Sunday, December 9, 2012

আমি এখন রিক্সা চালাই...

ছোটবেলায় একবার বাবা আর আমি রিক্সায় হাওয়া খেতে খেতে ধানমন্ডী থেকে মগবাজার ফিরছিলাম। তখন অনেক রাত। তবে ঢাকা তখনো অনেক নিরাপদ এবং যানজটমুক্ত নগরী। পাশে একটা খালি রিক্সা প্লেনের পাইলট হবার সংকল্প নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিলেন এক রিক্সাওয়ালা ভাই। যেতে যেতে গাইছিলেন তখনকার ভারী জনপ্রিয় এক গান, “অহন আমি রিস্কা চালাই ঢাকা শহরে, ও সখিনা গেসস কিনা ভুইল্লা আমারে!” কি করুণ সত্যতা!

ক’দিন আগে বিদেশে অবস্থানরত আমার এক বান্ধবীর ননদের বিয়ে হোল। ঘটকালীতে ওর কিঞ্চিত হাত ছিল এবং একমাত্র ভাই হিসেবে বিয়ের ব্যাবস্থাপনা এবং ফাইন্যান্সিংয়ে ওর স্বামীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা এই বিয়ের স্বপ্ন দেখেছে ওরা বছরের পর বছর। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা এই যে বিয়ের খরচ এবং দেশে যাওয়া আসার খরচ হিসেব করে ওদের পক্ষে বিয়েতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ঐ রিক্সাওয়ালা ভাই যেভাবে ঢাকার সাথে তাঁর গ্রামের বাড়ীর দুরত্ব ঘুচাতে পারেননি, ঠিক একইভাবে আমরা প্রবাসীরাও আটকা পড়ে গেছি দেশ আর বিদেশের টানাপোড়নের মাঝে।

এই কঠিন বাস্তবতার আরেকটি দিক হোল, গ্রামের মানুষ যেমন ভাবে ঢাকা শহরে টাকা বাতাসে ওড়ে, বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনের ব্যাপারেও দেশে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনের ধারণা এর আরেকটু স্ফীত সংস্করণ। প্রবাসী মাত্রই জানেন নিজের ন্যূনতম প্রয়োজনের অতিরিক্ত সকল টাকা দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রিয় মানুষগুলো যেন ভালো থাকে এই আশায়। এ’কারণে মন খারাপ থাকলেও ব্যায়সংকোচন করতে হয়, দেশের জন্য প্রাণ কাঁদলেও নিজেকে প্রবোধ দিতে হয়, কারো জন্য মন খারাপ হলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কঠোরভাবে। কিন্তু এই কষ্ট বলাও যায়না তারা বিচলিত হবেন ভেবে। অপরদিকে কারো কান্না, কারো অভিমানের সুর, কারো রাগ, কারো বা এই ধারণা, “ওর তো ব্যাঙ্কে কারি কারি টাকা, কিপটামীর জন্য খরচ করতে পারেনা!”- এই কষ্ট বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। সবই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই নিদারুন ভালোবাসা যে কত কষ্টকর!

যাদের বিদেশে আত্মীয়স্বজন আছেন তাদের অনুরোধ, আপনারা তো সবাই একসাথে আছেন, বিপদে আপদে সুখে অসুখে- বিদেশে একাকী যে মানুষগুলো প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে বিলিয়ে দেয় আপনাদের সুখের জন্য, তাদের জন্য কিছু করতে না পারলেও অন্তত আহ্লাদ বা ধারণা করে তাদের দুঃখ বাড়াবেন না। দেশে থেকে তাদের জন্য আর কিছু পাঠাতে না পারলেও অন্তত তাদের জন্য একটু সহমর্মিতা আর মায়া জমা করে রাখুন যেন আগামীবার যখন তারা ফোন করেন, তখন অভিযোগ অনুযোগে আপনাদের মনের কষ্ট তুলে না ধরে সেই মায়া দিয়ে তাদের মনের কষ্ট দূর করে দিতে পারেন। দুরের মানুষটির জন্য এটিই হতে পারে শ্রেষ্ঠ উপহার!


উৎসর্গঃ দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত সকল প্রবাসী ভাইবোনদের...

No comments:

Post a Comment