বিয়ের পাঁচবছর পরেও আমার শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হোলনা।
পেশাগত ব্যাস্ততা, পারিবারিক দায়িত্ব, শ্বশুরবাড়ী যাবার যে বিশাল খরচ তা জোগাড় করার অক্ষমতা তো বটেই, শ্বশুরশ্বাশুড়ীর সাথেই থাকতাম বলেই হয়ত তাগিদটাও কম ছিল। বুঝিয়ে বলি, আমার শ্বশুরশ্বাশুড়ী চট্টগ্রাম থাকেন বহুবছর ধরেই। তাঁদের ছেলেমেয়েদের এখানেই জন্ম, এখানেই বেড়ে ওঠা, তাদের বিয়ে দিয়ে এখানেই থেকে যাওয়া। কিন্তু উভয়ের আদি বাড়ী বরিশাল অঞ্চলে। আম্মার প্রায় আত্মীয়স্বজন ঢাকাবাসী হলেও আব্বার আত্মীয়স্বজন থাকেন বরিশাল। এর অর্থ আমরা বরিশাল না যাবার ফলে কেবল যে তাঁদের আদিবাড়ী দেখা হয়নি তাই নয়, তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সাথেও সেভাবে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেনি। এবার সংকল্প করলাম যাবই। এই সংকল্প আর কিছুতেই অবদমিত হবার নয়। আমি চট্টগ্রামের মেয়ে, বড় হয়েছি মরু অঞ্চলে। সাগরপাড়ে থেকেছি সারাজীবন কিন্তু পানিতে নামার সাহস হয়নি। তাই ঠিক হোল বরিশাল যাওয়া হবে সড়কপথে। প্রস্তুতিস্বরূপ প্রথমেই আমাদের ভেসপার সীট চওড়া করা হোল, দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে। নতুন ফোম দিয়ে সীট পুণঃনির্মান করে, স্টীলের ওপর আরামদায়ক ফোম আর চামড়ার গদি দিয়ে ব্যাকরেস্ট উঁচু করা হোল ১৮ ইঞ্চি। পেছনে একটা স্ট্যান্ড লাগানো হোল যার ওপর স্যুটকেস দাঁড় করিয়ে নেয়া যাবে। সামনে লাগানো হোল স্টীলের ঝুড়ি যেন খাবারদাবাড়সহ বাচ্চার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের নাগালে রাখা যায়। আমাদের কাপড়চোপড় নেয়া হোল রাসূল (সাঃ)এর সুন্নাত অনুযায়ী, জনপ্রতি তিনটি করে যেন লাগেজ এতটা ভারী না হয় যে মটরসাইকেল ভারহাম্যহীন হয়ে পড়ে। শুধু আমার দুই বছর বয়সী কন্যা রাদিয়ার জন্য বাড়তি কাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নেয়া হোল। ২০০২ সালের মার্চ মাসের এক সকালে আমরা ফজর নামাজ পড়ে বরিশালের পথে রওয়ানা দিলাম। আত্মীয়বন্ধু সবাই বলল আমরা পাগল হয়ে গেছি! কিন্তু আব্বা এই উপদেশ দিয়ে বিদায় দিলেন, “ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে থেকে যথাসম্ভব দ্রুত অন্য রাস্তায় চলে যাবে। ধীরেসুস্থে চালাবে, ক্লান্ত লাগলে থামিয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবে, ওভারটেক করার চেষ্টাও করবেনা। আমরা দুয়া করতে থাকব। তোমরা পথে সুযোগ পেলেই ফোন করে জানাবে কি খবর বা কতটুকু গেলে”। হাফিজ সাহেব বাইক চালান তখন ১৮ বছর। ততদিনে জোরে চালানোর শখের বয়স শেষ। চারপাশের শোভা উপভোগ করতে করতে সকাল আটটায় আমরা এসে পৌঁছলাম মুহুরী প্রজেক্ট। জলাশয়ে কতক বিদেশী পাখী খেলাধুলা করছে, শীতের সকালে সবাই তখনো নীড়ের ওম ছেড়ে বেরিয়ে আসার সাহস করে উঠতে পারেনি। চারিদিক জনমানবশূণ্য। বাঁধের ওপর বসে মটরসাইকেলের সামনে স্টীলের ঝুড়ি থেকে বিস্কিটের টিন আর পানি নিয়ে প্রাতঃরাশ সারলাম তিনজনে। আধঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে আবার পথে নামলাম। এতক্ষণ কন্যা আমার কোলে ঘুমাচ্ছিলেন। এবার ফ্রেশ হয়ে বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে চাইল। আমরা একটা শর্টকাট রাস্তা দিয়ে ফেনী ঢুকে গেলাম। তখন হাজারীর অত্যাচারের যুগ মাত্র সমাপ্ত হয়েছে। চারিদিকে দেখে ইংরেজী সিনেমার পরিত্যাক্ত শহর বা ‘গোস্ট টাউন’এর কথা মনে হোল। প্রত্যেকটি ভবন জরাজীর্ণ, কোন কোন ভবনের দেয়াল বেয়ে বেড়ে উঠছে বটগাছ, রাস্তাঘাটের ভগ্নদশা অথচ এরই মাঝে বসবাস করছে এতগুলো মানুষ! ফেনীর ম্যাজিস্ট্রেট তখন আমাদের এক বড় ভাই। তাঁকে তাঁর অফিসে গিয়ে সারপ্রাইজ দিলাম। তিনি আবার জোর জবরদস্তি আমাদের নাস্তা খাওয়ালেন। পরে ফেনী ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পথে বাসায় গিয়ে ভাবীর সাথে সালাম বিনিময় করে নোয়াখালীর পথ ধরলাম। আমাদের মূলত পরিকল্পনা ছিল সেদিন নোয়াখালী পর্যন্তই যাওয়া। কিন্তু তখন বাজে মাত্র সকাল দশটা। নোয়াখালী না গিয়ে আমরা এবার লক্ষ্মীপুরের দিকে রওয়ানা দিলাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে এত সুন্দর পিচঢালা পথ, গ্রামের মানুষজনের বাড়ীতে বাড়ীতে টেলিভিশনের আওয়াজ আর তাদের পোশাক আশাক দেখে বুঝতে পারলাম আগের সেই গ্রাম আর নেই যে গ্রামের কথা কবিসাহিত্যিকরা লিখেছেন- পাখীর কলকাকলীঘেরা গ্রাম যেখানে ভোরবেলা কৃষক ছেঁড়া লুঙ্গিখানা গায়ে জড়িয়ে হালের গরু নিয়ে যায়, গাঁয়ের বধু হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে ঘোমটা টেনে দিয়ে সরে দাঁড়ায়, ঘরে ঘরে যেখানে আমগাছ জামগাছ, হাঁসমুরগীর খোঁয়াড়, পায়রার খোপ- সব পরিস্কার হয়ে গেছে। জেলার পর জেলা এমনই দৃশ্য দেখে দেশের উন্নতি সম্পর্কে আশান্বিত হলাম যদিও এর পেছনে রয়ে গেল এক সুতীব্র বেদনা- শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সবসময়ই একটা তীব্র বেদনার সঞ্চার করে, মায়ের থেকে সন্তানের নাড়ীছেঁড়ার মতই। রায়পুর পৌঁছুলাম দুপুর দু’টোয়। সকালে দু’বার নাস্তা খাওয়ার ফলে ক্ষিদে পায়নি। পথের ধারে একটা সুন্দর মসজিদ দেখে দু’জনে পালা করে জুহর নামাজ পড়ে নিলাম। আধঘন্টা মসজিদের ছায়ায় বিশ্রাম নিলাম। পানি শেষ। মসজিদের পাশে এক ডাববিক্রেতার কাছ থেকে ডাবের পানি ভরে নিলাম বোতলে। বাসায় কথা বলে সবাইকে আশ্বস্ত করলাম যে আমরা ভাল আছি। তারপর আবার বেরিয়ে পড়লাম ভরদুপুর রোদে। প্রায় দু’ঘন্টা বিরামহীন চলার পর এক নাম না জানা জায়গায় ভারী সুন্দর এক মসজিদ কমপ্লেক্স দেখে থমকে দাঁড়ালাম। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব সহৃদয় ব্যাক্তি জনস্বার্থে এত সুন্দর মসজিদ নির্মান করেছেন তাদের বদান্যতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নলকূপের শীতল পানিতে অজু করে স্বস্তি পেলাম। সেই ঠান্ডা ঠান্ডা পানি ভরে নিলাম বোতলে। আবার যাত্রা হোল শুরু। এবার মেঘনা নদী পাড়ি দেব। হরিণহাটা ঘাটে পৌঁছলাম পৌণে পাঁচটায়। ফেরী ঘাটেই আছে দেখে আনন্দিত হলাম যে আমাদের ফেরীর জন্য অপেক্ষা করতে হবেনা। একটা ট্রাক উঠছিল, তারপরই আমাদের পালা। হঠাৎ আমাদের সমস্ত আশায় গুড়েবালি দিয়ে প্রচন্ড শব্দে ট্রাকের অ্যাক্সেল ভেঙ্গে গেল। ট্রাকের অর্ধেক ফেরীতে আর অর্ধেক মাটিতে। খবর নিয়ে জানা গেল এই ট্রাক না সরানো পর্যন্ত ফেরী চলবেনা আর ট্রাক যে কবে সরানো সম্ভব হবে কেউ জানেনা। আমি মুষড়ে পড়লাম না জানি কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাবার ভয়। হাফিজ সাহেব করিৎকর্মা মানুষ। নদী পাড় হবার ব্যাবস্থা করে ফেললেন। ট্রলারে মটরসাইকেল উঠিয়ে নদী পাড় হওয়া হবে! আমি তো পানি দেখে ভয়ে অস্থির! আমার ঐটুকু মেয়ে আমাকে হাত ধরে নিয়ে চলল, “আম্মু, তুমি ভয় পেয়োনা, আমি আছি তো!” ট্রলারের ঠিক মধ্যখানে মটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে তাকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হোল। চারপাশে ঘিরে বসেছে ট্রলারভর্তি মানুষ। আমি কন্যাকে নিয়ে যথাসম্ভব মাঝখানে গিয়ে বসলাম। ট্রলার চলতে শুরু করল। আধঘন্টা পর দেখলাম সামনে পেছনে ডানে বামে কোথাও মাটির কোন নাম নিশানা দেখা যাচ্ছেনা। হাফিজ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা কি কোন কারণে বঙ্গোপসাগরের মধ্যখান দিয়ে যাচ্ছি?” হাফিজ সাহেব তো হেসেই খুন, “জ্বী না ম্যাডাম, এটা পদ্মা মেঘনা যমুনার সঙ্গমস্থল- চাঁদপুর!” কন্যা এতক্ষণ খেলছিল। আমার চেহারা দেখে সে আমার কোলে উঠে বসল, “আম্মু, আমি তোমাকে গান শোনাই, তুমি ঘুমাও”। বুঝলাম, কন্যার জন্ম চট্টগ্রামে হলেও রক্ত বরিশালেরই বটে! অন্যপাড়ে শরীয়তপুর। সন্ধ্যা হয় হয়। ট্রলার পাড়ে ভিড়তেই হাফিজ সাহেব দ্রুত দড়ি খুলে মটরসাইকেল অবমুক্ত করলেন। তারপর টান দিয়ে ঘাটের পাশে এক মসজিদে ঢুকলেন। কেবল মাগরিবের নামাজই নয়, প্রতিপালককে ধন্যবাদ জানালাম ঐ সমুদ্রসম নদী নিরাপদে পাড় করে আনার জন্য। চিন্তামুক্ত হয়েই বুঝতে পারলাম ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। মসজিদ থেকে বেরোতেই দেখলাম রাস্তার অন্য পাড়ে গরম গরম পরটা ভাজা হচ্ছে। হাফিজ সাহেব পরটা আর ডিমভাজি নিয়ে এলেন। তিনজনে পেট ভরে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। শরীয়তপুরে আমার এক ভাই থাকেন জানতাম। তিনি সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করে ফার্নিচারের দোকান দিয়েছেন। কিন্তু এই অন্ধকারে নির্দিষ্ট ঠিকানা না জেনে তাকে খুঁজতে যাওয়া সমীচিন মনে হোলনা। আমরা বরিশালের পথেই যাত্রা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করে ভীষণ ভাল লাগল। ছোট্ট ছিমছাম শহর, চুপচাপ গোছালো বাড়ীঘর। চারিদিক থেকে ঝিঁঝিঁর শব্দ আর আমাদের পাশাপাশি উড়ে চলা জোনাকির ঝাঁক আমাদের সঙ্গ দিতে লাগল। বরিশাল প্রবেশ করে মারাত্মক একটা সমস্যার সম্মুখীন হলাম। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঠেলাগাড়ী বোঝাই করে টিন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। না ঠেলাগাড়ীতে আছে কোন আলোর ব্যাবস্থা, না টিনের ধার থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য কোন আচ্ছাদন। মটরসাইকেলে সামনে পেছনে আলোর পাশাপাশি হাতে বড় টর্চ জ্বালালাম যাতে আমরা তাদের দেখতে না পেলেও অন্তত তার আমাদের দেখে আওয়াজ দেয়। মাইলের পর মাইল এভাবে পিঁপড়ার গতিতে সাবধানতার সাথে পার হওয়াটা ছিল ধৈর্য্যের চরম পরীক্ষা। শেষপর্যন্ত আমরা গৌরনদী এসে আলোর দেখা পেলাম। গৌরনদী আব্বাদের আদিবাড়ী। পরিকল্পনা ছিল গৌরনদী রাত কাটিয়ে সকালে বরিশাল রওয়ানা দেব। কিন্তু তখন রাত আটটা। এই অন্ধকারে অচেনা পথে যেতে সাহস হোলনা। বরং হাফিজ সাহেব আমাদের এক নির্জন দোকানে বসিয়ে গৌরনদীর বিখ্যাত মিষ্টি এবং দই খাওয়ালেন। আমি মিষ্টির সমঝদার খাদিকা। বলাইবাহুল্য মিষ্টি খেয়ে খুশী হয়ে গেলাম! এবার গন্তব্য বরিশাল শহর। শিকারপুর ফেরী থেকেই পরিচিত জনদের দেখা মিলতে লাগল। মিষ্টি খেয়ে, তদুপরি সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। রাদিয়া আমার কোলে ঘুম দিয়েছে। চোখ খোলা রাখা মুস্কিল হয়ে পড়ল। হাফিজ সাহেব বাচ্চাদের মত এটাসেটা দেখিয়ে আমাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা এবং মটরসাইকেল চালানো দু’টোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে গিয়ে হিমসিম খেতে লাগলেন। বরিশাল শহরে প্রবেশ করলাম রাত দশটায়। রাত প্রায় সাড়ে দশটায় পৌঁছলাম আব্বার বাবার তৈরী বাড়ীতে। কিন্তু তখন আমার মাথায় ঘুম ছাড়া আর কিছু নেই। ঐ বাড়ীতে তখন থাকেন আমার চতুর্থ চাচাশ্বশুর। অল্প কিছু আত্মীয়স্বজন তখনো অপেক্ষা করছে আমাদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প শুনতে। সৌভাগ্যবশত তাঁরা তখন খুব একটা আলাপের মধ্যে গেলেন না। খেয়ে, নামাজ পড়ে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল যে আমরা একটানে চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল এসে পৌঁছেছি! পরদিন বরিশাল শহরে বিভিন্ন আত্মীয়বাড়ী ঘুরলাম। কাউকে দেখেছি চট্টগ্রাম বাসায়, কাউকে বিয়ের দিন, কাউকে কখনোই দেখিনি। সবাই জানতে চান আমাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছিল পথে যেসব এলাকা অতিক্রম করেছি সেখানে বাড়ীঘরের উপাদান এবং আকৃতির পরিবর্তন। চট্টগ্রামের দিকে ব্যাপক শিল্পায়ন এবং প্রচুর লোকজন বিদেশে চাকুরীরত থাকায় লোকজনের অবস্থা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। তাই বাড়িঘর অপেক্ষাকৃত স্থায়ী উপাদান দিয়ে তৈরী যেমন ইট, সিমেন্ট ইত্যাদি এবং ঘরের আকৃতিও বড় ধরণের। নিতান্ত দরিদ্র যারা তারাও পাহাড় থেকে মাটি এবং ছন এনে মজবুত আর বড় চালবিশিষ্ট ঘর বানায়। যতই পাহাড় থেকে দূরে এসে পড়েছি ততই টিন, বাঁশ, কাঠের তৈরী বাড়ী দেখতে পাচ্ছিলাম। অধিকাংশই ছোট এবং অধিক চালাযুক্ত। এদিকটায় দেখলাম তেমন ইন্ডস্ট্রিয়ালাইজেশন হয়নি। কলকারখানার সংখ্যা কম হওয়ায় এদিকে কর্মসংস্থান কম। এর কুফল হোল অধিকাংশ লোকজন জীবিকার তাগিদে অন্যান্য জেলার দিকে পাড়ি জমায়। সুফল হোল প্রয়োজনের তাগিদে এদিকে লোকজনের লেখাপড়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ। কলকারখানা না থাকায় পরিবেশ অনেক পরিচ্ছন্ন, পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীও পরিবেশ রক্ষায় সচেতন। দ্বিতীয় দিন আমরা ছোট্ট একটা ব্যাগে অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চাখারের উদ্দেশ্যে, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বাড়ী। এত আকর্ষনীয় একটি স্থানে গিয়ে বুঝতে পারলাম কেউ কিভাবে নিজের দেশকে এত ভালবাসতে পারে। প্রকৃতির এই উদার সৌন্দর্যের মাঝে যার বেড়ে ওঠা সে কিভাবে মূহূর্তের জন্যও দেশকে, দেশের মাটিকে ভুলে থাকতে পারে? নিজেকে সৌভাগ্যবতী বোধ করলাম যে তাঁরই নাতনী এই সৌন্দর্য বুনে দিয়েছিলেন আমার বিয়ের ড্রেস প্রস্তুত করার সময়। কাছেই মাধবপাশা যেখানে এক সহৃদয় জমিদারমাতা তাঁর পুত্রের কাছে আবদার করে জনস্বার্থে এক বিরাট দীঘি খনন করিয়েছিলেন। সেই দীঘির স্ফটিকস্বচ্ছ জলে পা ভিজিয়ে, চারপাশের প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে করতে ভাবছিলাম একসময় বাংলার মানুষ ভাবত আমি জনগণের জন্য কি করতে পারি? আর এখন আমাদের দেশের জন্য ভালোবাসার চাইতে নিজের জন্য ভালোবাসাটাই মনে হয় মূখ্য। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঐ শীতল সরোবর থেকে পা ওঠাতে হোল। রওয়ানা দিলাম গৌরনদী। হাফিজ সাহেব আর আমার দিকজ্ঞানের একট মজার কম্বিনেশন আছে। আমি খোলা মাঠে বা হাইওয়েতে খুব ভাল দিক নির্ণয় করতে পারি কিন্তু গলিতে ছেড়ে দিলে আমি চরম অসহায়। আর হাফিজ সাহেব ঠিক উলটো। উনি গলিপথের রাজা কিন্তু খোলা জায়গায় উনি কিছুতেই পথ খুঁজে পান না। জীবনে প্রথমবার এসে তাই আমিই ওনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম ওনার দাদাবাড়ী! সত্যি বলতে আমার যদিও এই প্রথমবার এদিকে আসা, ওনার নিজেরও মাত্র দ্বিতীয়বার। কেননা দাদা বলেছিলেন তাঁর ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে গ্রামের জমিতে কেউ ভাগ পাবেনা। এই সাংঘাতিক সাবধানবানী সত্ত্বেও কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে বিরত রইলেন না। গ্রামের জমি জনস্বার্থে দান করা হয়ে গেল। আব্বা এবং চাচারা মিলে ঐ জায়গায় মসজিদ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। ঐ মসজিদের কেয়ারটেকার কি’না হাফিজ সাহেব! আমি তো হেসেই খুন! জিন্সপরা কেয়ারটেকার! দাদার বাড়ী বারপাইকা গ্রামে। ছোট্ট ছিমছাম গ্রাম। গ্রামের এক কাকা আমাদের সাথে চট্টগ্রাম থাকেন বহু বছর যাবত, আমাদের পরিবারেরই একজন, তাঁর বাসাতেই ঊঠলাম। খানিক জিরিয়ে নিয়ে দাদুকে নিয়ে ধানক্ষেত দেখতে গেলাম। গ্রামের মহিলাদের স্ট্যামিনা দেখে আমি হতবাক। ধানক্ষেত বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। আমি হাঁটতে খুব পছন্দ করি, তবুও ফিরে আসতে আসতে কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপাচ্ছিলাম! অথচ দাদু আর তাঁর প্রতিবেশিনি এই বৃদ্ধ বয়সেও হন হন করে হেঁটে চলেছেন। এতদিন পর মসজিদের কেয়ারটেকারকে পেয়ে গ্রামের আত্মীয়স্বজন কিছুতেই আমাদের পরিকল্পনামাফিক বরিশাল ফিরে যেতে দিলেন না। আমাদের ঐ এক কাপড়েই সারাদিন তো বটেই সারা রাতও কাটাতে হোল! এমনকি সকালে ঈদের নামাজও পড়তে হোল ঐ কাপড়েই। কিন্তু ভালবাসা এমন জিনিস যা অস্বীকার করা যায়না! বরিশালের একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখেছি, সর্বত্র উন্নতমানের স্যানিটেশন ব্যাবস্থা। এইটুকু গ্রামেও দেখলাম যতগুলো ঘর তার চেয়েও বেশী বাথ্রুম! অথচ এর একটিতেও আমার কন্যা যাবেন না, আবার মানুষের সামনে পটিতেও বসবেন না। এখানে আমি নির্জনতা কোথায় পাই? পরে মেয়ে দেখলাম বাবার সাথে কোথায় যেন গিয়ে টয়লেট সেরে আসল কিন্তু দু’জনের একজনও বলেনা কোথায়। শুধু বলে, “খোলা টয়লেট”! পরদিন গ্রামের আত্মীয়স্বজন আমাদের প্রথম আগমন উপলক্ষ্যে রাদিয়াকে কাপড় আর আমাকে সোনার চেন দিয়েই ছাড়ল। ভীষণ লজ্জা লাগছিল যে এই আতিথেয়তার প্রতিদান দেয়ার মত কিছু করার সাধ্য আমাদের নেই! বিদায় নেবার সময় মটরসাইকেলে উঠব বলে রাদিয়াকে কোলে নিয়েছি, সে মসজিদের পাশে মাঠের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল, “ঐ যে আম্মু। খোলা টয়েলেট”। আহারে কন্যা আমার! এতগুলো ভাল বাথ্রুম ফেলে শেষে কি’না মাঠের মধ্যখানে! বরিশাল ফেরার পথে এক ভাবীর বাসায় ঢুঁ মারলাম। উনি আমাদের বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকেন, ঈদে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছেন। তাঁরা বস্তা ভর্তি করে গাছ থেকে নারকেলসহ নানাবিধ ফলফলাদি পেড়ে দিলেন। আমরা কিছুতেই নেবনা, তাঁরাও সমান নাছোড়বান্দা! কি আর করা? বস্তা বেঁধে নিলাম মটরসাইকেলের পেছনে। বরিশাল এসেই চাচীকে উপহার দিয়ে রাতে তাঁদের টেনশনে রাখার প্রায়শ্চিত্ত করলাম। জানতে পারলাম আমি এই পরিবারের প্রথম বৌ যে গ্রামের বাড়ী ঈদ করেছে। এমনকি দাদুও কোনদিন বারপাইকা ঈদ করেননি। তাই আমরা যখন ফিরলাম না তখন তাঁদের ঘুম হারাম হয়ে গেল! এর সাজাস্বরূপ আরো একদিন বরিশালেই অবস্থান করতে হোল। পরদিন আমরা রওয়ানা দিলাম কুয়াকাটা। পথে প্রথমে পটুয়াখালী ফেরী পাড় হয়ে আমতলী, সেজমামীর বাপের বাড়ী। তাঁর বাবা এককালে জমিদার ছিলেন, পরে বাবা ভাই উভয়েই এলাকার এম পি হন। নানু এবং এক মামা ঘরে ছিলেন। মামার সাথে পুরাতন জমিদারবাড়ী, পুকুরঘাট ইত্যাদি দেখে এসে দেখি নানু ততক্ষণে দুপুরের খাবার প্রস্তুত করে ফেলছেন। তৃপ্তি সহকারে খেলাম। তারপর আবার পথে নামলাম। আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি কিন্তু কুয়াকাটার মত এত ভাঙ্গাচোরা রাস্তা কোনদিন দেখিনি। তিনঘন্টার রাস্তা গর্ত এড়িয়ে পাড় হতে লেগে গেল পাঁচ ঘন্টা। পথে এক মসজিদে আসর নামাজ পড়ে নেয়ায় রক্ষা। গিয়ে সুর্যাস্ত পেলাম না। সেজমামীর এক ভাইয়ের কুয়াকাটায় আধুনিক হোটেল আছে। মামার হোটেলেই উঠলাম। আমাদের জন্য সবচেয়ে ভাল রুমের ব্যাবস্থা করা হোল। ভ্রমণের ক্লান্তির পর অতিরিক্ত আরামে সুর্যোদয় দেখতে যাওয়ার চেয়ে বিছানাই শ্রেয় মনে হোল। ফলে সুর্যোদয়ও মিস! একটু বেলা করে নৌকাভ্রমণে বের হয়ে 'ফাতরার বন' নামে সুন্দরবনের একাংশ দেখে এলাম। মূলত কিছু ম্যানগ্রোভের ঝাড় ছাড়া দেখার মত কিছুই ছিলোনা। লাভ হোল এই যে সামুদ্রিক আবহাওয়া আর রোদে কয়েকঘন্টায় আমাদের সবাই কয়েকপোঁচ কালো হয়ে গেলাম। তারপর দেখতে গেলাম শুটকীপল্লী। শুটকীপল্লীর লোকজন মূলত জেলে। এই জেলেরা মৌসুমে আসে, সাগরপাড়ে ঘর বেঁধে শুটকী করে। অফসিজনে সব গুটিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। এখানে যে পরিমাণ হাঙ্গর এবং রে জাতীয় মাছের শুটকী দেখলাম তাতে আতঙ্কিত বোধ করলাম হয়ত অচিরেই এই অঞ্চলের সাগরে এই প্রজাতিগুলো বিলীন হয়ে যাবে। হোটেলে ফেরার পথে হোটেলের অনতিদুরে একটি অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম। জানতে পারলাম এটি চালান একজন সমুদ্রবিজ্ঞানী। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এই রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছেন। তিনি জানালেন আমাদের আশঙ্কা সঠিক। তিনিও বিলীয়মান প্রজাতিগুলো নিয়েই গবেষনা করছেন। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে তিনি পরামর্শ দিলেন স্থানীয় মলমা মাছ খেতে। আমি রূপচাঁদা রেখে আর কোন মাছ খেতে রাজী না। কিন্তু হাফিজ সাহেব সর্বদা নতুন খাবার নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করেন। তিনি মলমা মাছ অর্ডার করলেন। খাবার পর মুখ বেজার করে বললেন চট্টগ্রামের অতি পরিচিত বেমজা মাছ পোয়া এখানে এসে মলমা নামধারণ করেছে! আমি তো হাসতে হাসতে অস্থির! দুপুরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকালে বের হয়েছি বরিশাল ফেরার উদ্দেশ্যে। মূল রাস্তার দিকে যেতেই এক বিশাল গাড়ীবহর আমাদের পথরোধ করল। হঠাৎ গাড়ির জানালায় চোখ পড়তেই দেখি অবিশ্বাস্য কান্ড! আম্মার খালাত বোনেরা সব সপরিবারে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা এসেছে ছুটি কাটাতে! ওরাও আমাদের দেখে হতবাক! কেউ বিশ্বাস করবেনা বলে খালারা আমাদের দাঁড় করিয়ে ক’খানা ছবি তুলে রাখলেন। তাঁরা বেশ রসিক, বললেন, “তিন ঘন্টার রাস্তা নয় ঘন্টায় এসেও আমাদের শরীরের নাটবল্টু সব খুলে গেল! তোরা সাবধানে যাস”! আসার সময় খানাখন্দ মুখস্ত করতে করতে আসায় যাবার সময় কোন অসুবিধা হোলনা। রাদিয়া বাইকে উঠেই আমার দিকে ফিরে ঘুম, উঠল পরদিন সকালে। কিন্তু পটুয়াখালীর রাস্তগুলো এমন যে রাস্তার দু’পাশে ধানক্ষেত, বহুদুর ভেতরে গ্রাম, মাইলের পর মাইল কোন দোকানপাট পর্যন্ত নেই! হু হু বাতাস বইছে। রদিয়াকে উষ্ণ রাখতে গিয়ে আমি নিজে শীতে জমে হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাবার জোগাড়। এক পর্যায়ে হাফিজ সাহেব বাইক থামিয়ে ওনার লেদার জ্যাকেট খুলে রাদিয়াসহ আমাকে পরিয়ে দিয়ে নিজে সোয়েটার পরে নিলেন। আশ্চর্যজনকভবে সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার পথে, জমে যেতে যেতে যে কথাটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তা হোল, “আহা! এত ভয়ানক সুন্দর চাঁদ জীবনে কমই দেখেছি!” আমার মনে হয় মাঝে মাঝে মাথায় পাগলামী চাপে! বরিশাল পৌঁছলাম রাত বারোটায়। পথেই নামাজ পড়া হয়ে গিয়েছিল। তাই পৌঁছেই কম্বলের তলায় ঢুকে ঘুম! দু’একদিন বরিশাল কাটিয়ে এবার আম্মার বাপের বাড়ি ধুলিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পথে পটুয়াখালি ফেরীসহ তিনখানা ফেরী। গ্রামের দিকে যাবার পথে দেখলাম হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে দেখানো ধুলিয়া গ্রামের হারানো ছেলে নরওয়েবাসী মোতালেবের প্রজেক্ট। বেচারার বাবামা একসময় নানার জমিতে কাজ করতেন। সে আজ গ্রামের উন্নয়নের জন্য প্রজেক্ট করছে দেখে ভাল লাগল। ছোটখাট করে শুরু করলেও বুঝলাম এই প্রজেক্টের ফান্ডিং এবং সুদুর প্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রামে ঢোকার মুখে এক অদ্ভুত সেতু পেলাম। আমি নিশ্চিত দুনিয়ার আর কোথাও এমন অদ্ভুতরকম খাড়া সেতু নেই! হাফিজ সাহেব পর্যন্ত ভয় পেয়ে আমাদের পদব্রজে সেতু পাড় হতে বলে অত্যন্ত সাবধানে সেতুর ওপর দিয়ে বাইক পাড় করলেন। নানাবাড়ি পৌঁছতে মাগরিব হয়ে গেল। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখলাম না। কিন্তু আশ্চর্য হলাম যে এতবড় গ্রামে মানুষ নেই! সৌভাগ্যবশত আমাদের আসার খবর শুনে বড় মামা মামী গ্রামে অবস্থান করছিলেন। পাশের বাড়িতে এক মামা থাকেন পরিবারসহ। তার পাশের বাড়িতে কেবল এক মামা মামীই থাকেন, তবে ঈদ উপলক্ষ্যে তাঁদের মেয়ে সপরিবারে ফ্রান্স থেকে বেড়াতে এসেছে। এই হোল মোট জনসংখ্যা। আর সব বাড়ি খা খা করছে! চাঁদের আলোয় দেখলাম পুকুরপাড়ে সাদা সিমেন্ট আর মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী মসজিদ থেকে পুকুর পর্যন্ত সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়ির দু’পাশে কমপক্ষে একশ লোকের বসার ব্যাবস্থা। বোঝাই গেল কোন একসময় গ্রামটি জমজমাট ছিল। পরদিন দিনের আলোয় দেখলাম মসজিদের উল্টোদিকে রাতের অন্ধকারে যেটা ঢিবি মনে হচ্ছিল সেটা আসলে পারিবারিক কবরস্থান। আম্মার বাবা এই এলাকার জমিদার ছিলেন। তিনি নিখোঁজ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত গ্রামবাসীদের জন্য অনেক কিছু করেছেন এবং মামা খালারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে একে বর্ধিত করেছেন। মসজিদটি আম্মার উদ্যোগে সংস্কার করা হয়। মামাদের উদ্যোগে ফ্রি ক্লিনিকটি পাকা করে পার্মানেন্ট ডাক্তার রাখার ব্যাবস্থা করা হয়। এক মামা ধুলিয়াতে লঞ্চ ভেড়ার সুবিধার জন্য পাকা ঘাট তৈরী করিয়ে দেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য হোল তাঁদের শিক্ষানুরাগ। ধুলিয়া স্কুলের বিশাল কম্পাউন্ড দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে নানা সেই যুগে এই অজ পাড়াগাঁয়ে বিশাল এলাকা স্কুলের জন্য দান করেছিলেন! ভাল প্রিন্সিপাল এনে যাতে রাখা যায় সেজন্য তিনি হেডমাস্টারের বসবাসোপযোগী একটি আলাদা বাড়ি, পুকুর ও মাঠসহ ঘেরা দিয়ে বড় কম্পাউন্ড নির্দিষ্ট করে দেন স্কুল কম্পাউন্ডের অদুরেই। সব ছেলেমেয়েদের ঢাকায় রেখে পড়াশোনার ব্যাবস্থা করেন। তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলে বড়মামা এই দায়িত্ব পালনে কোন ত্রুটি রাখেননি। মামা পরবর্তীতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এই এলাকার জন্য আরো কাজ করেন। ক্ষমতা এবং টাকাপয়সা থাকলে এভাবেই ব্যাবহার করা যথার্থ। দু’দিন নানাবাড়ী থেকে আবার বরিশাল ফিরে এলাম। শেষবারের মত সব আত্মীয়স্বজনের বাসা চক্কর দিয়ে ফেরার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। তার মধ্যে বরিশালের মিষ্টি নিয়ে যাবার পরিকল্পনা একটি মূখ্য ব্যাপার অবশ্যই। যাবার দিন চাচা ফুপু ঘাটে এলেন বিদায় দিতে। ফেরীতে করে আমরা পৌঁছলাম কাউয়ার চর। বাইকে চরের অন্য মাথায় এসে আরেক ফেরীতে লাহা্র হাট চর। এই চর থেকে ফেরী নিয়ে ভোলা। ভোলায় ফুপুর মেজবৌ, যাকে আমরা মেজভাবী বলি, আমাদের আগমন উপলক্ষ্যে আগের দিনই ভোলা চলে এসেছিলেন। তাঁর বাপের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেলাম। খেয়েদেয়ে ভাবীদের বিদায় জানিয়ে ভোলার অন্যপাড়ে গিয়ে ফেরীতে উঠলাম। গন্তব্য নোয়াখালি। নোয়াখালি ফেরীঘাটে বিশাল বিশাল ট্রাক। আমরা যতই আগে যাবার জন্য ইশারা করি, ট্রাকগুলো হেলেদুলে চলে যায়। শেষে হাফিজ সাহেব বিরক্ত হয়ে এক ট্রাকচালক ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, আপনি কি এতগুলো মাল নিয়ে স্পিডে আমাদের আগে গিয়ে কুলাতে পারবেন? আমাদের আগে যেতে দেন না!” ট্রাকচালক ভাই হতবাক হয়ে বললেন, “আপনিই তো ইশারা করলেন আমাদের আগে চলে যেতে!” আমরা ভাবলাম উনি বুঝি রসিকতা করছেন। খানিক পরে আবিস্কার করলাম ছোট্ট একখানা হাত মটরসাইকেলের সামনে থেকে ট্রাকগুলোকে যাবার ইশারা করছে। বুঝলাম সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কন্যা এই পাকামী করছেন! রাতটা কাটলাম নোয়াখালী রেস্টহাউজে। পরদিন ফিরে যচ্ছি চট্টগ্রাম। কিন্তু মনে মনে ভাবছি, “এই পথ যদি না শেষ হয়...!” হাফিজ সাহেব আমার মনের ভাব বুঝলেন। আমরা গিয়ে ঢুকলাম আই আই ইউ সি কুমিরা ক্যাম্পাসে। তখন মাত্র কাজ শেষ হচ্ছে। আগে সমাবর্তন বা নানা অনুষ্ঠানের জন্য আসা হয়েছে কিন্তু সবসময়ই সহকর্মীদের সাথে। এবার হাফিজ সাহেব আর কন্যাকে নিয়ে এসে ভাল লাগল। জীবনের সবকিছু প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করা না গেলে আনন্দটা কেমন যেন অপূর্ণ রয়ে যায়! ফিরে এলাম চট্টগ্রাম। বারোদিনের ভ্রমণপর্ব শেষ হোল। ফিরে গেলাম কাজে। কিন্তু সেই আনন্দ, সেই ভ্রমণের আলাপ আমাদের উজ্জীবিত রাখল আরো বহুদিন! |
No comments:
Post a Comment