Sunday, December 9, 2012

আমার জীবনে বইমেলা




আমি যখন বেহেস্তের চিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করি আমার মাথায় যে ছবিটা ভেসে ওঠে তা হোল সারি সারি বই- হাত বাড়ালেই উড়ে চলে আসছে হাতের নাগালে, বইয়ের স্তুপের ফাঁকে ফাঁকে চকলেট আর আইসক্রীমের গাছ, কোনরকম কাজকর্ম নেই,খাওয়াদাওয়ার ঝামেলা নেই, দিনরাত শুধু পড়া আর পড়া! একেক বইয়ের একেকরকম রঙ, একেকরকম গন্ধ, কোন বই পড়লে যাচাই করে নিতে পারব বিজ্ঞানীদের কল্পনা আর ডাইনোসরদের আসল চেহারা স্বভাবে মিলামিল, কোনটায় থাকবে আদম (আ)এর বেহেস্ত থেকে পৃথিবী যাত্রার হরর কাহিনী, কোন বই পড়লে জানতে পারব পিরামিড আর মমি তৈরীর বৈজ্ঞানিক সত্য, কোনটাতে থাকবে আদ জাতির পাহাড় কেটে প্রাসাদ বানাবার থ্রিলিং কাহিনী, কোনটাতে থাকবে সুলায়মান (আ)এর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীসমূহ, পৃথিবীর সব অজানা রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব এই বই পড়ে!





এই চিত্রটার কিঞ্চিত ছায়াসদৃশ দেখতে পেতাম বইমেলায়। তাই ছোটবেলা থেকেই বেরাতে যাবার জন্য আমার প্রিয় জায়গা ছিল বইমেলা আর লাইব্রেরী। দু’টোর মধ্যে পার্থক্য এই যে একটাতে বইয়ের দাম দিতে হয় আরেকটাতে লেট ফাইন, একটাতে নতুন বই আরেকটাতে পুরোনো। ছোটবেলায় যখন মায়ের হাত ধরে বইমেলায় যেতাম মনে হত প্রতিটি স্টল থেকে সবগুলো বই কিনে ফেলি! সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূতের গল্প থেকে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী পর্যন্ত কোনকিছুতে আগ্রহের কমতি ছিলোনা। তাই বই কিনতে গিয়ে হিমসিম খেতে হত কোনটা কিনব আর কোনটার মায়া ছেড়ে দেব। যখন আবুধাবী চলে গেলাম, যে বছর বইমেলায় দেশে আসতে পারতাম না আমার দাদার ছোট দুই ভাইবোন, ছোটদাদা আর ভালদাদু, কিনে পাঠাত হরেকরকম বই। এই বইয়ের মাঝে মাঝেসাঝে এমনভাবে হারিয়ে যেতাম যে একবার মা ডাকতে ডাকতে সাড়া না পেয়ে আমার রুমে এসে আবিস্কার করল যে আমি আলমারী গুছানো অসমাপ্ত রেখে একটা বইয়ের ভেতর হারিয়ে গেছি, বইগুলো সব আলমারীর বাইরে ছড়ানো ছিটানো আর আমি আলমারীর ভেতর বসে আছি! রুমের বেহাল দশা দেখে কি যে ক্ষেপেছিল মা, আমার সাধের বইখানা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলেছিল! আরেকবার ভালদাদুর সাথে বইমেলায় গেছি। বাবা তিনহাজার টাকা দিয়েছিল। কিন্তু সে টাকা চোখের নিমিষে শেষ। অথচ কত বই তখনো চোখের সামনে আমাকে প্রলুব্ধ করছে! আমার ফুপাত বোন পরামর্শ দিল দাদুর কাছ থেকে টাকা ধার নিতে। আমি একহাজার একহাজার করে তিনবার ধার নেয়ার পর আমার হুঁশ হোল কি করছি। বাসায় এসে বাবাকে বললাম, বাবা বলল সমস্যা নেই, ওদিকে দাদু ততক্ষণে আমার আগ্রহে খুশী হয়ে ঐ বইগুলো আমাকে গিফট করে দিয়েছে! কি যে মজার ছিল সেই দিনগুলো!





তখন বাংলাদেশে শিশুতোষ সাহিত্য লেখার লোক ছিলেন এখনকার চেয়ে অনেক কম। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ছিল তাই প্রিয় লেখক ছিলেন আবদুল্লাহ আল মুতী। তবে আমার ছোটবেলাটা ছিল অনেকটাই উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার-সত্যজিত রায় আর রাশিয়ান সাহিত্যিকদের দখলে। ভাল লাগত টলস্টয় আর বিশ্বসাহিত্যের বড় বড় দিকগজদের লেখা। আর্কিমিডিস আর গ্যালিলিওদের ভিড়ে জগদিশ বোসের নামটা দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠত, হোমারের ওডিসির সাথে বিশ বছর সমুদ্র পাড়ি দিতাম, তাপসী রাবেয়ার সাথে রাত জেগে নিজেকে প্রবোধ দিতাম কবরে গেলে ঘুমোবার অনেক সময় পাওয়া যাবে এখন কেবল জ্ঞানতপস্যা, রাসূল (সাঃ)এর মহানুভবতায় হারিয়ে যেতাম, গর্জে উঠতাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কিংবা গ্রীক বীরদের সাথে লড়তাম বীর বিক্রমে। আজকালকার সাহিত্যে কেন যেন সেই স্বাদ আর পাইনা, অধিকাংশ সাহিত্য এখন কেবল সাময়িক আনন্দদানের উদ্দেশ্যে লেখা হয়। সস্তা কিছু কথাবার্তা, মূল্যহীন কিছু আবেগ হয় উত্তেজনার খোরাক। কালজয়ী সাহিত্য পাওয়া যায় খুব কম। সাহিত্যে এখন মেসেজ থাকে কমই, ভাষাশৈলীর দিক থেকেও এখন সাহিত্য সর্বনিম্ন মানে অবস্থান করছে। এ’ ধ্বস কেবল বাংলা সাহিত্যে নয় বরং বিশ্বব্যাপী সাহিত্যের মান হ্রাস পাওয়ার অংশ হিসেবেই এটি বাংলা সাহিত্যে অনুপ্রবেশ করেছে। তবু বই পড়তে ভালবাসি, তাই বই কিনি, তাই বইমেলাকে তীব্রভাবে মিস করি।




যখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, ভর্তি হই একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। ঐ স্কুলের আরব ছেলেমেয়েদের দেখতাম তারা একটি মূহূর্ত সময়ও নষ্ট করতনা, স্কুলবাসে যাওয়া আসার পথে ওরা ছোট্ট পকেটসাইজ কুর’আন পকেট থেকে বের করে পড়ত, টিফিন ব্রেকেও অনেকে খেলার পরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে মাঠের একপাশে বসে কুর’আনের বিভিন্ন সুরা মুখস্ত করত। পদ্ধতিটা অত্যন্ত ভাল লেগে যায়, তারপর থেকে আমি যেখানেই যেতাম সাথে বই রাখতাম যেন বসে বসে সময় কাটেনা বলে হা-পিত্তেশ করার চেয়ে সময়টা ভাল কোন কাজে লাগান যায়। বাংলাদেশে ফিরে দেখলাম এতে সবাই ‘আঁতেল’, ‘পন্ডিত’ ইত্যাদি নামে ডাকা শুরু করল, অনার্সে মৌখিক পরীক্ষার জন্য বন্ধুরা ইংরেজী চর্চা করতে গেলে সবাই হাসাহাসি করত ‘জাতে উঠতে চায়’! জ্ঞানচর্চার প্রতি এই তীব্র বিতৃষ্ণায় আমি খুব অবাক হতাম, আমি এসব কানে নিতাম না বটে তবে অনেককেই দেখেছি জাত রক্ষা করার জন্য মাঠে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে জীবনের মূল্যবান সময় উড়িয়ে দিতে।




সেদিন এক ব্লগার ভাই দুঃখ করে বলছিলেন আগের দিনের লেখকদের একত্রে ৪০০০/৫০০০ বই বের হত, সব বিক্রি হয়ে যেত আর এখন ৫০০ বই ছাপালেও চলেনা! মজার ব্যাপার হচ্ছে আগের তুলনায় এখন আমাদের শিক্ষিতের হার বেড়েছে বৈ কমেনি। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে জাতি হিসেবে আমাদের জ্ঞানতৃষ্ণা কতটুকু! আবার এটাও বলা যায় যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই বাজারে যেখানে মানুষ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করতেই হিমসিম খাচ্ছে সেখানে বই কিনে পয়সা নষ্ট করবে কে, তাইনা? তবে কথাটা ঠিক নয়, কারণ এই বাজারেই বিক্রি হয় লক্ষ টাকা দামের শাড়ী, হাজার হাজার টাকা দামের ইমিটেশনের গহনা, বিশাল স্ক্রীণের টিভি, গান শোনার স্টিরিও সেট থেকে লক্ষ টাকা দামের মোবাইল ফোন, কোটি টাকা দামের গাড়ী! সুতরাং একে পয়সার অভাব না বলে জ্ঞানতৃষ্ণার অভাব বলাটাই শ্রেয়! একসময় মানুষ উপহার দিত বই কিন্তু এখন আর এত কম দামের উপহারে মানুষের মন ভরেনা। একসময় মানুষ ঘর সাজাত বই দিয়ে, আজকাল এমন ঘরও ভুরি ভুরি যেখানে দামী শোপিস থেকে ফার্নিচার কোনকিছুরই অভাব নেই কিন্তু পুরো ঘরে একখানা বইও পাওয়া যায়না। এর পরিণতি কি তা সহজেই অনুমেয়- এক বিশাল সার্টিফিকেটধারী জনগোষ্ঠী যাদের কাছে বইয়ের বা জ্ঞানের কোন মূল্য নেই। চিত্রটা কিছুতেই আমার কল্পিত বেহেস্তের সাথে মেলাতে পারিনা।

No comments:

Post a Comment