটাকে পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে নারাজ?

পরেরবার রেহনুমা আপার চেম্বারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে কথা উঠলো। উনি তখন জানালেন কলেজ ইউনিভার্সিটি, এমনকি স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও এখন তাঁর চেম্বারে এসে আবিষ্কার করে যে যদিও তাদের বিয়ে হয়নি তারা কিভাবে যেন মা হয়ে গিয়েছে! কিন্তু এত বয়সী একজন এমন কাজ করতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, একবার এক মেয়ে তাঁকে বারবার বলতে লাগল, “বিশ্বাস করুন, আমি কোনকিছু করিনি। এসব কি করে হোল আমি কিছুই জানিনা”। একপর্যায়ে তিনি বিরক্ত হয়ে বলে বসলেন, “তবে কি তুমি নিজেকে মাদার মেরী প্রমাণ করতে চাও?” তখন মেয়েটির প্রেগন্যান্সি সাতমাস পেরিয়েছে। সে যদি এ দায় থেকে বাঁচার জন্য উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তাহলে মারাও যেতে পারে। তাই তিনি মেয়েটির বাবামাকে খবর দিতে বাধ্য হলেন। বাবামায়ের অগোচরে এরা যে কি কি করে বেড়ায় তা যদি বাবামা জানতেন তাহলে তাঁদের এত কষ্টের রোজগার, সন্তানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, বিত্তবৈভব সব অর্থহীন বিস্বাদ মনে হত। কি করে পারে একজন মেয়ে তার বাবামায়ের কষ্ট, অবদান, ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান সব ধুলায় লুটিয়ে এমন একটা ছেলেকে বিশ্বাস করতে যার এতটুকু মেরুদন্ড নেই যে সে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে মেয়েটিকে আপন করে নেবে? একজন বোন কি করে ভুলে যায় তার ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্ব যারা তাকে ভালোবাসে, আদর্শ হিসেবে দেখে? একজন ছাত্রী কি করে তার জীবনের পরম বন্ধু লেখাপড়ার হাত ছেড়ে এমন একজনের হাত ধরে যার নিজের লেখাপড়ার প্রতি, জীবনে কিছু করার প্রতি, তার দায়িত্ব নেবার প্রতি কোন আকর্ষণ নেই? দায়িত্ব নেই কিন্তু প্রাপ্তি আছে, এ’ কেমন ভালোবাসা?

পেপারে যখন পড়ি “সুন্দরী অমুক বলেছে তমুক তাকে ফুসলিয়ে সন্তানের মা বানিয়েছে কিন্তু এখন সন্তানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেনা্‌”, তখন দুঃখও লাগে, হাসিও পায়। সে যদি ধর্ষিতা হত তার জন্য সহমর্মিতা এবং বেদনা ব্যাতীত আর কিছুই অনুভব করা কঠিন হত। কিন্তু যে বলে তাকে ঠকানো হয়েছে, তার যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে যে সে বাড়ীর সকলকে ধোঁকা দিয়ে এমন এক ব্যাক্তির সাথে মিলিত হতে পারে যে সর্বসমক্ষে তার সাথে চলাফেরা করতে অনিচ্ছুক, তবে এটা কি করে সম্ভব যে সে বোঝেনা এই ধরণের একটা লোক কখনোই তার সন্তানকে স্বীকৃতি দেবেনা?

মেরী স্টোপ্সে এক আত্মীয়া কাজ করতেন। তাই বাচ্চাদের টিকা দেয়ার জন্য ওখানে নিয়ে যেতাম। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালা, এতগুলো ছোটছোট মেয়ে এখানে কি করে? ওদের তো বাচ্চাও দেখছিনা যে বাচ্চাকে টিকা দিতে এনেছে!” উনি কিচ্ছু না বলে আমাকে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বের করে দিলেন। পরে জেনেছি এই ছোটছোট মেয়েগুলো তাদের প্রেমের খেসারত দিতে এসেছে। তাদের বাবামা জানে তারা কলেজ, ইউনিভার্সিটি বা স্কুলে। কোন কোন ক্ষেত্রে মা নিজেই নিয়ে এসেছেন মেয়েকে। কারো কারো সাথে বয়ফ্রেন্ড। তারপর আবার কিছুদিন পর একই কাহিনীর পুণরাবৃত্তি।

আমি সবসময় বলতাম, “সব মেয়েরা যেমন চায় তাদের বর প্রিন্সের মত দেখতে হবে, আমি কিন্তু চাইনা। কারণ আমি নিজে দেখতে প্রিন্সেসের মত নই। কিন্তু আমি এমন লোকের সাথে থাকার কল্পনাও করতে পারিনা যে আমি আসা পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা না করে এখানে সেখানে সৌখিন প্রেম করে বেড়িয়েছে। আমি চাই যে সততা সে আমার কাছে আশা করে, সে সততা যেন আমিও তার কাছে পাই”।

কিন্তু উপরোক্ত অবস্থা দেখে একদিকে মনে হয়, “হায় আল্লাহ, আমি কার কাছে মেয়ে বিয়ে দেব? আমি কি তবে আমার এত আদরযত্নে বড় করা কন্যাকে কোন লম্পটের হাতেই তুলে দিতে বাধ্য হব? কোন্ মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধু করে আনব?” আরেকদিকে মনে হয়, সমাজের অগণিত গুণী এবং কৃতী বাবামা তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েও সঠিকপথে পরিচালিত করতে পারছেন না এই সমাজে যেখানে টিভি, সিনেমা, মোবাইল, পত্রিকা মায় অ্যাডভার্টাইজমেন্টগুলো পর্যন্ত আমাদের সন্তানদের বিপথগামী করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই লাম্পট্যের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সমাজে আমি আমার দু’টি সন্তানকে কি করে রক্ষা করব?

আমার ছাত্রছাত্রী, যাদের সন্তানস্নেহে লালন করার পেশা এবং নেশা আমাকে উজ্জীবিত করে, তাদেরই এক এক সময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম- যখন ইনভিজিলেশনের ফাঁকে কেন্টাকী ফ্রাইড চিকেনে ম্যাডামদের সবাইকে একসাথে দেখে ওরা বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালিয়ে যেত, যখন আমার স্যারের বাসায় কার্ড পৌঁছতে গিয়ে অন্ধকার সিঁড়িতে ছাত্রীকে বয়ফ্রেন্ডের থেকে ছিটকে সরে যেতে দেখতাম, যখন ওয়ার সেমেট্রিতে আমার মেয়েকে ফুল দেখাতে নিয়ে গিয়ে দেখতাম কিভাবে ওরা একটা কবরস্থানকে পর্যত্ন রেহাই দিচ্ছেনা, যখন আমাদের বাইকে চড়ে বাড়ী ফেরার পথে কোন বন্ধুর ডাক শুনে পেছনে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ে যেত পেছনের রিক্সায় জড়াজড়ি করে বসা ছাত্রছাত্রীদের হতভম্ব চোখে…। যাকে সন্তানের মত ভালোবাসি তার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করে তোলে। কাকে বিশ্বাস করব আমি? আর কেনইবা তাকে অবিশ্বাস করব যাকে আমি মনে মনে নিষ্পাপ ভেবে এসেছি?

মাঝে মাঝে মনে হয়, আসলেই এ’ যুগে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখার চেয়েও কঠিন!

Monday, November 22, 2010

চা


আমার বিয়ের সময় কার্ডের যেখানটায় লেখা থাকে ‘দোয়াই কাম্য’- যার অর্থ ‘তবে উপহার দিলে ভালো হয়’- সেখানে লেখা ছিল ‘অনুগ্রহপূর্বক উপহার দেবেন না’। তারপরও যারা নিয়্মভঙ্গ করেছে তাদের একজন ছিলো আমার বান্ধবী সিমিন। সে আমাকে একটা বেডসাইড ল্যাম্প দিয়ে বলেছিল, “জানিস, আমার বিয়ের সময় এক বান্ধবী এরকম একটা ল্যাম্প দিয়েছিল। আমি প্রতিদিন সব কাজ সেরে যখন ঘুমাতে যেতাম, সবশেষে ল্যাম্পটার সুইচ অফ করতাম- ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার শেষ স্মৃতি হত ঐ বান্ধবীর মুখটা। তাই আমার মনে হোল এই ল্যাম্পটা দেই, প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও তুই আমাকে মনে করবি!”


এভাবে অনেক জিনিসের সাথে অনেক স্মৃতি জুড়ে যায়। যেমন মুড়ি দেখলেই আমার নানার কথা মনে হয়। নানা যখন রিটায়ার করল তখন সময় কাটানো জন্য একটা দোকান করল। ঐ দোকান থেকে আমি টিনভর্তি করে মুড়ি মোয়া এনে খেতাম! লিখতে বসলেই বাবার কথা মনে হয় কারণ বাবাকে চিঠি লিখতে গিয়েই আমার লেখায় হাতেখড়ি, পাঁচবছর বয়সেই বাবা একটা ডায়রী দিয়ে বলেছিল, “এতে প্রত্যেকদিন তোমার মনমত কবিতা গল্প কিছু একটা লিখবে”। আর চা দেখলেই মনে পড়ে আলিম ভাইয়ের কথা।


২০০৮ সালের আগস্ট মাসে যখন সিআরটিপি কোর্সে ভর্তি হই, দেখে খুব মজা লাগে যে আমাদের বাংলাদেশীদের দেয়া হয়েছে এক ক্লাসে আর সমস্ত পাকিস্তানীদের দেয়া হয়েছে অন্য ক্লাসে! যেন ওরা জানে যে আমরা একসাথে থাকাটা বিপজ্জনক! আমাদের চাকরী খুঁজে দেয়ার দায়িত্বে ছিল সুজান। সুজানের গ্রুপে আবার আমি ছাড়া আর কোন বাংলাদেশী ছিলোনা। সত্যি বলতে আমার চাইনিজ বান্ধবী জেনী আর আলজেরিয়ান বন্ধু সামির ছাড়া আর প্রায় সবাই ছিল অন্য ক্লাসের। স্বাভাবিকভাবেই প্রায় সব পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের দেখা হত সুজানের সাথে গ্রুপ মিটিংয়ে।


একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি আর জেনী দেরী করে মিটিংয়ে পৌঁছে দেখি সব চেয়ার দখল হয়ে গিয়েছে। এক পাকিস্তানী ভাই, বয়সে আমার বড়ই হবেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি বসুন”। আমি একটু অবাক হলাম, সারাজীবন জেনে এসেছি ওদের সাথে আমাদের জন্মজন্মান্তরের শত্রুতা! একটু পরে হিসেব করে দেখা গেল একজন শর্ট। তখন জানলাম যিনি আসেননি তাঁর নাম আলিম শওকত। পরদিন তাঁর সাথে সাড়ম্বরে পরিচয় হোল, তিনি কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছেন এবং খুশী হয়ে শুধু নিজের ক্লাসের জন্যই নয়, উভয় ক্লাসের জন্য ভারী মজার মিষ্টি নিয়ে এসেছেন!


পরে দেখা গেল সুজান আমার আর আলিম ভাইয়ের জন্য একই জায়গায় চাকরীর ব্যাবস্থা করছে। যেদিন ইন্টারভিউ তার আগেরদিন আলিম ভাই এসে বললেন, “চল, জায়গাটা চিনে আসি”। আমার জন্যও ভালো হোল। একা একা ডাউন্টাউনে ঘুরে ঠিকানা বের করার ঝক্কি পোহাতে হোলনা। হাঁটতে হাঁটতে উনি মোটামুটি ওনার চৌদ্দগুষ্টির ইতিহাস বলে ফেললেন, এমনকি নামাজে গাফলতি করার কারণে বৌয়ের কাছে বকা খাওয়ার কাহিনী পর্যন্ত! বুঝলাম উনি পাঞ্জাবী হলেও খুব সরল মনের অধিকারী।


ইন্টারভিউ ওনার ছিল সকালে আর আমার বিকেলে, দু’জনেরই চাকরী হয়ে গেল দু’মাসের জন্য। এখানে এটা খুব মজার ব্যাপার। একসপ্তাহ বা একদিনের জন্যও চাকরী হয়!


যেদিন থেকে যেতে হবে, উনি যোগাযোগ করে ঠিক করলেন আমরা একসাথে হাজিরা দেব। অফিসে গিয়ে দেখলাম আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে পাশাপাশি ডেস্কে। উনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে, সেকেন্ড ইন কমান্ড রোজিটার পাশে আর আমি একেবারে বস কোরিনের দরজার সামনাসামনি। আমার ডেস্ক হোল তিনরাস্তার মোড়ে, যেই যায় ‘হাই’ বলে যায় আর আমি হাই তুলতে তুলতে ‘হাই, হাই’ করতে থাকি। আলিম ভাই বললেন, “তুমি চা খাওয়ার অভ্যাস কর”। অফিসে চা কফি সবার জন্য ফ্রি। পুদিনা, আর্ল গ্রে, হার্বাল, রেড লেবেল, ইয়েলো লেবেল কত রকম যে লেবেল! চিনিও আছে, স্যাকারিনও আছে, দুধ তো আছেই। নেই যা তা হোল অভ্যাস। চা-কফি জীবনে মজা লাগলোনা। কতগুলো গরম গরম পানিতে দুধচিনি মিলিয়ে গলা মুখ জিহ্বা পুড়িয়ে মানুষ কি মজা পায় কোনদিন বুঝলাম না। দশ এগার বছর বয়সে কালেভদ্রে ঠান্ডা করে চা খেতাম বটে কিন্তু যেদিন টের পেলাম এক কাপ চায়ে পাঁচ চামচ চিনি দিয়েও আমার মিষ্টি লাগছেনা সেদিন থেকে সব ছেড়ে দিয়েছি।


কিন্তু আলিম ভাই ছাড়ার পাত্র নন। উনি কিছুতেই একা চা খেতে যাবেন না। তাই ওনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য হোক বা আমার বসতে বসতে ক্লান্ত হাড়গুলোকে জাগিয়ে তোলার জন্য হোক, টিরুমে যাওয়াই হত। আর গেলেই উনি চা বানাতেন দুই কাপ। এতরকম দুধ চিনি চাপাতা থাকতে উনি বাসা থেকে ওনার নিজস্ব পছন্দের দুধ চিনি চাপাতা নিয়ে আসতেন। “খাও, খাও, তোমার ঘুম কেটে যাবে”, বলে বলে চা খাওয়াতেন প্রায় জোর করে। আমি মনে মনে বলতাম, “আহারে, আইআইইউসি’র শাহীন, নাজমুন কতবার টেবিলের ওপর চা রেখে গিয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে, ম্যাডাম খায় কি’না দেখি- কত চা ফেলে দেয়া হয়েছে আমার টেবিল থেকে! এখানে এসেও আবার সেই পরীক্ষা! কি আছে এই চায়ে?”


আলিম ভাই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। ক্যানাডায় সবাই নিজের কাজ নিজে করে। একসময় শাহীন নাজমুন সব ফটোকপি করে এনে দিত, তখন ভেবেও দেখিনি কিভাবে কি করতে হয়। আর এখানে আমার ফটোকপি কে করে দেবে? উনি শিখিয়ে দিলেন কিভাবে ফটোকপি করতে হয়। আমি খুব দ্রুত কাজ করি। কিন্তু ক্যানাডিয়ানরা কাজ করে আস্তেধীরে রয়েসয়ে- কতক্ষণ গল্প করে, কতক্ষণ নেটে চ্যাট করে, নেটসার্ফিং করে- অফিসে অর্ধেক সময়ের বেশী কাজ করেনা, তাই কেউ বেশী কাজ করলে সে তাদের চক্ষুশূল হয়ে যায়। উনি আমাকে শেখালেন কিভাবে কাজ শেষ হয়ে গেলেও ধৈর্য্য ধরে বসে সময় কাটাতে হবে। আর যেটা শেখালেন সেটা হোল ‘ডিপ্লোমেসি’ যেটা আমার একেবারেই নেই।


আমার সরাসরি কথাগুলোকে উনি আবার মেজেঘসে সহনীয় করে তুলতেন। যেমন, একবার আমাদের কোম্পানীর আরেক শাখার অফিস থেকে এক মহিলা কিছু সময়ের জন্য আমাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে এলেন। ক্রীস্টমাসের কয়েকদিন আগে উনি খুব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “তা তোমরা ক্রীস্টমাসের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ?” আমি জানতাম এদের অন্যান্য ধর্ম এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রায় কোন ধারণাই নেই। বললাম, “আমরা তো ক্রীস্টমাস করিনা!” মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “তোমরা কি ক্রীস্টমাস একটুও করনা?” আমি বলতে যাচ্ছিলাম, “তোমরা কি ঈদ একটুও করনা?” তার আগেই আলিম ভাই বললেন, “হ্যাঁ, আমরা একটু একটু করি। রেহনুমা চল, আমাদের ক্রীস্টমাসের শপিং করতে হবে!”


আরেকদিন ট্রেন স্টেশনে যেতে যেতে দেখি এক মহিলা কুকুর কোলে নিয়ে, কুকুরের দিকে তাকিয়ে একহাতে তাকে আদর করতে করতে গাড়ী চালাচ্ছে। আহ্লাদের সীমা নেই! মানুষ চাকার নীচে পড়বে মাথাব্যাথা নেই, কুকুরের দিকে তাকিয়ে গাড়ী চালায়! আলিম ভাইকে দেখালাম, উনি বললেন, “কুত্তা মাত বোলনা, উয়ো তো উসকা বাচ্চা হ্যায়!” (কুকুর বোলনা, ওটা তো ওর সন্তান!)


নতুন বাবা হবার উচ্ছাস কাছে থেকে দেখেছি আলিম ভাইয়ের মধ্যে, “আজ আমার মেয়ে হেসেছে, আজ সারারাত ও কেঁদেছে আর আমি ওকে কোলে নিয়ে হেঁটেছি, ওর মা কি করে? আমিই তো আমার মেয়েকে দেখি!” নতুন মাদের কথা প্রায়ই শোনা যায়, তারা কিভাবে উচ্ছসিত, উত্তেজিত, পুলকিত হয়। বাবাদের অনুভূতিটা থাকে অনেকটা আগোচরে। তাই ওনার মেয়ে নিয়ে এই আদিখ্যেতা আমার খুব মজা লাগত।


ওনার সাথে প্রায় সকালে ট্রেনেই দেখা হয়ে যেত যেমন হত বাংলাদেশী দুই বন্ধু তানজীন আর ইফতেখার ভাইয়ের সাথে অথবা বাল্যবন্ধু তিথির সাথে। ফেরার সময় আমরা একসাথেই স্টেশনে যেতাম, সাথে নিয়ে নিতাম তিথিকে। মজার ব্যাপার হোল, তিথি আর আমি একই বিল্ডিংয়ের দুই টাওয়ারে কাজ করতাম। একবার ও আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল লাঞ্চের সময়। আলিম ভাই কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “আমি তোমার জন্য স্টেশনে যাবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করি আর তুমি আমাকে বাদ দিয়ে বান্ধবীর দাওয়াত খেতে যাও!” সিআরটিপির ইরানী বন্ধু আফশীন আর চাইনীজ বান্ধবী জেনী আমাদের কোম্পানী অ্যাল্টাগ্যাসে জয়েন করার পর থেকে চারজনে মিলে লাঞ্চ করার মজাটাই ছিল আলাদা। তাই তিথির সাথে মূলত বেরোবার পথে একত্রে যাওয়া হত। অনেক সময় ট্রেনে দু’জনে গল্প করতে করতে ভুলেই যেতাম আমার স্টপ তিথি আর আলিম ভাইয়ের দুই স্টেশন আগে। আলিম ভাই ডাক দিয়ে বলতেন, “তোমাদের দুই বান্ধবীর কি গল্প শেষ না তুমি আমাদের স্টেশনেই নামবে ঠিক করেছ?”


এখানে সরকার বেকারদের জন্য নানাপ্রকার ব্যাবস্থা রেখেছে। এই ব্যাবস্থার অধীনে আলিম ভাই কিছুদিন পর পর সরকারের কাছে টাকা বা খাবার পেতেন। একবার ৪০ ব্যাগ খাবার পেয়ে তিনি বিপদে পড়ে গেলেন, দু’জন মিলে এত খাবার শেষ করবেন কি করে? ব্যাস, পরদিন ব্যাগ ভরে আলু আর ম্যাকারনি নিয়ে এলেন আমার জন্য! কি মুস্কিল বলুন তো! অফিস থেকে বাসায় যাব দুই বস্তা খাবার নিয়ে! পরে বেচারা নিজে স্টেশন পর্যন্ত বস্তাগুলো বহন করে দিলেন। তবুও খাবারগুলো কারো কাজে লাগুক।


এভাবে কখন যে দু’মাস কেটে গেল টেরই পেলাম না। শেষদিন আমাদের গ্রুপের ঈজিপ্সিয়ান ছেলে খালিদ সবাইকে উপহার দিল, আমাকে যে কাজ শিখিয়েছিলেন সে বৃদ্ধ ওয়েন আমাদের কফি খাওয়াতে নিয়ে গেলেন, আর কোরিন যখন আমাকে জড়িয়ে ধরল তখন আলিম ভাই আতংকে পিছিয়ে গিয়েও রক্ষা পেলেন না। আমাকে ছেড়ে সে বিশালদেহী বয়স্কা বস যখন ওনাকে জড়িয়ে ধরল তখন ওনার চেহারাটা হয়েছিল দেখার মত! আমার হাতটা নিশপিশ করছিল একটা ক্যামেরার জন্য।


তবে সেই শেষমূহূর্তে উনি ঠিক করলেন শেষ একবার অফিসে বসে চা খেতে হবে! আমি গোঙ্গাতে শুরু করলাম, “না্…”। কিন্তু কোন কাজ হলনা। তিনি খুব যত্নসহকারে চা বানালেন, বাকী চায়ের সরঞ্জামাদি অফিসে দান করে দিলেন, তারপর খুব উপভোগ করে চা পান করতে শুরু করলেন। ততদিনে আমি চায়ের ওপর তিক্তবিরক্ত। বেচারা অন্যদিকে ফিরে কথা বলার সময় কায়দা করে অর্ধেক কাপ চা বিসমিল্লাহ বলে দিলাম সিঙ্কে ঢেলে!


কিন্তু এখন যেখানেই চা দেখি, আলিম ভাইয়ের কথা মনে হয়, ওনার আন্তরিকতার কথা মনে হয়। আমি পছন্দ না করতে পারি, কিন্তু চা জিনিসটা মনে হয় আসলে এত খারাপ না!

Tuesday, November 16, 2010

একজন বেহেস্তী নারী


একদিন অফিসে কাজ করছি, এমনসময় পিয়ন এসে বল্ল, “আপা, এক মহিলা এসেছেন আপনার সাথে দেখা করতে, ভিজিটর্স রুমে বসে আছেন”। আমি হাতের কাজটা গুছিয়ে নিতে নিতে সে ফিক করে হেসে বল্ল, “আপা, মহিলা মনে হয় পাগল!”, তারপর হঠাৎ আমার ঈষৎ বিরক্ত চেহারার দিকে চোখ পড়তে সে আর কথা না বলে কেটে পড়ল।

দু’মিনিট পর ভিজিটর্স রুমের দরজা থেকে উঁকি মেরে দেখি এক বিরাটাকার মহিলা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে গর্ভবতী, উদ্ভ্রান্তের মত চুল, ওড়না মাটিতে গড়াচ্ছে কোন খেয়াল নেই- মহিলা কে চিনতে পারলাম না। ভেতরে ঢুকতেই সে হঠাৎ তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠা মানুষের মত আমার হাত দু’টো চেপে ধরে বল্ল, “রেহনুমা, তুই আমাকে বাঁচা!” কোন সম্ভাষন নেই, পরিচিতি নেই … চেহারাটা কাছে থেকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম, “রিমা না? কি রে তোর এই অবস্থা হয়েছে কি করে? কি হয়েছে তোর?” এই বান্ধবীকে আমি কোনদিন একটা চুল এদিক ওদিক হতে দেখিনি। ভীষণ রুচিশীল আর শৈল্পিক একটা মেয়ে ছিল সে। বিয়ে হয়েছিল আপন ফুপাত ভাইয়ের সাথে। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সে ভালো আছে যেহেতু ফুপু নিজে ওকে চেয়ে নিয়েছিলেন। বিবাহিতা বান্ধবীদের সবার খোঁজখবর করা হত ওরা ভালো আছে কি’না, রিমার খোঁজ কোনদিন করা হয়নি। সে নিজেও সব বান্ধবীদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল বলে কেউ ভাবেনি সে কষ্টে আছে। এখন ওকে দেখে ভীষণ অপরাধবোধ হতে লাগল। তাড়াতাড়ি ওকে বসালাম। ওর জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করলাম। তারপর ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর এই অবস্থা হোল কি করে।

রিমার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। সে যা বল্ল তার সারমর্ম হোল, বিয়ের পরদিন থেকেই ফুপু কেবল শ্বাশুড়ীই হয়ে গেলেন, যেই ফুপু ওকে এত আদর করতেন তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলনা। উনি উঠতে বসতে ওকে কথা শোনাতেন, জ্বালাতন করতেন, অন্য বৌকে ওর সামনে আদর করতেন আর ওদের সামনে ওকে হেয় করতেন। ও নিজেই বুঝে পেলনা ও কি অন্যায় করেছে। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হবে মনে করে ও ওর বাবামা বা আর কোন আত্মীয় পরিজনকেই এ’কথা বলতে পারলনা। বান্ধবীরা শুনলে কি মনে করবে ভেবে সে আমাদের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। একসময় ওর নিজের ওপরেই ঘৃনা চলে এলো, “আমি যদি এতি খারাপ হই তাহলে আমার বেঁচে থেকে লাভ কি?” স্বামীর কাছ থেকেও সে কোন সহযোগিতা পেলনা, পেল সহানুভূতি কিন্তু সেটা ওকে এই সার্বক্ষণিক মানসিক অত্যাচার থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখেনা। একসময় ও বুঝতে পারল ওর মধ্যে আরেকটি জীবনের অস্তিত্ব। এ’সময় মেয়েরা শারিরীক মানসিক উভয় দিক থেকে স্বাভাবিক অবস্থার তুলনায় অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু অত্যাচার কমলোনা। এমতাবস্থায় সে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতে শুরু করল। হঠাৎ একদিন পেপারে আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখে ওর মনে হোল নিজের জন্য না হোক, ওর অনাগত সন্তানের জন্য ওকে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে। তাই সে এসেছে আমার কাছে।

আমি তখন নিজেই লজ্জায় মারা যাচ্ছি যে এত কিছু হয়ে গেল অথচ আমরা কেউ ওর একটা খবর পর্যন্ত নিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম আমি কিভাবে ওকে সাহায্য করতে পারি। ও বল্ল, “তুই যেভাবেই হোক আমার জন্য একটা চাকরীর ব্যাবস্থা কর। আমার পাগল হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে হবে। আমার যেকোন উসিলায় দিনের অন্তত কিছুটা সময় বাসার বাইরে থাকা দরকার। প্রতিদিন অন্তত কিছুক্ষণ আমি স্বাভাবিক লোকজনের সাথে মিশতে চাই, স্বাভাবিক কাকে বলে আমি ভুলেই গেছি”। ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, “তুই যেটা চাচ্ছিস সেটা যে আমার জন্য কত কঠিন ব্যাপার! দু’মাস পরে বাচ্চা হবে এমন কাউকে কোন প্রতিষ্ঠানেই নিতে চাইবেনা কারণ এর সাথে আছে ম্যাটার্নিটি লীভ, বেতন আর ঈদ বোনাসের ব্যাপার”। কিন্তু ওর চেহারা দেখে সাহস হোলনা ওকে ক’মাস পর আসতে বলি, হয়ত ততদিনে সে আত্মহত্যা করেই বসবে!

ওকে বসিয়ে রেখে ভেতরে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের সবার সাথে কথা বললাম। সবার আগেই উঠে আসল ম্যাটার্নিটি লীভ, বেতন আর ঈদ বোনাসের ব্যাপারটা। চাকরীর দু’মাসের ভেতর যাকে এতসব সুবিধা দিতে হবে তাকে নেয়া আদৌ যৌক্তিক কি’না। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হোল আগে পরীক্ষা নিয়ে দেখা যাক আদৌ সে চাকরীর জন্য উপযুক্ত কি’না। ওকে তিনদিন পর পরীক্ষার জন্য আসতে বললাম প্রস্তুতি নিয়ে, পরিপাটি হয়ে।

আশা মানুষের মধ্যে কি অদ্ভুত পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে স্বচক্ষে দেখলাম তিনদিন পর। রিমাকে দেখে মনে হোল যেন আমাদের আগের সেই রিমা। সে পরীক্ষা দিল এমনভাবে যেন এর ওপর ওর জীবনমরণ নির্ভর করছে। লৈখিক পরীক্ষায় অসম্ভব ভালো করাতে প্রতিষ্ঠান ওকে ইন্টারভিউর জন্য ডাকতে বাধ্য হোল। আমি ওকে বলে দিলাম যে এই ইন্টারভিউর ওপরেই নির্ভর করছে ওর চাকরী পাওয়া না পাওয়া- আমি ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকব সুতরাং ওর উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু ইন্টারভিউ ভালো না হলে আমি বোর্ডে থেকেও ওকে কোন সাহায্য করতে পারবনা।

সে আমাকে নিরাশ করলনা। ইন্টারভিউতে সে বল্ল, “এই চাকরীটাই হবে আমার আসল জীবন, সুতরাং আমি যে সিন্সিয়ারলি কাজ করব এ’ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমি চেষ্টা করব ম্যাটার্নিটি লীভ সংক্ষিপ্ত করতে আর আমাকে এ’সময় বেতন বা ঈদ বোনাস না দিলেও আমার কোন সমস্যা নেই”। ওর চাকরী হয়ে গেল।

রিমা এত ভালো কাজ করতে লাগল যে অল্প দিনের মধ্যেই ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। ওকে অনেক স্বাভাবিক আর প্রাণবন্ত মনে হতে লাগল। দিনের একটা সময় হাসিখুশী থাকায় এবং লোকজন ওকে অ্যাপ্রিশিয়েট করায়, বাসায় যেসব নেতিবাচক কথাবার্তা ওকে আগে কষ্ট দিত সেগুলো ওকে আর ওভাবে স্পর্শ করতে পারতনা। দু’মাস পর ওর একটা ফুটফুটে ছেলে হোল। সাতদিন পরই ও আবার ছেলে নিয়ে আসতে শুরু করল। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ওকে মানা করা হোল, জানানো হোল ও তিনমাস থেকে চারমাস ছুটির হকদার। কিন্তু ও আমাকে ডেকে বল্ল, “তুই কি ভাবিস আমি তোদের প্রতিষ্ঠানের জন্য সাতদিনের মধ্যে চলে এসেছি? আমি বাসায় থাকলে মরে যাবো রে!”

আমার প্রথম সন্তান হবার পর আমাদের প্রতিষ্ঠানে বাচ্চা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। খুব বেশী কিছু না, একটা রুম, রুমজোড়া বিছানা আর বাচ্চা দেখার জন্য একজন মানুষ। খেলনা আর খাবার মায়েরা নিয়ে আসবে। আমার সন্তানের জন্য এইসব ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। আমার মেয়ে বড় হয়ে যাবার পর প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই লোক রাখা হয়। তারপর থেকে মহিলা কর্মীরা তাদের শিশু সন্তানদের সাথে নিয়ে আসতে পারতেন। তাহলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেরাই সন্তানদের তদারক করতে পারতেন। এতে যেটা লাভ হয় তা হোল মায়েরা তাদের কাজের ব্যাপারে আরো আন্তরিক হয়ে যান এবং বাসায় ফেরার কোন তাড়া থাকেনা। রিমা এখানে বাচ্চা রাখতে শুরু করল আর ওর কাজ কমিয়ে দেয়া হোল যেন সে যথেষ্ট বিশ্রাম পায়।

দিনে দিনে ওর সুনাম আরো বাড়তে লাগল, ওর আত্মবিশ্বাস ফিরে এলো, ওর স্বামী ওকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে শুরু করল। ওদিকে ওর শ্বাশুড়ী যখন দেখলেন উনি ওকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, উনি মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন সে চাকরী ছেড়ে দেয়। আমরা সবাই ওকে পরামর্শ দিলাম ও যেন ভুলেও এই কথায় কান না দেয়। এদিকে ঝামেলা করে কোন ফলাফল হবেনা বুঝতে পারে উনি ছেলেকে চাপ দিতে শুরু করলেন, “আমি বাসায় থাকতে বৌ নাতি নিয়ে চাকরীতে যাবে কেন?” সাত মাসের সময়ই রিমার ছেলে একটু একটু হাঁটতে, কথা বলতে শুরু করেছিল। ন’মাসের সময় উনি সফল হলেন। রিমা ছেলেকে শ্বাশুড়ীর কাছে রেখে আসতে বাধ্য হোল।

একদিন বাসায় ফিরে রিমা একটু অবাক হোল। ওর ছেলে এত চঞ্চল প্রাণবন্ত, ঘরময় ঘুরে বেড়ায়, বকবক করে- সে কেন চুপচাপ শুয়ে আছে? হাত পায়ের পর্যন্ত কোন নড়াচড়া নেই! সেই ছেলে আর কোনদিনই নড়াচড়া করলোনা। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে, বিদেশ নিয়ে গিয়েছে কিন্তু সবাই বল্ল ওর ব্রেনের ভেতরে কোন গুরুতর আঘাতে ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। অনেক পরে সে জানতে পেরেছিল যে ওর একবছরের শিশু ওর শ্বাশুড়ীর সামনেই কাজের মেয়ের হাত থেকে লাফ দিতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে নীচে পড়ে গেছিল। উনি যদি সাথে সাথে জানাতেন হয়ত কিছু করা গেলেও যেতে পারত। কিন্তু বাচ্চার জ্বর বা দুর্বলতা জাতীয় স্বাভাবিক কোন অসুখ ভেবে প্রায় দু’মাস অপেক্ষা করার পর যখন ওরা ডাক্তারের কাছে যায় তখন বাচ্চা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।

রিমাকে চাকরী ছেড়ে দিতে হোল। হয়ত অপরাধবোধ থেকেই ওর শ্বাশুড়ী ওকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। ওকে আলাদা বাসা নিতে হোল। তার কয়েকবছর পর উনি অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যান্য বৌরা শ্বাশুড়ীকে দেখাশোনা করতে অপারগতা প্রকাশ করল। ওনার ঠাঁই হোল এই রিমার বাসায়। ওর শ্বাশুড়ী আর ছেলে একই রুমে থাকত। ওনার ‘পাওয়ার প্লে’র সর্বশ্রেষ্ঠ শিকারকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখতে ওনার কেমন লাগত জানিনা। তবে রিমা এই দুই রোগীকে নিয়ে কি আমানুষিক পরিশ্রম করেছে আমরা দেখেছি। ছেলে ততদিনে অনেক বড় হয়েছে, রিমার মতই বড়সড় গোছের। একবার ছেলেকে খাওয়ায় খাবার গ্রাইন্ড করে পাইপ দিয়ে, আবার শ্বাশুড়ীকে খাওয়ায়। একবার ছেলেকে কোলে করে বাথ্রুমে নিয়ে যায়, আবার শ্বাশুড়ীকে আলগে বাথ্রুমে নিয়ে যায়। এভাবে কয়েকবছর যাবার পর ওর শ্বাশুড়ী গ্রামে ঈদ করার শখ করলেন। এই অসুস্থ বাচ্চা শ্বাশুড়ী সব নিয়ে সে গ্রামের বাড়ী গেল বেশ কয়েকবার বাস নৌকা পরিবর্তন করে। ঈদের পরদিন উনি কোরবানীর গরুর নেহারী খেতে চাইলেন। রান্নার মধ্যখানেই রিমা শুনলো ওর শ্বাশুড়ীর শ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি ওনার শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য নেহারীর ঝোল অল্প চামচে করে এনে খাওয়ালো। সে ফিরে আসার পর যখন ওর সাথে দেখা করতে গেলাম ও বারবার বলতে লাগল, “আহারে, নেহারীতে বাগাড় দেয়ার আগেই উনি মারা গেলেন। বাগাড় ছাড়া ঝোলই ওনাকে দিতে হোল”। আমি ওর দিকে হা করে চেয়ে রইলাম। যে ওকে এতটা কষ্ট দিয়েছে যে এত বিশাল শক্তপোক্ত একটা মেয়ে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে গেছিল, ওর প্রথম সন্তানকে পঙ্গু করে দিয়েছে চিরতরে, তার জন্য সে দুঃখ করছে, “বাগাড় ছাড়া ঝোল ওনাকে দিতে হোল”!

ক্যানাডা আসার আগে গেছিলাম ওর সাথে দেখা করতে। ওর ছেলেটাকে খাওয়ানোর পর ও একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল পরবর্তী সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে। ওদের পাঠিয়ে ছেলের রুমে গিয়ে দেখে ওর গাল বেয়ে যে লালা পড়েছে সেখানে অসংখ্য পিঁপড়া, পিঁপড়ের কামড়ে গাল লাল হয়ে ফুলে গিয়েছে কিন্তু বেচারার হাত চলেনা যে সে পিঁপড়েগুলোকে সরিয়ে দেবে, কথা বলতে পারেনা যে মাকে ডেকে বলবে। ওর কথা শুনে দুঃখে আমার চোখ জ্বলতে লাগল। কি বলে সান্তনা দেব খুঁজে পেলাম না তাই চুপ করে রইলাম। কিন্তু রিমা নিজেই বল্ল, “জানিস, আমার এই ছেলে নিয়ে আমার অনেক দুঃখ। কিন্তু এর বিনিময়ে আমি অনেক কিছু পেয়েছি যা কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব না। আমি আগে কখনো নামাজ পড়িনি। কিন্তু আমার ছেলের এই অবস্থার পর থেকে আমি নামাজ পড়া শুরু করেছি আর ছাড়িনি। আল্লাহকে খুব কাছে মনে হয়। ওনার কাছে যখনই যা চাই তা পাই। আমি একসময় খুব উৎশৃংখল ছিলাম। কিন্তু এখন আমি ভালো কোনটা খারাপ কোনটা বুঝি এবং খারাপের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি। একসময় পর্দার ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই ছিলোনা। এখন আমি পর্দা করে চলি। আগে পথের ধারে যেই শিশুগুলোর দিকে তাকিয়েও দেখতাম না তাদের জন্য এখন খুব মায়া লাগে, কিছু করতে ইচ্ছা করে। আমি নিজেই বুঝি যে আমি এখন কোন ব্যপারে কষ্ট পাইনা, কেউ আমাকে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা যদি আল্লাহ আমার সাথে থাকেন”। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম রিমার দিকে। আমার এই বান্ধবী একসময় বিশাল আকারের শক্তিশালী দেহের অধিকারী হয়েও কথার আঘাত সইতে না পেরে নিজেকে ধ্বংস করে মুক্তি পেতে চেয়েছিল। আর আজ সে এত সহ্যাতীত দুঃখের ভেতরেও পাহাড়ের মত শান্ত অটল! বিশ্বাস বুঝি একেই বলে! ওকে দেখে আমার মনে হোল আমি এক বেহেস্তী নারীর দিকে তাকিয়ে আছি!

Tuesday, November 9, 2010

ছাত্রীজীবনের স্মৃতি – কলেজ জীবন




ইন্টারমিডিয়েটের দু’টো বছর আমার জীবনে আলোর রশ্মি হয়ে দীপ্তি ছড়িয়েছিল বান্ধবী শিখা সাহা। ভীষণ মায়াভরা দু’টো উজ্জ্বল চোখ ছিল ওর জোড়া ভ্রূর নীচে, শ্যামলা মিষ্টি চেহারার সাথে লম্বা লালচে চুল। কিন্তু ওর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য ছিল ওর অসম্ভব সুন্দর মনটা। কারো বিপদে সে সবার আগে এগিয়ে যেত, কারো মনখারাপ হলে সাহচর্য দিত, কারো সাহায্যের প্রয়োজন হলে সর্বস্ব দিয়ে সহায়তা করত।

কিভাবে ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমার নিজেরও মনে নেই। তখন আমরা আবুধাবী থেকে দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে চট্টগ্রাম এসেছি। এর আগে চট্টগ্রামে কখনো থাকা হয়নি, আত্মীয়স্বজন সব ঢাকায়। বাবার সাথেই বন্ধুত্ব ছিল বেশী। কিন্তু চাকরী ছেড়ে দেশে চলে আসার পর যাদের বাবা এত বছর ধরে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে আসছে এখন সাহায্য করার সামর্থ্য না থাকায় তাদের দুর্ব্যাবহারে আশ্চর্য তিক্ত বিরক্ত অসুস্থ হয়ে বাবাকে আমেরিকা চলে যেতে হোল। একটা নতুন জায়গায় এসে সংসারের সম্পূর্ণ দায়িত্ব একা সামাল দিতে গিয়ে মা তার সন্তানদের থেকে দূরে সরে গেল। এসময় আমরা তিন ভাইবোনই ছিলাম একে অপরের একমাত্র বন্ধু।

কলেজে গিয়ে দেখি এখানকার ছাত্রীরা বিদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের চেয়ে চিন্তাভাবনা আচারআচরণ কথাবার্তায় অনেক অগ্রসর, কাটা কাটা কথা বলে, অন্যকে কষ্ট দিতে কিছুমাত্র বিচলিত হয়না- ওদের দেখলে আমার ভয় লাগত। শিক্ষকরাও দেখি ছাত্রীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিবর্তে নিজেদের আকাশচারী ফেরেস্তার মত কিছু মনে করে সে ধরণের আচরণ করতেন। নিজেকে ভীষণ একা মনে হত। আর ক্লাসের সবাই আমার সামনেই বলত আমাকে দেখলে ওদের মনে হয় আমি মঙ্গল গ্রহ থেকে আসা কোন আজব প্রাণী। এ’সময়ই আমার শিখার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারপর থেকে দু’বছর আমাদের আর কখনো কেউ আলাদা দেখেনি।

আমি ওর নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ মনটাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। শিক্ষক পানি চাইলে সে তিনতলা থেকে নেমে নলকূপ থেকে পানি এনে দিত, সে শিক্ষককে যিনি ওর নামটাও জানার প্রয়োজন মনে করতেন না, যাঁর মুখ থেকে একটা ‘ধন্যবাদ’ উচ্চারিত হতনা কখনো। বিদেশ থেকে এসে দেশের আবহাওয়া পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে আমাদের ভাইবোনদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে। শরীর প্রায়ই খারাপ হয়ে যেত। কতবার শিখা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমে গিয়ে আমার বাসায় ফোন করে জানিয়েছে যেন বাসা থেকে কেউ এসে নিয়ে যায় যদিও ও প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে খুব ভয় পেত। প্র্যাক্টিকালের সময় সবার সাথে ধাক্কাধাক্কি করে ডেমন্সট্রেশন দেখতে পারতাম না। শিখা ছোটখাটো ছিল, তাই সামনে দাঁড়িয়ে দেখার সুযোগ পেত। পরে ও আমাকে আলাদা করে সব প্র্যাক্টিকাল শিখিয়ে দিত। ব্যাঙ, কেঁচো ধরতে ভয় পেতাম বলে ও ট্রেতে আটকে দিত। আর আমি? আমি ওর জন্য কিছুই করতে পারিনি। মাঝে মাঝে ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে যেতাম বাগান থেকে। মালা গাঁথতে গাঁথতে ঢাকায় থাকার দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করতাম যখন ছোটবেলায় বান্ধবীরা দল বেঁধে শিউলী বা হিজলের মালা গাঁথতাম।

পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, শিক্ষকদের ব্যাবহার সব মিলে পড়াশোনায় মন ছিলোনা মোটেও, পাশ করার আশা বা ইচ্ছা কোনটাই ছিলোনা। একদিন শিখা বাসায় এসে জানালো কলেজে ফর্মফিলাপ চলছে, আমি ফর্ম জমা দিয়েছি কি’না। আমি বললাম, আমি জানিইনা কিছু এ’ব্যাপারে। ও মা’র কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাকে নিয়ে গেল ফর্মফিলাপ করতে, নিজ হাতে ফর্ম ফিলাপ করল, টাকা জমা দিল, আমার ছবি ছিলোনা বলে কলেজের পাশের স্টুডিওতে নিয়ে ছবি তোলালো, পরদিন তারিখ শেষ তাই আমি কলেজে পৌঁছনোর আগেই দোকান থেকে ছবি নিয়ে অফিসে জমা দিয়ে দিল।

শিখা না থাকলে আমার পরীক্ষাই দেয়া হতনা। কিন্তু এই শিখাকেই হারিয়ে ফেললাম কয়েকবছর পর। তারপর কত যে খুঁজেছি, কতভাবে যে খুঁজেছি! পাইনি।

ওর মত পবিত্র মনের অধিকারী মেয়ে আমি দেখিনি বললেই চলে। সে আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলেও জানি কারো জীবনে দীপ্তিময়ী হয়ে আছে নিশ্চয়ই। দোয়া করি সে যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক; আমার মত অন্য কারো জীবনে আলোকবর্তিকা হয়ে বিরাজ করুক।




আগামীকাল এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। পড়তে ইচ্ছা করছেনা। আর পড়ে কি হবে? গত দু’বছর আমি বই ছুঁয়েও দেখিনি, কোন পরীক্ষা পাশ করিনি, এখন পড়ে কি করব? বাবা এসেছে, মন ভালো। কিন্তু পাশ করা সুদূরপরাহত। রাত আটটা বাজে তখনো আমার পড়াশোনা করার কোন ইচ্ছা বা লক্ষণ নেই। বাবা বল্ল, “কাল কি পরীক্ষা?”
“ইংরেজী- ফার্স্ট আর সেকেন্ড পেপার।”
“পড়তে ইচ্ছে করছেনা?”
“না”।
“মনোপলি খেলবি।”
“হ্যাঁ”।
“চল”।
এইজন্যই আমার বাবাকে এত ভালো লাগে। কোন চাপাচাপি নেই। এসএসসিতে ছাড়া কোনদিন অংকে পাশ করিনি, বাবা কিছু বলেনি; ক্লাসের বই ছাড়া সব বই পড়তাম, বাবা সোৎসাহে কিনে দিত; কাল এইচএসসি পরীক্ষা আর পড়তে ইচ্ছা করছেনা দেখে বাবা মনোপলি খেলতে ডাকছে! বান্ধবীরা বলত, ‘এ’তো স্বপ্নের বাবা!’

রাত দশটা পর্যন্ত খেলে ঘুমাতে গেলাম। রাত একটার সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম পরীক্ষা দিলে কি হবে আর না দিলে কি হবে? সিদ্ধান্তে এলাম যদি পরীক্ষা দেই ফেল করার সম্ভাবনা ৯০% যেহেতু শুধু আউটনলেজের ভিত্তিতে পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু যদি ভাগ্যক্রমে পাশ করে যাই তাহলে আর এই কলেজের আঙ্গিনা মাড়াতে হবেনা। শেষের যুক্তিটা এত আকর্ষণীয় মনে হোল যে সাথে সাথে উঠে প্রায়নতুন বইগুলো নিয়ে বসে গেলাম। নৈঃশব্দের মধ্যে পড়া খুব ভালো হয়। সকাল ছয়টা পর্যন্ত পড়ে মনে হোল পাশ করলেও করতে পারি। তাই ঘুমাতে চলে গেলাম। আটটার সময় বাবা জিজ্ঞেস করল, “কি রে, পরীক্ষা দিবি?” আমি হাই তুলে বললাম, “দিয়ে দেখি”।

প্রথমদিন দু’পেপার ইংরেজী দিয়ে আমার সর্বাঙ্গে ব্যাথা। এত সময় বসে থাকা হয়নি বহুদিন। বাসায় এসে পড়ব কি আহা উহু করতে করতে প্রাণ যায়! আমার ছোটভাই আহমদের হাতে যাদু আছে। ও কিছুক্ষণ ঘাড় টিপে দেয়ার পর যেন আমি প্রাণ ফিরে পেলাম। কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি থাকেনা কোন পরীক্ষার সময়ই। তাই সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে আবার রাত বারোটায় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা, সকাল ছ’টা পর্যন্ত পড়ে আটটা পর্যন্ত ঘুম, তারপর পরীক্ষা দিতে যাওয়া। বাকী সব পরীক্ষা এভাবেই দিয়েছিলাম।




প্র্যাক্টিকালে বরাবরই কাঁচা ছিলাম। প্রথমদিন ছিল বায়োলজি। সকালে বোটানী আর বিকেলে জুওলজি। সকালে লাউয়ের ডাঁটার প্রস্থচ্ছেদ। কিছুতেই যথেষ্ট পাতলা হয়না। শিখা ধারে কাছে কোথাও নেই, আমার গ্রুপেই নেই। ল্যাব হেল্পার আংকেল এসে বললেন, “তুমি এত মোটা মোটা করে এগুলো কি কাটছ? তোমার পাশের ওকে দেখ, কি সুন্দর পাতলা পাতলা করে কাটছে!” পাশের বান্ধবীর লাউয়ের ডাঁটা কাটা দেখে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের ট্রের দিকে তাকালাম। যেটা সবচেয়ে পাতলা মনে হোল সেটা মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে যা থাকে কপালে ভেবে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি ছিলাম দরজার পাশেই তাই এক্সটার্নাল স্যার এসে সবার আগে আমারটাই দেখলেন। দেখে উনি ভীষণ অভিভূত হয়ে গেলেন, এত সুন্দর কাটা উনি কমই দেখেছেন! আমি তো থ, বলে কি? উনি পুরো রুম দেখে এসে আবার আমার প্রস্থচ্ছেদের প্রশংসা করে চলে গেলেন। পরে জেনেছিলাম আমি যখন বান্ধবীর লাউয়ের ডাঁটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছি তখন আংকেল আমার লাউয়ের ডাঁটা কেটে রেখে গেছিলেন। আহা! কত মায়া ছিল মানুষটার মনে!

বিকেলে ছিল জুওলজি। শিখাদের গ্রুপ সকালে তেলাপোকা কেটে সব তেলাপোকা শেষ করে ফেলেছে। তাই আমাদের ভাগ্যে পড়ল ব্যাঙ। আমি মোটামোটি ব্যাঙ বেচারার বাইরেটা কেটে শেষ করেছি, নাড়িভুড়ি তখনো বের করতে পারিনি, শুনি আমার মৌখিক পরীক্ষার ডাক পড়েছে। ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার রোল সবার শেষে, অর্থাৎ আমার মৌখিক শেষ হলেই স্যার ব্যাঙ দেখতে আসবেন। আমি দরজার পাশেই, সুতরাং এসেও ব্যাঙ কাটা শেষ করার সময় পাবোনা। কিন্তু কিছুই করার নেই।

মৌখিক পরীক্ষার ব্যাপারে আমার কোনকালে ভয়ডর ছিলোনা। কিছু না পারলেও তো আর আমাকে মারতে মায় কামড় দিতে পারবেনা! গিয়ে দেখি স্যার অভিনব পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিচ্ছেন। দু’জন করে একসাথে ডেকে তাদের একজনকে দিয়ে আরেকজনের পরীক্ষা নিচ্ছেন, কিছুক্ষণ পর যে টিকে যাচ্ছে তাকে তিনি নিজে প্রশ্ন করছেন। সাথের বান্ধবী ছিল লাজুক ধরণের তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি টিকে গেলাম। প্রশ্নপর্ব শেষ করে স্যার গল্প করতে শুরু করলেন। বান্ধবী খুব মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল কিন্তু আমার মাথায় কাজ করছে আমার ব্যাঙ-এর কি হবে?

পরীক্ষা শেষে যেতে যেতে দেখি স্যার আমাদের পিছু পিছু আসছেন। আমার তো মাথায় বাড়ি! এখন কি হবে? প্রথমেই স্যার এলেন আমার ব্যাঙ দেখতে, আমি চোখ বুজে রইলাম। শুনি স্যার বলছেন, “বাহ, যেমন ভাইভা তেমন ব্যাঙ কাটা!” আমি মনে মনে ভাবছি, “আমার ভাইভা তো এত খারাপ হয়নি!” উনি ম্যাডামের দিকে ফিরে বললেন, “ও ভাইভাতে খুব ভালো করেছে”। ম্যাডাম ভারী সুন্দর একটা হাসি দিলেন। আমি ভাবলাম এই আধাকাটা ব্যাঙ-এর মধ্যে কি দেখে উনি এত খুশী হয়ে গেলেন? অনুসন্ধান করার জন্য খুব সাহস করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার ব্যাঙ ভারী সুন্দর করে কাটা, নাড়িভুড়ি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!পরে জানলাম আমাদের দেরী দেখে ম্যাডাম নিজেই আমার বাকী কাজ সম্পন্ন করেছেন! ধন্যবাদ ম্যাডাম!




সেদিন বিকেলে বাবার এক বন্ধু নববিবাহিতা আন্টিকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আংকেল আমেরিকা ফিরে যাচ্ছেন, তাই। আন্টি মাত্র ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়েছেন, পড়াশোনার সাথে তখনো সংশ্লিষ্ট। উনি আমাকে দেখে বললেন, “তোমার রেজাল্ট কি?” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “কিসের রেজাল্ট?” উনি একটু ইতস্তত করে বললেন, “তুমি ইন্টার দিয়েছ না এ’বছর?” আমি বললাম, “জ্বী”। উনি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বললেন, “এইচএসসি’র রেজাল্ট দিয়েছে তো চারদিন হোল। তুমি জানোনা?” এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। আমি নিজেই ভুলে গেছিলাম যে পরীক্ষা দিলে রেজাল্ট আসে, তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়! আমার মত ঝাড়াহাতপা ছাত্রী মনে হয় আল্লাহর দুনিয়াতে আর নেই!

তখন বিকেল হয়ে গিয়েছে, বাইরে বৃষ্টি, অন্ধকার। তবুও ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি। কলেজে গিয়ে দেখি দারোয়ান ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। উনি আমাকে দেখে বললেন, “সবাই এসে রেজাল্ট দেখে গিয়েছে, আপনিই শুধু আসেননি। আমি তো মনে করেছিলাম আপনার কিছু হয়েছে। আপনি বেঁচে আছেন দেখে আশ্বস্ত হলাম”। বলে কি?! আমি তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে রেজাল্ট দেখার জন্য নোটিসবোর্ড দেখতে গেলাম। সেকেন্ড ডিভিশন চেক করলাম, আমার নাম্বার নেই- না থাকারই কথা। থার্ড ডিভিশন চেক করলাম, ওখানেও আমার নাম্বার নেই। কি আর করা? দারোয়ান ভাইকে জানালাম আমি ফেল করেছি। বাসায় ফিরে দেখি মেহমান বসে আছেন আমার রেজাল্ট জানার জন্য- সবাইকে জানালাম আমি ফেল করেছি। আমাকে এত অবিচলিত দেখে মেহমান নিজেই ঘাবড়ে গেলেন। মা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাঁদের পানি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পানি খেয়ে মিষ্টি খান”।

তার তিনদিন পর পেপারে পড়ছি সম্পূর্ণ কুমিল্লা বোর্ডে প্রায় ২ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মাত্র ২০০০ ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। আমি আর কোথা থেকে পাশ করব? এমন সময় ওর ও লেভেল পড়ুয়া বান্ধবী মুনমুনকে নিয়ে শিখা এসে উপস্থিত, “মিষ্টি খাওয়াও”। আমি হাসতে হাসতে বললাম, “এটা কি নতুন সিস্টেম নাকি?” শিখা বল্ল, “নতুন সিস্টেম মানে?” “এই যে, ফেল করে মিষ্টি খাওয়ানো!” ও চোখ কপালে তুলে বল্ল, “বল কি?” “আমি পাশ করিনি তো!” আমি সত্যি বলছি বুঝতে পেরে ও আমাকে কান ধরে চেয়ার থেকে ওঠালো, ঐভাবেই কলেজে নিয়ে গেল, নোটিসবোর্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেখাল, “এটা কি?” অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারলাম না আমি জেগে আছি না ঘুমিয়ে। তারপর শিখার প্রশ্নবোধক দৃষ্টির সামনে আমতা আমতা করে বললাম, “আমি তো ফার্স্ট ডিভিশন চেক করিনি!”

এই ঘটনা কি করে হোল আমি আজও জানিনা। আল্লাহর রহমতের যে কোন সীমা নেই তা সেদিন আমি এই আলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি। তাই তো তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই প্রত্যেক কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি”। আমার বাবামাকে তাঁদের উদার মনোভাব এবং বিশ্বাসের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ!

Monday, November 8, 2010

ভূমিকম্প

২১শে নভেম্বর, ১৯৯৭, চট্টগ্রাম। মাগরিবের নামাজ পড়ছিলাম। পাশে আমার ছোটভাই মোহাম্মদ। হঠাৎ দে্খি কাপড়ের আলমারীটা ওর গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছে! কিছু বোঝার আগেই একহাতে ধরে ফেললাম আলমারীটা- রিফ্লেক্স। বুঝতে বেশী সময় লাগলোনা যে ভূমিকম্প হচ্ছে; হচ্ছে হয়ত বেশ কিছুক্ষণ ধরেই কিন্তু নামাজের মধ্যে নড়াচড়ায় থাকায় বুঝতে পারিনি। আমাদের বাড়ীটা ছিল ৫০ বছরের পুরনো আর আমি নিজে এর মেরামতর কাজ করিয়েছি তাই আমি জানি এই ধরনের জোরালো ভূমিকম্পে বাড়ী ভেঙ্গে পড়তে পারে যেকোন সময়। কোন কথা না বলে একহাতে আলমারী ধরে রেখেই মোহাম্মদকে নামাজের মধ্যখানে ঠেলে বের করে দিলাম রুম থেকে। তারপর আলমারী ছেড়ে দিয়ে পরের রুমে যেতেই দেখি আরেক ভাই আহমদ জায়নামাজ ভাঁজ করছে। মোহাম্মদকে একহাতে ধরে আরেকহাতে আহমদের কান ধরলাম। তখন কি ধরছি দেখার সময় নেই, ওদের বের করাটাই জরুরী। দুজনকে নিয়ে ডাইনিং রুম হয়ে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। সামনের দিকে যাওয়াটা নিরাপদ মনে হোলনা যেহেতু ড্রয়িং রুমের অধিকাংশই কাঁচের আর ভূমিকম্পের সময় কাঁচ ভেঙ্গে ছিটানোটা একটা বড় বিপদ। পেছনে বের হয়েই শুনি ছোটমামা জোরে জোরে আজান দিচ্ছে। বেচারা ভয়ে পশ্চিম দিকের পরিবর্তে পূর্বদিকে ফিরে আজান দিচ্ছে! মামাকে বললাম, “তুমি প্যাসেজে দাঁড়িয়ে কিসের আজান দিচ্ছ? দু’দিক থেকেই বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়তে পারে”। মামাকেও টেনে নিয়ে চললাম আমাদের সাথে সামনের আঙ্গিনায়, আমগাছটার নীচে। এগুলো সবই মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা। একটু পর ভূমিকম্প থেমে গেল। তবুও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। যখন মনে হোল এবার ঘরে ঢোকা যেতে পারে, ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলাম।

আলো জ্বালতেই দেখি ঘরের দেয়ালে বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরে গিয়েছে। পরে জেনেছি ৬.১ মাত্রার এই ভূমিকম্পে চট্টগ্রামের প্রায় বিল্ডিংযেই সেদিন ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। একটা পাঁচতলা ভবন ধ্বসে পড়ে ২২ জন মারা গেছিল আর বিল্ডিংযের অনেকখানিই মাটিতে দেবে গিয়েছিল। সে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে চারবছর বয়সী একটা শিশু আটকা পড়ে কয়েকদিন বেঁচে থাকলেও কেউ তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। শিশুটির জন্য মনে হয় সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম কেঁদেছে কিন্তু তাতেও তাকে বাঁচানো যায়নি। ভূমিকম্পের সময় মানুষের মাথা ঠিকমত কাজ করেনা। শিশুটির বাবামা ভাইবোন বাড়ী থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় কারোরই ওর কথা মনে হয়নি। যখন সবাই সুস্থির হোল তখন ওদের ফ্লোর মাটির নীচে চলে গিয়েছে।

আমাদের পাড়ার মসজিদে তখন মাগরিবের নামাজ হচ্ছিলো। নামাজের মধ্যখানে অনেকের সাথে বাবার ছোটবেলার বন্ধু ফরিদ মামা দৌড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। ভূমিকম্পের পর ইমাম সাহেবের সাথে ওনার ছেলেকে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতে দেখে ওনার মনে পড়লো যে সাথে আসা ছেলেকে রেখেই উনি চলে এসেছেন! আর আমার ভাই আহমদ পরে স্বীকার করল যে সে আগেই নামাজ শেষ করায় বুঝতে পারেছিল যে ভূমিকম্প হচ্ছে কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে জায়নামাজ ভাঁজ করেই বেরোবে! বিপদের সময় মানুষ কত অসহায় হয়ে যায় যে সে সঠিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে! আল্লাহর অশেষ রহমত যে তিনি সেদিন আমাকে স্থিরতা দিয়েছিলেন। নইলে আমার বাবামা যখন ইরান থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করল তখন আমি কি বলতাম?

এরকম আরো অসংখ্য ভূমিকম্প দেখেছি চট্টগ্রামে। এর কিছু কিছু স্মরনীয় হয়ে আছে এর সাথে বিজড়িত স্মৃতির কারণে। ২০০০ সালের দু’টো ভূমিকম্পের কথা মনে পড়ে। একটা বছরের প্রথমদিকে আরেকটা শেষদিকে। প্রথমটির সময় রাত চারটেয় জেগে বসে আছি, শরীর ভালো লাগছিলোনা। হঠাৎ পুরো বিল্ডিং দুলে উঠলো। সাথে সাথে পাশের ঘরের সারি সারি অ্যাকুয়ারিয়ামের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে ছলকে পড়তে শুরু করল, স্টিলের র‌্যাকশুদ্ধ এমন গুড়গুড় করে কাঁপতে শুরু করল যে মনে হচ্ছিল সব উপুড় হয়ে উলটে পড়বে। হাফিজ সাহেব দেখি নির্বিকার শুয়ে ঘুমোচ্ছেন! ওনাকে ডাক দিয়ে বুঝতে পারলাম উনি জেগেছেন কিন্তু নড়াচড়া করার প্রয়োজন মনে করছেন না! আমিও ভাবলাম এই পাঁচতলার ওপর থেকে যাব কোথায়? তাই বসেই রইলাম। একটু পরে ভূমিকম্প থেমে গেলে হাফিজ সাহেব উঠে আলো জ্বালিয়ে ওনার গোল্ডফিশ, এঞ্জেলফিশদের দঙ্গল্ দেখে এসে আনন্দের সাথে জানালেন যে ওনার মাছের ব্যাবসা অক্ষত আছে। তারপর ওপাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন! আমি মেজাজ খারাপ করে বসে রইলাম- ওনার হবু সন্তানের মা বমি করে মরে ওনার খবর নেই আর ওনার মাছেরা ভয় পেল কি’না দেখার জন্য উনি কষ্ট করে গাত্রোত্থান করেন!

সে বছরের শেষদিকে। তখন আমি আইআইইউসি তে শিক্ষকতা শুরু করেছি, সাথে আমার কয়েকমাস বয়সী মেয়েকে নিয়ে যাই। সেদিন বিকেলে ডিপার্টমেন্টের মিটিং ছিল। কি কারণে যেন ডিপার্টমেন্টের বয়োজ্যেষ্ঠ দু’জনের ভীষণ ঝগড়া লেগে গেল। বাকীরা অসহায়ের মত বসে আছি। হঠাৎ দু’জনেই ঝগড়া থামিয়ে দরজার দিকে দৌড় দিলেন, একটু পরে আবার আচমকা ফিরে এলেন। তাঁদের এই আচরণ আমাদের ঝগড়ার চাইতেও অদ্ভুত মনে হোল। জিজ্ঞেস করার পর দু’জনেই খুব লজ্জা লজ্জা মুখ করে বললেন, “ঝগড়ার মধ্যখানে আমাদের হঠাৎ মনে হোল ভূমিকম্প হচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি তোমাদের ফেলেই দৌড় দিলাম। কিন্তু একটু পরে দেখি তোমরা বা বিল্ডিংযের আর কেউই পালানোর কোন চেষ্টা করছেনা। তখন ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এলাম”।

২০০৪ সালের সুনামীর সময় আমরা ঢাকায়। সকালে ঘুমের মধ্যে তীব্র ধাক্কায় আমি উঠে বসলাম। সবাই যখন জেগে উঠে আলাপ করছে আমি বললাম ভূমিকম্প আর আমার বাবা আর তার জামাই বলে কি’না বড় ট্রাক যাবার ভাইব্রেশনকে আমি ভূমিকম্প মনে করে ভুল করেছি! পরে তো পৃথিবীব্যাপী সবাই দেখেছে সুনামীর প্রলয়তান্ডব। একদিন বান্ধবী নাহিদ আপার সাথে রিক্সায় করে গ্রীণ রোড দিয়ে আসার সময় আমরা আলাপ করছিলাম যে ঢাকায় যদি চট্টগ্রামের মত ভূমিকম্প হত তাহলে কেউ বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মানুষ যাবে কোথায়? এত বড় বড় বিল্ডিং, নামার আগেই তো সব শেষ! আর কেউ যদি নেমেও আসে, দাঁড়ানোর মত নিরাপদ জায়গাটুকুও তো নেই! চারপাশের বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়েই সে মারা পড়বে!

২০০৬ সালে একদিন ফজর নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছি। বিছানার নড়াচড়ায় বিরক্ত হয়ে আধোঘুমের মধ্যে হাফিজ সাহেবকে বললাম, “উফ! আপনার এই বিশাল দেহ নিয়ে বিছানা নাড়াচ্ছেন কেন?” উনি জবাব দিলেন, “পুরো বিল্ডিং আমি নাড়াই না?” ওনার কথায় ঘুম ছুটে গেল। সত্যিই তো! আমার দ্বিতীয় সন্তানের আসন্ন জন্ম উপলক্ষ্যে আমি খাট বহিষ্কার করেছি, মাটিতে বিছানা পাতা, এই বিছানা উনি নাড়বেন কি করে? পুরো বিল্ডিংই দুলছে!

কুর'আনে বিভিন্ন জায়গায় যে ভূমিকম্পের বর্ণনা এসেছে তার সাথে মিল খুঁজে পাই এইসব অভিজ্ঞতার। কোথাও বলা হয়েছে মানুষ মাতালের মত আচরন করবে যদিও তারা মাতাল হবেনা; কোথাও বলা হয়েছে তারা তর্করত থাকা অবস্থায়ই কেয়ামত শুরু হয়ে যাবে এবং তারা তর্ক থামিয়ে বলবে, “হায় এখন তো আমরা পরিবার পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারবনা!”; আর কোথাও বলা হয়েছে যে শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন জনপদে ভূমিকম্প দিয়ে সব ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে। মনে হয় আমরা এত দুর্বল- শারিরীক এবং মানসিকভাবে- যে আমাদের শাস্তি দেয়ার জন্য খুব বেশী বিপদ প্রয়োজন হয়না। অথচ বিপদ কেটে গেলেই আমরা এমন একটা ভাব করি যেন আমরা কত শক্তিশালী বা বুদ্ধিমান! যারা বুদ্ধিমান, এই অভিজ্ঞতা তাঁদের জীবনকে পরিবর্তন করে দেয়- তাঁরা তাঁদের জীবনের মূল্য বুঝতে পারেন এবং একে কাজে লাগানোর অন্য সর্বোতভাবে সচেষ্ট হন। কিন্তু যারা নির্বোধ, চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা তাঁদের মধ্যে কোন ভাবান্তর সৃষ্টি করতে পারেনা এবং উদ্দেশ্যহীনভাবেই তাদের দিন কাটতে থাকে।

Sunday, November 7, 2010

আমার বোনকে বলি


আপু, (ভুল করে লিখিনি, ছোটবোনদের আদর করে আপু ডাকি)

আসসালামু আলাইকুম।

আমি ছোটবেলা থেকেই অসহায় দুর্বলদের প্রতি ভীষণ সহানুভূতিশীল ছিলাম। কেন জানিনা, এরকম কাউকে দেখলেই আমার বুকের ভেতর একটা প্রচন্ড কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। রিক্সাওয়ালারা যখন রিক্সা থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে পানি খায় বা একটা শুকনো বানরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, আমার মনে হয় আমার হৃৎপিন্ডটাও যেন ঐ রুটির মত টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার চোখ থেকে পানি বেরোয়না তাই জ্বলতে থাকে, শীতল হওয়ার সুযোগ পায়না।

আমার নিজের রক্ত পড়ে ভেসে গেলেও পাত্তা দেইনা কিন্তু অন্য কারো আঙ্গুল থেকে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখলেও আমি অসুস্থ হয়ে যাই। হাসপাতালে আমি রোগী দেখব কি, নিজেই কাতরাতে থাকি!

এগুলো মানুষ ভালো চোখে দেখেনা। যেমন একবার আমাদের স্কুলে এক ছেলে ভর্তি হোল, আমাদের ক্লাসে, ক্লাস সিক্সে। ছেলেটা ছোটবেলা থেকে বিদেশী স্কুলে পড়েছে, তাই ওর হাবভাবে একটা বিদেশী বিদেশী ভাব ছিল যেটা আমার পর্যন্ত হাসি পেত যদিও আমি খুব সাবধান থাকার চেষ্টা করি যেন আমার ব্যবহারে কেউ কষ্ট না পায়। শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত, কেউ ওর সাথে কথা বলতনা। এভাবে কিছুদিন চলার পর আমি আর বেচারার মনখারাপ করা চেহারাটা সহ্য করতে পারলাম না। ঠিক করলাম ওকে আস্তে আস্তে আমাদের চালচলনের সাথে পরিচিত করে দেব যাতে ও সবার সাথে মিলেমিশে চলতে পারে। আমি যখন ওর সাথে মিশতে শুরু করলাম আমাদের অনেক ছেলেমেয়েই ওর সাথে কথা বলতে শুরু করল কারণ আমি লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো না হলেও খেলাধুলার জন্য আমি ছিলাম অপরিহার্য। আমি আমার এই জনপ্রিয়তা ব্যবহার করলাম ওকে একটা অবস্থান তৈরী করে দেয়ার জন্য। লাভ হোল এই যে একদিন আমাদের সিনিয়র এক মেয়ে ধুয়া তুলল যে সে ঐ ছেলেকে নাকি ফোন করে বলেছে সে আমি (বলাই বাহুল্য আমি ছেলেদের সাথে ফোনে কথা বলতাম না), ছেলেটা নাকি বলেছে সে আমাকে ভালোবাসে! অথচ সে আমাকে স্কুলবাসে বলছিল কেউ একজন বারবার ফোন করে কেটে দিচ্ছিল সেদিন। এসব ফালতু ব্যপার আমি পাত্তা দেইনা।তাই যখন সে মেয়ে পুরো স্কুলে রাষ্ট্র করে দিলো যে এমন এমন ঘটেছে আমি নির্বিকার রইলাম, কিন্তু ঐ ছেলে তো কেঁদে ফেলার অবস্থা। সে বারবার বলছে, "বিশ্বাস কর আমি তোমাকে ভালোবাসিনা!" আমি ওকে বললাম, "শোন, তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমাকে ভালোবাসবে না তো কে বাসবে? তুমি চুপচাপ থাক, আমি জানি এসব মিথ্যা কথা। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।" পরে শিক্ষকরা ঐ মেয়েকে ভালোভাবে ধরলেন এবং সে স্বীকার করতে বাধ্য হোল যে সে বানোয়াট খবর প্রচার করেছে। ছেলেটা না'কি খুব সুন্দর ছিল (আশ্চর্য! আমি কোনদিন খেয়াল করলাম না!), কিন্তু ওকে পাত্তা না দিয়ে আমার মত একটা কুৎসিত মেয়ের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এজন্য হিংসায় পড়ে সে এমন একটা গল্প ফেঁদেছে। তার পরে দু'টো বছর ওর কত খারাপ গিয়েছে ওর ডায়রীতে পড়েছিলাম। কতবার যে সে মাফ চেয়েছে এর জন্য! আমি ভাবলাম, আমি ওকে কি মাফ করব, ঐ এক পাপের শাস্তি তো বেচারী দু'বছর ভোগ করেই ফেলেছে!

সুতরাং, এসব করে আসলে মানুষ তোমাকে শুধু সাময়িকভাবে কষ্ট দিতে পারবে, আর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। কিন্তু একটা জিনিস শিখেছি আমার এক খালাকে দেখে। ওর স্বামী ওকে খুব ভালোবাসত। অনেক কিছু কিনে দিত। সে সরল মনে এগুলো ওর শ্বাশুড়ী ননদদের বলত, দেখাত। পরে ওরা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে ওর শ্বাশুড়ী ওর স্বামীকে বাধ্য করল ওকে তালাক দিতে। পরে শ্বাশুড়ী মারা গেলে ওর স্বামী আবার ওকে বিয়ে করে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। সুতরাং, এমন মানুষের সাথে এমন জিনিস শেয়ার করা উচিত না যেটা সে হজম করতে পারেনা।

এজন্যই বলি, বন্ধুত্ব থাক, তবে আচরণ হোক নিয়ন্ত্রিত।

আমাদের দেশ মুসলিমপ্রধান হলেও ইসলামের প্রতিফলন আমাদের জাতীয় জীবনে বিরল। তাই তুমি যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছ আমি তাতে মোটেও আশ্চর্য হইনা। এজন্যই হয়ত রাসূল (সা) বলেছেন, আমাদের যুগে এসে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা রাখার মতই কঠিন হবে। আমরা যারা আইআইইউসি তে একসাথে কাজ করতাম (মহিলারা), দেখা যেত কোথাও গিয়ে একাত্ম হতে পারতাম না। এটার মূলে অহংকার না, চিন্তার ভিন্নতা। একবার আমি সকালে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে এক দাওয়াতে গেলাম। ওখানে মেজবানের গ্রামের বাড়ী থেকে সব আত্মীয় স্বজন এসেছেন। কিন্তু তাদের জামাকাপড় সাজগোজ দেখে আমি চমকে গেলাম। এক মহিলা দেখি সবার মধ্যেই জামা তুলে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন! আশে পাশে সব পুরুষরা চলাফেরা করছে। আমার এত অস্বস্তি লাগছিল যে মনে হচ্ছিল আমি কোথাও পালিয়ে যাই। একটু পরে এক পুরুষ আত্মীয় এসে ঐ অবস্থাতেই ওনার সাথে হাসিতামাশা শুরু করল। ঐ লোক আমার সামনে দাঁড়ানো বলে উঠতেও পারছিলাম না, কিন্তু লজ্জায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটু পরে ঐ লোক চলে গেলে আমি না খেয়েই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঐ মহিলা আমাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, 'সরি, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি"। উনি একটু অবাক হয়ে গ্রামের ভাষায়ই বললেন, "ও, আমি তো মনে করেছি আপনিও আমার মত গ্রাম থেকে এসেছেন!" আমি কি বলব বুঝে না পেয়ে বললাম, "জ্বী না, আমি ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছি"। উনি এমনভাবে তাকালেন যে বুঝলাম শুধুমাত্র বোরকা পরার কারণেই উনি ধারণা করেছেন আমি গ্রাম থেকে এসেছি আর এই বেহায়াপনা করে উনি শুহুরে খ্যাতিতে উন্নীত হয়েছেন। আমার এখন মনে পড়লে খুব হাসি পায় কিন্তু মানুষের চিন্তার গন্ডির সীমাবদ্ধতা দেখলে মাঝে মাঝে খুব মায়া হয়।

আপু, তুমি মনে কষ্ট পেয়োনা। আনন্দিত হও যে তুমি যে পথের সন্ধান পেয়েছ কত বড় বড় কবি সাহিত্যিক চিন্তাবিদ আজীবন ভেবেচিন্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অথচ তাকে খুঁজে বের করতে পারেননি! এর জন্য কি কোনদিন শুকরিয়া করে শেষ করা যাবে?

দোয়া কোর,

মাআসসালাম,

রেহনুমা