যেবার প্রথম ক্যাল্গেরী আসি (অগাস্ট ২০০৮) তার দু’তিনদিনের ভেতর খবর পাই এখানে একটি ইসলামী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, বক্তাদের মধ্যে Peace TV খ্যাত আব্দুর রাহীম গ্রীন সাহেবও আছেন। খুব ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। কিন্তু তখন নতুন এসেছি, পথঘাট চিনিনা, চাকরী বাকরি হয়নি, টাকাপয়সাও গুনে হিসেব কষে খরচ করতে হচ্ছে। খুব মন খারাপ হলেও এই কথা শুনে আশান্বিত হলাম যে এখানে প্রায়ই এমন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। তারপর একে একে তিনটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, বহু কনফারেন্স এল গেল, কিন্তু নানাবিধ কারণে কোনটাতেই যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কখনো বক্তাদের তালিকা impressive মনে হয়নি, কখনো সময় মিলাতে পারিনি, কখনো বা নিজেদের গাফলতির খেসারত দিয়ে যাওয়া হয়নি।
এবার যখন Power of Unity কনফারেন্সের খবর পেলাম এবং দেখলাম বক্তাদের তালিকায় আছেন ডঃ আবু আমিনা বিলাল ফিলিপস, ইয়াসির ফাজাগার মত পরিচিত মুখ এবং বিখ্যাত Activist, বক্তা এবং লেখক ম্যালকম এক্সের কন্যা অ্যাম্বাসেডর শাবাজ তখন চিন্তা করলাম এবার যে করেই হোক যেতেই হবে। টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল আমাদের মসজিদে, অনলাইনে এবং আরো বহু জায়গায়। ছোটবোন জয়া বলল পরিচিত একজনের মাধ্যমে টিকেট নেবে, ভাবলাম এতে হয়ত টিকেটবিক্রেতার কিছু লাভ হতে পারে, তাই বললাম নিজের জন্য টিকেট নেয়ার সময় আমার জন্য একটা নিয়ে নিতে, আমি টাকা দিয়ে দেব। কিন্তু জয়া চালাকি করে অনলাইনে দু’খানা টিকেট কিনে একখানা আমাকে গিফট করে দিল সাওয়াবের আশায়। আমার কোন প্রতিবাদে কোন কাজ হোলনা।
অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল ক্যানাডা দিবসের ছুটিসহ long weekend কে মাথায় রেখে শুক্রবার (২৯শে জুন) থেকে রবিবার (১লা জুলাই) যেন মঙ্গলবার কাজে ফিরে যাবার আগে সোমবার সবাই বিশ্রাম নিতে পারে। ভেন্যু ছিল তিনটি- আমাদের জুমা মসজিদ (আকরাম জুমা মসজিদ), কোস্ট প্লাজা হোটেল এবং আবু বাকর ইসলামিক সেন্টার। অনুষ্ঠান ছিল দিনব্যাপী। তিনদিনের জন্য টিকেটের শুভেচ্ছামূল্য ছিল মাত্র ২৫ টাকা। একই টিকেটে তিনদিনে যেকোন সময় যেকোন ভেন্যুতে যাওয়া যাবে। খাবার এবং বাচ্চাদের দেখাশোনাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বক্তা ছিলেন চারজন মহিলাসহ মোট একুশজন। বক্তাদের বক্তৃতার বিষয়সহ শিডিউল দেয়া ছিল অনলাইনে যেন শ্রোতারা নিজের পছন্দমত ভেন্যু এবং সময় বেছে নিতে পারেন। পাশাপাশি অনুষ্ঠান হলের বাইরে পাওয়া যাচ্ছিল শিডিউল এবং বক্তাদের পরিচিতি সম্বলিত বুকলেট।
শুক্রবার working day হওয়াতে অনুষ্ঠান হবার কথা ছিল সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। ভাগ্যক্রমে তার আগেরদিন আমার দাদার ছোটভাই- আমার প্রিয় ছোটদাদা, যিনি আমার জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত হবার পেছনে অনেক অবদান রেখেছেন- চারদিনের সফরে আমেরিকা থেকে ক্যাল্গেরী আসছিল। শনি রবি আমি কিছুতেই মিস করবনা তাই দাদাকে উপলক্ষ্য করে প্রায় ২০-২৫ জনকে দাওয়াত দেয়া হোল শুক্রবার রাতে। ঠিক করলাম অনুষ্ঠানে যেতে না পারলেও জুমা কিছুতেই মিস করবনা। দাদা স্বাভাবিক খাবার খেতে পারেনা, তাই বৃহস্পতিবার বাবাকে দিয়ে দাদার জন্য এবং দাওয়াতের জন্য মিলিয়ে তিনখানা আইটেম রান্না করিয়ে রাখলাম। উল্লেখ্য, প্রায় দু’মাস হোল বাবামা আমার বাসায় আছে। আমাদের পরিবারের বৈশিষ্ট্য হোল আমরা শুয়েবসে থাকতে পারিনা, উপরন্তু আমাদের বাসায় নারীপুরুষ সবাই সবধরনের কাজ করতে পারে, তদুপরি বাবার রান্না অসম্ভব মজাদার আর হাফিজ সাহেবের মত বাবাও সবাইকে রেঁধে খাইয়ে প্রশংসা কুড়াতে ভালবাসে, আমি এর সুযোগ নিলাম আর কি! হাফিজ সাহেব দ্বিবিধ মিষ্টি বানালেন- রসগোল্লা আর চমচম। আর শুক্রবার সকালে উঠে আমি বিরিয়ানি চাপিয়ে দিয়ে দ্রুত ঘর গুছিয়ে ফেললাম। দৌড়ের ওপর কাজ শেষ করে হাজির হলাম মসজিদে।
সেদিন ক্যাল্গেরীর সাতটি মসজিদে সাতজন বক্তা খুতবা দিচ্ছিলেন, তন্মধ্যে আমাদের মসজিদে খুতবা দিলেন ডঃ আবু আমিনা বিলাল ফিলিপস। আমাদের মসজিদে প্রতি শুক্রবারেই প্রচুর লোক হয়, অনেক সময় একহাজার লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মসজিদ, মসজিদসংলগ্ন gym সব ভর্তি হয়ে বাইরে রাস্তার ওপরেও লোক দাঁড়াতে হয়- সেদিনও মনে হোল মানুষের ঢল নেমেছে। সৌভাগ্যক্রমে সামনেই জায়গা পেয়ে গেলাম। আমরা দুই রাকাত নামায শেষ করতে না করতেই খুতবার সময় হয়ে এলো। ডঃ ফিলিপস প্রথমেই প্রশ্ন করলেন গত এক সপ্তাহে কে কে কোন না কোন একসময় শুকরিয়া করে সিজদা করেছে। হাত উঠল দশখানা। মহিলারা ওপরতলায় দৃষ্টির আড়ালে তাই এদিকে কি অবস্থা বোঝা গেলনা। তারপর তিনি শুকরিয়ার গুরুত্ব নিয়ে আধঘন্টাখানেক খুতবা দিলেন যার মূল কথা ছিল আমাদের শুকরিয়া আল্লাহর নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ আমাদের মধ্যস্থিত অনেক ব্যাধির মহৌষধ, তাই এই অনুভূতি আমাদের নিজেদের স্বার্থেই জরুরী। কৃতজ্ঞতার সাথে লক্ষ্য করলাম আমার বারো বছর বয়সী কন্যা খুতবা গোগ্রাসে গিলছে যদিও অনেক সময় খুতবার প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য আমার ওকে তাগাদা দিতে হয়।
খুতবার পর জুমার নামায পড়ালেন ডঃ ফিলিপস। বিশুদ্ধ উচ্চারণে চমৎকার ক্বির’আতসহকারে নামায পড়ালেন তিনি। তখন চিন্তা করলাম কত নারীপুরুষ দেখি যারা মাস্টার্স পিএইচডি করে ফেলেছেন অথচ শুদ্ধভাবে কুর’আন পড়তে পারেন না। অন্যদিকে এই ভদ্রলোক যিনি জীবনের বৃহদাংশ ইসলাম সম্পর্কে জানতেন না অথচ ইসলাম গ্রহণ করার সাথে সাথে বিশুদ্ধভাবে কুর’আন পড়তে শিখে গেছেন, এমনকি লোকমুখে শোনার পরিবর্তে নিজেই ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানলাভ করার জন্য তিনি এই বিষয়ে পিএইচডি করে ফেলেন! এ’থেকে বোঝা যায়, কিছু শেখার জন্য সদিচ্ছা এবং অধ্যাবসায়ই যথেষ্ট যদি আমরা তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেই।
এর পর ছিল মুতাহ বীল নামে একজন নও মুসলিমের বক্তৃতা, তাঁর ইসলাম গ্রহণের কারণ নিয়ে। তিনি গায়ক টুপাক শাকুরের Outlaws দলের একজন সদস্য ছিলেন কিন্তু এই জগতের নোংরা দিকগুলো তাঁকে ভাবিয়ে তোলে, তিনি সত্যের অনুসন্ধানে ব্রতী হন এবং এক পর্যায়ে তিনি ইসলামের মাঝে উত্তম আদর্শ খুঁজে পেয়ে এই পথে চলে আসেন। বার বার ছোটভাই মুহাম্মদের শ্বশুরবাড়ী থেকে ফোন আসছিল, দুপুরে সবার দাওয়াত ঐ বাসায়, আমরা ছাড়া আর সবাই উপস্থিত। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বক্তৃতা না শুনে ওখানে হাজিরা দিতে হোল। একমাত্র সান্তনা ছিল ছোটদাদার সাথে চারবছর পর দেখা হওয়া, গল্প করা আর দাওয়াতীর সংখ্যা আরো কিছু বৃদ্ধি পাওয়া। সন্ধ্যায় মেহমান আসার আগেই বাড়তি মেহমানদের জন্য আবার রান্না চড়াতে হবে। তাই আবার ছুট। বাসায় ফেরার পথে আল মদীনা হালাল মিট থেকে মুরগী নিয়ে বাসায় এসেই দিলাম চড়িয়ে আরো এক হাঁড়ি বিরিয়ানী। সন্ধ্যা সাতটা থেকে মেহমান আসতে শুরু করল, সবাই যেতে যেতে রাত সাড়ে বারোটা। বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়ে গেলাম সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সামলে রাখতে কারণ পরদিন বাসায় থাকবনা। সব গুছিয়ে রাত দু’টোয় ভাবলাম এখন ঘুমালে দেড় ঘন্টা পর ফজরের নামায, ক্লান্ত শরীরে হয়ত উঠতে পারব না। তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঘুমালাম চারটায়।
সাড়ে সাতটায় হাফিজ সাহেব night duty থেকে ফিরে জাগাতে চেষ্টা করলে দিলাম এক বকা, ‘অনুষ্ঠান দশটায়, আমি আগে ঘুমাই!’ পৌনে দশটায় বান্ধবী মোনালিসা আপা ফোন করলেন উনি কোস্ট প্লাজা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছেন, আমি যাব কিনা। যাব কি’না মানে?! ওনাকে আসতে বললাম কিন্তু চোখ কিছুতেই খুলে রাখতে পারছিনা, গায়ে মাথায় পানি ঢেলে চোখ থেকে ঘুমের আঠা ছাড়ালাম। দশ মিনিটের ভেতর তৈরী হয়ে ওনার সাথে কনফারেন্স হলে পৌঁছলাম। শনিবার আকরাম জুমা, কোস্ট প্লাজা আর আবু বাকর সেন্টার সব জায়গাতেই অনুষ্ঠান চলছিল। কোস্ট প্লাজা আমার বাসা থেকে দেখা যায়, পাশাপাশি এখানে বক্তৃতার বিষয়গুলোও আমার খুব পছন্দের ছিল। গিয়ে দেখি গতদিন সবাই রাত এগারোটা পর্যন্ত বক্তব্য শুনে সকালে আর আসতে পারেনি। বক্তারা ঘুরাঘুরি করছেন কিন্তু শ্রোতারা অনু্পস্থিত, তাই দশটার পরিবর্তে অনুষ্ঠান শুরু হোল এগারোটায়। অনুষ্ঠানের শুরুতে আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব একটা হাদিস বললেন যার মর্মার্থ হচ্ছে রাসূল (সা) বলতেন সেই অনুষ্ঠানে কোন বরকত হয়না যেখানে শ্রোতারা পরস্পর বাক্যালাপ করতে থাকে। মোনালিসা আপা এবং আমি দু’জনই অত্যন্ত খুশি হলাম এই হাদিসটি পেয়ে কারণ আমাদের জ্ঞানানুসন্ধানমূলক বৈঠকগুলিতে বান্ধবীরা অনেকসময় জ্ঞানের কথা বাদ দিয়ে গল্পগুজবে মেতে ওঠেন। এবার আমাদের হাতে রয়েছে শক্ত দলিল!
অনুষ্ঠান শুরু হোল ক্কারী মুহাম্মাদ আহমাদ ইউসুফের সুললিত কুর’আন পাঠের মাধ্যমে। দেখে ভাল লাগল যে অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু হবার ফলে বক্তাদের বক্তৃতার সময় কমিয়ে দেয়ার পরিবর্তে আয়োজকরা তাদের নিজেদের বক্তৃতা বাদ দিয়ে দিলেন। উপস্থাপক প্রতিটি বক্তাকে আহ্বান জানানোর আগে এবং পরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কুর’আনের একটি আয়াত বা একটি হাদিস বা কোন উক্তি ইত্যাদি দিয়ে অনুষ্ঠানকে গতিশীল এবং উপভোগ্য করে তুলছিলেন। আরো ভাল লাগল দেখে যে বক্তারা একই বক্তৃতায় তাদের তাবৎ জ্ঞানের প্রদর্শনী দিতে তৎপর হবার পরিবর্তে বক্তব্য নির্দিষ্ট বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখেন এবং আয়োজক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি দুই মিনিট অন্তর চিরকুট দিয়ে বিরক্ত করার পরিবর্তে সময় শেষ হবার পাঁচ মিনিট আগে একটি ছোট্ট বাতি জ্বালিয়ে দেন যেন তাঁরা নিজেদের বক্তব্য গুটিয়ে আনতে পারেন।
প্রথম বক্তা হিসেবে মঞ্চে এলেন শাইখ ইয়াসির ফাজাগা। তাঁর বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল, Providing a roadmap for Muslim Community to be actively involved in Social Service. তিনি বলেন আমরা মুসলিমরা যদি আমাদের আদর্শ অন্যের সামনে তুলে ধরতে চাই তাহলে আমাদের বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে involved হতে হবে এবং সমাজের অন্যদের সুবিধা অসুবিধার প্রতি নজর রাখার মাধ্যমে একটি উত্তম উদাহরণ স্থাপন করতে হবে। কার্যত দেখা যায় অধিকাংশ মুসলিম social service বা volunteer service এর মত ক্ষেত্রগুলোতে involved হয়না। ফলে আমাদের ব্যাপারে লোকজনের একটা negative ধারণা জন্মায় যে আমরা শুধু নেয়ার বেলায় আছি, দেয়ার বেলায় নেই। অথচ আমাদেরই তো পরের জন্য করার আদর্শে উজ্জিবীত হয়ে এগিয়ে আসার ঐতিহ্য রয়েছে, তাহলে আমরা কিভাবে এত স্বার্থপর হয়ে গেলাম? তিনি আরো বলেন যে আমরা প্রায়ই ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের পরিবর্তে আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেই যার কারণে অন্যান্য ধর্মের লোকজন দূরে থাক, অন্যান্যা দেশের মুসলিমরাও আমাদের কাছে ভিড়তে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করেনা। যেমন তিনি বললেন বর্তমানে নর্থ আমেরিকার ৬০% মুসলিম স্থানীয়, ৪০% অভিবাসী। কিন্তু নও মুসলিমদের প্রতি অধিকাংশ জন্মগত মুসলিমদের সদাচরনের অভাব তাদের আমাদের কাছ থেকে দুরে সরিয়ে দেয়। এই বাঁধার প্রাচীর কাটিয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হিসেবে তিনি পরিচিত অপরিচিত সবার মাঝে সালামের প্রচলন করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য শেষ করেন। তাঁর বক্তব্যের যে দিকটি আমাকে সবসময় আকর্ষন করত তা হোল তিনি অত্যন্ত নম্রভাব কথা বলেন, বক্তার মত নয় বন্ধুর মত। আরেকটি ব্যাপার হোল তিনি এত মজা করে কথা বলেন যে মনেই হবেনা তিনি একটি ভাবগম্ভীর বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করছেন কিন্তু পরিশেষে তাঁর প্রতিটি কথা আনন্দদায়ক হবার কারণেই মনে গেঁথে যায়।
দ্বিতীয় বক্তা ছিলেন ডাক্তার আব্দুল্লাহ ইদ্রিস। ক্যানাডায় ইসলামের প্রচার এবং প্রসারে তাঁর অতুলনীয় অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম সাহেব তাঁর পরিচিতি দিতে গেলে এক মজার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ইমাম সাহেব যতই তাঁর ব্যাপারে বলার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি ততই তাঁকে ঠেলে মাইক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন যতক্ষণ না ইমাম সাহেব পরিচিতি অসমাপ্ত রেখে মঞ্চ থেকে নেমে যান। নিজের প্রশংসায় তিনি এত লজ্জা পাচ্ছিলেন যেন কেউ তাঁর বদনাম করছে! তাঁর বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল, How to develop Islamic personalities in secualr Canada. এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা অনেকেই এখানে এসে এখানকার সমাজে মিশে যেতে গিয়ে মাত্রাটা ঠিক বুঝে পান না। ফলে কেউ কেউ এই দেশে থেকেও এই দেশের সাথে সম্পর্কহীন থেকে যান যেমন ইয়াসির ফাজাগা সাহেব বলে গেলেন, আর কেউ কেউ এতটাই মিশে যান যে নিজের মুসলিম পরিচয়টা পর্যন্ত খুইয়ে বসেন। তিনি কিছু পরামর্শ দেন কিভাবে এবং কোথায় আমরা এই দেশের বা এই পরিবেশের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি এবং কোথায় নিজের স্বাতন্ত্র বজায় রাখা জরুরী। তিনি পাচ পাঁচটি সন্তান এই দেশে মানুষ করেছেন উত্তম মুসলিম হিসেবে এবং অতঃপর তাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন আফ্রিকায় জনসেবার্থে। অভিজ্ঞতার আলোকে যে জ্ঞান অর্জিত হয় তার বিকল্প কিছু হতে পারেনা। সুতরাং, ভাল লাগে তাঁর শিক্ষনীয় বক্তব্য।
পরবর্তীতে স্বরচিত কবিতা উপহার দেয় বুনা মুহাম্মাদ। ছেলেটি কি সুন্দর করে বলল, আমরা সবাই একই রক্তের ধারাবাহিকতায় এসেছি, একই মাঠে আবার মিলিত হব, এক আল্লাহর সামনে- তোমরা মুখে বল ‘তুমি আমার ভাই’ কিন্তু যখন আমি তোমার মেয়েকে বা বোনকে বিয়ে করতে চাই তখন তুমি কেবল আমার চামড়ার রংটাই দেখতে পাও কিংবা আমার জাতীয়তা ; তুমি বল তুমি তোমার সন্তানকে একটি ইসলামপ্রিয় মেয়ে বিয়ে করাতে চাও অথচ একটি মুসলিমা মেয়েকে তুমি তোমার ছেলের জন্য অনুপযুক্ত মনে কর কারণ তার ঠোঁট দু’টো তোমার অতিরিক্ত মোটা মনে হয়, এটা কবে থেকে বিয়ের criteria হোল? এইটুকু একটি ছেলের কবিতায় যে জীবনবোধ এবং ইসলামের মূলনীতির ব্যাপারে যে স্বচ্ছ ধারণা তা সকলের হৃদয় স্পর্শ করল। মোনালিসা আপা তাঁর মেয়েদের শোনানোর জন্য বুনার কবিতার সিডি কিনে নিলেন।
তারপর মঞ্চে এলেন ডাক্তার ইজ্জেলদিন আবুলেইশ, বক্তব্যের বিষয় Life changing stories in the Holy Land, a Canadian Perspective. বুঝতে পারছিলাম তিনি প্যালেস্টাইনের কথা বলবেন কিন্তু তিনি যা শোনালেন তাতে পাঁচ পাঁচটি রুমে যারা তাঁর বক্তব্য শুনেছেন কারো চোখ শুকনো ছিলোনা। তিনি কেবল তাঁর নিজের জীবনের গল্প বললেন। স্ত্রী মারা গেছেন কিছুদিন আগে। তিনি তাঁর চার মেয়ে এবং এক ভাগ্নীর সাথে তাদের রুমে বসে গল্প করছিলেন। কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দে তিনি ছুটে যান তাঁর মেয়েদের রুমে। গিয়ে দেখেন ইসরাইলী কামানের বেপরোয়াভাবে ছুঁড়ে মারা গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে তাঁর তিন মেয়ে এবং ভাগ্নী। দালানের ধ্বংসাবশেষ আর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মাংসপিন্ডের মাঝে বোঝার কোন উপায় নেই কোনটা তাঁর বড় মেয়ে বিসান (২০), কোনটা মায়ার (১৫), কোনটা আয়াহ (১৩), কোনটাই বা তাঁর ভাগ্নী নূর (১৪) এর লাশের টুকরো। একটি মেয়ে শাথাহ (১৬)আলৌকিকভাবে বেঁচে যায় যদিও তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়, ডানহাতের দু’টি আঙ্গুল পাওয়া যায়নি এবং extensive injury র কারণে তাকে বছরের পর বছর চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। তিনি বার বার নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকেন এদের কি দোষ ছিল? সেদিন ছিল জুমার দিন। মেয়েরা সকালে সবাই সুরাহ কাহফ পড়েছে, জুমার নামায আদায় করেছে, আসরের একটু আগে সবাই বসে নামাজের সময়ের অপেক্ষা করছিল। তিনি বার বার প্রশ্ন করতে থাকেন এরা তো ছিল মেয়ে, ওরা তো কখনোই ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যেতনা, তাহলে ওদের এমন নির্মমভাবে হত্যা করল যে ইসরাইলী সে কিভাবে পারল এমন করতে, কি অন্যায়ের কারণে সে কেড়ে নিলো এতগুলো তাজা প্রাণ? তিনি চিন্তা করছিলেন তার ১২ বছর বয়সী ছেলেটি ক’দিন আগে মাকে হারিয়েছে, এখন মায়ের মত যত্ন নেয়া তিন তিনটি বোনকে একসাথে হারিয়ে সে কিভাবে স্বাভাবিক থাকবে? এই অবস্থায় তাঁর ছেলেটি এগিয়ে এসে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘বাবা, তুমি ভাবছ কেন, ওরা তো শাহিদ হয়ে গিয়েছে! ওরা সবাই এখন মায়ের কাছে থাকবে, মা’র আর একাকী লাগবেনা!’ তিনি বর্ণনা করেন এই অবস্থায় তাঁর বেঁচে যাওয়া মেয়েটি পরীক্ষা দিয়ে ৯৬% মার্কস নিয়ে পাস করে। পরবর্তীতে অবশিষ্ট সন্তানদের মানুষ করার জন্য তিনি স্বদেশ ছেড়ে ক্যানাডায় পাড়ি জমান। এই ঘটনার পুনর্বিবেচনায় তিনি একটি বই লেখেন, I Shall Not Hate. বইটিতে তিনি পর্যালোচনা করেন কিভাবে জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্পের মত জায়গা থেকে আল্লাহ তাঁকে এতবড় ডাক্তার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন; এত বড় মানসিক আঘাতের মাঝে আল্লাহ কিভাবে একটি ছোট্ট ছেলের মাধ্যমে তাকে সান্তনা দান করেন; যে প্রতিশোধ নয় নিজেকে গড়ে তোলাই এই যুদ্ধে জেতার উপায়; এবং যারা এই নরক থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে তাদের সার্বিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে নিজের জন্য কিছু করার আগে যারা পেছনে রয়ে গেছে তাদের কথা চিন্তা করা। তিনি জানান এই বই লেখার পর তাঁর মেয়েটি তাকে ইমেল করে জানায় সে কতটা অবাক হয়েছে যে ওর বাবা ওর বোনদের এতটা অনুভব করে। সেই প্রথম তিনি realize করেন যদিও তিনি ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর সন্তানরা তাঁকে বোঝে, কিন্তু একই ঘরে থেকেও তারা কোনদিন তাঁর আবেগ বুঝতে পারেনি কারণ তিনি কখনো এর বঃহিপ্রকাশ ঘটাননি। তাই তিনি বাবামাদের পরামর্শ দেন তাদের অনুভূতিগুলো নিজের মাঝে লুকিয়ে না রেখে সন্তানদের সাথে খোলাখুলিভাবে শেয়ার করতে।
শেষ বক্তা ছিলেন ফাতিমা খামিসা, বক্তব্যের বিষয়, What would Khadijah (R) do today? How to use her as a model in our life today? তাঁর কথায় উঠে আসে খাদিজা (রা) কেবল তাঁর যুগেই নয়, সর্বযুগের সর্বাপেক্ষা স্মার্ট নারী ছিলেন। তাঁর মেধা এবং confidence আজকের যুগের নারীদের জন্যও একটি অনুকরণীয় আদর্শ কেননা তিনি ছিলেন একাধারে তুখোড় ব্যাবসায়ী, বুদ্ধিমতি এবং সাহসী নারী, উত্তম স্ত্রী, শ্বশুরকুলের প্রতি দায়িত্বশীলা বধু, আদর্শ মা, বিপদে ধৈর্য্যধারণকারী এবং উত্তম পরামর্শদানকারী বন্ধু। এমন বহুগুণে গুণান্বিতা দূরে থাক, এমন সাহসী মহিলা আজকের যুগেও পাওয়া যায়না যখন মেয়েরা দাবী করছে তারা পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করেছে। সুতরাং, আজকের কোন নারী নয় বরং খাদিজা (রা) ই হোক মুসলিম নারীদের আদর্শ।
এই অধিবেশনের সমাপ্তিতে এক ঘন্টার জন্য বাসায় এলাম আমরা, নামায পড়লাম এবং খাওয়াদাওয়া করে আবার রওয়ানা দিলাম।
বিকালে মহিলাদের জন্য আলাদা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় কোস্ট প্লাজায়। দু’টি বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন কেনিয়ার একটি অঞ্চলের crown prince এর স্ত্রী ফওজিয়া মুহাম্মাদ। বিষয় দু’টি ছিল, Did Allah Almighty make a mistake in placing you where you are? এবং Even we can do it, empowering our sisters towards a successful community and civic engagement. তাঁর উপস্থাপনার স্টাইলটি ছিল মূলত interactive. তিনি বিভিন্ন বিষয়গুলো আমাদের সাথে আলোচনা আকারে উপস্থাপন করেন, কখনো তাঁর সাথে এবং কখনো নিজেদের মধ্যে। আলোচনায় যে ব্যাপারগুলো উঠে আসে তা হোল মুসলিম মহিলারা ইসলামকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুসলিম পুরুষদের মত সক্রিয় নয়। আমাদের ক্ষেত্রগুলো আলাদা হতে পারে কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ খুঁজে নেয়াটা আমাদের দায়িত্ব। যেমন তিনি উদাহরণ দেন, ক্যানাডায় প্রথম এসে তিনি যে অফিসে কাজ নেন সেখানে এক লোক তাঁকে দেখে অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে ওঠে। সে নানান সময় জিজ্ঞেস করত, ‘তুমি ছেলেদের সাথে হ্যান্ডশেক করনা কেন?’, ‘তোমার কি মাথায় চুল নেই? তাহলে তুমি মাথা ঢেকে রাখ কেন?’, ‘তুমি প্রতিদিন দুপুরে বাথরুমে গেলে হাত মুখ ভিজিয়ে কি কর?’, ‘তুমি এই মাসে খাবার পানি কিছু খাওনা কেন?’ ইত্যদি ইত্যাদি। তিনি বিরক্ত না হয়ে তাকে উত্তর দিতেন, বুঝিয়ে দিতেন। পরে সেই লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। আবার পরবর্তীতে তিনি অফিসের কাজ ছেড়ে একটি নতুন কাজ শুরু করেন। তিনি এখন ডঃ আবু আমিনা বিলাল ফিলিপসসহ পঁচিশজন বক্তার mail এর জবাব দেয়া থেকে তাদের শিডিউল ঠিক করা, তাদের travel arrangements তৈরী করা, তাদের হোটেল বুকিং করা ইত্যাদি যাবতীয় কাজ ঘরে বসেই করে থাকেন। তিনি বলেন এভাবে মহিলারা নানান দিকে ইসলামের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে। এই আলোচনা অনুষ্ঠানেরই এক পর্যায়ে আমার পরিচয় ঘটে ক্যানাডিয়ান নও মুসলিমা অ্যাশলীর সাথে যে ছোটবেলা থেকে খুঁজতে খুঁজতে বছর তিনেক আগে ইসলামের সন্ধান পায়। আর আমরা automatically পেয়েছি বলে হয়ত আমাদের কাছে এর কোন কদর নেই।
তাঁর বক্তব্যের পর ফাতিমা খামিসা, বুনা মুহাম্মাদ এবং মুসলেহ খান শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। শনিবারের অধিবেশন এর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়।
পরদিন ঘুমাচ্ছিলাম বেঘোরে। জানালা দিয়ে প্রবল আলো ঘরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে দেখে বিরক্ত হয়ে ঘড়ির দিকে উঁকি দিলাম আর ঘুমটা গেল নষ্ট হয়ে। বাজে সাড়ে ন’টা। রবিবার আমার বান্ধবীরা সবাই সপরিবারে পিকনিকে গেল। পিকনিকের উদ্যোক্তা ছিলেন হাফিজ সাহেব। কিন্তু রবিবার কনফারেন্সের কথা শুনে উনি বললেন, ‘জীবনে অনেক পিকনিকে যাওয়া যাবে, তুমি কনফারেন্সে যাও, বাচ্চাদের আমি দেখব’। তারপর যদি ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করি! নিজে উঠে জয়াকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগালাম। বেচারী টিকেট করেও গত দু’দিনের একদিনও যেতে পারেনি, ভয় পাচ্ছিল রাস্তা চিনবে কিনা। পথের ডাইরেকশন দিয়ে রেডি হয়ে বাসার সামনের স্টেশনে ট্রেনে উঠলাম। পরের স্টেশনে নেমে হাঁটা দিলাম কোস্ট প্লাজার উদ্দেশ্যে। আমার সামনেই হাঁটছিলো এক capri পরিহিতা নারী, বোঝাই যাচ্ছিল সে ছোট প্যান্ট পরা উপলক্ষ্যে সদ্য পায়ের লোম উৎপাটন করেছে, বেচারীর পাগুলো দেখাচ্ছিল ঠিক ছিলা মুরগীর চামড়ার মত। খুব দুঃখ পেলাম যে কতগুলো পরপুরুষ আমাদের dictate করছে আমাদের কি পরা উচিত, কিভাবে সাজগোজ করা উচিত, কোথায় লোম তোলা উচিত আর আমরা ঠিক সেই মত চলার জন্য জীবনপাত করে ফেলছি অথচ পুরুষগুলো ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মাখেনা, রঙ মেখে সং সাজেনা, সাইজের তোয়াক্কা করেনা কিংবা ভুরুও তোলেনা!
যাই হোক, যদিও ঠিক করে রেখেছিলাম কোথায় বসব, শুধু কোস্ট প্লাজাতেই তখন একসাথে ছয়টা অনুষ্ঠান চলছে। তার একটা আরবী আর একটা উর্দু। এগুলো যদি বাদ দেই তবু বাকি চারটাতে হুলস্থুল কম্পিটিশন চলছে মনের ভেতর। শেষমেশ চোখমুখ বন্ধ করে বসে পড়লাম ডঃ আবু আমিনা বিলাল ফিলিপসের আসরে। তাঁর প্রথম বিষয় ছিল Dialogue with an Atheist. Does God exist and Who is God? আমার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবের মাঝে এদের সংখ্যা অনেক, তাই এই বিষয়ে আগ্রহ ছিল। দেখলাম আমি যা জানি তাই তিনি বললেন তাঁর বক্তব্যে। তবে তাঁর একটি কথায় আশ্বস্ত হলাম যে ওদের সংশোধন করা আমার এমনকি তাঁরও সাধ্যাতীত। তিনি বললেন এদের কোন যুক্ত তর্ক দিয়ে বোঝানো সম্ভব না কারণ আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে এদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় নেই, কিন্তু জীবনের কোন এক পর্যায়ে হয়ত তারা কিছু চেয়ে পায়নি, ব্যাস হয়ে গেল নাস্তিক। অথবা বিশ্বাস করতে তাদের আপত্তি নেই কিন্তু বিশ্বাস প্রমাণ করার জন্য যে কাজগুলো করতে বলা হয়েছে তা করতে তাদের অনীহা, তো বনে গেল নাস্তিক। যে বোঝেনা তাকে বোঝানো যায়, কিন্তু যে না বুঝতে বদ্ধপরিকর তাকে আপনি বোঝাবেন কোন যুক্তি দিয়ে? আধঘন্টার মত প্রশ্নোত্তর পর্বের পর তিনি মুসলেহ খানকে মঞ্চ ছেড়ে দিলেন। ততক্ষণে জয়া এসে পৌঁছেছে।
Multiculturalism vs Polyculturalism এর ওপর বক্তব্যটি আসলে দেয়ার কথা ছিল ডঃ মুনীর আল কাসিমের। কিন্তু তাঁকে সেদিন ভোরেই emergency টরোন্টো ফিরে যেতে হয় আর তিনি দায়িত্ব দিয়ে যান তাঁর ছাত্র মুসলেহ খানকে। মোনালিসা আপার কাছে তাঁর প্রশংসা শুনেছিলাম এবং গতদিন তাঁর প্রশ্নোত্তর পর্বেও উপস্থিত ছিলাম। তাঁর বক্তৃতার মূল বৈশিষ্ট্য যা অনেকের ভাল লাগে তা হোল তিনি খুব অল্প কথায় to the point আলোচনা করেন। মুসলেহ খান মূলত সমস্যাগ্রস্ত মুসলিমা বোনদের সমস্যা নিরসন করে থাকেন, তাই বলাবাহুল্য সেটাই তাঁর মূল আলোচনার বিষয়। এই দিন তিনি গতদিন ডাক্তার আবদুল্লাহ ইদ্রিস যা আলোচনা করেছিলেন অনেকটা সেই আদলেই আলোচনা করলেন। কিন্তু আমার যে বিষয়টি সবচেয়ে ভাল লাগল তা হোল তাঁর সরল স্বীকারোক্তি যে তাঁর শিক্ষকের বক্তব্যটি তাঁকে উপস্থাপন করতে হবে জেনেই তিনি ভীষণ মুষড়ে পড়েন এবং তাঁর মাথায় কিছুই ঢুকছিলোনা। তখন তাঁর স্ত্রী তাকে সাহস দেন যে তিনি চেষ্টা করলেই পারবেন ইনশাল্লাহ এবং তখন তিনি সাহস ফিরে পান। তিনি বলেন এমন স্ত্রী আল্লাহর পক্ষে থেকে উপহারস্বরূপ। পাশাপাশি তিনি বলেন অনেক সময় মহিলারা রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন কারণ তাদের মনে হয় তাদের সংসারে যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা। কিন্তু সে সময় যদি স্বামী রত্নটি চুপ করে থেকে ঝড় সামাল দিতে পারেন তাহলে প্রায়ই দেখা যায় কয়েকমিনিটের ভেতর স্ত্রীর আপনিই মাথা ঠান্ডা হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে এমন ধৈর্য্যশীল স্বামীটিকে তিনি জীবনের জন্য আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দেন। আকরাম জুমায় তাঁর আরেকটি বক্তব্য থাকায় তিনি প্রশ্নোত্তর পর্ব বাদ দিয়েই ছুটতে বাধ্য হন। আমরা ছুট দেই নির্ধারিত কক্ষে যুহরের নামায পড়তে।
এবার আবার ডঃ ফিলিপস ফিরে আসেন বিদ’আতের ওপর একটি চমৎকার আলোচনা নিয়ে। এই আলোচনাটি সবার শোনা দরকার কেননা এটি এমন এক বিষয় যা নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর ভুল ধারণার প্রচলন রয়েছে অথচ প্রতিটি জুমার খুতবায় বলা হয় প্রতিটি বিদ’আতই misguided এবং প্রত্যেক misguidance এর শেষফল জাহান্নাম। আমাদের সৌভাগ্য তাঁর পর আর কোন বক্তা ছিলোনা, কারো এই রুম প্রয়োজন ছিলোনা এবং সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত আর কোন অনুষ্ঠান ছিলোনা। তিনি সানন্দে আমাদের প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে আরো দেড়ঘন্টা সময় দেন- প্রশ্নোত্তরের বন্যা বয়ে যায়। এ’সময় তাঁর দু’টি জিনিস আমার খুব ভাল লাগে। একটি হোল তিনি খেয়াল করেন শ্রোতৃমন্ডলী তাঁর কথা বুঝতে পারছে কি’না এবং প্রয়োজনমত একাধিকবার বা অন্যভাবে বিষয়টি পুণরায় ব্যাখ্যা করেন। হলে লোকসংখ্যা বাড়ার এক পর্যায়ে অনেক মহিলাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যেহেতু মহিলাদের বসার জন্য কেবল একটি সারি নির্ধারিত ছিল, পুরুষদের দু’টি। তিনি বক্তৃতায় বিরতি দিয়ে ভাইদের অনুরোধ করেন সরে গিয়ে বোনদের জন্য কিছু সারি ছেড়ে দিতে। অনেক বক্তাই দেখা যায় নিজের মহিমায় এত মশগুল থাকেন যে তাঁদের শ্রোতাদের দিকে তাকানোরই সুযোগ হয়না।
প্রতিটি অনুষ্ঠানেই বেশ কিছু ক্যানাডিয়ান উপস্থিত ছিল। এই আসরে একটি পরিবার আসে যারা সম্ভবত ইসলাম কবুল করার পথে এবং খুঁটিনাটি অনেক বিষয় তারা জানতে চায়। পরিশেষে তারা ডঃ ফিলিপসের অনলাইন ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির তথ্য সংগ্রহ করে নেয়। এখানে ডিপ্লোমা এবং অনার্স উভয়প্রকার কোর্স আছে, মদীনা ইউনিভার্সিটি এবং এদের সিলেবাস একই কেবল এখানে পড়ানো হয় ইংরেজি মিডিয়ামে, রেজিস্ট্রেশন ফি ছাড়া কোর্স সম্পূর্ণ ফ্রি এবং পুরোপুরি অনলাইনে করা যায়। চারবছরে তাদের ডিপ্লোমা স্টুডেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বিশ হাজার এবং অনার্সে ছাত্রসংখ্যা তিন হাজার।
বিকালে বিদায়ী অধিবেশনের জন্য সকালের ছয়টি কক্ষকে পার্টিশন সরিয়ে একত্রিত করে দেয়া হয়। বিদায়ী সেশন হওয়াতে প্রচুর বক্তা বক্তব্য রাখেন কিন্তু মজার বিষয় সবাই নির্ধারিত সময়ের মাঝেই বক্তব্য শেষ করেন যার ফলে মাগরিবের নামাজের আগেই (দশটা বাজে) অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়ে যায়। এই অধিবেশনের বেশ কয়েকটি হাইলাইট ছিল। একটি ছিল উপস্থাপকের একটি মজার কাজ। তিনি সবাইকে অনুরোধ করেন পাশে বসা অপরিচিত ভাই বা বোনটিকে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। সাদা কালো লাল হলুদ হরেক চামড়ার মাঝে সালাম বিনিময় আর কোলাকুলি যেন ঈদের আমেজ সৃষ্টি করে! তিনি আসলে আমাদের দেখাতে চাইছিলেন কত সহজেই আমরা আমাদের মুসলিম ভাই বা বোনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি এবং এর মাধ্যমে কত আনন্দ পাওয়া যায়।
একটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য ছিল ম্যালকম এক্সের মেয়ে অ্যাম্বাসেডর শাবাজের। টিনেজের প্রথমপ্রান্তে ম্যালকম এক্স (মালিক শাবাজ) এর আত্মজীবনী পড়ে মোহিত হয়েছিলাম। সবাই তাঁকে black activist হিসেবে জানলেও তিনি বলেছেন তিনি তাবৎ নিপীড়িত মানবতার পক্ষে। তাঁর মত মেধাবী এবং উজ্জ্বল ব্যাক্তির কন্যা এমন জ্বাজল্যমান হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। তিনি মূলত তুলে ধরেন কিভাবে আমরা নিজেদের একটি ছোট গোত্রের অংশ মনে করে নিজেরাই নিজেদের corner করে ফেলি অথচ নিজেকে বৃহত্তর পরিসরে চিন্তা করলে আমাদের self identity বাড়ে বৈ কমেনা। যেমন তিনি বললেন তিনি নিজেকে ব্ল্যাক অ্যামেরিকান ভাবলে একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর সদস্য হন, কিন্তু নিজেকে মুসলিম ভাবলে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সদস্যে পরিণত হন। তিনি বলেন আত্মপরিচয় লুকানো মানে নিজেকে ছোট করা, সুতরাং যার নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির নামে সে কেন নিজেকে ‘মো’ বলে পরিচয় দেবে? অন্যরা মুহাম্মাদ উচ্চারণ করতে না পারলেও ক্ষতি নেই, সে তাদের শেখাবে কিভাবে তাকে ডাকতে হবে!
এবারের কনফারেন্সে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল মুসলিমদের প্রতি বর্তমান সরকারের বিমাতাসুলভ মনোভাব। এই বিষয়ে কথা বলেন আইনবিদ রাজ শর্মা। তিনি কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে দেখান কিভাবে ক্যানাডিয়ান সরকার আমেরিকার চাপে পড়ে সময় সময় মুসলিম ক্যানাডিয়ান নাগরিকদের অধিকার লঙ্ঘন করেছে এবং তারা যখনই সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে তখনই বিজয়ী হয়েছে। তিনি পরামর্শ দেন এই ধরনের পরিস্থিতিগুলোতে মুসলিমদের সম্মিলিতভাবে বেশি বেশি মামলা করা উচিত যেন সরকার ভাবতে না পারে যে মুসলিমরা অসহায় এবং তারা মুসলিমদের সাথে ঝামেলা করার আগে চিন্তা করতে বাধ্য হয় তাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে।
পরিশেষে আসন্ন রামাদানে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাপারে ছোট্ট একটি reminder দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেন ডঃ আবু আমিনা বিলাল ফিলিপস।
অনুষ্ঠানের শেষে আয়োজকরা তাঁদের স্ত্রীদের অবদান স্বীকার করেন এই কাজগুলিতে তাঁদের পাশে থাকার জন্য এবং অবশেষে যে ১০৫ জন কিশোর কিশোরী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সমস্ত কাজে ভলান্টিয়ার করেছে তাদের সবার সামনে ডেকে নিয়ে তাদের অবদান স্বীকার করেন- ছেলেদের দেন স্টেজের সামনে আর মেয়েদের ওঠান স্টেজের ওপর যেহেতু এই মেয়েরাই ভবিষ্যতে মা হবে। এই সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রচ্ছন্নভাবে ইসলামে নারীর মর্যাদার বিষয়টি উদাহরণের মাধ্যমে উঠে আসে, কথায় নয়।
অনুষ্ঠান শেষে জয়া আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়। রাতে শুতে গিয়ে মনটা আনন্দ আর কষ্টের মাঝে দুলতে থাকে- আনন্দ কারণ এই অসাধারন অনুষ্ঠানটিতে আল্লাহ আমাকে উপস্থিত থাকার সুযোগ করে দেন আর দুঃখ কারণ স্বপ্নময় তিনটি দিন শেষ হয়ে গেল।
No comments:
Post a Comment