টেলিভিশনে দেখেছি, গল্প শুনেছি কিংবা বইয়ে পড়েছি অনেক কিন্তু গতকালই প্রথম সরাসরি নিজের চোখে দেখলাম। আমাদের মসজিদে জুমার নামাজের পর এক শ্বেতাঙ্গ ক্যানাডিয়ান ইসলাম গ্রহণ করলেন। ইমামের সাথে প্রথমে আরবীতে এবং অতঃপর ইংরেজীতে শাহাদাহর বাক্যগুলো উচ্চারণ করলেন। সাথে সাথে পুরো মসজিদ আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হোল। নবাগত মুসলিম ভাইটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ইউসুফ এস্টেস সাহেব একবার এক ব্যাক্তির শাহাদাহ কবুলের পর ব্যাখ্যা করলেন, কোন ব্যাক্তি যখন সত্যকে গ্রহণ করে তখন তার হৃদয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে করুণাধারা বর্ষিত হয় সে কারণেই তার দুচোখ প্লাবিত হয়, এর দ্বারা তার অতীতের সব পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। হয়ত তাই শুধু তিনিই নন বরং যে ভাইরা তাকে জড়িয়ে ধরে নতুন জীবনের আহ্বান জানাচ্ছিলেন তাদের চোখেও অশ্রু বাঁধা মানছিলোনা।
কি আশ্চর্য, একটু আগেও যিনি আমাদের কাছে আর দশজন শ্বেতচর্ম ব্যাক্তি থেকে আলাদা কিছুই ছিলেন না তিনিই মাত্র কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করে বনে গেলেন পৃথিবীব্যাপী রঙবেরঙের কোটি কোটি মানুষের ভাই! এখন তিনি পৃথিবীর যেখানেই যাবেন সেখানেই পাবেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ‘আসসালামু আলাইকুম’ অভিবাদন, সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসবে সাদা কালো লাল হলুদ আরো কত রকম মানুষ, আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন পৃথিবীর নাম না জানা কোন প্রান্তরের নাম না জানা কোন চেহারার সাথে শুধু এ কারণে যে তারা দু’জনেই বিশ্বাস করেন এবং বলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’!
ভাবছিলাম তাদের কথা যারা জীবনটাকে সাগরপাড়ে হাওয়া খেতে যাবার মত সহজ এবং লক্ষ্যহীনভাবে যাপন করে। এ’ধরণের মনোভাব আপাতদৃষ্টে আকর্ষনীয় মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এইভাবে যাপিত জীবনের ফলাফল শূন্য। প্রতিটি কাজের পেছনেই কোন না কোন কার্যকারণ থাকা চাই, নইলে সে কাজ করার পেছনে কোন স্পৃহা বা অনুপ্রেরণা কাজ করেনা। সেক্ষেত্রে এমন ধারণা করে নেয়া কতটা যুক্তিগ্রাহ্য যে আমরা যে নিজেদের এই পৃথিবীতে দেখতে পাচ্ছি যেখানে আসার বা যেখান থেকে যাবার পেছনে আমাদের কোন হাত নেই এর পেছনে কেউ দায়ী নয় এবং আমাদের এখানে কোন দায়দায়িত্ব নেই? গোটা একটা জীবন এভাবে লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীনভাবে কাটিয়ে দেয়া কতটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে? মানুষ স্বভাবতই মুনাফাপ্রিয়। তাই সে প্রতিটি কাজের পেছনেই লাভ খোঁজে। অথচ অসংখ্য মানুষ নিজের জীবনটাকেই সবচেয়ে নিরর্থক শূন্যতায় সমাপ্ত করে। এই সক্ষম শরীর, এই মেধাবী মস্তিষ্ক, এই কোমল মন, এই চিন্তাশীল মনন যদি অন্য কোন প্রাণীকে দেয়া হত তারা হয়ত সত্যানুসন্ধানকেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিত যেমন নিয়েছেন আমাদের উপরোক্ত ভাইটি।
যখন লোকজনকে দেখি দু’কানে দু’খানা ইয়ারফোন লাগিয়ে পুরো পৃথিবীটাকে ভুলে থাকে তখন খুব আশ্চর্য লাগে তারা যে পৃথিবীতে বসবাস করেন সেই পৃথিবীর আসল শব্দগুলোর সাথেই তারা পরিচিত হবার সুযোগ পান না- পাখির কুহুতান, নদীর কলতান, সুমুদ্রের গর্জন, পাতার সরসর, জীবনের উচ্ছ্বাস, বেদনার দীর্ঘশ্বাস, বাতাসের হাহাকার সব সবকিছু চাপা পড়ে যায় গান নামে কিছু অহেতুক অনর্থক চিৎকারের কাছে। দিনরাত টিভি, গেম, আইফোন, আইপ্যাড আর ট্যাবলেটের রঙ্গিন চশমা পরে পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা এই মানুষগুলো- মানুষের দুঃখ, মানুষের আনন্দ, শিশুদের সারল্য, স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য, রংধনুর রঙ, কিছুই দেখতে পায়না, কিছুই তাদের চশমার স্তর ভেদ করে হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনা। সমস্যা হোল, জীবনের উদ্দেশ্যবিমুখ এবং জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ এই মানুষগুলো যখন জীবনের মুখোমুখি হয় তখন আরো অনেক সাধারন মানুষের তুলনায় এরা জীবনের ব্যাখ্যা করতে ব্যার্থ হয় এবং জীবনের কাছে হেরে যায়। যারা নিজের জন্যই কিছু করতে পারেনা তারা অন্যের জন্য করবে কিভাবে?
এভাবে নিজের যোগ্যতার অবমূল্যায়ন করা এবং মূল্যবান সম্পদের অপব্যায় করা ক্রিমিনাল অফেন্স হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাই হয়ত আল্লাহ বলেছেন কিয়ামতে দিন যেখানে তিনি সত্যানুসন্ধানীদের সালাম সহকারে স্বাগত জানাবেন সেখানে এদের বলবেন, ‘হে অপরাধীরা, আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও’ (সুরা ইয়াসীনঃ আয়াত ৫৯)।
পৃথিবীর কোটি কোটি কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী থেকে সাধারন মানুষ- চিন্তাশীল ব্যাক্তি মাত্রেই এই সত্যের অনুসন্ধান করেছেন। কেউ খুঁজে পেয়েছেন, কেউ কাছাকাছি এসেও নিরাশ হয়েছেন, কেউ পাননি, কেউ পেয়েও বরণ করতে পারেননি। কিন্তু যে সর্বাত্মকভাবে সত্যের অনুসন্ধান করে তার পাবার আকুতি বিফলে যায়না, সে সত্যকে পাওয়ামাত্র জীবনপণ করে আঁকড়ে ধরে সকল বাঁধাবিপত্তি তুচ্ছ করে, সত্য তার কাছেই ধরা দেয়। তাই আল্লাহ বলেন, ‘যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং সে ঈমানদার, পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত’ (সুরা নাহলঃ আয়াত ৯৭)। আমরা সবাই কি এই নবাগত ভাইটির মত পবিত্র জীবন এবং উত্তম পুরষ্কারের দিকে ছুটে যেতে প্রস্তুত?
No comments:
Post a Comment