Sunday, December 9, 2012

ঘরে ফেরা

বাংলাদেশে দীর্ঘ তিনমাসের ছুটি কাটিয়ে আবুধাবি ফিরেছি। বাবার বন্ধু গিয়ে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছেন। বাসার দরজা খুলতেই আমরা দু’ভাইবোন লাফিয়ে ড্রয়িং রুমের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আনন্দে হাত তুলে বলে উঠলাম, ‘আহ! কতদিন পর নিজের ঘরে ফিরে এলাম!’ দেখি বাবা আর তার বন্ধুবর পরস্পরের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আংকেল সুটকেস ঘরে ঢোকাতে ঢোকাতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আহারে! ওরা নিজের দেশ থেকে বিদেশে এসে বলে কিনা ঘরে ফিরে এলাম!’ তখন আমার বয়স এগার আর ছোটভাই আহমদের বয়স পাঁচ। ঘটনার irony তখন আমাদের কাছে স্পষ্ট ছিলোনা।

যখন প্রথম দেশ ছেড়ে আসি তখন আমার বয়স পাঁচ। আমার ছোটবেলার স্মৃতির শেলফে থরে থরে সাজানো আছে জানালা দিয়ে পারস্য উপসাগরের নীল সবুজে মাখামাখি ঢেউয়ের আন্দোলন, বাবার সাথে সাগরপাড়ে মাছ ধরার জন্য বড়শিতে চিংড়ি মাছ গাঁথা, বিশাল মরুভূমির মধ্যখানে ছোট ছোট বাগানগুলিতে ফুলের শোভা পাতার ছাঁটের কারুকাজ আর ফলভারে মাটি থেকে উঠতে না পারা খেজুর গাছগুলোকে জিইয়ে রাখতে মালিদের অক্লান্ত পরিশ্রম, বাগানে বা রাস্তার আইল্যান্ডে ঝর্ণার মাঝে রঙের ফোয়ারা আর ছলছল শব্দ, রাস্তায় সাঁ সাঁ করে চলে যাওয়া রঙবেরঙের মার্সিডিজ আর লেটেস্ট মডেলের দামী দামী গাড়ি, স্কুলবাসের জন্য অপেক্ষায় বা বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে ঘামে চুপচুপে হয়ে ভিজে যাওয়া, আরবী বাচ্চাদের দোলনায় চড়ে আকাশে উড়ে যাবার প্রয়াস, নানান ভাষাভাষীর নানান ভাষার উচ্ছ্বাস আর দীর্ঘশ্বাস, সুকে কচ্ছপ আর হাঙ্গর বিক্রির দৃশ্য, বাজারে লবনে চিনাবাদাম ভাজার গন্ধ, বিফ খাবনা চিকেন শাওয়ার্মা খাব বলে মন খারাপ করা, লাল সবুজ সাদা আর কালো একটি পতাকা আর একটি ভিন্ন জাতীয় সঙ্গীতের সুরের ঝঙ্কার রক্তে মিশে যাওয়া আবার লালসবুজ পতাকা বুকে নিয়ে স্কুলের ব্যান্ডে নিজের জাতীয় সঙ্গীতের লিড দিতে গিয়ে গর্বে বুক ফুলে ওঠা, আর ভোরবেলা ক্রমান্বয়ে আজানের সুমধুর সুর শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার শব্দে জেগে ওঠা। সবচেয়ে বেশি স্মৃতিতে গেঁথে আছে ধু ধু বালুকাময় সমুদ্রতীরটি আস্তে আস্তে বাগানে বাগানে ভরে ওঠা, সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে স্বদেশী আর পর্যটকদের জন্য একটি হাঙ্গরমুক্ত বিনোদন এলাকা রচনা করা, আকাশের মধ্যখানে বিশাল সব ক্রেনের ওঠানামা আর আবুধাবির সতত পরিবর্তনশীল চেহারার মাঝে শেখ জায়েদের সদিচ্ছা দৃঢ়সংকল্প আর দেশপ্রেমের চিত্র।

একদিন বিকালে সমুদ্রতীরে বসে আছি, সামনে সাগরের ঢেউ আর পেছনে আমার ঘরের জানালা দেখতে পাচ্ছি। তখন আমি ক্লাস নাইনে। আবুধাবির কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট বাগানগুলো শেষপর্যন্ত মরু আবহাওয়ায় পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে, আবহাওয়া ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে আসছে, মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হয়, আরো পরে শুনেছি শীতকাল নামক অচেনা ঋতুর অস্তিত্বও ওখানে সৃষ্টি হয়েছে। তাই তখন আগের তুলনায় অনেক লোকজন সাহস করে প্রয়োজন ছাড়া বিনোদনের জন্যও ঘর থেকে বের হত। পাশ দিয়ে দু’জন যুবক হেঁটে যাচ্ছিল। চাঁটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলতে শুনে কান খাড়া হয়ে গেল। চাঁটগাঁইয়া বলতে অভ্যস্ত না হলেও স্পষ্ট বুঝতাম কারণ বাবামা নিজেদের মধ্যে এবং আমাদের সাথে এই ভাষাতেই কথা বলত। তাদের কথা শুনে বুঝলাম একজনের চাকরীর মেয়াদ শেষ, দেশে ফিরে যেতে হবে বলে সে দিশাহারা বোধ করছে। আর অন্যজন তাকে বৃথাই সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে বন্ধুটি বলল, ‘এত চিন্তার কি আছে? তুমি আজ এতবছর চাকরি করছ, কিছু তো নিশ্চয়ই জমা আছে। তা দিয়ে তুমি কিছু একটা ব্যাবসাপাতি শুরু করলে আরামসে চলতে পারবে’।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যুবক বলল, ‘ভাই, টাকা থাকলে কি আর এত চিন্তা করি?’
বন্ধু বলল, ‘তাহলে তোমার পনেরো বছরের কামাইয়ের পয়সা সব গেল কোথায়?’
‘মায়ের পেটে, বোনের পেটে, আত্মীয়স্বজনের পেটে...’।
‘তাহলে তাদের বল তোমার এই বিপদের সময় সাহায্য করতে’।
‘আহারে ভাই, ওরা সব খেয়ে পেট পরিষ্কার করে ফেলেছে, এখন ওদের ওসব কিছুই মনে নেই, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আমার দুঃখ বোঝার এখন আর কেউ নেই’।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা আমাদের শ্রবণসীমার বাইরে চলে গেল। ওদের কথাবার্তা আমাকে অনেকগুলো স্মৃতির অতলে তলিয়ে দিল।

মনে পড়ল সেই বাংলাদেশী শ্রমিকের কথা যিনি মাসের পর মাস মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে যখন পরাস্ত হলেন, দাফনের জন্য তাঁর লাশ হাসপাতালের বিছানা থেকে তুলতে গিয়ে দেখা গেল দীর্ঘদিনব্যাপী অসুস্থ অনড় থাকায় শরীরের শেষ বন্ধনটিও যখন অবমুক্ত হয়ে গেল তখন প্রাণহীন দেহ থেকে মাংস খুলে চলে আসতে লাগল। শেষে তাকে হাসপাতালের চাদরে মুড়েই কবর দেয়া হয়।

মনে পড়ল গোমেজ আঙ্কেল যখন দেশে যাবার আগে কিছু একটাকা দু’টাকার (দিরহাম) প্লেট কিনে নিলেন আমরা খুব অবাক হলাম। দেশ থেকে ফিরে তিনি গল্প শোনালেন, ‘কাস্টমসের লোকগুলো ব্যাগ খুলে ঝাঁকি দেয় যেন ওপরে যা থাকে তা ওদের টেবিলের ওপাশে পড়ে যায়, ঐ জিনিস তখন আর আপনার ফেরত চাওয়ার কোন উপায় থাকেনা কারণ আপনি জানেন না কি কি পড়ল। আমি তাই ঐ সস্তা প্লেটগুলো বাক্সের ওপরে ওপরে দিলাম যেন ঝাঁকি দিতে না পারে, ঝাঁকি দিলেই প্লেট পড়ে ভাঙ্গার শব্দ হবে। তবু ছাড়াছাড়ি নাই। ওরা দেখে ভাবল এগুলো দামি জিনিস, বলল ট্যাক্স দিতে হবে, মানে সোজা কথায় ওদের ঘুষ দিতে হবে। এই একটাকা দু’টাকার জিনিসের জন্য ট্যাক্স, বোঝেন কান্ড! সোজা বলে দিলাম, ‘ট্যাক্স দেবনা, কি করবেন করেন’। ওরা বলল, ‘তাহলে প্লেটগুলো রেখে যান’। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে’। প্লেটগুলো বের করে কাস্টমসের টেবিলের ওপর রাখলাম, তারপর জুতা খুলে একে একে জুতার বাড়ি দিয়ে ভাঙ্গা শুরু করলাম। অফিসার হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘করেন কি? করেন কি?’ আমি বললাম, ‘আমার জিনিস আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে দেব, আপনার অসুবিধা কি?’’ গল্প করার এই পর্যায় উনি কিছুক্ষণ এয়ারপোর্টের লোকজন এবং বিশেষ করে ঐ ‘অভদ্রলোককে’ গালিগালাজ করে ফুঁসতে লাগলেন, ‘আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিবার পরিজন ফেলে রোগেশোকে ভুগে পয়সা কামিয়ে দেশে পাঠাই যেন আমাদের প্রিয়জনেরা ভাল থাকে, সরকার আমাদের রেমিট্যান্সের টাকায় এই ব্যাটাদের বেতন দেয় আর ব্যাটারা এয়ারপোর্টে আমাদের সাথে কি ব্যাবহারটা করে! কপাল চাপড়াতে ইচ্ছা করে, চোরের দেশে জন্ম আমার! আর আমাদের অথর্ব কবি সাহিত্যিকরা বলে কিনা, ‘এই বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, পৃথিবীর মুখ দেখিতে চাহিনা আর!’’

মনে পড়ে এয়ারপোর্টে দেখা সেই যুবকটির কথা, অবৈধ ভিসায় অবস্থানের দায়ে যাকে ছ’মাস জেল খাটার পর এক কাপড়ে ডিপোর্ট করে দেয়া হয়। হাড়জিরজিরে ছেলেটি আর কিছু আনতে পারেনি, প্লেনে তাকে যে বিস্কিট খেতে দেয়া হয়েছিল সে প্যাকেটটি নিজে না খেয়ে মায়ের জন্য নিয়ে আসছিল। কাস্টমস অফিসার ছেলেটির কাকুতিমিনতি উপেক্ষা করে প্যাকেটটি তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল, ধমক দিয়ে তাকে শূন্যহাতে ভাগিয়ে দিল, তারপর হাসতে হাসতে প্যাকেট খুলে এতগুলো মানুষের সামনে বিস্কিটগুলো মজা করে খেতে শুরু করল।

তবু আমার বাবা দেশকে ভালবেসে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। বন্ধুরা পরামর্শ দিল, ‘চল ক্যানাডা যাই, এখানে যেমন ছিলাম ওখানেও তেমন সবাই একসাথেই থাকব’। দেশপ্রেমিক বাবা বলল, ‘আমি যদি পেটে ভাতে চলতে পারি তাহলে সামর্থ্য না হলে জানালায় লুঙ্গি ঝুলিয়ে পর্দা বানাতে হলেও আমি নিজের দেশেই থাকব’। বাবার রিটায়ারমেন্ট আমাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। তখন আমি এস এস সি পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। দু’ভাই অনেক ছোট।

আবুধাবি থেকে ঢাকার ফ্লাইট ছিল পাঁচঘন্টা। ঢাকা পৌঁছে কাস্টমসে ঘুষ দিতে রাজী না হওয়ায় ট্যাক্সেবল কোন জিনিস না থাকা সত্ত্বেও আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে লাগল আরো পাঁচঘন্টা। বের হতেই অভাবী হাতের ভিড়, প্রত্যেক যাত্রীই দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে স্বদেশের অভাগা মানুষগুলোকে কিছু না কিছু দিচ্ছে, কিন্তু একটি হাতও অভাব পূরণ হয়ে গেছে মনে করে সরে যাচ্ছেনা! ট্যাক্সি নিতে গেলে কেতাদুরস্ত চালক অদ্ভুত ভাড়া হাঁকল, নিরুপায় হয়ে ঐ ভাড়াতেই রাজী হয়ে ঘরে আসতে হোল। দাদুর বাসায় পৌঁছে দেখলাম অন্যান্যবারের মত এবার আমাদের দাদুর বাসায় থাকার ব্যাবস্থা করা হয়নি। চট্টগ্রামে চলে গেলাম আমরা।

বাবার ছিল দরিয়া দিল আর মা’র দরাজ হাত, সবসময় দেখে এসেছি আত্মীয়স্বজন থেকে অপরিচিত লোকজনকে পর্যন্ত নিয়মিত সাহায্য করতে, আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের চট্টগ্রামের বাসার সম্পূর্ণ ফায়দা তারা উপভোগ করত। এবার বাবা সবাইকে জানিয়ে দিল আর বিদেশে যাবেনা, যেহেতু আর আয় নেই, নিজের পরিবারের জন্যই ব্যায়সংকোচন করতে হবে, সুতরাং আগের মত আর সাহায্য সহযোগিতা করতে পারবেনা। তখন এক অদ্ভুত কান্ড শুরু হোল। দুরদুরান্ত থেকে এমন সব আত্মীয়স্বজন এসে হক্ক আদায় করার জন্য পিড়াপিড়ি করতে শুরু করল যাদের আমি তো কোন ছাড়, আমার বাবামাও চেনেনা! তারা নিজ নিজ দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আমাদের বাসায় অবস্থান ধর্মঘট শুরু করল। একপর্যায়ে যখন আর আমাদের দেয়ার কিছু অবশিষ্ট রইলোনা, তখন আমাদের বাসায় সর্বপ্রকার লোকজন আসা বন্ধ হয়ে গেল।

একদিন সরকারী লোকজন এলো ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট করতে। বাবা বলল, 'আমি সৎভাবে জীবনযাপন করতে চাই, সুতরাং সঠিক হিসেব করে যা ট্যাক্স আসে আমি দিয়ে দেব, কিন্তু ঘুষ এক পয়সাও দিতে পারবনা'। ট্যাক্স অফিসার ভদ্রলোক যেতে যেতে বাড়ীর আঙ্গিনায়, অড়বরই গাছটার নীচে বরাবর দাঁড়িয়ে ঘোষোনা দিয়ে গেলেন, আপনি সৎ থাকতে চাইলেও আমরা আপনাকে সৎ থাকতে দেবনা। আপনি কি ভেবেছেন এসব বলে আপনি আমাদের বঞ্চিত করতে পারবেন? আপনি আমাদের টাকা না দিলে আমরা আপনাকে এমনভাবে ফাঁসাব যে তখন আপনি নিজেই এসে আমাদের টাকা দিয়ে যেতে বাধ্য হবেন’। ঠিক একসপ্তাহ পর ঐ লোককে আবার দেখলাম বিটিভিতে, মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর পরিচালিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে- নিজ চোখে না দেখলে বা নিজ কানে না শুনলে টিভিতে উনি যা বললেন তাতে আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করতাম তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে সৎলোক!

এই ধরণের ঘটনাপ্রবাহে বিক্ষিপ্ত হয়ে বাবা একদিন শিকারের বন্দুক নিয়ে গুলি ভরতে শুরু করল, মা প্রমাদ গুনল, তারপর বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাসপোর্টে আমেরিকার ভিসার মেয়াদ আছে দেখিয়ে বাবাকে আমেরিকা পাঠিয়ে দিল। রিটায়ার করার পর একবছরের চেয়েও অল্প সময়ে বাবা আবার জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। তারপর দেশে দেশে ঘুরল আরো পনেরো বছর, কখনো আমাদের নিয়ে, কখনো আমাদের ছাড়া। তন্মধ্যে চারবছর ইন্ডিয়া ছিলাম। প্রতিবেশি দেশ, স্বভাবচরিত্রে অনেক মিল, এটাই স্বাভাবিক। তবে লক্ষ্যনীয় বিষয় ছিল এটাই যে তাদের কিছু কিছু রাজনীতিবিদ সত্যিকার অর্থেই দেশকে ভালবাসে, দেশের জন্য কাজ করে, আর যারা নিজের অবস্থানকে শোষণের জন্য কাজে লাগায় তারাও সমস্ত চেটেপুটে খায়না, জনগণের জন্যও কিছু করে খায়।

ইন্ডিয়া থেকে ফেরার কিছুদিন পর আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর দশবছর দেশে রইলাম, চাকরী করলাম। ভাবতাম আমারই মনে হয় মানসিক সমস্যা, আমিই শুধু ভাবি যে দেশের একাংশ দুর্নীতিগ্রস্ত এবং আরেক অংশ মনে করে সততা ব্যাক্তিগত ব্যাপার তাই তারা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে, সেদেশের কি হবে? দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম এই ভেবে যে এদেশের জনগণের প্রাণশক্তি কর্মশক্তি আর সময়ের অর্ধেক চলে যায় রাস্তাঘাটের জ্যামে, আর অর্ধেক ইলেকট্রিসিটি আর পানির অপেক্ষায়- তাহলে তারা দেশের জন্য ভাববে বা কাজ করবে কখন? প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের হতেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। মোড়ে দাঁড়িয়ে পাড়ার মাস্তানরা ট্যাক্সি ড্রাইভারদের বাধ্য করত তাদের ভেজাল তেল চড়া দামে কিনতে, না নিতে চাইলে আরোহীদের সামনেই মারামারি গালাগালি, কেউ পালিয়ে যেতে সক্ষম হলে পরদিন তার চেহারা আর শরীরের বিভিন্ন অংশের রঙ আর আকৃতির পরিবর্তন হত লক্ষ্যনীয়। চাকরিতে দুর্নীতি, যেকোন কাজে ঘুষ আদায়, প্রাপ্য হতে বঞ্চিত করা ইত্যাদি ছিল ডালভাত। আর প্রচন্ড প্রতিযোগিতার বাজারে যে সৎ থাকতে চায়, তার টাকা না থাকার কারণে বাবামার কাছে পর্যন্ত মূল্য থাকেনা। এই আমাদের জননী, জন্মভূমি, স্বর্গাদপি, গরিয়সী।

আমি হয়ত দুর্বল, বিদেশে বড় হয়েছি, জন্মভূমির অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক ভাবতে শিখতে পারিনি, দেশের কুলাঙ্গার সন্তান- কিন্তু আজন্ম বাংলাদেশে বেড়ে ওঠা হাফিজ সাহেব কেন শ্বাসরুদ্ধ বোধ করতে শুরু করলেন তার জবাব তিনিই ভাল দিতে পারবেন। শেষপর্যন্ত আমরা টিকতে পারলাম না, পালিয়ে এলাম বিদেশে।

তবে যতই জন্মভূমি আর দেশপ্রেমের বুলি কপচাই না কেন, এই পৃথিবীতে আমরা সবাই প্রবাসী। অপেক্ষায় আছি ঘরে ফেরার। যেদিন নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করতে পারব সেদিনই এই জীবনের সার্থকতা বিধৃত হবে, আর কিছুই কোন ব্যাপার নয়।

No comments:

Post a Comment