Monday, November 22, 2010

চা


আমার বিয়ের সময় কার্ডের যেখানটায় লেখা থাকে ‘দোয়াই কাম্য’- যার অর্থ ‘তবে উপহার দিলে ভালো হয়’- সেখানে লেখা ছিল ‘অনুগ্রহপূর্বক উপহার দেবেন না’। তারপরও যারা নিয়্মভঙ্গ করেছে তাদের একজন ছিলো আমার বান্ধবী সিমিন। সে আমাকে একটা বেডসাইড ল্যাম্প দিয়ে বলেছিল, “জানিস, আমার বিয়ের সময় এক বান্ধবী এরকম একটা ল্যাম্প দিয়েছিল। আমি প্রতিদিন সব কাজ সেরে যখন ঘুমাতে যেতাম, সবশেষে ল্যাম্পটার সুইচ অফ করতাম- ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার শেষ স্মৃতি হত ঐ বান্ধবীর মুখটা। তাই আমার মনে হোল এই ল্যাম্পটা দেই, প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও তুই আমাকে মনে করবি!”


এভাবে অনেক জিনিসের সাথে অনেক স্মৃতি জুড়ে যায়। যেমন মুড়ি দেখলেই আমার নানার কথা মনে হয়। নানা যখন রিটায়ার করল তখন সময় কাটানো জন্য একটা দোকান করল। ঐ দোকান থেকে আমি টিনভর্তি করে মুড়ি মোয়া এনে খেতাম! লিখতে বসলেই বাবার কথা মনে হয় কারণ বাবাকে চিঠি লিখতে গিয়েই আমার লেখায় হাতেখড়ি, পাঁচবছর বয়সেই বাবা একটা ডায়রী দিয়ে বলেছিল, “এতে প্রত্যেকদিন তোমার মনমত কবিতা গল্প কিছু একটা লিখবে”। আর চা দেখলেই মনে পড়ে আলিম ভাইয়ের কথা।


২০০৮ সালের আগস্ট মাসে যখন সিআরটিপি কোর্সে ভর্তি হই, দেখে খুব মজা লাগে যে আমাদের বাংলাদেশীদের দেয়া হয়েছে এক ক্লাসে আর সমস্ত পাকিস্তানীদের দেয়া হয়েছে অন্য ক্লাসে! যেন ওরা জানে যে আমরা একসাথে থাকাটা বিপজ্জনক! আমাদের চাকরী খুঁজে দেয়ার দায়িত্বে ছিল সুজান। সুজানের গ্রুপে আবার আমি ছাড়া আর কোন বাংলাদেশী ছিলোনা। সত্যি বলতে আমার চাইনিজ বান্ধবী জেনী আর আলজেরিয়ান বন্ধু সামির ছাড়া আর প্রায় সবাই ছিল অন্য ক্লাসের। স্বাভাবিকভাবেই প্রায় সব পাকিস্তানীদের সাথে আমাদের দেখা হত সুজানের সাথে গ্রুপ মিটিংয়ে।


একদিনের কথা মনে পড়ে। আমি আর জেনী দেরী করে মিটিংয়ে পৌঁছে দেখি সব চেয়ার দখল হয়ে গিয়েছে। এক পাকিস্তানী ভাই, বয়সে আমার বড়ই হবেন, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনি বসুন”। আমি একটু অবাক হলাম, সারাজীবন জেনে এসেছি ওদের সাথে আমাদের জন্মজন্মান্তরের শত্রুতা! একটু পরে হিসেব করে দেখা গেল একজন শর্ট। তখন জানলাম যিনি আসেননি তাঁর নাম আলিম শওকত। পরদিন তাঁর সাথে সাড়ম্বরে পরিচয় হোল, তিনি কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছেন এবং খুশী হয়ে শুধু নিজের ক্লাসের জন্যই নয়, উভয় ক্লাসের জন্য ভারী মজার মিষ্টি নিয়ে এসেছেন!


পরে দেখা গেল সুজান আমার আর আলিম ভাইয়ের জন্য একই জায়গায় চাকরীর ব্যাবস্থা করছে। যেদিন ইন্টারভিউ তার আগেরদিন আলিম ভাই এসে বললেন, “চল, জায়গাটা চিনে আসি”। আমার জন্যও ভালো হোল। একা একা ডাউন্টাউনে ঘুরে ঠিকানা বের করার ঝক্কি পোহাতে হোলনা। হাঁটতে হাঁটতে উনি মোটামুটি ওনার চৌদ্দগুষ্টির ইতিহাস বলে ফেললেন, এমনকি নামাজে গাফলতি করার কারণে বৌয়ের কাছে বকা খাওয়ার কাহিনী পর্যন্ত! বুঝলাম উনি পাঞ্জাবী হলেও খুব সরল মনের অধিকারী।


ইন্টারভিউ ওনার ছিল সকালে আর আমার বিকেলে, দু’জনেরই চাকরী হয়ে গেল দু’মাসের জন্য। এখানে এটা খুব মজার ব্যাপার। একসপ্তাহ বা একদিনের জন্যও চাকরী হয়!


যেদিন থেকে যেতে হবে, উনি যোগাযোগ করে ঠিক করলেন আমরা একসাথে হাজিরা দেব। অফিসে গিয়ে দেখলাম আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে পাশাপাশি ডেস্কে। উনি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অবস্থানে, সেকেন্ড ইন কমান্ড রোজিটার পাশে আর আমি একেবারে বস কোরিনের দরজার সামনাসামনি। আমার ডেস্ক হোল তিনরাস্তার মোড়ে, যেই যায় ‘হাই’ বলে যায় আর আমি হাই তুলতে তুলতে ‘হাই, হাই’ করতে থাকি। আলিম ভাই বললেন, “তুমি চা খাওয়ার অভ্যাস কর”। অফিসে চা কফি সবার জন্য ফ্রি। পুদিনা, আর্ল গ্রে, হার্বাল, রেড লেবেল, ইয়েলো লেবেল কত রকম যে লেবেল! চিনিও আছে, স্যাকারিনও আছে, দুধ তো আছেই। নেই যা তা হোল অভ্যাস। চা-কফি জীবনে মজা লাগলোনা। কতগুলো গরম গরম পানিতে দুধচিনি মিলিয়ে গলা মুখ জিহ্বা পুড়িয়ে মানুষ কি মজা পায় কোনদিন বুঝলাম না। দশ এগার বছর বয়সে কালেভদ্রে ঠান্ডা করে চা খেতাম বটে কিন্তু যেদিন টের পেলাম এক কাপ চায়ে পাঁচ চামচ চিনি দিয়েও আমার মিষ্টি লাগছেনা সেদিন থেকে সব ছেড়ে দিয়েছি।


কিন্তু আলিম ভাই ছাড়ার পাত্র নন। উনি কিছুতেই একা চা খেতে যাবেন না। তাই ওনাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য হোক বা আমার বসতে বসতে ক্লান্ত হাড়গুলোকে জাগিয়ে তোলার জন্য হোক, টিরুমে যাওয়াই হত। আর গেলেই উনি চা বানাতেন দুই কাপ। এতরকম দুধ চিনি চাপাতা থাকতে উনি বাসা থেকে ওনার নিজস্ব পছন্দের দুধ চিনি চাপাতা নিয়ে আসতেন। “খাও, খাও, তোমার ঘুম কেটে যাবে”, বলে বলে চা খাওয়াতেন প্রায় জোর করে। আমি মনে মনে বলতাম, “আহারে, আইআইইউসি’র শাহীন, নাজমুন কতবার টেবিলের ওপর চা রেখে গিয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে, ম্যাডাম খায় কি’না দেখি- কত চা ফেলে দেয়া হয়েছে আমার টেবিল থেকে! এখানে এসেও আবার সেই পরীক্ষা! কি আছে এই চায়ে?”


আলিম ভাই আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। ক্যানাডায় সবাই নিজের কাজ নিজে করে। একসময় শাহীন নাজমুন সব ফটোকপি করে এনে দিত, তখন ভেবেও দেখিনি কিভাবে কি করতে হয়। আর এখানে আমার ফটোকপি কে করে দেবে? উনি শিখিয়ে দিলেন কিভাবে ফটোকপি করতে হয়। আমি খুব দ্রুত কাজ করি। কিন্তু ক্যানাডিয়ানরা কাজ করে আস্তেধীরে রয়েসয়ে- কতক্ষণ গল্প করে, কতক্ষণ নেটে চ্যাট করে, নেটসার্ফিং করে- অফিসে অর্ধেক সময়ের বেশী কাজ করেনা, তাই কেউ বেশী কাজ করলে সে তাদের চক্ষুশূল হয়ে যায়। উনি আমাকে শেখালেন কিভাবে কাজ শেষ হয়ে গেলেও ধৈর্য্য ধরে বসে সময় কাটাতে হবে। আর যেটা শেখালেন সেটা হোল ‘ডিপ্লোমেসি’ যেটা আমার একেবারেই নেই।


আমার সরাসরি কথাগুলোকে উনি আবার মেজেঘসে সহনীয় করে তুলতেন। যেমন, একবার আমাদের কোম্পানীর আরেক শাখার অফিস থেকে এক মহিলা কিছু সময়ের জন্য আমাদের ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে এলেন। ক্রীস্টমাসের কয়েকদিন আগে উনি খুব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, “তা তোমরা ক্রীস্টমাসের জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছ?” আমি জানতাম এদের অন্যান্য ধর্ম এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রায় কোন ধারণাই নেই। বললাম, “আমরা তো ক্রীস্টমাস করিনা!” মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “তোমরা কি ক্রীস্টমাস একটুও করনা?” আমি বলতে যাচ্ছিলাম, “তোমরা কি ঈদ একটুও করনা?” তার আগেই আলিম ভাই বললেন, “হ্যাঁ, আমরা একটু একটু করি। রেহনুমা চল, আমাদের ক্রীস্টমাসের শপিং করতে হবে!”


আরেকদিন ট্রেন স্টেশনে যেতে যেতে দেখি এক মহিলা কুকুর কোলে নিয়ে, কুকুরের দিকে তাকিয়ে একহাতে তাকে আদর করতে করতে গাড়ী চালাচ্ছে। আহ্লাদের সীমা নেই! মানুষ চাকার নীচে পড়বে মাথাব্যাথা নেই, কুকুরের দিকে তাকিয়ে গাড়ী চালায়! আলিম ভাইকে দেখালাম, উনি বললেন, “কুত্তা মাত বোলনা, উয়ো তো উসকা বাচ্চা হ্যায়!” (কুকুর বোলনা, ওটা তো ওর সন্তান!)


নতুন বাবা হবার উচ্ছাস কাছে থেকে দেখেছি আলিম ভাইয়ের মধ্যে, “আজ আমার মেয়ে হেসেছে, আজ সারারাত ও কেঁদেছে আর আমি ওকে কোলে নিয়ে হেঁটেছি, ওর মা কি করে? আমিই তো আমার মেয়েকে দেখি!” নতুন মাদের কথা প্রায়ই শোনা যায়, তারা কিভাবে উচ্ছসিত, উত্তেজিত, পুলকিত হয়। বাবাদের অনুভূতিটা থাকে অনেকটা আগোচরে। তাই ওনার মেয়ে নিয়ে এই আদিখ্যেতা আমার খুব মজা লাগত।


ওনার সাথে প্রায় সকালে ট্রেনেই দেখা হয়ে যেত যেমন হত বাংলাদেশী দুই বন্ধু তানজীন আর ইফতেখার ভাইয়ের সাথে অথবা বাল্যবন্ধু তিথির সাথে। ফেরার সময় আমরা একসাথেই স্টেশনে যেতাম, সাথে নিয়ে নিতাম তিথিকে। মজার ব্যাপার হোল, তিথি আর আমি একই বিল্ডিংয়ের দুই টাওয়ারে কাজ করতাম। একবার ও আমাকে খাওয়াতে নিয়ে গেল লাঞ্চের সময়। আলিম ভাই কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, “আমি তোমার জন্য স্টেশনে যাবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করি আর তুমি আমাকে বাদ দিয়ে বান্ধবীর দাওয়াত খেতে যাও!” সিআরটিপির ইরানী বন্ধু আফশীন আর চাইনীজ বান্ধবী জেনী আমাদের কোম্পানী অ্যাল্টাগ্যাসে জয়েন করার পর থেকে চারজনে মিলে লাঞ্চ করার মজাটাই ছিল আলাদা। তাই তিথির সাথে মূলত বেরোবার পথে একত্রে যাওয়া হত। অনেক সময় ট্রেনে দু’জনে গল্প করতে করতে ভুলেই যেতাম আমার স্টপ তিথি আর আলিম ভাইয়ের দুই স্টেশন আগে। আলিম ভাই ডাক দিয়ে বলতেন, “তোমাদের দুই বান্ধবীর কি গল্প শেষ না তুমি আমাদের স্টেশনেই নামবে ঠিক করেছ?”


এখানে সরকার বেকারদের জন্য নানাপ্রকার ব্যাবস্থা রেখেছে। এই ব্যাবস্থার অধীনে আলিম ভাই কিছুদিন পর পর সরকারের কাছে টাকা বা খাবার পেতেন। একবার ৪০ ব্যাগ খাবার পেয়ে তিনি বিপদে পড়ে গেলেন, দু’জন মিলে এত খাবার শেষ করবেন কি করে? ব্যাস, পরদিন ব্যাগ ভরে আলু আর ম্যাকারনি নিয়ে এলেন আমার জন্য! কি মুস্কিল বলুন তো! অফিস থেকে বাসায় যাব দুই বস্তা খাবার নিয়ে! পরে বেচারা নিজে স্টেশন পর্যন্ত বস্তাগুলো বহন করে দিলেন। তবুও খাবারগুলো কারো কাজে লাগুক।


এভাবে কখন যে দু’মাস কেটে গেল টেরই পেলাম না। শেষদিন আমাদের গ্রুপের ঈজিপ্সিয়ান ছেলে খালিদ সবাইকে উপহার দিল, আমাকে যে কাজ শিখিয়েছিলেন সে বৃদ্ধ ওয়েন আমাদের কফি খাওয়াতে নিয়ে গেলেন, আর কোরিন যখন আমাকে জড়িয়ে ধরল তখন আলিম ভাই আতংকে পিছিয়ে গিয়েও রক্ষা পেলেন না। আমাকে ছেড়ে সে বিশালদেহী বয়স্কা বস যখন ওনাকে জড়িয়ে ধরল তখন ওনার চেহারাটা হয়েছিল দেখার মত! আমার হাতটা নিশপিশ করছিল একটা ক্যামেরার জন্য।


তবে সেই শেষমূহূর্তে উনি ঠিক করলেন শেষ একবার অফিসে বসে চা খেতে হবে! আমি গোঙ্গাতে শুরু করলাম, “না্…”। কিন্তু কোন কাজ হলনা। তিনি খুব যত্নসহকারে চা বানালেন, বাকী চায়ের সরঞ্জামাদি অফিসে দান করে দিলেন, তারপর খুব উপভোগ করে চা পান করতে শুরু করলেন। ততদিনে আমি চায়ের ওপর তিক্তবিরক্ত। বেচারা অন্যদিকে ফিরে কথা বলার সময় কায়দা করে অর্ধেক কাপ চা বিসমিল্লাহ বলে দিলাম সিঙ্কে ঢেলে!


কিন্তু এখন যেখানেই চা দেখি, আলিম ভাইয়ের কথা মনে হয়, ওনার আন্তরিকতার কথা মনে হয়। আমি পছন্দ না করতে পারি, কিন্তু চা জিনিসটা মনে হয় আসলে এত খারাপ না!

1 comment: