Sunday, December 9, 2012

আবার ডাইনোসর যুগে

বহুদিন পর আবার ড্রামহেলারের পথে রওয়ানা হলাম, রয়াল টিরেল মিউজিয়ামে (Royal Tyrell Museum) ডাইনোসরদের সাথে সাক্ষাত করতে। গতবার যখন গেলাম (ডাইনোসর যুগে ঘুরে এলাম) সেবার সাথে ক্যামেরা ছিলোনা, তাই গিয়ে আফসোসের সীমা ছিলোনা। এবার তাই সাবধান ছিলাম যেন ভুলটার পুণরাবৃত্তি না হয়। হাফিজ সাহেব, রাদিয়া আর আমি মিলে শ তিনেক ছবি তো তুলেছিই। তন্মধ্যে মাত্র ক’খানা ছবির মাধ্যমে ব্লগ বন্ধুদের মাঝে যারা ডাইনোসরদের নিয়ে ততটাই আগ্রহী যতটা আমরা, তাদের জন্য অভিজ্ঞতাটার যতটুকু আমার ভাষা এবং স্মরনশক্তিতে কুলোয় তা শেয়ার করলাম।




এখন গ্রীষ্মকাল, তাই চাষীরা সামান্য যে ক’মাস আবহাওয়া ভাল থাকে তার সুযোগ নিয়ে নানাপ্রকার চাষবাস করছে- সবই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কারণ কয়েকশ একর জমিতে হয়ত একটি পরিবারই বসবাস করে। তাদের জন্য রয়েছে সরকারের সর্বৈব সহযোগিতা, নিরাপত্তা ব্যাবস্থা এবং তাদের সন্তানদের অত্যাধুনিক স্কুলে পড়াশোনা নিশ্চিত করার সুপরিকল্পিত পন্থা। রাস্তা ভাল হওয়ায় ক্যাল্গেরী থেকে ড্রামহেলারের ১৩০ কিমি পথ আমরা গেলাম মাত্র দুই ঘন্টায়। গাড়ীর জানালা থেকে ক্যানোলা (একপ্রকার সরিষা) ক্ষেতগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ আর হলুদে মাখামাখি এক আরামপ্রদ চাদর!




দিগন্তজোড়া সরিষা ক্ষেতের সৌন্দর্য্যের মায়া কাটিয়ে এসে পৌঁছলাম রুক্ষ পাহাড়শ্রেণীর মাঝে। এগুলো একসময় নিরক্ষীয় বনাঞ্চল ছিল, ছিল ডাইনোসরদের নিরাপদ চারণভূমি। তারপর হঠাৎ একদিন আচমকা আকাশ থেকে ছুটে আসা এক উল্কাপিণ্ড সব তছনছ করে দিল, উল্কার আঘাতে পৃথিবী তাঁর অক্ষ থেকে বিচ্যূত হয়ে গেল, পৃথিবীর সব আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ একসাথে বিস্ফোরিত হোল, পৃথিবীর আকাশ ছেয়ে গেল ছাই আর ভস্মে, আর তার মাঝে বিলীন হয়ে গেল পৃথিবীর ৫০% প্রাণের অস্তিত্ব। অতিকায় ডাইনোসরদের অস্তিত্বের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেল এই পাহাড়গুলোতে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত কিছু ফসিল। আশেপাশের পাহাড়শ্রেণী থেকে প্রাপ্ত ফসিলগুলো নিয়ে এসে জড়ো করা হোল এর মধ্যস্থলে অবস্থিত এই রয়াল টিরেল মিউজিয়ামে।




প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে আজ ছুটির দিন না হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর লোক এসেছে মিউজিয়ামে, অধিকাংশই তারা যাদের সাথে সন্তান বা শিক্ষার্থী রয়েছে। টিকেটের দাম অল্প হওয়ায় সপরিবারেই এসেছে বড় বড় গ্রুপ, যেমন আমরা। ড্রামহেলার শহরে প্রবেশ করার পর থেকেই পথের দু’ধারে বড় বড় ডাইনোসর মডেল দেখতে পাওয়া যায়, যেমন মিউজিয়ামের প্রবেশপথে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে এই প্যাকিরাইনোসরাস এবং এর পরিবারের মডেল।







এই গেটটি দেখলে টাইম মেশিনের কথা মনে হয়। যেন আদিযুগের পর্যায়গুলো যেমন দেয়া আছে তেমনি পছন্দমত সুইচ টিপে চলে যাওয়া যাবে ঐ যুগে, দেখে আসা যাবে তখনকার বাসিন্দাদের।




আর এরাই তাঁরা যাদের বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলশ্রুতিতে আমরা আজ ডাইনোসরদের স্বরূপ দেখতে পাচ্ছি বা অন্তত এ’সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পারছি। একটি ফসিলের ব্যাপারে পড়লাম একদল বিজ্ঞানী (পেলিওন্টোলজিস্ট) তীব্র গরমে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে গিয়েও ২১ দিন প্রচন্ড পরিশ্রমের পর একে একটি কয়লাক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করতে সক্ষম হন। এটিকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার মত অবস্থায় উপনীত করতে ব্যায় হয় আরো তিনবছর। ছবিতে যে বিজ্ঞানী কাজ করছেন তিনি কাঁচের আড়ালে কাজ করছেন, তবে তিনি কি করছেন তা জানালার বাইরে শুধু নয়, একটি বড় টিভি স্ক্রীণে বড় করে দেখানো হচ্ছে যেন মানুষ এই কাজের ধরন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে পারে।




এটি একটি টাইরেনোসরাসের পায়ের হাড়। এটিকে দৈর্ঘ্য চিহ্নিত করে পাশে একটি প্ল্যাটফর্মে মানুষ দাড়াবার ব্যাবস্থা করে দেয়া হয়েছে যেন আপনি মেপে দেখতে পারেন ওর তুলনায় আপনার উচ্চতা কত। কল্পনা করে দেখুন তো এরা এখন বেঁচে থাকলে আমাদের কি অবস্থা হত!




মিউজিয়ামে ঢুকেই চোখে পড়বে এই অ্যালবার্টোসরাস এবং তার পরিবারের নদী পাড় হবার কাল্পনিক দৃশ্য। হয়ত হঠাৎ নদীতে বন্যা (flashflood) হয়ে পরিবারটি নদীর তলদেশে চাপা পড়ে। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পর একদিন মাটি খুঁড়তে গিয়ে কোন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন তাদের দেহাবশেষ বা পদচিহ্ন। কালের পরিক্রমায় পরিবারটি হয়ে যায় কেবল ফসিল।







ফসিল বা জীবাশ্ম হোল কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর রেখে যাওয়া শেষ চিহ্ন। এতে আসলে প্রাণী বা উদ্ভিদটির দেহাবশেষের কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা। কালক্রমে ঐ প্রাণী বা উদ্ভিদের কোষে কোষে প্রবেশ করে মাটির মধ্যস্থিত খনিজ, দখল করে নেয় এর আকার, আকৃতি বা ছাপ। একেই আমরা ফসিল বলে জানি। চিত্রে দেখা যাচ্ছে নটিলাস নামক বৃহদাকার ঝিনুকের খোলে খনিজ জমে সৃষ্টি হওয়া অদ্ভুত এক প্রাকৃতিক উপাদান যার নাম অ্যামোনাইট, এটি একপ্রকার পাথর যার সৃষ্টি জীবদেহ থেকে!




এই ডাইনোসরটি কোন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে মারা পড়ে। সূর্যের খরতাপে এর দেহখানা অদ্ভুতভাবে বেঁকে যায়, পড়ে হয়ত এর ওপর কাদা চাপা পড়ে বেচারার মরদেহখানা বাঁকানো হতে রক্ষা পায়, কিন্তু সে নিজেই পরিণত হয় পাথরের মাঝে জমে থাকা আরেক পাথরে। এই ফসিলটি ১৯৯০ সালে আবিষ্কৃত হবার পর টোকিওতে উদ্বোধন হয়ে পৃথিবীর নানা দেশ সফর করে এই মিউজিয়ামে এসে ঠাঁই পায়।




স্বাভাবিক অবস্থায় ডাইনোসরদের হাঁটার ভঙ্গি কেমন ছিল তা কিছুটা আন্দাজ করা যায় এই ফসিলটি থেকে।




এটি ট্রাইসেরাটপ্সের মাথার খুলি। এর মাঝে অনায়াসে একটি ছয়বছরের শিশু শুয়ে যেতে পারবে!




জুরাসিক পার্ক (Jurassic Park) মুভি সিরিজের কল্যাণে টাইরেনোসরাস রেক্স এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুপরিচিত ডাইনোসর। মানুষের মত ডাইনোসরদের মাঝেও ভিলেনেরই জয় হোল, হায়! মাংসাশী ডাইনোসরদের মাঝে টাইরেনোসরাস ছিল আকারে সবচেয়ে বড় তাই একে রেক্স বা রাজা উপাধি দেয়া হয়। এখানে একটি পূর্ণবয়স্ক টি রেক্সের মডেল দেয়া হয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার হোল এর পায়ের তুলনায় এর হাত প্রায় অদৃশ্য!




এখানে দু’টি ছোট আকারের ডাইনোসর অরনিথোসরাসের মডেল দেখা যাচ্ছে, ধারণা করা হয় এরা ছিল সবচেয়ে বড় আকারের উড়ুক্কু ডাইনোসর।




ওপরতলা থেকে তৃণভোজী ট্রাইসেরাটপ আর মাংসাশী টাইরেনোসরাসের মাঝে কে বড় বোঝা গেলনা। আপনাদের কি মনে হয়?




এবার নীচের তলায় এসে টাইরেনোসরাস বাবাজীর আরেকখানা ছবি তোলা হোল। এটা কিন্তু মডেল না, আসল কঙ্কালের ফসিল।




এটা আরেক মাংসাশী ডাইনোসর অ্যালোসরাসের কঙ্কাল। সে দৈর্ঘ্যপ্রস্থে টাইরেনোসরাসের অর্ধেক হলেও বুদ্ধিতে ছিল অনেক অগ্রসর, দেখুন সে কিভাবে তার শিকারকে বাগে আনার সংগ্রামে লিপ্ত।







আমার প্রিয় ডাইনোসর স্টেগোসরাস- আপাদমস্তক বর্মে ঢাকা হলেও সে কিন্তু আদতেই নিরীহ, তৃণভোজী প্রাণী, কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই, কিন্তু তাকে ঘাটাতে গেলেই কাঁটাযুক্ত লেজ দিয়ে দেবে এক প্রাণঘাতি বাড়ি!




সেরাটপস পরিবারের ডাইনোসরগুলো দেখতে শিংযুক্ত ভয়ানক হলেও আসলে ছিল খুব শান্তিপ্রিয় তৃনভোজী প্রাণী।




এখানে দুই ডাইমেট্রোডন দুপুর রোদে নিজেদের শীতল করার জন্য পিঠের ওপর লাগানো পাখা দিয়ে বাতাস খাচ্ছে।




কুমিরের পুর্বপুরুষ নাকি?!




পানির নীচে কেমন ছিল তার কল্পিত মডেল তৈরী করেছেন বিজ্ঞানীরা। নানাপ্রকার মোলাস্ক আর পোকাশ্রেণীর প্রাণীই দেখা যাচ্ছে বেশি।







তবে এই মাছটি দেখুন তো! আমার তো মনে হয় এর মাথাটাই খাওয়া যাবে একমাস!




পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইকথিওসরটি পাওয়া গেছে এখানকার চিফ সিকানি নদীতে। তিনবছর চেষ্টা করার পর বিজ্ঞানীরা এর উর্ধ্বাংশের এবং লেজের দিকের অল্প ক’টি হাড় উদ্ধার করতে সক্ষম হন। এখানে কালো দাগ দিয়ে এর প্রকৃত শরীরের সীমারেখা দেখানো হয়েছে। ছবিতে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তা এর শরীরের এক তৃতিয়াংশ মাত্র।




আইস এজ (Ice Age) অ্যানিমেটেড সিরিজের কল্যাণে এখন ম্যামথ মোটামুটি সুপরিচিত প্রাণী তবে তারা এসেছে ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পর (প্লায়োসিন যুগে) এবং বিদায় নিয়েছে বেশ তাড়াতাড়ি। হাতির মত দেখতে হলেও তারা বৈজ্ঞানিকভাবে হাতির আত্মীয়স্বজনের মধ্যে পড়েনা।




ইনি গন্ডারের পুর্বপুরুষ, তখনো বেচারার চামড়া বেশ মোটাই ছিল!




এটা এতদঞ্চলে প্রাপ্ত সেবরটুথ বাঘের কঙ্কাল। বাইরের দাঁতগুলো দেখতে ভয়ানক হলেও ওর মুখের ভেতরের দাঁতগুলো ছিল যাঁতার মত পিষে ফেলার যন্ত্রসদৃশ। একে আইস এজ কার্টুনে ভিলেন হিসেবে দেখা যায় যে পরে ভাল হয়ে যায়। আমরাও যদি এভাবে নিজেকে বদলে ফেলার, ভাল হয়ে যাবার চেষ্টা করতাম বেশ হত।




প্রচন্ড গরমের মাঝেও এই গাছগুলোর মত ছায়াঘন স্নিগ্ধ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে আপনাদের জন্য এই উপহার প্রস্তুত করলাম। আশা করি ভাল লাগবে।

No comments:

Post a Comment