Sunday, November 7, 2010

আমার বোনকে বলি


আপু, (ভুল করে লিখিনি, ছোটবোনদের আদর করে আপু ডাকি)

আসসালামু আলাইকুম।

আমি ছোটবেলা থেকেই অসহায় দুর্বলদের প্রতি ভীষণ সহানুভূতিশীল ছিলাম। কেন জানিনা, এরকম কাউকে দেখলেই আমার বুকের ভেতর একটা প্রচন্ড কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। রিক্সাওয়ালারা যখন রিক্সা থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে পানি খায় বা একটা শুকনো বানরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়, আমার মনে হয় আমার হৃৎপিন্ডটাও যেন ঐ রুটির মত টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার চোখ থেকে পানি বেরোয়না তাই জ্বলতে থাকে, শীতল হওয়ার সুযোগ পায়না।

আমার নিজের রক্ত পড়ে ভেসে গেলেও পাত্তা দেইনা কিন্তু অন্য কারো আঙ্গুল থেকে একফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখলেও আমি অসুস্থ হয়ে যাই। হাসপাতালে আমি রোগী দেখব কি, নিজেই কাতরাতে থাকি!

এগুলো মানুষ ভালো চোখে দেখেনা। যেমন একবার আমাদের স্কুলে এক ছেলে ভর্তি হোল, আমাদের ক্লাসে, ক্লাস সিক্সে। ছেলেটা ছোটবেলা থেকে বিদেশী স্কুলে পড়েছে, তাই ওর হাবভাবে একটা বিদেশী বিদেশী ভাব ছিল যেটা আমার পর্যন্ত হাসি পেত যদিও আমি খুব সাবধান থাকার চেষ্টা করি যেন আমার ব্যবহারে কেউ কষ্ট না পায়। শিক্ষক থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী পর্যন্ত সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত, কেউ ওর সাথে কথা বলতনা। এভাবে কিছুদিন চলার পর আমি আর বেচারার মনখারাপ করা চেহারাটা সহ্য করতে পারলাম না। ঠিক করলাম ওকে আস্তে আস্তে আমাদের চালচলনের সাথে পরিচিত করে দেব যাতে ও সবার সাথে মিলেমিশে চলতে পারে। আমি যখন ওর সাথে মিশতে শুরু করলাম আমাদের অনেক ছেলেমেয়েই ওর সাথে কথা বলতে শুরু করল কারণ আমি লেখাপড়ায় খুব একটা ভালো না হলেও খেলাধুলার জন্য আমি ছিলাম অপরিহার্য। আমি আমার এই জনপ্রিয়তা ব্যবহার করলাম ওকে একটা অবস্থান তৈরী করে দেয়ার জন্য। লাভ হোল এই যে একদিন আমাদের সিনিয়র এক মেয়ে ধুয়া তুলল যে সে ঐ ছেলেকে নাকি ফোন করে বলেছে সে আমি (বলাই বাহুল্য আমি ছেলেদের সাথে ফোনে কথা বলতাম না), ছেলেটা নাকি বলেছে সে আমাকে ভালোবাসে! অথচ সে আমাকে স্কুলবাসে বলছিল কেউ একজন বারবার ফোন করে কেটে দিচ্ছিল সেদিন। এসব ফালতু ব্যপার আমি পাত্তা দেইনা।তাই যখন সে মেয়ে পুরো স্কুলে রাষ্ট্র করে দিলো যে এমন এমন ঘটেছে আমি নির্বিকার রইলাম, কিন্তু ঐ ছেলে তো কেঁদে ফেলার অবস্থা। সে বারবার বলছে, "বিশ্বাস কর আমি তোমাকে ভালোবাসিনা!" আমি ওকে বললাম, "শোন, তুমি আমার বন্ধু, তুমি আমাকে ভালোবাসবে না তো কে বাসবে? তুমি চুপচাপ থাক, আমি জানি এসব মিথ্যা কথা। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।" পরে শিক্ষকরা ঐ মেয়েকে ভালোভাবে ধরলেন এবং সে স্বীকার করতে বাধ্য হোল যে সে বানোয়াট খবর প্রচার করেছে। ছেলেটা না'কি খুব সুন্দর ছিল (আশ্চর্য! আমি কোনদিন খেয়াল করলাম না!), কিন্তু ওকে পাত্তা না দিয়ে আমার মত একটা কুৎসিত মেয়ের সাথে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এজন্য হিংসায় পড়ে সে এমন একটা গল্প ফেঁদেছে। তার পরে দু'টো বছর ওর কত খারাপ গিয়েছে ওর ডায়রীতে পড়েছিলাম। কতবার যে সে মাফ চেয়েছে এর জন্য! আমি ভাবলাম, আমি ওকে কি মাফ করব, ঐ এক পাপের শাস্তি তো বেচারী দু'বছর ভোগ করেই ফেলেছে!

সুতরাং, এসব করে আসলে মানুষ তোমাকে শুধু সাময়িকভাবে কষ্ট দিতে পারবে, আর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। কিন্তু একটা জিনিস শিখেছি আমার এক খালাকে দেখে। ওর স্বামী ওকে খুব ভালোবাসত। অনেক কিছু কিনে দিত। সে সরল মনে এগুলো ওর শ্বাশুড়ী ননদদের বলত, দেখাত। পরে ওরা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল যে ওর শ্বাশুড়ী ওর স্বামীকে বাধ্য করল ওকে তালাক দিতে। পরে শ্বাশুড়ী মারা গেলে ওর স্বামী আবার ওকে বিয়ে করে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। সুতরাং, এমন মানুষের সাথে এমন জিনিস শেয়ার করা উচিত না যেটা সে হজম করতে পারেনা।

এজন্যই বলি, বন্ধুত্ব থাক, তবে আচরণ হোক নিয়ন্ত্রিত।

আমাদের দেশ মুসলিমপ্রধান হলেও ইসলামের প্রতিফলন আমাদের জাতীয় জীবনে বিরল। তাই তুমি যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছ আমি তাতে মোটেও আশ্চর্য হইনা। এজন্যই হয়ত রাসূল (সা) বলেছেন, আমাদের যুগে এসে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা রাখার মতই কঠিন হবে। আমরা যারা আইআইইউসি তে একসাথে কাজ করতাম (মহিলারা), দেখা যেত কোথাও গিয়ে একাত্ম হতে পারতাম না। এটার মূলে অহংকার না, চিন্তার ভিন্নতা। একবার আমি সকালে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিয়ে এক দাওয়াতে গেলাম। ওখানে মেজবানের গ্রামের বাড়ী থেকে সব আত্মীয় স্বজন এসেছেন। কিন্তু তাদের জামাকাপড় সাজগোজ দেখে আমি চমকে গেলাম। এক মহিলা দেখি সবার মধ্যেই জামা তুলে বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন! আশে পাশে সব পুরুষরা চলাফেরা করছে। আমার এত অস্বস্তি লাগছিল যে মনে হচ্ছিল আমি কোথাও পালিয়ে যাই। একটু পরে এক পুরুষ আত্মীয় এসে ঐ অবস্থাতেই ওনার সাথে হাসিতামাশা শুরু করল। ঐ লোক আমার সামনে দাঁড়ানো বলে উঠতেও পারছিলাম না, কিন্তু লজ্জায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটু পরে ঐ লোক চলে গেলে আমি না খেয়েই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঐ মহিলা আমাকে কি যেন জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, 'সরি, আমি আপনার কথা বুঝতে পারিনি"। উনি একটু অবাক হয়ে গ্রামের ভাষায়ই বললেন, "ও, আমি তো মনে করেছি আপনিও আমার মত গ্রাম থেকে এসেছেন!" আমি কি বলব বুঝে না পেয়ে বললাম, "জ্বী না, আমি ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছি"। উনি এমনভাবে তাকালেন যে বুঝলাম শুধুমাত্র বোরকা পরার কারণেই উনি ধারণা করেছেন আমি গ্রাম থেকে এসেছি আর এই বেহায়াপনা করে উনি শুহুরে খ্যাতিতে উন্নীত হয়েছেন। আমার এখন মনে পড়লে খুব হাসি পায় কিন্তু মানুষের চিন্তার গন্ডির সীমাবদ্ধতা দেখলে মাঝে মাঝে খুব মায়া হয়।

আপু, তুমি মনে কষ্ট পেয়োনা। আনন্দিত হও যে তুমি যে পথের সন্ধান পেয়েছ কত বড় বড় কবি সাহিত্যিক চিন্তাবিদ আজীবন ভেবেচিন্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অথচ তাকে খুঁজে বের করতে পারেননি! এর জন্য কি কোনদিন শুকরিয়া করে শেষ করা যাবে?

দোয়া কোর,

মাআসসালাম,

রেহনুমা

1 comment:

  1. হায়রে মানুষ!!!! হায়রে গাধার দল!!!!!!

    ReplyDelete