Thursday, November 25, 2010

ভয়

আমি সচরাচর ভয় পাইনা। তবে একবার সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম। ঐ ঘটনার কথা মনে হলে আমার এখনো বুক কেঁপে ওঠে।

আমার প্রথম সন্তানের সময় পুরুষ ডাক্তারের কাছে আল্ট্রাসাউন্ড করবনা বলে শেষমূহূর্তে ঢাকা গিয়েছিলাম সবার আদেশ অনুরোধ উপেক্ষা করে। দ্বিতীয়বার ডাক্তার বান্ধবী নাহিদ আপা জানালেন চট্টগ্রামে তাঁর পরিচিতা এক সনোলজিস্ট আছেন, তাঁর সাথে দেখা করতে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাঁর নামও রেহনুমা! নিজের নামে আরেকজনকে ডাকতে কেমন লাগে সে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। তবে এবারে কিভাবে যেন আমার মিতার সাথে ভীষণ মিতালী হয়ে গেল। তাঁর যেকোন সমস্যা বা প্রয়োজনের কথা তিনি আমাকে জানাতেন, আমিও তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারতাম আমার যেকোন সমস্যার কথা।

একদিন রেহনুমা আপার কাছে গিয়েছি এক বান্ধবীকে সাথে নিয়ে। কথায় কথায় বান্ধবী বল্ল, “আমার বুয়ার কিছুদিন যাবৎ গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হচ্ছে। আগে কোনদিন হয়নি তাই ভেবেছিলাম কয়েকদিন ওষুধ খেলে সেরে যাবে। কিন্তু কিছুতেই ভালো হচ্ছেনা। আপনি কি মনে করেন ওর একটা আল্ট্রাসাউন্ড করে দেখা দরকার ভেতরে কি অবস্থা?” রেহনুমা আপা বললেন, “আমি আপাতত ফ্রি আছি, যদি তাকে তাড়াতাড়ি আনতে পারেন তবে দেখে দিতে পারি”। বুয়া কাছেই ছিল। তাঁকে নিয়ে এসে পরীক্ষা করতে করতে বান্ধবী চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল, আমি রেহনুমা আপার পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। হঠাৎ স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আমাদের দু’জনেরই কথা বন্ধ হয়ে গেল! আমার হাতপা কাঁপতে শুরু করল। রেহনুমা আপা ডাক্তার হয়েও ভড়কে গেলেন। উনি কোনক্রমে সনোগ্রাম শেষ করে বুয়াকে রুমের বাইরে চলে যেতে বললেন। বান্ধবী আমাদের চেহারা দেখে আন্দাজ করল কিছু একটা গুরুতর সমস্যা হয়েছে। রেহনুমা আপা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বুয়ার স্বামী এসেছে কতদিন হোল?”
বান্ধবী বল্ল, “বুয়া তো বিধবা, ৪৫ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে তাই আর বিয়ে করেনি”।
রেহনুমা আপা এবার আমার দিকে তাকালেন। উভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শেষে যথাসম্ভব নরমভাবে বান্ধবীকে বললাম, “তোমার বুয়া প্রেগন্যান্ট”।
সে প্রথমে হেসে ফেল্ল। তারপর আমাদের উভয়ের দিকে তাকিয়ে যখন বুঝতে পারল আমরা ঠাট্টা করছিনা, সে কোনক্রমে চেয়ারের হাতল ধরে ধপ করে বসে পড়লো। আমি গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত দিতেই সে উদ্ভ্রান্তের মত বলতে শুরু করল, “এই মহিলাকে আমি মায়ের মত বিশ্বাস করেছি… আমার সবচেয়ে দামী জিনিস, আমার সন্তান, আমি তার হাতে দিয়ে কাজে আসি… কোনদিকে তার সুবিধা বা টাকাপয়সার কোন ঘাটতি রাখিনি… ড্রাইভার তো সারাদিন আমার সাথে থাকে… তাহলে কি সে আমার অনপস্থিতিতে…” রেহনুমা আপার চেম্বারে যদি বান্ধবীর প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয় তাহলে কি হবে ভেবে আপাকে বললাম, “তাড়াতাড়ি সনোগ্রাম আমার হাতে দিন। আমি পরে ওকে বুঝিয়ে দেব। আপাতত আমাদের এখান থেকে দ্রুত সরে পড়া দরকার”। রেহনুমা আপা খুব দুঃখী মন নিয়ে রিপোর্টটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন।

বান্ধবীকে বাসায় যেতে দিলে কি হতে পারে ভেবে আমার ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ কথা বললাম যতক্ষণ না তাকে কিছুটা প্রকৃতিস্থ মনে হোল। সে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার বলতে লাগল, “একজন বয়স্কা মহিলা… আমি তাকে মায়ের মত বিশ্বাস করেছি… আমার সন্তান তার কাছে রেখে আমি কাজে আসতাম… সে কাকে ঘরে এনেছে… সে লোক যদি আমার সন্তানের কোন ক্ষতি করত… এমন মহিলার হাতে আমি কি করে আমার সন্তানকে রেখে এলাম…”।

পরে তাকে বললাম ভাইয়াকে বলতে যেন তিনি আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘরে আসেন। তারপর ওকে বাসায় দিয়ে আমি বাড়ী ফিরে গেলাম।

বান্ধবী মহিলাকে অনেক বোঝানোর পর মহিলা স্বীকার করলেন আরেক বাসায় ষোল বছর বয়সী কাজের ছেলে এই সন্তানের বাবা। ঐ বাসার লোকজনের সাথে কথা বলে সাব্যাস্ত হোল এদের বিয়ে দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দেয়া হবে। বান্ধবী কাজ থেকে ছুটি নিল আরেকজন বুয়া না পাওয়া পর্যন্ত।

এটা হয়ত একরকম সমাধান হোল। কিন্তু আমি বুঝে পাইনা, একজন মানুষ কি করে এমন কাউকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে বিশ্বাস করতে পারে যে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটাকে পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে নারাজ?

পরেরবার রেহনুমা আপার চেম্বারে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে কথা উঠলো। উনি তখন জানালেন কলেজ ইউনিভার্সিটি, এমনকি স্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও এখন তাঁর চেম্বারে এসে আবিষ্কার করে যে যদিও তাদের বিয়ে হয়নি তারা কিভাবে যেন মা হয়ে গিয়েছে! কিন্তু এত বয়সী একজন এমন কাজ করতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, একবার এক মেয়ে তাঁকে বারবার বলতে লাগল, “বিশ্বাস করুন, আমি কোনকিছু করিনি। এসব কি করে হোল আমি কিছুই জানিনা”। একপর্যায়ে তিনি বিরক্ত হয়ে বলে বসলেন, “তবে কি তুমি নিজেকে মাদার মেরী প্রমাণ করতে চাও?” তখন মেয়েটির প্রেগন্যান্সি সাতমাস পেরিয়েছে। সে যদি এ দায় থেকে বাঁচার জন্য উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে তাহলে মারাও যেতে পারে। তাই তিনি মেয়েটির বাবামাকে খবর দিতে বাধ্য হলেন। বাবামায়ের অগোচরে এরা যে কি কি করে বেড়ায় তা যদি বাবামা জানতেন তাহলে তাঁদের এত কষ্টের রোজগার, সন্তানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, বিত্তবৈভব সব অর্থহীন বিস্বাদ মনে হত। কি করে পারে একজন মেয়ে তার বাবামায়ের কষ্ট, অবদান, ভালোবাসা, বিশ্বাস, সম্মান সব ধুলায় লুটিয়ে এমন একটা ছেলেকে বিশ্বাস করতে যার এতটুকু মেরুদন্ড নেই যে সে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে মেয়েটিকে আপন করে নেবে? একজন বোন কি করে ভুলে যায় তার ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্ব যারা তাকে ভালোবাসে, আদর্শ হিসেবে দেখে? একজন ছাত্রী কি করে তার জীবনের পরম বন্ধু লেখাপড়ার হাত ছেড়ে এমন একজনের হাত ধরে যার নিজের লেখাপড়ার প্রতি, জীবনে কিছু করার প্রতি, তার দায়িত্ব নেবার প্রতি কোন আকর্ষণ নেই? দায়িত্ব নেই কিন্তু প্রাপ্তি আছে, এ’ কেমন ভালোবাসা?

পেপারে যখন পড়ি “সুন্দরী অমুক বলেছে তমুক তাকে ফুসলিয়ে সন্তানের মা বানিয়েছে কিন্তু এখন সন্তানকে স্বীকৃতি দিচ্ছেনা্‌”, তখন দুঃখও লাগে, হাসিও পায়। সে যদি ধর্ষিতা হত তার জন্য সহমর্মিতা এবং বেদনা ব্যাতীত আর কিছুই অনুভব করা কঠিন হত। কিন্তু যে বলে তাকে ঠকানো হয়েছে, তার যদি এতটুকু বুদ্ধি থাকে যে সে বাড়ীর সকলকে ধোঁকা দিয়ে এমন এক ব্যাক্তির সাথে মিলিত হতে পারে যে সর্বসমক্ষে তার সাথে চলাফেরা করতে অনিচ্ছুক, তবে এটা কি করে সম্ভব যে সে বোঝেনা এই ধরণের একটা লোক কখনোই তার সন্তানকে স্বীকৃতি দেবেনা?

মেরী স্টোপ্সে এক আত্মীয়া কাজ করতেন। তাই বাচ্চাদের টিকা দেয়ার জন্য ওখানে নিয়ে যেতাম। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “খালা, এতগুলো ছোটছোট মেয়ে এখানে কি করে? ওদের তো বাচ্চাও দেখছিনা যে বাচ্চাকে টিকা দিতে এনেছে!” উনি কিচ্ছু না বলে আমাকে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বের করে দিলেন। পরে জেনেছি এই ছোটছোট মেয়েগুলো তাদের প্রেমের খেসারত দিতে এসেছে। তাদের বাবামা জানে তারা কলেজ, ইউনিভার্সিটি বা স্কুলে। কোন কোন ক্ষেত্রে মা নিজেই নিয়ে এসেছেন মেয়েকে। কারো কারো সাথে বয়ফ্রেন্ড। তারপর আবার কিছুদিন পর একই কাহিনীর পুণরাবৃত্তি।

আমি সবসময় বলতাম, “সব মেয়েরা যেমন চায় তাদের বর প্রিন্সের মত দেখতে হবে, আমি কিন্তু চাইনা। কারণ আমি নিজে দেখতে প্রিন্সেসের মত নই। কিন্তু আমি এমন লোকের সাথে থাকার কল্পনাও করতে পারিনা যে আমি আসা পর্যন্ত আমার জন্য অপেক্ষা না করে এখানে সেখানে সৌখিন প্রেম করে বেড়িয়েছে। আমি চাই যে সততা সে আমার কাছে আশা করে, সে সততা যেন আমিও তার কাছে পাই”।

কিন্তু উপরোক্ত অবস্থা দেখে একদিকে মনে হয়, “হায় আল্লাহ, আমি কার কাছে মেয়ে বিয়ে দেব? আমি কি তবে আমার এত আদরযত্নে বড় করা কন্যাকে কোন লম্পটের হাতেই তুলে দিতে বাধ্য হব? কোন্ মেয়েকে আমি আমার পুত্রবধু করে আনব?” আরেকদিকে মনে হয়, সমাজের অগণিত গুণী এবং কৃতী বাবামা তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েও সঠিকপথে পরিচালিত করতে পারছেন না এই সমাজে যেখানে টিভি, সিনেমা, মোবাইল, পত্রিকা মায় অ্যাডভার্টাইজমেন্টগুলো পর্যন্ত আমাদের সন্তানদের বিপথগামী করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই লাম্পট্যের জোয়ারে ভেসে যাওয়া সমাজে আমি আমার দু’টি সন্তানকে কি করে রক্ষা করব?

আমার ছাত্রছাত্রী, যাদের সন্তানস্নেহে লালন করার পেশা এবং নেশা আমাকে উজ্জীবিত করে, তাদেরই এক এক সময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করলাম- যখন ইনভিজিলেশনের ফাঁকে কেন্টাকী ফ্রাইড চিকেনে ম্যাডামদের সবাইকে একসাথে দেখে ওরা বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালিয়ে যেত, যখন আমার স্যারের বাসায় কার্ড পৌঁছতে গিয়ে অন্ধকার সিঁড়িতে ছাত্রীকে বয়ফ্রেন্ডের থেকে ছিটকে সরে যেতে দেখতাম, যখন ওয়ার সেমেট্রিতে আমার মেয়েকে ফুল দেখাতে নিয়ে গিয়ে দেখতাম কিভাবে ওরা একটা কবরস্থানকে পর্যত্ন রেহাই দিচ্ছেনা, যখন আমাদের বাইকে চড়ে বাড়ী ফেরার পথে কোন বন্ধুর ডাক শুনে পেছনে তাকাতে গিয়ে চোখ পড়ে যেত পেছনের রিক্সায় জড়াজড়ি করে বসা ছাত্রছাত্রীদের হতভম্ব চোখে…। যাকে সন্তানের মত ভালোবাসি তার প্রতি বিশ্বাসভঙ্গের বেদনা হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত করে তোলে। কাকে বিশ্বাস করব আমি? আর কেনইবা তাকে অবিশ্বাস করব যাকে আমি মনে মনে নিষ্পাপ ভেবে এসেছি?

মাঝে মাঝে মনে হয়, আসলেই এ’ যুগে ঈমান ধরে রাখা হাতে জ্বলন্ত কয়লা ধরে রাখার চেয়েও কঠিন!

No comments:

Post a Comment